প্রেম ও অপ্রেমের গল্প : সুদীপ ঘোষাল
প্রেম শব্দটার কোন সীমানা নেই, জাতি নেই ধর্মও নেই। প্রেম নিজেই একটা ধর্ম। প্রেম শুধুই কামজ নয়, শুধু একটা যুবক আর যুবতীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আমি আমার ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেমে আবদ্ধ হতে পারি। কোনো আশা ছাড়াই আমি বাবা, মা কে ঈশ্বরজ্ঞানে প্রেম করতে পারি। আমার পাড়া,প্রতিবেশী বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশে প্রেম বিতরণ করতে পারি। শ্রীচৈতন্যদেব এক অমর প্রেমিক। সকলকে প্রেম বিতরণ করে অমর হয়েছেন। গুরুনানক,কবীর এরা সকলেই প্রেমিক।এবার আসি জন্মদায়িনী জননীর কথায়। বিশ্বের সব মায়ের, ছেলের জন্য অসীম অপেক্ষা চিরকালের প্রথা হয়ে গেছে। রাত্রিবেলা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আমার তারা গুনতে ইচ্ছা হয়। যারা চার দেওয়ালে শ্বেত পাথরের আড়ালে বড় হয় তারা কি এই খোলা আকাশ আর আপন-মনে বেড়ে ওঠা প্রকৃতি বাগান দেখতে পায়। এইসব চিন্তা করতে করতে হাঁটার সময় গতি শ্লথ হয়ে যায়। আর মায়ের চিন্তা বাড়ে।আমি জানি যত রাতই হোক মা ঠিক অপত্য স্নেহ নিয়ে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা চার ভাই দুই বোন। চারা গাছের মত বেড়া দিয়ে যত্ন করে মা আমাদের মানুষ করেছেন।
কোনদিন কোন অভাব তিনি বুঝতে দেননি।
বাবা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন।
সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করে তিনি বেরিয়ে পড়তেন সাদা ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে।
আবার দুপুর সাড়ে বারোটায় খেতে আসেন।
তারপর দুপুর দুটোর সময় অফিস গিয়ে রাত্রি আটটার সময় বাড়ি ফিরতেন।
ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি প্রাণ মন সমর্পণ করে কাজ করতেন। নিজের কাজে বাবা খুব একটিভ ছিলেন। সকালবেলা চোখ মেলেই দেখি মায়ের সুন্দর দেবী প্রতিমার মত মুখ। হাতে চা মুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি মাঝে মাঝে মাঝে মাকে একটা প্রণাম করে নিতাম। জানি সকালবেলা মায়ের মুখ দেখলে সারা দিনটা ভালো যাবে। রক্ত দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করা মা আমাদের জ্যান্ত দেবী।
এবার আসি অপ্রেমের কথায়। এখন ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। যে যার নিজের মতো সংসার নিয়ে ব্যস্ত।মা বৃদ্ধা হয়েছেন।এবার মাকে তো যত্ন করে দেখাশোনা করা চিকিৎসা করানো তার খাওয়া-পরার সমস্ত ব্যবস্থা করা উচিত। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। আমি আমার মায়ের নাম করে পৃথিবীর সব মায়ের 70% মা কিভাবে থাকেন তার কথা বলছি।আর শতকরা তিরিশ ভাগ মা যেসব আছেন তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন।
তারা ভালই থাকেন আশা করি।
আমি কোনো বিতর্কে যেতে চাইছি না আমার দেখা বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে একটা ঘটনা বলছি।
তারা সবাইকে নিয়ে সুখে থাকে। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে তাদের মাকে নিয়ে। ওদের আলাদা সংসারে একটি দুটি করে বাচ্চা স্বামী অফিস চলে গেলে স্ত্রীর আর কোন কাজের চাপ থাকে না। কারণ ছেলেও স্কুল চলে গেছে। নিজে বেশ পেট ভরে ভালোমন্দ খেয়ে ফাঁটিয়ে টিভির সামনে বসে অখন্ড অবকাশ কাটাচ্ছেন। হয়তো মা বললেন, বৌমা এবার আমাকে খেতে দাও বেলা দুটো হলো, যাহোক একটু খাই।
বৌমা বললেন, যান রান্না ঘরে ঢুকে নিজে খেয়ে নিন।
ছোট ছেলের কাছে ছয় মাস। বড় ছেলের কাছে ছয়মাস মা থাকেন।
বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। এখন বিধবা মা। তিনি একাদশী করেন। তাহলে মায়ের খাবার কথা চিন্তা করা কি উচিত নয়?
কিন্তু ছেলেরা বলছে বাজে খরচ করার পয়সা নেই।
একাদশী বা উপবাসের দিন কষ্ট হয় বেশি মায়ের। ছেলেরা ওসব পাত্তা দেয় না। মেয়েরা তবু শ্বশুরবাড়ি সামলে মাকে দেখেন যতটা পারেন।
মা বিছানায় শয্যাশায়ী। পায়খানা, পেচ্ছাপ সবকিছু এখন বিছানায়। ছেলেরা যুক্তি করে মাকে হাসপাতালে ভরতি করে দিল। হাসপাতালে নাতি যায় দেখতে মাঝেমাঝে ঠাকুমাকে। নাতির অন্তর কেঁদে ওঠে। কিন্তু তার হাতে তো পয়সা নেই। ঠাকুমা হাতের সোনার বালা আর গলার চেনটা খুলে নাতির হাতে দিলেন উপহারস্বরূপ। নাতি কলেজে পড়ে। যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। সে সোনার গহনাগুলো বিক্রি করে ঠাকুমাকে দেখাশোনার জন্য আয়া রাখল। ফলমূল এনে ঠাকুমাকে
খাওয়াত। ঠাকুমা প্রাণভরে আশীর্বাদ করতেন নাতিকে। এসব কিন্তু বাড়ির লোকজন জানত না। তারা অপেক্ষায় থাকত কখন বুড়ি মরবে।
মরবে বললেই তো মরা হয় না। সময় তার বিচারক।নাতি বলল,ঠাকুমা এবার আমি তোমাকে ঘরভাড়া করে আলাদা জায়গায় রাখব। তোমার যত্ন করব। সেই রাতেই ঠাকুমা নাতিকে ছেড়ে চলে গেলেন।
ছেলেমেয়েরা এল। দাহকাজ সমাপ্ত হল। নাতি হঠাৎ বলে উঠল আবেগ ভরা কন্ঠে, মা এবার তো ঠাকুমা নেই।এবার তোমার পালা শুরু হল। কি হবে গো, ঠাকুমার চোখের জলের অভিশাপ তোমাদের অপ্রেমের আগুনে দগ্ধ করবে না তো?
Posted in: February 2021 - Cover Story, STORY