লৌকিক – অলৌকিক – অলীক মানুষ : উমাপদ কর

[কবি ও গদ্যকার উমাপদ কর বছর আটেক আগে গল্প ও উপন্যাসকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অনন্য উপন্যাস “অলীক মানুষ” নিয়ে চরিত্রভিত্তিক একটি দীর্ঘ আলোচনা তথা গদ্য লেখেন, যা প্রকাশ পায় “বিনির্মাণ” পত্রিকায়। সম্প্রতি অপরজন পত্রিকার তরফে সেই গদ্যটি প্রকাশ করতে চাইলে তিনি পূর্বোক্ত গদ্যটিকে সংযোজন-বিযোজন-বিবর্ধন ইত্যাদির মাধ্যমে পুনর্লিখিত করেন। গদ্যটি দীর্ঘ। লেখকের সম্মতিক্রমে আমরা বেশ কয়েকটি কিস্তিতে (৬-৭) আলোচনাটি প্রকাশ করব ধারাক্রমে প্রতিমাসে। আজ তার প্রথম পর্ব।]

বদুপিরের তিন সন্তান। এক স্ত্রী। সংসারের সব দায় স্ত্রী সাইদার ওপর ছেড়ে তিনি ধর্ম-প্রচারক। প্রচার স্বার্থে অথবা নিজে আঘাত পেলে বারবার ঠাঁইনাড়া, গ্রামের পর গ্রাম। বড় ছেলেকে মৌলবি বানানোর উদ্দেশ্যে পড়তে দেন। সে মৌলবি হয়ও। মেজ ছেলে জন্ম প্রতিবন্ধী। তার প্রতি তিনি কিছুটা উদাসীন। অনেকের অসুখ-বিসুখ দূর করার চেষ্টায় জলপড়া, দোয়া মাঙা দেখা যায়। মন্দ জিন ছাড়াবার কথাও আমরা জানি। কিন্তু ছেলের প্রতিবন্ধীতা নিয়ে তিনি এত উদাসীন কেন বোঝা যায় না। মূল কথাটি জানতেন বলেই কি তাঁর এমন আচরণ? ছোট ছেলেকে প্রথম থেকেই মক্তবে না-পাঠিয়ে পড়তে দেন পাঠশালায়, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে বারুমিয়া শফিকে হরিণমারা স্কুলে ভর্তি করতে চাইলে এক কথায় রাজি হন। একজন ধর্মগুরু নিজ সন্তানকেই নিজ ধারা ছাড়িয়ে অন্য ধারায় মানুষ করতে চাইছেন। এখানে সমসাময়িক বাস্তবতার লক্ষণগুলো দেখা যায়।
খ) ধর্মগুরুর অলৌকিকত্বে জনসাধারণ তাঁকে আল্লাসম জ্ঞান করলেও মৌলানা জানতেন তিনি কী! সম্পূর্ণ রক্তমাংসের মানুষ। তাই ঘর সংসার ছেড়ে মাসাবধিকাল মসজিদবাসে কোনো এক ঝড়ের রাতে তাঁর মনে হয় সাইদার সঙ্গে তার দেখা নেই অনেকদিন। “এ কি করছেন তিনি? বদিউজ্জামান নিজেকে যেন নতুন করে আবিষ্কার করলেন।” নিজেকে ধিক্কারও দিলেন। আল্লাহ স্মরণে এনে ভাবলেন— “তিনি তো সর্বত্যাগী সাধকপুরুষ নন। তিনি ওহাবপন্থী ফরাজি মুসলিম। ইহলোকের সবরকম নৈতিক সুখ উপভোগ করাই তো যথার্থ ইসলাম। ……… পবিত্র কোরাণে আল্লাহ বলেছেন, কৃষক যেমন শস্যক্ষেত্রের দিকে গমন করে, পুরুষ তার নারীর দিকে একই নিষ্ঠা ও প্রেমে অনুগমন করবে……”। সাইদার মাধ্যমে আমরা জেনে নিই মৌলানার প্রকৃতি। “সাইদা অকুণ্ঠিতভাবে দ্রুত স্মরণ করলেন স্বামীর সঙ্গে রাত্রিযাপনের সেইসব তীব্র সুন্দর সময়গুলোকে। বরং তার তো মনে হয়েছে, মৌলানা এসব গোপনীয় শারীরিক ব্যাপারে কি নির্লজ্জ আর প্রবল পুরুষ হয়ে ওঠেন। তাঁকে কদাচিৎ শয্যার পাশে পান বলেই সাইদার মনে যেমন রাক্ষসীর ক্ষুধা জেগে ওঠে, মৌলানাকেও তেমনি মনে হয় ভয়ঙ্কর ক্ষুধার দাউদাউ আগুন।” এ-বিষয়ে বদিউজ্জামানের শাস্ত্রের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দেখবার সময়ও যে ভাবনায় ভাবিত হন তা প্রণিধানযোগ্য। “তবে যা দেখছি, অনেক উঁচুতে উঠে গেলে নিচের লোকদের তত নজর চলে না। অথচ আমার কষ্ট। আমার মনে খাহেস। তসবিহ জপে ভুল হয়।” শারীরিক চাহিদার বাস্তবতা বনাম ধর্মটান এখানে প্রায় সমান।
গ) ধর্মপ্রচারক, সর্বদা ঠাঁইনড়া মানুষ। একসময় তাঁরও মাটির জন্য খাহেস দেখা যায়। মৌলাহাটের ‘এবাদতখানার দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তরে ডাঙা জমিগুলোর মালিক হরিণমারার হিন্দু জমিদার।’ ‘এবাদতখানার চারদিকের মাটি আমার দরকার, কারন এতিমখানা (অনাথ-আশ্রম) আর মেহমানখানা (অতিথিনিবাস) খুলতে চাই’। “আমাকে একটা খোয়াব (স্বপ্ন) আচ্ছন্ন করছে ইদানীং। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা উচিৎ। আর এতিমখানায় বাপ-মা হারা অনাথ ছেলেমেয়েরা থাকবে।” সুতরাং মানুষের মতো তিনিও স্বপ্ন দেখেন এবং সেটা গঠনের স্বপ্ন, যাতে মাটির প্রয়োজন। মাটিটা সম্পূর্ণ নিজের জন্য নয়, বলা যায় নিজের ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য। কিন্তু এও ঠিক তার মধ্যে এই মাটির স্বপ্ন যে তারই স্বভাব বিরুদ্ধতা তাও তিনি জানেন। একদিন তিনি ছড়ির ডগায় খুঁচিয়ে একটু গুঁড়ো মাটি তুলে নেন। খুঁচিয়ে দেখেন আল্লাহর কুদরৎ। মনে পড়ে মাটি দিয়েই আল্লাহ প্রথম পুরুষ আদমকে বানিয়েছিলেন। তার দেহেও এই মাটি। মৃত্যুতে মাটিতেই মিশে যেতে হয়। এই মাটির দুনিয়াও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। এই দুনিয়ার জন্য তাঁর এত মায়া! এত স্বপ্ন! গ্রাস করে হতাশা। আর হাজারো প্রশ্নে নিজে বিদ্ধ হতে থাকেন। “কিন্তু আমি তো কোনোদিন মাটির প্রত্যাশী ছিলাম না। আজ কেন মাটির জন্য এ খাহেস? এতিমখানা, মেহমানখানা, এবাদতখানা। কী অদ্ভুত ঘটনার মধ্যে কয়েদি হয়ে গেছি বা হতে চলেছি ক্রমে ক্রমে। অনিত্য মাটির কথা ভেবেই কি এতদিন মুসাফিরের মতো ঠাঁই বদলে বদলে ঘুরে বেড়াইনি? অথচ আজ আমি এইসব গাছের মত শেকড় বিঁধিয়ে দাঁড়াতে চাইছি।” ভাবনায় নিত্য অনিত্যের দ্বন্দ্ব বাস্তবের মাটিতে এসে প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধিতে খাহেসের পক্ষ নেয়। ফলে তিনিও জমিদারবাবুকে ফারসিতে খত লিখে সিলমোহর মেরে দেন। এখানে ধর্মাচরণের মাধ্যমে ব্যক্তিমুক্তির চেয়ে জনকল্যান প্রাধান্য পায়।
ঘ) বদিউজ্জামান একদিকে ধর্মগুরু ও প্রচারক অন্যদিকে ইংরেজ বিদ্বেষী, আর হিন্দুরা মুসলিমদের যাবতীয় কেড়ে নিচ্ছে বলে মনে করেন। মুসলমানদের একহাতে ইংরেজকে অন্যহাতে হিন্দুদের মোকাবিলা করতে হবে, এই তাঁর অভিমত। তবু শিক্ষা সংস্কারে তাঁর মত আশ্চর্যজনকভাবে অভিনব। দেশের মুসলমানদের হৃত গৌরব পুনুরুদ্ধারে তিনি ভবিষ্যতকে যেন দেখতে পেতেন। শুধুমাত্র শফিউজ্জামানের ইংরেজি-বাংলা পাঠে সম্মতি দেননি। সাধারণে তা বাস্তবায়িত করতেও এগিয়ে এসেছেন। “মসজিদ সংলগ্ন মক্তবটি পুরোপুরি মাদ্রাসা হয়ে ওঠে এবং এর পিছনে হরিণমারার বড়োগাজির প্রচুর মদত ছিল। মৌলানা নুরাজ্জামানের (বদিউজ্জামানের বড়ো ছেলে) সঙ্গে এ নিয়ে তুমুল বাহাস হয় বড়োগাজির। নুরাজ্জামান মাদ্রাসাটিতে দেওবন্দ কারিকুলাম চালু করতে চেয়েছিলেন। শুধু আরবি-ফারসি-উর্দু ছাড়া আর কোনো ভাষায় পড়াশুনা হারাম— এই ছিল তার মত। কিন্তু বড়োগাজি আলিগড় ধাঁচের পক্ষপাতী। তিনি বাঙলা আর ইংরেজিকেই আবশ্যিক করতে চান। ……… হজরত বদিউজ্জামান বড়োগাজির মতে সায় দেন।” মুসলমানরাও বিজ্ঞানভিত্তিক পড়াশোনায় মানুষ হোক, এই বাসনা তিনি পোষণ করতেন। হতে পারে তা মুসলমানরা পড়াশোনায় হিন্দুদের সমকক্ষ হোক এবং হিন্দুদের মোকাবিলা করুক, এই তার ইচ্ছা। বাস্তবতার পরিচয়।
ঙ) ইকরাতনকে শাদি কি শুধুমাত্র ফরাজি প্রচার অথবা বিপথগামিনী নারীটিকে সুপথে আনার প্রয়াস? না এর পেছনে অন্য চাহিদাও আছে রক্ত-মাংসের বদিউজ্জামানের? সাইদা তাঁকে শরীরে পরিত্যাগ করেছে। এমন সময়ই তাঁর ইকরাতনকে শাদি। এর অনেক অর্থ খোঁজা যেতেই পারে। আবার নিজেরও অনেক দোটানা ছিল। সেজন্য ঐশী বিধির ব্যাখ্যা নিজের মনে আওরাতে হয়েছিল তাঁকে। এখানে শাস্ত্রব্যাখ্যাকে নিজের উপযুক্ত চিন্তন, টানাপোড়েন সত্ত্বেও বাস্তবিক।
চ) ঘটনা পরম্পরা, পারিপার্শ্বিক ভাবনা ফরাজি-সুফী, বাস্তব ও উচ্চতা এসবের প্রেক্ষিতে তাঁকে বুঝতে চাইলে লেখককেই উদ্ধৃত করতে হবে দীর্ঘ। বদিউজ্জামান “জীবনের বাস্তবতাগুলিকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরতে বাজপাখির মতো বেঁকে মাটির দিকে নেমে এসেছিলেন। কিন্তু বক্রগতি সেই ছোঁগুলি প্রতিবার ব্যর্থ হত। ……… এই ফরাজি ধর্মগুরু, যিনি কিনা জীবনের বাস্তবতা সমূহকে ঐশী বিধি অনুসারে ব্যাখ্যা করতেন, তিনিই সুফী-উচ্চতায় উত্থিত হন ঘটনা পরম্পরায়। উচ্চতা বাস্তবতার দুশমন, তিনি বুঝতেন। মাঝে মাঝে তাই অবতরণের জন্য চেষ্টা করতেন। কিন্তু তিনি ক্রমশ টের পান, তাঁর দেহ-মন মাধ্যাকর্ষণকে পরাজিত করেছে। অস্পষ্ট, সূক্ষ্ম, মাকড়সার জালের মতো। অলৌকিকতা তাঁকে ঘিরে ফেলেছে। তিনি ছোঁ মেরে লৌকিক দুনিয়ার মাটিতে অবস্থিত কোনো লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধাবিত হতেন। কিন্তু সেটি স্পর্শমাত্র নিষ্ফল ও বস্তুপিণ্ড বোধ হত; এভাবেই ‘কাহিন’ আওরত ইকরাতনকে তিনি ত্যাগ করেন, ধর্মসংস্কারবশে নয়। তারপর সাইদার দিকে ছোঁ মারেন। বোঝেন এ সাইদা ভিন্ন এক নারী। একটি গৃহিনী মুরগি। তার চেয়ে বড় কথা, সাইদাও তাঁর স্বামীর সূক্ষ্ম ও রহস্যময় শরীরকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে পারছিলেন না। সাইদা মুগ্ধ ও ভীত হয়ে পড়ছিলেন ক্রমশ। বুজুর্গ স্বামীর শরীর ঘিরে নুরের রোশনি (জ্যোতিপুঞ্জ)! ভাবতেন, এ সেই মানুষ নয়, জিন পরাবৃত এক সূক্ষ্ম সত্তা। রক্তমাংস-অস্থিহীন অবয়ব। তবু তিনি ফের গর্ভবতী হন। বদিউজ্জামান খুশি হয়ে ভাবেন, তাহলে বাস্তবতা তাঁর লক্ষ্যবিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তিনমাস পরে এক দুপুরে সাইদা যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে ঘরের মেঝে রক্তে ভাসিয়ে দেন। ……… বদিউজ্জামানও স্তম্ভিত এবং ভীত হন।” এই যে উচ্চতা থেকে বারবার মাটিতে নামার প্রয়াস, এখানে স্ববিরোধিতার সঙ্গে এসে মিশেছে ধর্মীয় ঐশীবিধান আর অভিজ্ঞতার টানাপোড়েন। এসবই একজন বিবেকবান সাধারণ মানুষের মধ্যেও ঘটে চলে, ঘটে।
ছ) রাখীবন্ধন উৎসবে হিন্দুরা সমবেতভাবে মিছিল করে ক্রমশ মৌলাহাটের দিকে আসছে বঙ্গভঙ্গের ইংরেজ আদেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। মুসলিমরা ভীত দ্বিধাবিভক্ত। মিছিল মোকাবিলার উদ্দেশ্যে মুসলিমরা রণসাজ নিতে উদ্যত। কিন্তু বদিউজ্জামান তাদের ‘খামোশ হও’ বলে নিবৃত্ত করেন। মিছিল ঈদগাহের দিকে ঘুরল। বদিউজ্জামান আনিসুর সর্দারকে হুকুম দিলেন, “শীঘ্র ২ জাইয়া মোছলেমদিগের নিবৃত্ত করুন।” এভাবে বাকিটা বদিউজ্জামানের আত্মজৈবনিক কলমে শোনা যাক। “সেই হিজরী ১২৭৪ সনে আমার আব্বার জওয়ান বয়স এবং আমার বালক বয়সে একবার তামাম হিন্দুস্থানে হিন্দু ও মুসলিম সিপাহী আংরেজশাহীর বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া জঙ্গ লড়িয়াছিল। আমার অজুদ শিহরিত হইল; কাঁপিয়া উঠিলাম। মিনার হইতে নামিয়া নামিয়া গেলাম। আমার পেছেনে মোছলেমগণ, আমি সম্মুখে। হিন্দুগণ আওয়াজ দিলেন ‘বন্দেমাতরং’! আল্লাহের কুদরৎ! একটি বালিকা, মনে হইল বেহেশতের হুরী হইবেক, ছুটিয়া আসিয়া আমার দক্ষিণ হস্তে রেশমী ধাগা এবং তক্‌মা বাঁধিয়া শের (মাথা) ঝুঁকাইবামাত্র তাহার দুই কাঁধ ধরিয়া বুকে টানিলাম। আবেগবশতঃ আমার চক্ষু সিক্ত হইল। কহিলাম— ‘বেরাদরে ঔর বহিনে হিন্দুস্তান!’ আজ পাক খুশির দিবসে পুনরায় আংরেজশাহীর ফেরেরবাজীর (প্রতারণা/ ধূর্তামি) বিরুদ্ধে আমরা মিলিত হইলাম। আল্লাহ আমাকে জে বাড়তি চশম্‌ (চক্ষু) দিয়াছেন, উহা দ্বারা নজর হইতেছে, আংরেজশাহীর বিরুদ্ধে বহুত বড় জঙ্গের জামানা আসিতেছে। তামাম হিন্দুস্তানে সমুন্দরের আওয়াজ উঠিবেক। আপনারা তৈয়ার থাকুন।” বোঝা যাচ্ছে ধর্মের মৌলবাদের রূপই শুধু নয়, বাস্তবের জমিতে তিনি ধর্মসহিষ্ণুও। ইংরেজকে শত্রু ভাবতে তার দ্বিধা হয়নি। মিলিত শক্তির প্রয়োজনীয়তা ধর্মের গোঁড়ামিকেও পরাভূত করেছে। দুইহাতে দুই ধর্মীয় শক্তিকে একইসঙ্গে লড়তে হবে, এমত মতবাদের দিশারীও, প্রয়োজনে ইংরেজকেই প্রধান শত্রু ভেবেছেন। স্ববিরোধিতা থাকলেও বাস্তবের জমিতে তা অর্থবহ।
জ়) ছোট ছেলে শফিউজ্জামানের বিরুদ্ধে সরকার শাস্তি প্রয়োগ করেছেন। তার শাস্তি রদের জন্য বারি মিঞা তৎপর। সকলের স্বাক্ষর সংগ্রহ করছেন। সরকারের হাতে তুলে দেবেন। বদিউজ্জামান সেখানে স্বাক্ষর করেননি, কারণ তাঁর কাছে ‘শফিউজ্জামান মুর্দা’, কেননা সে হিন্দু অথবা ব্রাহ্ম হয়েছে। স্বাক্ষর না-দিয়ে তিনি একাকী নীরবে বা কখনো শব্দ করে কাঁদেন। রত্নময়ীর প্রতিনিধি গোবিন্দরাম তার কাছে খত নিয়ে আসেন। অনুরোধ, পুত্রের জন্য তিনি বড়োগাজি বা দিদারুলকে খত লেখেন। বদিউজ্জামান অস্বীকার করেন। শেষে রত্নময়ীর খত খুলে দেখেন, লেখা আছে— ‘শফিকে রক্ষার জন্য শীঘ্র একজন জিন পাঠান।’ উনি হাসবার চেষ্টা করলেন বেটির পাগলামি দেখে। গোবিন্দরাম দ্বিতীয়বার খত চাইলে, “বদিউজ্জামান হঠাৎ খাপ্পা হয়ে বললেন, শফি মুর্দা। আমি মুর্দার জন্য জিন্দাদের কাছে খত লিখব না, বাবু! আপনি আসুন।” পরে এবাদতখানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করেন। “কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ক্রন্দনের পর দুইহাত তুলে মৃদুস্বরে প্রার্থনা করলেন, ‘আল্লাহ! তুমি জিন ও ইনসান (মানুষ) পয়দা করিয়াছো। আমি এই জিন্দেগিতে কিছু চাহি নাই তোমার কাছে। এক্ষনে মাত্র একজন জিনকে ভিখ্‌ মাঙিতেছি। তাহাকে পাঠাইয়া দাও, মালেক।” হা পুত্রচিন্তা, হা সন্তানবেদনা! হা অলৌকিকত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ মানুষ পিতার আর্তি! তবে কি জিন-এর বিষয়ে তাঁর নিজেরও সংশয় কিছু কম নয়! মানুষ ও জিন আল্লার সৃষ্টি, এতে দ্বিমত নেই, কিন্তু জিন কতটা কার্যকরী তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও ছেলের জন্য তা পাঠাবার ভিক্ষা চাইছেন আল্লাহর কাছে। একদিকে ধর্মীয় অনুশাসনের বেড়াজাল অন্যদিকে অপত্যস্নেহজনিত পিতৃহৃদয়, যা একান্তে কেঁদে ভাসায় আর আর্তি জানায়।
ঝ) শেষাবধি তাঁর জীবনে ধোঁকার সৃষ্টি হয়। এবাদতখানার পাশে এতিমখানার জুলেখাকে তিনিই আবিষ্কার করেন। জালালুদ্দিন-এর (তাঁরই আবিষ্কার) ওপর তার আরবী বর্ণপরিচয় ও শিক্ষাদীক্ষার ভার দেন। নিজের নাতি রফিকুদ্দিনের সঙ্গে তার বিবাহ তিনিই স্থির করেন এবং বিবাহ দেন। তিনি জানতেন বালিকাটির ‘চক্ষু দুইটি পিঙ্গলবর্ণ’। কিন্তু শাদির দিন, শাদির বিষয়ে তাঁর জ্ঞান বা জানার বাইরে যা ঘটেছিল, মস্তানবাবা তথা তাঁর ভাই ফরিদুজ্জামানের গণপ্রহারে মৃত্যু ঘটেছিল, ভাইকে যথাসময়ে চিনতে পেরেছিলেন তিনি, তাতে এক অসহ্য যন্ত্রণার স্বীকার হন। কাউকে ভাইয়ের পরিচয় দিতে পারেননি, আবার অন্তর থেকে সহ্য করাও কঠিন ছিল। শেষে তারই নির্দেশে ছোটগাজি ভাইয়ের ‘কাফন দাফন’-এর ব্যবস্থা করে। শুভ ও অশুভর এই যুগপত সংঘটন কি কোনো অমঙ্গলের সূচক? সম্ভবত এখানেই তিনি ধোঁকা খেয়েছেন, এখান থেকেই ভ্রম আর সংশয়ের দোলা। যা পরের কথোপকথনে কিছুটা পরিস্কার হবে। রাত্রে ছায়ার সঙ্গে (যেন নিজেরই বিবেক) কথোপকথনে তিনি নিজেকে পাপ ও মানসিক ভ্রমের মাঝখানে ফেলে দেন। ছায়ার সঙ্গে তাঁর বাৎচিতের কিছু অংশ এইরকম—
‘সে কহিল তুমি আলেম লোক। বদি কথার অর্থ জান না? বদি হইল পাপ। তুমি এতদিনে জমানার পাপ হইলে—’
ক্রুদ্ধভাবে কহিলাম, আমার নাম ওয়াদি-উজ-জামান। জমানার (কালের) নদী। বাঙ্গালায় ওয়াদি বদিতে পরিণত হইয়াছে। ওয়াদি অর্থ নদী। …’
‘সে বাধা দিয়া পুর্ববৎ হাওয়ার স্বরে কহিল, খামোশ! তুমি কি করিয়াছ, জান না।’
‘কী করিয়াছি, তুমিই বলো। ………’
‘ওই লড়কির দিকে তাকাইলেই বুঝিতে পারিবে। উহার চুল, উহার চক্ষু, উহার চাহনি……’
‘এ কী বলিতেছ?………’
‘বদি উজ-জামান। তুমি আজ হইতে জমানার বদি। তোমার জন্য সুনিশ্চিত দোজখ।’
‘আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম, ফরিদুজ্জামান! তুমি কি সেই কথা বলিবার নিমিত্ত শাদির মজলিশে ঢুকিতে গিয়েছিলে?…’

একি তার গোনাহ? নাকি মানসিক ভ্রম? আবার এই গোপন তত্ত্ব ও তথ্য কারো কাছেই প্রকাশ করার নয়। অসম্ভব মনকষ্টে জর্জরিত তিনি। এবার তাঁর আত্মগোপন। মউৎ প্রার্থনা। একজন অতি সাধারণ মানুষের মতো। দেখি, নিজেরই কর্মকাণ্ডের জালে তাঁকে ফেঁসে যেতে। দেখি, নিজেকে পাপহীন প্রমাণ করার অদম্য প্রচেষ্টা। দেখি, দোজখের জন্য ভয়, গোনাহ না-করার লক্ষ্যে আল্লাহর দীন সেবক যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, ধর্মপথে চলেন, তিনিই গোনাহ ও মানসিক ভ্রমের দ্বন্দ্বে জীর্ণ। আত্মগোপনের পথে নিজেকে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চান। “পরদিবস হইতে এবাদতখানায় ইত্তেফাক লইলাম। ……… কালো মশারির ভিতর আত্মগোপন করিয়া রহিলাম। …… খাইতে পারিতাম না। দুনিয়া আঁধারে ঢাকিয়া যাইতেছিল …… কালো মশারির ভিতরে গোপনে ক্রন্দন করিতাম। আমার জন্য এক্ষণে মউত বরাদ্দ হউক। কারণ জিন্দেগীতে ধোঁকা সৃষ্টি হইলে উহা নিদারুণ ক্ষতস্বরূপ। এক্ষেত্রে, মউতই নিষ্কৃতি।…”। একজন ধর্মগুরু এবং প্রচারক, যিনি মৌলবাদী চিন্তার মানুষ, তিনিও নিজকর্মে নিজেই প্রতারিত হয়ে মৃত্যু প্রার্থনা করছেন দিন-দুনিয়ার মালিকের কাছে, এ বড়ো বেদনাদায়ক ও সংবেদনশীল।

উপন্যাস থেকে সংগৃহীত এমন সমস্ত বিষয়গুলির নিরিখে বদুপিরকে সামান্য দেখলে, চিন্তা করলে এবং মেলালে যে ভাবনাগুলো সামনে উঠে আসার সম্ভাবনা প্রবল হয়, তা সাজালে এইরকম—

ক) খানদানি অথচ সন্ন্যাস নিয়ে সংসারত্যাগী ঘরে তাঁর জন্ম। নিজে ফরাজি, ভাই মজনুন। বাবার জওয়ানকালে বাবারই হাত ধরে দেখেছিলেন ইংরেজের বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত জঙ্গ। শিক্ষিত ধর্মপ্রচারক, আল্লাহ ছাড়া কাউকে মানেন না, পির-মাজারে বিশ্বাস নেই, নিজেকে দীনসেবক ভাবেন, অথচ অনুগামীরা বা পরিবারের মানুষরা তাঁর অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করেন ও প্রচার করেন। তাঁর মোজেজা (বিভূতি) দেখতে চান। জিনের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা চাউর করেন। তিনি কিন্তু নিজেকে জেনেও এসবে বাধা দেন না। একসময় নিজের ওপর অলৌকিকত্ব স্থাপনে যেন নিজেও সহায়ক হয়ে ওঠেন। বিশ্বাস করতে শুরু করেন বিভূতিতে।

খ) একরোখা জেদি আবার ঐশী বাণী ও আল্লাহ সৃষ্ট কুরানের কথা বারবার নিজের জীবনের বাস্তবে মেলাতে চান। নিজের ইচ্ছা ও জেদকেও সেই আলোকে দেখেন, দেখাতে চান, বাধা পান না তেমন কারো কাছ থেকেই, শুধুমাত্র নিজের বিবেক ছাড়া।

গ) বিবাহের পর তিন বছর নিরুদ্দিষ্ট। অর্থাৎ খানদানের ধারা কিছুটা বহমান। পরে সংসারে এসেও দেখা যায়, অধিকাংশ সময় থাকেন মসজিদে, এবাদতখানায়, নির্জনে, নিরালায়, একাকী, নামাজে, পাঠে, বক্তৃতায়। এখানে থেকেই আলাদা হন, অলীক হন। রাতের অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ-পোকার ডাক, গ্রামের বাইরে ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ, মাঝেমধ্যেই ইত্তেফাক (মৌনী), কালো মশারির মধ্যে একাকীত্বে অবস্থান, শাদা-জিন কালো-জিনদের (দুটি সত্তা) সঙ্গে কথোপকথনে এক অশরীরী অবস্থানের তৈরি হয় বৈকি। আর সংসারে থেকেও নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা, দূরত্বের আড়াল তোলা, সমাজ থেকে উঁচু একটা অবস্থান বজায় রাখা তাঁকে অলৌকিকতার দিকে ঠেলে দেয়।

ঘ) একদিকে সংসার-বৈরাগ্য অন্যদিকে শরীরীটোপ; একদিকে আল্লাহর বাণী অনুসারে নিষ্কাম, নিরুদ্বেগ, শোকহীন, কঠোর-কঠিন, অন্যদিকে মমতায় আচ্ছন্ন; সন্তানের প্রতি অমোঘ টান; একদিকে সামাজিকতা বিমুখ অন্যদিকে ধর্মের কারণে গঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ; একদিকে আবেগহীন, রাজনীতির জাল থেকে বহুদূরে, অন্যদিকে আবেগাভিভূত হয়ে রাখীবন্ধনে সামিল; একদিকে উচ্চতার প্রতি স্বাভাবিক টান, অন্যদিকে বাস্তবতার মাটিতে ছোঁ মারার বাসনা, যদিও জানেন উচ্চতা বাস্তবের দুষমন; একদিকে গোনাহর প্রতি বিদ্বেষ, অন্যদিকে অলক্ষ্যে কখন গোনাহ করে বসেন; একদিকে ধর্মের কুঠুরীতে নিমজ্জমান জেদি অসহিষ্ণু, অন্যদিকে মানবতার প্রতি টান, ধর্মের কর্তব্যে অবিচল, সহিষ্ণুতাকেও পরখ করে দেখেন; একদিকে ধর্মের অনুশাসনে সন্তান কাফের বনে, মুর্দা মনে হয়, অন্যদিকে তারই জন্য প্রার্থনা পিতৃহৃদয়ের। সংশয়-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-ভালো-মন্দের বিচারে ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষটি অলীক হয়তো বা, কিন্তু প্রথমত নিশ্চিত রক্তমাংসের মানুষ, দ্বিতীয়ত যা কিছু অলীকত্ব তা আরোপিত, যা মানুষটিকে মানুষ থেকে বাহ্যিকভাবে আলাদা করলেও অন্তরে আলাদা করতে পারে না। সেখানে টানাপোড়েন সত্ত্বেও মানুষই বড়ো হয়ে ওঠে।

ঙ) একসময় নানা ঘাত-প্রতিঘাতে ভেঙে পড়েন, কেঁদে ওঠেন। নিজে যে রক্তমাংসের এক মানুষ, তিনি যে পাপের প্রতীক নন, বরং এক বহতা নদীর মতো, তা বোঝাতে তাঁর নিজের বিবেকের সঙ্গে কথাবার্তার আর্তিতে আমাদের মনও ছুঁয়ে যায়। নিজের সৎ প্রার্থনা শুধুমাত্র কোনো ধর্মগুরুর মনেই আসে না, মনে আসে প্রকৃত মানুষেরও।

চ) আমরা দেখি মুসলিম ধর্মের সঙ্গে ব্রাহ্মধর্মের মিলের জায়গাগুলিতে তিনি উৎসাহী, সন্ধিৎসু। মির্জা গালিবের শায়েরিতে আনন্দ খুঁজে পান, নিজের জীবনের সঙ্গে মেলাতে চান। বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে শিহরিত হন, হয়ে পড়েন আবেগপূর্ণ। এসবই মানবিক গুণ হিসেবে বিবেচিত।

ছ) চরিত্রটি অসম্ভব জটিল। লৌকিক ও অলৌকিকের বেড়াজাল ছিন্ন হয়ে যায় যে কোনো মুহূর্তে। স্ববিরোধী সত্তাটিও হাজির হয় যখনতখন। কিন্তু শেষাবধি সে মানুষ, যা তাঁর নিজস্ব আকূতিতে ধরা পড়ে। ইস্পাতের মতো কঠিন ধর্মরক্ষক ও ধর্মগুরুকেও আড়ালে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। সংসার জীবন থেকে পরিত্রাণ চাওয়া মানুষ বারবারই সংসারের নানা টানে ও স্নেহে জড়িয়ে পড়েন। আবার হাহাকারও করেন। মনুষ্য আরোপিত বিভূতির কথা কখনো হয়তো উপভোগ করেছেন, কিন্তু তাতে যে তিনি ক্রমশই সবার থেকে দূরে সরে গেছেন, সেই দুঃখবোধেও বিদীর্ণ হন। অসাধারণ ক্রাফটিং করে এই চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন ঔপন্যাসিক। তাঁর ধর্মীয় মৌলবাদজনিত ক্রুরতা ও জটিলতার সঙ্গে মিশিয়েছেন উদারতা সহিষ্ণুতা ও মানবিক কোমলতা।

Facebook Comments

Leave a Reply