অপ্রকাশিত কবি
[বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, বহু প্রতিভাশালী কবিই অপ্রকাশিত অপ্রচারিত থাকেন – কখনও বা তাঁদের ভাষা আঙ্গিক শৈলীর বিশেষত্বের কারণে, কখনও জনসংযোগ করতে অক্ষম বা অনিচ্ছুক ব’লে, আবার কখনও হয়ত কেবলমাত্র তাঁর ভৌগোলিক অবস্থান বা পরিবেশের কারণে। এমন কত কারণই ঘুরে বেড়ায়। একজন প্রকৃত কবির কাজ লুকিয়ে থাকে অপ্রকাশের আড়ালে।
“অপ্রকাশিত কবি” – অপরজন পত্রিকার একটি প্রয়াস, এমন কবিদের কাজকে সামনে আনার, যাঁরা ব্যপকভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত নন। যাঁদের লেখা হয় এর আগে কোথাও প্রকাশিত হয়নি, অথবা কেবলমাত্র দু’ একটি পত্রিকাতেই প্রকাশ পেয়েছে। অথচ যাঁরা লেখার মাধ্যমে আমাদের দেখাতে পারেন ভবিষ্যত বাংলা কবিতার বাঁক।
বিভাগ সম্পাদনা করছেন, রাহেবুল।]
প্রতিভা বর্মণ
জন্ম: ০৪/০৩/১৯৯১
জন্মস্থান: কোচবিহার জেলার বড়শৌলমাড়ি গ্রাম
কবিতা লেখার উদ্দেশ্য-বিধেয়: কবিতার নিগূঢ় তত্ত্বে নিজেকে প্রস্ফুটিত করা।
প্রথম প্রকাশ: স্বপ্নসন্ধানী সাহিত্য পত্রিকা।
জন্মসনের বিচারে বয়সে খুব যে তরুণ তা বলা যাবে না প্রতিভাকে। কিন্তু ওর লেখার পরিমাণ যথেষ্টই কম। এখনও অব্দি কোনো বই নেই। যে দু’চারটে লেখা প্রকাশিত তাও অখ্যাত দু’একটি ছোট পত্রিকায়। ওর কবিতার প্রধান গুণ সরলতা। মনেহয় নিষ্পাপ। উচ্চারণ নিভৃত। এখনও ভাষাগত বিচারে সমসময়ের বা অতীতের পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে প্রতিভার কবিতার অবস্থান যথেষ্ট দূরত্বে মনেহয়। ব্যক্তিগত দুঃখ-সুখ, না-পাওয়া, পথ চলতি নানান ওঠা-পড়া, গ্রামীণ জীবনের অনটন আর সেইসবের নিবিড় চিত্রকল্প ওর কবিতার সারল্যকে ধরেছে। আর একটা দিকও আছে হয়তো, মেয়েদের বড়ো হওয়ার বাড়তি চাপ যেটা। প্রেম-পরিবার-পরিজন ইত্যাদি সকল মিলে যে নিয়ত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-ক্ষয়। যদিও পরিপার্শ্বের বহুবিধ কূটকচাল কবিতায় অধরাই প্রায়, তাই জটলা-জটিলতাও কম। সরলতা আর সৎ উচ্চারণের কথা ভেবেই প্রতিভার একগুচ্ছ কবিতার পাঠ/স্বাদ নেওয়া যাক।
প্রতিভা বর্মণ-এর কবিতা
যাপন ও একটি ভোর
দেখতে দেখতে ধানক্ষেত সবুজে ভরে গেল
বসে বসে একলা ঋতুপরিবর্তন দেখি
বাবার চোখে এখন আর সবুজ নেই
অতিবৃষ্টির ফলে এখনও ধান বোনা হয়নি বলে
বাবা রাশি রাশি দুশ্চিন্তার ফসল বুনে চলেছে।
এখন সন্ধ্যে নামবে বলে
গোধূলিকে আর নতুন করে জানান দিতে হয় না।
নিঃশব্দে সন্ধ্যা মালতী পাপড়ি মেলে দেয় ঝরবে জেনেও।
অতঃপর রাত নেমে এলে
রোজ রাতে কাকে যেন দেখি
বুকে বই চেপে
নিবিড় ফসলের ধার বেয়ে হেঁটে যেতে।
অনেকদিন পাখির ডাক শোনা হয়নি
চোখেও পড়েনি কোনো আলো
তবুও বুকে সযত্নে লালন করি
একটি স্নিগ্ধ ভোর।
একটি অ-কবিতা
১.
যার হারাবার কিছু নেই
সে কি কখনও কাঁদে
সুখ দুঃখ একরাশ হিমের মতন
আর কিছু নয়
ধূলার শরীর থেকে
উঠে আসা ঝরা পাতার মতন
জীবন প্রবাহে ভাসছি নিরন্তর।
২.
একলা জীবনে ভেসে গেছে
কত বিষণ্ণ বিকেল
নিবিড় ফসলের কত কান্না শুনেছি
সারারাত জেগে
এখনও রাত জাগি উড়ে চলি
যেভাবে ঝড়ের শেষে
অফুরান নীলে উড়ে চলে
নীড় ভাঙা পাখিটি।
বিষণ্ন
ঝরা বকুল দেখেছ কি?
শুকনো অথচ থেকে যায় সুগন্ধ
শুকনো স্মৃতিগুলো আজও
মনোভূমিতে সুবাস ছড়িয়েই চলছে।
চোখের তারায় ভিড় করা রঙিন স্বপ্নগুলো ফিকে আজ,
যদি কখনো চোখ যায়
রক্তিম প্রভাতের রাঙা হাসির দিকে
অনাকাঙ্ক্ষিত বৃষ্টি অসময়ে ঢেকে দেয় দৃষ্টিপথ—
মনের কড়া শাসন উপেক্ষা করেও
অবাধ্য চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
মন খারাপের বেলায়,
কালো মেঘ থেকে ক’ফোঁটা বৃষ্টি বিন্দুর পতন
কে বা মনে রাখে বলো?
ঝরে যায় খুব তুচ্ছভাবেই।
মাপা সংলাপ
বৃষ্টি ভেজা দিনান্তে
মেঘের বুকচেরা কান্নার আওয়াজ আর ভিজে হাওয়ার আনাগোনায়,
চোখের কোণে ও বৃষ্টি নেমেছিল প্রবল।
কাঁচা জোৎস্নাকে আড়াল করে
একটুকরো ধূসর মেঘে দুঃস্বপ্নের উঁকি, বারম্বার।
বিদায় নিতে তুমি সে সময় নির্লিপ্ত, নির্বাক
আর মুখ চাইতেই যেন মাপা সংলাপ।
আকীর্ণ কাগজ কলম, আমার ভাবনারা তখনও বন্দী,
তবুও সূর্যাস্ত সন্ধ্যা থেকে কাকভোর পর্যন্ত বিষন্ন শব্দগুচ্ছরা খুজেছিল মুক্তির পথ।
কল্পিত সুখানুভূতি কেবলই বিমূর্ত অথবা পদ্মপাতার জল,
আলতো ছোঁয়াতেই ঝরে পড়ে।
ঝড়, সে তো কবেই গেছে চলে
কিন্তু মনপাপড়িতে এখনও বিপর্যস্তের ছাপ
অথচ মুছে দিয়েও গভীরেই থেকে গেল
সেদিনের শেষ মাপা সংলাপ।
অন্তঃকরণের দহন
১.
গভীর অসুখ থেকে উঠে
পূর্বজন্মের ক্ষত নিয়ে বসে আছি
কি অতল সেই ক্ষত
অথচ কোন রক্তপাত নেই।
২.
শিশির সিক্ত কন্ঠে
গান ধরেছে সদ্যজাত পাখি
এখনো বোঝেনি সে
ললিত বসন্ত শেষে
ঝড় আরও হিংস্র হয়।
৩.
সান্ধ্য শিশিরের সাথে কথা বলে
অন্তঃকরণের দহন
শীতলতা দাও এ তো দীর্ঘ সময়ের দাবি
সমস্ত ছায়া হাসি গান
একে একে মিশে গেছে গোধূলির রঙে
অসংখ্য ছায়ামুখের আড়াল থেকে
আরও একবার কে যেন কেঁদে ওঠে।
Posted in: March 2021 - Serial, POETRY