কাশবনের ভাস্কর্য : শুভংকর গুহ
“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।
৭
আমি বাবার তক্তপোষের নিচ বসে ছিলাম। মা বাবার পাশে বসে উল বুনছিলেন। মা উল বুনতে বুনতে নিজের সমস্ত মনোযোগকে উলের কাঁটার মধ্যে রেখে বাবার কথা শুনে যাচ্ছিলেন। উল দিয়ে চমৎকার ফুলের বিন্যাস গড়ে তুলছিলেন সোয়েটারে। মা জানেন, একটু দৃষ্টি ফেরালেই উলে জট পেকে যাবে। তিন রঙয়ের উল যে ফুলের রচনার জন্য হুড়োহুড়ি করছে। আমিও ভাবছিলাম, কখন উলের জট পেকে যায়। উলের জট পেকে গেলেই মা আমাকে বলবেন, জট খুলে দাও। এই কাজে আমি বেশ আমোদ বোধ করতাম। বুঝতে পারতাম, এই কাজটির ক্ষেত্রে মা আমাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন। আমিও বেশ উৎসাহিত হয়ে উলের জট খুলতাম। অনেক সময় এমন উলের জট পেকে যেত, আমি কেন কারও পক্ষে সেই জট খুলে সরল উলকে বের করে আনা দুঃসাধ্য ছিল। সেই জট নিয়ে আমি মাকে বলতাম,- বৈজ্ঞানিক… বৈজ্ঞানিক।
মা বলতেন,- পারলি না তো।
আমি আবার বলতাম,- বৈজ্ঞানিক… বৈজ্ঞানিক।
মা হাসতেন।
বাবা নিজের দেশ গাঁয়ের গল্প করছিলেন। তাঁর মুখ থেকে ময়মনসিংহ জেলার নদ নদীর গল্প শোনা ছিল আমাদের নিয়মিত অভ্যেস। যেমন ময়মনসিংহ জেলার ক্ষীরু নদীর কথা প্রায়ই বাবার মুখে শুনতাম। তিনি বলতেন ক্ষীরু নদী ময়মনসিংহ জেলার প্রখ্যাত নদীগুলির মধ্যে অন্যতম। ক্ষীরু নদী প্রাচীন নদী। বাবা ইতিহাসের কথা বলতেন। সেই সময়ে ইতিহাসের কথা আমাকে তেমন আকর্ষণ করত না। কিন্তু তিনি বলতেন, আমরা সবাই শুনতাম। আমাদের বড় ভাই উৎসাহ প্রকাশ করতেন। কারণ তাঁর জন্ম পাকিস্তানে, মানে অধুনা বাংলাদেশে। বাবা বলতেন, ভবদেব ভট্টের তাম্রশাসনে ক্ষীরু বা ক্ষীরোদা নদীর নাম উল্লেখ আছে। দেবপর্বত সেই সময়ে ক্ষীরোদা নদীর তীরেই অবস্থিত ছিল। শ্রীচন্দ্রের শ্রীহট্ট তাম্রশাসনেও ক্ষীরু নদীর তীরে অমূল্য সম্পদ হিসেবে মান্য করা হয়েছে দেবপর্বতকে। আগে নাকি, হাজার বছর আগে এই নদী প্রশস্ত ছিল, একূল ওকূল দেখা যেত না। বঙ্গোপসাগর ফেরত জাহাজ এই নদীর মধ্য দিয়ে, ময়নামতি পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত যাতায়াত করত। বাবা এই কথাগুলি বলতেন, এমন যেন তিনি ইতিহাস বইয়ের পাতা থেকে অবলীলায় পড়ে যাচ্ছেন। বাবার মুখ থেকেই শুনেছিলাম গলগণ্ডা নদীর কথা। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে উঠতেন- গলগণ্ডার মাঝি…ই…ই…ই…গলগণ্ডার মাঝি…ই…ই…ই…। একটানে বেশ কয়েকবার বাবা না কি তাঁর শৈশবের মাঝিকে এমন ডাক দিয়ে যেতেন। এই ডাক দিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের বাল্যকাল, কিশোরবেলাকে, যৌবন বয়সের ছাত্রজীবনকে স্মরণে আনতেন। ভাইদের মধ্যে বাবার মাঝি…ই…ই… মাঝি…ই…ই… চিৎকার শুনে হাসলেও আমি হাসতাম না। আমার বেশ লাগত। বাবার সেই ডাকের মধ্যে অদ্ভুত এক নদীর আহ্বান ছিল। যেন ক্ষীরু নদীর জল আমাদের ঘরের ভিতরে প্রবেশ করবে। তখন মনে হত একটি কাগজের নৌকো বানিয়ে ঘরের মেঝেতে ভাসিয়ে দিই। বাবা বলতেন, এখনও আমার মনে আছে গলগণ্ডা হল ছোটো নদী। বহুদূর থেকে ক্ষীরু নদীর শাখা প্রশাখা ভেঙ্গে ভেঙ্গে গ্রামে এসে গ্রামের নাম ধারণ করে গলগণ্ডা নদী। অনেকটা খালের মতো। বর্ষাকালে সেই নদী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবরণের মতো অখ্যাত কোনো এক নদীচিহ্ন। সেই নদীচিহ্নের ওপরে কত নৌকোপাখি ডানা মেলে দেশান্তরের উড়ে যাচ্ছে। আজ থেকে প্রায় দশবছর আগে এই গলগণ্ডা নদীকে এক নদীদাগ বা নদীচিহ্ন মনে করে লিখেছিলাম “জলফকির” নামে একটি গল্প।
বাবা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রকৃতির সাধক মনে করতেন। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাবা মহাপুরুষ মনে করতেন। বাবার আদর্শ ছিলেন চৈতন্যদেব, মহাত্মা গান্ধী এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে কথা আগেই বলেছি। গলগণ্ডা হল তখন পাকিস্তান, অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার প্রান্তিক গ্রাম। বাবার শৈশবের গ্রাম। আমাদের মধ্যে অনেকেরই সৌভাগ্য হয় না, পিতৃদেবের জন্মস্থান জন্মগ্রাম দেখার। আমারও হয়নি। আমাদের। মধ্যে শুধু বড়ভাই ছাড়া সবারই জন্ম কলকাতায়। বাবা বলতেন, একেবারেই লন্ঠনের টিমটিম আলোর মতো গলগণ্ডা প্রান্তিক একটি গ্রাম।
গলগণ্ডা নদীও তাই। মাত্র চার পাঁচ মাইল লম্বা এই নদীদাগ। নিখুঁত ভৌগোলিক পরিচয়ের বাইরে। এইসব নদী প্রকৃতির ইতিহাসের বাইরে অনাথ ক্ষীণ প্রবাহ। দেশের বাড়ির গল্প করতে করতে বাবা তন্ময় হয়ে যেতেন। আশ্চর্য !!! বাবাকে অন্য পূর্ববঙ্গের দেশ ছেড়ে আসা মানুষগুলির মতো কখনও বলতে শুনি নি আমাদের বিঘের পর বিঘে জমি ছিল। পুকুর ছিল। ধানের গোলা ছিল। গোয়ালভর্তি গরু বলদ ছিল। বাবার পিতৃদেব শশীকুমার গুহ ছিলেন দারোগা। তখনকার দিনে দারোগাবাবুদের জিপ গাড়ি ছিল না। তারা ঘোড়ার পিঠে চেপে নিজের থানা এলাকার ক্ষেত্র বা এরিয়ার মধ্যে ডিউটি করতেন। বাবার মুখ থেকেই শোনা ঠাকুরদার সম্পর্কে গল্পগুলিকে আজ রূপকথার মতো মনে হয়। তখন থানাকে বা পুলিশ স্টেশনকে বলা হত দারোগা বাবুর কাছারিখানা। অপরাধীকে গ্রামের মধ্যে খুঁজে পেলে সিপাহিকে পাহারার জন্য রেখে দেওয়া হত। একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হত অপরাধীকে। বেশির ভাগই অপরাধী ডাকাতি বা চুরির দায়ে ধরা পড়ত। সেই সময়ে জলপথ ধরেই বেশির ভাগ ডাকাত ডাকাতি করতে আসত।
বাবা বলে যেতেন, শশী কুমার গুহ ও তাঁর ভাইদের খুব বড় সংসার ছিল, চাষাবাদের জমিজমা নামমাত্র ছিল। বর্ষাকালে চারদিকে জল থৈ থৈ, ডাঙ্গা মাঠঘাট ভেসে যেত, সবার বাড়িতেই ডিঙ্গি বা ছিপ নৌকা থাকত। লিকলিকে ছোটো পাতলা নৌকা, খুব বেশি হলে মাত্র তিনজন উঠে বসা যেত। বর্ষাকালে সেই নৌকা যাতায়াতের জন্য একমাত্র অবলম্বন। সেই ছিপ নৌকার ওপরে ভেসে, হাত জাল দিয়ে মাছও ধরা হত।
চারদিকে তাকিয়ে দেখে মনে হত, জল যেন আর কোনো দিনই নামবে না। সবাই যেন সাগরের ওপরে সংসার পেতেছে। যেন পৃথিবী জুড়ে নেমে এসেছে খণ্ডিত দ্বীপের মতো ছোটো ছোটো চিরায়ত জলের গ্রাম। বর্ষাকালের গ্রামজীবনের আতঙ্ক যে কি ভয়াবহ, শহরের মানুষের পক্ষে সে অনুমান সম্ভব নয়। বাবাদের বাড়িতে যারা পড়াশোনা করতেন তারা গামছা কোমরে বেঁধে ডিঙ্গি নৌকায় চেপে পাঠশালায় যেতেন। আর মাথায় তুলে নিতেন শুকনো পোশাক ও কাপড়চোপড়ের ঝুড়ি। অন্যজন মাথায় ঝুড়িতে বা থলিয়াতে বই খাতা পেনসিল নিতেন। বাবার হাতে থাকত আক্সির মতো লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে তিনি জলের ওপরে ভেসে ভেসে যাওয়া সাপ সরিয়ে দিতেন। বিষাক্ত সব সাপ, গোখরো, চন্দ্রবোড়া ও আল কেউটে। আষাঢ় মাস এক ভাবে চললেও শ্রাবণ মাসে পাঠশালা বন্ধ হয়ে যেত জলযন্ত্রণার জন্য। ঠাকুরদা না কি বলতেন, তাদের তেমন জমিজমা ছিল না বলে, পড়াশোনা বা অধ্যয়নই একমাত্র তাঁদের পুঁজি। লেখাপড়া শিখে শহরে গেলে, সেখানে না কি জীবন খুব সুন্দর। বাবা আমাদেরও তাই বলতেন। বলতেন, দেখ, আমাদের গ্রামের আর বাড়িঘর নেই। জমিজমা কোনোকালেই ছিল না। তাই শহরে থাকতে হলে, কলকাতায় থাকতে হলে লেখাপড়া জানা ছাড়া আর কোনোই অবলম্বন নেই। ব্যবসা বাণিজ্য আমাদের রক্তে নেই। আমরা অধ্যয়ন ও লেখাপড়া করে পেশা অবলম্বন করি। অবকাশে ভাবের ঘরে ডুব দিয়ে থাকি।
দেশবিভাগের আগে বাবা এক ব্রিটিশ সাহেবের অধীনে স্টেনোগ্রাফারের কাজ করতেন। তিনিই বাবাকে জানিয়েছিলেন সামরিক বাহিনীতে কাজে যোগদান করতে।
১৯৪৮ সালে দেশভাগের কঠিন যন্ত্রণাকে অবলম্বন করে বাবারা পরিবার নিয়ে চলে এলেন কলকাতায়। আমার জন্ম ১৯৫৬ সালে, এক অখ্যাত ও মেঘভর্তি আকাশ দিবসে। মায়ের জন্মদিনের দিন আমার জন্ম। এ এক অদ্ভুত মিল। ভাদ্র মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে একই তারিখে মায়ের ও আমার জন্ম। তারিখটা না হয় নাই বা উল্লেখ করলাম। সেইদিন কোচর ভর্তি এক অবসাদের দিনে মহাজাগতিক বিশ্বসংসারে আমার আগমনে, নিশ্চয়ই শহরতলী অঞ্চলের গিধড় বা শেয়াল হয় তো গর্ত বদল করে ট্রেন লাইনের পাশ ধরে দিব্যি ছুট দিয়েছিল এক নতুন আস্তানার খোঁজে। টিপ টিপ করে ভাদ্রের বৃষ্টির মধ্যে কলকাতার কুনোব্যাঙ নালির পাড়ে স্যাঁতস্যাঁতে মাশরুমের উপলব্ধি নিচ্ছিল।
সেই নিজের কালো কুৎসিত এক মাংসপিণ্ডের ছদ্মবেশ আত্মপ্রকাশকে জানতাম ভবিষ্যৎ এক প্রেমহীন উপেক্ষার মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে। আজ মনে হয়, আমি নিজেকে সঠিক সংজ্ঞায়িত করতে পারি, ঘৃণা ও উপেক্ষা দিয়ে সাজানো ভাবের ঘরের মজুর হিসেবে। পরবর্তীকালে যখন পানাগড়ে একটু একটু করে বই পড়ে উঠতে শিখছি, তখন বাবা আমাকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন,- “আঙ্কল টমস্ কেবিন”। বহুদিন লেখকের নাম মনে রাখতে পারিনি। কিশোর বয়সে ভালো লাগা একটি গ্রন্থ জীবনস্মৃতির প্রাঙ্গণ আচ্ছন্ন করে রাখে। ১৮৫২ সালে লেখা এই মর্মভেদী উপন্যাস আমার গভীর অন্তরে অন্ধকারের প্রতি অনুরাগের জন্ম দিয়েছিল। লেখকের নাম মনে করতে হলে এখন আর স্মৃতি হাতড়াতে হয়না। এখন স্পষ্ট মনে করতে পারি,-লেখকের নাম হ্যারিয়েট বীচার স্টো। বাবা বলতেন, বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে এটি একটি মহৎ গ্রন্থ।
এই অবকাশে বলে রাখি, কালো রঙয়ের প্রতি আমার অনুরাগ ও মায়া জীবিত জীবনে সেরা প্রাপ্তি। প্রচ্ছদে শিল্পী যে ভাবে আঙ্কল টমস্ কে চিত্রাঙ্কন করেছিলেন, আমি নিজেকে সেই চেহারার সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করে, কল্পনায় এক নির্জন সৈকতে একটি কাঠের কুটির গড়ে নিতাম। বাবা বলতেন, সমাজ ও চারপাশের মানুষজন তোমাকে যদি উপেক্ষা করে, দেখবে তোমার বেড়ে ওঠার চারপাশ ততই মজবুত হয়ে উঠছে। যদি সবাই তোমাকে খারাপ বলে,,তখন লোভে পড়ে নিজের ভালো বা উত্তমকে প্রকাশ করতে যেও না, তাকে আড়াল করে রাখবে। নিজের উত্তম ও ভালোকে সবসময় আড়াল করে রাখতে হয়। যতই নিজেকে আড়ালে রাখবে, ততই তুমি খোলা মনে কাজ করতে পারবে। তখন কি আর বাবার এই সব বড় বড় কথাকে বুঝে ওঠার সময়? বাবা নিজের অভ্যাসে কথাগুলি বলতেন। অনেক সম্মানীয় প্রকাশক আমার কাছে অনেক সময় জানতে চেয়েছেন বা এখনও জানতে চান, আমার সব গ্রন্থের প্রচ্ছদ কালো রঙয়ের হয় কেন? আমি বলেছিলাম,- আমি অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার লিখি তাই আমি আমার সব গ্রন্থের প্রচ্ছদের রঙ কালোই পছন্দ করি। কালো রঙ আমার ভাবনার প্রতিনিধিত্ব করে। আমি অন্ধকারের অনুরাগী।
বাবা তক্তপোষে বসে, অদ্ভুত এক আবেগে কখনো কখনো আমাদের সাথে কথা বলতেন। সেই সময়ে বাবা ঈশ্বরে খুব একটা বিশ্বাস করতেন না। নাস্তিক ছিলেন। সংসার নিজের চাকরি কাজ এইসব কিছু নিয়ে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। কিন্তু নিজের ভাবের ঘরকে নিয়ে সংগোপনে তিনি কখনও কখনও একা থাকতেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারে অনেকেই আমার মতো, যারা তাদের বাবা মায়ের তীব্র মতের অমিল ও অশান্তি ও ঝগড়াঝাঁটি দেখে বেড়ে ওঠে, আমি কি এর ব্যতিক্রম ছিলাম? না, একেবারেই নয়। মায়ের সুক্ষ্ম শিল্পবোধ বাবার ব্যক্তিত্বকে কখনো কখনো হয় তো আঘাত করত। কিন্তু মা সবসময় নিজের আত্মভিমানকে নিজের কোচরে রেখে সমস্ত ঘরণী ও মায়ের মতো বলতেন,- এই লোকটা আমার জীবনকে জেরবার করে দিল তার উদ্ধত মনোভাবের জন্য। আজ বুঝি, পুরুষদের একপ্রকার ফিউডাল মনোভাব থাকে, বহু পুরুষ ধরে সেই শিকড় ছড়িয়ে আছে যুগ যুগান্ত ধরে। আজ অনেক সংসারের পতনের গভীরতম কারণ পুরুষদের এই ফিউডাল মনোভাবের জন্যই। বাবা মায়ের দাম্পত্য জীবনের ভুল বোঝাবুঝির তাপ উত্তাপ আমাদের স্পর্শ করত। খুব ভয় পেতাম পুরুষদের এই ফিউডাল সংস্কার আচ্ছন্ন এই ঔদ্ধত্য ও উদ্ধত মানসিকতা আমাকেও ভবিষ্যতে যেন আক্রান্ত না করে। কিন্তু আমি নিজেকে প্রতিহত করতে পারিনি পরবর্তী জীবনে। আমি আর সবার মতোই গভীর ভাবে আক্রান্ত হয়ে নিজস্ব ক্যানসার ওয়ার্ডে শায়িত হলাম। আমরা প্রত্যেকেই গভীর গোপনে বহন করে চলি এক কর্কট রোগ। বিছানায় শুয়ে দেখি দরজা জানালার সাদা কাপড়ের পর্দা বাতাসে উড়ছে। নিজের ঘরের বিছানাও যে হাসপাতালের শয্যার মতো হয়ে ওঠে।
মা কাঁদতেন। বুঝতে পারতাম, অনেকদিনের মতো আজও বাবা ও মায়ের মধ্যে চরম কথা কাটাকাটি হয়েছে। বাবা বুটজুতো পড়ে অভিমানে চলে যেতেন শহর ঘুরতে। বলে যেতেন,- কোথায় যাচ্ছি, কোথায় আছি? এইসব কিছু কোনোদিন জানতে চেও না।
উনুনের আগুনে ভাতের হাঁড়ি পুড়ে যেত। পোড়া ভাতের গন্ধ আমাকে বিচলিত করে তুলত। আমি দৌড়ে গিয়ে ভাতের হাঁড়ি নামিয়ে দিতাম উনুনের আঁচ থেকে। মায়ের চোখের জলে দুপুর গড়িয়ে যেত। বেলাশেষে মা আমাকে বলতেন, যাও দেখ তো গিয়ে একবার মানুষটা নাওয়া খাওয়া ছেড়ে কোথায় যে চলে গেল, একবার গিয়ে খুঁজে নিয়ে এস। আমি একটি লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে হাফিয়ে উঠতাম। কোথায় বাবা? তিনমাথার রাস্তার কোন দিকে বাবা চলে গেছেন কি করে জানব? সন্ধ্যা নেমে আসত। নিজের ভিতরখানা হু হু করে উঠত। বাবা কি তাহলে আর ফিরে আসবেন না? বাবা হয় তো চলে গেছেন সেই ঠিকানাহীন একটি শহরহীন শহরে।
এরপরের দিন যা ঘটত, তা আমদের বাড়ির ভিতরে জলতরঙ্গের খুশির টুং টাং শব্দের চেয়ে অধিক কিছু ছিল। কয়েকদিন বাবা এবং মা পরস্পর নিজেদের মধ্যে ডুবে থাকতেন। দুপুরের ঘুমের পরে মা উনুনে পায়েসর হাঁড়ি চাপিয়ে দিয়ে, ময়দা মাখতে বসে যেতেন। বিকেলের দিকে সমস্ত আয়োজন পাট পাট করে গুছিয়ে দিয়ে, বলতেন, তোমরা সবাই খেয়ে নিও। রাত কোরো না। তোমার বাবা এবং আমি সিনেমা দেখতে যাচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। বাবা এবং মা যতক্ষণ না ফিরে আসতেন, আমি সেই লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতাম। গাছের ডালে, একটি রাতপাখি উঁহু উঁহু উঁহু করে ডেকে যেত, নিজের সঙ্গীকে আহ্বান করত। বেশ রাতে বাবা মা ফিরে আসতেন। রাতের আলোছায়া অতিক্রম করে মা বাবা কি অসামান্য মন্থর পায়ে হেঁটে আসতেন, বুঝতে পারতাম, এই রাতের নির্জন পথ অনেকটাই সেই ডানা মেলে দেওয়া এক ধনেশ পাখির মতো, আমি ধনেশ পাখি উড়তে দেখেছি।
বাবা বলেছিলেন, দেশভাগের পরে বাড়িঘর ছেড়ে আমরা চলে এলাম বালিগঞ্জে। সেখানেই তোমার জন্ম। চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে। তবে দেশবিভাগ আমাকে নিজের কর্মজীবনে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। আমি সামরিক বাহিনীর কাজে যোগদান করলাম। ও দেশে আমাদের তেমন কিছু না থাকলেও শিকড় তো ছিল তো গেঁথে ছড়িয়ে ছিল। সেই শিকড় ছিন্ন হল, এখানে এসে আমরা এবং ভাইয়েরা সবাই জীবিকার সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কত বড় শহর, কারও জন্য কোথাও না কোথাও কাজের জন্য কিছু আসন পাতাই থাকে।
খুব ভোরে বাবা কাজে চলে যেতেন। ফিরে আসতেন বিকেলের একটু আগেই। কলকাতার হেস্টিংসে ইস্টার্ন কম্যান্ডের কাজের কেন্দ্র বা হেডকোয়ার্টার। কাজে যাওয়ার আগে, বাবা প্রতিদিন মায়ের কাছে চাউলের ও আনাজপাতির খবর নিতেন। মাকে বলে যেতেন, বাজার করিয়ে নিও। বড়ভাই বাজার করত। আমি বিছানায় ঘুমের ঘোরে বাবা মায়ের প্রভাতী কথাবার্তা শুনতাম। ঘরের ভিতরে জানালা অতিক্রম করে ভোরের আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ত। ভোরের কথার মধ্যে অদ্ভুত এক সত্য থাকে, অদ্ভুত এক নির্জনতা, আর একাকীত্ব। যে নির্জনতা একাকীত্ব ও সত্যগুলি বেলা বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মরে যায়। পরে বুঝেছিলাম, পরিবার ও সংসার হল অনুশাসনের আরেক নাম। অনুশোচনার আরেক দিক।
কখনও কখনও বাংলাদেশ থেকে অতিথির আগমন, তখন বাংলাদেশ মানে পাকিস্তান, এখন এই সময়ে পাকিস্তান ভাবলে মনেই হয় না, সেই সময়ের বাবাদের পাকিস্তান নামে একটি দেশ ছিল। তবে বয়স্কদের বলতে শুনেছি অধিকাংশ সময়ই তারা পূর্ববঙ্গ বলতেন। বাংলাদেশ থেকে যিনিই আসতেন পোড়াবাড়ির চমচম নিয়ে আসতেন। যারা পোড়াবাড়ির চমচম মুখে দিয়েছেন তারা জানেন সেই স্বাদ জীবনে ভুলে যাবার নয়।
বাবা কাজে চলে যাওয়ার পরে, মা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। আর সবাই লেখাপড়া নিয়ে বসে যেত। আমি ঢুকে যেতাম কয়েদখানায়। ক্লাসের লেখাপড়াকে আমি কয়েদখানার আলো ভাবতাম। অর্থাৎ কয়েদখানার এক ফালি জানালা দিয়ে আলোর রশ্নি যেমন চুইয়ে চুইয়ে অন্ধকারের মধ্যে জ্যামিতি গড়ত। অধ্যয়ন ও পড়াশোনা হল, আলোর দিশারি। আলোর সঙ্গে যাপন না করলে অন্ধকারের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজের লেখালেখির জীবনে যা কিছু সামান্য লিখেছি আলোর থেকে অন্ধকারের সন্ধান বেশি করেছি। কিন্তু এ কথাও বুজেছি অন্ধকার দিয়ে আলোর কথা এবং আলো দিয়ে অন্ধকারের কথা লেখা খুবই সহজ। কিন্তু অন্ধকার দিয়ে অন্ধকারের কথা লেখা খুবই কঠিন কাজ। আমাদের জীবনে আলো এবং অন্ধকারের খুব প্রয়োজন। আলো এবং অন্ধকারের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সাহিত্য রচনার প্রতিটি শব্দচেতনা বোধের সারস।
যখন আর্ট কলেজে ভর্তি হলাম, শিল্পশিক্ষার জন্য অর্থাৎ ছবি আঁকার ক্লাসে যখন ভর্তি হলাম, তখন বুঝতে পেরেছিলাম, ছবি আঁকার ক্ষেত্রে আলো ছায়া ও অন্ধকারের জ্ঞান থাকা কতটা জরুরি। এই প্রসঙ্গে অবশ্যই রেমব্রান্টের কথা উল্লেখ করব, যাকে বিশ্বের মহত্তম আলো আধারির চিত্রকর বলা হয়। মানুষের জীবনেও আলো ও অন্ধকার না থাকলে সেই জীবন আর যাই হোক জীবন হয় না।
বাবা যখন রাতের দিকে নিজের অবসরে, আমাদের সবাইকে নিয়ে গল্প করতেন, তিনি তাঁর জীবনের কথা বলতে বলতে ঘরের দেওয়ালে জ্বলে থাকা বাল্ব দেখতেন। নিস্পলক তাকিয়ে থাকতেন। আর কেউ দেখুক না দেখুক বাবার এই তাকিয়ে থাকাকে আমি বিস্ময়ে দেখতাম। আর ভাবতাম, একটি মানুষ তাঁর জীবনে কত স্মৃতি ধরে রাখেন?
আসলে আমাদের জীবনে আমাদের প্রত্যেকের বাবা ও মা এক একটি স্মৃতির সংগ্রহশালা।
হ্যাঁ সেই দিনের কথা আমি আজও ভুলতে পারি নি। বাবা অফিস থেকে এলেন, নিজের পোশাক খুলে, মায়ের কাছে এক গ্লাস জল চাইলেন। মা নিজের কাজ সেরে, প্রতিদিন বই পড়তেন। বই পড়া মায়ের এক বিশেষ অভ্যাস ছিল। আর প্রতি বুধবারে আকাশবাণী কলকাতার রাতের দিকে নাটক শুনতেন। বিশেষ করে, শরৎচন্দ্রের কাহিনি অবলম্বনে নাটক হলে, মাকে আর রেডিওর সামনে থেকে নড়ানো যেত না। বাবা এলেন, সেদিন অনেক দেরি করে। মা অবাক হয়ে বললেন,- ভারি যে দেরি করে এলে আজ? তাই বলে এত দেরি !!!
মা রেডিওর কাছে গিয়ে কান পাতলেন। নাটকের সংলাপ শুনছিলেন।
আজকে দেখি সন্ধ্যা থেকেই নাটকের আসরে ডুব দিয়েছ?
আজকে বুধবার না? জানো না সংবাদের পরেই নাটক হয় আজ?
বাবা মায়ের হাতে একটি সাদা কগজ তুলে দিয়ে বললেন,- বদলির অর্ডার।
দাঁড়াও, একটু শুনে নিই।
মা বাবার হাত থেকে সাদা কাগজটি নিয়ে রেডিও থেকে ভেসে আসা সংলাপ শুনতে শুনতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, যতবার শুনি ততবারই মনে হয় জীবনকে নতুন করে জানতে পারছি।
কি নাটক গো?
মা হাসতে হাসতে বললেন,- তোমার অভাগীর স্বর্গ।
কাগজটা আমাকে দাও। ভুলে কোথাও রেখে দেবে, শেষে আর খুঁজে পাব না।
বদলি তো হবারই ছিল।
হ্যাঁ, আজ অর্ডার হাতে এল।
কোথায় বদলি হল?
মথুরা। সেন্ট্রাল কম্যান্ড। ইস্টার্ন কম্যান্ড থেকে সোজা সেন্ট্রাল কম্যান্ডে।
সে তো বহুদূরে? দূরদেশে?
উত্তরপ্রদেশে।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মস্থানে, ভালোই হল, জীবনে তো কোনোদিন যাওয়াই হত না। তোমার বদলি হল মথুরায়। তোমারই কাজের সূত্রে মথুরা দর্শন হয়ে যাবে। কবে যেতে হবে?
আগামীকালই হেস্টিংসয়ের অফিসে শেষদিন। বদলির অর্ডার তো হয়ই গেছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মথুরায় কাজে যোগদান করব, দেরি করলে ছুটি নষ্ট হবে। তবে কলকাতা থেকে অনেক দূরে বলে, সাতদিনের জন্য সময় দেওয়া আছে। ট্রেনেই যেতেই চলে যাবে তিনদিন। কয়েকদিনের মধ্যেই সব গুছিয়ে ফেলতে হবে। আগামীকাল অফিসে গেলে, যাওয়ার টিকিট হাতে পাব।
আমি বাবা মায়ের কথা কান পেতে শুনছিলাম। আনন্দ হচ্ছিল। বহু দূর দেশে ট্রেনে যেতে হবে বলে। এমন তো কোনোদিন হয় নি, নিজেই আহ্লাদে গদ গদ হয়ে উঠলাম।
বাবাকে আনন্দে বলে উঠলাম,- ট্রেনের নাম কি বলো না?
উঁহু, এখন বিরক্ত করবে না, আপার ইণ্ডিয়া এক্সপ্রেস। মনে থাকবে তো?
মনে মনে ভাবলাম, এই নাম কি আর মনে থাকে? এত বড় ইংরেজি নাম।
মা বললেন,- পানাগড় থেকে এসে এখনও দম ফেলতে পারি নি। এর মধ্যেই আবার বদলির অর্ডার। ওদের লেখাপড়ার কি যে হবে? বুঝতে পারছি না। মাথায় কিছু আসছে না।
কি করবে? তুমি যে বদলির মানুষের সঙ্গেই সংসার করছ।
ভেবেছ একবার? ওদের লেখাপড়ার কথা? আমরা কেউই হিন্দি বলতে পারি না। আমি বলি বরং তুমি চলে যাও। আমি ওদের নিয়ে এখানে থেকে যাই। আমি এখানে থাকলে ওদের লেখাপড়া নষ্ট হবে না। কি করে যে কি হবে বুঝতেই পারছি না।
আমি চলে গেলে, তোমরা এখানে থাকবে। বাড়ি ভাড়া, আরও কত খরচ। মাইনে মাত্র এই কটা টাকা, আমি ওখানে, তুমি এখানে, তোমার সংসার এখানে। একবার ভেবেছ?
ভালোই বললে, তোমার সংসার। সংসার তাহলে আমার একার তাই না?
তা কেন হবে? দুইজনের।
তারপরে বাবা যেমন মায়ের দিকে তাকিয়ে মাঝে হাসেন।
মা বললেন,- আহা রে, অনুরাগ, দুকূল ছাপিয়ে উঠছে?
বাবা এবার সশব্দে হাসলেন। খুব খুশি থাকলে গাইতেন,-“এই করেছ ভালো নিঠুর হে’’ বা এখন যেমন গুন গুন করে গাইলেন,- “একবার জরা ফির কহ দোঁ মুঝে সরমা কে তুম দিওয়ানা।”
বাবার এই গান আমার জীবনে প্রিয়তম গান হয়ে উঠল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া এই গান কতবার যে শুনেছি। এখনও শুনি।
আমি বাবা ও মায়ের কথা শুনতে শুনতে, কল্পনায় পানাগড়ের কাশবনের এপার ওপার দেখছিলাম। ভাবছিলাম, এমন তো কিছু দূরে নয়, মা একবার বলেছিলেন, এবং বেশ কয়েকবার আমার কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, চলো ট্রেন ধরে একবার ঘুরে আসি পানাগড়ে। মনটা ভীষণ টানছে। এখানে এলেও, মনটা যে ফেলে এসেছি পানাগড়ে। কতবার মাকে বলেছি, চলো না, পানাগড়ে। চলো।
মা বলতেন পৃথিবীতে এমন সুন্দর জায়গা আর নেই রে। কিন্তু তোমার বাবা রাজি হবে না। জানিস তো আমাদের কি একা ছেড়েছে কোথাও?
চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল ধু ধু কাশবন। আর ল্যাংরা খাটাস খোঁড়াতে খোঁড়াতে ভেদ করে যাচ্ছে কাশবনের অন্দরমহল। বিকেলের আলোতে পড়ে থাকা পাকা ধানের মতো সোনালি রোদের মধ্যে ক্যাপ্টেন ব্রজেন মিশ্রা নিজের কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে বাজিয়ে চলেছেন এ্যাকোরডিয়ান। কি মিহি তাঁর শব্দ।
Posted in: February 2021 - Serial, PROSE
সবাইকে ছুঁয়ে দাগলিপি হয়ে থাকলো ।