রবীন্দ্রনৃত্য ভাবনাঃ প্রেক্ষিত ও চলন – সোমা দত্ত

পঞ্চম পর্ব

বাল্যবিধবা ও নারীশিক্ষাঃ

১৮৫৬ সালে জুলাই মাসে বিধবা বিবাহ আইন পাশ হওয়ার পিছনে ছিল বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আগে থেকে চলে আসা বেশকিছু মানুষের দীর্ঘ লড়াই।বিদ্যাসাগর মহাশয় বই লিখছেন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করছেন, সভা সমিতিতে বক্তব্য রাখছেন, বিধবা বিবাহের স্বপক্ষে জনমত গঠন করছেন, শাস্ত্রের পূর্বউল্লিখিত যুক্তিকে সামনে আনছেন তীব্র তেজে- আগের মানুষদের থেকেও বেশী খাটছেন।বেশী আক্রমণের শিকার হচ্ছেন।সরকারের সংগে তাঁর বেশী ভালো সম্পর্কও।
ব্রাহ্মসমাজের প্রথম আচার্য রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশ বিদ্যাসাগরের যুক্তি সমর্থন করেন। ১৮৫৪ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে ‘সমাজোন্নতি বিধায়িনী সুহৃদ সমিতি’র সভায় হিন্দু বিধবার পুনর্বিবাহ, বহুবিবাহ রোধ বাল্যবিবাহ বর্জন নিয়ে কিশোরীচাঁদ মিত্রের প্রস্তাব আর অক্ষয় মিত্রের সমর্থনের বিস্তারিত প্রতিলিপি ব্রিটিশ লিগাল সেলে পাঠানো হয়েছিল।
এখন প্রশ্ন হল দেবেন্দ্রনাথ নিজ জীবনে এই একটি বিষয়ও পালন করেছেন কিনা। ঠাকুর পরিবারে প্রথম বিধবা বিবাহ রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথের সাথে প্রতিমা দেবীর,দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর।দেবেন্দ্রনাথের পাঁচ কন্যার মধ্যে একমাত্র সৌদামিনী বেথুন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন বলে জানা যায় কিন্তু বিবাহ বাল্য বয়সেই হয়।পুত্রদের প্রত্যেকের বিবাহ দিয়ে বালিকা বধূই নিয়ে আসেন ঠাকুরবাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সকলেই বালিকা বয়সি কন্যা বিবাহ করেন এবং কেউ বিধবা বিবাহ করেননি।রবীন্দ্রনাথের মেয়েদেরও বালিকা বয়সেই বিবাহ হয়।মাধুরীলতা ও মীরা দেবীর ১৫ বছর বয়সে,রেণুকার ১১ বছর বয়সে বিবাহ দেন তিনি। শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয় খুলতে রবীন্দ্রনাথ ভয় পেয়েছিলেন তিনি নিজেই লিখছেন চিঠিতে।
১৮২১ সালে ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতে নারীশিক্ষা প্রসারের উদ্যোগ নেওয়া হয়।কিছু সরকারী কিছুটা চার্চ মিশন সোসাইটির সহায়তায় বাংলায়ও নারীশিক্ষার শুরু হয়। পরে লেডি Armharst এর উদ্যোগে ‘বেঙ্গল লেডিস সোসাইটি’ গঠিত হয় ও উনিশটি স্কুলে প্রায় ৪৫০ জন বালিকা ভর্তি হয়।বেথুন স্কুল স্থাপন হয় ১৮৭৯ সালে। বেথুন স্কুল সোসাইটির প্রথম কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৮৫১ সালে সৌদামিনীকে তিনি বেথুন স্কুলে ভর্তি করেন কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই তার বিবাহ দিয়ে দেন।নিজের মেয়েদের মধ্যে সচেতনভাবে শিক্ষার প্রসার করলেন না,নাতনীদের মধ্যেও সে রকম আগ্রহ ছিলনা।একমাত্র ব্যতিক্রম সত্যেন্দ্রনাথ,যিনি নিজের মতকে প্রাধান্য দিয়ে ইন্দিরাকে সাহেবী স্কুলে পড়িয়েছেন ফরাসী ভাষা শিখিয়েছেন।কিন্তু বাড়ির আর কোনো মেয়েদের পড়াশোনা নিয়ে বড়দের তেমন কোনো আগ্রহ জানা যাচ্ছেনা।
রবীন্দ্রনাথও রথীন্দ্রনাথকে বিলাত পাঠাচ্ছেন পড়াশোনার জন্য আর মেয়েদের বিবাহ দিয়ে জামাইকে বিলাত পাঠাচ্ছেন।দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তিনি শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয়কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন কিন্তু চালিয়ে নিয়ে যেতে পারছেন না।যে দু’বছর শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয় ছিল তা ছিল কঠোর নিয়মের ঘেরাটোপে।মেয়েরা থাকত দেহলী বাড়িতে,বাইরে তাদের স্বাভাবিক যাতায়াতে বাধা ছিল।পৌষমেলা প্রাঙ্গণে তারা যেতে পারতেননা।এইসময় মেয়েদের নিয়ে ‘লক্ষীর পরীক্ষা’ নামক একটি নাটকের অভিনয় হয়েছিল যার দর্শকও ছিল কেবলমাত্র মেয়েরা।কোনো পুরুষ অধ্যাপক ও ছাত্রদের সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।

প্রথম পর্যায়ের ব্রহ্মচর্যাশ্রমঃ

শান্তিনিকেতনে প্রথম পর্যায়ের ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপনে রবীন্দ্রনাথ, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সাহায্য পেয়েছিলেন।সেই সময় ব্রহ্মবান্ধব কলকাতাতেই নিজের ছেলে ও আরো পাঁচজন ছাত্র নিয়ে একটি বিদ্যালয় পরিচালনা করছিলেন।প্রাচীন বৈদিক আদর্শে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের পরিকল্পনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও।ব্রহ্মবান্ধব বরাবর শান্তিনিকেতনে থাকেননি কখনো, কিন্তু তার পরিকল্পনা রূপায়নের জন্য সেখানে ছিলেন তার সহকর্মী রেবাচাঁদ।শান্তিনিকেতনে মূলত ব্রাহ্ম ও উচ্চবর্ণ হিন্দু পরিবার থেকেই ছাত্ররা এসেছিলেন।রেবাচাঁদ সেখানে ব্রাহ্মন ক্ষত্রিয় বৈশ্য বিভাজন স্পষ্ট করেছিলেন পোশাকের রঙেও। ব্রাহ্মণের ছেলে সাদা,কায়স্থ ও বৈদ্য ছেলেদের লাল, ও বৈশ্য ছেলেদের হলুদ পোষাক নির্দিষ্ট হয়েছিল এবং তারা পৃথক গাছের তলায় বসবেন প্রার্থনা করতে এই নির্দেশ ছিল।বলার বিষয় এই যে রবীন্দ্রনাথ এই ব্যবস্থা চলতে দেননি।এই বিভাজন এবং ব্রহ্মবান্ধবের কট্টর হিন্দুত্ববাদী বর্ণাশ্রমিক ভাবনা তাঁকে বিব্রত করেছিল। ফলে অল্প সময়েই ব্রহ্মবান্ধবের সংগে তাঁর বিচ্ছেদ ঘটে এবং রেবাচাঁদ বিদায় নেন শান্তিনিকেতন থেকে।তাছাড়া আদর্শগতভাবে জাতিভেদ ছিলনা।যদিও ফলিত ক্ষেত্রে সেখানেও একদা একপ্রকারের জাতিভেদ কাজ করেছিল, সে অন্য কথা।
শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয় চলে মূলত ঠাকুরবাড়ির জমিদারী কালীগ্রামের আয় থেকে।দ্বারকানাথ এই জমিদারী কিনেছিলেন ১৮৩০ সালে।পরবর্তীতে দেবেন্দ্রনাথ মালিক এই জমিদারীর।ব্রাহ্মসমাজের মাথা দেবেন্দ্রনাথের সম্পত্তিতে এমন বিভাজন সম্মিলিত ব্যবস্থা সম্ভব ছিলনা। আশ্রম ও বিদ্যালয় সংক্রান্ত প্রথম কার্যপ্রণালীতে যে নিয়মাবলী রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে লিখে পাঠাচ্ছেন সেখানে কিন্তু হিন্দু আচার নিয়মের কথা আছে, ব্রাহ্মণ দ্বারা খাদ্য পরিবেশনের কথা আছে, নিঃশর্ত গুরুভক্তির কথা আছে,গুরুর প্রতি সেবা ধর্মের কথা আছে।তখনো পর্যন্ত তিনিও ব্রাহ্ম হয়েও আরো অনেকের মত বর্ণবাদের সমর্থক।
সত্যেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এর আগেই ঠাকুরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলেন পিতার সাথে বিরোধের কারণে।রবীন্দ্রনাথের বিবাহের পর দেবেন্দ্রনাথ নানান কাজকর্মে জড়িয়ে খানিক তাঁকে সংসারে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিলেন।এই সময়েই আদি ব্রাহ্ম সমাজের সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে, তা তিনি পালন করেন বেশিটাই কর্তব্য পালনের অভিপ্রায়ে।দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর আদি ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারের চেষ্টাও করেন তিনি,কিন্তু তাঁর কর্মজীবনের মধ্যেই আদি ব্রাহ্ম সমাজের কাজ বন্ধ হয়ে যায়।পিতার সাথে সরাসরি বিরোধে যাননি,আদেশ পালন করেছেন,জমিদারী দেখভাল করেছেন।জমিদারীর আয়ে শান্তিনিকেতন গড়ে তুলেছেন সংসার প্রতিপালন করেছেন, বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের জন্য ত্রিপুরার মহারাজা বার্ষিক হাজার মুদ্রা বরাদ্দ করেছিলেন।মোহিতচন্দ্র সেন এককালীন অর্থদান করেছিলেন।ব্রিটিশ সরকারের শিক্ষাব্যবস্থা ব্যতিরেকে জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতি কি হতে পারে, কেমন হতে পারে তার রূপ তা নিয়ে যেমন একটা মতামত গড়ে উঠছিল এবং তার বাস্তব প্রয়োজনীয়তাও ছিল। তেমনি আবার হিন্দু জাতীয়তাবাদের ধারণাও গড়ে উঠছিল।সে কারণেই হয়ত ব্রহ্মবান্ধবের মত মানুষদেরও বিদ্যালয় স্থাপন করতে হয় কিন্তু মনোনিবেশ করে দীর্ঘদিন চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
আবার যে সমস্ত বিদ্যালয় থেকে ছাত্র শিক্ষকেরা বিপুল পরিমাণে স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছিলেন তারা ব্রিটিশ সরকারের কোপে পড়ে গ্রেপ্তার হচ্ছিলেন।কলেজ ও বিদ্যালয়গুলিকে হয় সরকারী আদেশ মানতে বাধ্য হতে হচ্ছিল নচেৎ তা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল।যেমনটা ঘটেছিল সেনহাটি জাতীয় বিদ্যালয়ের শিক্ষক হীরালাল সেনের ক্ষেত্রে।রবীন্দ্রনাথকে তিনি উৎসর্গ করেছিলেন তার কবিতার বই হুঙ্কার, রবীন্দ্রনাথকে সে মামলায় সাক্ষী হিসেবে হাজির হতে হয় এবং হীরালালের ছয়মাস জেল হয়। জেল থেকে বেরিয়ে এলে তার চাকরী যায় এবং রবীন্দ্রনাথ প্রথমে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন হীরালালকে।হীরালাল সেনকে শান্তিনিকেতনে রাখার প্রবল ইচ্ছে থাকলেও ব্রিটিশের সাথে দ্বন্দ্বে পেরে উঠলেননা তিনি।
১৯১২ সালে পূর্ববঙ্গ-আসাম গবর্মেন্ট গোপন ইস্তাহার প্রচার করে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে।যার মূল কথা হল শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় তাদের ছেলেদের পড়বার উপযুক্ত স্থান নয়। যা একপ্রকার সরকারি হুমকি যাতে দলে দলে ছেলে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে যেতে থাকে।বিদ্যালয় বাঁচাতে তিনি হীরালাল সেনকে শান্তিনিকেতন থেকে সরিয়ে দেন, কালীগ্রামে তাঁর জমিদারীতেই কাজের ব্যবস্থা করেন।

ভারতবর্ষের ধর্মঃ

১৯০৮ সালে ক্ষিতিমোহন সেন ও বিধুশেখর শাস্ত্রী যোগদান করলেন শান্তিনিকেতনে।ক্ষিতিমোহন যেমন সংস্কৃত ভাষার পন্ডিত তেমনি আবার তথাকথিত মধ্যযুগের সন্তধর্মের কবিদের গানের সংগ্রাহকও।তার সংগ্রহ থেকে রবীন্দ্রনাথ আরো বেশি জানতে পারেন এইসব সন্তদের কথা।‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন,”ভারতীয় মধ্যযুগের কবিস্মৃতিভান্ডার সুহৃদ ক্ষিতিমোহনের কাছ থেকে কবি রজ্জবের একটি বাণী পেয়েছি। তিনি বলেছেন-
সব সাঁচ মিলৈ সো সাঁচ হৈ, না মিলে সো ঝুঁট।
জন রজ্জব সাঁচী কহী ভাবই রিঝি ভাবই রূঠ।।
সব সত্যের সংগে যা মেলে তাই সত্য, যা মিলল না তা মিথ্যে; রজ্জব বলছে, এই কথাটি খাঁটি – এতে তুমি খুশিই হো আর রাগই কর।“
যে মত বা প্রথার বাস্তব সত্যের সাথে মিল থেকে না তাকে গলার জোরে ও গায়ের জোরে, উত্তেজনা উগ্রতা মিশিয়ে প্রমাণ করতে হয়।রবীন্দ্রনাথের ভাবনার জগতেরও বিবর্তন হচ্ছে,বর্ণবাদকে পিছনে ফেলে এগিয়ে চলেছেন বিশ্বমানবতার দিকে।ক্ষিতিমোহনের বাউল গানের সংগ্রহ থেকে তিনি তুলে নিচ্ছেন কয়েকটি লাইন ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধতে।
জীবে জীবে চাইয়া দেখি
সবই যে তার অবতার-
ও তুই নতুন লীলা কী দেখাবি,
যার নিত্যলীলা চমৎকার।
তৎকালীন দেশের বাস্তব সত্যের সাথে মিলছে না বর্ণবাদ, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ,মিলছে না পিকেটিং ও বিদেশি দ্রব্য পোড়ানোর আন্দোলন।রবীন্দ্রনাথ দেখতে পাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে গরীব মানুষের খাওয়া নেই, নেই বেশি দাম দিয়ে দেশি ছাপ মারা কাপড় কেনার ক্ষমতা।দেখছেন পিকেটিংয়ের নামে গরীব মুসলমানের কাপড়ের গাঁঠরি পুড়ে যাচ্ছে যা দিয়ে সে তার পরিবার প্রতিপালন করে। রবীন্দ্রনাথ প্রতিবাদ করছেন তার লেখায়।‘গোরা’ও ‘ঘরে বাইরে’ এমনি দু’টি উপন্যাস।গোরা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় প্রবাসী পত্রিকায়।পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯১০ সালে।ঘরে বাইরের প্রকাশকাল ১৯১৬।
উপন্যাসের চরিত্র গোরা,যে প্রথমে ব্রাহ্ম হলেও ধীরে উগ্রহিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদকে আশ্রয় করে প্রবল নিয়মনীতি আচার আচরণে নিষ্ঠ হয়ে ওঠে শুধু নয়, হিন্দুয়ানির প্রচারে দল গঠন করে ফেলে।পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখে তর্ক করে,হিন্দুয়ানির প্রচারে যা করনীয় সবকিছু করতে থাকে।এই পর্যন্ত গোরা চরিত্রে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের ছায়া দেখতে পাই।প্রথম জীবনে খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহন করে সেই ধর্মপ্রচারে ব্যস্ত উপাধ্যায় পরবর্তীতে উগ্র হিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের পথ ধরেন।ব্রহ্মবান্ধবের জীবন এখানেই শেষ কিন্তু রবীন্দ্রনাথের চরিত্র এবার বেরয় গ্রামভ্রমনে।দেখতে বুঝতে জানতে চায় আসল ভারতবর্ষকে।যেখানে বাস্তব সত্যের সাথে তার আচার বিচার বর্ণবাদ, জাতিভেদ এসবের দ্বন্দ্ব বাধে।বুঝতে পারে এইসবই বাস্তবে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়,যা এই দেশকে শতধাবিভক্ত করে ফেলছে ভিতরে ভিতরে।ধর্ম যদি মানুষকে ধারণ করতে না পারে তবে তা কিসের ধর্ম।মানুষে মানুষে ভেদ সৃষ্টি করে যা তা ভারতবর্ষের ধর্ম হতে পারেনা।তাই সব শেষে পরেশবাবুর কাছে আসে গোরা সেই দেবতার মন্ত্র চাইতে,”যিনি হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান ব্রাহ্ম সকলেরই-যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে, কোনোদিন অবরুদ্ধ হয়না-যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।“
রবীন্দ্রনাথ নিজেও যে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলেছেন,হিন্দু ও ব্রাহ্মধর্মের উরদ্ধে মানুষের ধর্মে পৌঁছবেন শেষত।

বিশ্বভারতীঃ

বিধুশেখর শাস্ত্রী মহাশয় যোগদান করেছিলেন শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে।তাঁর বিশেষভাবে মনে হয়েছিল যে আমাদের দেশে বহুযুগ ধরে যে নিজস্ব শিক্ষা পদ্ধতি আছে যেমন টোল, চতুষ্পাঠী এগুলির সম্প্রসারণ দরকার।শুধুমাত্র সংস্কৃত শিক্ষা দিয়ে নয় এইগুলির মধ্য দিয়েই নতুন যুগের জ্ঞানের ধারা চালিয়ে দিতে হবে।এই ইচ্ছায় তিনি একবার শান্তিনিকেতন ছেড়ে নিজের গ্রামে ফিরে যান কিন্তু নানাবাধায় টোল স্থাপন করতে পারেননি।রবীন্দ্রনাথ তখন তাকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে আপনার ইচ্ছা শান্তিনিকেতনেই রূপ পাবে।
এরপরের ঘটনা প্রবাহ খানিক এইরকম.১৯১৬ সাল রবীন্দ্রনাথ জাপান হয়ে আমেরিকা যাত্রা করেন।জাপানেও অনেকগুলি বক্তৃতা দেন এবং সেখানে তিনি জাপানের রাজনীতি নিয়েই তাদের সমালোচনা করেন।চীনযুদ্ধে জয়লাভ করে জাপান যে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে এবং যুদ্ধজয়ের চিহ্ণগুলিকে যেভাবে রক্ষিত করেছে, কবির কাছে তা বর্বরতা অসুন্দর ঠেকেছে।এরপর আমেরিকা, সেখানে তিনি রীতিমত পেশাদার কোম্পানীর ভাড়া করা বক্তৃতা দেবার লোক।সে যেখানে যেখানে বক্তৃতার ব্যবস্থা করবেন কবিকে সেখানেই যেতে হবে এবং এর জন্য তিনি নির্দিষ্ট অংকের ডলারও পাবেন।চুক্তিমত তিনি আমেরিকার বিভিন্ন শহর ঘুরে প্রচুর বক্তৃতা দিলেন।এক একটি সভায় মানুষ হলে ঢুকতে না পেয়ে ফিরে গেলেন,প্রচুর মানুষকে যেমন পাশে পেলেন তেমনি প্রচুর সমালোচিতও হলেন।যে বক্তৃতা তিনি গোটা আমেরিকা জুড়ে দিলেন তাকে এককথায় জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে অভিযান বললে মোটেও অত্যুক্তি হবেনা।পরবর্তীতে এই বক্তৃতা “ন্যাশনালিজম” নামে প্রবন্ধাকারে প্রকাশিত হয়।
আমেরিকায় থাকাকালীনই তিনি নানা চিঠিপত্রে লিখছেন তাঁর ভাবনার কথা।“স্বজাতিক সংকীর্ণতার যুগ শেষ হয়ে আসচে,ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে।“ বিশ্বজাতিক মহামিলন, সে কি নিজে নিজেই ঘটে উঠে নাকি ঘটাতে হয়? আমার মতে অবশ্যই ঘটাতে হয় এবং তিনি তা ঘটিয়ে ফেলতে চাইছেন।বক্তৃতায় যেমন দেখাচ্ছেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কিভাবে দানা পাকিয়ে ন্যাশনালিশম গড়ে উঠছে ,তার বর্বরতা নৃশংস চেহারা দেখিয়ে দিচ্ছেন তেমনি তার বিপরীতে বিশ্বমানবতার কথা বলছেন।“পৃথিবী থেকে স্বাদেশিক অভিমানের নাগপাশ ছিন্ন” করাকেই নিজের শেষ জীবনের কাজ বলে মনে করছেন।
“আমাদের দেশে বিদ্যা সমবায়ের একটি বড় ক্ষেত্র চাই, যেখানে বিদ্যার আদান প্রদান ও তুলনা হইবে, যেখানে ভারতীয় বিদ্যাকে মানবের সকল বিদ্যার ক্রমবিকাশের মধ্যে রাখিয়া বিচার করিতে হইবেই।“ শান্তিনিকেতনকে প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার বাইরে ভারতীয় শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সংকল্পের কথা জানাচ্ছেন এন্ড্রুজ ও রথীন্দ্রনাথকে (১৯১৮ সাল)। বিশ্বভারতীর অধ্যাপনার কাজ শুরু হয় ১৯১৯ জুলাই মাসে।বিষয় ও অধ্যাপনার দায়িত্ব বন্টন হয় খানিক এইভাবেঃ

সাহিত্যঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সাহিত্য সমালোচনাঃ এন্ড্রুজ
হিন্দুদর্শনঃ বিধুশেখর ভট্টাচার্য
বৌদ্ধ দর্শনঃ রাজগুরু মহাস্থবির (বৌদ্ধভিক্ষু)
জীবতত্ত্বঃ রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পাণিণির ব্যাকরণঃ মৈথিলী পণ্ডিত কপিলেশ্বর মিশ্র

ধীরে ধীরে সংগীত চিত্রকলা নৃত্য সমস্ত বিদ্যা যুক্ত হবে বিশ্বভারতীর পাঠক্রমে।চিত্র বিভাগের(কলাভবন) দায়িত্ব নেবেন সুরেন কর, আসিত কুমার হালদার,নন্দলাল বসু প্রমুখ।বিশ্বভারতীতে ভারতীয় রাগ সংগীত(সংগীত ভবন) শেখাতে এসেছিলেন দুইজন মুসলমান ওস্তাদ কিন্তু তারা বেশিদিন থাকেননি।পরে মহারাষ্ট্র থেকে আসেন ভীমরাও হসুরকর।বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার বেশ কিছু বছর আগে আগরতলার ডাক্তার রবীন্দ্র কাজির পুত্র শান্তিনিকেতন আশ্রমে আসার কথা হয়েছিল কিন্তু তার থাকা খাওয়া ইত্যাদি নিয়ে তৎকালীন অধ্যাপকবৃন্দের আপত্তি থাকায় তা ঘটে ওঠেনি।এবারে মুসলমান শিক্ষক এলেন কিন্তু বেশীদিন থাকলেন না।
বিশ্বভারতীর বিভিন্ন পর্বে এমন নানা রক্ষণশীলতার বাধা আমরা দেখব এর পরবর্তী পর্যায়েও।রবীন্দ্রনাথ বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা,হিন্দু জাতীয়তাবাদ, প্রাদেশিকতা থেকে যেভাবে সরে এসেছেন, নিজেকে প্রস্তুত করেছেন,প্রস্তুত করতে চেষ্টা করেছেন তা সবাই করে উঠতে পারেনি।তাই বিরোধিতা করেছেন।বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠার সাথে দ্বিতীয়বার মেয়েদের প্রবেশ ঘটবে শান্তিনিকেতনে।এবার ব্যবস্থার বেশকিছু পরিবর্তন ঘটবে।একই ঘরে ছেলে মেয়ে সকলে পৃথক দলে সমবেত হবে অধ্যাপকদের ক্লাস করার জন্য।মজা হচ্ছে সব অধ্যাপকরাও কিন্তু এরকম ব্যবস্থার জন্য তৈরি নন।জানা যায়,মহাস্থবির বৌদ্ধ দর্শন পড়াবার সময় মেয়েদের দিকে পাখার আড়াল করে বসতেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৃত অর্থে বিদ্যার উদ্ভাবন কেন্দ্র, বিদ্যাদান এর গৌণ কাজ।এদিক থেকে যে যে বিষয়গুলিতে ‘বিশ্বভারতী’ তার নিজস্ব উদ্ভাবনীশক্তির গৌরব অর্জন করেছে তা মূলত কলাবিদ্যার শাখাগুলিতে, সংগীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নৃত্য। ১৯২৩-২৪ সাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরি,ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা অমিতা ও কবি দৌহিত্রী নন্দিতা, সকলকে নিয়ে নৃত্যশিক্ষা ও চর্চার স্থায়ী ব্যবস্থা শুরু করলেন।১৯২৩ -২৪ সালে “কালের মন্দিরা যে” গানটি রচনা করে তার সাথে নৃত্যছন্দ রচনা করেন।এর আগেই তিনি পশ্চিম ভারত ভ্রমণ করেন, সেখানে কবি ভজনের সাথে খঞ্জনি বাজাবার সময় যে নৃত্যছন্দ জাগে তা প্রত্যক্ষ করেন।নিজের রচিত গানে এবার এই ছন্দ ও ভঙ্গিমা জাগিয়ে তুললেন তিনি।

ক্রমশঃ

Facebook Comments

Leave a Reply