অনন্তকথা : অর্ক মন্ডল
সাত সকালের ঘনঘোর কুয়াশা থেকে আজ এই ধুলো-গড়ানো দুপুর- অনন্ত ঠায় বসে আছে। দুটো খিটকেল পোকার হাতে অদ্ভুত ভাবে নির্যাতিত হয়ে চলেছে সে। সে মনে-মনে পুনঃপুন বিচলিত হতে থাকে কিন্তু সেই বিচলন একটা নিভৃত স্রোতের মতো তার কিছু দূর দিয়ে বয়ে যায়। সে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু তার স্নায়ুর কেশাগ্র সেটা ছুঁতে পারে না। ফলত সে পুনঃপুন কাটা পড়া ঘুড়ির মতো শান্ত হতে চায়। এবং অনন্ত জানে, আজ ভোরের ঘনঘোর কুয়াশার থেকে এই ধুলো-গড়ানো দুপুরটা সে কিছুতেই আলাদা করতে পারবে না কারণ এইসব সকাল-দুপুর-বিকেল-সন্ধ্যে সমস্তই একটা সিঁড়ির একেকটা ধাপ। একটা ধাপ মুছে নিলে সিঁড়িটা কি তার সিঁড়িত্ব রাখতে পারবে- অনন্ত বুঝতে পারে না। অনন্ত রোজ এই সিঁড়ি দিয়ে ধীরেসুস্থে ধাপে-ধাপে ওঠে। তার এই কাজ কিন্তু এখন তার তেষ্টা পেয়েছে খুব। তৃষ্ণা বোধে সিঁড়ির অর্ডারটা গুলিয়ে যায়- সে জোর ক’রে মনে আনে জল। আর জল ভেঙে দুই অণু হাইড্রোজেন এক অণু অক্সিজেন এই ক্যালাস তথ্যটা ছাড়া জল সম্পর্কে কিছু মনে আনতে পারে না সে। তেষ্টায় তার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে এই বোধে সে চোখ বন্ধ করে আর চোখ বুজতেই একটা সন্ধ্যামণি গাছ তার চোখের সামনে দুলে ওঠে।
অনন্ত ফিক করে হেসে ফ্যালে। আর সেই দেখে একটা উচ্চিংড়ে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে চিৎকার দেয়- “বোকাচোদা, দাঁত ক্যালাচ্চো?” অনন্ত হাসি বুজিয়ে গম্ভীর হয়। তার চোখে ভেসে ওঠে নটরাজ মূর্তি। নটরাজের হাতের ভঙ্গিমায় সে আশ্বস্ত হয়। মনে করে যে একটু পরেই তার ছুটি হবে। আসন্ন ছুটির আরামে সে চোখ খোলে। গঙ্গাফড়িংটা কোথায় চলে গেলো? ফাঁকা চেয়ারের ঘাড়ের ওপর দিয়ে সে দেখে ঘোড়াসুভাষের ছবি- “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।“ ছুটি পেয়েই অনন্ত জল খাবে তিন গ্লাস। তারপর কী খাবে? তারপর সে খাবে দই। রসুল মিঁয়ার মিঠা দই- যে দই-য়ে তার কৈশোর মাখামাখি। রসুল মিয়াঁ কি বেঁচে আছে? দই-এর ছাঁচ চাখতে-চাখতে সে অনুভব করে রসুল মিয়াঁ জাদুকর ছিলো। গঙ্গাফড়িংটা কোথা থেকে উড়ে এসে আবার বসলো। তার দিকে চেয়ে দাঁত কিড়মিড় করছে। চেয়ারের তেলতেলে হাতলটায় হাত বোলায় অনন্ত। ব্যথা। ব্যথা। কোথা থেকে উৎপত্তি হয় মানুষের ব্যথার? সন্ধ্যামণি ফুল?
“বাঞ্চোৎ, মুচুকুন্দপুর স্টেশনে- কাল রাতে- পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্মে- তুমি ছাড়া আর কেউ শুয়ে ছিলো না! সকাল থেকে দুপুর গড়ালো- এবার চোদনামি রাখো মাস্টার- যা দেখেছো- যতটুকু দেখেছো- চুপচাপ বলো- তোমার ছুটি- না-হলে এটা জানো তো- এইটা- কোথায় ঢোকাবো বলোতো..” খিস্তি বা গালাগালি সম্পর্কে, অনন্ত ভাবে, সে সমস্তটুকু জেনে গেছে। সকালের জাগা থেকে রাত্রির ঘুম, সে কতোকতো গালাগালি শোনে, সমস্ত যৌনতা বিষয়ক, বেশিরভাগ অজাচার। প্ল্যাটফর্মে বেশি গালাগাল চলে পুরুষে-পুরুষে। নারীসম্পর্ককে ক্লিন্ন করে। এখনকার তাজা খিস্তিগুলো মনে-মনে আওড়ায় অনন্ত, আর ভাবে, এই ক্লান্ত দুপুরটা ভীষণভাবে যৌনধ্বস্ত- তারই সাক্ষীস্বরূপ এই যৌন খিস্তিগুলো ছাই রঙের ঘুঘু আর ঘিয়ে রঙের পায়রা হয়ে তার হেতুহীনতার চতুর্দিকে ঘুরছে। পিঠোপিঠি দুই বেঞ্চের ফাঁকে শুয়ে পড়ে অনন্ত। বাঁড়া ল্যাওড়া বাঞ্চোৎ বিটিচোৎ পাখিগুলো তার ঘনসন্নিবিষ্ট হয়। অনন্ত বুকে হাত বুলিয়ে-বুলিয়ে ঘুম আনে। হাতিবাড়ির জ্যাঠাইমা জগত্তারিণী হয়ে বেঞ্চিতে এসে বসে। নোনো-চেনোর দল খানকি-খানকি ক’রে চলে যায় নিরালার দিকে। ব্যথা। ব্যথা। বুকে পাখিগুলো ছটপটায়। অনন্ত পুনরায় হাত বোলায় বুকে, আর মুখের ভেতরে আলগোছে জমা লালাটা সুড়ুৎ ক’রে টেনে নেয়। আমার মুখে লালা নেই। শুকনো।
এক থাপ্পড়ে দারুণ ঝাঁকুনি খায় অনন্ত। এইবার সে বুঝতে পারে তাকে সজাগ হতে হবে। কাল রাত্তিরের ঝাঁকুনিটা একরকম ছিলো। সে সজাগ হয়ে উঠে বসেছিলো। কি কুয়াশারে বাবা! সমস্ত কুয়াশায় ঢেকে গেলেপর সে পেচ্ছাপ করে শুয়ে পড়েছিলো পুনরায়। কিন্তু সকল ঝাঁকুনিতে একইভাবে মুতে দিলে চলবে না-তো! এতে তারই বিপদ। তার দায় তাকে ছুটি পেতে হবে। সুতরাং বলাই মন্ডলের কথা সে চিন্তা করে। আরো চারজন। ব্যাপারটা সে এইভাবে ভাবে। বলাই মন্ডল কিছু ক্রিয়া করছে, আর চারজন তার প্রতিক্রিয়া। অথবা উল্টোটাও হতে পারে। প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া। ব্যাপারটা একটু গুছিয়ে নিতে নিতেই প্ল্যাটফর্মের হলদে আলোয় কী একটা চমকালো আর ব্যথার ঝিক্কুর তুলে বলাই মন্ডল দ্রুত শান্ত হয়ে এলো। কুয়াশায় নিভে গেলো চারজন। আর অনন্তর পেলো পেচ্ছাপ। পেচ্ছাপের রিনরিনে অনুভূতিতে অনন্তর চোখ কুঁচকে যায় আর সে দেখতে পায় একটা পাঞ্জা। “ব্যথা!” পাঞ্জাটা সরে গেলো। বদলে এগিয়ে এলো একটা উচ্চিংড়েমুখ। “কী?” “ব্যথা- চাকু- রক্ত!”“শালা! সকাল থেকে সাতকাণ্ড রামায়ণ হয়ে গেলো, আর তুমি দেশরথের জন্ম-বেত্তান্ত খুলেচো!” “কালু-চেনো-হুঁকো-রাধা।” কী এক পরিশ্রান্তির কালো জলে গা ধুচ্ছে অনন্ত। উদ্ধত পঙ্গপাল ওকে ঠেলে তুলে আনে পুনরায়। “কালুচেনোহুঁকোরাধা।” অনন্তর ছুটি। ডাকলেই আসতে হবে এই মর্মে অনন্ত ঝুঁকে প’ড়ে সেলাম জানায়।
একটু মুষড়ে গিয়ে অনন্ত হাঁটছিলো। পঙ্গপাল দ্বয় ঐ চারজনকে তুলে আনবে। আহ! আবার! ওরা হয়তো ক্লান্ত। হয়তো নিজেদের আর্থ-সাংসারিক বুকের বলয়ের মধ্যে ঢুকে ওরা ঘুমিয়ে রয়েছে। সেইখান থেকে তুলে আনা হবে। ওরা হয়তো প্রস্তুত। কিন্তু ওদের ঘুমগুলো! ওই ঘুমগুলো ভেঙে যাওয়ার ব্যথা। যেমন ওকে ঘিরে আজ সারাদিন দুর্বিনীত আঁশটে গন্ধ শোঁকা। যেমন ভোরের ঘনঘোর কুয়াশায় বলাই মন্ডলকে শান্ত সৌমভাবে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেছিলো। দেখেছিলো তলপেটে চাকু আর রক্ত। উবু হয়ে বসে তার নোংরা নিবিড় আঙুল দিয়ে ঘুমন্ত বলাই-এর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। ব্যথা! কী অপরূপ ব্যথার এক মন্ডল! এই পৃথিবীতে কতো ধরনের ব্যথা! বলাই মন্ডলের চিক্কুর দেওয়া ব্যথা, ওই শান্ত-সৌম ব্যথা, উচ্চিংড়ে-গঙ্গাফড়িং ব্যথা, কালু-চেনো-হুঁকো-রাধা ব্যথা, খিস্তিময় জগতের কানমুখের ব্যথা, হাতিবাড়ির জ্যাঠাইমা ব্যথা, সন্ধ্যামণি ব্যথা, তার নিজস্ব খুনখুনে ব্যথা- এই সমস্ত ব্যথাই কোথাও গিয়ে কি এক? জগত্তারিণীর ঘণ্টা বাজা শুরু হয়। শুকনো মুখে, বলাই-এর চুলে হাত বুলিয়ে দিতেদিতে সে ভেবেছিলো মায়ের অনন্য ডালপুরি খেয়ে দিন শুরু করবে।
খিন্ন বিকেলটুকু ফিরে যায় সন্ধ্যের আঁচলে। অনন্ত দাঁড়ায়। মুচুকুন্দপুর ইস্কুলের ফটক। এই স্কুলে ছোটদের বিজ্ঞান পড়াতো। উঁচু ক্লাস তাকে দেওয়া হয়নি। হেডস্যারের বিচক্ষণতায় কমিটির তুষ্টি হলেও অনন্ত কী করবে- যদি একদিন তার ক্লাসে ফার্স্ট বেঞ্চে এসে বসে ফুলসহ-এক-সন্ধ্যামণি-গাছ। সন্ধ্যামণি! মাস্টারের অনৈতিক ব্যবহারে গাছটি এই স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে যায়। অনন্তর জামা ছিঁড়ে দেয় একজন, আরেকজন তাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবার হুমকি দেয়। আর হেডস্যার তো সাক্ষাৎ ডবলএমএ যম। অনন্তর মনে হয়েছিলো সে যমালয়ে এক জীবন্ত মানুষ। অবশ্য নতুন স্কুলের গেটে সে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, পরপর দুইদিন। পামের সারিতে ঘেরা নতুন স্কুল, পুষ্করিণীতে যার ছায়া পড়ে। সন্ধ্যামণি,ভীতত্রস্ত পায়ে হেঁটে ছুটে গিয়ে বসেছিলো ঠিক করে দেওয়া অটোকাকুর অটোরিক্সায়। তারপর কৌতূহলী চোখদুটি দিয়ে তাকে দেখেছিলো, পরপর দুইদিন। তৃতীয়দিন, সাঙ্গ-পাঙ্গ জুটিয়ে নিয়ে এসে সে যখন অনন্তকে আর দেখতে পায়নি, হয়তো কিছুটা ব্যথাই পেয়েছিলো- এই ছিলো পুরনো অনন্তকে ছেড়ে নতুন অনন্তে যাওয়ার আগে তার শেষ চিন্তা।
Posted in: April 2021, STORY