কুয়াশায় চুনিয়ায় গিত্তল মি আচ্ছিয়ায় : শাফিনূর শাফিন

রাসেল একদিন হুট করে ফোনে জানালো, “আমি মধুপুর যাচ্ছি। তুমি যেতে চাও? তুমি তো অনেক দিন ধরে ময়মনসিংহ যাবে যাবে করছিলে।” জিজ্ঞেস করলাম হঠাৎ মধুপুরে যাচ্ছো কেন? বললো বীথি আপুর গিত্তাল মি আচ্ছিয়া’র প্রদর্শনী হবে ওখানে। সাথে সাথে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো সাদা উঠান। সবুজ গাছ। একটা বাচ্চা মন খারাপ করে গাছ কেটে ফেলা দেখছে। ফাংসাং! সাদিকা রুমনের লেখা থেকে ফাংসাং আর তার গ্রাম দেখা। এরও বহুবছর আগে- তখন আমি দোস্ত বিল্ডিং-এর পাঁচতলায় বসে শুনছিলাম গারো আদিবাসীদের যত্নের, জীবিকার একমাত্র উপায় বন, তাদের অঞ্চল বেদখল হয়ে যাচ্ছে কিংবা অধিগ্রহণ হয়ে যাচ্ছে। এই নিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রতিবাদ করতে গিয়ে কেউ যেন মারাও গেছে। তখনই আমার প্রথম জানা কিভাবে সব দেশে-দেশেই আদিবাসীরা বঞ্চিত হয়ে এসেছে। কীভাবে রেড ইন্ডিয়ানদের গণহত্যা করে ইউরোপীয়রা তাদের ভূমি থেকে তাদেরই উচ্ছেদ করেছে। কোন এক রেড ইন্ডিয়ান কবি লিখছেন…আমারে কবর দিও হাঁটুভাঙার বাঁকে! আবার একই নিপীড়নের চিত্র দেখা যায় অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও। এবং শাসকের রূপ সবদেশে, সব ভাষায় কি ভীষণ একইরকম ! তো এসব এক পলকে মনে পড়ে গেলো মধুপুরে যাওয়ার কথা শুনে। এবং বিপরীতে আদিবাসীদের পক্ষে, শাসকদের বিপরীতে কাজ করতে গিয়ে কি কোথাও সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিনিজেদের ভাবনা-চিন্তা চাপিয়ে কর্তৃত্ব স্থাপন করে ফেলছেকিনা সে প্রশ্নও টোকা দিলো মাথায়।

কুয়াশাময় চুনিয়া। আলোকচিত্রী: আসমা বীথি

ভুল বাস কাউন্টারে বসে থেকে শুরু হলো যাত্রা। টানা ৮ ঘন্টার বাস যাত্রা শেষে যখন মধুপুরে পৌঁছালাম তখন মোটামুটি কনকনে শীত আমার হাড় কাঁপিয়ে দিয়েছে! সকালের নাশতা করে যখন গ্রামের দিকে রওনা দিলাম ট্যাক্সিতে করে, সাদা ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় চারপাশের কিছুই তখন চোখে পড়ছে না। গ্রামের মাঠঘাট, বাড়িঘর সব ঝাপসা! চুনিয়া গ্রামে ঢোকার মুখেই একটা ব্রীজ আছে। দেখলাম, সেই কুয়াশা ঢাকা ভোরে ব্রিজের উপর বীথি আপু, সৈকত ভাই এবং আরও কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে আমরা নেমে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে আসা সহযাত্রীরা দোতারা বাজিয়ে তখনি গান শুরু করে দিলো। যেন নিজেরাই নিজেদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নেওয়া আরও একটা নতুন দিনে নতুন অভিজ্ঞতা প্রাপ্তির আগে।

চুনিয়ায় কালভার্টের উপর ভোরবেলায় গান। আলোকচিত্রী:আসমাবীথি

আমরা যেদিন পৌঁছাই মধুপুরে সেদিন ছিলো ২১ জানুয়ারি। সেদিন সন্ধ্যায় জনিক আচ্চুর বাড়ির উঠানে ছবিটির প্রদর্শনী হয়। কবি এবং ‘গিত্তাল মি আচ্ছিয়া’র পরিচালক আসমা বীথির ইচ্ছে ছিল, যদি এই তথ্যচিত্রটির প্রদর্শনী কখনো বাংলাদেশে হয় তবে সেই প্রথম প্রদর্শনীটি মধুপুরের চুনিয়াতেই হবে এবং সেই প্রদর্শনীটি তিনি জনিক আচ্চুর পাশে বসে, তাঁকে সঙ্গে নিয়েই দেখবেন। সেই সন্ধ্যায় আচ্চু, আচ্চুর গ্রামের মানুষ এবং দেশের নানা অঞ্চল থেকে আসা আমরা অনেকেই প্রথম দর্শক হিসেবে ছবিটি দেখলাম। তথ্যচিত্রটির উদ্বোধনী পর্বে আরও অনেক অভ্যাগতদেরসহ উপস্থিত ছিলেন কিংবদন্তী সঙ্গীতশিল্পী কফিল আহমেদ।

মান্দি। মানে মানুষ। একটি জাতির নাম। ব্রিটিশরা এসে নাম দিয়ে দিলো তার গারো। সাংমা, মারাক আর মমিন মিলে মান্দি জাতি। মান্দিদের হাজার বছরের প্রাচীন ধর্ম সাংসারেক। তাদের বড় কঠিন আইন। সেই আইন প্রতিবেশীর অসুবিধে করে আনন্দ সমর্থন করে না। মান্দিদের কাছে নারীর সম্মান সবচেয়ে বেশি। নারীর ইচ্ছের মূল্য বেশি। মান্দি আদিবাসীরা জানে বন, পাহাড় তাদের পূর্বপুরুষদের। একদিন ঘুম ভেঙে দেখে সবই নেই হয়ে গেছে। অধিগ্রহণ হয়ে গেছে রাতারাতি! অধিগ্রহণ থেকে বাঁচতে, স্বজাতিকে বাঁচাতে, নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে পড়া থেকে বাঁচতে, সবচেয়ে বেশি নিজের অস্তিত্ব বাঁচাতে সে খুঁজে ফিরে উপায়। তখন সেখানে এসে হাজির হয় যিশুর বাণী নিয়ে পাদ্রীরা। যেন একটা উপায়, একটা খড়কুটোর দেখা তারা পায় যা তাদের সাহায্য করবে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে! খ্রিস্টান মিশনারীরা এই অঞ্চলে আসে ধর্ম প্রচার ছাড়াও শিক্ষা এবং সেবার বার্তা নিয়ে। মোটামুটি সবাই গ্রহণ করে মিশনারীদের ধর্ম। হাজার বছরের মান্দি মার্তৃপ্রধান সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতি ধীরে ধীরে মিশে যায় খ্রিস্টান ধর্ম এবং প্রথার সাথে। সেইসাথে সাংসারেক ধর্ম এসে দাঁড়ায় হারিয়ে যাবার দ্বারপ্রান্তে! তখন একমাত্র একজন দাঁড়িয়ে থাকেন তার সমস্ত ক্ষমতা এবং শক্তি নিয়ে সাংসারেককে আগলে। তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী অন্যতম ধর্মের বিপরীতে একা দাঁড়িয়ে থাকেন সাংসারেক মান্দি হয়ে। তিনি জনিক নকরেক। সাংসারেক ধর্মের শেষ মশাল হয়ে যিনি পালন করে যাচ্ছেন সমস্ত আচার। যার কারণে সাংসারেক নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েনি। এই জনিক নকরেক নিয়ে আলোকচিত্রী এবং কবি আসমা বীথি তৈরি করেছেন ডকুফিল্ম গিত্তাল মি আচ্ছিয়া যার বাংলায়ন ‘নতুন ধানের জন্ম’। কিন্তু এই ডকুমেন্টারি শুধুই জনিককে নিয়ে ভাবলে ভীষণ ভুল করা হবে। এটি ক্ষমতার বিপরীতে একা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার গল্পকে তুলে এনেছে। তুলে এনেছে একটা অঞ্চলের নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি এবং তার ইতিহাস, ৩৬ মিনিট ব্যাপ্তির তথ্যচিত্রে। এই ডকুমেন্টারি ধারণ করা হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত। ধান কাটার পরে যে বীজধান থেকে আবার ধান হবে তাকে ভূমিকে দিয়ে ভূমিপূজা করা হয় মাটিকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে যেন সে আবার ফসল দেয়- শুরুতে এই দৃশ্যের মতো এমন বহু দৃশ্য খুব সুক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছে মান্দিদের উজ্জ্বল সংস্কৃতি। জনিকের সাথে বঙ্গবন্ধুর পরিচয় এবং আলাপচারিতার কথা আমরা জানতে পারি অন্যদের বয়ানে। জনিক হেঁটে যান শালবনের ভিতর দিয়ে যেখানে সূর্যের আলোর রেখা একটা তীক্ষ্ণ সুরের মতো ছড়িয়ে পড়ে। লং শট, আলোর ব্যবহার এবং শব্দের ব্যবহার এই ছবিতে অসাধারণ বলতে হবে। ছবিটি যখন চলছিলো তখন আমার পাশে বসে থাকা অলীক মৃ মান্দিদের ইতিহাস বলে যাচ্ছিলো। এইজন্য গারো ভাষায় ডকুমেন্টারি হবার পরেও বুঝতে সহজ হচ্ছিলো। আসমা বীথি কবি বলেই হয়তো কাব্যিক ভঙ্গীতে দেখার একটা প্রয়াস পাওয়া যায়। এই দেখাতে প্রশ্ন উঠতে পারে, কোথাও কি বহিরাগতের দৃষ্টিকোণ থেকে গেছে কিনা?

গ্রামের সবাই বসে দেখছে গিত্তল মি আচ্ছিয়া। আলোকচিত্রী: মইনুল আলম

ডকুমেন্টারি শেষে খেয়েদেয়ে সবাই পূর্নিমাদের বাড়ির দাওয়ায় বসে গান শুরু করলো। মান্দিদের এটাও এক চমৎকার বৈশিষ্ট্য। তারা বেশ আনন্দ উৎসবপ্রবণ। প্রাত্যহিক জীবনের ক্লান্তি ভুলে যায় নাচ গান করে। রাত পার হলো কফিল আহমেদের গান, গানের দল ‘মাদল’, পংকজ রনি, রনি জাবালি, টুম্পা, রাসেল এবং পিনাকিদার গান শুনে। আগুন পোহাতে পোহাতে শীতের শব্দ আর নানা বাদ্য-বাঁশির তালে গান শুনতে শুনতে। এসব যখন চলছে, তখন শালবনের ভিতর সদ্য পরিচয় হওয়া দুজন মানুষের কথা কানে বেজে যাচ্ছিলো, ‘‘এই বন ভূমি, জমি সব অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণের নামে আদিবাসীদেরও ঘেরাও করে রাখা হবে। যাতে পর্যটকরা এসে বনের পাশাপাশি গারোদের দেখেও আনন্দ পায়!’’ এই যে এখন আমরা গারো বাঙালী একসাথে বসে গান গাইছি খোলা আকাশের নিচে, আকাশের আধখানা চাঁদ দেখতে দেখতে, কখনো কখনো মনে হচ্ছিলো, এই যে সহজ যাপন- আমরা কেন এর সাথে থাকতে পারি না! কেন শত্রুতার বীজ বপন হয়ে যায় সহজেই!

Facebook Comments

Leave a Reply