মোৎসার্টের চিঠি : দোলনচাঁপা চক্রবর্তীর অনুবাদে
– অনুবাদক।]

মোৎসার্ট, বাবাকে,
১৭ই অক্টোবর ১৭৭৭, অগ্সবার্গ
প্রিয় বাবা,
স্টাইনের পিয়ানোর কথা দিয়ে শুরু করি। স্টাইনের কোনও কাজ দেখার আগে, সব সময় স্প্যাথের পিয়ানোই আমার পছন্দের ছিল; কিন্তু এখন স্টাইনের কাজই বেশি ভালো লাগছে, রেগেন্সবার্গের যন্ত্রের চাইতে ওগুলো অনেক বেশি ভালো। আমি জোরে বাজাতে চাইলে, আমার আঙুল ওঠানো আছে নাকি নামানো, তাতে কিছু যায় আসে না, সুর বেরিয়ে আসার মুহূর্ত পরেই থেমে যায়। যেভাবেই আমি চাবিগুলোকে বাজাই না কেন, ধ্বনিটা সব সময়ই সমান থাকে। যান্ত্রিক শব্দ তোলে না, আরও জোর বা নরম হয়ে যায় না এমনকি শব্দ তুলতে ব্যর্থও হয় না; এক কথায় বলতে গেলে, সব সময়ই সমান থাকে। এটা সত্যি যে, উনি ৩০০ ফ্লোরিনের নিচে এমন একটা পিয়ানো বেচবেন না, কিন্তু যে চেষ্টা আর শ্রম উনি এগুলোর পেছনে দিয়েছেন তার কোনও মূল্য হয় না। ওনার যন্ত্রের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাদের এস্কেপ ক্রিয়াটি। একশো জনের মধ্যে একজন নির্মাতাও এ নিয়ে মাথা ঘামায় না। কিন্তু এসকেপ ক্রিয়াটিকে বাদ দিলে কোনও পিয়ানোতে যান্ত্রিক ধ্বনি উৎপন্ন না হওয়া অথবা সুরটা বাজার পরে তা ছড়িয়ে না পড়া অসম্ভব; চাবি টেপা মাত্র, তার হাতুড়িটা তারগুলোকে স্পর্শ করা মাত্রই পিছনদিকে পড়ে যায়, তা সে আপনি চাবিগুলোকে টিপে ধরে থাকুন অথবা ছেড়ে দিন। উনি আমাকে বললেন যে কেবলমাত্র এরকম একটা পিয়ানো তৈরি করা শেষ হওয়ার পরেই উনি সমস্ত প্যাসেজওয়র্ক, রান আর লিপ্গুলোকে পরীক্ষা করে দেখেন, এবং, শেভ ব্যবহার করে, যন্ত্রটি নিয়ে ততক্ষণ কাজ করতে থাকেন যতক্ষণ না সমস্ত কিছু মনোমতো হয়। উনি কেবলমাত্র সঙ্গীতের সেবা করার জন্যই পরিশ্রম করেন, শুধু নিজের লাভের জন্য নয়, নয়ত এতদিনে শেষ হয়ে যেতেন।
উনি প্রায়ই বলেন যে উনি যদি এত বড় সঙ্গীতপ্রেমী না হতেন, আর যন্ত্রের উপর যদি ওঁর সামান্য দক্ষতা না থাকত, বহু আগেই নিজের কাজ করার ধৈর্য শেষ হয়ে যেত; কিন্তু উনি সেই যন্ত্রকে ভালোবাসেন যে যন্ত্র কখনো একজন বাজিয়ের সম্মান নষ্ট হতে দেয় না, আর থাকেও অনেকদিন। ওঁর পিয়ানোগুলো সত্যিই বহুদিন থাকবে। উনি শপথ করে বলেন যে ওঁর সাউন্ডবোর্ড ভাঙবে না, ফাটবেও না। একটা পিয়ানোর জন্য একটা সাউন্ডবোর্ড তৈরি করা শেষ হলে উনি সেটা বাইরে রেখে দেন, যাতে হাওয়া, বৃষ্টি, বরফ, সূর্যের তাপ আর আরও যতরকম কিছু রয়েছে সবকিছু লাগতে লাগতে সেটা ফেটে যায়। তারপরে উনি ওটার মধ্যে ওয়েজ ঢুকিয়ে দেন, যেগুলোকে আঠা দিয়ে আটকে দিতে হয়, যাতে ওগুলো প্রচণ্ড শক্ত আর কঠিন হয়ে যায়। ওগুলো ফেটে গেলে উনি খুব খুশি হন কারণ এতে উনি আশ্বস্ত হন যে আর কিছু ওগুলোতে হওয়া সম্ভব না। সত্যিই, উনি নিজেই অনেক সময় ওগুলোর ভেতরটা কেটে দেখেন আর তারপরে আবার আঠা দিয়ে জুড়ে দেন। ফলে ওগুলো খুব শক্ত হয়ে যায়। এভাবে উনি তিনটে পিয়ানো বানানো শেষ করেছেন। আজকের আগে আমি ওগুলোর কোনোটাতে দ্বিতীয়বার বাজিয়ে দেখিনি।
আজকে — ১৭ তারিখে — আমরা হের গাস্যার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজন সারলাম। একজন অকৃতদার যুবক যিনি তার সুন্দরী যুবতী স্ত্রীকে হারিয়েছেন। মাত্র ২ বছর ওঁদের বিয়ে হয়েছিল। অসামান্য এবং নম্র একজন মানুষ এই যুবকটি। আমাদের সময়টা ভীষণ ভালো কেটেছে। ওখানে আবে অঁরি, বুলিংগার এবং ওয়াইজহফারের একজন পুরনো সহকর্মীও ছিলেন। একজন প্রাক্তন জেস্যুইট যিনি এখন এখানকার ক্যাথিড্রালে একজন খ্যাপেলমাইস্টার। উনি হের শ্যাখ্টনারকে ভালোমতো চেনেন, ইঙ্গোশটাডে ওঁর কোয়্যারমাস্টার ছিলেন। ওঁর নাম পিটার গারব্ল। হের শ্যাখ্টনারকে ওঁর শুভেচ্ছা পৌঁছে দিতে হবে আমার।
মধ্যাহ্নভোজনর পরে হের গাস্যার আর আমি হের স্টাইনের বাড়িতে গেছিলাম। ওখানে ওঁর একজন বৌদির সঙ্গে মাম্মা আর আমাদের একজন তুতো বোনও ছিল। ৪টে নাগাদ খ্যাপেলমাইস্টার আর হের শ্মিড্বাওয়ার আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন। সেন্ট উল্রিখে হের শ্মিড্বাওয়ার অর্গ্যান বাজান, চমৎকার বৃদ্ধ মানুষটি, দারুণ কথা বলেন; এরপর আমি দেখে দেখে বিকার একটা সোনাটা একটু পড়লাম যা প্রচণ্ড কঠিন আর অসম্ভব খারাপ; যেভাবে খ্যাপেলমাইস্টার আর অর্গ্যান বাজানো ভদ্রলোক নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছিলেন, তা বলার নয়। এখানেও, মিউনিখেও বহুবার আমি স্মৃতি থেকেই আমার ৬টা সোনাটা বাজিয়েছি। বাওয়ার্নশ্টুবেতে অভিজাতদের কনসার্টে পঞ্চমটা আমি জি-তে বাজিয়েছিলাম। শেষেরটা, ডি-তে, স্টাইনের পিয়ানোতে অসাধারণ শুনতে লাগে। যে সরঞ্জামটা আপনি হাঁটু দিয়ে চেপে থাকেন, সেটাও অন্যদের চেয়ে ওঁর যন্ত্রে বেশি ভালোভাবে তৈরি। আমার প্রায় ওটাকে ছুঁতেই লাগে না অথচ ওটা দিব্যি কাজ করে; আর যেইমাত্র আপনি হাঁটুটা একটুও সরাবেন, ওটার কম্পন পর্যন্ত আপনি টের পাবেন না। আগামীকাল আমি ওঁর অর্গ্যানগুলোকে পেতে পারি। মানে, বলতে চাইছি যে, ওগুলোর সম্বন্ধে লিখতে পারতে পারি; ওঁর ছোট্ট মেয়েটিকে আমি একদম শেষের জন্য রেখে দিয়েছি।
যখন হের স্টাইনকে বললাম যে আমি ওঁর অর্গ্যানে বাজাতে চাই যেহেতু অর্গ্যান আমার প্যাশন, উনি খুব অবাক হয়ে বললেন: আপনার মতো একজন মানুষ, এত বড় একজন কীবোর্ড বাজিয়ে এমন একটা যন্ত্র বাজাতে চান যেটাতে কোনও ডজ্যুয়ার নেই, কোনও প্রকাশভঙ্গী নেই, পিয়ানো বা ফোর্ত্ নয় বরং সব সময় একই রকম শুনতে লাগে? —আমি বললাম, এসবে কিছুই যায় আসে না। আমার চোখে আর কানে অর্গ্যান হলো যন্ত্রের রাজা। উনি বললেন, বেশ, আপনি যেমন চাইবেন। আমরা একসঙ্গে বেরোলাম। ওঁর কথা থেকে আমি বুঝতেই পারছিলাম যে উনি মোটেই ভাবেননি যে আমি ওঁর অর্গ্যান নিয়ে বিশেষ কিছু করব – যেমন – পিয়ানোতে বেশি ভালো লাগে এমনভাবেই হয়ত বাজালাম। উনি আমাকে বললেন যে শ্যুবার্ট ওঁর অর্গ্যান দেখতে চেয়েছেন, আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। উনি এও বললেন –শ্যুবার্ট সকলকে ইতিমধ্যেই বলে বেড়িয়েছেন, চার্চও ভর্তি হয়ে গেছিল; আমার মনে হচ্ছিল যে উনি হৃদয়, ভেতরের আগুন আর গতির তাড়নায় জমিয়ে ফেলবেন, যদিও এর কোনোটাই অর্গ্যানে কাজ করে না; কিন্তু উনি শুরু করা মাত্রই আমার মন বদলে গেল। কেবল জিজ্ঞেস করলাম, কি ভাবছেন, হের স্টাইন? আপনার কি মনে হয় আমি অর্গ্যানটা ঠিক সামলাতে পারব না? –উনি বললেন, আপনার কথা আলাদা। আমরা ততক্ষণে কোয়্যারে পৌঁছে গেছি।
আমি সঙ্গে সঙ্গে যেমন মনে এলো বাজাতে শুরু করলাম, উনি ততক্ষণে হাসতে শুরু করেছেন। চারপাশ স্তব্ধ। উনি বললেন, আমি বেশ বুঝতে পারছি –যদি আপনি সত্যিই এভাবে বাজান তার মানে হলো যে আপনি অর্গ্যানটা বাজানো পছন্দ করেন– প্রথমে পাদানিটা একটু অস্বস্তিকর লাগছিল যেহেতু ওটাতে কোনও ভাগ ছিল না। ওটা শুরু হলো ‘সি’ দিয়ে, তারপরে ‘ডি’, আর তারপরে একই শ্রেণীতে ‘ই’। কিন্তু আমাদের তো ‘ডি’ আর ‘ই’ ওপরে থাকে, ‘ই’ ফ্ল্যাট আর ‘এফ’ শার্প এখানে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই আমার অভ্যাস হয়ে গেল। সেন্ট উল্রিখে পুরনো অর্গ্যানটাতেও আমি বাজিয়েছিলাম। ওটার ধাপগুলো একেবারে দুঃস্বপ্নের মতো। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম কেউ আমার জন্য ওটা একটু বাজাতে পারবে কিনা, ততক্ষণে আমি নেমে একটু শুনে নিতাম। ওপর থেকে অর্গ্যানটা একদমই কার্যকর নয়। কিন্তু আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না যেহেতু যুবক কোয়্যারমাস্টারটি, যিনি কিনা একজন পাদ্রী, কেবলমাত্র স্কেলগুলোকে বাজিয়ে গেলেন, ফলত তা থেকে কোনোরকম বোধ তৈরি করা সম্ভবই ছিল না। আর যেই উনি কিছু কর্ড বাজাতে চেষ্টা করলেন, সেটা কেবল বেসুরো শোনালো যেহেতু ওটা সুরে বাঁধা ছিল না।
এরপর কফি-ঘরে যেতে হলো যেহেতু মা, বোন আর হের স্টাইন আমাদের সঙ্গে ছিলেন। পিটার অ্যামেলিয়ান নামে কে একজন, উদ্ধত বদমাশ একটা যে তেমন কিছু করেও না, বেজায় ফুর্তিতে ছিল। সে কেবলই বোনটার সঙ্গে মশকরা করে যাচ্ছে, আর ওদিকে বোনটা ওকে নিয়ে ঠাট্টা করছে – শেষমেশ, যখন ওর বেশ চড়ে গেছে (যাতে একেবারেই বেশি সময় লাগেনি), সে গানবাজনা নিয়ে কথা শুরু করল। সে একটা ক্যানন গাইল, আমি শুনে বললাম যে জীবনে কখনও এর চেয়ে মধুর ভাবে এটা কাউকে গাইতে শুনিনি। দুঃখপ্রকাশ করে জানালাম যে আমি এতে যোগ দিতে পারব না যেহেতু গান গাওয়ার কোনও স্বাভাবিক ক্ষমতা আমার নেই। সে বলল, তাতে কিছু যায় আসে না। সে গানটা ধরল। তৃতীয় গলাটা ছিল আমার, কিন্তু খুব আলাদা কয়েকটা শব্দ আমি তৈরি করে ফেলেছিলাম, যেমন, ওহে ছ্যাঁচড়া, আমার পেছনটা তোমার চাটার জন্য। খুব আস্তে বোনের কানে কানে বলেছিলাম অবশ্য। আধ ঘণ্টা ধরে এই নিয়ে হাসাহাসি চলল আমাদের। লোকটা বলে কিনা: আরেকটু সময় যদি একসাথে কাটানো যেত। বিন্যাসের শৈলী নিয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে ইচ্ছে করছে। আমি বললাম, তাহলে তো শুরু না হতেই কথাবার্তা শেষ হয়ে যাবে। দূর হও। (চলবে)
মোৎসার্ট
Posted in: March 2021 - Serial, TRANSLATION