লৌকিক – অলৌকিক – অলীক মানুষ : উমাপদ কর
[কবি ও গদ্যকার উমাপদ কর বছর আটেক আগে গল্প ও উপন্যাসকার সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের অনন্য উপন্যাস “অলীক মানুষ” নিয়ে চরিত্রভিত্তিক একটি দীর্ঘ আলোচনা তথা গদ্য লেখেন, যা প্রকাশ পায় “বিনির্মাণ” পত্রিকায়। সম্প্রতি অপরজন পত্রিকার তরফে সেই গদ্যটি প্রকাশ করতে চাইলে তিনি পূর্বোক্ত গদ্যটিকে সংযোজন-বিযোজন-বিবর্ধন ইত্যাদির মাধ্যমে পুনর্লিখিত করেন। গদ্যটি দীর্ঘ। লেখকের সম্মতিক্রমে আমরা বেশ কয়েকটি কিস্তিতে (৬-৭) আলোচনাটি প্রকাশ করব ধারাক্রমে প্রতিমাসে। আজ তার প্রথম পর্ব।]
‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসটির উপজীব্য অধিকাংশ চরিত্র বস্তুতঃ সেই সময়কালের প্রেক্ষিতে যথার্থ বাস্তব, এবং অলৌকিকত্ব যা, তা শুধুই বহিরাবরণের ও যত্নে আরোপিত। অলীক, বিশেষ্য পদ, অসত্য বা মিথ্যাকে বোঝায়। বিশেষণে অমূলক, বৃথা বা অসারকে প্রতিপন্ন করে। ‘অলীক মানুষ’ শব্দবন্ধটি অমূলক বা অসার মানুষকে রেফার করে। এখন, যে-কোনো স্থান-কাল-দর্শনে এটি অবাস্তব। মানুষকে মানুষই, অলীক অবান্তর অসম অসহিষ্ণু অতিমানব অশংক অসভ্য অপরিণামদর্শী অকরুণ অকুতোভয় অকৃপণ অচ্ছুৎ অত্যাসক্ত অদ্ভুত অনাচারী অন্তর্যামী অনুসন্ধিৎসু অন্বয়ী অন্যায়কারী অনাসক্ত/সক্তা অপকারী অপয়া অজ্ঞেয় অপারগ অবহেলিত অবিবেচক অবুঝ অযোগ্য অশরীরী অশুভকর অশ্লীল অসংযত অসহযোগী অসামাজিক অসূয়ক অহংবাদী অহিংস অহৈতুক ইত্যাদি ইত্যাদি অ-যুক্ত বিশেষণে বিশেষিত করে থাকে। অলৌকিক বা লোকাতীতের শুরুটা এখান থেকেই। আমরা তক্মা এঁটে দিই, এবং নানারকম মিথ-এর জন্ম দিই প্রকারান্তরে মানুষকে বাস্তব নয়, এমনকি স্বপ্নও নয়, অন্য এক আধিভৌতিক জায়গা থেকে বিচার বিশ্লেষণ শুরু করি। এমন মানুষ কি বাস্তবে সম্ভব, উপরোক্ত বিশেষণগুলির এক বা একাধিক যার ওপর ন্যস্ত নয়? অলীক মানুষও তাই স্বাভাবিক অবস্থান, যেমন অসামাজিক মানুষ বা অসহিষ্ণু মানুষ।
‘অলীক মানুষ’ উপন্যাসে উপন্যাসকার এরকমই একটা সৃষ্ট পরিবেশ-পরিমণ্ডলে, যা সেই কাল ও স্থানিক পরিসরের প্রেক্ষিতে আদৌও অবাস্তব ও অবিজ্ঞানসম্মত নয়, একাধিক ও চলমান ঘটনাক্রমের ভূগোল-ইতিহাস-মনস্তত্ত্ব-সংস্কৃতি-বিজ্ঞান ইত্যাদির মাধ্যমে পর্যটনকালে বেশকিছু চরিত্রের উত্থাপন করেছেন। এই চরিত্রগুলোকে উপন্যাসজনিত কারণে যেমন ভাগ করা যায়, তেমনি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এবং তাদের ক্রিয়াকাণ্ড ও ভাবনার নিরিখেও ভাগ করা চলে। চরিত্রগুলোকে দুটো কারণে বেছে নেব। দেখতে চাইব, ঐ সময়কালে ও স্থানিক অবস্থানে চরিত্রগুলো আদৌ অলীক কিনা, হলে তাদের অলৌকিকত্ব কীভাবে প্রকাশিত, নাকি সেই সামাজিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সবই বাস্তবসম্মত, বা বাস্তবের লৌকিক ও অতিলৌকিক উভয় পরিসরেও কখনো কখনো প্রকাশিত। দেখতে চাইব, ঘটনাক্রমের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা, ধর্ম-রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক জগতটিকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে এবং একইসঙ্গে তারা নিজেরাই বা কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে।
বারবার ঘুরেফিরেই আমি স্থান ও কালের কথা বলছি। তাই, প্রথমেই স্থান ও কালকে নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। প্রয়োজন সেই সময়কালের মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করা এবং স্থানবিশেষের সামাজিক-অর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবস্থাটিকে বুঝে নেওয়া। সময়কালটি প্রায় একশ বছর ব্যাপ্ত। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। (সুবিধার জন্য ইংরেজি ও বাংলা সন ব্যবহৃত হবে, হিজরি সনের উল্লেখ থাকবে না)। আর স্থানিক অবস্থানটি মোটামুটি পরাধীন (ইংরেজ শাসনে) ভারতবর্ষের অবিভক্ত বাংলার গঙ্গা-পদ্মা-ব্রাহ্মণী ইত্যাদি নদী তীরবর্তী জনপদ, যা মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম জেলার অংশবিশেষ। রোডম্যাপটা এমন— (বর্তমান কালের) বহরমপুর, লালবাগ, ভগবানগোলা, কৃষ্ণপুর, লালগোলা, ব্রহ্মপুর, হরিণমারা, মৌলাহাট ইত্যাদি ইত্যাদি। এবারে কিছু মুখ্য ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ চরিত্রকে দেখা যাক।
বদিউজ্জামান
পিরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাকারীর মহালে নাম পরিচিতি বদু-পির। জন্ম— ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দ, মৃত্যু— ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দ। পিতার নাম জানা যায় না, মা— কামরুন্নিসা। পুরো নাম— সৈয়দ আবুল কাশেম মুহাম্মদ ওয়াদি-উজ-জামান আল হুসায়নি আলখু্রাসানি। মুসলিম ধর্মগুরু। ফরাজি। পূর্ববাঙলার প্রখ্যাত ফরাজি আন্দোলনের প্রবক্তা হাজি শরিয়তুল্লার মুরিদ বা শিষ্য। এঁদের মতে আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। এর কোনো দূত বা মহাপুরুষ নেই। মাথা নোয়াতে হলে একজনের কাছেই মাথা নোয়াতে হবে। তিনি আল্লাহ। আল্লার নিরাকারে বিশ্বাসী। হিন্দুদের বা যে-কোনো পৌত্তলিকতাবাদীদের ঘোর বিরোধী। মাজার, পির এসবে বিশ্বাস নেই। উলটে ঘোর জেহাদ। ‘সুফি’ এবং ‘মজনুন’— অর্থাৎ যারা ঈশ্বরপ্রেমে উন্মাদ তাদের ঘেন্না করে। এঁরা সংসারত্যাগী নয়, বরং সংসারের যাবতীয় ক্রিয়াকর্মাদি ও ভাবধারার প্রতি আস্থাশীল। সঙ্গীত এঁদের কাছে হারাম। মসজিদে পাঁচ-ওয়াক্ত নামাজপড়া অবশ্যকর্তব্য। ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্বেষী, একইভাবে হিন্দুদের হিঁদুয়ানির বিরুদ্ধেও। ইংরেজ এবং হিন্দুরা একইভাবে কাফের এবং এদের বিরুদ্ধে যে-কোনোভাবে লড়াই চালানো বা মুসলিম ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধিই আল্লাহর ইচ্ছা তথা ফরাজিদেরও। হানাফি মুসলমান সম্প্রদায় যে বিপথগামী সেটাও তাঁরা মান্য করে এবং তাদের ফরাজি সম্প্রদায়ভুক্ত করতে চা্য। এবার যদি মৌলানা বদিউজ্জামানের কথায় আসা যায় উপরোক্ত সবকিছুই তাঁর প্রাথমিক পরিচয়। বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা যায়— ক) ‘যেমন অমায়িক, মিষ্টভাষী আর ভাবপ্রবণ, তেমনি খামখেয়ালি, জেদি আর হঠকারী’। খ) খুব ভালো বক্তা। ‘বক্তৃতায় সবাই মুগ্ধ’। ‘উদাত্ত ও মন্দ্র কণ্ঠস্বর’। আবৃত্তিও ভালো করেন। গ) মুসাফির। সব সময় ঠাঁইনড়া। কোথাও মৌরসীপাট্টা গাঁড়া নেই। মসজিদে ভাষণে বলেন— “আল্লাহ পাক আমাকে জিন্দেগীভর রাহি মুসাফির করেছেন। যদি বলেন, আপনার দেশ কোথায়? আমার কোনো দেশ নাই ভাইসকল! আমার দেশ সারা দুনিয়া।” উদাহরণস্বরূপ— ছোট ছেলে শজিউজ্জামানের জন্ম কাঁটালিয়া। এবারে শফির বয়ক্রম অনুসারে স্থানসকল— তিন— পোখরা, পাঁচ— বিনুটি গোবিন্দপুর, দশ— নবাবগঞ্জ, বারো— কুতুবপুর, ষোলো— খয়রাডাঙ্গা, পরের বছর মৌল্লাহাট এবং তার জন্মের পূর্বেও একই অবস্থা। ঘ) হানাফি মুসলমানদের তাঁদের দলে আনতে বদ্ধপরিকর। ছোটভাই ফরিদুজ্জামান ‘মজনুন’। তাকে ফরাজি করার লক্ষ্যে এমনই জুলুম ও অত্যাচার করেছেন, যে তিনি নিরুদ্দিষ্ট। ঙ) বালিকা সাইদাকে বিয়ে করার পর নিজে তিন বছর নিরুদ্দিষ্ট ছিলেন। কারণ জানা যায় না। হতে পারে বালিকাকে নারী হওয়ার সময় প্রদান। চ) পৌত্তলিক, সম্ভবত একদা হিন্দুব্রাহ্মন ঘরের বৌ, বর্তমানে আবদুলের স্ত্রী ইকরাতনকে ফরাজি করতে বদ্ধপরিকর। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, প্রাণে বাঁচিয়ে, শেষে নিকাহ করেন। আবার তালাকও দেন। ছ) সংবেদনশীল, মানবিক। ঐশী বিধানের সঙ্গে নিজ জীবনকে মেলানোর চেষ্টায় যে অবদমন, তাতে তাকে কষ্ট পেতে দেখা যায়। এ-সবই এক ধর্মপ্রচারক গোঁড়া মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক। ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত গ্রামীন মানুষের কাছেও সত্য ও বাস্তব।
এরপর আমি তাকে নিয়ে যে অলৌকিকত্ব, মিথ, কেউ দেখেনি অথচ হয়, অমুকে বলেছে বা তমুকে শুনেছে, আবছা অস্পষ্ট দেখেছে, ওঁর সবই জানা, ইত্যাদি ইত্যাদি কথাবার্তায় আসি। ক) “মৌলানার সঙ্গে আসমান থেকে জিনেরা নিশুতি রাতে দলিজ ঘরে দেখা করতে আসত। জানলা দিয়ে ঠিকরে পড়ত শাদা রোশনি।” জিনেরা আসে, দেখা ও কথা হয়, আলোচনা চলে। তারা নানা তথ্য যোগায়। জিন দুরকম। শাদা জিন, ভালো ও মিত্র। সঠিক রাস্তা বাৎলে দেয়। কালো জিন, মন্দ ও দুষমন। ভুল পথ দেখায়। এরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপ ধরে আসে। গোটা উপন্যাসে বারবারে এদের উপস্থিতির জানান। তবে প্রচার এই, এই জিনদের মৌলানার সঙ্গেই যা দহরম। সাধারণে নয়। সাধারণে প্রচার পায় মূলত বদিউজ্জামানের মা কামরুন্নিসা ও স্ত্রী সাইদা বেগম এবং কখনও কোনো ঘনিষ্টজনের মাধ্যমে।
খ) “কিছুক্ষণ পরে অলৌকিক ঘটনাটি ঘটল। একেই বলে বুজুর্গের মোজেজা— দিব্য-শক্তির নিদর্শন। ……… হুজুরের অসাধ্য তো কিছু নাই।” সাধারণে প্রচার হুজুর অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত করার ক্ষমতাধারী। তার অসাধ্য কিছু নাই। সে হারানো পথ উদ্ধারের মাধ্যমেই হোক বা অন্য কোনো ক্ষেত্রে। শাদা চুল, শাদা ভুরু, শাদা চোখের পাতা সম্বলিত মানুষ বকলমে জিন হাজির হয়ে যায় হুজুরের জোরালো উদাত্ত কণ্ঠস্বরে। বদ-জিনকে হারিয়ে সৎ-জিনকে নিয়ে আসা ও কর্মসাধন করা তাঁরই কীর্তি।
গ) বদিউজ্জামান সর্বজ্ঞ। সংসারে খুঁটিনাটি সমেত সবকিছু তার জ্ঞাতসারেই ঘটে। যেমন তাঁর বেয়াইন (পুত্রের শাশুড়ি) দরিয়াবানু গভীর রাতে ডুমুরগাছে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লে পরদিন সকালে “বদিউজ্জামান শুধু বলেছিলেন আমি সবই জানতাম।” স্রেফ এই কথার ভিত্তিতে প্রচার ছড়িয়ে পড়ে, পিরসাহেব এই আত্মহত্যার কথা জানতেন জিনদের মাধ্যমে। জিনের সঙ্গে তাঁর প্রচুর তর্কাতর্কি হয়, যা শুনেছিল মসজিদ সংলগ্ন একটি বাড়ির বুড়োবুড়ি। পিরসাহেব, আল্লাহর ইচ্ছাই পূর্ণ হোক এই ভাবনায় জিনকে ফেরৎ পাঠান। ব্যথিত জিন চলে যাওয়ার সময় নিমগাছে আলোর ঝলক তুলে যায়, যা তারা দেখেছিল। আল্লাহ সাতটি দোজখের একাংশ খালি রেখেছেন এই আত্মহত্যাকারীদের জন্য।
ঘ) মায়ের মৃত্যু বদিউজ্জামানকে টলাতে পারেনি। কেননা সেটা আল্লাহর ইচ্ছা। ‘মউতের জন্য শোক হারাম’। তাই মৌলাহাট (যেখানে মা মারা গেছেন) থেকে দশ ক্রোশ দূরে মহুলা যাওয়ার সময় যখন তিনি আম্মাজানের ইন্তেকালের খবর পান, শিষ্যরা গাড়ীর মুখ ঘোরাতে চাইলে তিনি ভর্ৎসনা করে ওঠেন এবং নিজস্ব কার্যক্রম বজায় রাখেন। সেই সন্ধ্যাতেই মৌলাহাটে অলৌকিক ঘটনা ঘটে। কালবোশেখি উপস্থিত হয় সন্ধ্যায় জানাজার সময়। “বিস্মিত হয়ে তারা দেখে, অবিকল হুজুরের মতো লম্বা-চওড়া এবং শাদা আলখেল্লা, সবুজ পাগড়ি পরা একটি মানুষ আগের সারির সামনে লাশের কাছে দাঁড়িয়ে জানাজার নামাজ পড়ছেন। ধুলোর পরদার ভেতর ওই দৃশ্য এমনকি মেঘের গর্জনের ভেতর চেনা গম্ভীর কণ্ঠস্বরও কেউ কেউ শুনেছিল।”
ঙ) বদিউজ্জামান বাঁধে হাঁটলে বাঁধ পাথর হয়ে যায়। মহুলা “নদীটি ছোট্ট হলেও তার নিষ্ঠুরতা ছিল অসামান্য। বর্ষার পর থেকে তার হিংস্রতা যেত বেড়ে। এ পাড়ের বাঁধ ভেঙে কতবার সর্বনাশী হয়ে ঘর সংসার ভাসিয়ে দিয়েছে লোকের।” হাজি নসরুল্লা “মুচকি হেসে বলতেন, আর ডর নাই বাছারা। হুজুর বাঁধে হেঁটেছেন, বাঁধ পাথর হয়ে গেছে।” অভ্যাসমত বদিউজ্জামান প্রতি বিকেলে তাঁর ময়ূরমুখো ছড়িটি নিয়ে বাঁধ ধরে বহুদূর হেঁটে যেতেন। বিকেলে কোনো ঘাসজমিতে একা ‘আসরের নামাজ’ পড়ে নিতেন। “লোকেরা বাঁধটির দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, এই শাদা ধূসর মাটির বাঁধ অবশ্যই পাথরে পরিণত হতে চলেছে।”
চ) হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই জানে মৌলানা বদিউজ্জামান ওরফে বদুপির ওরফে হুজুর ওরফে মহম্মদ (কোনো একসময় এই ভূষণেও তাঁকে ডাকা হতো) তাঁর বিভূতি জড়ানো জলপড়া বা তুকতাকে বা ওষধিতে, ঝাঁড়ফুকে, এমনকি তাঁর দর্শনে সমস্ত রোগ নির্মূল করতে পারেন। বিভিন্ন জায়গায় তাই মসজিদের বাইরে কাতারে কাতারে লোক জড়ো হতো। লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হতো সেই বার্তা। “জুম্মাবারে তারা দল বেঁধে স্ত্রী পুত্র কন্যা নিয়ে মসজিদের বাইরে একটা গাবগাছের তলায় ভক্তিভরে বসে থাকত। অসুখের জন্য পিরসাহেবের মন্ত্রপুত জল ঘটিতে করে নিয়ে যেত। পিরসাহেবের দর্শন আশীর্বাদ চাইত।” এমনকি শিক্ষিত হিন্দু জমিদার অনন্ত নারায়ণ ত্রিবেদী তার মেয়ে রত্নময়ীকে পিরসাহেবের কাছে পাঠান আরোগ্যের জন্য। তার ছিল ফিটের ব্যামো। অনেক ডাক্তার কবিরাজে উন্নতি না-ঘটলে পিরসাহেবে বিশ্বাস স্থাপন। কথিত আছে পিরসাহেবের সঙ্গে রত্নময়ীর আরবীতে বাহাস (তর্ক) হয় এবং শেষাবধি রত্নস্থিত জিনটি পালায়।
ছ) “গোরস্থানে বেশরা মস্তান আর বদুপিরের বামছ আর বহুত ২ জিনের জঙ্গের পর বিবি কামরুন্নিসার গোর হইতে উঠার বয়ান।” বয়ানটি দীর্ঘ। খুব সংক্ষেপে ‘শবে বদর’ এর রাত্রে মায়ের কবর জেয়ারতে বের হন বদুপির। সঙ্গে ময়ূরমুখো ছড়ি। সেখানে হুজুরের মতই আরেকজন, হাতে চিমটা। উভয়ে উভয়কে গালিগালাজ শুরু করে। তর্ক শুরু হয়। শরিয়ত এবং মারফতের সেই বাহাস কেউ বোঝেনি। শেষে ছড়ি ও চিমটাতে আগুন ছড়ানো যুদ্ধ। ভয়ে লোকজন কাঁপতে শুরু করে এবং দেখে কামরুন্নিসার কবরস্থল ফেটে দুভাগ হয় এবং তিনি উঠে দাঁড়ান। তিনি প্রথমে মস্তানের (বস্তুত বদুপিরের ভাই ফরিদুজ্জামান) কপালে ও পরে বদুপিরের কপালে চুম্বন করেন এবং আসমানে অন্তর্হিতা হন।
জ) তিনি ইচ্ছা করলে ‘মোজেজা’ দেখাতে পারেন। যেমন কথিত আছে, ‘তালেবুলএলেম’ জালালুদ্দিনকে তিনি ‘মোজেজা’ দেখিয়েছেন। এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁর বহুদিনের অনুগামী হরিণমারার ছোটোগাজি মোজেজা দেখার প্রার্থনা জানালে, সে-ও এক মোজেজার সম্মুখীন হয়। যদিও এই নিয়ে বদিউজ্জামানের স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে— “আল্লাহ কি সকল মানুষকেই হরবখ্ত্ মোজেজা দেখান না?” আরও, “জালালুদ্দিন যদি কিছু দেখে থাকে, তার মধ্যে আল্লাহ্ ইল্ম্ (প্রজ্ঞা) দিয়েছেন বলেই দেখেছে।” অর্থাৎ, আল্লাহ সবাইকেই সবসময়ই মোজেজা দেখিয়ে চলেছেন, যার মধ্যে আল্লাহ সেই মোজেজা দেখার অনুভবশক্তি দেন সেই তা দেখতে পায়। এখানে তিনি নিজেকে খানিকটা আড়ালে রাখেন। হঠাৎই চৈত্রের ঝোড়ো ঘূর্ণিহাওয়ায় ছোটোগাজির মাথার টুপি উড়িয়ে নেয়, পুকুরের জলে আলোড়ন তোলে, ধেয়ে যায় সড়কের দিকে। হাসতে হাসতে তিনি একে ‘কমবখ্ত্ জিনের তামাসা’ বলে উল্লেখ করেন। জিনের খেলা চিন্তন থেকে সরেন না।
ঝ) তিনি তাঁর কেতাবে কিছু ভবিষ্যতবাণী লিখে রেখেছিলেন। যেমন— “চান্দ্রমাস জেলহজ্জের দশম দিবসে কেয়ামতের (মহাপ্রলয়) নিদর্শন প্রকাশ পাইবে। সেই দিবস সূর্য উঠিবে না। দুনিয়া অন্ধকার থাকিবে। … … অতঃপর তাহারা আশ্চর্যান্বিত হইয়া দেখিবে, পশ্চিমদিকে সূর্য উঠিতেছে। তখন তাহারা জানিবে, কেয়ামত নিকটবর্তী কিন্তু হায়! তখন তওবার (ক্ষমাপ্রার্থনা) দুয়ার আল্লাহ বন্ধ করিয়াছেন। … … প্রাণীসকল মৃত ও নিশ্চিহ্ন হইবে। সমস্ত নিরাকার শূন্যে পরিণত হইবে। শুধু থাকিবেন আল্লাহ এবং তাঁহার বান্দা ফেরেশতাবৃন্দ। আর আল্লাহ তখন ইস্রাফিলকে দ্বিতীয়বার শিঙায় ফুঁ দিতে বলিবেন। এক্ষণে মৃত সকল প্রাণী, সকল মানুষ ও জিন পুনরায় জীবিত হইবে।” সৃষ্টির পূর্ণ ধ্বংস ও পুনর্নির্মিত হওয়ার ভবিষ্যতবাণী। যেন দিব্যদৃষ্টি আছে তাঁর, বা ফরাজি মতে এমন কিছু পরম্পরাগতভাবে জেনেছেন তিনি।
(ক্রমশ)
Posted in: March 2021 - Serial, PROSE