আবছায়ার এধারে : শানু চৌধুরী

আশু। যাঁর কয়েককটা বিক্ষিপ্ত ডায়েরির পাতা নিয়ে এই গল্প। যে পাতাগুলো প্রেমের-অপ্রেমের। একাকিত্বের বা বন্ধনের। প্রায় চোদ্দ বছর পর আশুর একমাত্র মেয়ে সুদক্ষিণা এই পাতাগুলো হাতে পায়, আর সেটা পড়তে গিয়ে সে বুঝতে পারে, কোনো জোয়ারের স্রোত এসে তাকে নিয়ে যাচ্ছে এক অনির্বচনীয় চেতনাশক্তিকে পরিপূর্ণ করার তাগিদে। সে নিজেকে দেখছে ওই পাতাতে, ভাবছে, প্রশ্ন করছে এবং বোঝাবার চেষ্টা করছে ক্রমে বয়স বেড়ে ওঠা এক তরুণের মানসিক পর্যায়। এই পাতাগুলোই যেন যৌবনভারগ্রস্ত সমস্ত প্রেমিক ও অপ্রেমিকের, ঘৃণা ও ভালবাসার। আসুন ডায়েরির পাতা কয়েকটা পড়া যাক-
আজ বাইরে খুব হাওয়া দিচ্ছে। ঠাণ্ডা হাওয়া। আমি এখন জানি না, ঠাণ্ডা হাওয়া আমার কেমন লাগে। ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। আমার প্রেমের সময় অনেকে বলেছিল, একদিন একা হয়ে যাবি। একা থাকা তোর অভ্যেস হয়ে যাবে। একা হচ্ছি কি না, জানি না। বাইরে পিকনিকের গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে মাকড়সা পুকুরের দিকে। যে পুকুরে এককালে প্রেম হত আর শীতে হত পিকনিক।কেউ তখন একা থাকত না।অনেকদিন পর কুয়াশাজড়ানো শীত ডানায় মাখছে,কাকগুলো। শুধু উড়ছে পর্দার ওপারে। নাকের ভিতর সর্দি ফড়ফড় করছে, দম নিতে কষ্ট হচ্ছে আমার পর্দার এপারে। এই শীতকাল এলে নাকটা এইরকম করে। নাক ঝাড়তে গ্রিলের পাশে দাঁড়াতেই দেখি,একটা মেয়ে উড়ে যাচ্ছে নগ্ন দেহ নিয়ে। রাস্তায় পড়ে আছে তাঁর সালোয়ার, কামিজ,ব্রেসিয়ার। সে ডাকে আমাকে, হাত বাড়ায়, মোহিনীময় আকার ইঙ্গিতে।
আমি এগিয়ে যাই।
সে দূরে সরে যায়।
এভাবে আমার জামাকাপড় জন্মলগ্নের আদি থেকে সরে গিয়ে তাঁর গায়ে জড়িয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি না,ঘটনার সারমর্ম। আমি আমার দেহকে চিনতে ঘুরে বেড়াই কুয়াশার বলয় কেটে। কেউ বলে, ‘ ঠিকই আছি’, কেউ বলে, ‘ বদলাইনি একটুও’। এভাবে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হই। ধোঁয়াশা পায়ে সুডৌল রেখা ভেঙে জড়িয়ে যাচ্ছি গাছের পাতায়। ভিজে ভিজে ফিরে যাচ্ছে সেই মেয়েটা। কুয়াশাভেজা স্নান সেরেছে সে। ভেসে যাচ্ছে ব্যক্তিগত স্বপ্ন। ব্যক্তিগত মাদকতা। আমাকে তাঁর মধ্যে থেকে টেনে বের করতে চাইছে। আমি বলি- ” কুয়াশায় বেরোলে আমার মাথা যন্ত্রণা করে। আমি বেরোবো না।” সে উত্যক্ত করে আমায়। ইশারা করে পৃথুলা গড়ন বুঝিয়ে।

আমি বেরোলাম। কিন্তু, বেরোবার পরেই আমার গায়ে ছেনালি করে সমস্ত শীত মাখিয়ে দেওয়া হল। তীব্র কাঁপুনিতে আমার বুকে খিঁচ লাগতে শুরু করে। মেয়েটি হাসে,কুচক্রীর মতো। যেন সে খুব মজা পেয়েছে। একটা কালো দরজার ভিতরে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে সে আমাকে বিবস্ত্র করে এবার। এককালে প্রেমের বশেই আমার সমস্ত বস্ত্র আমি তাঁকে দান করেছিলাম,আমার মনে পড়ে। এখন অপ্রেমে সে ছিনিয়ে নিতে শিখেছে। আমি তাকে বলি, অনুরোধ করি। সে তুমুল উচ্ছ্বাসে একের পর একে আমার সোয়েটার, জামা, প্যান্ট,এমনকি জাঙ্গিয়া খুলে দিয়ে অপার আনন্দ পায়। ঠাণ্ডায় আমার দেহ ফ্যাকাশে হতে থাকে। সে আনন্দে বলতে থাকে-
হিমশৈল হিমশৈল
বস্ত্র খুলে
বস্ত্র পাইলো
আমি নীরব মুখে হাঁটু মুড়িয়ে বসে থাকি,কুঁকড়ে। ঘরে ফিরে আসতে চাই। জীবনের মতো একা হতে চাই।
যেমন আমি ছোটবেলায় ছিলাম
যেমন আমি তরুণবেলায় ছিলাম
যেমন আমি কিছু বছর আগে ছিলাম

আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, কুয়াশার ওপিঠের ঘনঘোর। আমাকে মেয়েটা একটান মেরে কুয়াশায় নামালে আমার শীত করছিলই কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি এই শীতই আমার ভালবাসা পেয়েছিল একসময়। আজ সেই শীত হয়ে গেছে আমার কাছে ঘৃণিত বস্তু। তোমাকে বুঝতে পারিনি শীত। তোমাকে কামেচ্ছায় জড়িয়ে পেয়েছি প্রতারণা। তাই এই চিঠিকে নামহীন রেখে তার উত্তালকে কান পেতে শুনতে চাইলাম আমি। অপেক্ষায় রইল, আশু।

Facebook Comments

Leave a Reply