কাশবনের ভাস্কর্য : শুভংকর গুহ

[“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।]

ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা আকারে ছোটো হয়, দুইটি ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা আকারে বড় হয়। বড় আকারের টাঙ্গার সামনে ও পিছনের সিট বেশ প্রশস্ত ও আরামদায়ক। সিটের নিচে বাক্সের মতো জায়গায় ঘাস রাখা আছে। সওয়ারি আনা নেওয়ার অবকাশে ঘোড়া ঘাস খায়। উত্তরপ্রদেশের মহল্লা অলিগলিতে ঘোড়া দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে যা একেবারেই বিরল।
উত্তরপ্রদেশের নাগরিক ও গ্রামীণ জীবনের প্রধান যান হল টাঙ্গা। হিন্দি ফিল্মে তাই অনেক গানের সঙ্গে ঘোড়ার নালের শব্দ খুবই জনপ্রিয় ছিল। আমার নিজের লেখাতেই অনেকাংশ জুড়ে ঘোড়া বিষয় হয়ে উঠেছে। ঠিক এরকমই টাঙ্গা অনেক বছর পরে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারিতে দেখেছিলাম। ঐতিহাসিক শহর ঘুরে ঘুর পরিক্রমা করছে। তবে আকারে ও গঠনে সামান্য অন্যরকম। খাটো খাটো আকারের ঘোড়া বড়ই নির্জীব। ঘোড়াগুলির হাড়গিলে অবস্থা দেখলে কোচোয়ানের নিষ্ঠুর চরিত্র মনে মনে কষ্ট দিত।
অভিজ্ঞ কুলি তিনটি বড় আকারের টাঙ্গা বায়না করে নিয়ে এলেন। আমাদের জন্যই সান্যাল বাবু মথুরা স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। তিনিই পরিষ্কার হিনি ভাষায় গড়গড় করে বলে গেলেন কোচোয়ানদের ঠিক কোথায় যেতে হবে। বাকি কথা টাঙ্গার কোচোয়ানই বুঝে নিলেন। বললেন,- চিড়িয়া কা ময়দান। বাবা হিন্দি ভাষা বলতে পারতেন, তবে সামান্য হোঁচট খেয়ে। স্যান্যালবাবু ও বাবার কথায় বুঝতে পারলাম, ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার বেস অফিসের কাছেই আমরা যাচ্ছি। দুইটি বা তিনটি বড় আকারের টাঙ্গার ওপরে সব মালপত্তর গুছিয়ে তুলে নিতে সময় লাগল। স্টেশন সংলগ্ন দোকানপাটগুলিকে ঠিক যে ভাবে দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, সেইরকম মোটেই নয়। অধিকাংশই চোখা চোখা বাঁশের ডগা দিয়ে টানানো রঙ্গিন ত্রিপলের অস্থায়ী ছাউনি। লোকজন খুবই কম, ফাঁকা ফাঁকা রাস্তাঘাট। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে সিভিলিয়ানদের যাতায়াত খুবই নিয়ন্ত্রিত। মিলিটারি পুলিশ মোটর সাইকেলের শব্দের তুফান তুলে রেকি করছে। সামরিক বাহিনীর পোশাকের মধ্যে মাথায় অদ্ভুত পাগড়ি। গভীর টকটকে লালের বেড়। কারও কারও চোখে রোদ চশমা।
বাবাকে সান্যাল বাবু বুঝিয়ে দিলেন, গন্তব্য স্থানটি ঠিক কোথায়? টাঙ্গা মসৃণ গতিতে যাচ্ছিল, চমৎকার কালো পিচের রাস্তা। শিল্পী যেন রেখার সাহায্যে রাস্তার নিখুঁত চিত্রাঙ্কন করে রেখেছেন।
মিঠাইয়ের দোকানে উনানে বড় বড় লোহার কড়াইয়ে দুধ গরম হচ্ছে। মথুরার মালাই আর ক্ষীরের স্বাদ… সে না কি আহা… আহা… গরুর দুধের জন্য খুব বিখ্যাত এই শহর। বড় উনানে বড় বড় লোহার কড়াইয়ে দুধ জ্বাল দেওয়াই মথুরাবাসীদের প্রধান কারোবার। লোহার কড়াই রূপোর মতো চক চক করে। মিঠাইয়ের দোকানে, কাঁচের বাক্সের ভিতরে বা সামনে, কাঠের বারকোসের ওপরে থরে থরে সাজানো ক্ষীরের প্যারা। মথুরার ক্ষীরের প্যারার স্বাদ না কি ভারতবর্ষকে জিভের আহ্লাদে মাতিয়ে রাখে। মুখে দিয়ে বুঝেছিলাম, এই স্বাদের সত্যিই বিকল্প নেই।
মসৃণ পিচের রাস্তার দুইধারে বড় বড় প্রাচীন গাছ। সামরিক বাহিনীর সৌজন্যে গাছগুলিকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। চুনের দাগের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর অনুশাসন রেখা রাস্তা বরাবর। গাছের গোঁড়ায় গোঁড়ায় ছোটো ছোটো ফালি মতো ফুলের বাগিচা। মালি ঝাঁজি দিয়ে জল দিচ্ছে বাগানে। সবকিছুই গোছানো একেবারে ঠিক পানাগড়ের ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত যেমন প্রতিদিন অনুশাসন ও নিয়ম। সামরিক বাহিনীর ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া বোধহয় সবখানেই একইরকম। বিস্তীর্ণ হলুদ মাঠ। এই মাঠকেই চিরিয়ার ময়দান বলা হয়। ভাবছিলাম শহর কোথায়? প্রবেশ করে গেছি ফৌজি ও কর্মীদের কোয়ার্টারের কাছেই। সব শহরের ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার চরিত্র একই রকম হয়। মাঠের ধার দিয়ে তারকাটার বাউন্ডারি মাইলের পর মাইল। গাছের গোঁড়ায় চুন ও রেড অক্সাইড দিয়ে বেড় দিয়ে দাগ দেওয়া। সাদা লাল গাছের গোঁড়ায় মিলিটারি পেটেন্ট দাগ।
একটি নতুন শহরে এসেছি বলে, মা কেমন জানি কুঁকড়ে গেছিলেন। নিজেকে আকারে অনেকটা ছোটো করে, সম্ভবত নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য প্রস্তুত করে নিচ্ছিলেন। যাতায়াতের পথে এত ঘোড়ার গাড়ি কোনোদিন দেখিনি। অধিকাংশই বাদামি রঙয়ের ঘোড়া। মাঝে মাঝে কয়েকটি সাদা ও কালো ঘোড়া চোখে চমৎকার রিলিফ আনছে। উচ্চতায় খাটো। বড়ই নির্জীব দেখতে। শুধু পা ফেলে টগবগ করে ছুটে চলেছে। আর লোহার নালের টগবগ টগবগ আওয়াজ হয়ে চলেছে। অন্য প্রদেশ থেকে আসা যে কোনো নবাগতের ঘোড়াগুলিকে দেখলে করুণা হবে। মানুষ কত হিংস্র। নিজের উদরের জন্য পশু হত্যা করে খায়। আবার সেই পশুকেই গাড়িতে জুতে মাল টানার কাজ করিয়ে নেয়। এই বিশ্বসংসারে মানুষই সব থেকে হিংস্র। নিজেদের প্রয়োজন মতো পশু পাখিকে তারা ব্যবহার করে। কিন্তু মানুষ ভুলে যায়, এই পৃথিবী তার একার নয়। সব পশু পাখিরই মানুষের মতোই তাদের সমানাধিকার।
মাঠ ঘাসের রঙ বিচিত্র। হলুদ। রুক্ষ। ছবিতে দেখা অনেকটা জলহীন বৃষ্টিহীন দেশের মাঠের মতো। সান্যাল বাবু বললেন,- পশ্চিমবঙ্গের মতো কি আর এখানে বৃষ্টি হয়? তাই সেখানকার ভূমি ও আকাশ অনেকটাই কোমল। টাঙ্গা মাঠ বরাবর ছুটে যাচ্ছিল। অন্তহীন এত বড় মাঠ দেখিনি। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে একটি বড় মাঠ থাকে। মথুরাও ব্যতিক্রম নয়। মাঠের মধ্যিখান দিয়ে একটি রাস্তা গেছে। সেই রাস্তাটি একটি প্রাচীন অশ্বত্থ গাছের নিচে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে যেন।
গাছের নিচে সিমেন্টের একটি খাসা বেদি করা আছে। সেই বেদির ওপরে একজনকে দেখলাম, পুস্তক মেলে রাখার জন্য কাঠের বইদানির ওপরে একটি মোটা গ্রন্থ রেখে বিড়বিড় করে কি যেন পড়ছে। তিনটি টাঙ্গা সেই গাছতলার নিচে দাঁড়ালো, গ্রন্থ পাঠ করে যাওয়া মানুষটির ভ্রূক্ষেপ ভ্রূক্ষেপ পর্যন্ত নেই। লোকটি আপনমনে পাঠ করেই যাচ্ছে গভীর মনোযোগের সাথে। গাছতলার আশেপাশে কেউ কোথাও নেই, কিন্তু সে উচ্চস্বরে পাঠ করেই যাচ্ছে।
বিস্মিত হওয়ার অবকাশ আছে বৈকি। স্যান্যালবাবু বুঝতে পারলেন। বললেন, খুব বড় প্রচীন গাছ থাকলেই সেই গাছের নিচে বসে কেউ না কেউ গ্রন্থপাঠ করে। এখানকার রেওয়াজ এমনই।
কি পড়ছেন উনি?
উনি গোকুল অধ্যায় পড়ছেন। এখানে মানুষ সময় পেলেই গোকুল অধ্যায় পড়েন। শ্রীকৃষ্ণের দেশ তো। এখানকার ধুলো বালিতে রাধাকৃষ্ণ মিশে আছেন।
বাবা স্যান্যালবাবুকে কি যেন বললেন। তিনি শুনে হাসলেন এবং বললেন,- এখানে কি টাঙ্গার অভাব আছে? দরাদরি করে, না হয় নিয়ে নেওয়া যাবে। যেদিন যাব, সেইদিন ঠিক করে নেব। আপনি এত ভাবছেন কেন? যেদিন যাবেন সদর বাজার থেকে আমি নিজে দরাদরি করে টাঙ্গা বায়না করে নিয়ে আসব। আপনি এত বিচলিত হবেন না। মথুরা ক্যান্টে আমার পাঁচ বছর হয়ে গেল।
পাঁচ বছর?
হ্যাঁ। পাঁচ বছর।
কারও কপালে বদলির পর বদলি, আর কেউ থিতু টানা কয়েক বছর।
বদলির অর্ডারের রহস্য নিয়েই আমাদের চাকুরি। তবে আমি ভাগ্যবান।
আমার মতন কপাল কি আপনার?
আপনি তো ডিপার্টমেন্টের কথা জানেন? যে কাজে যত বেশি পারদর্শী তার কপালেই তত বেশি বদলি। আপনাকে তাই সব কম্যান্ডই চায়।
আপনি আমাকে নিয়ে রসিকতা করছেন।
সান্যাল বাবু মৃদু হাসলেন। আপনি আমার অনেক সিনিয়র।
কি যেন নাম বলছিলেন? কি বাড়ি যেন…কি বাড়ি যেন…
গাঙ্গুলিদের জমিদার বাড়ি। ওরা মথুরার বিখ্যাত পরিবার। কৃষ্ণের উপাসক, কৃষ্ণভক্তি নিয়েই গাঙ্গুলিদের প্রভাব প্রতিপত্তি। এখন সেই বাড়িতে কেউ থাকেনা। ওরা মথুরা ছেড়ে চলে গেছে দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক আগেই।
খুব কি পুরানো বাড়ি?
সেই প্রাচীনকালের ছোটো ছোটো ইটের গাঁথনি। শুনেছি যখন ওরা এসেছিল তখন সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প ছিলনা। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া অনেক পরে। ওদের আঙ্গিনায় বনের হরিণ চড়ে বেড়াত একসময়। বাড়িটির পিছনেই ছিল বনাঞ্চল। বনাঞ্চলের ঠিক পাশেই যমুনা নদী।
এখন কি ওদের আর কেউই থাকে না?
না। এখন কেউই থাকে না। সবাই যে কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না। শুনেছি বিহারের দ্বারভাঙ্গায় চলে গেছে।
প্রবাসী বাঙ্গালিরা সবাই দ্বারভাঙ্গায় কেন চলে যায় জানি না। দ্বারভাঙ্গায় বাঙ্গালিদের একটি বড় সমাজ আছে। বাঙলা বইয়ের একটি বড় লাইব্রেরিও আছে জানি।
গাঙ্গুলিদের বাড়ি এখন মথুরার সামরিক বিভাগ দখল নিয়ে ফৌজিদের পরিবারের বাসযোগ্য করে তুলেছে। এক কথায় বলতে পারেন এখন গাঙ্গুলিদের বাড়ি স্টাফ কোয়ার্টার।
তা হলে আপনার কোয়ার্টারে আমাদের দুইদিন থাকতে হবে?
থাকুন না। যত খুশি যত ইচ্ছে দিন থাকুন।
আহা। আমি কি আপনাকে সেই কথা বললাম।
আপনারা যতদিন থাকবেন হৈ হৈ করে থাকা যাবে। এই দূর দেশে একা একা থাকি। বাঙালি পরিবার পেলে বেশ ভালো লাগে। সখ্য অর্জনে আনন্দ হয়। আমার কোয়ার্টার তো আপনার নিজের জায়গাই। আজকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম নিয়ে নিন। কালকে অফিস ব্রেকের পরে আপনাকে নিয়ে যাব।
আপনি বলছিলেন যমুনা নদীর কাছেই।
হ্যাঁ। এখানকার তুলনায় অনেক কাছে। এখান থেকে যমুনা বেশ দূরে।
আপনার মতো একটি কোয়ার্টার যদি?
আমার মনে আছে আপনার কথা, কেউ ট্রান্সফার হলেই চেষ্টা করতে পারতাম। মেজর উপাধ্যায়কে বলেও রেখেছি। আমার পাশের কোয়ার্টারে আপনি এলে তো ভালোই লাগবে। এই দেশে দুই বাঙালি পরিবার পাশাপাশি থাকা মানে বেশ ভাগ্যের। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট গাঙ্গুলিবাড়ি আপনার নামে এলোট করে দিয়েছে। ওখানেও কয়েকটি পরিবার থাকে। শুনেছি একটি বাঙালি পরিবারও আছে। পুরানো বাড়ি। বড় বড় ঘর। লাল পাথরের প্রশস্ত মেঝে। খুব বড় পাতকুয়ো। সারাদিন ক্যান্টনমেন্টের কলের জল। শুধু বাউন্ডারির ভিতরে সিভিলিয়ানদের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু তরিতরকারি যারা বিক্রি করেন, প্রয়োজনে অন্যজনের প্রবেশের অনুমতি আছে। এখানে কিন্তু লুকিয়েই মাছ মাংস খেতে হয়। আপনি বাঙালি জেনে মাছ বিক্রেতা আপনার বাড়িতে ঢুঁ দেবেই। যমুনা নদীর মাছ খুব সুস্বাদু। কিন্তু খবরদার কচ্ছপের মাংস খাবেন না। কচ্ছপ হল ভগবান। যমুনার বাহন। তিনি কচ্ছপের পিঠে চেপেই নদী ঘুরে বেড়ান। স্থানীয়রা জানতে পারলে খুন করে দেবে। মাছওয়ালারা লুকিয়ে নিয়ে আসে। খবরদার কিনবেন না। কচ্ছপের মাংস নিয়ে এলে স্রেফ তাড়িয়ে দেবেন।
সান্যালবাবু মানুষ হিসেবে খুবই আন্তরিক। আমরা তার কোয়ার্টারে দুইদিন ছিলাম। আমাদের যাতে কোনোপ্রকার অসুবিধা না হয়, সবসময় তিনি সতর্ক ছিলেন। তাঁর একটি মোমের পুতুলের মতো কন্যা ছিল। লাল চেরি রঙয়ের ইংলিশ গাউন পড়ে ময়ূরের মতো খেলে বেড়াত। কথার সঙ্গে হিন্দি শব্দ মিলিয়ে মিশিয়ে এমন বলত, মনে হত কাঁচের রঙ্গিন বল গড়িয়ে যাচ্ছে।
এখানে মাত্র দুইদিনের জন্য থেকে যাওয়ার অবসরে সময় কেটে যাচ্ছিল। নতুন দেশ, নতুন শহর, নতুন সব গাছপালার মতো মানুষজন। স্যান্যালবাবুর কোয়ার্টারের সামনে সীমানাহীন উদার হলুদ ঘাসের মাঠটি দেখে মনে হত অনেকদূরের আত্মীয়স্বজন, বান্ধবহীন মাঠের এক বিন্দুর মতো একটি দাগ যেন আমি।
টাঙ্গা থেকে নেমে যে মানুষটিকে ‘গোকুল অধ্যায়” পড়তে দেখেছিলাম, পরের দিকে আর তাকে দেখলাম না। বুঝতে পারলাম, তার নির্দিষ্ট সময় আছে, গাছের নিচে বসে ‘গোকুল অধ্যায়’ পাঠের। নিজের মনে নিজেই পড়ে যায়, কেউ শুনলো কি শুনলো না তাতে পাঠের কিছু পার্থক্য হয় না। চেতনে অবচেতনে ভক্তির যেন আর কোনো বিকল্পই নেই।
গ্রীষ্মকালের উত্তরপ্রদেশের সকাল এক চমৎকার ধুলোগন্ধের বিনম্র অনুভব আনে। ধুলো বাতাস নেই অথচ ধুলোর গন্ধ। আগের দিনের প্রখর রোদের তাপের গরম বাতাসের প্রবাহ যাকে মা বলতেন পশ্চিমা বাতাস সকালের বাতাসেও একপ্রকার শির শির অনুভব নিয়ে এলেও বেলা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তাপ নিয়ে আসত। মথুরা শহরের এই বাতস বড়ই আদরের। ভোরের পাখির ডাক ও মানুষের কথার মধ্যে একপ্রকার নির্জনতা থাকে, গাছ মানুষ পাখি অসীম আকাশে একা একা কথা বলে। দূরে মাঠের ধার দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলেছে সারি সারি গোয়ালা দুধের পিপে সাইকেলের ক্যারিয়ারে চাপিয়ে মথুরা নগরের গভীরে। যমুনা নদীর ধারে সারি সারি মিষ্টির দোকানে দুধ সাপ্লাই দিতে।
দুধ মথুরা নগরীর সংস্কৃতি ও আবেগকে বহন করে চলেছে যুগ যুগ ধরে। দোকানে দোকানে গরুর গলকম্বলের জন্য গয়নাগাটি বিক্রি হয়। পিঠের জন্য রঙ্গিন কম্বল চাদর ও ছদরি। বিভিন্ন আকারের গরুর গলার ঘণ্টি। লেজের ঝালর। আরও কত কি। কথায় আছে, নটখট গোবিন্দ গোপাল গোয়ালা জীবনকে ধন্য করেছে। গরুর দুধ মথুরা শহরে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য নগরবাসীদের অন্যতম অবলম্বন। দুধের সাগরে ডুব দিয়েছে নগরবাসীর মন প্রাণ।
নতুন শহরে ঘুম আসে না। শহরের নতুন মানুষ নতুন শহরের সঙ্গে ঘুমে অভ্যস্ত হতে বেশ কিছুদিন সময় নিয়ে নেয়। এতটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, ভোর সকালের দুয়ারে টোকা দিতে আরও কিছুটা সময় বাকি আছে। ভোর একেবারেই ক্ষণস্থায়ী কিন্তু সকাল কিছুটা কম হলেও বেলা বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই এই শহরের বিশ্রামঘাটের ঘণ্টাধ্বনি মথুরাবাসীকে মাত করে দেয়। চঞ্চল করে তোলে।
বিশ্রামঘাটের মাহাত্ম্য হল, শ্রীকৃষ্ণ কংশকে বধ করার পরে যমুনা নদীর পাড়ে একটি পাথরে বাঁধানো ঘাটে বসে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। সেই ঘাটই বিশ্রামঘাট বলে প্রসিদ্ধ। পৌরাণিক কাহিনির মধ্য দিয়ে, এই ঘাটকে মহাতীর্থ ঘাট হিসেবে মান্য করা হয়। বিশ্রাম ঘাট নিয়ে মথুরা শহরে অনেক রকম কথা ও কাহিনির প্রচলন আছে। সেই সময়ে যে যমুনা নদীর দর্শন আমরা পেয়েছিলাম, সে নদীতে বড় বড় প্রাচীন কচ্ছপের সমাবেশ ছিল। শুকনো ছোলা জলের ওপরে ভাসিয়ে দিলে অসংখ্য কচ্ছপ জল ফুঁড়ে ঘাটের পাথরে ওপরে ভেসে ওঠে।
আমার চোখে তখনও ঘুম লেগে ছিল। নতুন জায়গা আর মাঠ আলো ও ভোরবেলাকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম, কলকাতা ও পানাগড়ের স্মৃতিকে। স্যান্যালবাবুর কোয়ার্টারের চারদিকে নানান গাছগাছালি ভর্তি। কত রকমের পাতাবাহার কত ধরণের ক্যাকটাস। চারদিকে হলুদ মরুমাঠের মধ্যে ঘন সবুজের সমাহার অনেকটাই স্বস্তি।
গতকাল যখন অশ্বত্থ গাছের নিচে তিনটি টাঙ্গা দাঁড়িয়েছিল, সেই গাছের নিচে সাদা চাদরের মেঘ যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। মনে হচ্ছিল এক দীর্ঘকায় মানুষ সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে সটান শুয়ে আছে। এ কি সেই মানুষ যিনি গভীর মনোযোগের সঙ্গে গোকুল অধ্যায় পাঠ করে যাচ্ছিলেন। সীমাহীন হলুদ মাঠের সমস্ত বাতাস সাদা চাদরের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। আমি বিস্মিত হয়ে, বরফের মতো সাদা চাদরটিকে নিস্পলক দেখছিলাম।
কাছে গিয়ে দেখব, সেই অবস্থানে আমি ছিলাম না। কারণ আমার নড়ে ওঠার সমস্ত শক্তিকেই শোষণ করেছে সেই অলৌকিক দৃশ্য। অদ্ভুত, নিজেই নিজের কাছে নানান প্রশ্নকে অবলম্বন করে, জানতে চাইছিলাম, কে এই ব্যক্তি? কি তার পরিচয়? ভোরবেলা এমনই হয়, অন্য কোনো মানুষের উপস্থিতিকে খুব সহজেই পেতে দেয় না। আমি আর সেই গাছের নিচে সাদা চাদরে ঢাকা শায়িত রহস্যময় মানুষটি। চরাচর বা ভোরের বেলা খুব একাকী না হলে, এমন দৃশ্য বা মানুষের ধোঁয়াশা মেঘ সহজে ধরা দেয় না।
বুঝতে পারিনি। অশ্বত্থ গাছের নিচে সাদা চাদরে শায়িত মানুষটি বিবশ করে রেখেছিল। আমি এক পা পিছনে বা দুই পা এগিয়ে যাব তেমন অবস্থানে ছিলাম না। বুঝতেই পারিনি, কখন তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঠিক আমার পাশে। তারপরে বললেন,- কি দেখছ?
আমি বললাম,- আপনিও কি দেখছেন?
যেদিন খুব ভোরে উঠে পড়ি সেদিন দেখতে পাই। ঠিক আজকের মতো ভোরেই।
লোকটি কি রোজ এমন অশ্বত্থ গাছের নিচে শুয়ে থাকে?
তা বলতে পারব না। তবে বললাম যে, যেদিন তাড়াতাড়ি সকালে ঘুম ভেঙ্গে যায়, সেদিন দেখতে পাই। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলে, মানে আমি একা যদি দেখি তবে দেখতে পাই।
আজকে আমরা যে দুইজনেই দেখছি।
ঠিক তা নয়, যখন আমি দেখতে পারছি, তখন তুমি দেখতে পারছ না।
এখন আমি দেখতে পারছি।
আমি এখন দেখতে পারছি না। কিন্তু তুমি কি দেখতে পারছ, আমি জানি।
আমি দেখছি আপাদমস্তক ধবধবে সাদা চাদর গায়ে দিয়ে একটি লোক শুয়ে আছে। লোকটি কে? আপনি তাঁকে চেনেন?
ইন্দর সিং।
সে কে?
সেন্ট্রাল কম্যান্ডের তেতাল্লিশ নম্বর ব্যাটেলিয়ানের ফৌজি। শিখ ফৌজি।
ও গাছতলায় ঘুমোচ্ছে কেন?
ও এখানেই ঘুমোয়। এখানেই ঘুমিয়ে থাকে।
ও নিজের কোয়ার্টারে ঘুমোয় না কেন?
মাঠের ওইদিকে দূরে দেখ। সারি সারি ইট রঙয়ের ফৌজি কোয়ার্টার দেখতে পারছ? ওখানেই থাকত। এখন ওখানে থাকে না। এই গাছের নিচে থাকে।
তাই বলে একজন ফৌজিকে গাছের নিচে থাকতে হবে?
এখানেই থাকে। আমি যতদিন এখানে এসেছি, ততদিন ইন্দর সিংকে এখানেই দেখছি।
নিজের কোয়ার্টারে থাকে না?
এখানেই থাকে।
কেন এখানে থাকে?
ও মৃত। মৃত ফৌজি কোয়ার্টারে থাকে না। তাই ও এখানেই থাকে। খুব ভোরে একা থাকলে ওকে দেখা যায়। তুমি কি এখনও ওকে দেখতে পারছ?
হ্যাঁ, দেখছি তো।
আমি ওকে ইন্দর সিং বলে ডাকছি। দেখবে ওকে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে ওকে আর দেখতে পারবে না। এই শোনো আমি ডাকছি…ইন্দর সিং… ইন্দর সিং…
স্যান্যাল বাবু যতটা গলা ছেড়ে পারলেন, ডাকলেন,- ইন্দর সিং… ইন্দর সিং…
আশ্চর্য !!!
স্যান্যালবাবু হাসতে হাসতে বললেন,- এখন দেখতে পারছ?
তাই তো বলছি, এখন দেখতে পারছিনা।
ইন্দর সিং মৃত।

তিনদিন পরে, আবার সেই তিনটি বড়সড় আকারের টাঙ্গা এল। মাল বোঝাই হল। আমরা চললাম, মথুরা শহরের আরও গভীরে। যমুনা নদীর আরও কাছে। গাঙ্গুলি জমিদার বাড়িতে। চমৎকার আবাসন গড়ে তুলেছে সামরিক বাহিনী। আগের দিনের দাপুটে জমিদার বাড়ির যেমন খাস বাড়ি, অনেকটা সেই বাড়ির মতোই। ছাদের মাথায়, ত্রিভুজ খিলানের মতো, বড় বড় মোটা থাম। ছোটো ছোটো ইটের ও সুরকির গাঁথনি। সামনে প্রশস্ত বারান্দা। অনেকগুলি ঘর। উত্তর থেকে দক্ষিণ খাস বাড়িটি আয়তনে বিক্ষিপ্ত হলেও গোটা ক্ষেত্রটিতে মোট চার পাঁচটি সামরিক বাহিনীতে কর্মরত কর্মীদের পরিবার থাকত। আমাদের পরিবারের জন্য এত ঘর বরাদ্দ ছিল, আমরা সমস্ত ঘর ব্যবহার করতে পারতাম না। বড় বড় ঘর। বড় বড় লাল পাথর পেতে দেওয়া মেঝে। পুরু দেওয়াল। বড় বড় জানালা। জনালার পাল্লাগুলি ওজনে এত ভারি বন্ধ বা খুলতে হলে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হত। গোটা বাড়িটিই সুরকির গাঁথনি। মাঝে মাঝে বেশ কিছু জায়গায় সুরকির নলচে হি হি করে হাসছে। বাবা খুবই অবাক হয়েছিলেন, বলেছিলেন,- বাঙ্গালিরা ভারতবর্ষের সব শহরেই নিজেদের অস্তিত্বের পতাকা পুঁতে রেখেছে। এ কম বড় কথা নয়।
বাঙালি হিসেবে এই কথার মর্ম বুঝে গর্বিত হওয়ার মতো মানসিক অবস্থা ও বোধ আমার আরও পরে গড়ে উঠেছিল।
বেশ কয়েক বছর আগে নাগিব মাহফুজের লেখায় ঠিক এই বাড়িটির মতোই প্রাচীনকালের একটি বাড়ির বিবরণ পেয়েছিলাম, অনেক অনেক বছর পরে। স্মৃতি থেকে মেলাতে চেষ্টা করেছিলাম গাঙ্গুলি মহলের মতো বাড়িটিকে। বিশেষ করে কায়রো শহরের সংগ্রহশালার চমৎকার বিবরণের কথা জেনেছিলাম নাগিব মাহফুজের “ও রেস্পেকটেড স্যার” একটি ছোটো আয়তনের উপন্যাসে। বাড়ির ভিতরে বাড়ি যেমন, ঘরের ভিতরে ঘর, ছাদের নিচে উঠোনের মধ্যে আরেকটি অন্ধকার আচ্ছন্ন উঠোন, পাশে সামান্য আলোর কেদারায় স্নানঘর শৌচালয় পাশেই ঘন অন্ধকার, এমন একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে, আমার মনে হত, গত জন্মের পরবাসে এই জীবন প্রত্নযামিনীর সহোদর হয়ে উঠেছে।
২০০৮ সালে আমার একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, গ্রন্থটির নাম দিয়েছিলাম এই কথা মনে রেখেই। “প্রত্নযামিনী”। এই বাড়িটির কথা মনে রেখেই লিখেছিলাম প্রত্নযামিনী গল্পটি। মানুষের স্মৃতি একটি পুরানো বাড়ি বা সংগ্রহশালার মতোই।
বেশ মনে আছে মা একদিন বাবাকে রাতের দিকে বলছিলেন, সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন কেন জানি কারও হেঁটে চলে ফেরার শব্দ শুনতে পাই।
বাবা বলেছিলেন, পুরানো বাড়ি আর অন্ধকার এমনই রহস্য সৃষ্টি করে। শব্দহীন পরিবেশে পুরানো বাড়িতে মানুষের বা কোনো জন্তুর হেঁটে চলে ফেরা যাওয়ার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।
মা বললেন, হাত নাকের কাছে নিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি, শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক আছে কি না?
তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
শরীর অসাড় হয়ে আসে যে। তুমি কি কোনোদিন অশরীরীর হেঁটে চলার শব্দ শুনেছ?
আমি অশরীরী বিশ্বাস করিনা। তুমি যদি ভাবো হাওয়া বাতাস অশরীরী তা হলে তোমার ভাবনাকে ভাঙ্গবে কে? বিশ্বাস ও কাল্পনিক শব্দভ্রম সহজে ভাঙ্গেনা। এটি একটি অপসংস্কারের মায়া। পুরানো বাড়িতে এমন হয়। মনে হয় অশরীরী চলাফেরা করে।
মা যেন এই হাহাকার বাড়িতে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেছিলেন। সংসারের কাজের মাঝে তিনি আমাদের সঙ্গে অনেক কথাই বলতেন। চুপ করে যাওয়া আমার মা, যার অনবরত কথায় ঝর্ণার জলের পতনের শব্দ অনুভূত হত, আমার সেই মা কোথায়? কাজ করছেন, কাজ করতে করতে ঘরের দেওয়াল দেখছেন, সিলিং ফ্যান দেখছেন, বড় বড় হা হুতাসের মতো জানালার কপাট দেখছেন। ওই জানালার দিকে তাকিয়ে মা বললেন,- শীত আসছে। এখানে না কি ভয়ংকর ঠাণ্ডা পড়ে। অনেকেই না কি ঘরের ভিতরে উনুন জ্বালিয়ে রাখে।
ভিন দেশের শীত গ্রীষ্ম সম্পর্কে আমাদের সবার ধারণাই নেই। বাবার কিছুটা আছে। বাবার ভিন প্রদেশের থাকার অনেক অভিজ্ঞতা আছে। টানাটানির সংসার আমাদের। মথুরার শীতকে যুঝতে গেলে শীতের পর্যাপ্ত বস্ত্র চাই, শরীরকে উষ্ণ রাখতে হলে আয়োজন চাই। আর সেই আয়োজনের জন্য চাই অর্থ। সেই কথাই মা বলছিলেন বাবাকে। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,- পানাগড় থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে মথুরা, আর দম ফেলতে পারছিনা। দেখি সামনের মাসের মাইনা হলে, ওদের সোয়েটার কিনে রাখতে হবে।
তুমি কি ভেবেছ ওদের জন্য সোয়েটার নেই? নিজে হাতেই কত বুনে রেখেছি।
ওগুলো ন্যাপথলিন দিয়ে ভালো করে রেখে দাও। কলকাতায় ফিরে গেলে কাজে লাগবে। ওই উলের সোয়েটার এখানকার শীত মানবে না। যে দেশে যেমন শীত সেখানে গরম পোশাকের আয়োজন তেমন। মাইনে হোক, দোকানে গিয়ে দেখে কিনে নেব। এখানে লুধিয়ানার গরম পোশাকের খুব চল আছে। দামেও সস্তা হয়।
টানাটানির সংসারে কথা ও ইচ্ছের মধ্যে কত নিয়ন্ত্রণ থাকে সেটি বাবা মায়ের পারস্পরিক কথার মধ্য দিয়েই জেনেছিলাম।
বাড়িটির ফাঁকা শূন্য ঘরগুলিতে নিজেই পায়চারি করে, খুঁজে যেতাম বাড়িটির মধ্যে আর কেউ বসবাস করে কি না? একটি অজানা মানুষের সন্ধান করতাম, একটি জাদুরহস্যের প্রদীপের মালিক যার নাম আলাদীন। একটি তালাবন্দি বেশ বড় আকারের ঘর ছিল। বাড়িটির চারধারে আশাপাশে যারা থাকত, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, স্মৃতি খুব যদি বিরোধ না করে, তিনি মনোহর পাণ্ডেজি। বলেছিলেন, ওটি বাঙালিবাবুদের বিলাসিতার ঘর ছিল। নাচ গান খানাপিনা চলত। সন্তুর বেহালা বেজে উঠত, খঞ্জনি ও পাখোয়াজের শব্দে এই বর্তমান শ্মশানভূমি আলোকিত হয়ে উঠত। শুনেছি ওই ঘরের ভিতরে এখনও অনেক আসবাব ও সঙ্গীতের যন্ত্র আছে, অনেক কিছুই আছে। সামরিক বাহিনীর অফিসে তার তালিকা রাখা আছে। সামরিক বাহিনী বাড়িটিকে হেরিটেজ মনে করলেও মেরামতি করে আধুনিকতার রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছিল।
মনোহর পাণ্ডেজি এই কথা বলার পরে, আমি প্রায়ই ওই ঘরটি থেকে নূপুরের শব্দ শুনতে পেতাম। বহু বছর পরে যখন আমি হিন্দি ছবি মজিয়ে দেখছি, ‘সাহেব বিবি আউর গোলাম’ ছবির সেই গানটি মনে পড়লে, ‘ও পিয়া আজ মোহে নীদ নহী আয়ে’ গানটির কথা মনে পড়লেই আমার গাঙ্গুলি বাড়ির সেই ঘরটির কথা মনে পড়ে যেত। জীবনের অনেক স্মৃতিকে বিরল কিছু সিনেমার গান মিলিয়ে দেয়। আবার অনেক গান স্মৃতিকে নির্মাণ করে। আমার জীবনের স্মৃতির সঙ্গে অনেক ছায়াছবির গান আজও যুক্ত হয়ে আছে।

Facebook Comments

1 thought on “কাশবনের ভাস্কর্য : শুভংকর গুহ Leave a comment

Leave a Reply