মুরাকামির একটি গল্প: প্রান্তিকতা ও উধাও হাতির বাস্তবতা – শতানীক রায়

“Is the world such a pragmatic place?”

একটি হাতি হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গেল। সঙ্গে হাতিটিকে যে রক্ষণাবেক্ষণ করত সে-ও উধাও। প্রসঙ্গটা উধাও। ভ্যানিস। পৃথিবীর বুক থেকে দুটো জীবন্ত অস্তিত্ব উধাও। তারা কোথায় গেল তার কোনো প্রমাণ নেই। আমি শুধু হাতির আকার নিয়ে ভাবছি। আর মানুষটার আকার। এই জটিল পৃথিবীর বুক থেকে হাতিটা উধাও হয়ে গেল। অত বড়ো… কী করে কেউই দেখতে পেল না হাতিটাকে! এরকমভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে আজ সকালেই অদ্ভুত ধূ ধূ শূন্য প্রান্তরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়টির দৃশ্য। যেখানে আমার মনে হয়েছে হাতিকে সরু নলের ভেতর প্রবেশ করিয়ে ইঁদুর বানানো সম্ভব। এই সম্ভাবনা নিয়েই আমার কতরকম ভাবনাচিন্তা। হাতিটা গতকালই ছিল কিন্তু আজ আর নেই। এই শূন্যতা থেকেই আমাদের বেঁচে থাকা শুরু আর সে-বেঁচে থাকা ক্রমাগত স্রোতের মতো নানারকমভাবে সত্য হয় আবার মিথ্যাও হয়। হাতি উধাও হয়। হাতিকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এত বড়ো জীবন আমাদের— তা এগোতে থাকে। অতিবাহিত হয় আর সবকিছু মিলিয়ে কী যে ঘটে তার হদিশও পাওয়া যায় না শেষ পর্যন্ত।

হাতি উধাও হওয়ার গল্পটা হারুকি মুরাকামির। ‘দ্য এলিফ্যান্ট ভ্যানিসেস’ গল্পের হাতিটা উধাও হওয়ার পরে আর কোনোদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কেন যায়নি। হাতিটার কী হল? এ-সব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। একটা টানটান অথচ এবড়ো-খেবড়ো কিছু মাথায় ভিড় করে আসছে। কত মানুষ নিত্যদিন হারিয়ে যায় উধাও হয়ে যায় শূন্যে। আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না শেষ পর্যন্ত। তারা অনেক ক্ষুদ্র। সাধারণ। তাদের নিয়ে কোনো বিশেষ খবর বেরোয় না। তাদের নিয়ে রাজনীতি হয় না। তাদের নিয়ে মিথ তৈরি হয় না। তারা কেবল অদৃশ্য হয়ে যায় পৃথিবী থেকে। ২০০১ সালে আমার দাদু উধাও হয়ে যায়। আর ফিরে আসেনি। কখনো ফিরে আসলেও তাদের আকৃতি একরকম থাকে না। বদলে যায়— এ-সব ভেবেই কি মুরাকামি গল্পটা লিখে ফেলেছিলেন? আপাত সোজাসাপটা গল্প। শুধুই গল্প বলে গেলেন গল্পে। আর সেখান থেকে আজ এই মুহূর্তে আমি আরও গল্প ফাঁদতে পারছি। মনে রাখতে হবে: হাতিটা উধাও। নেই।

আমি বুঝতে পারছি এটা হারিয়ে যাওয়া নয়। ভ্যানিস হওয়ার গল্প। বেশ বৃদ্ধ একটা হাতি উধাও হয়েছে। এর ফলে পুরো শহরে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। এমনিতেও হাতিটাকে নিয়ে টানাটানি চলছিল অনেকদিন। হাতিটাকে নিয়ে মাথা ঘামানোর অঢেল সময় সে-শহরের আছে। প্রশাসনের সময় আছে। সংবাদমাধ্যমের সময় আছে। হাতিটা যে নেই সেটা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। গল্পের কথন লেখক নিজেই। তিনি একজন চরিত্রও এই গল্পের। তিনি নিজেও হাতি উধাও হওয়ার রহস্য নিয়ে ক্রমাগত তথ্য সংগ্রহ করে চলেছেন। আর মনে রাখবেন এখনও হাতিটার দেখা পাওয়া যায়নি। মানুষটারও কোনো খোঁজখবর নেই। যদিও তাকে নিয়ে বিশেষ ভাবা হয়নি গল্পে। গল্প এগিয়েছে। মানুষটা আরও উধাও হয়েছে। কিন্তু হাতিটা ক্রমাগত রক্তমাংস আর চামড়া পেয়েছে। হাতিটা প্রাঞ্জল হয়েছে। সংবাদপত্রের পাতা ক্রমাগত হাতিকে জীবিত করে তুলেছে। সে আছে।

মাঝে একবার গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হল এটা একজন মানুষ ও হাতির মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের গল্প। তখনই হাতিটাকে ছোটো হতে শোনা গেল। কথক দেখেছেন সেটা বর্ণনা করছেন অন্য আরেকজনকে। আর আমরা শুনছি। গল্পের আরেকজন চরিত্র (একজন মহিলার সঙ্গে কথকের আলাপ হয় এবং একদিন হোটেলের ককটেল লাউঞ্জে বসে তাদের হাতিটার উধাও হওয়া নিয়ে কিছু কথা হয়) সে-ও শুনছেন। কথক যে ব্যাপারটার সরাসরি প্রত্যক্ষদর্শী তাও নয়। তিনি উঁচু ভূমিতে দাঁড়িয়ে ফাঁক থেকে দেখেছেন। সামনাসামনি দেখেননি। ঘটনাটা বলতে গিয়েও তাঁর নানারকম দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। আসলে আমি কেন পড়ছিলাম গল্পটা? কেনই-বা আমি এই গদ্যটা লিখছি। আমার গদ্য লেখার কোনো গতিপথও ঠিক করতে পারছি না তবে আমাকে গদ্যটা লিখে ফেলতে হবে। গল্পটা হাতি উধাও হওয়ারই গল্প এই অনিশ্চিত জগতে।

আমার প্রশ্ন— কেন এখানে একটা হাতি হঠাৎ উধাও হল? এই প্রশ্ন আমি লেখককে করতে পারি না। গল্পকেও না। হাতিকেও না। অতএব অবান্তর এরকম সময়ে হাতিটার কোনো ইয়ত্তা করার প্রয়োজন আছে। হাতিটা খুব জরুরি। একটা শহরের পোষ্য প্রাণী সে-হাতি। তার আকৃতিরও বর্ণনা করেছেন মুরাকামি তাকে আরও হাতির সাবলীলতা দেওয়ার জন্য। যারা হাতি ভালোবাসে তাদের অনুভূতিতে গিয়ে ধাক্কা খাবে আর ভাবতে শুরু করবেন তাঁরা হাতিটার প্রকৃতি নিয়ে। আদৌ কি তাঁদের এ-সব ভাবার কোনো কারণ ছিল। বা ভাববার সময় তাঁরা হাতিটাকে নিয়ে ভাবার চেষ্টা করেও হাতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ভাবতে থাকবে শূন্যতা নিয়ে। হঠাৎ একটা বাসস্থান থেকে কোনো এক অস্তিত্ব অদৃশ্য হয়ে গেলে যেরকম শূন্যতার বোধ হয় আরকী! প্রসঙ্গ হচ্ছে একটা হাতি উধাও হয়ে গেছে। তাকে নিয়ে কতরকম জল্পনা-কল্পনা চলেছে। গল্পটাকে কখন আমরা সত্যি ভেবে ফেলেছি সেটা বুঝতে পারিনি। এই গল্পটা কি তাহলে এক বিভ্রম। অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার কাহিনি? না কি আরও অনেক বড়ো কিছু যা আমাদের মানুষের স্বভাবের শাশ্বতকে তুলে ধরে। গল্পটা উত্তর-ঔপনিবেশিক বিক্ষিপ্ততার আখ্যান বলা যেতে পারে। আবার এই সবকিছু উপেক্ষা করে একটি হাতি ও তার প্রিয় মানুষসঙ্গীর গল্পও বলতে পারি। যেখানে প্রান্তিকতা ও উপেক্ষার সংস্কৃতিকে পিঠ দেখিয়ে চলে যাওয়া আছে। হাতিটা আলাদা হয়ে গেছে সমাজ থেকে তার বড়ো শরীর নিয়ে। আখ্যায়িত হয়েছে একক সত্তা নিয়ে আমাদের সামনে। আর মনে রাখি বার বার যে, এই পৃথিবীতে এমন অনেক কিছু ঘটে যার ব্যাখ্যা আমাদের কাছে থাকে না।

আরেকটা প্রসঙ্গে বলেছিলাম না, হাতিকে সরু নলে ঢুকিয়ে ইঁদুর করার সম্ভাবনা। এ আবার কী বিষয়! আসলে এই গল্পটা নিবিড়ভাবে পড়ে ফেললেও ব্যাপারটা এরকম দাঁড়াবে না। এ এক সম্পূর্ণ বিপরীত দর্শন যার সৃষ্টির উৎস এখানে হতে পারে কিন্তু পুরোপুরি ভিন্ন। পীযূষ ভট্টাচার্যর ‘তালপাতার ঠাকুমা’ উপন্যাসের একটা কোর মনস্তত্ত্ব এটা। যাইহোক এটা নিয়ে পরে বলব। একটা হাতি ভ্যানিস। কোনো এক শূন্যে। কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি হাতিটা কীভাবে অদৃশ্য হল। তার অনুসন্ধান চলছে।

“So, then, you believe that the elephant kept shrinking until it was small enough to escape through the bars, or else that it simply dissolved into nothingness. Is that it?” এই নাথিংনেসের প্রতিধ্বনি শুনি। আসলে এই উদ্ধৃতিটির সঙ্গে আমার বক্তব্যের সরাসরি যোগাযোগ নেই। একটি হাতি। সে এত বড়ো প্রাণী কী করে শূন্যে বিলীন হয়ে গেল! উধাও হওয়ার আগের দিন যখন শেষ দেখেছিলেন কথক তখন হাতিটা ছোটো হয়ে গেছিল। কতটা ছোটো হয়েছিল সেটা অবশ্য বলেননি। ছোটো হয়ে সমস্ত বাঁধন ছিন্ন করে তার রক্ষণাবেক্ষণ করার মানুষটার সঙ্গে কোথায় উধাও হয়ে গেল হাতিটা কথকও বলতে পারেননি। তারপরই আলো নিভে গিয়েছিল। এরপরের খবর সবাই জানে। সেটা তারপর রাষ্ট্র হল। সে-সব খবরের মধ্যে কথক ডুবে গিয়েছিলেন। আমি বলব অন্য কথা। এর মধ্যে নাথিংনেস আছে। চরমভাবে একটা উধাওবোধ। দুটো অস্তিত্ব কেন এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল? এও কি কোনোরকম প্রতিবাদ? হাতিটা যখন ছিল তাকে নিয়ে অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল। চিড়িয়াখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এ নিয়ে জল্পনা। তাকে কোথায় রাখা হবে। বৃদ্ধ হাতি নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন প্রশাসন। কেউ নিতে চাইছে না। এ-প্রসঙ্গে আবার পরে ফিরছি। শূন্যতার কিছুটা আভাস গল্পকারও দিয়েছেন: “Without the elephant, something about the place seemed wrong. It looked bigger than it needed to be, blank and empty like some huge, dehydrated beast from which the innards had been plucked.” এখানে শূন্যতা কেবল নয় সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মেটাফিজিক্যাল আবহ। ব্যাপারটা মারাত্মক। আর হাতিটা উধাও। না-থাকাটা এখানে এতটাই অস্বাভাবিক! যেখানে হাতিটা না থাকলেই বরং শহরের সমস্যা অনেক মিটে যেত আরকী।

“(the elephant mostly ate leftovers from the lunches of children in the local elementary school)”— প্রান্তিকতাটুকু একটু ভেবে দেখুন। “Care and feeding costs would be too high… The elephant was so old that it neither ate very much… The children’s lunch scraps would serve as the elephant’s feed.” ইশকুলের ছাত্রদের পড়ে থাকা খাবার খেয়ে হাতিটা বেঁচে থাকবে, এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। একটা প্রাণী তার জন্য আলাদা করে কোনো খাদ্যের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। তার বেঁচে থাকা এতটাই প্রান্তিক! তাকে রাখার ব্যবস্থা করা হল ইশকুলে শেষ পর্যন্ত কিন্তু তাকে উচ্ছিষ্ট খাবারের ওপর বেঁচে থাকতে হবে আর এ-জন্য যেভাবে প্রস্তাবনা পেশ করা হয়েছে তাতে এমন তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেয়েছে যে, এর থেকে অপমানের আর কিছু হতে পারে না। আমি এর গভীরতা অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছি। ভেবেছি অনেক। পৃথিবীতে একটা হাতি। বৃদ্ধ বলে তাকে এভাবে উপেক্ষা করছে সমাজ। তবে এর মধ্যে রসিকতাটুকু হল তার আকার। বৃহদাকার বলে তাকে এড়িয়ে যেতেও পারছে না কেউ। অদৃশ্য হওয়ার পরে হাতিটা এতটাই বড়ো বিষয় হয়ে উঠল যে, সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রশাসন সবাই তাকে নিয়ে মেতে উঠেছিল। জিজ্ঞাসা জন্মেছে। উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। অদৃশ্য হওয়ার আগে যে-হাতিটাকে জায়গা দিতে না পারায় সেই সমস্যার সমাধান হিসেবে তাকে মেরে ফেলার কথাও ভাবা হয়েছিল। এটাই হল আমাদের মনুষ্য সমাজ। “This caused a lot of difficulty, both for the zoo and for the town. The zoo had sold its land to a developer, who was planning to put up a high-rise condo building, and the town had already issued him a permit. The longer the elephant problem remained unresolved, the more interest the developer had to pay for nothing. Still, simply killing the thing would have been out of the question. If it had been a spider monkey or a bat, they might have been able to get away with it, but the killing of an elephant would have been too hard to cover up, and if it ever came out afterward, the repercussions would have been tremendous.”

“It was such an awfully old elephant that its every move seemed a tremendous effort—so much so that people seeing it for the first time feared it might collapse at any moment and draw its final breath.” এটা হাতির জন্য আমাদের সহানুভূতি প্রকাশ। আবার হাতিটার ভেঙে পড়ার প্রসঙ্গটা আমার কিছুটা আস্তিত্বিক মনে হয়েছে। কঠিন নির্মম সমাজের বিপরীতে হাতিটা দাঁড়িয়ে আছে একা। বেসরকারি চিড়িয়াখানাতেও চার মাস হাতিটা একা ছিল। নিঃসঙ্গ। তাকে ইশকুলে একটা জায়গা করে দেওয়া হল। হাতিটা আর ফিরে আসেনি। তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। উধাও হয়েছে সে। অনেকদিন পর ধীরে ধীরে পৃথিবী নিজের গতিতে আবার ফিরে গেছে। হাতির খোঁজ আর কেউ করেনি। শহরও হাতির কথা ভুলে গেছে। কথকও নিজের কাজে ফিরে গেল। এক রূঢ় বাস্তব জগতে ফিরে গিয়ে মিশে গেছেন তিনি। সেখানে তাঁর কর্মজীবনে উন্নতি হয়েছে অনেক। উধাও হওয়ার আগে তিনি হাতিটাকে শেষবারের মতো দেখেছিলেন। হাতি বৃহদাকার প্রাণী তার উধাও হওয়ার খবরও অনেক বড়ো হয়ে ছড়িয়েছিল কিন্তু সময় আরও বৃহৎ পৃথিবী আরও দীর্ঘ। এইসব অনন্তের মাঝে একটি বৃদ্ধ হাতি হারিয়ে গেল।

Facebook Comments

Leave a Reply