ভালবাসার শরীর : শুভ্র চট্টোপাধ্যায়
কাল বাসন্তী পূর্ণিমা। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া ঘরে অনেকক্ষণ ধরে রোবট যৌনসঙ্গীর সাথে রতিক্রিয়া করার পর ইশাইয়া বেশ বিরক্তি সূচক গলায় সঙ্গীকে ধমকের সুরে বলল, “ব্যাপার কী? কয়েক দিন ধরেই দেখছি ঠিক ঠাক করতে পারছ না! ব্যাটারি ঠিকমত চার্জ হচ্ছে তো?”
রোবট একটু থমকে গিয়ে বিনয়ের সুরে বলল, “আপনাকে বেশ কয়েকবার মনে করিয়ে দিয়েছি যে লিঙ্গটা বদলাতে হবে।”
“বদলাতে হবে কেন? চারমাস হলো তোমাকে কিনেছি। কোম্পানি কী লিঙ্গ লাগিয়েছে যে চারমাসও টেঁকে না!”
“আপনার হতাশার জন্য দুঃখিত ম্যাডাম। তবে পাঁচশো ঘন্টার বেশি পরিষেবা কোন লিঙ্গই দিতে পারে না। আপনি প্রায় ছশো ঘন্টার দিকে যাচ্ছেন।”
“চারমাসে ছশো ঘন্টা কি খুব বেশি সেক্স?”
“অমন কোন নিয়ম নেই।একটু ব্যায়বহুল মাত্র।”
ইশাইয়া একটা চাদর টেনে গায়ে জড়িয়ে রোবটের দিকে তাকিয়ে বলল, “আগে যে রোবটটা ব্যবহার করতাম সেটার তো কিছু বদলাতে হত না। দামেও শস্তা ছিল।”
“আমি ম্যাডাম নতুন প্রযুক্তির রোবট। আপনি আগে যেই মডেলটা ব্যবহার করতেন সেটার ব্যাটারি কমে গেলে লিঙ্গ শক্ত হতে সময় নিত। তখন আপনি হয় ব্যাটারি অথবা গোটা রোবটটাকেই বদলে ফেলতেন। এতে খরচ অনেক বেশি হত আপনার।“
“তা হত।”
“এখানে শুধু লিঙ্গটা বদলে দিলেই চলবে।”
“নিজে বদলাতে পারব?”
“খুব সোজা ম্যাডাম। আমার পায়ুর ঠিক ওপরে একটা বোতাম আছে। সেটায় চাপ দিয়ে লিঙ্গ ধরে একটা টান দেবেন। খুলে হাতে চলে আসবে। নতুনটা ফিট করাও সোজা। গর্ত মিলিয়ে বসিয়ে চাপ দিলেই খুট করে সেট হয়ে যাবে।”
“দাম কত?”
“তিরানব্বই টাকা সত্তর পয়সা। ইনবিল্ড স্পিকার থাকলে একুশ টাকা বেশি লাগবে।”
“লিঙ্গে ইনবিল্ড স্পিকার?” ইশাইয়া বেশ মজা পেল। “তা দিয়ে কী হবে?”
“আপনি চাইলে রোবটের কথাবার্তা মুখের বদলে ওখান দিয়ে বের হবে। অনেকে এটা পছন্দ করছে আজকাল।”
“কোনটা?”
“রতিক্রিয়া চলাকালীন মুখের বদলে যৌনাঙ্গ দিয়ে সঙ্গীর শীৎকার নির্গমন।”
ইশাইয়া গম্ভীর হয়ে বলল, “বাজে ভাবনা। এর জন্য একুশ টাকা অতিরিক্ত খরচা করা অর্থহীন।”
কোম্পানিকে ফোন করে ইশাইয়া জানতে পারল যে অর্ডার দেওয়ার আধঘন্টার মধ্যে লিঙ্গ পৌঁছে যাবে। পুরোনটা বদলে নতুনটা লাগান জলের মত সোজা। কোম্পানির রোবট ফোনের ওধার থেকে একটা নতুন প্রডাক্টের কথাও শোনাল। পোস্ট পেইড লিঙ্গ। কত ঘন্টা শক্ত থেকেছে তার বিচারে প্রতি মাসে বিল পাঠাবে। লিঙ্গ মিলবে বিনি পয়সায়।
“বেশি করতে চাইলে পোস্ট পেইড ভাল স্কিম।” সবার শেষে বলেছিল কোম্পানি।
২
চাঁদের আলোয় শান্ত সমুদ্রের ধারে একটা বাড়ির ছাদে নরম আসনে হেলান দিয়ে বসেছিল বার্তাকু। কাছেই তাঁর রোবট যৌন সহচরী অপেক্ষা করছিল নগ্ন শরীরে। ইদানীং সহচরীকে দেখে বিন্দুমাত্র কামভাব জাগছে না বার্তকুর শরীরে। অথচ প্রায় চারশ টাকা দিয়ে আধুনিক মডেলের রোবট সহচরীটা কেনার পর মাস কয়েক বার্তাকু মহাফূর্তি করেছে। উদাসীন ভাবটা জেগেছে মাত্র কয়েক দিন হল।
চাঁদের আলোয় চারিদিক খুব মনোরম। সমুদ্রের শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। এমন পরিবেশে সহচরীর নিখুঁত নগ্ন শরীর এবং ছলকালা উপভোগ্য হওয়ার মতই বিষয়। অথচ বার্তাকুর সে সব ভাবতেই বিরক্তি লাগছে। সহচরীরর উদ্দেশে সে একটু বিদ্রুপের সুরে বলল, “তোমাদের কোম্পানি যে বিজ্ঞাপণে বলে, পুরুষমাত্রই গলে যাবে — আমার কিন্তু সেটা মনে হচ্ছে না।”
“আমি দুঃখিত।” সহচরী বিনম্র গলায় উচ্চারণ করল। “কামভাব সব সময় না-ও থাকতে পারে। আপনি তো আমার থেকে তৃপ্তি লাভ করেছেন। আবারও করবেন।”
“আমার এখন তবে কী করা উচিত?”
“মারধোর করতে পারেন। অত্যাচার করতে পারেন।”
“ওসব আমার দ্বারা হবে না।” বিরক্তির সুরে বলল বার্তাকু। “তোমাকে সুন্দর করে বানিয়েছে। আমি শিল্প ভালবাসি। একটা সুন্দর মূর্তিকে আঘাত করতে পারব না।”
“আমার মডেলটায় মুখ বদলে দেওয়ার সুযোগ আছে। আপনি নতুন কোন মেয়ের মাথা লাগিয়ে দেখতে পারেন। একই মুখ অনেক সময় একঘেয়ে হয়ে যায়।”
“সে তো অনেক খরচ।”
“বেশি না। দেড়শ টাকার মত।”
বার্তাকু কিছু বলল না। দেড়শ টাকা এই মুহূর্তে খরচ করা একটু কঠিন তাঁর পক্ষে। মায়ের হার্ট বদলাতে হবে। ব্যক্তিগত উড়োযানের ইঞ্জিনটাও বদলান দরকার। কাজের জন্য তাঁকে কলম্বো থেকে ইস্তাম্বুল ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করতে হয়। নিজের যানে গেলে সময় বাঁচবে খানিকটা।
তখন ফোনে ইশাইয়ার ডাক পেল বার্তাকু। বিস্মিত হয়ে বলল, “কী ব্যাপার? কিছু করছ মনে হচ্ছে!”
ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল ইশাইয়া তাঁর রোবট সঙ্গীর লিঙ্গ পরিবর্তনের উদ্যোগ নিচ্ছে। বার্তাকু বিরক্ত হয়ে বলল, “এইসব হলো টাকা খসাবার বুদ্ধি। কোম্পানিগুলো খুব পাজি। আমার সহচরী বলছে মুন্ডু বদলাতে। দেড়শ টাকা খরচ! কোন মানে হয়?”
“তুমি এখন কোথায়?”
“কলম্বো।”
“আমি সেন্ট হেলেনা দ্বীপে।”
“সেখানে কী করছ?”
“আগামি বছর রবীন্দ্রনাথের পাঁচশতম জন্মদিন। আমরা কয়েকজন মিলে একটা কমিটি বানিয়েছি। কাল মিটিং।”
“রবীন্দ্রনাথ কে?”
“কবি। বাঙলা ভাষায় লিখতেন। অনেককাল আগে আমাদের এক পূর্বপুরুষ তাঁর গান গাইতেন। রেকর্ডও হত। লোক কিনে কিনে শুনত।”
“বাঃ! শুনিও তো একদিন।”
“চলে এসো।”
“এখন?” বার্তাকু ঘাবড়ে যায়। তাঁদের মধ্যে সাক্ষাতের দিনক্ষণ বছরের গোড়া থেকেই নির্দিষ্ট করা থাকে। এইটাই নিয়ম। আচমকা দেখা-সাক্ষাতের খরচা অনেক। ইশাইয়া কখনো আচমকা দেখা করতে চায় নি।
“কাল পূর্ণিমা। তোমাকে স্পর্শ করতে ইচ্ছে করছে।”
ইশাইয়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করল। বার্তাকু ইচ্ছে করলেই যোগাযোগ আবার স্থাপন করতে পারে। কিন্তু সেটা করল না। আগামিকাল তাঁর জরুরী কাজ আছে। কাজ ফেলে ইশাইয়ার সাথে দেখা করতে যাওয়াটা প্রতিক্রিয়াশীলতার লক্ষণ। পূর্ণিমার সাথে স্পর্শ করার কী সম্পর্ক?
বার্তাকু অনেকক্ষণ ভাবল। যুক্তির বিচারে আগামিকাল তাঁর কাজে যাওয়াটাই উচিত। সহচরী চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে বার্তাকু তাঁকে ব্যাপারটা খুলে বলল অতঃপর। সহচরী বিনম্র কণ্ঠে জানিয়ে দিল, “মানবীসঙ্গী বিষয়টা তাঁর এক্তিয়ারের বাইরে। সে শুধু বলতে পারে যে যুক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত কিন্তু সর্বক্ষেত্রে নয়। কোন ক্ষেত্রে উচিত বা অনুচিত তা নির্ণয়ের অধিকার আমাদের নেই। প্রেমজ আবেগ বিষয়ক এগার নম্বরে সাত উপধারায় —।”
“অসহ্য!” বিরক্তিতে চিৎকার করে উঠল বার্তাকু। সহচরী তৎক্ষণাৎ চলে গেল সাইলেন্ট মোড-এ।
৩
পরদিন সন্ধের একটু আগে থর মরভূমির মাঝখানে রচিত একটি মরূদ্যানে বার্তাকু অবতরণ করল একটা এয়ার ট্যাক্সি চেপে। পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন মাত্র আড়াইশো কোটি। অধিকাংশ স্থানই ফাঁকা। পেল্লায় মরূদ্যানে মেরেকেটে শ দুয়েক লোক ঘোরাঘূরি করছিল। বেশির ভাগই প্রেমিক-প্রেমিকা। আগে থেকে সাক্ষাতের দিন ঠিক করে রাষ্ট্রকে জানিয়ে দিলে প্রেমিক-প্রেমিকারা অতি শস্তায় ভাল ভাল জায়গায় থাকতে পারে। বার্তাকু অবশ্য আচমকাই চলে এসেছে ইশাইয়ার সাথে দেখা করার জন্য। তাঁদের সাক্ষাতের আগাম তথ্য রাষ্ট্রের কাছে না থাকায় সাক্ষাৎ বেশ ব্যায়বহুল হবে সন্দেহ নেই।
এমন অবস্থায় অবশ্য প্রেমিক-প্রেমিকারা রাষ্ট্র থেকে ধার নিতে পারে। বার্তাকু তিনশ টাকা ধার নিয়েছে। এর অর্ধেকটাই চলে যাবে যাতায়াতে।
ইশাইয়া অপেক্ষা করছিল। তাঁর পরণে কচুপাতার পোশাক। গাছপাতার পোশাকই ইদানীং চলছে। শীতপ্রধান এলাকায় যেমন চলছে স্বচ্ছ জ্যাকেট আর সোয়েটার। দু-জনের দেখা হলে একবার প্রগাঢ চুম্বন হল। মরূদ্যান জুড়ে ঝুলে থাকা বড় বড় পর্দায় চুম্বনের দৃশ্য ফুটে উঠল একটু পর। তার পরেই ফুটে উঠল বিশ্বভাষায় লেখা একটি বাক্য। “অভিনন্দন! আপনাদের চুম্বন একশতে আটানব্বই পেয়েছে। মরূদ্যানে এর বেশি চুম্বনাংক-এর রেকর্ড নেই। আপনারা আমাদের পক্ষ থেকে ছশো টাকা পুরস্কার পেয়েছেন।”
অভাবনীয় ঘটনা! দু-জনে উল্লসিত হয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আরো কয়েকবার চুমু খেল। সুপুরি গাছের ছাল দিয়ে তৈরি বস্ত্র গায়ে পেঁচিয়ে একজন এসে তাঁদের বলল, “অনেক দিন এমন ব্যাপার এত জীবন্ত দেখি নি। অনুমতি দিলে আপনাদের ফোটো আমাদের পত্রিকায় প্রকাশ করতে পারি। এর জন্য আমরা তিনশ টাকা দিতে পারব।”
ইশাইয়া অবাক হয়ে বলল, “ভাবো! আমাদের চুমুর দাম প্রায় হাজার টাকা!”
এরপর একটা ভাসমান বাড়ি ভাড়া করতে ওদের কোন সমস্যাই হল না। বাড়ির মালিক একজন শক্তসমর্থ বৃদ্ধা। অচিরেই একশ বছরে পা দেবেন। তখন একটি সন্তানের মা হওয়ার ইচ্ছায় টাকা জমাচ্ছেন। ভাড়ার টাকা বুঝে নিয়ে হেসে বললেন, “তোমাদের চুমুর ছবি দেখলাম। এত আবেগ অনেকদিন দেখি নি।”
ইশাইয়া মুচকি হেসে জবাব দিল, “হঠাৎ দেখা তো, তাই।”
বাড়িটা চমৎকার। দুশো ফুট ওপরে ভেসে আছে। পূর্ণিমার চাঁদ আলোর বন্যা ঢেলে দিয়েছে চারদিকে। মরূদ্যানের চারপাশে বিস্তৃত মরুভূমি রূপোর মত চকচক করছিল। ইশাইয়া আর বার্তাকু পরস্পরকে জড়িয়ে বসেছিল জানালার পাশে। কোন কথা বলছিল না ওরা। তীব্র জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে থেকে হারিয়ে গিয়েছিল নিজেদের মধ্যে।
একটা সময় বার্তাকু জিগ্যেস করল, “নতুন লিঙ্গ কাজ করছে?”
“করছে — ।”
“কিছু বলতে চাইছ?”
“আসলে কী জান, রোবটের মধ্যে তাপ আছে কিন্তু ওম নেই।”
“কী নেই?”
“ওম। এটা বাঙলা শব্দ। আমার মাতৃভাষা বাংলা।”
“সেটা তো জানি। ওম মানে কী?”
“এখন যেই তাপটা পাচ্ছ সেটা সহচরীর মধ্যে পেতে?”
বার্তাকু জবাবে কিছু বলতে গিয়ে থমকে যায়। সে হঠাৎ খুব জোরে আঁকড়ে ধরে ইশাইয়াকে। বুঝতে চেষ্টা করে তাঁর নিরাবরণ শরীর থেকে বিচ্ছুরিত কোন তাপীয় আভাকে। তাঁর আলিঙ্গনে নিষ্পেষিত ইশাইয়া তখন গুণ গুণ করে গাইছে, “জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে।”
বার্তাকু বুঝতে পারল আজ তাঁর সব কিছু অন্যরকম লাগছে। অপরিকল্পিত সাক্ষাতের কারণেই এমনটা হচ্ছে আজ। রোবট একটা পরিকল্পিত ব্যাপার। প্রেমের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা সব সময় কাজ করে না। শেষবার তাঁরা সাক্ষাৎ করেছিল এস্কিমোদের দেশে। সাত দিন কী করবে তা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল।
কিন্তু আজকের মত রোমাঞ্চকর কিছু ঘটে নি।
বার্তাকুর শরীরে কোন যৌন উত্তেজনা নেই। প্রিয়তমার কবোষ্ণ নগ্নতাকে আলিঙ্গনে বেঁধে রাখলেও একটি উদোম শিশুর মত শান্ত ছিল সে। ইশাইয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে জিগ্যেস করল, “চারমাসে ছশো ঘন্টা করেছ! আমার সাধ্য ছিল না!”
ইশাইয়া যেন খুব লজ্জা পেল। বলল, “ধেৎ!”
Posted in: February 2021 - Cover Story, STORY