ব্যক্তিগত সিনেমাটিক : সেঁজুতি দত্ত
[ব্যক্তিগত সিনেমাটিক – সিনেমা সংক্রান্ত নিজের ভাবনাগুলি অথবা প্রতিনিয়ত যা কিছু নিজেকে ভাবাচ্ছে সেগুলিকে সিনেমার রেফারেন্সে ভাবার একটা প্রয়াসে এই কলাম। তাই এই কলামটি যেমন ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক আবার তেমনই ব্যক্তিগত এবং সিনেমাটিকও বটে। সিনেমায় পাওয়া বিশেষ কিছু মুখ নিয়ে লেখা এই কলাম এবং সেই প্রতিকৃতির বাছাই প্রক্রিয়া অবশ্যই ব্যক্তিগত। সেই মুখ সিনেমার, সেই মুখ ব্যক্তিগত এবং সেই মুখ রাজনৈতিক।]
আজকের মুখ – হোয়াইট গড
এই পত্রিকায় সিনেমায় মুখ নিয়ে লিখতে শুরু করেছিলাম চার মাস আগে। তখন আমার দুটো কুকুর ছিল। আর আজ যখন এই সংখ্যার জন্য লিখছি তখন আমার শুধু একটা কুকুর আছে। ছোটজনের অসুস্থতার কারণে প্রায় এক মাস কাজ করতে পারিনি তাই গত সংখ্যায় লেখা দিইনি। কিন্তু এখন যখন একটু একটু কাজ করতে শুরু করেছি তখনও কি সদ্য স্বজনহারার স্মৃতিমুক্ত থাকতে পারছি? মনে হয় না। এই শোক কতটা ব্যক্তিগত আর কতটা জাগতিক সেটা বুঝতেই এই লেখা। আর তাই, যেহেতু এটা কলাম তাই কিছুটা ব্যক্তিগত অবস্থাকে লেখার মধ্যে জায়গা দিতে চাইছি হয়ত।
আমরা যারা চলচ্চিত্রের ছাত্রী তাদের হয়ত সবরকম মানসিক অবস্থাতেই নিজের পছন্দের সিনেমা খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে। তেমনি, আমাদের বাড়িতে যখন প্রথম সারমেয়টি এসেছিল তখন কিছু সিনেমা দেখেছিলাম। ফুটফুটে কুকুরছানাদের মানুষের পরিবারে বড় হয়ে ওঠার সিনেমা, কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝেছিলাম যে এই ছবিগুলো খুব কাঁদায়। ছবির শেষে এদের মৃত্যু হয়, আমাদের মন ভাঙে, ছবির চরিত্ররাও স্থির থাকতে পারে না। প্রথম প্রথম যা দেখতাম তার সবই প্রায় হলিউডের এবং লক্ষ্য করেছি যে কুকুরদের নিয়ে সিনেমাতে হাচি: আ ডগ’স টেল (২০০৯) এবং মার্লি অ্যান্ড মি (২০০৮) এই দুই ছবির ছায়া বেশ প্রকট। তাই ঠিক করেছিলাম আর দেখব না; মন খারাপ করে, তাত্ত্বিক দূরত্বটুকুও বজায় রাখা যায় না। এসবের মধ্যেই ২০১৪ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘Un Certain Regard’ পেল করনেল মুন্দ্রুকজোর ছবি হোয়াইট গড যার হাঙ্গেরিয়ান নাম ফেহের ইস্তে। নামটা শুনেই ভারতীয় কান আরাম পায়, আমাদের চেনা শব্দ ‘ফেরেশতা’-র সঙ্গে মিল।
এই কলামের উদ্দেশ্য সিনেমায় দেখা মুখ নিয়ে আলোচনা করা। সেই মুখ বলতে মানুষের মুখই আমরা বুঝে থাকি। কিন্তু কুকুরের মুখ কিভাবে পড়তে হয় সেটা আমরা জানি কি? এই ভেবে যখন লিখছি, বুঝতে পারছি ভাবনার অনেক জায়গা এখনো বাকি থেকে যাচ্ছে।
সিনেমার বাইরে কুকুরের দাঁত, মুখ এবং চোখের মূলত দুই রকম রিসেপশন আমরা সমাজে দেখতে পাই – এক, ভীতি-উদ্রেগকারী ভয়াবহ অপরের মুখ হিসেবে, দুই, বাৎসল্যের দৃষ্টি থেকে দেখা আপনজনের মুখ হিসেবে। এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীর মানুষ যখন মার্লি অ্যান্ড মি অথবা হাচি ছবির শেষে প্রাণহীন নিস্তব্ধ কুকুরের মুখের দ্রষ্টা তখন তারা সেই মুখে দেখতে পান শৈশব অথবা কৈশোরের মৃত্যু। তা সে যতই বৃদ্ধ কুকুর হোক না কেন, যতই পরিপূর্ণ জীবন সে কাটাক না কেন, আমাদের মনুষ্যকেন্দ্রিক ভাবনার অভ্যাসে সেই মৃত্যু সন্তান হারানোর শোকের মতোই আঘাত দেয়। আর এখানেই হয়ত হোয়াইট গড অন্যান্য ছবির থেকে আলাদা।
সারমেয় সন্তানের মা, বাবা, পরিবারের মিষ্টি আখ্যান থেকে বেরিয়ে ছবিটি হয়ে ওঠে বন্ধুত্বের সম্পর্কের। ১৩ বছরের লিলি এবং রাস্তার কুকুর হেগেনের বন্ধুত্ব হয় কিন্তু তাদের বন্ধুত্বে বাধ সাধে লিলির বাবা। হাঙ্গেরির সরকারি নিয়ম অনুযায়ী মিশ্র জাতের কুকুর বাড়িতে রাখলে অনেক টাকা ‘মংরেল’ ফি দিতে হয় যা লিলির বাবা দিতে রাজি নয়। অতএব লিলির হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও ছাড়াছাড়ি অনিবার্য।
বাকি ছবিটা লিলির তার বন্ধুকে খোঁজা এবং হেগেনের অচেনা রাস্তায় একাকী যাপনের গল্প। জ্যাক লন্ডনের কল অফ দ্য ওয়াইল্ড-এর বাকের মতো হেগেনকে বিভিন্ন কষ্টসহিষ্ণু এবং শ্রমসাধ্য অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় যার অন্তিম পরিস্থিতিস্বরূপ সে ‘ডগ ফাইটিং রিং’-এ বিক্রি হয়ে যায়। প্রবল ক্ষুধা উদ্রেক করে এবং তা থেকে উদ্ভূত খাদ্যের প্রতি আগ্রাসনের ওপর ভিত্তি করে তাকে তৈরি করা হয় হিংস্র এক সারমেয় যোদ্ধা হিসেবে।
আজকের এই লেখাতে আমি গল্পের এই মুহূর্তের একটি ক্লোজআপ নিয়ে দু’কথা বলতে চাই কিন্তু তার আগে ডোনা হারাওয়ের বই The Companion Species Manifesto: Dogs, People, and Significant Otherness (২০০৩) থেকে একটি অংশ উল্লেখ করছি।
“…contrary to lots of dangerous and unethical projection in the Western world that makes domestic canines into furry children, dogs are not about oneself. Indeed, that is the beauty of dogs. They are not a projection, nor the realization of an intention, nor the telos of anything. They are dogs; i.e., a species in obligatory, constitutive, historical, protean relationship with human beings. The relationship is not especially nice; it is full of waste, cruelty, indifference, ignorance, and loss, as well as of joy, invention, labor, intelligence, and play. I want to learn how to narrate this cohistory and how to inherit the consequences of coevolution in natureculture. (পৃঃ ১১-১২)
প্রথম যুদ্ধেই হেগেন জয়ী হয়, অর্থাৎ তার প্রতিপক্ষ আরেকটি কুকুরের গলায় কামড় বসিয়ে সে হত্যা করে। রাস্তায় বড় হওয়া এবং এতদিন রাস্তায় থাকার অভ্যেসেও এই অভিজ্ঞতা তার কাছে নতুন। খাদ্য এবং নিজের এলাকা রক্ষা করার সারমেয়মেয়সুলভ স্বভাবের বাইরে, নতুন মালিকের দ্বারা শাণ দেওয়া দাঁতের ব্যবহারে অপরের প্রাণনাশের মুহূর্তে হেগেনের একটা ক্লোজআপ আমরা দেখতে পাই। রক্তমাখা মুখে সে চেয়ে আছে সামনে পড়ে থাকা মৃত কুকুরটির দিকে। আমাদের মানবিকতা বোধ ভাবতে বাধ্য করে যে সে হয়ত ঘাবড়ে গেছে। কারণ তার পরেই সেখান থেকে পালিয়ে হেগেন দৌড়তে থাকে কোন অজানা গন্তব্যে।
এই ক্লোজআপটা নিয়ে যদি ভাবি তাহলে দেখব, আখ্যানের লজিকে এবং মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে এই মুহূর্তটি আমাদের স্বস্তি দেয়। হেগেন পাশবিক কিছু করতে সক্ষম নয়। সামনে পড়ে থাকা মৃত কুকুরটির দিকে বিষণ্ণ চোখে সে একবার এগিয়েও যায়। সে যা করেছে তা তার স্বভাববিচ্যুত। কিন্তু ছবি যত এগোয় তত বুঝতে পারি তার ভবিষ্যৎ কর্মকান্ড প্রায় এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠবে। সে লিলিকে খুঁজছে এবং সেই অনুসন্ধান হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পেতে নয় বরং বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দিতে।
হেগেনের লিলির প্রতি রাগ ভুল বোঝাবুঝির জায়গা থেকে। সে ভেবেছিল লিলি তাকে পরিত্যাগ করেছিল হয়ত। তাই শহরের সমস্ত অবহেলিত কুকুর নিয়ে সে শুরু করে ধ্বংসলীলা। যে মুখ স্বজাতিকে হত্যা করে বিভ্রান্ত হয়েছিল সেই মুখ এখন প্রতিহিংসা পরায়ণ, সেই বিষণ্ণ এবং ঘাবড়ে যাওয়া মুখ তার শরীরের হিংস্রতার জন্য দায়ী করছে আমাদের। হারাওয়ে বলছেন কুকুর এবং মানুষের সম্পর্ক পরিবর্তমান এবং এর মধ্যে আনন্দ, বাৎসল্য ইত্যাদির সঙ্গে আছে হিংস্রতা এবং নিষ্ঠুরতার ইতিহাস।
প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নিছকই নিজেদের স্বার্থের জন্য এসে ঠেকেছে। এই পৃথিবী যে সহাবস্থানের জায়গা সেটা ভুলে আমরা সমস্তকিছু বশীভূত করার চেষ্টা করে চলেছি প্রতিনিয়ত। আর তাই নিজের পালিত পশুটিকে মানবাকার দিতে ব্যস্ত থাকি চিরটাকাল। অজানাকে আমাদের সামনে মেলে ধরার সুযোগ না দিয়ে আমরা নিজেদের দৃষ্টিকোণ চাপিয়ে দিচ্ছি প্রকৃতির ওপর। হারাওয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছেন সহচর প্রাণীদের গল্প আমাদের কেন্দ্র করে হতে পারে না। একটি কুকুরের মৃত্যু শুধু ব্যক্তিমানুষের শোকে আটকে থাকে না, সারা পৃথিবী সেই শোক পালন করে। প্রাণীজগতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অস্তিত্বের শর্ত কিন্তু মানুষের স্বার্থে সেটাই হয়ে ওঠে জীবনমরণ প্রতিযোগিতা। তাই ডগ ফাইটিং রিং-এ হত্যা করার পর হেগেনের বিভ্রান্ত মুখ যেন অপরের মৃত মুখে স্বজাতির বিপন্নতা দেখতে পায়।
“[A]s he sings a song of the younger world, which is the song of the pack”.
[লেখক – সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।]
Posted in: ARTICLE, February 2021 - Serial