অর্বাচীনের ঠাকুর ভজনা: রাহেবুল
রবি ঠাকুর তো বাঙালির সবচে বড় আইকন এ নিয়া কথা কইতে দম চাই, আমার তাহা নাই বলিলেই চলে তবু এ ধৃষ্টতা, ঠাকুর ক্ষম অপরাধ!
বাঙালি বাবু তথা রওশান বাবুর গপ্পো:
আমার বাপের বোধয় জ্যাঠাতো ভাই রওশান। আব্বা সহ অনেকেই ওনাকে ডাকেন নামের পরিবর্তে ‘বাঙালি’ বলে। ‘বাঙালি’ কীভাবে কারোর নাম হতে পারে তখন ও বোঝার বয়স ছিল না, এখন অবাক লাগে। তিনি ছিলেন বাম জমানায় আমার গাঁয়ে সিপিএম এর পার্টি মেম্বার, কেবল তাহা নহে ব্রাঞ্চ সেক্রেটারিবশত পার্টি অফিসের সকল মিটিং ডাকতেন তিনিই, অফিসের বাক্সটিও তিনি সামলাতেন। টিভিটি বোধ করি সামলাতেন না, কারণ তখনও ও জিনিস ঢোকেনি ঘরে। সবসময় শশের মতন ব্যস্ত মানুষ, কথাবার্তায় স্মার্ট, চটভট। ঠোঁটকাটা, স্পষ্টভাষী হওয়ায় গাঁয়ের সাধারণে সমীহ করে চলত তাঁকে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু কে ছিল তাঁর? কে জানে। বড়আম্মাকে ভালো লাগত খুব কখনও ওদের বাড়ি গেলে, কথা বলেন অনর্গল প্রায়। গলায় দেখেছিলাম ট্যাটুর মতন কী যেন পরা। পরে আব্বা বা আম্মার কাছে শুনি বাবু (বাবু<বড়আব্বু?) বিয়ে করেছিল তাঁকে পাশের আদিবাসী পাড়া থেকে। বাবুর শোয়া-বসার ঘরে ছিল প্রচুর বই, ক’মাইল দূরে এক লাইব্রেরি ছিল সেখান থেকে বোধয় আনত। আমার অবশ্য সে বই পড়ার সুযোগ হয়নি খুব। হঠাৎই যেতাম তাও হয়তো নাইন-টেনে পড়ার কালে। ‘শক্তিমান’ বা হিন্দি সিনেমা বা রবিবারের ছায়াছবি এসবের জন্যে কিন্তু বাবু বাড়িতে থাকলে খুব একটা সুবিধা হত না আমার মতন সমবয়সী পুরো দঙ্গলেরই। বেজার মুখে ফিরতে হত। বাবুর ছেলেরাও বেশি কিছু বলতে পারত না। বাবুর পছন্দ ছিল একমাত্র উত্তম কুমার, আর বোধ করি সাদাকালো জমানার সব সিনেমা। সে দেখলেই কেবল যুতসই মতন বসে দেখা যেত, তাও মুখে পুটুর পুটুর কথা কওয়া বারণ। অথচ অমন সিনেমায় (তখন বলতাম ‘বই’) আমাদের প্রায় সবারই বদহজম। ফলত বাবুকে আমাদের কারোরই পছন্দ ছিল না বিশেষ, মনে হত বড্ড খিটখিটে, বদমেজাজি।
আরেকবার আমরা গেছিলাম, বিশেষভাবে মনে আছে তখন আমরা সবে টানাটুনি করে কলেজে ভর্তি হয়েছি। আমরা এরসাদ, আলি (জুলফিকার) আর আমি মিলে তখন শুরু করেছিলাম কোচিং সেন্টার, তারই ছিল একটা অনুষ্ঠান। কী সেসময় আমরা বানিয়েছিলাম একটা সমাজসেবী সংগঠন তারই পক্ষে ছিল মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের কৃতী সংবর্ধনা। আমরা বাবুদের বাড়ি গেছিলাম আমন্ত্রণ করতে যেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা সুখকর হল না। কীসের সংগঠন, কীসের অনুষ্ঠান ইত্যাদি জেরার মুখে আমরা নাকাল। আমার যাওয়ার কথা ছিল না আমন্ত্রণ করতে কিন্তু এরসাদ আর জুলফিকার দোনামনা করায় আমিও সঙ্গী হই ওরা জানত যে আমিই একমাত্র ঠোঁটকাটা, ভয়ডরহীন, লাজশরমহীন, উটকো গোছের—এমন অস্ত্রও কদাচ কাজে লাগে। অনেক জিজ্ঞাসায় বিরক্ত হয়ে আমিই বুঝি তারপর সোজাসুজি অনুষ্ঠানে আসতে বলে বিদেয় হয়েছিলাম, ভাবখানা এমন আসলে আসেন না এলে নাই, না এলে বয়েই গেল! বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিন বন্ধুতে পুনরায় সেসব নিরাশ হওয়ার কথাই আলাপ হল যা আমরা আগেই আন্দাজ করেছিলাম। এমনকি পরেও একথা নিয়ে আমরা আড্ডা জমিয়েছি। এমনিতেও এমন পার্টি সংগঠক, ধনী, জমিদার-জোতদারের বংশধর … এমনতর শ্রেণিগুলির প্রতি আমাদের কেমন যেন বীতরাগ ছিল, তা আরও বেড়ে যায়। আমাদের চালচুলোহীনভাবে বড়ো হতে থাকাটাও এর একটা প্রাসঙ্গিক কারণ।
আমার বাড়ির সামনে এক মাটির রাস্তা, অল্প হেঁটে স্কুলের পাড়। স্কুলের পাড়ে রাস্তার ওপর কালভার্ট, ভেতরে একটা সরু-লিকলিকে জাম্পই (নালা) ততদিনে যার পানি শুকিয়ে গেছে, কেবল বর্ষায় উতলা হয় বেচারি। তখন আমার ল্যাদখোর-লাথখোর বিষাদকালীন বয়স। কালভার্টের দুই রকে টীকা (পাছা) অদল-বদল করে বসে কাটাতাম প্রায় বিকেল, প্রায় দুপুর, প্রায় রাত্তির—কেবল স্কুলের টিফিনের সময় ওখানে বসতাম না অস্বস্তি হত! হাতে তখন সদ্য ২ জিবি চিপ লাগানো কিবোর্ড মোবাইল, তাতে অদূরের দোকানের পাড়, কী আরও দূরের গোবিনহাটের কোনো কমপিউটার দোকান থেকে ভরানো গান। একা একা শুনি। বাংলা গান চাইতে ভরিয়ে দিয়েছে কতগুলো কুমার শানুর বাংলা গান, কতগুলো রবীন্দ্র সংগীত। কোনোটাতেই মন ভরে না। ঘ্যাঙ্গারি গলায় রবীন্দ্রসংগীত বেশ সাউন্ড দিয়ে বাজিয়ে কী একটা কাজে রাঙ্গালিবাজনা গেলাম একদিন, মোবাইল জামার বুক পকেটে। কিন্তু মনকে সে শান্তি দেয় না কিছুতেই। এ গান শোনা বড্ড বেশি কৃত্রিম বোধ হয়। তারপর কলেজে পড়তে পড়তে সিডি-ডিভিডির দোকানে খোঁজ। সেখানেই পেলাম রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, ব্যান্ডের ক্যাসেট, খুব একটা দামও নয়। তখনও জানতাম না এসব পাইরেসি ক্যাসেট, ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করে ক’টা করে এমপি থ্রি গান ব্ল্যাংক সিডিতে ঢুকিয়ে এমনকি অন্য নামের অ্যালবামের ফটো কভার দিয়ে তা বিকোত। সেসব ক্যাসেট বাড়ি এনে ততদিনে বাড়ির পাশে স্কুলের পাড়ে হয়েছে আবিদদার দোকান সেখান থেকে এগুলি ওর কম্পিউটারে নিয়ে তা থেকে আমার মোবাইলের মেমরি কার্ডে সেসব ঢোকানো। মোবাইলের মেমরিতে নজরুলগীতির একটা আলাদা ফোল্ডার হলো, রবীন্দ্রসংগীতের আরেকটা, ব্যান্ডের আরেকটা। তারপর অসীম সময় নিয়ে আমার ছোট্ট কুঠুরি ঘরের মাটির মেঝেতে বিছানো চটের বস্তার ওপর শুয়ে এসব নিরন্তর শোনা চলে। রবীন্দ্রসংগীত তাতে খুব বেশি ছিল না। যেহেতু ও জিনিস আগে থেকেই আমাকে টানত না বিশেষ (পরে কই ও বৃত্তান্ত) বলেই বোধয় ওর খোঁজ আমি খুব বেশি করতাম না। তবু “গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ” ভাল্ লাগে খানিক, বাকিগুলো মনে ধরেনা আরোই। এবার নজরুলগীতির ফোল্ডার খুললাম। এতে অনেক গান, প্রায় দেড়শো। এবার মনে ধরলো অনেক গান। কিছু অবশ্য অল্প শুনেই এড়িয়ে যাই। “শাওন–রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে”, “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়” এত্ত ভালো লেগে গেল… বাজতে থাকে বাজতে থাকে। এমন আরও ক’টা, খুব বিষাদময় গলা-সুর, আর বিংশ শতকের মার্কামারা ভাষা তার। তারপর পেলাম “এ-কূল ভাঙে ও-কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা… সকাল বেলা আমির, রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা।” তারপর “শুকনো পাতার নূপুর পায়ে / নাচিছে ঘুর্ণিবায় / জল তরঙ্গে ঝিল্মিল্ ঝিল্মিল্ / ঢেউ তুলে সে যায়” গানটা বনে গেল মোবাইলের রিংটোন, এমনকি কোচিং এর ক্লাসে কচিকাচাদের মোবাইলে ফুল ভলিউম দিয়ে শোনালাম এ গান! এক্সট্রা কারিক্যুলার অ্যাক্টিভিটি! জানলাম ছোটোবেলায় রোজা মাসে (রমজান মাস) বাড়ি বাড়ি গিয়ে গেয়ে বেড়ানো গজল “ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ / তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ” ও তো কবি নজরুলেরই। তারপর ব্যান্ডের ফোল্ডার। মহীনের ঘোড়াগুলি, ফসিলস্, ক্যাকটাস, লক্ষ্মীছাড়া, ভূমি, মাইলস, জেমস… এসব পেলাম। আরেক অন্য দুয়ার খুলে গেল…
সে সময় বা তার খানিক পরে বাবুকে দেখতাম আমার বাড়ির পাশে কাদের চাজির (<চাচাজি) বাড়ি সকালে করে নিত্য আসতে-যেতে, প্রায় হনহনিয়ে হেঁটে। মোবাইলে গান বাজে। তারপর বাবুর সঙ্গে আমার মোলাকাত হয় প্রায় প্রতি বিকেল। কালভার্টের রকে। বাবু বসে গান শোনে। একা। নজরুলগীতি। আমি অন্য রকে বসে দু’একটা কথা কওয়ার সাহস দেখাই কদাচ, নইলে নয়, গান শুনি। সেসব গান তদ্দিনে আমার তখন বড্ড চেনা। সেসবের গায় তখন আমার ব্যক্তিগত গোটা কতক রাত্তিরের পরাগ, লেগে রক্ত, ব্লেড, নখর, কান্না, কারোর কণ্ঠস্বর, বমি …
এর আগে অব্দি আমি জানতাম না যে বাবু গান শোনে, বা শুনতে ভালোবাসে, তাও আবার নজরুলগীতি।
বাবু ক’দিন পর মারা গেল, ক্যান্সার।
বাপের সনে সংগীতদীক্ষা:
ছোটো বেলায় বাপের ছিল রেডিও। তাতে আকাশবাণী শিলিগুড়ি, কলকাতা ক; খ, বাংলাদেশ বেতার ঢাকা; খুলনা নিয়মিত বাজে। শুনি শর্ট ওয়েভ, মিডিয়াম ওয়েভ এর মতন মনহরা শব্দ। কখনও নাটক শুনতাম রাতে রাঁধন ঘরে পিঁড়িতে বসে বসে ভাত খাওয়ার সময়—বাপে-মায়ে ভাই-বোন মিলে। কখনও খাওয়া শেষে শোবার একমাত্র খড়ের চালার ঘরটিতে শুনতাম নাটক। নাটক আমার খুব ভাল লাগেনা। এদিকে দিনের বেলা দুপুর বারোটা, সাড়ে বারোটা কী বেলা একটার সময় হত লোকগীতি গান। বাপ-মায়ের বিশেষত আব্বার সবচেয়ে প্রিয় এই অনুষ্ঠান। দু’তিনটে করে গান হত মুখ্যত ভাওয়াইয়া। হঠাৎই শুনতাম আমার গাঁয়েরই মোজাফ্ফর হোসেন নাকি বেতারশিল্পী, সেও ভাওয়াইয়া গায় রেডিওতে। এভাবেই কোনোদিন শুনি মিনতি রায়ের গান, শুনি আম্মা-আব্বার কাছে সে মোজাফ্ফরের স্ত্রী। ভাওয়াইয়া শোনার সময় এক গাল কাঁচা কী মজানো গুয়া মুখে মাঝে মাঝে আব্বার আক্ষেপ শোনা যায় “আব্বাসুদ্দিনের গান রে, এইল্লা গান আরও নয়া বানাইচে, আব্বাসুদ্দিনের মোতোন হয় নাই, আব্বাসুদ্দিনের মোতোন কী আর হয়!” এইভাবেই কখনও শোনা হত বাংলাদেশ বেতারের কোনো চ্যানেলে পল্লীগীতি। কখনও বাজত আধুনিক সংগীত যা ভালো লাগত না কারোরই, চ্যানেল পাল্টে যেত। রবীন্দ্রসংগীত কী নজরুলগীতি দৈবাৎ কখনও হয়তো শুনেছি।
বাপ আমার নিরক্ষর, মা-ও। মাকে আখার (উনুন) পাড়ে বসে কখনও ‘গীত’ গাইতে শুনেছি। আমাদের কাছে গীত বলতে বিয়ের সংগীত যা ছাম-গাইন, কলাপাতা, হলুদ, গুয়া-পান, সিঁদুর এবং গাবড়ু (বর) বা কনে মিলে হয়। অথবা আম্মা গুনগুন করত মায়ের ছোটোবেলায় শোনা কোনো গান, স্পষ্ট শুনিনি কোনোদিন, জিজ্ঞেস করলে মৃদু হাসিটুকুই কেবল হত উত্তর। আর আব্বা বর্ষালি দিনে ঘরের দাওয়ায় বসে মাছ ধরার টেপাই কী ঠুসি বানাতে বানাতে একা একা গেয়ে চলত পুরনো ভাওয়াইয়া, দরিয়া। আঙ্গিনায় তখন নিঝুম বর্ষণ। সাঁতাও (এক নাগারে সাতদিন ব্যাপী বর্ষণ) এর সময় বিছানায় চিৎ শুয়ে কী বসে ঘুণে খাওয়া জানালার পাল্লা খুলে আঙ্গিনায় চোখ বাবার, কী চোখ পাঠশলার সিলিঙের ওপর—ঠোঁটে ভাওয়াইয়া গুনগুন। “ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে”, “তোর্ষা নদীর উথাল পাতাল” ননস্টপ চলে। আজও তেমনই বাবা। যে দু’এক বিঘা জমি আমাদের চাষের তা চষাবার, আবাদ করবার সময় পেরিয়ে যায় যায়…বাবার হুঁশ ফেরে না। মায়ের কত বকাঝকা, মুখ ঝামটা সব মুখ থুবড়ে পড়ে, অতি বিলম্বে একদিন সক্কাল সক্কাল তারপর হয় আব্বার লাঙ্গল অভিযান। এইভাবে আমার মজ্জায় ঢোকে ভাওয়াইয়া, লোকগীতি। আব্বা রবীন্দ্রনাথের নাম বা সৃষ্টিকর্মের ধারণা রাখত না কিন্তু কীভাবে ছোটোবেলায় কার মুখে শুনেছিল কে জানে আব্বার মুখে বহুবার শুনি, বিশেষত শীত-শরতে—
“এসেছে শরৎ, হিমের পরশ
লেগেছে হাওয়ার ’পরে।
সকাল বেলায় ঘাসের আগায়
শিশিরের রেখা ধরে।
আমলকী-বন কাঁপে, যেন তার
বুক করে দুরু দুরু।
পেয়েছে খবর, পাতা-খসানোর
সময় হয়েছে শুরু।”
…
আগুনের বপন:
স্কুলজীবনে বা তারপরে আলিকে বহুবার গুনগুনাতে শুনেছি “আগুনের পরশমণি” রবীন্দ্রসংগীত। এরসাদও বোধয় কখনও বেসুরো গাইত। কিন্তু আমার আসত না কখনও, এমনকি মনে মনেও। বা নিদেনপক্ষে বাথরুমেও। এমনিতেও আগেকার খোলামাঠে আর পরবর্তীতে কাঁচা পায়খানায় হাগতে বসে গালে হাত দিয়ে আমি যত রাজ্য-রাজত্বের ভাবনা ভাবি, মনে স্লাইড শোয়ের মতন করে এ গান সে গান, এ সিনারিও ও সিনারিও এদিক-ওদিক আসতে থাকে যেতে থাকে, পারাপার। কিন্তু তাতে রবি ঠাকুরের গান উঁকি দিত না বিশেষ। স্কুলে সরস্বতী পূজা বা ফাইনাল স্পোর্টস সব কিছুতেই তো রবি ঠাকুরেরই একচ্ছত্র রাজত্ব চলে আর বেশির ভাগ বাচ্চাকাচ্চা উশখুশ করে, যেন শান্তি মেলে না তাদের এতে। তাদের মধ্যে আমিও হই অবশ্যম্ভাবি এক হতভাগা। ভুল করে কোনো ছেলে-ছোকরা যখন একটা পরিচিত হিন্দি কী বাংলা গান বাজিয়ে ফেলে মুহূর্তখানেকের জন্য কেমন যেন আরাম লাগে। ক’বছর বাদে অবশ্য সে আরাম অত্যাচারে পরিণত হতে সময় লাগেনি যখন ক্লাবে ক্লাবে বা স্কুলে বা পাড়ার মোরে সোচ্চারে ডিজে বক্সে কেবল ডিজে মিক্স হিন্দি বা বাংলা আইটেম সং বা বা উৎকট ভোজপুরি অটোটিউনের গান বাজতে থাকে। তারপর টেনেটুনে ধেধরে-ছেঁচড়ে স্কুল-কলেজ পেরতে পেরতে “আগুনের পরশমণি” কাছের হয়ে ওঠে। তারও বেশি জরুরি সঙ্গী হয় “আমার মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী”। আর “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে” তো কোনোরূপ অভিমানের উপক্রম হলেই হে হে করে গেয়ে দেওয়া চলে যখন তখন, যেন ‘থোড়াই কেয়ার করে’=‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে।’ আর প্রেমেপিরিতে, ল্যাদে-লাথে “আমার পরাণ যাহা চায়” অত্যাবশ্যকীয়।
যেমন এক ছাওয়ালের সাথে প্রেম হয়েছিল, বেশিদিন আগের কথা নয়। প্রেম বলিতে ওই অনেকটা ভার্চুয়াল আলাপন—যা বার্তালাপ ওই sms-এ। আর কথা কিছু ফোন কলে। হোয়াটস অ্যাপও ছিল কি ভাব আদান, ভাব প্রদানের মাধ্যম হিসাবে? বোধয় ছিল। কিংবা ছিল না, মনে পড়ে না এ ক’দিনেই। কিংবা এমন হতে পারে ইউটিউব, ইউটিউব লিংক—তাতে এসেছিল একটা গান ওর তরফে। হারমোনিয়াম বাজিয়ে ও গাইতও ভালো শুনেছিলাম। হারমোনিয়ামটা অবশ্য আমার তেমন একটা শ্রুতিতে ঢালে না মধু কেন যেন কস্মিনকালেও। তবু ওর কন্ঠ, তাতে ছিল মিঠাস্। গাইত কী? রবি ঠাকুর? না নজরুল? হয়তো এ দু’টোই—হয়তো কবিগুরুর ভাগে খানিক বেশি, দুখু মিয়ার ভাগে খানিক কম এমন হবে বা। ও পাঠিয়েছিল “আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে” এ গান। তখনও আমি শুনিনি তেমন একটা গানটাকে কোথাও, ক্বচিৎ নিইনি গভীরে। প্রথম শুনলাম। ভালো লাগলো। কেমন বিচ্ছেদ বিচ্ছেদ বিষাদ বিষাদ গন্ধ গানটার গায়ে।
মাস দেড়েকই ছিল আমাদের ও সম্পর্কের দৌড়। সমাপ্তিটা ছিল সাংঘাতিক রকম তেতো। তেতোটা উহ্য রাখি, বিচ্ছেদে মিলায় বস্তু, বিষাদে বাড়ে ভার্চুয়াল মিলন—সে গানটা কিন্তু থাকলো বিঁধে, মগজ-মেমরিতে সেভ। মাঝেমাঝে তার রোমন্থন হয় ঘনঘোর বর্ষায় কী বাদলে কী বেখেয়ালে পথ চলিতে চলিতে।
রোদ্দুর:
নানা সময়ে রবি ঠাকুরের সংগীত নিয়ে কত ছকভাঙা চর্চা হয়—রবীন্দ্র অনুরাগীর দল তাহা খুব সহজে নেয় কি? অঞ্জন দত্ত কর্তৃক সুর ভেঙে এবং অগতানুগতিক যন্ত্রসঙ্গীত জুড়ে সিনেমায় ব্যবহৃত ‘তোমার খোলা হাওয়া’ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল একদা। শুনেছিলাম এমন বিতর্ক খুব পুরনো, সে জর্জ বিশ্বাসের কালও কেটেছে অনেকদিন হলো। পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে নানা ব্যান্ড রবীন্দ্রসংগীতকে নানান ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে প্রায়শই ব্যর্থ হয়, কারণ শ্রোতা নিতে পারে না। ব্যান্ডসংগীত ভালোবাসেন এমনই গুটিকয়েক শ্রোতা কদাচ এগুলিকে গুডলি এক্সেপ্ট করে। রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে এমন প্রয়াস ও অপপ্রয়াসের সাক্ষাৎ আমাদের সময়ে সময়ে হয়েই যায়। কোনো ছুঁড়ি-ছোকরা আবার দুম করে রবীন্দ্রনাথকে নস্যাৎ করেন নানান দৃষ্টিকোণ থেকে (অতীতের বুদ্ধদেব বসুদের মতন করে ধরা যাবে কি এদের বলা-কওয়ার ধরণধারণকে?)। আর জানা তো গো-বলয়ের খাপ পঞ্চায়েতের দাপট এখন কিঞ্চিৎ কমলেও ‘খাপ’ বসানো কমেনি বরঞ্চ তা বেড়েছে এ জমানায়— ভার্চুয়াল প্লাটফর্মগুলিতে। ঠিক খাপ না হলেও কোনো ঘটনার সূত্রে ক’জন অগ্রজ কবি এ নিয়ে একদা আলাপ করছিলেন রবিরশ্মির দীপ্তি নিয়েই। রবিরশ্মির দীপ্তি তো অনস্বীকার্য কিন্তু এর ব্যাপ্তি কতদূর? কোনো সীমা? বদ্ধতা? মনে হচ্ছিল এসব। কিন্তু বলিনি, কুণ্ঠা হচ্ছিল যতটা ঠিক ততটাই সাহসে কুলোচ্ছিল না, সংখ্যালঘুর আশঙ্কা, ভীতি। আসলে এখন সবেতেই ফাটল, সবেতেই মেরুকরণ—হয় উত্তর নয় দক্ষিণ। মাঝে কিছু নেই, নিরপেক্ষও যখন এক চরম চতুরালি। এল রোদ্দুর রায় নাম্নী এক ‘চোখে আঙুল দাদা’। রবির গানের মাঝে ধরতাই ঢুকলো, আর সে ধরতাই হলো ‘বাঁড়া”, “বাঁড়া চাঁদ উঠেছিল গগনে”। তা দেদার হিট সাধারণ শ্রোতৃমহলে, সাধারণ ছেলে-ছোকরার দলে-দঙ্গলে। আবারও সোশ্যাল মিডিয়া তোলপাড়, তুফান। কেউ পক্ষে কেউ বিপক্ষে, কেউ পিঠে তা ট্যাটু করায় তো কেউ নীতিপুলিশি ফলায়, থানাপুলিশ অব্দি গড়ায়।
দেখি তিতিবিরক্ত ঠাকুর তার ব্যক্তিগত স্ট্যাচুগুলির ঘাড়ে কাক হয়ে বসে থাকে বেজার মুখে, মাঝে মাঝে নিজের ঘাড়ে বসে হাগে, নিজের গায়।
আমারও বলা বাকি থাকে। কত জানার বাকি থাকে। নিকটে কেউ ডুবুরি নাই বলিয়া অথৈয়ে ডুব দিতে যাই না। দেশটা তো এক ঠাকুরেরও নয়, তেত্রিশ কোটি ঠাকুরের— লালন-হাসন-রামপ্রসাদ, রাধারমণ, ভবা পাগলা, দ্বিজেন্দ্রলাল, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকা, বিজয় সরকার, আব্দুল করিম, আব্বাসউদ্দীন…শেষ হন না তাহারা, ব্যক্তিনামের বাইরেও পড়ে থাকে মুর্শিদি-মারেফতি-ফকিরি আখড়ার জমায়েত, ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালির মতন কত লোকসংগীতের অন-একক সংগীত, থাকে গণসংগীত, থাকে আজকের হিপহপ-র্যাপ-রক। ফুরায় না এ সিলসিলা সংগীতের।
Posted in: April 2021, PROSE
দারুন❣️। মায়া জড়ানো এক অনুভূতি উপলব্ধি করলাম
কাল রাত দেড়টায় লেখাটা চোখে পড়লো, প্রায় পনের মিনিট সময় নিয়ে পড়লাম। ছোটবেলায় একটা অভ্যেস ছিল আমার, সুস্বাদু বা পছন্দের খাবার যাতে তাড়াতাড়ি শেষ না হয় তাই অল্প অল্প করে অনেকটা সময় নিয়ে খেতাম। একটা অদ্ভুত ভালোলাগা আর তৃপ্তি কাজ করতো। ঠিক সেভাবেই মিনিট পনের সময় নিয়ে কোনও কোনও লাইন বারবার পড়েছি।
কত সহজ-সাবলীল অথচ কি গভীর ব্যাপ্তি। মনে হচ্ছিল পনের মিনিটেই টাইম মেশিনে চেপে আমার কৈশোর থেকে বর্তমানে ফিরে এলাম। লেখার পরতে-পরতে লেখকের স্মৃতিচারণ কল্পনা করার সাথে সাথে নিজের ফেলে আসা অতীতও কোথাও যেন হাতড়ে বেড়াচ্ছলাম।
মায়ের গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে জন্মলগ্ন থেকে বড় হয়েছি। তাই রবি ঠাকুরের গানের সাথে নাড়ির যোগ,মজ্জায় মিশে আছেন গুরুদেব।এ ক্ষেত্রে লেখকের সাথে আমার পছন্দের ভিন্নতা থাকলেও এমন উৎকৃষ্ট মানের লেখা বারংবার পড়তে ইচ্ছে করে।
খুব ভালো লাগলো