অর্ধেকের খোঁজে: নিজস্ব বুননে ভারতীয় নারীদের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ – অমৃতা সরকার
দ্বাদশ কিস্তি
যে মুহূর্ত সকল তাদের অর্জন: সুঘ্রা হুমায়ুন মির্জা ও আদা জাফরি
সুঘ্রা হুমায়ুন মির্জা ( ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দ- ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) হায়দ্রাবাদের বিংশ শতাব্দীর নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ । তাঁর লেখক পরিচিতিকে ছাপিয়ে তাঁর নারী আন্দোলনের কর্মী পরিচিতিটিই অপেক্ষাকৃত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সক্রিয় নারীবাদী কর্মী ও লেখিকা — ভারতীয় নারীর এই আধুনিক সত্তাটি নির্মাণে সুঘ্রার ভূমিকা অনস্বীকার্য। সুঘ্রার জন্ম হায়দ্রাবাদের অভিজাত এক পরিবারে। বাবা হাজি সফদর আলি মির্জা সেনাবাহিনীতে সার্জেন হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সুঘ্রা ইস্কুলে গিয়ে পড়াশুনা করেন নি। বাড়িতে শিক্ষক রেখে তাঁকে উর্দু, ফার্সি ও ইংরেজি ভাষায় ইতিহাস, সাহিত্য ও দর্শন পড়ানো হয়। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে সুঘ্রা, তাইয়াবা বেগম দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মুসলিম নারীদের সংগঠন ‘অঞ্জুমন-ই-খাওয়াতি-ই-ইসলাম’-এর সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে এই সংগঠনটির সঙ্গেই বাংলায় বেগম রোকেয়া সংযুক্ত ছিলেন। সুঘ্রার নেতৃত্বে সংগঠনটি হায়দ্রাবাদ ছাড়াও মাদ্রাজ, দিল্লি, ঔরঙ্গাবাদে মেয়েদের হাতের কাজ শেখানো এবং সেই কাজকে কী করে বাণিজ্যিক ভাবে ব্যবহার করা যায় এই প্রকল্পে নিযুক্ত হয়। ‘অঞ্জুমন’-এ সুঘ্রা বিবিধ পণ্ডিত মানুষদের ডাকতেন, যাঁরা মেয়েদের সামনে নারীমুক্তির প্রয়োজন ও পর্দাপ্রথার কুফল নিয়ে বক্তব্য রাখতেন। সুঘ্রা নিজের পৈতৃক সম্পত্তির বেশিরভাগ অংশ বিক্রি করে হায়দ্রাবাদে মাদ্রাসা-ই-সাফদারিয়া নামে একটি মেয়েদের ইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তী কালে এই ইস্কুলটি হায়দ্রাবাদে নারী-চেতনা উন্মেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুঘ্রার বিয়ে করেন সঈদ হুমায়ুন মির্জাকে। ভারতের প্রতিটি প্রান্তে সুঘ্রা তাঁর স্বামীর সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁরা একসঙ্গে ইউরোপ ভ্রমন করেন।
সুঘ্রা ছিলেন মূলত গদ্যকার। তাঁর ‘সফরনামা’গুলি, ছোটোগল্প এবং উপন্যাস উর্দু ভাষার সম্পদ। সুঘ্রার বেশিরভাগ কবিতা মূলত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে খাপ খাওয়াতে না পারা নারীর একটি ‘অজানা ভয়’কে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। সেই ভয় কখনো একাকীত্বের ভয়, সেই ভয় কখনো ভুল বোঝার ভয়। কিন্তু বারংবার সুঘ্রা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে এই ভয়ের হেতুই নারী নিজের হকের সংগ্রাম থেকে যেন বিচ্যুত না হয়।
আদা জাফরি ( ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ- ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মেছিলেন ব্রিটিশ শাসিত ভারতের উত্তর প্রদেশের বঁদায়ুতে। তাঁর বাবা মৌলভী বাদরুল হাসান তাঁর তিন বছর বয়সে মারা যান। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর তিনি পাকিস্তানি নাগরিক হলেও তাঁর পড়াশুনা ও লেখালেখির জীবন বঁদায়ু থেকে শুরু হওয়ায় তাঁকে এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আদা জাফরিকে উর্দু ভাষার প্রথম ‘মেজর’ মহিলা কবি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। পুরুষ প্রধান উর্দু কবিতার জগতে আদা ছিলেন সেই ধাক্কা যাকে স্বীকৃতি দিতে খানিক সময় নিয়েছিল উর্দু কবিতা মহল। উর্দু কবিতা এবং গজলের পুরুষ-কেন্দ্রিকতাকে লিঙ্গ নিরপেক্ষতায় নিয়ে আসতে আদা জাফরির কবিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাঁর লেখায় বারবার উর্দু কবিতার ধারায় নারীকে শুধুমাত্র যৌনবস্তু হিসেবে দেখার প্রবণতাকে আক্রমণ করা হয়েছে। উর্দু ভাষার খবরের কাগজ ‘এক্সপ্রেস নিউজ’-এ ২০০৮ সালের ১৫ই মার্চ আদা জানান, “ আমি পুরুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত সামাজিক সীমারেখা কোনোদিনই মেনে চলি নি। আমি নিজের সীমারেখা নিজে নির্মাণ করেছি। তাই ব্যক্তিজীবনে আমি সবসময় পর্দা প্রথার বিরোধী । কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে আমি আমার রাজনীতিকে প্রতীক, চিত্রকল্প, ইঙ্গিতের মোড়কেই তুলে ধরেছি কারণ কবিতার এই পর্দা সুন্দর এবং তা কারো অধিকার হরণ করে না”। আদা’র কবিতা জুড়ে তাই খেলা করে হরেক পর্দা যা সরালে দেখা যায় দৃঢ় চোয়ালে এক নারী তথাকথিত কাব্যিক সিনট্যাক্স দিয়েই ভেঙে চলেছেন একটি পুরুষ প্রাধান পুরুষতান্ত্রিক পরিসর। আদা জাফরি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় নারীবাদের পরিসরে।
সুঘ্রা হুমায়ুন মির্জা
যখন আমি নেই
কে আসবে আমার কবরে যখন আমি নেই,
হাওয়ায় উড়বে ধুলা যখন আমি নেই।
বেঁচে থাকার সময় কদর করেনি কেউ,
কেউ ফেলবে না চোখের জল যখন আমি নেই।
প্রিয়জনের অবহেলার আফসোস রয়ে যাবে,
কবর থেকে উঠবে আওয়াজ , যখন আমি নেই।
মেলেনি কোনও পুরস্কার এ জীবনে
আল্লাহ! আমার কাজ যেন রয়ে যায় যখন আমি নেই।
খায়েশ শুধু এই, যারা ভালবেসেছিল
কিছু ফুল যেন কবরে ছড়ায় তারা, যখন আমি নেই।
হায়ার প্রশ্ন তোমার কাছে
এখনি আসো না , আসবে কী আর
যখন আমি নেই।
******
লতায় ,শাখায় তুমি, সাঁঝের চাঁদেও তুমি
লতায় ,শাখায় তুমি, সাঁঝের চাঁদেও তুমি
আলোছলছল চারিধারে তুমি শুধুই তুমি
সুভাগে তুমি, সুবচনে তুমি
লুকিয়েছ কখনো, মুখোমুখি কোথাও তুমি
বিচারকও তুমি, ফাঁসিকাঠেও তুমি
সত্য যেখানে ক্ষীণ, বদনাম অলিগলিতে
মন্দির-মসজিদ-গীর্জা ,অহেতুকী তর্ক
এ সবেই তোমার বসতি,প্রতিটি কণায় তুমি।
আমার খোদা, হায়ার দোয়া তোমার কাছে
ভালো রেখো সকল প্রাণকে
যা কিছু পেয়েছে হায়া
দিয়েছ সকলই তুমি।
আদা জাফরি
যে মুহূর্তেরা ছিল আমার
একদিন
তুমি আমায় বলেছিলে
রোদ্দুর খুব কড়া
নিজের ছায়া সাথেই রেখো
সময়ের তূণে যে ক’টা তীর ছিল একটাও মাটিতে পড়েনি
ফেরেবী হাওয়ার পাথর ঝাপটে
দেহের পাখি ঘায়েল
ঝাঁ ঝাঁ রোদের বন হা হা তেষ্টার দরিয়া
এখন একফোঁটা চোখের জলের জন্য
মানুষ শুকায়
তুমি আমায় বলেছিলে
সময়ের বহতা নদীতে
মূহুর্ত খুঁজে রেখো
উঁকি দিয়ে দেখো আমার মনে
সাত রঙের ফুল ফুটে আছে
মূহুর্ত যা আমার ছিল, আমারই আছে
সময়ের তীরের ফলা বুকে বিঁধুক যতই
ঐ মূহুর্তের সাথে সম্পর্ক কত গভীর ,দেখো।
******
এই চরাচর
যখন তার সাথে ছিলাম
এই চরাচরের
প্রতি নিশ্বাসে, প্রতি পদে, প্রতি নজরে
ছিলাম ধনী
আর এখন
আবছা দিন রাতের নেশায় বন্দী।
******
অচেনা সবুজ জমি
অচেনা সবুজ জমিতে
যতদূর নজর চলে শুধু জাফরানি ফুল
অচেনা তখনও ছিলে না , এখনও নও
পথের উজল আলো ছিলে তুমি
চলার সাথীও তুমি ছিলে
দাস্তান কতই না শোনাতে
দাস্তান শুনতেও কত তুমি!
এই মরশুমের খুব মনে পড়ছে তোমাকে
আর আমি চুপ করে আছি।
******
Posted in: March 2021 - Serial, TRANSLATION