বর্ণাশ্রম, অপর, সমাজ এবং দুটি রামায়ণ কেন্দ্রিক সংস্কৃত নাটক : রাম চরিত্রের বিবর্তন তথা রামায়ণের বহুপাঠ – শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অঙ্ক – শূদ্র, সম্পদ, মন্দির এবং আদর্শ ভ্রাতা

দ্বিতীয় অঙ্কে শয্যা নিয়েছেন দশরথ। শুরুতে একটি মিশ্র বিষ্কম্ভক আছে। তাতে আমরা জানতে পাই রাম-সীতা-লক্ষ্মণ চলে গেছেন বনে। তারপরে, দশরথ, তাঁর দুই রাণী কৌশল্যা এবং সুমিত্রার সঙ্গে প্রবেশ করেন। কৈকেয়ী নেই এ দৃশ্যে স্বাভাবিক ভাবেই। বিলাপ করতে করতে দশরথ মূর্ছা যাচ্ছেন এবং জ্ঞান ফিরে পাচ্ছেন. এই বিলাপের মধ্যে দিয়ে নাটকটি যে আলাদা করে খুব এগিয়েছে এমন নয়, কিন্তু মানবিক কিছু দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে। বিশেষ করে দশরথের দুটি জায়গায় সংলাপ নাটককারের মানবচরিত্র দর্শনের আন্তরিকতাকে আবার প্রতিষ্ঠিত করছে। একটি জায়গায় দশরথ রাম এবং লক্ষ্মণকে সূর্য ও দিনের সঙ্গে তুলনা করছেন। সূর্যের সঙ্গে সঙ্গে দিন চলে গেল, যেমন রামের সঙ্গে লক্ষ্মণ। আর ছায়ার মত সীতাও সূর্য ও দিনের অবসানে অপসৃতা হলেন। কাব্যিক সৌন্দর্য এর অনুপম। সঙ্গে নিজের অপারগতা এবং কৈকেয়ীর কাণ্ডের জন্য দুর্দৈবকে বলছেন, তিনি নিঃসন্তান হলেন না কেন! রাম কেন অন্য রাজার সন্তান হল না! আর কৈকেয়ী কেন বনের ব্যাঘ্রী হল না। রাজার বিলাপ আর সাধারণের বিলাপের পদ্ধতির কোনো পার্থক্য পাওয়া যাচ্ছে না এখানে।
আরেকটি জায়গায় সুমন্ত্র যখন রাম-লক্ষ্মণ-সীতাকে বনপ্রান্তে ছেড়ে তাঁর কাছে ফিরছেন তখন তাঁদের কথা শুনতে চাইছেন। সুমন্ত্র রাম-লক্ষ্মণ-সীতা এই ক্রমে সংবাদ দিচ্ছিলেন বলে দশরথ তাঁকে ক্রম সংশোধনের নির্দেশ দিচ্ছেন। রাম-সীতা-লক্ষ্মণ এই ক্রমে সংবাদ শুনবেন। এই ক্রমে নামগুলি শুনলেও তাঁর মনে হবে অরণ্যে মৈথিলী অনাথ থাকবে না। এই যে সীতার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনা এও খুব সুক্ষ্মতার সাহায্যে নাটককার ফুটিয়ে তুলেছেন। সঙ্গে যা ফুটেছে তা হল নারী সম্বন্ধিয় ভাবনা রাজ-পরিবারে। এক রাজকন্যা, রাজপুত্রের স্ত্রী বনে চলেছে। বন এমন অঞ্চল নয় যেখানে অন্য কোনো নারী (পুরুষ তো বটেই) বসবাস করে না। রামায়ণ জুড়ে আমরা দেখতে পাই নারী রাক্ষসীদের। বল-বীর্যমত্ততায় তাঁরা যথেষ্ট। তাঁরা সর্বদাই দলে দলে বিচরণ করেন এমনও না। একাকীই বহুক্ষেত্রে আমরা তাঁদের পাব, যুদ্ধেও লিপ্ত হতে দেখব। অথচ রাজকন্যা এতই নরম যে তাঁর সঙ্গে পুরুষ না থাকলে প্রতিরক্ষা অসম্ভব? এখানেও তথাকথিত বর্ণাশ্রমবাদী এবং বর্ণবিহীন সমাজে নারীর অবস্থানের পার্থক্য লক্ষিত হয়।
যাই হোক, আরেক জায়গাতে নাটককার সুক্ষ্ম অনুভূতির তুঙ্গ স্পর্শ করছেন রথ থেকে শৃঙ্গবেরপুরে এঁদের অবতরণ কালের ঘটনায়। সেখানে অবতরণ করে দশরথকে তাঁরা প্রণাম করে কিছু বলতে আরম্ভ করেন। কিন্তু কন্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হওয়ায় অধর কম্পিত হতে থাকলেও বাক্য নির্গত হল না। তাঁরা বনেই চলে গেলেন। এ এক অপরূপ সুক্ষ্মতা। যে সংসার প্রাণাধিক, সে সংসার থেকে চলে যেতে হলে কত কথাই বা বলতে পারে মানুষ। বাক্য নয়, নৈঃশব্দ এবং শোকেই তার পূর্ণ মর্যাদা ফুটে ওঠে যেন।
দ্বিতীয় অঙ্ক নাটকের গতির ক্ষেত্রে পৃথক কিছু সংযোজন করেনি। দশরথের অন্তিম মূর্চ্ছা অবধি পৌঁছে থেকে গিয়েছে। কিন্তু স্থানের ঐক্য বজায় রাখতে কিঞ্চিত সহায়তা করেছে। ভাব ও রসের বিস্তারের উপযোগী সময় নিয়েছে। তৃতীয় অঙ্ক, এই নাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্ক। বস্তুত, ভাবনার দিক থেকে এই অঙ্ক মৌলিকতায় উৎকৃষ্টতর।
এ অঙ্কের স্থান মন্দির। অভিষেক পণ্ড। দশরথ মৃত। তাঁর প্রতিমাগৃহ দর্শনের জন্য কৌশল্যা এবং অন্যান্য অন্তঃপুরচারিণীরা আসবেন সেখানে। এই প্রতিমাগৃহ, ধারণাটি খুব কৌতুহলজনক ধারণা। পুরাতত্ত্ব এ বিষয় সাক্ষ্য দেয় যে এই উপমহাদেশে প্রাচীন কাল থেকে ব্যক্তির প্রতিমা গড়ার কাজটি শুরু হয়েছে। অবশ্যই সেই সকল ব্যক্তির যাঁরা সমাজের পিরামিডাকার চেহারার উপরের দিকের। যেমন তারানন্দ মিশ্রের লেখা থেকে নেপালের মালিগাঁও-এ পাওয়া জয়বর্মার মূর্তির কথা এখানে মনে করাই। তিনি আবিষ্কারের প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে লিচ্ছবি রাজা মনদেব-এর মনগৃহ এবং পরবর্তী আরেক রাজা অংশুবর্মার মহল ছাড়াও, আরেকটি মহল আবিষ্কৃত হবার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। সেই মহলটি দেবকূল অথবা চিত্রশালা – অর্থাৎ বর্মা রাজাদের প্রতিকৃতিশালা।
ভাসের নাটকে আমরা এমন প্রতিকৃতিশালা পেলাম। প্রাচীনকালে এই জাতীয় মাটি বা পাথর দিয়ে প্রস্তুত প্রতিকৃতির ক্ষেত্রে নানারকম নাম ব্যবহার করা হত, যেমন প্রতিমা, চিত্র, কৃতকৃতী, প্রতিবিম্ব, মূর্তি, শালিকা। ভাসের নাটক ছাড়াও প্রতিমার কথা আছে নানা সাহিত্যিক উপাদানে। আমরা শুধুমাত্র দুটি মহাকাব্যের দিকে চাইলেই জানতে পারি এর ব্যবহারের কথা। রামায়ণেই আছে, রাম যজ্ঞ করছেন স্বর্ণসীতা প্রস্তুত করে। মহাভারতে আছে একলব্যের অরণ্যে দ্রোণাচার্যের মূর্তি গড়ে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষার কথা। আছে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধশেষে ধৃতরাষ্ট্রের সামনে লৌহ ভীম উপস্থিত করার কথা। আর ভাস ছাড়াও কালিদাসের ‘রঘুবংশ’-এও আছে প্রতিকৃতি মৃত ব্যক্তির স্মৃতিধারণ করে থাকে। সুতরাং, ভাসের নাটকে প্রতিমা গৃহ থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এর ব্যবহার নাটকীয় কৌশলের দক্ষতার প্রমাণ।
অঙ্কটি শুরু হচ্ছে ভট এবং সুধাকরের সংলাপের মধ্যে দিয়ে। সুধাকর ঝাঁটা হাতে নিয়ে প্রবেশ করেছিল। বহক্ষণ কাজ করেছে সে। এবারে ঘুমোতে চায়। ভট বা প্রহরী প্রবেশ করে। যথাবিহিত প্রহরীর চরিত্রের কাণ্ডই প্রহরী করে। ঘুমন্ত সুধাকরকে মারতে শুরু করে। সুধাকর অত্যাচারিত হয়ে বলে কার্তবীর্যের মত তার হাজার হাত থাকলে সেও মারতো প্রহরীকে। ভট তাকে দাসীপুত্র বলে সম্বোধন করে আবার মারতে শুরু করে। সে মার থামাতে সুধাকর অবশেষে তার কাজের ফিরিস্তি দেয়। বিপুল সে কাজের তালিকা। দশরথের মৃত্যুর পরে রাণীরা এবং অন্তঃপুরবাসীরা আসবেন তাঁর প্রতিমাগৃহ দেখতে। তার জন্য কাজের যাবতীয় দায় সুধাকরের কাঁধে ছিল।
এখানে নাটকের সঙ্গে সঙ্গে চলার আগে আমরা একটি শব্দকে এবং সংলগ্ন কার্যকে কিছুটা গুরুত্ব দেব। শব্দটি হল ‘দাসীপুত্র’। এই আলোচনাটি আমরা করব, ১৯৩৫ সালের ২৭শে জুলাই-এ তৎকালে বোম্বে (এখন মুম্বই) হাইকোর্ট-এর একটি রায়ের উপরে ভিত্তি করে। রামচন্দ্র ডোড্ডাপ্পা নায়েক বনাম হামাননায়েক ডোডনায়েক পাটিল-এর মামলা। প্রশ্ন উঠতে পারে, নাটক আলোচনায় আদালত কেন! আসলে নাটকের এই অঙ্কে (নাট্যশাস্ত্রের ব্রাহ্মণ্য চরিত্রের আগে বলেও উল্লেখযোগ্য) নাটককার এমন কিছু বিষয় দেখিয়ে ফেলেছেন যা বর্ণাশ্রম এবং তার ফলশ্রুত বৈষম্যের সঙ্গে জড়িত। সে ফল যে শুধু নাটককারের যুগেই ছিল তাই নয়, ১৯৩৫-এও জ্বলজ্বল করছিল। আজকের ভারতবর্ষেও জ্বলজ্বল করছে।
আদালতের মামলাটি লিখি। বাকী কথা সে সব প্রসঙ্গেই চলে আসবে। ডোড্ডাপ্পানায়েক একজন শূদ্র। তাঁর দুই শূদ্রা স্ত্রী ছিলেন। আরেকজন ব্রাহ্মণ বংশীয় বিধবা, দীর্ঘকাল তাঁর উপপত্নী হয়ে বসবাস করেছেন তাঁর সঙ্গে। একটি সন্তানের জন্মও দিয়েছেন। মামলার মূল প্রশ্ন ছিল, সেই সন্তান কি ‘দাসীপুত্র’? ‘দাসীপুত্র’ এই সম্বোধনের উপর নির্ভর করছিল তাঁর পিতার সম্পত্তির ভাগ পাওয়া। বাদীরা, ডোড্ডাপ্পানায়েকের দুই শূদ্রা স্ত্রী-র সন্তান এবং ভাইপো/বোনপোরা। তাঁদের দাবী ছিল শূদ্র ডোড্ডাপ্পানায়েকের উপপত্নীর সন্তান বৈধ বা অবৈধ কোনোটাই নয়, ভাগ তো দূরস্থান, সম্পত্তি থেকে খাইখরচা পাওয়ারও দাবী করতে পারে না। এই মামলায় প্রচুর শাস্ত্রাদি ঘাঁটা হয়েছিল, যেহেতু বিচার হচ্ছিল হিন্দু আইনের আওতায়।
ট্রায়াল কোর্ট, রায় দিয়েছিল, সেই সন্তান ‘দাসীপুত্র’। কেন? ট্রায়ালের বিচারক, অপস্তম্ব স্মৃতির একটি অংশকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সেখানে বলা আছে, যে ব্রাহ্মণ একমাসও শূদ্রের (প্রদত্ত) খাবার খায় তাহলে সে এ জন্মে তো শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হবেই, পরজন্মে কুকুর হয়ে জন্মাবে। সেই সূত্রে বিচারক ভেবেছিলেন, ব্রাহ্মণ বিধবা যখন শূদ্রের উপপত্নী, তখন শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। তাই শূদ্রের সন্তানের জন্ম দিলে তিনি শূদ্র হিসেবেই বিবেচিত হবেন। অতএব এই সন্তানের ডোড্ডানায়েকের সম্পত্তির অংশ পাওয়া উচিত। কারণ শূদ্রের দ্বারা শূদ্রার গর্ভের সন্তান বলে সে ‘দাসীপুত্র’। উচ্চ আদালত বলছে, আবেদনকারীর (বিবাদী) বক্তব্য ‘দাসী’ বলতে ধরা হয় প্রকৃত অর্থে ‘দাসী’কে। অথবা পরকীয়া নয়, অজাচার নয়, একটানা অবৈধভাবে থাকা নারীকে ‘দাসী’ বলা যায়। অন্যদিকে উত্তরদাতারা (বাদীপক্ষ) বলছে, সাধারণত ‘দাসী’ বলা চলে একমাত্র শূদ্রা নারীকে। তাই ‘দাসীপুত্র’ বলতে শূদ্রানারীর গর্ভজাত পুত্রই বোঝাতে পারে।
উচ্চ আদালত, অন্য একটি মামলার কথা তুলে আনছেন। সেখানে শূদ্র পুরুষের সঙ্গে অন্য নারীর সম্পর্ক বিচার হয়েছিল। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রাহ্মণ বংশীয় নারীর সঙ্গে শূদ্র পুরুষের বৈধ বিবাহই সম্ভব নয়। কারণ তা প্রতিলোম বিবাহ। নারী উচ্চবর্ণের, পুরুষ নিম্নবর্ণের। কাজেই সে ব্রাহ্মণ বংশীয় নারীর, ওই শূদ্র পুরুষের সম্পদে কোনো অধিকার নেই। হ্যাঁ, টানা একসঙ্গে থাকলে তবু তার রক্ষিতা হিসেবে খোরপোষ চাইতে পারে। এই প্রসঙ্গেই এসেছে যাজ্ঞ্যবল্ক স্মৃতির প্রসঙ্গ। সেই স্মৃতিশাস্ত্র কি বলছে? সে ব্রাহ্মণ বংশীয় নারীর সঙ্গে অন্য তিন বর্ণের পুরুষের সম্পর্কের ফলে জন্মানো সন্তানের জাতের কথা বলছে। ক্ষত্রিয় থেকে জন্ম নিলে সুত, বৈশ্য থেকে জন্ম নিলে বৈদেহক আর শূদ্রের থেকে জন্ম নিলে চণ্ডাল। চণ্ডালের সমস্ত ধর্ম থেকে নির্বাসন হবে।
আদালত নিজেই বলছে, অবাক লাগতে পারে যে, শূদ্রের শূদ্রাণী রক্ষিতাদের সন্তান শূদ্রের সম্পত্তি পেতে পারে, কিন্তু ব্রাহ্মণ বংশীয় নারীর ক্ষেত্রে পারে না এই দেখে। ব্রাহ্মণ নারী তো শূদ্রার থেকে উঁচু জাত। কিন্তু অবাক লাগার কারণ নেই। এই বিধানের কারণ হল শূদ্র পুরুষ এবং ব্রাহ্মণ নারীর সম্পর্ক এত ঘৃণ্য যে কোনোভাবেই একে প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। জাতি ধ্বংস হয় এতে। তাই এই চণ্ডাল বলে নির্বাসনের বিধান এবং সম্পত্তির অধিকার না দেওয়া। উচ্চ আদালত এরপরে ট্রায়াল কোর্টের রায়কে খারিজ করে নিম্ন আদালতের রায়কেই বহাল রাখেন। সে রায় ছিল, এই ব্রাহ্মণ বংশীয় নারীর সন্তান ‘দাসীপুত্র’-এর স্বীকৃতি পাবে না।
এখানে এ মামলার কথা শেষ করার আগে আরো দু-একটি কথা বলে নিই। ট্রায়াল কোর্ট যে রায় দিয়েছিল তা সেই সন্তানের সম্পত্তির অধিকারের পক্ষে গিয়েছিল। তার কারণ কি পিতা-মাতা-সন্তান সম্পর্কের প্রতি তার মানবিক সহমর্মিতা? না। সে সহমর্মিতা থাকলে অপস্তম্ব স্মৃতির ব্রাহ্মণের শূদ্রান্ন ভোজনে কুকুর হবার কথা আসতো না। এ রায়কেও একদিক থেকে দেখলে ঘৃণার রায়ই বলা চলে। কার্যকরীভাবে সম্পত্তির ভাগ পাবার অধিকার সেই ব্রাহ্মণ বংশীয় নারীর সন্তানের হাতে যেত বটে, সম্মান যেত না। সেই ঘৃণাকে আরো উচ্চতর ঘৃণা দিয়ে সেই দিন উচ্চ আদালত মুছে ওই রায় বদলে দিয়েছিল। ‘দাসীপুত্র’ কাকে বলে তার বিবেচনা করেছিল। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল। সেদিনের ওই মামলায় শূদ্র ডোড্ডানায়েকের সঙ্গে ব্রাহ্মণ বংশীয় নারীর সম্পর্কে জন্মানো সন্তানের নাম ছিল রামচন্দ্র।
১৯৩৫-এও যদি এই অবস্থা থেকে থাকে তাহলে এই নাটকে ভট বা প্রহরী যে কেমন কাজ হয়েছে সে সব না দেখেই সুধাকরকে মারতে শুরু করবে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু আছে? ভট শব্দের অর্থ অনেক। যোদ্ধা, বীর থেকে শুরু করে নীচজাতি, ম্লেচ্ছ, রাত্রিচর। এখানে ভট কোন জাতির অথবা বর্ণের জানার রাস্তা খুব একটা নেই। কিন্তু তার হাতে যে ক্ষমতা আছে তা বিলক্ষণ জানা যাচ্ছে। কাজ না দেখেই সে মারতে পারে দাসীপুত্রকে, যে শূদ্রবংশজ। এবং শূদ্রও যে তাকে পাল্টা মারার ইচ্ছে অন্তত পোষণ করে তার পরিচয়ও এই নাটককার কিন্তু নাটকে রেখে গিয়েছেন। আমরা বোম্বে হাইকোর্টের যে মামলাটিকে ব্যবহার করেছিলাম, তাতে অন্য অনেক কিছুর মত এ কথাও কিন্তু স্পষ্টই ছিল যে শূদ্রও যদি সম্পদশালী হয়, তাহলে অন্যকে বঞ্চিত করার আগ্রহ তার অন্য কোনো বর্ণের চাইতে কম হয় না। আবার এখানে, নাট্যশাস্ত্র পূর্ববর্তী যুগের (হেতু আগেই আলোচিত) নাটক জানাচ্ছে, শূদ্র অসহায় হলেও, প্রজন্ম বাহিত দাসত্ব বয়ে চললেও, তার মনেও সংক্ষোভ আছে, ক্রোধ আছে। সুযোগ পেলে সেও পাল্টা মারার কথা ভাবে।
প্রতিমাগৃহের জন্য তার কাজের তালিকাটা এখানে একবার দেখে নিই। তাহলে আমরা খানিক বুঝতে পারব শ্রমের সঙ্গে তার সম্পর্কটা, যা আমাদের পরবর্তী ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। পায়রা ঢোকা বন্ধ করার জন্য যে জাল দিয়ে ঘিরে রাখা ছিল গর্ভগৃহ, তা সে সরিয়ে দিয়েছে। প্রতিমাগৃহটি যত বড় এবং উচ্চ তত বড় কিছু রাজপ্রাসাদে মেলাও দুর্ভর। নাটকে কিছু পরেই এমন সংলাপ আমরা পাব। অর্থাৎ স্রেফ জাল সরাতেই তার খাটুনি কম নয়। তার সঙ্গে সে অত বড় এবং উচ্চ জায়গার দেওয়ালে চুনকামও করেছে। করে পাঁচ আঙুলের ছাপও মেরেছে। এখানেই শেষ নয়। দুয়ারের মাথায়, যা বেশ উঁচু, সেখানে ফুলের মালা ঝুলিয়ে সাজিয়েছে। বালু ছড়িয়েছে। সঙ্গে ঝাঁটা হাতে তার প্রবেশ নিশ্চিত করছে, সে সম্পূর্ণ প্রতিমাগৃহ পরিস্কারের কাজও করেছে পাশাপাশি।
একা একজন মানুষ, এতটা শ্রমের কাজ করেছে। তারপর সে বিশ্রাম নিতে গেছে বলে মার খেল! কেন? কারণ, সে বা তার মত মানুষের শ্রমেই গড়ে উঠেছিল ওই সমাজ, যে সমাজ তাকে সবচাইতে নিম্নবর্ণ হিসেবে দেখে। তার পরিশ্রমের ফসল নেয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য (অবস্থাসম্পন্ন)। সে কী পায়? অপমান, নির্যাতন ইত্যাদি। শ্রমের মূল্য? দাসের বেঁচে থাকাটুকুই যা মূল্যবান। বাকীতে তার অধিকার সে সমাজ স্বীকার করেনি। নাটককার এইখানে প্রসঙ্গটি এনে সামাজিক চালচিত্রে কিন্তু যথাসম্ভব সত্যনিষ্ঠ থেকেছেন। দশরথ রাজত্ব যা পরে রামরাজত্ব হবে তার সব ভারী ভাল, ভারী অপূর্ব এমন গোদা প্রলেপ দেননি। দেননি বলে রামায়ণে শূদ্র শম্বুক বধ জাতীয় কাণ্ড যতই প্রক্ষিপ্ত হয়ে থাকুক না কেন, তার সম্ভাবনাকে নাটকের এই অংশ আরো দৃঢ় করেছে।
যে শাসকদের রাজত্বে এভাবে বিনা অপরাধে শ্রমিক শূদ্র মার খায় বা খেতে পারে, সে শাসকদের শাসনে সশরীরে স্বর্গে যেতে চাওয়া শূদ্র সন্ন্যাসী বধ হবে না? প্রথমত, সশরীরে স্বর্গে যাবার ক্ষেত্রে তিনজন পুরাণ অনুসারে সফল। এক নহুষ, দুই তাঁরই বংশধর পাণ্ডব যুধিষ্ঠির। নহুষকে স্বর্গে নিয়ে যেতে হয়েছিল স্বর্গের শাসনের প্রয়োজনে। আবার তাকে নাগ বা সর্পে রূপান্তরিত করা হয়েছিল যখনই সে স্বর্গের নারী, প্রাক্তন ইন্দ্রপত্নীকে (যে ইন্দ্র সমগ্র পুরাণজুড়ে অসংখ্য লাম্পট্যের পরিচয় দিয়েছে) বিবাহ করতে চাওয়ার অপরাধে। শচীর না চাওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শচীর না চাওয়ার পিছনে আরো খেলা থাকতে পারে। মানব নহুষ আর স্বর্গাধীপের স্ত্রী-র বিবাহ হলে যে সন্তান হবে সে তো দেবাংশীই। দেবতারা এসে মানবীর গর্ভে উৎপাদন করতে পারেন, উচ্চস্থানে আসীন বলে, মানব তা করবে কেন? পুরাণকারেদের বা মহাকাব্যকারেদের এ ভাবনাও কাজ করেনি এমন আজ আর বলা চলে না। অপ্সরারা স্বর্গে থাকে, কিন্তু স্বর্গীয় নয় সে অর্থে। তারা পারে জন্ম দিতে মানবের সঙ্গে সঙ্গমে, স্বর্গীয় দেবীরা নৈব নৈব চ।
দ্বিতীয় হলেন যুধিষ্ঠির, যিনি বর্ণাশ্রম ধর্ম দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠা করে, দেবতাদের সম্মান, বেদের এই জাতীয় বিধানের সম্মান প্রতিষ্ঠা করেছেন। করেছেন ভারী নড়বড়ে এক সময়, যখন শ্রামণিকেরা সব কিছুকেই দ্বন্দ্বের মুখে ফেলে দিচ্ছে। অতএব এমন কাহিনীর নায়ককে একবার টুক করে নরক দেখিয়ে স্বর্গে নেওয়াই চলে। সঙ্গের কুকুরটি আবার ধর্ম স্বয়ং। কিন্তু ত্রিশঙ্কুকে সশরীরে স্বর্গে যেতে দেননি পুরাণকারেরা। আবার বিশ্বামিত্রের প্রতিপত্তি খর্ব করার সাহসও পাননি বলে বিশ্বামিত্রকে দিয়ে ত্রিশঙ্কুর জন্য পৃথক ব্রহ্মাণ্ড এবং পৃথক স্বর্গ রচনা করতে দিয়েছেন। শুধু মার্কন্ডেয় পুরাণে হরিশ্চন্দ্র তাঁর সত্যবাদীতা এবং বিশেষ করে যজ্ঞকারী ব্রাহ্মণের (বিশ্বামিত্র রাজর্ষি থেকে ব্রহ্মর্ষি হয়েছিলেন) জন্য নেওয়া অকল্পনীয় দুঃখকে মর্যাদা দিতে তাঁকে সশরীরে স্বর্গে নিয়ে যেতে চেয়েছেন দেবতারা। তিনি তৃতীয়জন। কিন্তু তিনি একদিনের জন্য হলেও তাঁর প্রজাদের নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যা দেবতারা অনুমোদন করেছিলেন। সেও কিন্তু বর্ণাশ্রম ধর্ম আর দেব-বেদের মহিমা প্রতিষ্ঠার কাহিনী।
শূদ্র ঋষি শম্বুকের ক্ষেত্রে তা হয়নি। তিনি বরং সশরীরে স্বর্গে যেতে চেয়ে বর্ণাশ্রমকে ভেঙে দিতে বসেছিলেন। শূদ্র, যে উপবীত ধারণ থেকে বেদপাঠেরও অযোগ্য সে যাবে স্বর্গে? তাহলে বর্ণধর্ম টিকবে কেমন করে? তাছাড়া আজকের কালে চার্বাকাদিদের রাস্তা ধরলে বলাই যায়, সে তো বুঝেই যেত স্বর্গ বলে কিচ্ছু নেই। উপবাস-টাস করে মরতো স্রেফ। অতএব শূদ্রদের মধ্যে তা ছড়িয়েও যেত। তাহলে তারা বর্ণাশ্রম আর মানত নাকি? অত শূদ্র এক হলে ওই কতিপয় ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়দের সাজানো ব্যবস্থা (কোথাও কোথাও বৈশ্যদেরও) চলতে পারতো? অতএব স্বর্গ আছে কী নেই, পাপ-পূণ্য যেমনটি বলা হচ্ছে তাই কী না সে সবের অনুসন্ধান বন্ধ করার জন্য শম্বুকবধের কাহিনী কাজে লেগেছে। শূদ্র, প্রশ্নহীন ভাবে শ্রম দিলে, অনুগত থাকলে তবেই না বিপুল সম্পদ গড়ে উঠবে, সাম্রাজ্যও কালে কালে। আমাদের নাটককার কিন্তু আনুগত্যের বদলে পাওয়া অত্যাচার যেমন দেখিয়েছেন, তেমন শূদ্রের পালটা মারের ইচ্ছেও গোপন করেননি। সেভাবে দেখতে গেলে পাল্টা মার যে হয়েছিল তার একটা প্রমাণ অন্তত আমাদের হাতেই আছে। মৃচ্ছকটিক (মাটির গাড়ি) নাটকে অভ্যুত্থান আর শূদ্রের সিংহাসন লাভের কাহিনী। অর্থাৎ, ভারতে কখনো দাস বিদ্রোহ হয়নি, শূদ্রবিদ্রোহ হয়নি এ সব যুক্তির বিরোধী উপাদান খুঁজলে ততোটাও অমিল হবে না।
যাই হোক, ফিরে আসি সরাসরি এই নাটকের প্রসঙ্গেই আবার। এই শূদ্র দাসের শ্রমে নির্মিত, পরিচ্ছন্ন থাকা, সুসজ্জিত প্রতিমাগৃহে আসবেন ভরত, এরপরে। মাতুলালয় থেকে তিনি ফিরছেন অযোধ্যা। এত যে কাণ্ড ঘটে গিয়েছে তা তাঁকে তেমন করে জানানো হয়নি। দশরথ অসুস্থ শুনে আসছেন। যেমন সাধারণ পরিবারে চল আছে, কেউ মারা গেলে নিকটজন দূরে থাকলে, সরাসরি দুঃসংবাদ দেওয়া হয় না। তাতে আসার আগেই বা পথে বিপর্যয় ঘটতে পারে। ভরতের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তিনি দ্রুত অযোধ্যায় পৌঁছোতে ইচ্ছুক।
রথে আসছেন। নাটককার ভরতের সংলাপে রথের চলার বর্ণনা দিচ্ছেন। গাছের দল দ্রুত পিছনে সরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা যেন দৌড়ে চলেছে। এই যে পিছনের দিকে চলার বর্ণনা নাটককার দিচ্ছেন, আজকের কালে আমাদের এতে আগ্রহ থাকার কথা নয়। আমরা রেল থেকে মোটরগাড়ি নানা ক্ষেত্রে নিত্য দেখে দেখে খুবই অভ্যস্ত। কিন্তু সেকালে সকলের রথারোহণের ক্ষমতা ছিল না। বড়জোর গরুর বা মহিষের গাড়ি ছিল। তাও চড়তেন কম মানুষই। সেও তো অর্থেরই বিষয়। গরু বা মোষের গাড়িতে বসে গাছেদের পেছনে বড়জোর হেঁটে যেতে দেখা যেতে পারে। তাদের বা হস্তির কারোর গতির সঙ্গেই অশ্বের গতির তুলনা চলে না। অশ্বারোহণের সময় দ্রুত গতিতে আরোহীর নিয়ন্ত্রণের জন্য যে দক্ষতা লাগে, তা পথ দৃশ্য দেখার জন্য সুবিধেজনক নয়। আর অশ্বারোহণও সকলের ক্ষমতায় নেই। সারথীযুক্ত রথের ক্ষেত্রে আরোহীই একমাত্র এই সময় এবং পরিস্থিতি দুই-ই পেতে পারেন। সে দৃশ্যের অভিজ্ঞতাকেও নাটককার গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন সাধারণ দর্শকের জন্য।
তাছাড়াও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, গতির এই বিভ্রম কেন্দ্র করে একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের কথা। প্রাচীন জ্যোতির্বিদ আর্যভটের আবিষ্কার। এই যে আশেপাশের জীবন খুঁটিয়ে দেখার অভ্যাস, এই অভ্যাস থেকেই তিনি ভূ-ভ্রমণের কথা ভাবতে পেরেছিলেন। সে আমলে বিজ্ঞানের সহযোগী এত-শত কৃৎকৌশল ছিল না। শুধু দেখার এবং ভাবার সক্ষমতা দিয়েই তাঁদের জগতের যাবতীয় বিষয়কে বুঝতে হত। এই যে নাটটকার রথগতিকে লক্ষ্য করছেন, এমন ভাবেই নৌকার গতিকে লক্ষ্য করেছিলেন আর্যভট। ভট্ট নয়, ভট, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ছিলেন না তিনি। জ্ঞানচর্চা শুধু ব্রাহ্মণের এমন ধারণাতেও ঘা দেয় এই তথ্য। যাই হোক, তিনি বলছেন, যেমন গতিশীল নৌকার আরোহী তীরের অচল বৃক্ষদের উল্টোদিকে যেতে দেখে, তেমনই লঙ্কাতে (পৃথিবীর গতির জন্য) স্থির নক্ষত্রদের সমবেগে পশ্চিম দিকে যেতে দেখা যায়। নক্ষত্র স্থির ভেবেছেন, এ আজকের যুগে সত্য নয়। কিন্তু পৃথিবীর যে গতি আছে তা নিশ্চিত বুঝেছেন। চল্বা পৃথ্বীস্থিরা ভাতি – পৃথিবীকে স্থির মনে হলেও তা সচল। সেই কালে এ কথা বোঝা খুব কম কথা নয়। পর্যবেক্ষণই এই সব আবিষ্কারে সহায়তা করেছে। এই নাটককারের পর্যবেক্ষণও বহু ক্ষেত্রে অতুলনীয়।
সারথী ভরতকে দশরথের মৃত্যু সংবাদ দিতে পারছেন না। রামের বনবাস, কৈকেয়ীর সম্পদ-বাসনা, এ সবের কথাও জানাতে পারছেন না। রথ অযোধ্যার যখন কাছাকাছি, বিশেষ করে প্রতিমা গৃহের, তখনই ভট প্রবেশ করে। অযোধ্যা থেকে উপাধ্যায়দের পরামর্শ এসেছে। কৃত্তিকা নক্ষত্রের কালে নগরে প্রবেশ করা অশুভ। রোহিনী অনুগমন করবে কৃত্তিকার। সে এলে প্রবেশ করাই ভাল। ভরতও সে সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। এইটাও দেখার বিষয়। নক্ষত্রের শুভাশুভ এ সব গণনার পরম্পরার অর্থ জ্যোতিষচর্চার উপস্থিতি। মানুষ তার ভবিষ্যৎ কখনোই জানে না। তার এই যে মহান অনিশ্চয়তা, তাই তাকে বাধ্য করে এমন সব উপাচারের দিকে মন দিতে। একদিকে পর্যবেক্ষণ নিপুণতা থেকে বিজ্ঞান জন্মাচ্ছে, একই সমাজে পর্যবেক্ষণ নিপুণতা জন্ম দিচ্ছে জল্পনার। সে জল্পনা শাসকদের স্তরকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। তিথি-নক্ষত্র-মাদুলি-কবজের বিশ্বাস নিয়েই চলছে শাসন।
কুমার শত্রুঘ্ন তাঁর কাছাকাছিই আছেন শুনেছেন ভরত। রামের সঙ্গে লক্ষ্মণের মত, শত্রুঘ্ন-ভরত সম্পর্কও যে বিশেষ তা এখানে নাটককার প্রতিষ্ঠিত করলেন। অযোধ্যা থেকে আসা পরামর্শ শুনে, ভরত স্থির করলেন প্রতিমাগৃহের কাছেই বিশ্রাম করবেন। দেবদর্শন এবং বিশ্রাম দুই-ই হবে। দেবতার মন্দির ভাবছেন সাজ-সজ্জা দেখে। সঙ্গে এও খেয়াল করছেন, ত্রিশূলাদি বা পতাকা কিছুই নেই। ভাবছেন তাহলে দেব-মন্দির হবে কেমন করে! যে সময় নাটককার, নাটকটি রচনা করছেন সে সময় নিশ্চয়ই দেব মন্দির প্রথা প্রচলিত হয়ে গিয়েছে। বৈদিক যুগে মন্দির ও মূর্তির চল ছিল না বলেই জানা যায়। ধীরে ধীরে সে চল এসেছে। অন্যান্য সাংস্কৃতিক প্রভাবেই এসেছে। নাটককার, যে সময়ের সে সময় সে চল হয়েছে বলেই ভরতের মনে এই দ্বন্দ্ব তৈরী করা গিয়েছে।
মন্দিরে প্রবেশ করলেন ভরত। পাষাণ মূর্তিও দেখলেন। অর্থাৎ দীর্ঘ স্থায়ী উপাদানে মূর্তি নির্মাণ শুরু হয়ে গেছে। ভরতের মনে হল প্রতিমাগুলি যেন মানুষের। অর্থাৎ শুধুমাত্র আবক্ষ মূর্তি নিশ্চয়ই নয়। সম্পূর্ণ অবয়বই খোদিত পাথরে। ভরতের আরো মনে হল চতুর্দেবতার মূর্তি হবে সেগুলি সম্ভবত। এও এক কৌতুহলজনক জায়গা নাটকের, অন্তত আমাদের সময়ে পাঠের জন্য। ত্রিদেব আমরা জানি। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর। পঞ্চোপাসনাও জানি আজকের সময়। স্মার্ত ধারায় ব্রহ্মা বাদ গিয়েছেন। শিব-বিষ্ণু-সূর্য-গণেশ-শক্তি, এই পঞ্চ মূর্তি পাঁচটি দেউলে পূজা করার ধারা। চতুর্দেব বলে ভরত কাদের কথা ভাবছেন? উল্লিখিত দেবতাদের মধ্যে কারা থাকলেন কারা বাদ গেলেন, এ কথা জানা গেলে তিন দেবতা থেকে পাঁচের দিকের যাত্রার মধ্যেকার একটি সূত্র পাওয়া যেতেও পারতো। নাটককার, তাঁর সময়ের দর্শকের জানা কথা বলেই হয়তো উল্লেখ করেননি। অথবা নিতান্তই চতুর্মূর্তির গুরুত্ব বোঝাতে চতুর্দেবের প্রসঙ্গ এনেছেন।
কিন্তু এই মূর্তিগুলি দেখে ভরত যে কথাগুলি বললেন তা আমাদের বিশেষ অবধানের বিষয়। বললেন তাঁর মন আনন্দরসে পূর্ণ হচ্ছে মূর্তিগুলি দেখে। দেবতা বলেই প্রণাম করা উচিত। কিন্তু মন্ত্রহীন প্রণাম শূদ্রোচিত হবে। অন্য তিন বর্ণ নয়, শূদ্রের উল্লেখই এল ভরতে কথায়। সুধাকর শূদ্র। তার বা তাদের পরিশ্রমেই প্রতিমা গৃহ হয়, থাকে – তারই উল্লেখ অবনত অবস্থান হিসেবে? এই যে সমাজ, যা ধরেই রেখেছে তার বড় অংশের মানুষই সমমর্যাদার যোগ্য নয় তার ছাপ নাটককার রেখে গেলেন এখানে। সুধাকর এবং ভরতের এই যে অবজ্ঞামূলক দূরত্ব, যেখানে শূদ্র সুধাকরের সামনেই শূদ্রের হীনতা ভরত প্রকাশ করছেন, তার সূত্র ধরেই ভটেরা সুধাকরদের উপর অত্যাচার করতে সাহস পায়। এমন অসম্মানের দূরত্ব না থাকলে সাহস পেত না।
এই সংলাপের পরেই দেবকুলিক আসে। মন্দিরের কর্মচারী সে। মন্ত্রহীন প্রণাম শূদ্রোচিত বলে মন্তব্য করা ভরতকে প্রণাম করতে নিষেধ করে। ভরতকে দেখে তার ব্রাহ্মণ মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই। কারণ সে বলছে, ভুল করে যাতে ব্রাহ্মণ কেউ এই মূর্তিকে প্রণাম না করে, তাই এই নিষেধ। কারণ এই মূর্তি ক্ষত্রিয়ের। ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের প্রণম্য নয়। শূদ্রকে তাচ্ছিল্যকারী ক্ষত্রিয় আবার ব্রাহ্মণের চাইতে নীচু, এ কথাও স্থাপন করে গেলেন নাটককার। অবশ্যই বর্ণাশ্রম ভাল ভাবেই প্রচলিত যে অঞ্চলে নাটকটি জন্মাচ্ছে সেখানে। এখানে আরেকটি কৌতুহল জন্মায় আমাদের। যুদ্ধে যাচ্ছেন না, রণসজ্জা নেই ক্ষত্রিয়ের। কিন্তু ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণে কি পরিচ্ছদগত কোনো পার্থক্য ছিল না তখন? অথবা কেশ, বিশেষ কেশসজ্জা (মুণ্ডিত মস্তকে টিকি জাতীয়) বা দাড়ি থাকা না থাকারও পার্থক্য ছিল না? কারণ এই সকল বহিরঙ্গের পার্থক্য চিহ্ন শুধু চতুর্বর্ণই নয়, অন্যান্য ধর্মের ক্ষেত্রে, জাতির চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রেও কাজ করেছে। সেখানে ক্ষত্র-ব্রাহ্মণ সাদৃশ্য কৌতুহলজনক নয়?
যাই হোক, এরপরে দেবকুলিক, ভরতকে একে একে মূর্তিগুলিকে চেনায়। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজাদের মূর্তি। দিলীপ-রঘু-অজ এই ক্রমে চিহ্নিত করে। যদিও এই ক্রম প্রচলিত রামায়ণের বিরোধী তাও পরে কালিদাসও এই ক্রম অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ দুজনেই এমন কোনো সূত্র থেকে এই ক্রম সংগ্রহ করেছেন যা প্রচলিত রামায়ণের থেকে তখনই পৃথক। তারপরেই ভরত আকুল হয়ে ওঠেন দশরথের মূর্তি দেখে। জানতে পারেন দশরথ মৃত। বাকী সংবাদের কিছুটা জানেন, কিছুটা তাঁর অনুমান বলেন। যদিও এখানে একটি দুর্বলতা নাটকে বেশ রয়ে গিয়েছে। দশরথের মূর্তি নিয়েই চতুর্মূর্তি। সে তো ভরত প্রথমেই দেখেছেন। তাহলে এত পরে তাঁর প্রতিক্রিয়া কেন? নাটক এখানে দুর্বল হয়েছে যুক্তিতে। আরেকটি বড় দুর্বলতাও আছে। এই অঙ্কে বা এর আগের কোনো অঙ্কে ভরত, কৈকেয়ীর বর চাওয়ার ইচ্ছে জানেন এমন জানানো হয়নি। ভরতের সে নিয়ে উদ্বেগ বা বিরোধীতাও জানানো হয়নি। তাহলে আচমকাই ভরত, বর প্রার্থনা ও রামের বনবাসের অনুমান করলেন কেন? উত্তর নেই তার।
বরং এর কিছু পরে রাণীরা এলে আরেক দুর্বলতার জায়গা তৈরী হয়। ভরত দীর্ঘদিন মাতুলালয়ে, তাই তাঁকে কেউ চিনতে পারেন না প্রথমে। দেবকুলিকের সাহায্যে চিনলেন সকলে। বালক থেকে বা কিশোর থেকে যুবকে পরিণত হলে চেহারার পরিবর্তন অনেকটাই হয়, তা সত্যি। কিন্তু ভরত কৌশল্যাদের চিনলেন না এ আশ্চর্যজনক! যুবতী থেকে বৃদ্ধা হয়েছেন হয়তো কৌশল্যা। এত পরিবর্তন? সুমিত্রাও প্রৌঢ়া হবেন বড়জোর! তাতে এত পরিবর্তন? কৈকেয়ী যুবতীই থেকেছেন বলে অন্য অঙ্কে লক্ষ্মণ বলছেন। তাঁকেও প্রথমে চিনলেন না ভরত? অস্বাভাবিক! যাই হোক, কৈকেয়ীকে দোষারোপ করে-টরে এই অঙ্কের শেষে ভরত চললেন রাম-সন্দর্শনে বনে। সে সময়কালে, ব্রাহ্মণ্য পারিবারিক আদর্শ অনুসারে ভরতকে আদর্শ ভ্রাতা গড়ে তোলার প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হল নাটককারের।
প্রচলিত রামায়ণে মন্দির বিষয়টিই নেই। এ একেবারে নাটককারের কল্পনা। নাটকীয় কলাকৌশলের দিক থেকে দেখলে কৌতুহলপ্রদ গুরুতর আবিষ্কার। ভরতের মনস্তাত্বিক উদ্বেগ থেকে শোকের দিকে যাত্রা ইত্যাদির মাধ্যমে মানব চরিত্র উন্মোচনে নাটককার বেশ কিছুটা সফল। সঙ্গে বিগত রাজাদের জীবনের বিপুল মহিমা প্রতিষ্ঠাও করা গেল এর মাধ্যমে, যাতে আবার ইক্ষ্বাকু বংশ যে ব্রাহ্মণপ্রিয় এবং বেদ-দেব-যজ্ঞ নিষ্ঠ এ প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্বর্ণে সামাজিক স্তর বিন্যাসে ভেদ স্পষ্ট হয়। সমাজচিত্রের জন অংশের একটি ছবিও ফুটে ওঠে। আর নাটককার যে তাঁর কলামাধ্যমে নবীনোদ্ভব ঘটাতে দক্ষ তাও প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্বলতাগুলি না থাকলে নাট্যের এবং দৃশ্যের মহিমা আরো বাড়তো।
স্বাভাবিকভাবেই রাণীদের সঙ্গে ভরতের দেখা এবং বনগমনও প্রচলিত রামায়ণে এমনটা নয়। প্রথম অঙ্কে রামের সীতা-লক্ষ্মণ সহযোগে বনগমনের ক্ষেত্রেও যেমন নাটককার স্বাধীনতা নিয়েছেন, এখানেও তাই। প্রচলিত রামায়ণে রাম, দশরথ এবং কৈকেয়ীর কাছে বনবাসের কথা শোনার পর গিয়েছিলেন কৌশল্যার কাছে। কৌশল্যা সেখানে জানিয়েছিলেন কৈকেয়ীর প্রতাপে তাঁর দাসীরাও তাঁকে অবমাননা করে। এমন কী তাঁর নিজস্ব দাসীরাও ভরতকে কাছেপিঠে দেখলে ভয়ে তাঁকে সম্বোধন করে না। রাম থাকতেই এই অবস্থা ছিল। এই আদর্শ পরিবার? এই ভরতের ভ্রাতৃভক্তির নমুনা? ভায়ের মা-কে এভাবে কোণঠাসা করার সহায়তা ভরত কি না জেনেই করেছেন? ভায়ের মা-কে নিজ মাতৃসমা জ্ঞান করলে, এমন একটি অবস্থান ভরতের কখনো চোখেও পড়লো না কেন?
উত্তর নেই এ সবের। যেমন উত্তর নেই রাম-ই বা কেন জানতেন না এতদিন এই সব, তার! মায়ের প্রতি মনোযোগ কতটা ছিল তাহলে তাঁর, তারও উত্তর আমরা পাই না। এই অবস্থা রাম থাকতেই হয়ে থাকলে, না থাকলে কৌশল্যা কেমন করে এই সকল নির্যাতন থেকে বাঁচবেন? লক্ষ্মণ, যিনি নিজেও এ সব জানতেন না একই রকম অবোধ্য কারণে, এ সব কথা কৌশল্যার মুখে শুনে নিজ পিতা দশরথকে বিষয়াসক্ত কামার্ত এবং স্ত্রৈণ বলে নিন্দা করেন। বলপ্রয়োগে রাজ্যলাভের কথা বলেন লক্ষ্মণ। গৃহযুদ্ধ লেগে যাবার মুখে এসে দাঁড়ায় প্রায়। রাম, পিতৃ-আজ্ঞা পালনের ক্ষেত্রে সগরের ষাটহাজার পুত্র থেকে শুরু করে ভার্গব পরশুরামের দৃষ্টান্ত দেন। ধর্মাধর্মের কথা বলেন। ব্রাহ্মণ অনুবর্তীতা ইত্যাদিকে সামনে রেখে লক্ষ্মণকেও নিরস্ত করেন। তারপরে জানকীর কাছে গিয়ে পরামর্শ দেন প্রথমে, তাঁকে ছাড়া জানকী কেমন করে চলবে এ বিষয়ে।
প্রচলিত রামায়ণের কাহিনী অনুসরণ করলে আমরা দেখব, ভরতের সামনে রামের গুণপনার ব্যাখ্যা করতে জানকীকে নিষেধ করছেন স্বয়ং রাম। বলছেন যারা বিভবশালী হয় তারা অন্যের প্রশংসা সহ্য করতে পারে না। জানকীকে বলছেন ভরতের প্রতি সর্বাংশে অনুকূল হবার জন্য। নইলে জানকী অযোধ্যায় তিষ্ঠোতে পারবেন না। আবার এও বলছেন ভরত-শত্রুঘ্ন তাঁর প্রাণাধিক। জানকী যেন তাঁদের পুত্রবৎ স্নেহ করেন। অর্থাৎ ভরতের ক্ষেত্রে রামের আশঙ্কা কিন্তু স্পষ্ট। তারপরেও রাম লক্ষ্মণের বনানুগমনের অভিপ্রায় ঠেকাতে স্পষ্ট বলছেন, ভরত রাজ্য পেলে কৌশল্যা এবং সুমিত্রাকে স্মরণই করবেন না। তিনি, তাঁর মাতার পক্ষ নেবেন। অর্থাৎ পক্ষপাতের সম্ভাবনা প্রকট। আদর্শ পরিবারের চিহ্নমাত্র নেই। রাম আদর্শ স্থাপনের চেষ্টা করছেন। চেষ্টা করছেন অননুকূল পরিস্থিতিতে ব্যবহার ইত্যাদি দিয়ে বংশে শান্তি স্থাপন করার। নিজের বনবাসকে সে কারণের নিমিত্ত বলি বা আত্মত্যাগ বলেই ধরছেন। না হলে বনবাস নিয়ে তাঁরও বক্তব্য থাকতো।
অথচ, নাটককার ভরতের প্রতি রামের এই সব আশঙ্কাকে ঠাঁই দিলেন না নাটকে। প্রচলিত রামায়ণের এই সব প্যাঁচ-পয়জার, আদর্শ পরিবার না হবার ফলে আভ্যন্তরীণ বিদ্বেষ, রামের মধ্যেকার দ্বন্দ্বও তিনি এড়িয়ে গেলেন। বরং ভরতকে আদর্শ সন্তান ও ভ্রাতা হিসেবেই উপস্থিত করলেন। প্রচলিত রামায়ণের পাঠের সঙ্গে নাটককারের পরিচয় যে সুক্ষ্ম তাও কিন্তু প্রথম অঙ্কে আছে। সীতা, প্রচলিত রামায়ণে, রামের বনগমনের কথা শুনে রামকে জানাচ্ছেন, তাঁর বালিকা বয়স থেকেই বনগমন যে তাঁর ভাগ্যে আছে সে কথা তিনি শুনেছেন। বনবাস বিষয় তাই তাঁর আগ্রহ যথেষ্ট। এই যে সুক্ষ্ম ইঙ্গিত, একে কেন্দ্র করেই নাটককার সম্ভবত সীতার বল্কল পরিধানের দৃশ্যের সূচনা করেছেন। কিন্তু ভরতের ক্ষেত্রে একেবারেই সে পথে হাঁটলেন না। বরং তৃতীয় অঙ্কে ভরতকে দিয়ে ঘোষণা করিয়েই দিলেন, রাম ছাড়া অযোধ্যা অযোধ্যাই নয়। যেখানে রাম, সেখানেই অযোধ্যা।
নাটকের দ্বন্দ্বের জন্যও এই সকল নাটককার ব্যবহার করতে পারতেন কিন্তু। সম্ভবত, তাঁর ভাবনায় রামায়ণে রামের পরিবার যেমত হওয়া উচিত তার আদর্শের সঙ্গে প্রচলিত রামায়ণের এই সকল পাঠ মিলছিল না। সে পরিবার, দশরথ কেন্দ্রিক প্রথমে। পিতৃ আজ্ঞা, তা অন্যায় হলেও পালনীয়, এ পিতৃতন্ত্রের সেকালের আদর্শ পাঠ। রাম সেই পাঠের অনুগত সেবক। আবার পিতার পরেই সংসারে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার স্থান বা গুরুত্ব। এ কথা নাটককার স্বয়ং তাঁর অন্যান্য নাটকে (যেমন মধ্যমব্যয়োগ) স্পষ্ট প্রতিষ্ঠা করেছেন। সুতরাং দশরথের অযোধ্যার ভরাডুবির মুখে, নাটকের সকল চরিত্র অযোধ্যা বলতে রামকে আঁকড়ে ধরতে চাইছে। অযোধ্যা আসলে স্থান নয়, ব্রাহ্মণ্য এবং পুরুষতান্ত্রিক আদর্শের কেন্দ্র। যদি অযোধ্যা, সে আদর্শ থেকে বিচ্যূত হয়, তাহলে অযোধ্যা অযোধ্যা থাকে না। সে আদর্শের ধারক-বাহক রাম। অতএব, রাম অযোধ্যা থেকে সে আদর্শ বহন করতে গিয়ে নির্বাসিত হলে রাম যেখানে যাবেন সেখানেই অযোধ্যা হবে। নাটককার, তাঁর পরিকল্পনায় এই আদর্শকে এত উচ্চ আসন দিয়েছেন যে, তার ফলে ভ্রাতায় ভ্রাতায় দ্বন্দ্বের সম্ভাবনার এ প্রকাশ তাঁর কাছে অবান্তর হয়ে গিয়েছে। অথবা তাঁর আসল পরিকল্পনায় এ বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। তাই, এই ঘোষণা করেই ভরত চললেন রাম সন্দর্শনে। বর্ণাশ্রমী ক্ষত্রিয়দের মহিমা কীর্তন এভাবেই চললো এ নাটকের চতুর্থ অঙ্কে।
নাটককার, প্রচলিত পাঠের মধ্যে থেকে যে রাম আর ভরতকে নিষ্কাষণ করে আনলেন সেই রাম আর ভরত ক্ষত্রিয় শাসক সমাজে পরিবারের আদর্শ কেমন হবে, ভায়ে ভায়ে সম্পদ থেকে ক্ষমতার বিভাজন কেমন হবে, তার নবীন এক চলন সূচনা করল। প্রচলিত রামায়ণে সে চলন নেই। জ্যেষ্ঠই সম্পদের অধিকারী, ক্ষমতার অধিকারী এই তত্ত্বকে প্রায়োগিক চেহারাতে আনলেন নাটককার। আনতে গিয়ে যেখানে যেখানে সংসারের আনাচে-কানাচে থাকা দ্বন্দ্বকে তিনি একেবারেই অবজ্ঞা করে গেলেন। কৌশল্যা-কৈকেয়ীর বিরোধ থেকে দশরথ বা রামের আশঙ্কা, ভরত বা লক্ষ্মণের আচরণ সবটাকেই সরিয়ে দিলেন সুকৌশলে? কৈকেয়ীর উচ্চাকাঙ্খাকেই আপাত দৃষ্টিতে প্রধান করে তুললেন। কেন? ভরতের ভূমিকা, বা দশরথের রাজ্যের অন্যান্যদের ভূমিকা, দশরথের সম্বন্ধীদের ভূমিকা সব কিছুকেই এড়িয়ে গেলেন। কেন? যত দোষ নন্দ ঘোষ হয়ে কৈকেয়ী-মন্থরা জুটিটিই কেন থেকে গেল? সেও কি এভাবেই থাকবে?
এর উত্তর আমরা খুঁজতে থাকব আগামী পর্বে।

[ক্রমশঃ]

Facebook Comments

Leave a Reply