কার্ল ইয়ুং – কুণ্ডলিনী যোগের মনস্তত্ত্ব : অনুবাদ – অর্ঘ্য দত্ত বক্‌সী

[১৯৩২ সালের সেমিনারে প্রদেয় এ বক্তৃতার মূল উদ্দেশ্য ছিল অপরিচিত ভারতবর্ষকে জানা চেনার জন্য পাশ্চাত্যের অপরিসীম কৌতুহলকে কিছুটা পূরণ করার চেষ্টা। এখানে কুণ্ডলিনী সাধনাকে পাশ্চাত্যের মনোবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে; এমনভাবে যা কিনা হয়তো সিদ্ধ তান্ত্রিকরাও করেন না। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত যেমন ভারতেরই সাধারণ মানুষের কাছে শুধু সেই “আ আ আ আ …” তেমনই কুণ্ডলিনী বা তান্ত্রিক সাধনা বিষয়ে জ্ঞান আপামর ভারতবাসীর কাছেও প্রায় শূন্য, কিছুটা ভয়-ভীতি-ভক্তির ব্যাপার! সেই ধারণাগুলি প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের আপামর জনতার কাছেই আজও ৮০% অধরা। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে ধর্ম-সাধনা-যোগ বা দেবদেবী বলে যদি কিছু আসলে থেকে থাকে তার মূল আকর হল কুণ্ডলিনী যোগ। তার থেকেই প্রতীকায়নে দেবমূর্তি, পুজোয় শঙ্খ কাসর ঘণ্টা, তার থেকেই প্রতীকে বলা পুরাণ কী সৃষ্টিরহস্য (সমুদ্র মন্থন)। ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়নে বিকারগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার আগে ধর্ম বলতে শুধু এটাই বোঝাতো। এগুলি দেহগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আবার এই অভিজ্ঞতা এক একজনের কাছে এক একরকম, তবে দেহগত বলে ( কোন আইডিয়া নয় ) সব ধর্মেই তাই এর প্রভাব কমবেশি আছে। তাই প্রাচীন ধর্মগুলির ‘গল্প’গুলো খানিকটা একরকম।
ব্যস এটাই, এখানে শুধু শরীরী-সংস্থানগতভাবেই নয়, প্রতিটি চক্রের চিত্রিত প্রতীকগুলিকে মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিশ্লেষণ করে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে যে এই শরীরী চক্রস্থানে বীর্য উঠে এলে যা অনুভূতি হয়, তার সঙ্গে সঙ্গে মনেও এক আলাদারকমের ভাব জেগে ওঠে। সেই ভাবগুলিকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন ইয়ুং। তিনি নিজে যোগাসন প্রাণায়াম সবই করতেন। এছাড়াও এই বক্তৃতাগুলো গ্রন্থরূপে ও ইংরেজিতে আমেরিকায় প্রকাশিত হচ্ছে নব্বইয়ের দশকে। এবং বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। এইসব চর্বণগুলি তাই প্রাসঙ্গিক থেকে যায়। কারণ কুণ্ডলিনী এক শাশ্বত জিনিষ ও যা যা শাশ্বত তাতেই অনুবাদকের আগ্রহ।

গত সংখ্যায় কার্ল ইয়ুং প্রদেয় প্রথম বক্তৃতার অনুবাদের ধারাবাহিকতায় এই সংখ্যার অনুবাদ, দ্বিতীয় পর্ব]

দ্বিতীয় পর্ব

সংস্কারকে মূর্ত বিষয় হিসাবে ধরলে আমাদের কাছে তার কোন প্রতিরূপ নেই। এটি সম্পূর্ণভাবে একটি দার্শনিক চিন্তা যার অল্পই মাত্র যথাযথতা আমরা খুঁজে পাই আত্মা পুনর্জন্ম অবতারবাদ এগুলির মধ্যে। বংশগতির ধারণার সঙ্গে আমরা সংস্কারের মিল খুঁজে পাই এবং আর খুঁজে পাই আমাদের যৌথ অবচেতনের প্রকল্পের মধ্যে। অবচেতন মন পুরাবিন্যাসের প্রতিমাগুলির এক স্বর্ণখনি। পুরাবিন্যাসেরা সৃজনশীল কল্পনাশক্তিগুলির কারণ শর্ত বা নিয়মাবলী, এবং তাই তারা সংস্কারের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিরূপ। যদিও প্রাচ্য মনের কাছে সংস্কারের তত্ত্ব এতটাই আলাদা যে একজন হিন্দু হয়ত এই সংজ্ঞার ও এজাতীয় তুলনার বিরোধিতা করবে। কিন্তু পুরাবিন্যাসের প্রতিমারাই আমাদের কাছে এর সবচেয়ে কাছাকাছি যায়।
জনৈকাঃ আমার স্থূল দশার বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাস্য আছে। আমার ভাবনায় স্থূল অবস্থা খুবই বাস্তবিক যেখানে সূক্ষ্ম দশা হল অনেকটাই মনোবৈজ্ঞানিক, শুধুমাত্র বিমূর্তই নয়, একটি দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ একে শুধু বুদ্ধি দিয়ে ধারণা করা যায় না; এটা সবকিছুর সঙ্গে সংযুক্ত থাকার অদ্ভুত এক মানসিকতা।
ইয়ুংঃ আপনি অনেকটাই সঠিক কিন্তু মনোবৈজ্ঞানিকভাবে কোন কিছুকে ব্যাখ্যার একটি দার্শনিক দিকও বিদ্যমান থাকে। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক একটি চেয়ারঃ তার স্থূল ও সূক্ষ্ম উভয় দিকই রয়েছে। তার গুণ রূপ আকৃতি ছাড়াও চেয়ারের ধারণা একটি সূক্ষ্ম জিনিষ। প্লেটোর মতে যা আইডোলন (eidolon), কোনো বস্তুর আইডস (eidos) হল তার সূক্ষ্ম ভাব। প্লেটো মনে করতেন বস্তুর একটি সূক্ষ্ম অবস্থা (eidola) থেকে জাগতিক অসম্পূর্ণ সব বস্তুরা অনুকরণের দ্বারা সৃষ্ট হয়েছে এবং স্বর্গীয় কোন গুদামঘরে বস্তুগুলির প্রতিরূপটি রাখা আছে। এই ধারণাই হল সূক্ষ্ম দশা অথবা বলা যায় বস্তুদের মনস্তত্ত্ব। কিন্তু আমাদের কাছে এগুলি শুধু প্লেটোনিক চিন্তাভাবনাই, যাকে কীনা প্লেটো বাস্তব বলে মনে করতেন কিন্তু তা আসলে মনস্তাত্ত্বিক সত্য, বা বলা যায় বিভ্রম বা অনুমান মাত্র। যদি বা আমরা ধরেও নিই যে মনোবৈজ্ঞানিক সূক্ষ্ম না হয়ে এমন একটি গুদাম আছে তবুও আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিত তো হতে পারি না, তাই না! এর মাধ্যমে কিছুই প্রমাণ করা যায় না। যেমন প্রাগৈতিহাসিক মন যা ভাবে তাই তার কাছে সত্য হয়ে যায়। একটি স্বপ্ন তাদের কাছে চেয়ারের মতোই সত্য। তাই কিছু কিছু জিনিষ তাদের ভাবা কঠোরভাবে বারণ, কারণ সেই চিন্তা খুব সহজভাবেই বাস্তব হয়ে যাবে। আমরা এখনও সেরকমই আছি, আমরা বড় বড় কথা বলি তবুও আমরা অন্ধ কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
জনৈকাঃ এই সূক্ষ্ম দশা কী কান্টের বস্তুর অন্তর্গত বস্তুসত্তা বা পর্যবেক্ষণ নিরপেক্ষ বস্তুসত্তা (thing in itself)?
ইয়ুংঃ তার ব্যবহৃত শব্দটি ছিল নাউমেনা (noumenon)। এটি একটি ধারণা, বস্তুর আধ্যাত্মিক রূপ। কান্ট একজন অত্যন্ত যুক্তিবাদী মানুষ, তার “শুদ্ধ যুক্তির সমালোচনা”য় তিনি বলেন যে এই বস্তুর চৈতন্যের ধারণাটি পূর্ণত একটি নাবাচকতার সীমান্তগত ধারণা, যা একথার প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না যে বস্তুটির আদৌ সেই অস্তিত্ব আছে কীনা। তিনি এই ধারণাটি এটা বোঝাতেই দিয়েছিলেন যে বাস্তব ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের পশ্চাতেও এমন কিছু আছে যার বিষয়ে আমরা কিছুই বলতে পারি না। তবুও তাঁর মনস্তত্ত্বের উপর বক্তৃতায় তিনি বলেছেন যে বস্তুর মধ্যে একাধিক অন্তর্গত সত্তা থাকতে পারে যা তার শুদ্ধ যুক্তির সমালোচনার বক্তব্যের সঙ্গে স্ববিরোধ তৈরি করে।
জনৈকাঃ এটি কী তবে পুরাবিন্যাসই নয়?
ইয়ুংঃ প্লেটোর বস্তুর সূক্ষ্ম প্রতিরূপ থাকার ধারণা অবশ্যই একটি পুরাবিন্যাস। পুরাবিন্যাস শব্দটি সন্ত অগাস্টিনের থেকে এসেছে যিনি এই পরিভাষাটি প্লেটোনিক অর্থেই ব্যবহার করেছেন। তিনি সেইসময়কার অনেক দার্শনিকদের মতোই নব্যপ্লেটোনিক ছিলেন। কিন্তু তা মনোবৈজ্ঞানিক সত্য অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। ব্যবহৃত হয়েছে দৃঢ় বাস্তবিক সত্য অর্থে, যাকে বর্ণনার উত্তম শব্দ হল হাইপোস্ট্যাসিস ( যে ধারণার পিছনে দৃঢ় প্রমাণাদি রয়েছে বলে ধারণা করা হয়! )। হাইপোথিসিস হাইপোস্ট্যাসিস নয়। হাইপোথিসিস একটি অনুমান, একটি ধারণা যা আমি বানালাম, যার মাধ্যমে আমি কোন সত্যকে ব্যাখ্যা করতে পারব। কিন্তু সবসময় আমাকে মাথায় রাখতে হবে যে ওটি আমার অনুমানগত এবং আমার ধারণার সাপেক্ষে প্রমাণ চাই। কিন্তু হাইপোস্ট্যাসিস হল এমন এক ধারণা যা মনে করে সে কোন দৃঢ় সত্যের উপরেই ভর করে দাঁড়িয়ে আছে (অথচ যা কল্পিত)। হাইপোস্ট্যাসিস হল সেই আবিষ্কার যা নিরালম্ব। এর কোন ভিত্তি প্রমাণাদি নেই, কিন্তু বিশ্বাস করা হয় যে আছে। আর তাই এটা বাস্তব জিনিষ! উদাহরণস্বরূপ একটি তৎত্বের ধারণা আপনি আবিষ্কার করেছেন এবং আপনার মতে এটি একটি শব্দই শুধু নয়, একটি আস্তিত্বিক সত্য এবং আসলে কিন্তু এ একটি হাওয়ার ঝোঁকা মাত্র যা শূন্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। আপনি বলবেন তৎত্ব একটি আন্তর্গুণ বা চরিত্র; যার কীনা অস্তিত্ব আছে, যা কীনা কোন দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই হাইপোস্ট্যাসিস সবসময় ধারণা করে যে সে আস্তিত্বিক সত্য। প্রাগৈতিহাসিক মানুষও এরকমভাবেই ভাবত। আমাদের ভালো সময়ে, যখন আমরা সামান্য কুসংস্কারে বিশ্বাস করে তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করি, আমরাও তখন হাইপোস্ট্যাসিস মেনে চলি।
যেমন কীনা মাধ্যাকর্ষণের হাইপোস্ট্যাসিসে আপেল মাটিতে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ কান্টের ঈশ্বরের অনুমান বিষয়ে সেই বিখ্যাত মন্তব্য “ঈশ্বর আছেন, ঈশ্বর নেই”- কেউ যখন বলে যে ঈশ্বর আছেন, সে কেবলমাত্র একটি মন্তব্যই করে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে ঈশ্বর আছেনই। সে বলতে পারে ঈশ্বর আছে, কিন্তু সম্ভবত তিনি নেই। তার বদলে হাইপোস্ট্যাসিসের মধ্যে পরে কেউ যদি বলেন ঈশ্বর আছেন, তবে তার ধারণা হয় যে সত্যই ঈশ্বর আছেন। সে এই ঈশ্বর বানিয়েছে তাই ঈশ্বর বাস্তব অস্তিত্ব। এই ধরনের প্রবৃত্তি থাকে অ্যানিমাসের (নারীর অন্তর্স্থিত পুরুষ) এবং যা নিয়ে সবার অভিযোগ থাকে। একজন এরকম ধারণার বশবর্তী হয়ে জীবনে সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য নিয়ে আসতে পারে। সে ভাবল যে সে নিজে তার বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে আর আগুন লেগে গেল! দোষ সে নিজেকে দিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আগুন কোনভাবে লেগে গিয়েছিল।
জনৈকাঃ সবধরনের অনুসন্ধানমূলক ক্রিয়াই কি শেষপর্যন্ত হাইপোস্ট্যাসিসে পরিণত হয়ে পরে না?
ইয়ুংঃ হ্যাঁ, তার সম্ভবনা থাকে। যেই হাইপোথিসিস তার বাস্তবতার প্রমাণ পেয়ে যায়, তা তখন একটি সত্য হয়ে যায় আর তার পর থেকে তা পরিণত হয় হাইপোস্ট্যাসিসে – তারপর আমরা সম্পূর্ণ ভুলে যাই যে এটা আসলে একটা হাইপোথিসিসই ছিল, একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত স্বেচ্ছাচারী তত্ত্ব যা আমরা বানিয়েছিলাম।
জনৈকঃ ফ্রয়েডের যৌনতা তত্ত্বকে বলা যেত হাইপোথিসিস যা কীনা এখন হাইপোস্ট্যাসিসে পরিণত।
ইয়ুংঃ যথার্থভাবেই তাই। ওটা কিছু পরিমাণ তথ্য প্রমাণ পেয়েছিল, তারপর ধারণা করে নেওয়া হয় যে উহা পূর্ণ সত্য। যাই হোক আমরা ধারণা নিয়ে কথা বলছিলাম আর তান্ত্রিক যোগে এমন বহু ব্যাপার আছে যার আরো বিস্তারিত মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে।
জনৈকা: প্রফেসর হেয়ার চক্র প্রসঙ্গে চক্রের মধ্যস্থিত চিত্রগুলির কথা বলেছেন। কিন্তু পূর্ণচক্রগুলিকে কি মণ্ডল বলা যায় না?
ইয়ুং: কখনও কখনও চক্র মণ্ডলাকারও বলা যায়। উনি মণ্ডল বলতে যে পরিভাষার কথা বলেছেন তার থেকে আমাদের ধারণা পৃথক। তিনি পূর্ণচিত্রগুলিকে পদ্ম হিসাবে দেখেছেন। মণ্ডল অর্থে বলয় বা বৃত্ত। কখনও এটি জাদুবৃত্ত আবার কখনও কখনও চক্র (যেমন- জীবনচক্র অর্থে)। বেদের ক্রমান্বয়িক একাধিক সূত্রগুলি একত্রে এক একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করে যাকেও মণ্ডল বলা হয়। যেমন ধরা যাক তৃতীয় মণ্ডল, অধ্যায় ১০ সূত্র ১৫ – খুব সাধারণভাবে বললে মণ্ডল সেই পূর্ণচক্রের নাম।
জনৈকা: কিন্তু উনি বর্গক্ষেত্রগুলিকেও মণ্ডল বলেছেন?
ইয়ুং: হ্যাঁ, তাকেও মণ্ডল বলা যায়, যা কিছু অভ্যন্তরর্স্থিত তাই মণ্ডল আর এরকম জিনিষ যথার্থভাবে দেখা যায় লামাদের চিত্রগুলিতেঃ মণ্ডল, পদ্ম এগুলি আভ্যন্তরিক। একইসঙ্গে মন্দির বা আশ্রম যারা বর্গাকার প্রাচীরের বেষ্টনে থাকে , আর পুরোটাকে বেষ্টন করে থাকে এক জাদুবৃত্ত; সেখানে ঈশ্বর পর্বতের থেকেও উচ্চস্থানে বিরাজিত। মণ্ডলকে আমরা এত গুরুত্ব দিই কিন্তু হিন্দু তান্ত্রিকদের কাছে তা হল কেবল কিছু ‘যন্ত্র’ – সাধনা করার একটি যন্ত্র যা লামাদের আর তান্ত্রিকদের মধ্যে প্রচলিত আছে। সাধারণ হিন্দুরা অবশ্য খুব কমই তন্ত্র বিষয়ে জানে এবং তাদের কাছে মণ্ডল কী জানতে চাইলে তারা হয়ত গোল টেবিল বা গোলাকার কোনকিছুকে বোঝাবে কিন্তু আমাদের কাছে এটি একটি বিশেষ শব্দ। এমনকি তান্ত্রিকদের কাছেও এর তত গুরুত্ব নেই যতটা আমাদের কাছে আছে। আমাদের ধারণার সবচেয়ে নিকটবর্তী ধারণা লামাদের বা তিব্বতী ধর্মবাদের, কিন্তু যা খুব কম লোকই জানে, আর তাদের ধর্মগ্রন্থগুলি খুব সম্প্রতিই অনুদিত হয়েছে।
জনৈক: প্রফেসর হেয়ার বলেছেন যে দ্বিতীয় চক্র হল জলের স্থান যেখানে একজন দ্বিধাহীনভাবে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ( হেয়ার দ্বিতীয় চক্র প্রসঙ্গে বলেছেন- স্বাধিষ্ঠান; যে জীবন আমরা সহজভাবে দুশ্চিন্তা ছাড়াই বাঁচি, নিজেদের জীবনপ্রবাহে নিক্ষেপ করে আমাদের প্রবাহিত হতে দিই, যা কিছু আমাদের সংস্পর্শে আসে তার সঙ্গে বয়ে চলি)। কিন্তু সেই অবস্থা তো অনেক উচ্চস্তরের ব্যাপার। এই ব্যাখ্যা মানা কঠিন কারণ আমরা তো বয়ঃসন্ধিতেই এই প্রক্রিয়া পার করে যাই। মনে হয় তিনি যেন উচ্চতর দশা থেকে নিম্নস্তরে নেমে আসছেন।
ইয়ুং: এজাতীয় প্রশ্ন করে আপনি বিভ্রান্তির মূর্ত প্রতীকের ভূমিকা পালন করছেন। এই বিরাট বিভ্রান্তির মধ্যে কেউ যদি বিষয়টির মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে তবে সে তদ্রূপ আশ্চর্য সব সিদ্ধান্তে পৌঁছবে। যেমন ধরা যাক মূলাধার চক্র ( হেয়ার একে বর্ণনা করেছেন “মূল+ আধার” এভাবে যে এই চক্র যা সবকিছুর মূলকে ধরে রাখে। এটি সৃজনশীল পুরুষ বা নারীশক্তির ধরিত্রীর স্থান, … পৃথিবীর ভিত্তিস্থান।), যাকে বেশ সহজ বিষয় বলে মনে হয়। এর মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান যৌনস্থানে। আপনি হয়ত ভাবতে পারেন এ বিষয়ে আপনি সবই জানেন কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে মূলাধার কী? আপনি হয়ত ভাবেন যেহেতু এটির অবস্থান তলপেটের নিচে আর তাই এর সঙ্গে যাবতীয় যৌনতা জড়িয়ে আছে; কিন্তু মূলাধার একটি সম্পূর্ণ অন্য ধারণা। প্রথমে আমরা বরং দ্বিতীয় চক্রটির দিকে মনোনিবেশ করব। (স্বাধিষ্ঠান চক্রের চিত্রে মকরের ছবি আছে, পুরাকথার সেই সামুদ্রিক দৈত্য জীব।)
সামুদ্রিক বিশালাকার জীব সহ সমুদ্র-চক্র চক্রব্যবস্থার উচ্চস্তর। কিন্তু আমরা এই জলের স্থানকে মনস্তত্ত্বের নিম্নস্তর ভাবি- আমরা অবচেতনে তো ডুব দিই। সুতরাং মূলাধার বিষয়ে আমাদের ভাবনা অন্যরকম। আপনাদের মধ্যে কি কেউ মূলাধারে অবস্থান করেছেন? আপনি হয়ত বলবেন হ্যাঁ, বা ধরা যাক আপনি রাত্রিকালীন সমুদ্রযাত্রা করেছেন, এবং বিশাল জলদানবদের সঙ্গে যুদ্ধও করেছেন। তার অর্থ এই যে আপনি স্বাধিষ্ঠানে স্থিত, দ্বিতীয় চক্র জলস্থানে। তার মানে কি আপনি মূলাধারেও আছেন? এখানেই ধাঁধা। মূলাধার হল একটি পূর্ণ পৃথিবী, প্রত্যেক চক্রই হল পূর্ণ পৃথিবী ( যেগুলিকে হেয়ার বলেছেন জীবন থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতার প্রতীকসমূহ)। আপনাদের হয়ত মনে থাকবে একজন রোগীর কথা, যিনি একটি গাছের মূলে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং তারপর তিনি উপরের আলোর দিকে হাত প্রসারিত করে দেন। এই মহিলাটি কোথায় অবস্থান করছেন যখন তিনি কীনা মূলে আবদ্ধ?
উত্তর: মূলাধারে।
ইয়ুং: কিন্তু বাস্তব অর্থে তার মানে কী?
জনৈকা: আত্ম-নিদ্রা?
ইয়ুং: অবশ্যই, আত্মন ঘুমিয়ে আছে। এমন কোন অবস্থা আছে যখন আত্মন ঘুমিয়ে আছে আর অহং সজাগ হয়ে আছে? হ্যাঁ, এই বাস্তব চেতন জগৎ যেখানে আমরা যুক্তিপূর্ণ সম্মানীয় ব্যক্তি, মানানসই ব্যক্তিসত্তা। সবকিছুই যা বাস্তবসম্পৃক্ত যেমন আহার করা, সিনেমা দেখা ইত্যাদি বিষয়ে আমরা যেন স্বাভাবিক নাগরিক। আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু দায়বদ্ধতা আছে, আমরা কর্তব্য করে যাচ্ছি যতক্ষণ না আমাদের মধ্যে স্নায়ুরোগের লক্ষণ প্রকাশ পেয়ে ছুটি পাচ্ছি। সুতরাং আমরা মূলে সন্নিবিষ্ট, আমরা আমাদের শিকড়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি (‘রুট সাপোর্ট’ মূলাধারের যথাযথ ভাষান্তর)। আমরা হয়ত বাস্তব ছুঁয়ে আছি; কিন্তু আমাদের আত্মন ঘুমিয়ে আছে, ঈশ্বর বিষয়ক সবকিছু ঘুমিয়ে আছে।
এরকম একটি চমকপ্রদ বক্তব্যের পর আমাদের ভাবতে হবে যে এওরকম ব্যাখ্যা যুক্তিযুক্ত কিনা? আমি নিশ্চিত নই। এবং আমি নিশ্চিত প্রফেসর হেয়ার এই ব্যাখ্যায় আমার সঙ্গে সহমত হবেন না। এইধরনের বিষয়ে ব্যাপক মনস্তাত্ত্বিক ধারণার প্রয়োজন যাতে তা পাশ্চাত্য মনের কাছে গ্রহণীয় হতে পারে। একে প্রবল তাগিদ সহ বোঝার চেষ্টা না করলে আর ভুলভ্রান্তিগুলি করার সাহস দেখিয়ে একে পাশ্চাত্য মানসিকতায় আত্তীকরণ না করে নিলে এর প্রভাব বিষময় হয়ে উঠবে। কারণ এই প্রতীকগুলি অবচেতনকে পাঁকড়ে ধরে ও তাতে দৃঢ়ভাবে আটকে বসে থাকে। এগুলি আমাদের দেহ-মন ব্যবস্থায় কৃত্রিম জিনিষ যা দেহে প্রবিষ্ট হয়ে আছে এবং আমাদের স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক বৃদ্ধি ও বিকাশে বাধাদান করছে। এটা যেন গুরুত্বহীন বৃদ্ধি বা বিষবৎ। সুতরাং এই প্রতীকগুলির প্রভাব থেকে মুক্ত হতে একজনকে বীরোচিত প্রচেষ্টা করতে হবে যাতে এগুলির উপর কর্তৃত্ব কায়েম করা যায় আর এগুলি যেন তাদের প্রভাব দিয়ে আমাদের প্রতাড়িত না করতে পারে। সম্ভবত আপনারা বুঝতে পারছেন না যে আমি যথাযথভাবে কী বলতে চাইছি, কিন্তু একে হাইপোথিসিস হিসাবেই ভাবুন। এমনকি এটা হাইপোথিসিসের থেকেও বেশি, একে সত্যরূপেই মেনে নিন। আমি মাঝেমধ্যেই দেখতে পাই যে এগুলির প্রভাব কী মারাত্মক হতে পারে।
যদি আমরা মূলাধারকেই শিকড় ভাবি, সেই মাটি যার উপরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, তাহলে এটিকেই আমাদের চেতন জগৎ বলে মেনে নিতে হবে কারণ এখানেই আমরা বাস্তব জগতের সঙ্গে সংযুক্ত এবং এই পৃথিবীর চার দিকও রয়েছে। আমরা মৃত্তিকা মণ্ডলে রয়েছি। এটা সেই স্থান যেখানে মনুষ্যজাতি প্রবৃত্তি কামনা-বাসনার আর অচেতনের তাড়নার শিকার; আসলে আমরা যেখানে আছি সেটি অন্ধকার আর অচেতনের জগৎ। আমরা পরিস্থিতির শিকার আর আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি বাস্তবে খুব কমই উপযোগী হয়। যতক্ষণ পর্যন্ত না মনস্তাত্ত্বিক ঝড় উঠছে আমরা কিছু কিছু যান্ত্রিক কাজ করে যেতে পারি। আর তারপর আসে সেই ঝড়, ধরা যাক কোন যুদ্ধ বা বিপ্লব আর সমগ্র ব্যবস্থাটি ধ্বসে পড়ে আর আমরা শূন্যে চলে যাই।

Facebook Comments

Leave a Reply