যাপন : উমাদাস ভট্টাচার্য

যাপন – এক

একতলা ও দোতলার সিঁড়ির মাঝখানের ল্যান্ডিং এ নিখিলেশ বাবু একটু দাঁড়ান। দোতলার ছাদে উঠতে এখন অনেকটা সময় লাগে। ওঠার আগে মনটা একটু উচাটন হয়। সন্ধের আগে আগে ছাদে উঠবেন ভেবে সারা দুপুরটাকে জড়িয়ে থাকেন।। কারও সঙ্গে নিশ্চিত দেখা হবে জানলে তার আগের সময়টুকু যেরকম ভালো লাগে সেরকম ভালো লাগা। সময়ে বেরনো। বারবার ঘড়ি দেখা। সাইড ব্যাগটা নিয়ে নেওয়া। কিছু দেওয়ার থাকলে ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে নেওয়া। বাসস্টপে এসে দাঁড়ানো। কিন্তু ছাদে উঠতে এসব দরকার হয়না। শুধু একটু একটু করে সময় পার করা। এখন একটু বেশী সময়ই লাগে সিঁড়িগুলো পেরোতে। সময়ের প্রাপ্য তো মেটাতেই হবে। তবু যখন অপেক্ষার শেষে ছাদে ঢোকার সিঁড়ির দরজা খুলে ছাদে এসে দাঁড়ান তখন ভুলেই যান তিনি রিটায়ার্ড মানুষ। ভুলে যান এতখানি উঠে এসে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হতে সময় লাগে ইদানীং। নিবেদিতা থাকলে ঠিক ধরে ফেলত।
—-ঐ কোনে একটা হলুদ রঙ্গন দরকার।
নিবেদিতার হলুদ রঙ্গনের আবদারে নিখিলেশবাবু বলতেন
—-কেন? লাল রঙ্গনটাই তো আছে।
—-তুমি দেখনি একই ফুল দু’তিন রং এর পাশাপাশি থাকলে কেমন মেলা মেলা মনে হয়?
নিবেদিতা ফুল নিয়ে মেতে উঠেছিল। হঠাৎ করেই। না বোধ হয়। নিখিলেশবাবু প্রথম প্রথম বোঝার চেষ্টা করতেন। তারপর বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
—-বেলিফুলগুলো নিয়ে গিয়ে যখন নিচের ঘরের টেবিলে রূপালী রেকাবীতে রাখি আর ঘরে শুধুই নীল আলোটা জ্বালিয়ে দিই তখন?
—-একেবারে ফুলশয্যা ফুলশয্যা
নিখিলেশবাবুর উত্তরে নিবেদিতা ঠোঁট কুঁচকে নিখিলেশ বাবুকে ছদ্ম অবজ্ঞা করলেও নিবেদিতার চোখের কোনে কোথাও একটু উপভোগও থাকতো মনে হয় নিখিলেশ বাবুর। নিবেদিতা কোনকালেই ঠিক আদুরে ঢলঢলে টাইপ ছিলনা। তবু নিখিলেশ দেখেছেন মুখের পেশীর সামান্য হেরফেরে ছেলেদের মুখে যতটা অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে তার চেয়ে অনেক বেশী স্পষ্ট অভিব্যক্তি ফোটে মেয়েদের ক্ষেত্রে।
—-তাহলে তুমি যে বল সাদা ফুল সহ্য করতে পারি না?
নিবেদিতার কথার উত্তরে নিখিলেশ বলে উঠতেন
—- সাদা ফুল দেখলেই আমার শেষ যাত্রার কথা মনে আসে
—-সে তো ওই রজনীগন্ধা
—-লোকে শ্মশানে কিংবা শ্রাদ্ধবাসরে ঠিক ওই রজনীগন্ধা হাতেই হাজির হয়।
নিবেদিতা লড়াই করতেন
—-কিন্তু বিবাহবার্ষিকীতেও তো সেই রজনীগন্ধার স্টিক নিয়েই আসে সবাই।
নিবেদিতা লড়াই করতেন ঠিকই কিন্তু নিখিলেশবাবুর মনে হয় নিবেদিতা কিছু ভুলতে এবং ভোলাতে চাইছেন।
নিখিলেশবাবু আজ বেশ কয়েকদিন বাদে ছাদে উঠছেন। আসলে শরীরটা জুতের ছিলনা ক’দিন। একটু ভালো লাগতেই আজ সকাল থেকে ছাদ ছাদ করছিল মনটা। নিখিলেশ জানেন কোনও লাভ নেই। তবু উঠছেন। এই ক’মাসে সারি সারি টবের মাটিগুলো শুকিয়ে শক্ত কাঠের মতো হয়ে যাচ্ছে। তবু নিখিলেশবাবু জল দিয়ে যাচ্ছেন।
—-তুমি এত কুঁড়ে কেন? মাটিগুলো একটু খুঁচিয়ে দিলে কি হয়? নাকি বউ এর কথায় কাজ করতে প্রেস্টিজে লাগে?
নিবেদিতা তখন জোর করে নিখিলেশ বাবুকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে উঠতেন। এরকম সন্ধের ঠিক আগে আগে। ওরা ওঠার পর আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নামত। তারপর কবে থেকে যেন নিখিলেশবাবুরও
অভ্যেস হয়ে গেল। খুরপিতেও হাত লাগাতে লাগলেন। জলের প্লাস্টিকটা দিয়ে গাছের গোড়ায় পাতায় জল দিতে লাগলেন। নিখিলেশবাবু কেন করতে লাগলেন এসব? আসলে কিছু কিছু জিনিস মন থেকে সরাতে চাইলেও সরানো যায় না। তখন অন্য কিছু আঁকড়ে ধরতে হয়।
—-কি হ’ল? পাইপটা ধরে কোনদিকে তাকিয়ে আছো ?
নিবেদিতার কথায় নিখিলেশ বাবু থতমত হয়ে পাইপের মুখ টবের ঠিক জায়গায় ধরতেন। গাছ বেয়ে টবের গা বেয়ে জলের ধারা নেমে আসত ছাদের মেঝেতে। ছাদের ঢাল যেদিকে নিশ্চিন্ত ধারায় উপচে পড়া জল সেদিকে বয়ে বয়ে নেমে যেতো বাইরে। বাড়ির বাইরে। নিখিলেশ বাবু অন্যমনস্ক হয়ে রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে জলের নেমে যাওয়ার শব্দ শুনতেন। জলের শব্দ থাকে। নদীর ধারে সমুদ্রের কাছে ঝর্নার নিচে এমনকি ড্রেনের পাশে গেলেও সে শব্দ শোনা যায়। কিন্তু জলকে বইতে দিতে হবে। জল থামিয়ে দিলে আর জলের শব্দ নাই।
—-কি ব্যাপারটা কি?
নিবেদিতা কখন পাশে এসে দাঁড়াত। হাত থেকে আস্তে আস্তে জলের পাইপটা নিয়ে নিত। ফিসফিসিয়ে বলত
—-এভাবে চলেনা। একটা সময়ে বাঁধ দিতে হয়। নাহলে ভেসে যেতে হয়।
—-না—না—আমি এমনি একটা কথা ভাবছিলাম
—-ভেবো না —দেখো নাইটকুইনটা এবার ঠিক ফুটবে। শুধু সেই সময়টা থাকতে হবে কাছাকাছি।
নিখিলেশবাবু বুঝতে পারেন নিবেদিতার এক চোখ সবসময় তার দিকে। ডাকাবুকো নিখিলেশবাবু আসলে ডাকাবুকো নন। তবু নিবেদিতা কখনও সেই প্রসঙ্গে যেত না। আসলে নিখিলেশবাবুকে সামলানোর ভান করে নিজেকে শক্ত রাখার ছুতো খুঁজত। নিবেদিতা শেষ পর্যন্ত থাকল কই? ও চলে যাওয়ার পর আজ ছ’মাস নিয়মিত নিখিলেশবাবু ছাদে উঠছেন। সব টবগুলোতে জল ঢালেন। তবে বুঝতে পারেন বেশিরভাগই বাইরে চলে যাচ্ছে। আর আস্তে আস্তে বুঝতে পারছেন টবের মাটি ক্রমশ: শুকিয়ে যাচ্ছে। জমাট বাঁধছে। শক্ত হচ্ছে। কিছু টবে আগাছা হচ্ছে। আগাছার রং হলদেটে। তামাটে। কেমন যেন মাকড়শার জালের মত হয়ে উঠছে আগাছাগুলো। প্রথম প্রথম নিখিলেশবাবু ভাবতেন বোধহয় কোনও গাছ উঠছে। তারপর যখন বুঝলেন ওগুলো তুলে ফেলতে হবে তখন প্রাণপণে টান মেরেও দেখলেন ওগুলো শেকড়শুদ্ধ ওপড়ানো যাচ্ছে না। হাতের মুঠোয় কিছু গাছপাতা উঠে আসছে শুধু। নিখিলেশবাবু এদিক ওদিক তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। অবচেতন মনে নিবেদিতাকে খুঁজতেন। তারপর থেকে শুধুই জল ঢেলে চলেছেন। গাছ নেই। ফুল নেই নিবেদিতা নেই। শুধুই অন্যমনস্ক জল ঢালা আছে। রেনওয়াটার পাইপ বেয়ে জলের শব্দ আছে। সেই শব্দে নিখিলেশ বাবুর আবার অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়া আছে। সন্ধে গড়িয়ে নিখিলেশবাবুর নেমে যাওয়া আছে। ড্রয়িংরুমে একা একা বসে থাকা আছে। আছে পরেরদিন আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা।
—-মাটিগুলো তো অরুণই বানিয়ে দিয়ে যেতে পারে বললেই।
নিখিলেশবাবু নিবেদিতাকে বলতেন অরুণের কাছ থেকে কেনা বস্তা ভর্তি ডেলা পাকানো মাটিগুলোকে ঝুরোঝুরো করতে করতে।
—-আরে করোই না একটু। বসেই তো আছো।
—-তাবোলে এই বেলা এগারোটার রোদে ছাদে বসে এসব করতে হবে? এই বয়সে পোষায় ?
—-একটু খাটাও তো শরীরটাকে। সারাদিন ওই তো এক কাজ বসে বসে পেপার পড়া।
আসলে নিখিলেশবাবু পেপার পড়তে পড়তেও অন্যমনস্ক হয়ে যেতেন ওই ঘটনার পর থেকে। নিবেদিতা যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছেন ব্যাপারটা সেদিন থেকেই নিখিলেশবাবুকে ব্যস্ত রাখতেন সময়ে অসময়ে। আজ বুঝতে পারেন নিবেদিতা নিখিলেশবাবুকে কাজ করাতে চাননি ব্যস্ত রাখতে চেয়েছিলেন।মাটি তৈরি করতে কেই বা পারে রিটায়ার্ড লাইফে হঠাৎ করে যার মধ্যে বাগান বাগান ব্যাপারটা কোনদিনই ছিলনা। নিবেদিতারই কি ছিল? তবু সেদিনের পর কয়েকদিন চুপ ছিলেন নিবেদিতা। তারপর হঠাৎই মেতে উঠলেন ছাদের ওপর। যেকোনোও বাড়ির ছাদেই দু’একটা টব থাকেই চিরকাল। উঠতে নামতে জলও পায় ওরা। নিবেদিতা সময় মেহনত সবই বাড়ালেন। নিবেদিতাও কি সব ভুলতে পারলেন? যদি পারতেনই তবে ছাদ থেকে নেমে এসে রাত যত আস্তে আস্তে গভীর হত তার চেয়েও আস্তে আস্তে নিবেদিতা কেন রাত পার করতেন? চুপি চুপি উঠতেন? নিখিলেশবাবু্র দিকে তাকিয়ে থাকতেন অন্ধকারে? তারপর অন্য ঘরগুলোর পর্দা সরিয়ে সরিয়ে দেখতেন? ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে অনর্থক বসে থাকতেন দু’পাঁচ সেকেন্ড? আবার ফিরে এসে শুয়ে পড়তেন নিখিলেশবাবুর পাশে? চুপিচুপি? সকাল হতে না হতেই নিবেদিতা সব ঘরের দরজা জানলা হাট করে খুলে দিতেন। বলতেন সকালবেলা সব খুলে না দিলে ভ্যাপসা লাগে। নাকি সকালের আলো ঘরে ঢুকলেই এঘরে ওঘরে ওদের ছড়ানো ছিটানো ফেলে রেখে যাওয়া ছবি আলমারি কিংবা দু’একটা অ্যাটাচি কেস নিবেদিতার সঙ্গে কথা বলে উঠত? নিবেদিতা সেদিন আলাদা করে কিছু বলেননি। নিখিলেশ বাবু বোঝার চেষ্টা করেছিলেন পরে। প্রসঙ্গ উত্থাপন করতেন ছুতোনাতায়। কিন্তু নিবেদিতা এড়িয়ে গিয়েছেন। নিখিলেশবাবু ভাবতেই পারেননি অলকেশ এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবে। নিখিলেশবাবু ভাবতেন তিনি যেভাবে ভাবিয়েছেন ছেলে সেভাবেই ভেবেছে।
—-তুমি বুঝছ না বাবা এখন দিনকাল অন্যরকম।
—-তাবোলে আমাদের একমাত্র বসার ঘর সকাল থেকে সন্ধে আটকে থাকবে?
—-তা কেন? সপ্তাহে তো তিনদিন
—-তোমরা দুজনেই তো মাস্টারি কর। তারপরও টিউশানির কি দরকার ?
—-না– আসলে কিছু ছেলে প্রচণ্ড ধরেছে
—-ওদের স্কুলের পর স্কুলেই ডেকে নাও। কারও অসুবিধে হলে ওখানেই বুঝি‌য়ে দাও
—-তা হয় না বাবা। এখন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা অনেক বড় ব্যাপার।
—-আমিতো একাই চাকরি করে সংসার টেনেছি। তোমরা তো দুজনেই স্বাবলম্বী।
নিখিলেশবাবু বুঝতে পারছিলেন লড়ে যাচ্ছেন বটে কিন্তু তার ধ্যানধারণা অলকেশের বিরক্তি উৎপাদন করছে মাত্র। অলকেশ ক্রমশ: চোখেমুখে অসন্তুষ্ট হচ্ছিল।
—-তাহলে তুমি ড্রয়িংরুমটা ইউজ করতে দেবে না?
—-প্রশ্নটা ড্রয়িংরুম নয়। প্রশ্নটা প্রাইভেট….
নিখিলেশবাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই অলকেশ বলে উঠেছিল
—-তোমার নীতিবাগীশতার ফল তো দেখছিই—একটা ঘর শেয়ার করার অবস্থা নেই।
—-ঘর শেয়ার করার ব্যাপার নয় দোতলা তিনতলা থাকলেও আমি—
নিখিলেশবাবুর কথা শেষ হওয়ার আগেই অলকেশের ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেছিল। ওর বন্ধ দরজার বাইরে পর্দাটা এমনভাবে তিরতির করে কাঁপছিল যেন ঘটনাটা দেখে বলছিল কিছু বলার নেই কিছু বলার নেই। এক মাসের মধ্যেই একটা ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছিল সদর দরজার সামনে। ওরা চলে গিয়েছিল। দুবছর পরে ওরা আরেকদিন এসেছিল যেদিন নিবেদিতা সব ছেড়েছুড়ে ওই সদর দরজা দিয়েই চলে গিয়েছিল। সেদিনও একটা ট্রাক এসেছিল।
এরপর নিবেদিতার বাগানে জলের ঘাটতি শুরু হয়েছিল। অপটু নিখিলেশবাবু ক্রমশ: কাঠ হয়ে যাওয়া টবগুলোতে অন্যমনস্কভাবে জল দিতে দিতে ভাবতে থাকেন নিবেদিতা বেঁচে থাকতে থাকতেই গাছগুলোকে ভালবাসতে হয় কিভাবে জেনে নিলে হ’তো। ভাবতে ভাবতে আজ কয়েকদিন পরে আবার নিখিলেশবাবু ছাদে যাওয়ার কোলাপসিবল্ গেট খোলেন। কাঠের দরজা খোলেন। অন্ধকার অন্ধকার হয়ে এসেছে তবু ছাদের লাইট জ্বালান না ।
—-শোনো ছাদের লাইট আগে জ্বালাবে না ।
—-কেন? নিখিলেশবাবু বলতেন
—-ওরা নিজেদের মধ্যে সহজ সরল থাকে। লাইট জ্বালালেই ওরা আড়ষ্ট হয়ে যায়।
—-ধুস। নিখিলেশবাবু হেসে উঠতেন।
—-অন্ধকারে গাছের অন্যরূপ থাকে। দেখবে ওরা হাতে ফুল নিয়ে আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।
নিবেদিতা এতশত কি বলত? নিখিলেশবাবুকে ভোলাতে আবোলতাবোল গল্প করতো? নিখিলেশবাবু ছাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ান। কোনও টবে কোনও গাছ তার জন্য ফুল হাতে দাঁড়িয়ে নেই। আস্তে আস্তে ছাদের ওপর অন্ধকার নেমে আসছে। রাস্তার আলোটা নিখিলেশবাবুর ছাদের দিকেই ফেরানো। একতলা ছাদ। রাস্তার আলোটা ছাদময় ছড়িয়ে পড়েছে। হঠাৎ চমকে ওঠেন নিখিলেশবাবু। কোনার দিকের টবটায় একটা লম্বা সবুজ শীষ দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় অস্ফুট সাদা কুঁড়ি। গোটা ছাদে একটাই টবে একটাই রজনীগন্ধার স্টিক। এত আকালেও ও মাথা তুলেছে।ফুটবে ফুটবে করছে। নিখিলেশবাবু দাঁড়িয়ে থাকেন। নিখিলেশবাবু আনমনে আকাশের দিকে তাকান। এক ফালি পরিষ্কার চাঁদ। তার গা বেয়ে সাদা মেঘ বৈঠা বেয়ে ভেসে যাচ্ছে। কাঁপা কাঁপা হাতে রজনীগন্ধার গায়ে হাত দেন নিখিলেশবাবু। নিবেদিতার সঙ্গে এখন খুব আবোলতাবোল বকতে ইচ্ছে করছে নিখিলেশবাবুর।

যাপন – দুই

অপালা ডাইনিং রুমের মাঝখানটায় এসে দাঁড়ায়। কাঁধের ব্যাগটা সোফায় নামিয়ে রাখে। অজান্তেই সিলিং এর দিকে চোখ চলে যায়। ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে ছত্রখান হয়ে থাকা মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছড়িয়ে থাকা আধভাঙা বুদ্ধমূর্তি। ফ্রিজের ওপর থেকে গড়িয়ে আসা ফ্লাওয়ারভাস। সোফার নিচে গড়াগড়ি যাওয়া কুশন। অপালা চুপ করে দেখে। অপালার পায়ের কাছে এসে চুপ করে বসে পড়ে গোল্ডেন রিট্রিভার দুটো। অপালা পা সরাতে যেতেই হাত থেকে ছিটকে পড়ে মোবাইলটা। অপালা জানে গিজগিজ করছে অনেকগুলো মিস্ ড কল। ও জানে কলগুলো কার। রিং ব্যাক করা জরুরী কিন্তু করেনা। নামিয়ে রাখা কাঁধের ব্যাগটার দিকে ওর চোখ পড়ে। ওর মধ্যে ওর মন আছে। মুক্তি আছে। প্রায় দেড় যুগ পর ও আবার শুরু করেছিল। অনভ্যাস বাধা দিচ্ছিল। তবু সময়ের মরচেগুলো ঘষে ঘষে যতটা পারে তুলে ফেলছিল।
—-কিরে ফোন করেছিলি কেন ?
—-আমি আবার শুরু করেছি
—-কি ?
—-আবৃত্তি
—-কবে থেকে ?
—-এইতো মাস খানেক
অপালা ঠিক করেই রেখেছিল সুমনদাকে জানাবে। তবে ভেবেছিল একটু থিতু হয়ে নিক। সুমনদাকে ও সব বলে। সারাজীবন ধরেই বলে এসেছে। শুধু ঠিক সময়ে ঠিক কথাটা বলা হয়ে ওঠেনি। আর বলবেই বা কি করে? বলবে বলবে করতে করতেই তো বাবা বলে উঠেছিল
—-কাল বিকেলে রেডি হয়ে থাকবে। ওরা আসবে।
ওরা কারা? অপালার হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা শেষ হওয়ার জন্যেই নাকি অপেক্ষা করছিল ওরা। মেয়েদের একটা বয়সে ওরা আসবে মানে কারা আসবে সেকি বলে দিতে হয়? মা শুধু বলেছিল
—-ওই তো। জয়ন্ত ওর বাবা মা আর কাকা কাকিমা।
জয়ন্তদের চিনত অপালা। বাবার অফিসের এক সাপ্লায়ারের ছেলে। হয়তো ভালো ছেলে। হয়তো ব্যবসাপাতিও ভালই করে। হয়তো বাড়ি ঘরদুয়ার সবই আছে। কিন্তু অপালা তো আর ভাবেনি। ওর হয়ে বাবা ভেবেছে। মা ভেবেছে। জয়ন্তদের বাড়ির লোকজন ভেবেছে। শুধু অপালাই ভাবেনি। অপালা ভাবার আগেই ওর হয়ে অন্যেরা ভেবে দিয়েছে। সেও নিজের নিজের মতো করে। অপালার মতো করে নয়।
—-পজিটিভ
অপালা বুঝতে পারেনি প্রথমে। জয়ন্তও দোকান থেকে একটু আগে আগেই ফিরেছিল সেদিন। পা টিপে টিপে অন্যরকমভাবে। চোখে খুশীর ঝিলিক। অপালা রান্নাঘরে কি করছিল আজ আর মনে নেই। খুশিয়াল জয়ন্ত পেছন থেকে অপালাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে খেতে কানে কানে বলেছিল কথাটা। অপালা ভুলেই গিয়েছিল সকালে ইউরিন টেস্টের জন্য স্যাম্পল নিয়ে গিয়েছিল জয়ন্ত। জয়ন্তর উচ্চারণে অপালার ধক করে উঠেছিল মনটা। জয়ন্তর চোখ এড়ায়নি। বলেছিল
—-কি? তুমি খুশি হওনি ?
অপালা চেয়েছিল কি? এত তাড়াতাড়ি ?একবছরও তো হয়নি। একটু ঘুরতে ফিরতে চেয়েছিল ক’দিন।
—-তুমি একা একা থাকো। আমি সারাদিন বাইরে বাইরে…
সেই অপালার জন্যে ভেবে দেওয়া। অপালার মতো করে নয়। নিজের নিজের মতো করে। কেন? বাইরে বাইরে তো কি? যখন ঘরে থাকো সেই খুশির মুহূর্তগুলো যখন বাইরে থাকো তখন যে অপালা একটু একটু করে তোরঙ্গ খুলে খুলে দেখে আর খুশি হয়। আবিষ্ট হয়। আবার ফিরে এলে কিভাবে নতুন করে আবিষ্ট হবে সেটা বুঝি কিছুইনা? অপালাকে অপালার মতো করে ভাবার সুযোগই দেয়না কেউ কোনদিন। শাড়ির নীচে টান পড়তেই অপালা উঠে দাঁড়ায়। ডাগরডোগর অফ হোয়াইট এর ওপর ছিটছিট। ডন। পুরুষ। খয়েরি জমিনের ওপর নাকি নিচে সাদা ব্রাশওয়াশের মতো শরীর। লিজা। নারী। কুঁই কুঁই আওয়াজ করতে করতেই অপালার পা চাটছে। অপালা নিচু হয়ে তাকাতেই দু’জনে প্রশ্রয় পেয়ে তার কোলে উঠতে চায়।
—-কি হ’ল? ফোন তুলছিলেনা কেন ?
দশ পনেরো মিনিটে ছ’সাতবার ফোন বেজে উঠেছিল। অপালা বুঝতে পেরেছিল রিং টোন ওর দুরে রাখা ব্যাগ থেকেই আসছে।অপালার ধরার উপায় ছিলনা। ভুলে গিয়েছিল সাইলেন্ট মোডে রাখার কথা। রিহার্সাল থেকে উঠে যেতেও পারছিলনা। শ্যামার কাহিনী তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। থেমে যাবে সবাই। কেটে যাবে তাল। স্টেজ রিহার্সালে সবার কাছেই বেসুরো লাগছিলো রিং টোনটা। অপালার দিকে তাকাচ্ছিল সবাই। শেষমেশ ফাঁক পেতে একবার উঠে গিয়ে ধরেছিল কলটা।
—-কি বলছ ?
অপালার প্রশ্নে খেঁকিয়ে উঠেছিল জয়ন্ত।
—-কুকুরদুটোর চীৎকারে পাড়াপড়শি পাগল হয়ে যাচ্ছে। তুমি জানো না ওদের খাওয়ার সময় হয়ে গেল
—-রিহার্সাল শেষ হয়নি।তুমিই তো বলেছিলে আজ ওদের তুমি খাওয়াবে।
অপালার কথায় জয়ন্ত বলেছিল
—-আই পি এল এর খেলা ছিল।খেয়াল ছিল না। দোকানে দেখছি।
—-বাড়িতে কি হ’ল? আজ তো রোববার
—-বাড়িতে হয় নাকি? কুকুর দেখে কেউ আসতে চায়না।
অপালা নীরব হয়ে গেছিল। সুমনদা রিহার্সাল দেওয়াতে দেওয়াতেই ওকে ইশারা করেছিল চলে যাওয়ার জন্য। ওর হয়ে সুমনদাও ভেবে দিল। অপালা ডাইনিং এ ছড়িয় থাকা জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। সোফা থেকে ব্যাগটা নিয়ে চেন খোলে। মাথার জন্য নকল ফুল। কানের জন্য নকল দুল। গলার জন্য হার। চুড়ি বালা।সব নকল। সব ম্যাচিং। লিপস্টিক। উত্তরীয়। এসবই প্রোগ্রামের দিন লাগবে। টিপের পাতাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অপালা। তখনই পায়ের নিচে শাড়িতে আবার টান পড়ে অপালার। সমস্ত সাজের জিনিস সোফায় ফেলে রেখে রান্নাঘরে গিয়ে ঢোকে অপালা। নামিয়ে আনে আটার টিন। জলের মগ। চাকতি বেলনা। বাটিতে আটা নেয়। জল দেয়। কুড়িখানা রুটি হবে।
—-মা পেয়েছ জিনিষটা ?
ছেলের ফোন পেয়ে অপালা শুধু বলেছিল
—-পেয়েছি।
—-তুমি খুশি হওনি ?
সারাজীবন সবাই নিজের নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছে তারা যা সিদ্ধান্ত তাতেই অপালা খুশি হবে। কলকাতায় পড়তে যাওয়া অপালার ছেলে এখনও ঠিকঠাক বড়ই হয়নি। সেও অপালার ভাবনা আগেই ভেবে দিচ্ছে।
—-কি কিউট না বাচ্চা দুটো ?
—-হ্যাঁ
অপালা সেদিন ভোরবেলা বুঝতে পারেনি জয়ন্ত হঠাৎ ভোরবেলা স্টেশনে কেন গেল? জয়ন্ত শুধু যাবার আগে মুচকি হেসে বলেছিল
—-তোমার জন্যই যাচ্ছি।চমকে দেব।
জয়ন্ত ফিরেছিল। ছেলে কলকাতা থেকে ট্রেনে বাচ্চা দুটোকে পাঠিয়েছিল।
—-আমিতো বাইরে।বাবাও সারাদিন দোকানে। তুমি সারাদিন বসে বসে বোর হবে। তাই….
অপালা বলতে পারেনি ও অন্যরকম ভেবেছিল। সুমনদাকে বলবে আমি আবার শুরু করতে চাই।
অপালা চুপ করে আটা মাখতে থাকে। ডন আর লিজা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে ওর‌ আটামাখা। ওর আটামাখা শেষ হলে লেচি হবে। ওরা দেখতে থাকবে। ওর লেচি থেকে রুটি বেলা হবে। ওরা নড়বে না ।ওর রুটি সেঁকা হবে। ওরা তখনও নড়বে না। ও ফ্রিজ থেকে তরকারি বের করে গরম করতে গেলে ওরা প্রথমে উচাটন হবে। ওদের পাত্রে ঢালার সময় ওরা ধৈর্য্য হারাতে থাকবে। প্রথমে নিজেদের গুটিগুটি ঠেলতে ঠেলতে পায়ে পায়ে ঢুকে পড়তে চাইবে। অপালা ওদের খাওয়ার দিয়ে সরে গেলেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়বে খাবারের থালায়। ট্যাঁ ট্যাঁ করে কলিং বেল বাজতেই অপালার ঘোর কাটে। দরজা খুলে দেয় সদরের।
—-এসেছ? একটা ফোন করবে তো ?
অপালা কিছু না বলে ডাইনিং রুমে এসে বসে। জয়ন্ত বলে যায়
—-ওরা খিদের চোটে বন্ধ ঘরে চেঁচামেচি করছিল। পাশের বাড়ির মানিকদা থাকতে না পেরে ফোন করেছিল।
অপালা চুপ।
—-আরে ওদের ব্যাপারটাও তো দেখতে হবে ?
অপালা তবুও চুপ।
—-রিহার্সাল বলে তো আর ওরা খিদে চেপে রাখতে পারবেনা। অপালা আস্তে আস্তে বাথরুমে ঢুকে যায়। ভিতর থেকে জয়ন্তর গলা শুনতে পায় কিন্তু বোঝার চেষ্টাও করেনা। অপালা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে ডাইনিং এ দাঁড়াতেই চমকে ওঠে। ডন আর লিজা মিলে ওর প্রোগ্রামের সমস্ত গয়না সোফা থেকে নিচে ফেলে মুখে নিয়ে খেলছে। অর্ধেক গয়না কুটিকুটি। ওরা অপালাকে দেখেই ছুটে এসে আনন্দে লাফাতে লাগলো। ওকে ঘিরে ডাকতে শুরু করলো। ওরা কি ভাবছিল অপালা ওদের সঙ্গে খেলতে পেলে খুশি হবে? অপালার কান্না আসার থেকেও মনে হচ্ছিল ওরাও অপালার আগেই অপালার খুশির কথা ভেবে ফেলেছে। জয়ন্ত ওর পাশ দিয়েই মোবাইলে কথা বলতে বলতেই নিজের মনে বাথরুমে চলে যাচ্ছিল একটা গামছা পড়ে। কোনদিকে খেয়ালই নেই ওর। অপালার মনে হ’ল জয়ন্ত বলে কেউ নয় শুধু দু’টো অণ্ডকোষ তাকে পাশ কাটিয়ে বাথরুমের দিকে চলে গেল।

Facebook Comments

5 thoughts on “যাপন : উমাদাস ভট্টাচার্য Leave a comment

  1. উমাদা, অসামান্য দুটো লেখাই।
    যাপন ১ এর কিছু কথা ছাদের, গাছে জল দেওয়া… সাথে সাথে বর্তমান সময়ে চিত্র।
    আর যাপন ২ পড়তে পড়তে কেমন একটা ঘোরে চলে গেলাম।

Leave a Reply