মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের নতুন ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
৮
মহাকাশের গন্ধ ও মহাজাগতিক পঞ্জিকা:
পারফিউম, ওয়াইন আর কবিতা কিভাবে তাদের গঠনে ও মেজাজে পরস্পর সম্পর্কিত হয়ে আছে, সেই নিয়ে অন্যত্র একটা দীর্ঘ আলোচনা করেছিলাম। তার নাম ছিল ‘ওক কাঠের ব্যারেল’, প্রকাশিত হয়েছিল কৌরব পত্রিকার বইমেলা ২০২০ সংখ্যায়।
ফরাসী সুগন্ধীর বহুস্তরীয় গঠন আমাকে আপ্লুত করে রেখেছে তাদের অপার রহস্যের কারণে, সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণধর্মী রিপোর্টগুলোও তাই আমার কাছে অবশ্যপাঠ্য। সেই প্রেক্ষিতে, প্রতিটি উৎকৃষ্ট কবিতাপাঠও আমার কাছে যেন ইন্দ্রিয়গত এক উৎসব— আ সেলিব্রেশান অফ সেন্সেস— যার পরিণতিতে জন্ম নেয় কত বহুস্তরীয় বোধ, যা গভীর বিস্মৃতির মধ্যেও আমাকে জাগিয়ে রাখে।
কবিশ্রেষ্ঠ শার্ল বোদল্যের তাঁর একটি কবিতায় উল্লেখ করেছিলেন এমনই বহুস্তরীয় মিশ্র সুবাসের কথা। সেই এক নারী, যাঁর শরীরী ঘ্রাণ কবিকে আপ্লুত করেছিল, লিখেছিলেন- ‘মিশ্র সুবাসে হই মাতাল’। কেমন ছিল সেই সুবাস ? কবি লিখেছেন (অনু : বুদ্ধদেব বসু)—‘নারিকেল তেল, আলকাতরা ও কস্তুরীর’ ।
তো, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই হয়। অনেক বছর আগে, কর্মজীবনে জামসেদপুরে একবার সাকচি বাজারের ভীড়ে হঠাৎই হাওয়ায় ভেসে আসা এক সুগন্ধ আমাকে চঞ্চল করে তুলেছিল, এক লহমায়। ভীড়ের মধ্যে বাজারের অলিগলি ঘুরেও তার উৎসকে আমি খুঁজে পাইনি। তার সাথে জড়িয়ে ছিল কতকালের কত স্মৃতিরহস্য– কত আদর, আশ্রয়, কত হারিয়ে যাওয়া স্পর্শ, আলো, ঘুম, যা শুধু মনই জানে।
হাওয়ায় ভেসে আসা এমনই সব অচেনা গন্ধ, কতদিন। কিন্তু কেমন হয় আকাশের গন্ধ, বিশেষতঃ মহাকাশের, যা পৃথিবীতে ফিরে আসার পরে একজন মহাকাশচারীকে কখনও স্মৃতি-মেদুর করে তুলতেও পারে ? মানুষের মহাকাশযাত্রা শুরু হওয়ার অনেক আগেই বাংলার কবি সুকুমার রায় লিখে গেছেন—‘আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ? ছোটবেলায় আমি সেই কবিতা পড়ে ভাবতাম, পাকা তেঁতুলের আচারের গন্ধই হয়তো। বৃষ্টিতে ধুয়ে গিয়ে মিষ্টি হয়ে যায়, লিখেছে। কিন্তু সে তো ছিল ছেলেবেলার কথা। তারপর কত মেঘ বৃষ্টি খরা বন্যা বজ্রবিদ্যুতের দিন পেরিয়ে এসেছি। কতকিছু ধুয়ে মুছে গেছে। এবার ২০২০ সালে বিজ্ঞানীরা সত্যিই নেমে পড়েছেন মহাকাশের গন্ধকে স্তরে স্তরে বিশ্লেষণ করে, তার মতো পারফিউম বানাতে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘অ ডি স্পেস’ (Eau de Space), যেভাবে আমরা ‘অ ডি কোলোন’ পেয়েছি আগেই।
আমরা যারা মহাকাশে যাইনি কখনও এবং যাদের যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, তাঁদের জন্য এবার বাজারে আসতে চলেছে এমন একটি পারফিউম, যা নাকি আলটিমেট, যা এই স্পেস এজ-এর সাথে মানানসই। দীর্ঘদিনের চেষ্টায় এই পারফিউমটি নির্মাণ করেছেন প্রখ্যাত এক খাদ্য-পানীয় শিল্পের ডিরেক্টর, রসায়নবিদ স্টিভ পিয়ার্স। তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, মহাকাশের গন্ধ টকটক নয়, বরং কিছুটা তেতো, বিটার। আর একটু পোড়া ও ধোঁয়াটে যেন, বার্নড অ্যান্ড স্মোকি। ওঁদের কোম্পানির প্রোডাক্ট ম্যানেজার রিচমন্ডকে জিগ্যেস করা হলে তিনি মনে করেন, এটা কাউকে বুঝিয়ে বলা খুব শক্ত, বরং নিজে গন্ধ শুঁকে বুঝে নিতে হবে। তবে মহাকাশচারীরা পৃথিবীতে ফিরে এসে তাঁদের স্পেস-স্টেশানের অভিজ্ঞতা থেকে বলেছেন—এটা একটা মিশ্র গন্ধ ; পিস্তল থেকে ফায়ার করলে তার নলের প্রান্তে যে পোড়া ধাতবগন্ধ পাওয়া যায় (বেস নোট), তার সাথে যুক্ত করতে হবে ঝলসানো মাংসের গন্ধ (হার্ট নোট)। এছাড়াও তার সাথে মিশবে দুটো ফল ও সুরার গন্ধ, যথাক্রমে র্যাস্পবেরি ও ডার্ক রাম (টপ নোট)।
খুব শিগগিরি নাকি মার্কেটে আসতে চলেছে এই দারুণ রহস্যময় পারফিউমটি। নির্মাতাদের বিশ্বাস, এটা জনপ্রিয় হবে হাইস্কুলের পড়ুয়া, মাস্টার আর অভিভাবকদের মধ্যেও, কারণ এটা একধরণের এক্সপেরিএন্সিয়াল এজুকেশান। এর মাধ্যমেই বিজ্ঞানীদের সাথে তাদের যোগাযোগ গড়ে উঠবে, জানতে চাইবে মহাকাশের বিশালতা আর বিশ্বসৃষ্টির রহস্যময় পর্বগুলোর কথা।
*
বিশ্বসৃষ্টিরহস্য নিয়ে ব্রহ্মপুরাণে আমি যা পড়েছিলাম, যৌবনে আমাকে তা অচিরেই নিরাশ করেছিল। অবশ্য সেই কল্পকাহিনীর মধ্যে ছিল আরও গভীরে অনুসন্ধানের জন্য কিছু বীজ, যা আমাকে আজও বিস্মিত করে।
ব্রহ্মপুরাণে লোমহর্ষণ মুনি, যিনি গল্পকথকও বটে, অন্যান্য মুনি ঋষিদের কাছে সৃষ্টিরহস্য বর্ণনা করছেন। বলছেন, যারা এই আদি সৃষ্টির কথা জানে তারা দীর্ঘায়ু ও কীর্তিমান হয়। –ভগবান স্বয়ম্ভু প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছায় সর্বাগ্রে জলের সৃষ্টি করলেন। সেই জলে বীর্য নিক্ষেপ করলে ক্রমে তা হিরণ্যবর্ণ অন্ডের আকারে পরিণত হয়। সেই সুবর্ণ অন্ডেই ব্রহ্মার জন্ম। ব্রহ্মা সেই অন্ডে প্রায় এক বছর থাকার পর তাকে দুভাগে ভাগ করলেন। এর থেকেই উৎপত্তি হয় স্বর্গ আর পৃথিবীর। ক্রমে এই দুই লোকেই তিনি আকাশ সৃষ্টি করলেন। ক্রমে দশদিক, কাল, মন, বাক্য, কাম, ক্রোধ ইত্যাদির সৃষ্টি হল।
তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন সপ্ত ঋষিদের– ক্রতু, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ এবং মরীচি। (সপ্তর্ষিমন্ডলে এই বশিষ্ঠ ঋষির পাশেই অবস্থান করছেন তাঁর স্ত্রী অরুন্ধতী। খুবই স্তিমিত অনুজ্জ্বল এই নক্ষত্রকে রাতের আকাশে খালি চোখে যদি পাঠক আপনি দেখতে পান, তবে আপনার চোখ সুস্থ এবং দৃষ্টিশক্তি খুবই ঈর্ষণীয়। অল্প বয়সে আমি তো অনেকবার দেখেছি।)
ক্রমে বিদ্যুৎ, বজ্র, মেঘ, ইন্দ্রধনু, চার বেদ এবং অন্য দেবতাদের সৃষ্টি হল। এতসব সৃষ্টির পরেও যখন দেখা গেল জনসংখ্যার যথেষ্ট বৃদ্ধি হচ্ছে না, তখন তিনি নিজের দেহকে দুভাগ করে এক অংশ থেকে পুরুষ ও অন্য অংশ থেকে নারীকে সৃষ্টি করলেন।
মনে আছে, লোমহর্ষণ আসরে বসে অন্যান্য মুনিঋষিদের বলছেন : আমি আমার জ্ঞান ও বুদ্ধি অনুসারে সেই প্রাচীন সৃষ্টিতত্ত্ব আজ আপনাদের শোনাব। তো, এভাবেই পুরাণ রচিত হয়েছে ; সৃষ্টিরহস্য ব্যাখ্যাত হয়েছে রচয়িতার ও কথকের জ্ঞান ও বুদ্ধি অনুসারে। কার্য-কারণ, স্থান-কাল-পাত্র, সমস্তই ওলোট পালোট ক’রে, নিয়ম ও যুক্তি ভেঙে।
লোমহর্ষণ মুনি বললেন– সেই নারীর দ্বারাই ব্রহ্মা প্রজাসংখ্যা বৃদ্ধি করে চললেন। বিষ্ণু সৃষ্টি করেন বিরাট পুরুষকে (‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু’)। সেই বিরাট পুরুষ থেকে যাঁর জন্ম, তিনি ‘মনু’ নামে প্রসিদ্ধ। শতরূপা নামে এক অযোনিসম্ভবা নারীর গর্ভে মনুর তিনটি পুত্র জন্মায়। তাদের বংশধরদের একাংশ প্রচেতা নামে পরিচিত। এই প্রচেতাদের ওপরেই ভার পড়েছিল পৃথিবী রক্ষার। সেইমতো শক্তি অর্জনের জন্য প্রচেতারা দশ হাজার বছর সমুদ্রের তলায় তপস্যায় প্রবৃত্ত হলে পৃথিবী শাসকহীন হয়ে পড়লো। পৃথিবী বিশাল গাছে গাছে এমন পরিপূর্ণ হয়ে গেল যে, বাতাস পর্যন্ত আর প্রবাহিত হয় না। প্রচেতাদের কাছে প্রজাদের দুঃখের খবর পৌঁছলে (পাঠক ভেবে দেখুন, জঙ্গলমহল থেকে সমুদ্রের তলদেশ অব্দি খবর পৌঁছনোর কারিগরী কল্পনা) ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁরা মুখ থেকে বায়ু ও অগ্নিকে সৃষ্টি করলেন। সেই আগুনে নৈমিষারণ্যের অনেক গাছ পুড়ে গেলে ভগবান সোম প্রচেতাদের অনেক প্রশস্তি করে তাঁদের সামনে এক অপূর্ব সুন্দরী নিয়ে এলেন। বললেন– এই কন্যার নাম মারিষা, ইনি বৃক্ষসমূহের কন্যা। একে পত্নীরূপে গ্রহণ করুন। প্রচেতারা তখন শান্ত ও সম্মত হলেন। কালক্রমে মারিষার গর্ভে দক্ষ প্রজাপতির জন্ম হল। এই প্রজাপতি দক্ষ তাঁর মনের দ্বারা সৃষ্টি করলেন স্থাবর ও জঙ্গম, দ্বিপদ ও চতুস্পদ প্রাণীসমূহ। দেবতা, ঋষি, অসুর, গন্ধর্ব, যক্ষ এবং রাক্ষস প্রভৃতি মানসপ্রাণী।
পুরাণে সৃষ্টিরহস্য প্রসঙ্গ সত্যিই লোমহর্ষক। এখানে শুধু নারী-পুরুষ, বা দেবতা, অসুর, গন্ধর্ব, রাক্ষস, ব্রাহ্মণ, ঋষি নয়, শুধু ঐরাবত, নাগ, গাভী, ক্ষীর, তামা, লোহা, ভেষজ উদ্ভিদ নয়। সৃষ্টি বর্ণনায় রয়েছে জল-আগুন, আকাশ-বাতাস, স্বর্গ-নরক, আলো, বাক্য, ছায়া, দশদিক, স্থাবর-জঙ্গম, সমস্ত সৃষ্টির তাবৎ কথা। আছে মহত্তত্ত্ব, প্রকৃতি, সংজ্ঞা, ক্রোধ, বাক্য এবং সংকল্পের সৃষ্টি বর্ণনা। যত প্রাণী স্বর্গে আছে, সমসংখ্যক প্রাণী রয়েছে নরকেও, এরকম অদ্ভুত বাইনারী সিস্টেমের কল্পনা। আরও আছে এমন কিছু উল্লেখ, যা আজকের রেডিয়ো-টেলিস্কোপ্বের যুগেও যথেষ্ট আধুনিক। এরই পাশাপাশি আছে প্রাক-গ্যালিলিও যুগের মতই দুর্বল গ্রহ-নক্ষত্র জ্ঞান। যেমন, পৃথিবীকে আবর্তন করছে সূর্য! অথবা, চন্দ্রমন্ডল সৌরমন্ডল থেকেও লক্ষযোজন দূরে রয়েছে! নক্ষত্রমন্ডলেরও দু-লক্ষ যোজন দূরত্বে বুধ গ্রহের অবস্থান! এবং শনির ঠিক এক লক্ষ যোজন দূরেই রয়েছে সপ্তর্ষিমন্ডল!
এই সব প্রগলভতার পাশাপাশি রয়েছে সৃষ্টি সম্বন্ধে আরও বর্ণনা, যা অদ্ভুত, গম্ভীর ও সুন্দর। আছে শূন্যময় মহর্লোকের কথা, কল্পের শেষেও যার বিনাশ নেই! ব্রহ্মান্ড কয়েৎবেলের বীজের মতো, যাকে বেষ্টন করে আছে আকাশ। সেই আকাশ তার চেয়েও দশগুণ বেশী মহত্তত্ত্ব দিয়ে বেষ্টিত হয়ে আছে। এই মহত্তত্ত্বকে বেষ্টন করে আছে প্রধান বা প্রকৃতি। হাজার হাজার কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড ওই প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করে আছে। তিলে যেমন তেল থাকে সুপ্তভাবে, তেমনিভাবেই চৈতন্য আত্মা সর্বব্যাপী পুরুষ এই প্রকৃতিতে থাকেন সম্মিলিত ভাবে। সৃষ্টির প্রারম্ভে ওই প্রকৃতিই কম্পনের কারণ হয়! আর এই আত্মাই বিষ্ণুশক্তি। সমগ্র দৃশ্যমান জগৎ চরাচর তাঁরই ব্যক্ত রূপ।
বিভিন্ন সভ্যতা ও জাতির হাতে বিবর্তনের বিশেষ বিশেষ পর্বে তৈরী হয়েছে তাদের নিজ নিজ পুরাণ। হিন্দু, ইহুদি, মিশরীয়, গ্রীক, চৈনিক, মায়া, আজটেক, এস্কিমো। দ্বারকা, মগধ, রোম, ব্যাবিলন, কনস্টান্টিনোপল, বেথলেহেম। তৈরী হয়েছে ধর্ম বিশ্বাস মূল্যবোধ। এদের মধ্যে সামাজিক অনুশাসনে, সংস্কারে, পার্থক্য যেমন বিরাট, তেমনই আবার অন্তর্নিহিত এক মূল স্রোত, যা প্রকৃতি ও আদিপুরুষ সম্বন্ধীয়। সেইমত সৃষ্টিরহস্য অনুসন্ধান। আদি মন্ত্র, সুর, জলপাত্র, ওঁকার।
সৃষ্টির শুরু থেকে কালপ্রবাহের এই বর্তমান ক্ষণ অব্দি যে যাত্রাপথ। যার প্রাথমিক অবস্থাকে কোনও বস্তু, তেজ, শক্তি, মাত্রা, গতি ও আলো দিয়ে সূচিত করাই যায় না। যখন সৃষ্টি হয়নি আকার, দিক, জ্যামিতি, গুণ। সেই অবস্থানকে পুরাণে বলেছে, একটা ইচ্ছা, যা একক। বস্তুগত বা, প্রাণী-মনজাত নয়। –আমরা দেহ ও মনের ফ্রেমের মধ্যে অবস্থিত হয়ে ভাবতে পারি না সেই অবস্থার কথা। অথচ এই সংজ্ঞা আমাদেরই কল্পনায় রচিত ! -যা ছিল নির্গুণ ও সর্বব্যাপী ইচ্ছা, ক্রমে তা থেকেই শুরু হয় কম্পন !! এই কল্পনা ব্রহ্মপুরাণের। কথিত আছে যে, পুরাণ অপৌরুষেয়। অর্থাৎ কোনও পুরুষ দ্বারা নয়, পরম জ্ঞান থেকেই তার রচনা ! -কিন্তু এই পরম জ্ঞানের উৎপত্তি কীভাবে ?
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিজ্ঞানী, পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিদ, আংকিক, সৃষ্টিরহস্যের সূত্র খুঁজতে খুঁজতে ক্রমে প্রায় একই মতবাদে এসে পৌঁছেছেন মনে হয়। তাঁদের আছে সুপার কম্পিউটার, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, পার্টিকল অ্যাক্সিলারেটর, হাবল টেলিস্কোপ। তাঁদের সাহায্য করেছে বিপুল ডাটাবেস, ফাজি লজিক, ডিফারেন্সিয়াল ইকোয়েশান, রিলেটিভিটি তত্ত্ব, সিমুলেশান মডেল, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ফ্র্যাক্টাল জিওমেট্রি, থিয়োরি অফ্ কেঅস, সিস্টেমস ডায়নামিক্স। তাঁরা বলছেন, শুরুতে প্রথম যে অবস্থা, তা একটি ইচ্ছা মাত্র। ক্রমে শুরু হয় কম্পন। এই কম্পনই পদার্থ সৃষ্টির একক কণিকা যেন। ক্রমে এর থেকে সৃষ্টি হয় কয়েক রকমের কোয়ার্ক। সম্ভতঃ এভাবেই গ্র্যাভিটেশন আর ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক আকর্ষণ বল। ক্রমে যা ফোটন, মেসন, ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, গ্রাভিটন, পরমাণু, অণু। এভাবেই নক্ষত্রমন্ডল, গ্রহ উপগ্রহ। এভাবেই পৃথিবীতে ছয় ঋতু, সাত সমুদ্র, হিমবাহ, বৃষ্টিবন। এভাবেই অ্যামিনো অ্যাসিড, প্রোটিন, এনজাইম, ডিএনএ। শিশু মাকে জিগ্যেস করছে, ‘এলেম আমি কোথা হতে?’ মা বলছেন, ‘ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’।
এভাবেই সৃষ্টিরহস্য ও কল্প-বিনাশের মতো মৌলিক দর্শন রচিত হয়ে গেছে আদি ভারতের মাটিতে। জীবাত্মা ও পরমাত্মার স্বরূপ। আর আত্মার রয়েছে আঠারো রকমের ভাগ ও উল্লেখ। রয়েছে, দেহ ও মনের পরস্পর অবস্থানের কথা, আর সমগ্র চেতনার বর্ণালী। নানা প্রক্ষিপ্ত, অসার, অবান্তর ও প্রগলভ বর্ণনার পাশাপাশি রয়েছে এমন সব মৌলিক ও গূঢ় উচ্চারণ যা বিংশ শতাব্দী পার করেও আমাদের মূল পর্যন্ত নাড়িয়ে দেয়।
যখন নব্য বিজ্ঞান আর প্রাচীন দর্শন কাছাকাছি এসে মেলে, ভারি অসুবিধে হয় আমাদের, শূন্য মনে হয়। কিন্তু বিজ্ঞান তো পুরাণের কল্পনা ও দর্শনের ওপর সকল দায়িত্ব গচ্ছিত রেখে বিশ্রাম নিতে পারে না। তাকে তো জেনে নিতে হবে সকল অজানাকে। তাকে তো বেছে, যাচাই করে নিতে হবে সকল তথ্য। পরীক্ষাগারে হাতে হাতে প্রমাণ না পেলে সে কোনও কিছুই স্বীকার করবে না। বিজ্ঞানীর তাই ঘুম নেই চোখে। বিশ্বসৃষ্টিরহস্যের এখনও অনেকটাই যে তার অজানা। মানুষ পৃথিবী ছেড়ে পা রেখেছে চাঁদে। তার সৃষ্ট মহাকাশযান (ভয়েজার-১ এবং ২) সবে মাত্র পার হতে চলেছে সৌরমন্ডলের সীমানা। আমাদের টেলিস্কোপের দৃষ্টি এখন প্রায় ১৩০০ কোটি আলোকবর্ষ অবধি প্রসারিত। আমরা শুনেছি সৃষ্টির শুরুতে জন্ম নেওয়া এমন অনেক শব্দ যা এতকাল অশ্রুত ছিল। আমরা এখন গভীর মহাকাশের ঘ্রাণের সাথেও ক্রমে পরিচিত হয়ে উঠছি। আমরা বুঝতে পেরেছি যে বিশ্বসৃষ্টিরহস্যকে জানতে হলে আরও অনেক ধৈর্য ধরে কাজ করে যেতে হবে আমাদের, থাকতে হবে অপেক্ষায়। কারণ, মহাকালের নিরিখে সবেমাত্র আমাদের জন্ম হয়েছে। এই বিশ্বে আমরা সদ্যপ্রসূত।
আনুমানিক ১৩৭৮ কোটি বছর আগে এই ব্রহ্মান্ড জগতের সৃষ্টি হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীরা। আজ অব্দি এই দীর্ঘ সময়কালকে যদি একটা গোটা বছর হিসেবে ধরে নেওয়া যায়, অর্থাৎ ১-জানুয়ারীর দিন সৃষ্টির শুরু হয়ে, আজকে আমার লেখার এই মুহূর্তটাকে যদি ধরা হয় ৩১-ডিসেম্বর রাত বারোটা, তবে এই বিশ্বে বিচক্ষণ মানুষের জন্ম হয়েছে মাত্র আট মিনিট আগে ; ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টা বেজে ৫২ মিনিটে। এই দীর্ঘ সময়কালের একটি মহাজাগতিক পঞ্জিকা (Cosmic Calender) আজকের বিজ্ঞানীরা তৈরী করে ফেলেছেন।
১-জানুয়ারী রাত ০০ ঘন্টা ০০ মিনিট : ব্রহ্মান্ডের জন্ম (বিগ ব্যাং)
১ সেপ্টেম্বর: সৌরমন্ডলের সৃষ্টি
১৯ ডিসেম্বর: পৃথিবীর মাটিতে উদ্ভিদের জন্ম
২০-২১ ডিসেম্বর : মাছ এবং কীটপতঙ্গের আবির্ভাব
২৫ ডিসেম্বর : ডাইনোসরদের আবির্ভাব
২৬ ডিসেম্বর : স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আবির্ভাব
২৭ ডিসেম্বর : বড় আকারের ডানা মেলা পাখি
২৮ ডিসেম্বর : গাছে গাছে ফুল
৩০ ডিসেম্বর (গতকাল) : পৃথিবী থেকে ডাইনোসরের অবলুপ্তি।
মহাজাগতিক পঞ্জিকায় বছরের আজ শেষদিন :
৩১ ডিসেম্বর (আজ) : ভোরবেলা : লেজওয়ালা বাঁদরদের থেকে পৃথক হয়ে বেড়ে উঠলো শিপাঞ্জি, ওরাংউটান
আজ রাত আটটা : শিম্পাঞ্জিদের থেকে পৃথক হয়ে বেড়ে উঠলো মানুষ
রাত ৯টা ২৫ মিনিট : সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুপায়ে হাঁটতে পারছে মানুষ
রাত ১১টা ৫২ মিনিট : আধুনিক চেহারার মানুষ
রাত ১১টা বেজে ৫৬ থেকে ৫৯ মিনিট : এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছে মানুষ
রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ০৩ সেকেন্ড : লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় এই সময় থেকে
রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ২৩ সেকেন্ড : কৃষিনির্ভর মানুষের এক জায়গায় বসবাস শুরু।
রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ৫৯.৮৩ সেকেন্ড : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ।
রাত ১১টা ৫৯ মিনিট ৫৯.৮৫ সেকেন্ড : মহাকাশভ্রমণে প্রথম মানুষ (উরি গ্যাগারিন)।
রাত ১২টা : পাঠক যখন এই লেখাটা পড়ছেন।
এভাবে আরও ৪৩৬ বছর পার হলে, মহাজাগতিক পঞ্জিকায় তবে মাত্র ১ সেকেন্ড অতিক্রান্ত হবে।
এই অনন্ত মহাকালের নিরিখে মানুষের আয়ু কত সামান্য। তারাশংকরের ‘কবি’-র কথা মনে পড়ে। ‘হায়, জীবন এত ছোট কেনে, এ ভুবনে?’ কবি মণীন্দ্র গুপ্ত একদিন আমায় শুনিয়েছিলেন কৈলাসে শিবালয়ে শিব-দুর্গার পাশা খেলার গল্প। খেলতে খেলতে হঠাৎ বাইরে একটা শব্দ শুনে দেবি দুর্গা শিবকে শুধোলেন—দূরে ওটা কিসের আওয়াজ? শিব বললেন, কিছু না, মর্ত্যে রাবণের জন্ম হল। শুনে দুর্গা খেলায় মন দিলেন। একটু পরেই আবার একটা শব্দ। দুর্গা বললেন, এবার কী হল? শিব বললেন, এবার রাবণের মৃত্যু হল।
এই গল্প আমাকে বিস্মিত করেছে। আজকের পৃথিবীতে দীর্ঘায়ু মানুষের আয়ু যদি একশো বছরও ধরা হয়, তবে ব্রহ্মান্ডের ওই ‘কসমিক ক্যালেন্ডার’-এর নিরিখে তার স্থায়িত্ব মাত্র ০.২৩ সেকেন্ড, অর্থৎ এক সেকেন্ডের পাঁচভাগের এক ভাগ মাত্র। এই সামান্য সময়টুকুর মধ্যেই আধুনিক সভ্য মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান আরও কত সুন্দর করে তুলতে পারে তাকে, অথবা তার সামান্য ভুলচুকে দ্রুত ধ্বংস হয়ে যেতে পারে এতকালের এই সুন্দর পৃথিবী।
[ক্রমশঃ]
Posted in: February 2021 - Serial, PROSE