“ভারতীয় রাজনীতি”, তুমি ভালো আছো তো ?? – জয়ন্ত ঘোষাল

১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্টের মধ্যরাতে যখন খণ্ডিত ভারত রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে, তখন সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত আপামর ভারতীয় জাতি এক নবতম যুগের উদ্ভাসের স্বপ্নে বিভোর ছিল বলা যায়। যদিও তথাকথিত “জাতির জনক” এমন স্বাধীনতা আশা করেননি, এবং নিজেকে এমন খণ্ডিত জাতির আত্মপ্রকাশের উৎসব পালন হতে বিরত রেখেছিলেন – এমন কথিত আছে। তবে, নবজাতক ভারত রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থার চরিত্র তথা কর্ণধার বর্গের অভিষেক সম্পাদনে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকা অনুচিত। এছাড়াও বলা যায়, ভারতীয় রাজনীতির বীজ উপ্ত হয়েছিল স্বাধীনতা লাভের বহু পূর্বে। একথা নিয়ে কোনও সংশয় থাকতেই পারেনা যে, ভারতের স্বাধীনতা আনয়নে বহু আন্দোলন অস্তিত্ব রাখলেও কোনও অভ্যুত্থান বা সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা আসেনি। বলা বাহুল্য যে, ভারতের স্বাধীনতা এসেছিল মূলত: একটি “প্রবরবাদী ক্ষমতা হস্তান্তর” প্রক্রিয়ার মাধ্যমে; অর্থাৎ, ব্রিটিশ প্রবরদের হাত থেকে রাজনৈতিক প্রাধিকার হস্তান্তরিত হয়েছিল ভারতীয় নরমপন্থী প্রবরদের হাতে; এবং ব্রিটিশ সংসদীয় শাসনব্যবস্থাকেই এই দেশের ভবিষ্যতের আদর্শ প্রতিরূপ বলে ধরে নেওয়া হয়, তথা ভারতীয় সংসদীয় শাসনব্যবস্থার গোড়াপত্তন করা হয়। তৎসহ যথাবিহিত পদ্ধতিতেই ভারতের তদানীন্তন চয়িত প্রবরবর্গের সমন্বয়ে সংগঠিত গণপরিষদ নামক সংস্থার বদান্যতায় যে ভারতীয় সংবিধান প্রণীত হয়, সেখানেও বিষয়টি মান্যতা পায়। তবে, এটা আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, শ্রীলঙ্কার মতো কোনও ব্রিটিশ আইনজ্ঞ প্রণীত (স্যর আইভর জেনিংস) সংবিধান আমরা আমাদের ঔপনিবেশিক শাসকদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার উপহার হিসাবে পাইনি; এবং তৎকালীন বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সংবিধানকে বিশ্লেষণ তথা অনুসরণ করেই এক সঙ্কর প্রজাতির সংবিধান আমাদের তথাকথিত সংবিধান প্রণেতাবর্গ আমাদের উপহার দিয়েছিলেন; যা কার্যকর হয়েছিল ১৯৫০ সাল হতে।
উপরে যে চিত্রটি তুলে ধরা হল, সে বিষয়ে পাঠকেরা প্রায় সকলেই অবগত। তবে, মজার ব্যাপার হল এটাই যে, ভারতীয় সংবিধানের কোনও অংশেই রাজনৈতিক দলব্যবস্থার উল্লেখ না থাকলেও, সংসদীয় গণতন্ত্রের মসৃণ পরিচালনা হেতু বহুদলীয় ব্যবস্থা কেই একমাত্র বিকল্প রূপে মান্যতা দেওয়া হয়; তথা নির্বাচন কমিশন নামক এক “নিরপেক্ষ” সংস্থার জন্মদান করা হয়। যদিও দ্বিতীয় কাজটি ছিল সাংবিধানিক। সেই হিসাবে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালে, যার মাধ্যমে জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসি সরকার ভারত রাষ্ট্রের ভাগ্যবিধাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। উল্লেখ্য যে, সংসদীয় ব্যবস্থায় যেহেতু রাষ্ট্রপতির ভূমিকা কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক সম্মতিজ্ঞাপনসূচক স্বাক্ষর প্রদানের মধ্যেই সীমায়িত, তার ফলশ্রুতিতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভা সকল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ভারতীয় রাজনীতির নির্মম রূপ এই সময় হতেই প্রকাশিত হতে থাকে, যা আজও বর্তমান ।
১৯৫২ হতে সংসদীয় রাজনীতির জয়যাত্রা যেমন সূচিত হয়, তার সাথেই প্রকট হয় আরেক ব্যাধি, যার নাম – পরিবারতন্ত্র। একথা সকলেরই জানা আছে যে, নেহেরু পরিবারতন্ত্র ভারতের সংসদে তার প্রভাব বিস্তার করে রেখেছিল প্রায় ২০১৪ সাল পর্যন্ত। জরুরি অবস্থা, লাইসেন্স রাজ, তথা আঞ্চলিক দলকে সরকারে বসিয়ে পুনরায় ক্ষমতাচ্যুত করা, সাংসদ ক্রয়, বিচারবিভাগকে খর্ব করে রাখা, বহুবিধ সংশোধনী আইন প্রণয়ন – এসবই ছিল তাদের মূল রাজনৈতিক কর্মপন্থা। এছাড়াও রাজ্যে কোনও শক্তিশালী বিরোধী সরকার থাকলে, তাকেও বারবার ৩৫৬ ধারার মাধ্যমে ভেঙ্গে দেওয়ার নিদর্শনের অভাব নেই। রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব যে “প্রবরের আবর্তন” তত্ত্বের প্রচার করে, তা যেন এই সময়কালে অর্থহীন হয়ে পড়েছিল বলা যায়।
তবে, ২০১৪ সালে এক নতুন প্রবরের আত্মপ্রকাশ ঘটে। হিন্দুত্বের ইন্দ্রজালে ভারতীয় হিন্দুদের মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে আবির্ভূত হয় ভারতীয় জনতা পার্টি। বলা বাহুল্য, ধর্মনিরপেক্ষতাকে নস্যাৎ করেই মোদী যুগের সূত্রপাত ঘটে। কংগ্রেসি সরকারের দুর্বলতাগুলিই যেন এই দলটির শক্তিবৃদ্ধি ঘটায়। “আচ্ছে দিন” নামক এক অলীক স্বপ্নে ভারতীয়দের বিভোর করেই তার জয়যাত্রা সূচিত হয় ভারতীয় রাজনীতিতে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ম্যাক্স হ্বেবার যে গণমোহিনী কর্তৃত্বের কথা তুলে ধরেছিলেন, তার চাক্ষুষ প্রমাণ যেন এই মোদীতন্ত্র। উদ্ভট হিন্দুত্ববাদ, মিথ্যাচার, পুঁজিতান্ত্রিক রাজনীতির বলে বলীয়ান এই বিজেপি সরকার। রাজা উলঙ্গ ঠিকই কিন্তু রাজভক্তদের দৃষ্টি যেন পাকিস্তান আর চিনের প্রতি আবদ্ধ। এই “হীরকের রাজা” নিজেকে ফকির রূপে প্রতিভাত করেন, কিন্তু , অতি সুকৌশলে জনগণকে নিঃস্ব করতে সিদ্ধহস্ত। জিডিপি নিম্নতম, সঞ্চয় বিলীয়মান, জাতীয় সম্পত্তি বেসরকারিকৃত, কৃষকরা অসন্তুষ্ট, বেকারত্ব ঊর্ধ্বগামী, ক্ষুধা ক্রমবর্ধমান; অথচ জনগণকে কত সুন্দরভাবে “হিন্দু – মুসলিম” খেলায় ব্যাপৃত রেখেছেন, নির্মাণ করতে চলেছেন রাম মন্দির, অথচ সেই রাম জন্মভূমিতেই ধর্ষিত হয়ে চলেছে কত জানকী – কত দুর্গা। স্ফীত হয়ে চলেছে দেশের দুই বিখ্যাত পুঁজিপতির সম্পদ। তাঁরা, অবৈধ অনুপ্রবেশের জিগির তুলে আসামের মানুষকে নিজভূমে পরবাসী করেছেন, কয়েদী বানিয়েছেন। এখন এই “হাল্লার রাজা” তার সামন্তদের নিয়ে চলেছেন বঙ্গ বিজয়ে, যে বঙ্গ চিরকাল ভারতীয় রাজনীতিকে নতুন দিশা দেখিয়েছে, ভারতীয় মানসকে মনীষার সম্ভার দান করেছে; বিশ্বের দরবারে সমাদৃত হয়েছে যে বঙ্গীয় মেধা, তাকেই অস্বীকার করার অপচেষ্টার অন্ত নেই। তার সাথেই সুকৌশলে চলছে নেতাজি সুভাষ এবং রবিঠাকুরকে একপ্রকার হাইজ্যাক করার চেষ্টা; যদিও বাংলা ভাষার অবমাননার বিষয়টি প্রাচীর নির্মাণ করে বস্তি ঢেকে দেওয়ার মতো করেই অন্তরালে রাখা হচ্ছে।
পাশ্চাত্যের মার্ক্সবাদ একদা এই তত্ত্ব প্রচার করতো যে, পুঁজিবাদ যখন চরমভাবে বিকশিত হয়, তখন, রাষ্ট্র তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে এবং রাজনীতি বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা হয়ে ওঠে অর্থনীতির প্রতিফলন মাত্র। অন্যভাবে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় যে, রাষ্ট্র যন্ত্র পুঁজিপতিদের অনুগত হয়ে পড়ে। তবে, এর বিরুদ্ধে বহু মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক একথাও প্রচার করেছিলেন যে, একসময় পুঁজিপতিদের দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্র নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। কিন্তু, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারতে প্রথম বিষয়টির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এক দেশ এক সংবিধান বা এন আর সি–র মতো বিষয়গুলি যে পুঁজিবাদী স্বার্থরক্ষার সফল প্রচেষ্টা মাত্র, সেটি একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যাবে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকার যদি অপার অর্থশক্তিকে বিনিয়োগ করে বিরোধীদের ক্রয় করে ফেলতে পারে, তাহলে পুঁজিপতিদের পক্ষে মনোপলি মার্কেট প্রতিষ্ঠা অতি সহজ হবে।
অতিসম্প্রতি ভারতীয় রাজনীতির শব্দকোষে একটি নবতম শব্দবন্ধের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে, যা হল “আত্মনির্ভর ভারত” । শাব্দিক দিক হতে এর অর্থ হল, ভারত স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। অর্থাৎ, যাবতীয় বৈদেশিক প্রযুক্তিগত নির্ভরতা অতিক্রম করে ভারত স্বদেশী শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠবে। কিন্তু, একটি সরল মৌলিক প্রশ্ন হল, ভারত কি আদৌ নিজস্ব কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম গড়ে তুলতে পারবে? সাধারণ যুক্তির ভিত্তিতে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ভারত সেটাও পারবে ভবিষ্যতে; সেক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি ভারতকে রেয়াৎ করবে? WTO-র চাপের কাছে নতিস্বীকার না করেই ভারত তার আত্মনির্ভরতাকে প্রতিষ্ঠা দান করতে সক্ষম হবে? উত্তরে বলা যায়, ভারতের পক্ষে মার্কিন নির্ভরতা কাটিয়ে ওঠা আদৌ সম্ভব নয়। তাই, আত্মনির্ভরতার তত্ত্ব একটি কষ্টকল্পনা ব্যতীত কিছুই না। আরও বড় ব্যাপার হল, যে রাষ্ট্র মানবসম্পদ বিকাশ অপেক্ষা ধর্মের বিকাশ নিয়ে ব্যাপৃত থাকে, তার পক্ষে এমন উন্নয়ন সাধন অসম্ভব।
আলোচনার অন্তিম চরণে উপনীত হয়ে বলা যায়, আপামর ভারতবাসীর মননে যদি আত্মচেতনার উন্মেষ যদি সাধিত না হয়, তারা যদি ভারতীয় রাজনীতির প্রকৃত রূপটিকে অনুধাবনে ব্যর্থ হন, তাহলে রাষ্ট্রের ব্ল্যাক বক্সে ভূমিকা পালনকারী কারবারিরা অতি সহজেই নিজেদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সক্ষম হবে। মনে রাখা প্রয়োজন একটি ব্যবস্থার রূপান্তর সাধনের শক্তি কিন্তু সরবরাহ করে উপরিকাঠামোতে থাকা সিভিল সোসাইটি। বর্তমান দিনে ধর্মের দ্বারা যে ISA নিজের প্রভাববিস্তার করে একটি HEGEMONY গড়ে তুলেছে, তার বিরুদ্ধে COUNTER HEGEMONY গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই বহন করতে হবে। তবেই, জন্ম নেবে শত – শত উদয়ন পণ্ডিত, যারা উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়ে বলবে – “দড়ি ধরে মারো টান , রাজা হবে খান খান…”। তবেই, উপরি কাঠামোতে থাকা HIGH POLITICS তার স্বাতন্ত্র্য ফিরে পাবে…

Facebook Comments

Leave a Reply