শান্তির ব্যাপারে উৎকণ্ঠা ও বিবিধ প্রস্তাব : সঞ্জীব নিয়োগী

আপনি সবচেয়ে বেশি কখন শান্তি পান?
কাঁদলে।
আচ্ছা…?
হ্যাঁ, যখন সত্যি সত্যি এবং নির্দিষ্ট কোনও কারণ ছাড়াই কাঁদি, তখন যেমন শান্তি পাই, আর কিছুতে কখনও পাই না।
ও…। খুব দুঃখের জীবন বুঝি ঘিরে রেখেছে আপনার আত্মাকে?
না। খুঁজে পাবেন না। দুঃখ। আবার হ্যাঁ। খুঁজতে জানলে পাবেন। যেমন, অর্ধনগ্ন দুটো রুটি, মাখন না অন্য কোনও তেল, নাকি চোরা অভিসন্ধির কোনও এক এসিড মাখিয়ে নিস্পাপ হাসি মুখে পরিবেশন করা হয়েছে অন্যান্য সুখাদ্যের সাথে…।
সহজ করে, এমন ভাবে বলুন, তা যেন খুব লম্বা সম্ভাবনা নিয়ে হাজির না হয়…
আমি তো সংক্ষেপেই উত্তর দিয়েছি?
শব্দ হয়তো কম ব্যবহার করেছেন, কিন্তু আমাকে দিশেহারা করে দিচ্ছে…
কান্না যে আল্টিমেট শান্তির দিকে প্রথম পদক্ষেপ, তা কি বুঝতে পারোনা? …এবার ধরো, ধান চাষ লাভজনক হয়নি। না, দামের ব্যাপারটা খুব একটা হেরফের হয়নি। আসলে উৎপাদন কম হয়েছে, যথেষ্টই কম। আর উৎপাদন কম হলেও প্রথম দিকে দাম ছিল গতবছরের তুলনায় কুইন্টাল পিছু মাত্র আঠারো টাকা অধিক। ফড়েদের রাজত্ব চলে ধান ওঠার মরশুমে।
বেশ, তাতে কিন্তু কান্নার বিষয়টা পরিষ্কার হয় না…
বলতে দাও, বলতে দাও, মাঝখানে তুমি তো সেই টিভি সূত্রধরের মতো মুতে দিচ্ছ ভায়া, যে তার হাউজের ইগোর বাইরে যেতে দেয় না বক্তাকে!
আচ্ছা, বলুন…
মনটাই তো খিঁচড়ে দিলে বাছা বাজে বকে। থাক, আজ আর ও বিষয়ে বলছি না। ধানের ব্যাপারে আরকি। তবে ধান, ধরো, একটা প্রতীক। তাই না?
তাই কি, তাই না, এসব আমি কী বলব? আপনিই কথা তুলেছেন, আপনাকেই সমাধান করতে হবে!
সমাধান?
আশ্চর্য হবার কী আছে? ঠিকই শুনেছেন, সমাধান…
তাহলে বোসো, এসো এদিকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু হয় না। যুৎ করে চাট্টি চা মুড়ি খেতে খেতে হোক বাকিটা…
আরে, মুড়ি তো ইউরিয়া ফিউরিয়া দিয়ে ফোলাচ্ছে, খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
বেশ তবে চা খাও, চা বাগানের অসুখের কেমিক্যাল কন্ট্রোল তো নিষিদ্ধ।
তাহলে চিনি ছাড়া, দাদা! চিনিকেও বিশ্বাস করিনা আর।
জল? যে জলে চা পাতা ভেজাব?
কেন, আপনি কি ঘরের পানীয় জলের স্ট্যাটাস পরীক্ষা করাননি?
না তো! জানিই না ওসব…
ইস! সেরেছেন মশায়!
তাহলে চা-ও খাবে না? বলছ?

************

সনাতন মণ্ডল। মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিল ধান উঠলে ধান বেচে বিয়ে দেবে এই ছিল পরিকল্পনা। এখন, সরকারের সমর্থন মূল্য, ন্যূনতম মূল্য ইত্যাদির কালঘাম পেরিয়ে শেষে দেখল ফড়ের হাতে সঁপে দিলে নগদ তো বটেই, বরং খানিক বেশিই পাওয়া যাবে। ওদিকে সরকারি গুদামের লোকগুলো ওজনে হেরফের করতে ওস্তাদ। শালা, চুতমারানির ব্যাটারা। …আচ্ছা যাক, গল্প শুনতে এসে তোমার নিশ্চয় এসব কুচুটেপনা শুনতে মোটেই ভালো লাগছে না?
গল্পের টানে এসেছি বটে, ওই যে কান্নার প্রসঙ্গ উঠেছিল না, সেটার পেছনে একটা গন্ধ তো পাচ্ছিই।
শোনো না, একবার হয়েছিল কী, তখন আমাদের গ্রামে কাঁচা রাস্তা, মানে ইয়ে, মাটির রাস্তা।
দাঁড়ান, বসি…
বলছি তো তখন থেকে, আর তুমি কিনা একগুঁয়ে জেদ নিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে দাঁড়িয়ে আছ। হেস্তনেস্ত করার চটজলদি মুডে এসব কথা বোঝা যায়না ভায়া। …বেশ, শোনো। গরুগাড়ি চলত, বুঝলে, ওই মাটির সড়ক দিয়ে। চারিদিকে তখন কত শান্তি ছিল…
এক মিনিট, এক মিনিট! আবার থামাতে বাধ্য হলাম। এই আপনাদের মতো পুরোনো দিনের জাবর-কাটা মানুষরা কী ভাবে জানেন তো, যাবতীয় আধুনিক সুবিধাহীন দিনগুলো বুঝি ছিল সমস্ত শান্তির আতুর ঘর!
বলো, আরও বলো। মন খুলে পেদে নাও। এক কাজ করো না, তুমি আগে তোমার আঁতলেমি-সমগ্র প্রকাশ করে ফেল। সবাই জানুক, আমিও জানি, কত বড় সবজান্তা হয়ে বসে আছ তুমি, তারপর নাহয় মুখোমুখি বসা যাবে কোনও এক দিন!
তাহলে বোঝা যাচ্ছে শান্তির জন্য আগে আপনাকে অশান্তি করতে হবে, তারপর দেখবেন শ্মশানের শান্তি, হাঃ হাঃ হাঃ!
আমি কি অশান্তি করছি বলছ?
আঁতলেমি বললেন যে!
হ্যাঁ। তাতে অশান্তি হল?

************

যাক, গল্পটা এখন বলি।…
ভারতে তখন একুশ মাসের ইমারজেন্সি চলছে রমরমিয়ে। সবে তিন চার বছর হলো বাংলাদেশ নামের একটা রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। সঞ্জয় গান্ধী দাপিয়ে নসবন্দি করাচ্ছেন ভারতীয় পাবলিকের। বিনা টিকিট ধরা পড়লেও নসবন্দি। ভারত তখন এক আজব দেশ।
আর, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন এসেছে সবে, কেউ ঠিক মতো তখনও বোঝে না। হাঃ হাঃ হাসতে হাসতে বাবুরা শিকার করে, পুলিশে ধরে না। বরং সালাম ঠুকে চলে যায়।
পাখিরা ওসব খবর না রেখেই চিরকাল করুণ ভাবে ওড়ে।
সেইসব সাদাকালো দিন, স্মৃতিমেদুর। চিঠি পৌঁছনোর আগে অতিথি চলে আসে।
প্রেমও ছিল খুব মৃদু, অনেকের জীবনে। উচ্ছল তরুণী বলল, চলো আমরা হাতির পিঠে চড়ে ডুয়ার্সের জঙ্গলে ঘুরি সমস্ত সন্দেহের চোখে ধুলো দিয়ে; জীবন একটাই সোনা আমার। তরুণ পুরুষ বলে, দেখো, যেদিন তোমার সব চুল সাদা হয়ে যাবে সেদিন আমি ঠিক আসব! জীবনের স্বাদের আভাষ পেতে চাওয়া তরুণী বালিকার মতো অনুনয়ে বলে, ত-খ-ন তো বু-ড়ি হ-য়ে যা-বো!
…তখন, সেই সাদাকালো দিনের হঠাৎ কিছু ফুটেজ সিনেমার রঙিন আনন্দের বেদনায় তরুণ পুরুষ হয়তো বলে থাকবে, তোমার সব চুল সাদা হয়ে গেলে দেখা হবে। যেকথা তরুণী সেদিন বোঝেনা, বোঝে, তার চল্লিশ ছুঁয়ে যাওয়া ঋতু বন্ধের মন নিয়ে। আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, সেদিন, ম্লান হেসে কোনও হারিয়ে যাওয়া মুখের স্মৃতিকে বলে, দেখো, দেখে যাও, বেশ কিছু চুল আজ সাদা হয়ে আছে।
সেইসব দিনগুলোতে মাটির রাস্তা দিয়ে গরুগাড়ি যেত। দশ-বিশ বস্তা ধান মাঠ থেকে গেরস্থের ঘরে বা গেরস্থের ঘর থেকে হাটে বাটে নিয়ে যেতে অবলীলায় সারাটা দিন খুইয়ে দিতে পারত হাসতে হাসতে আর গান গেয়ে গেয়ে সেই গাড়ির গারোয়ান। দিল খোলা মেজাজে থাকত সেই সকালে চাট্টি পান্তাভাত খেয়ে দুপুর গড়িয়ে বিকেলেও। নানান গ্রাম ও প্রান্তরের পথে যেতে যেতে সে বহুবিধ রাঁধনের গন্ধ পেতো।
এইভাবে শান্তির দিকে ঝুঁকে থেকে তখন গরুগাড়ি চালানো কোনও আহামরি ব্যাপারেই ছিল না।

************
বাচ্চাটা একটানা কাঁদছে আর শরীরে সেকারণে অক্সিজেন কমে গেলে ফুঁপিয়ে উঠছে। বা, ঘোর লেগে গিয়ে থাকতে পারে আর স্নায়ুর ব্যাপারে কেউ একেবারে পাকা কথা বলতে পারে না।
আমার ভেতরের সেই বাচ্চাটাকে নির্দিষ্ট বিরতিতে নানা মনোহারি বস্তু ও ঘটনায় জর্জরিত করে রাখার আয়োজন থাকে।
শান্তির ব্যাপারে কেউ তেমনকিছু বলতে পারে না। একটা উদ্ভট খেলার মধ্যে বারবার জড়িয়ে পড়তে বলে, এছাড়া তারা কিছু বলে না।
আমি তখন হতাশ হবার ভঙ্গি করতে করতে, কেননা সেরকম করাটাই সেসময় যুক্তিপূর্ণ আচরণ মনে হয়, বলি: উৎপাদন শিখেছে বলে মানুষ কি তবে নিজের যাবতীয় সমস্যা বাড়িয়ে ফেলেনি? কিছু কাল্পনিক সাফল্য আর আনন্দ বানিয়ে ইঁদুর হয়ে থাকে যা আসলে তাকে অপরের মুনাফায় ব্যবহৃত করার মজুরি-ফাঁদ।
…এমনও হয়, সবসময় যে আমার কথায় সায় দেবার লোক থাকে তাও নয়। তখন সেরকম একজন বিচারবুদ্ধির মানুষ বলে যে, দেখুন। উৎপাদন তো মানুষ ছাড়াও সামান্য কিছু অন্য জীবও করে। যেমন মৌমাছি।
আমি মরিয়া হয়ে তখন বলব, দাঁড়ান!
বেচার গরজ, বিক্রয়যোগ্য অবয়বের মূল্য হ্রাস করে। শুধু শিল্পের সমঝদার কোনও রেয়ার জীব তার সমস্ত উজাড় করে তুচ্ছ একটা চকমকি পাথর কিনে নিতে পারে। তেমন কেনা-বেচার মুহূর্ত বিরল।
কাঁচা রাস্তার ধুলোয় চাকা ঢুবিয়ে গরুগাড়ি যাচ্ছে, আমার মেজো পিসি শুদ্ধ গাওয়া ঘি আর রগরগে মশলা দিয়ে কবুতরের মাংস রান্না করছে… বাতাসে তখনও বিচিত্র কৃত্রিম গন্ধ স্থায়ী বসবাস শুরু না করার কারণে এবং ভারতবর্ষের মানুষের হৃদয়ে একমাত্র কংগ্রেস আর গাঁধী ফ্যামিলির প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য। …গরুগাড়ির গারোয়ান সেই সরলতা মাখানো ভারতীয় বাতাসে কবুতরের মাংসের সুগন্ধ পায় ও তার প্রভাতব্যপী উপবাসের ক্ষুধা তাকে আচমকা আচ্ছন্ন করে ফেলে। এক্ষেত্রে রন্ধনশিল্পীর হৃদয় ও দেহের কমনীয়তা তার মনে কোনও কল্পনা আনতে পারে কিনা বোঝা যায় না। তবে তার অকলুষ কন্ঠ থেকে অজানা অদেখা রাঁধুনির রান্নার প্রশংসা বেরিয়ে আসে মুক্তস্বরে “হায়রে খুসবু!”।
এইভাবে সেইসব ভালো দিনে গ্রামের গণ্যমান্য পরিবারের কুমারী আর অজানা দীর্ঘ অভূক্ত গরুগাড়ি চালকের কাহিনি তৈরি হতো।

************
পদক্ষেপ কেউ একা একা নেবার কথা ভাবতেই পারে। কিন্তু তা কার্যকর হয় অনেকগুলো বিন্দু থেকে সক্রিয় অনুমোদন পেলে, তবেই।
অনেক মানুষই যেমন জানেনা কীভাবে নিজের সাথীকে শরীর দিতে হয়, মনে কখন কোন ভাব নিয়ে। অনেকেই হয় হতচ্ছেদ্দা করে দেহ দেয় নয় মনে বিদঘুটে অহংকার পুষে রেখে। এসব কথা এখন বেশ স্বচ্ছ ভাবে বুঝতে পারে সুকোমল। …সম্মান দিয়ে কেউ কোনওদিন, আজ অবধি, শরীর বিনিময় করেনি তার সাথে। দীর্ঘ জীবন হতচ্ছেদ্দার যেমন তেমন যোনি সংসর্গ করে করে মনের মধ্যে অশান্তির বিষ জমে আছে।
আচমকা কেউ জানতে চায়, ধানের দাম পেলনা বলে জীবনের সব আনন্দ ভেস্তে গেল?
সময় নিরুত্তর থাকে।
তখন কেউ খুব বিনীত, মিহি আর স্পর্ধাহীন উচ্চারণে বলে, শুধু কি ধান…ধান তো আমাদের জীবনে একটা প্রতীকের নাম। কী নয় বলুন! ফসলের জমিতে পরিবার সমেত সারাজীবন খেটে মজুরিও তো ঠিক মতো উঠে আসে না। এই বাংলায় সকলেই তো প্রায় প্রান্তিক চাষি। একরের পর একর বহুফসলি জমি, ট্রাক্টর, সেচ, ভর্তুকি, সুলভ বিদ্যুৎ এসবের মুখ কজন দেখতে পাই! ব্যাংক থেকে ভুয়ো লোন নিয়ে বাজার মাত করছে আর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দালালের সিন্ডিকেট আর গলায় পেটে গামছা বেঁধে হাহাকার করছে গরিব চাষি।
তখনও তো কেউ কেউ একা বসে কাঁদে। সেই কান্নায় তবে সে শান্তি পায়?
এমতো প্রশ্নে বিপন্ন হয়ে যায় শান্তি বিষয়ে কান্না সংক্রান্ত প্রস্তাব।
দেখো, পূর্ণতা, তা সে যেমনই হোক, মন শরীর অর্থ বা অন্যকিছুর, তার থেকেও লুকোনো কান্না উঠে আসে। কিন্তু শূন্যতা থেকে উৎসারিত ক্রন্দন বিলাসিতার জন্য নয়। তাতে বায়ু বিদীর্ণ হয়।
কান্না সারাক্ষণ ঘুঙুরের মতো বাজে, পায়ে পায়ে ঘোরে। আবহে বেজে যায়।
মাটির রাস্তা দিয়ে যেদিন গরুগাড়ি চলে যেত, সেইসব সাদাকালো দিনেও তো বাতাসে সুরন্ধনের সুবাস কারও ক্ষীণ স্মৃতির ক্ষরণ বুকের মধ্যে গুমরে উঠতো।
একটা জীবৎকাল কান্না দিয়ে সাজানো থাকে।
কী মাস্টার, ঠিক বলেছি? এই প্রশ্ন করে উত্তর শোনার গরজ না দেখিয়ে মাতৃভাষার মতো বাংলা বলতে পারে রামবিহারি পান্ডে, যে খুব বাচ্চা বয়সে পাড়াতুতো কাকার হাত ধরে কলকাতা চলে আসে আর একটু বড় হয়ে মানুষটানা রিকশা চালাতে শেখে, সে, হাঃ হাঃ করে হাসতে হাসতে ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

************

আর তার পরেও কিন্তু গল্পটা চলতে থাকে। গরুগাড়ি, সত্যি বলতে কী, যখন নিরেট গরুতেই টানে, সেই গাড়ির চাকার গতি জীবদুটির সম্মিলিত ক্ষমতা ও দক্ষতার উপর এবং তা চালকের কৌশলের সাথে যুগপৎ সমন্বয় সাধনের মাত্রার উপর নির্ভরশীল।
এখানে যদিও গতি নয়, গারওয়ানের মনের আনন্দ আর সীমিত বস্তুর সাথে বেঁচে থাকার নির্ভার ছন্দ বিষয়ে কথা হতে পারে। সেটাই কাঙ্খিত। পাশাপাশি কান্নার একটা মিহি অথচ পারাপারহীন গান চলুক। নির্ভরশীল হয়ে থাকুক জীবন, বারবার।
মোস্তাক বলে, পিঁয়াজের বিজনেস দাদা, বাংলাদেশে এক্সপোর্ট করি, খুব লাভ, বুঝলেন।
আমাকে এসব বলছ কেন?
আসলে, মনের মানুষ কোথা পাই, বলুন। আপনার মুখ দেখে মনে হলো মুসলমানরা গোরু খায় বলে আপনি ওদের ঘেন্না করেন না। ভাবুন, ঘেন্না, স্রেফ গোরু খায় বলে?
জীবের বিষয়ে, দেখো, আরও কিছু কথা থেকে যায়। আমাকে সহজ ভাবে নিয়েছ কেন জানিনা।
“বাংলাদেশে মাটি কিনা আছে আমার।” …সে বলল, আর সেই স্টেটমেন্ট শুনলাম আমি। একটা ফুলস্টপ ছাড়া অন্য কিছু কি রাখা ছিল বাক্যটির শেষে? যা, আমাকে থামিয়ে দেওয়া ছাড়া বাড়তি কিছু কাজ দেয়?
শুয়োর খাওয়ার জন্য ঘেন্না করা হয়।
হ্যাঁ, হয়।
বিষয়টা সেই একই।
মাংসের পরিচয় শুধু আলাদা।
দেখো, সেই গরুগাড়ি চালক, ক্ষুধা নিয়ে সকাল থেকে পথের ক্লান্তিও ছিল, ছোট পিসির রাঁধনের ঘ্রাণ তাকে মোহিত করেছিল। সে কিন্তু জানতো না, কী রান্না হচ্ছে, নিভৃতে…তার চোখের আড়ালে…
সুরন্ধনই মূল…
বটে তো…
দেখো, রাঁধুনি বা পথিক কেউ কাউকে আগে বা পরে, কোনও দিন চাক্ষুষ করল না, অথচ তাদের মধ্যে দুর্বার প্রেম ঘটে গেল। আকাঙ্খা জন্ম নিল। আশ্চর্য না?
গল্প তো এভাবেই জন্ম নেয়।
বাংলাদেশে পেঁয়াজ সাপ্লাই দিয়ে মোটা টাকা করার পরও অনিরাপত্তা কুরে কুরে খায় বদরুল আলম কে। সে নানান ফিকির বের করে আর বাংলাদেশে দুচার কাঠা জমি কিনে রাখে। তখন সে যেন কিছু নিরাপদ হয়।
…সে কি তবু কাঁদে?
গোপন ক্রন্দন, যা তাকে ভিন দেশে নানাবিধ অনিয়ম করে জমি কিনে রাখতে বাধ্য করে, তা কি তাকে কাঁদায় না! দ্যাখো, কান্না তাকে, আসলে, জমি কিনতে বাধ্য করে। এটুকু বুঝতে না পারলে তুমি নিজেকে কী জবাব দেবে।
দিনগুলো তখন কি সত্যিই জটিল হয়ে যায় না?

************

সুপ্রিয় মজুমদার শোনে, গৌরব ভট্টকে:
“…দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি তখন দ্বিমুখী ছিলই, কিন্তু বড় সাফ সাফ ছিল সমীকরণ। নেহরুর রাশিয়া-মডেল-নির্ভর গোষ্ঠিনিরপেক্ষতা, তার মেয়ে ইন্দিরা, নিক্সনের আমেরিকার কাছে খাদ্যশস্য ভিক্ষা করতে গিয়ে বুঝতে পারলেন, হয়ত অচিরেই ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।
তবু যুযুধান দ্বিমুখী কূটনীতির কাছে শিক্ষা নিতে নিতে পাকিস্তান কে বিচ্ছিন্ন করলেন। রাশিয়া তখনও হাত ধরে। …
কিন্তু দ্যাখো, পরিষ্কার ছিল সবকিছু।
তারপর ব্যাংক গুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হলো, কৃষিতে হাইব্রিড বীজ, কীটনাশক, কেমিক্যাল ও অর্গানিক সারের মাটিপরীক্ষা নির্ভর মাত্রার প্রয়োগ, বণ্টন ব্যবস্থা। ওদিকে অপারেশন ফ্লাড। ভারত নিজের পায়ে ক্রমশ। …অনেক ফসলের বস্তা গরুগাড়ির চাপিয়ে ভারতের প্রান্তজন গান গেয়ে নিশ্চিন্তে গ্রামের রাস্তায় রাঁধনের গন্ধ নিতে নিতে চলল। …”
গৌরব ভট্ট কিছুটা ক্লান্ত স্বরে সুপ্রিয় মজুমদার কে বলছিলেন, “দেখো বাপু, সেই ১৮৫১ তে বম্বের কাপড় মিলে মজদুররা সংগঠিত হয়েছিল। তারপর দীর্ঘ দিনের নানার ওঠা পড়া শেষে ১৯৭০ এ সিটু এলো অস্তিত্বে।”…
সুপ্রিয় থামায়, কেন, আইএনটিইউসি? সে তো সম্ভবত ১৯৪৮ থেকে?
অত জট পাকিও না সুপ্রিয়, যা বলছি তার সারকথা বোঝো।
গোষ্ঠিনিরপেক্ষ ভারত কীভাবে শান্তির ব্যাপারে তার মানুষদের উৎকণ্ঠা নিবারণ করতে পারল সেই গল্প শোনাও।
কী জানো তো, সুবিধাহীন দিন গুলোয় মানুষ অনেক নিরপেক্ষ ভাবে জীবনযাপন করতে পারত, বুঝলে? আর পার্টির এমন কোন্দল একেবারেই ছিল না। এখন, বলো, মাঠে ঘটে সেইরকম মনখোলা দরাজ গলায় গান শুনতে পাও? আর সেই গান শুনে কি তোমার মৃত পিতামহের সুবিধাহীন যাপিত জীবনের ছাপ লেগে থাকা মুখ মনে পড়ে গিয়ে বুকের ভেতর কান্না উপচে আসে না?
পরে তো আমাকে চীনের দালাল বলা হলো…! সে তখন আরও বলল, বক্তব্যে আসলে যোগ করলো, “আপনার রাজনীতি জ্ঞান খিচুড়ি পাকিয়ে গেছে স্যার।”
তারপর সব চুপচাপ হয়ে গেল।

************
সনাতন মণ্ডল মোটেও বুঝতে পারেন না, সমস্ত কুচুটেপনার উপরে একজন মানুষ একা একা উঠে যেতে পারে কিনা।
তাই এই একবিংশ শতাব্দীতেও সনাতন একজন সাধারণ মানুষের ধর্ম মেনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে ছিলেন।
তখন রাস্তা দিয়ে ভোটের মিছিল যায়।
তখন রাস্তা দিয়ে হরিনাম সংকীর্তন যায়।
তখনও রাস্তা দিয়ে অটো, বাস, বাইকের পাশাপাশি দুএকটা গরুগাড়ি বড় সঙ্কোচে একপাশ ঘেষে কোথাও যেতে চায়।
তখনও রন্ধনের সুবাস বাতাসে ভেসে থাকে আর সক্কাল বেলা কাজে বেরোনো শ্রমিক দিনশেষে তবু ঘরে ফেরার নেশায় একাগ্র হয়ে থাকে। শ্রম-অবধির সমাপনে মুনাফার হিসাব জানতে পারে না।
তাকে আজ বলা হয়, একটা বিরিয়ানির প্যাকেট ও তিনশো টাকা মজুরি দেওয়া হবে একদিনের জন্য। ব্রিগেডে নামতে হবে ট্রাকে চেপে যেতে হবে। ফ্রি তে কলকাতা দেখতে পাবে।

কোথাকার গল্প কোথায় চলে যায়…।

Facebook Comments

1 thought on “শান্তির ব্যাপারে উৎকণ্ঠা ও বিবিধ প্রস্তাব : সঞ্জীব নিয়োগী Leave a comment

Leave a Reply