এসো চোত মাস : নিলয় সমীরণ নন্দী

নয় বছরের সীতা দৌড়াচ্ছে। পিছন থেকে সমুদ্রের আওয়াজটা তার জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। সবুজ ঝাউবন ভেদ করে লাল রঙের ফ্রক পড়া সীতা প্রানপনে দৌড়াচ্ছে। তার সাথে দৌড়াচ্ছে লক্ষ বছর আগের মানুষের ডিএনএ। যারা ধীরে ধীরে ঘর বাঁধতে শিখেছে। যুদ্ধ করতে শিখেছে। গান লিখতে শিখেছে। সীতার হাতে ধরা চকলেটটা মাটিতে পড়ে গেলো। সীতা ঝাউবন পেরিয়ে একটা ছোট্ট খোলা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। খোলা জায়গাটার একেবারে মাঝখানে কেয়া একটা সতরণচীর এক কোনায় বসে বসে ফয়লে মোড়া বিভিন্ন খাওয়ার একটা বড় বাস্কেট থেকে বের করছে। বিদিশা আরেক কোনায় বসে বসে শশা, আপেল, পেয়ারা, ন্যেষ্পাতি কেটে কেটে একটা বড় কাঁচের পাত্রে পর পর সাজিয়ে রাখছে। বড় বাস্কেটের পাশে আটটা বড় বড় হটপট। একটু দূরে একটা বড় শীতলপাটিতে তন্ময়, সৌরভ আর জিৎ রামের আসর জমিয়ে বসেছে। বাপন গ্লাসে গ্লাসে মদ ঢেলে দিচ্ছে আর বিভিন্ন ছোট ছোট কাঁচের বাটিতে রাখা কাজু, কিসমিস, ঝুড়িভাজা, চানাচুর, চকলেট, কুকিজ তাদের হাতের সামনে এগিয়ে ধরছে। পাশেই একটা গাছে হেলান দিয়ে অর্ণব মদের গ্লাসে অল্প অল্প চুমুক দিচ্ছে। সে দূরে মুমুর দিকে তাকিয়ে আছে। রাধাঘাটে যেভাবে স্নান সেরে ঘনশ্যাম খিচুড়ি খেতে বসে। যে ভাবে ভেনাস ড্যাফোডিলগুচ্ছের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে। সেইভাবে অর্ণব মুমুর শরীরখানা চুমুক করে নিচ্ছে। মুমু একটা বড় ফ্রুটকেকের ওপর কোন দিয়ে খুব যত্ন করে লিখছে, “সৌরভ ও জিৎ/ শুভ জন্মদিন/ বাইশে চৈত্র/ সাল আলাদা”। বাপন এক এক করে কেয়া, বিদিশা আর মুমুর কাছে মদের গ্লাস দিয়ে এলো। চারিদিকে ছোটো ছোটো কুশান ছড়ানো। লাল নীল কুশান। হলুদ সবুজ কুশান। সাদা কালো কুশান। সোনালী রুপালি কুশান। ঘোর লাগা কুশান। চাঁদ মাখা কুশান। বিরহী রস শুকিয়ে যাওয়া কুশান। ঝাউবনের কিনারায় সীতা এখনো ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। সহস্র বছর ধরে কুঞ্জ প্লাবিয়া সীতা সঠিক কোনো সময়ের অপেক্ষা করতে থাকে। ত্রিকাল যেনো তার পাদপদ্মে কুয়াশার মতো জমে আছে। তার দিকে কারোর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। জিৎ, সৌরভ আর তন্ময় প্রেম আর অপ্রেম নিয়ে এক বিরাট তর্কে মেতে আছে।
জিৎ- “প্রেম বলে কি আদেও কিছু এক্সিস্ট করে?”
সৌরভ- “আমরাই কি এক্সিস্ট করি?”
তন্ময়- “না, এই মুহুর্তে আমরা যখন ভাবতে পারছি, আমরা ধরে নিচ্ছি আমরা আছি। এখান থেকে আমরা আলোচনাটা শুরু করতে পারি।”
জিৎ- “প্রেম বলে কিছু নেই। এবং প্রেম নেই অবস্থাতেই আছে। প্রেম সর্বদাই অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই তুঙ্গ, তুরীয়, ক্ষণিক ও খন্ড। জীবনের লক্ষ্য এই খন্ড অংশ থেকে পূর্নতা প্রাপ্তি।”
সৌরভ- “পৃথিবীতে এই মুহুর্তে ৭৭ শতাংশ মানুষ অভুক্ত আছে। তাদের কাছে প্রেম কি নেই অবস্থাতেই আছে?”
তন্ময়- “হম্ম। এবং ইহাই অপ্রেম। অপ্রেম আছে বলেই প্রেমকে থাকতে হচ্ছে। দুটো আলাদা কিছু নয়। প্রেমের ধাপে পৌঁছাতে গেলে তোমাকে অপ্রেমের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এটা একটা যাত্রা। এবং যাত্রাপথটি অবশ্যই গোল। সে কোথাও পৌঁছায় না। সে একই সাথে ক্ষণিক এবং পূর্ণ।”
জিৎ- “মানে প্রেম একইসাথে পূর্ণ ও অপূর্ণ দুটোই এবং কোনোটিই নয়। প্রেমিক হিটলার কি প্রেম সম্পর্কে তবে উদাসীন? জীবনানন্দের ছোটো গল্পগুলোর মতো? রাশিয়ান সাহিত্যের মতো ঠান্ডা? জাপানী ছবিগুলোর মতো অনন্ত?”
সৌরভ- “অতীশ দীপঙ্কর পথে নেমেছিলেন প্রেম নেই বলে। কিন্তু যত এগোতে লাগলেন দেখলেন পৃথিবী প্রেমময়। আবার লাকা রাস্তায় নামলেন প্রেম আছে বলে। কিন্তু তিনি দেখলেন জীবন অপ্রেমে ঠাঁসা এক অগভীর নদী।”
তন্ময় মদের গ্লাস ওপরে তুলে ধরলো,
তন্ময়- “চিয়ার্স টু লাইফ, সে প্রেমে থাকুক কি অপ্রেমে?”
বাপন আর সীতা বাদে বাকিরাও সবাই মদের গ্লাস ওপরে তুলে ধরে বললো, “চিয়ার্স”। চারিদিকে নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে। বাপন আর একটা মদ ভরা গ্লাস নিয়ে চারিদিকে তিস্তাকে খুঁজতে লাগলো।
মুমু- “কেয়ারটেকার দাদা, গ্লাসটা তুমি ওই অর্ণবদার হাতে দাও। তিস্তা তার দুই জামাইবাবুর জন্য তোমাদের এই দ্বীপে জংলী ফুল খুঁজতে গেছে।”
বিদিশা- “মুমু তোর ডাকগুলো এত বাজে না। কেনো মানুষটার কোনো নাম নেই নাকি!”
কেয়া- “তোমার নামটা কি যেন বেশ ভাইটি?”
বাপন- “জি, মোহাম্মদ বাপন চৌধুরী।”
কেয়া- “মুসলিমও চৌধুরী হয় না!?”
বিদিশা- “আচ্ছা, এই দ্বীপটায় তো একটা ফোনেও টাওয়ার নেই। সেই যে সকালে আমাদের ছেড়ে দিয়ে চলে গেল, সন্ধের আগে লঞ্চটা আবার চলে আসবেতো? আমার না কিরকম ভয় ভয় করছে।”
বাপন- “ওটাইতো এই দ্বীপে পিকনিক করতে আসার মজা। আজ এই চোদ্দো বছর এই দ্বীপে কাজ করছি, ছুটির সিজিন তো ছেড়েই দিন, তখন কোনো বুকিংই পাবেননা, এছাড়া সারা বছরই কোনো শনি রবি আমার ছুটি নেই। একমাত্র ওই করোনার সময়টাতে সাত আট মাস যা সরকার থেকে বন্ধ রেখেছিল।”
মুমু- “ও তোমার এটা সরকারি চাকরি না! ইশ কি আরামের চাকরি।”
বাপন- “বর্ষাকালটা খুবই কষ্টের। এখানে প্রায় দশ বারোটা দ্বীপ আছে পাশাপাশি। বৃষ্টির সময় প্রায় সবগুলোতেই জল ঢুকে যায়। তখন ওই প্রতিটা দ্বীপে নেমে নেমে জায়গা খোঁজা খুব চাপ।”
বিদিশা- “রাতেও অনেকে এখানে স্টে করে না?”
বাপন- “সরকার থেকে এখন আর নিয়ম নেই। কিন্তু আগে কলেজের ছেলেমেয়েরা আমাদের কিছু এক্সটা টাকা দিলে, আমরা ওদের এক রাতের জন্য পুরো দ্বীপটা ছেড়ে দিতাম। সকালে আবার লঞ্চ এসে ওদের নিয়ে যেতো।”
কেয়া- “আচ্ছা ভাইটি, ওই মিসিং কেসের খবরগুলোর কি হলো?”
বাপন- “লাশইতো কোনোদিন পাওয়া গেলো না। ওদের ভিতরকার গন্ডগোল বুঝেছেন। ইয়ং ইয়ং সব ছেলে পিলের দল, এক এক জনকে সব রাজপুত্তুরের মতো দেখতে। শরীর গুলো থেকে যেন আলো ঠিকরে ঠিকরে বেরোচ্ছে। লঞ্চ চলে যেতেই দেখি হঠাৎ সবাই জামাকাপড় খুলতে শুরু করলো, এ ওকে জড়াচ্ছে, ও একে চুমু খাচ্ছে, তারপর সব কুকুরের মত … রাতের টাকা আগেই দেওয়া ছিল। আমি তো সন্ধ্যে বেলায় চলে গেলাম লঞ্চে করে। পরের দিন সকাল বেলা ফিরে এসে দেখি কেউ কোথাও নেই। পুরো দ্বীপ খাঁ খাঁ করছে। রাতারাতি সব ভ্যানিশ।”
সবাই কিছুক্ষণ কি বলবে বুঝতে পারলোনা।
বাপন- “গরীব মানুষ আমরা, চাকরি নিয়ে কি টানাটানি। তারপর থেকে রাতে থাকাটা বন্ধ হয়েছে।”
মুমু- “অর্ণব, যাও তো ওই বাপনদার হাত থেকে মদের গ্লাসটা নিয়ে তোমার হবু বউকে গিয়ে দিয়ে এসো।”
অর্ণব সলজ্জভাবে গ্লাসটা নিয়ে ঝাউবনের ভিতরে ঢুকে পড়ল। বাপন একটা বিড়ি ধরিয়ে বললো,
বাপন- “আপনারা তাহলে চার বোন?”
কেয়া- “হুমম, আমাদের ছোট বনেরই খালি বিয়ে হয়নি। ওই অর্নবের সাথেই ওর প্রেম। ওর নাম তিস্তা। আগের বছরই ওর বিয়ের ডেট ফিক্সড ছিল। কেনাকাটা শুরু করে দিয়েছিলাম, বিয়েবাড়ি বুকড, কার্ড ছাপাতে দেওয়া হয়ে গেছে। এমন সময়েই তো লকডাউন হয়ে গেল। ও হচ্ছে বড়, বিদিশা। ওর বর হলো গিয়ে ওই দাড়িওয়ালা দাদাটা, সৌরভদা। এ হচ্ছে মেজ,ভালো নাম শতরুপা, আমরা ডাকি মুমু। ওর বর ওই লম্বা লোকটা, জিৎদা। আর আমি হচ্ছি সেজো, কেয়া। ওই বেঁটে লোকটা আমার বর, তন্ময়।”
বাপন- “তারমধ্যে দুই ভায়রাভাইয়ের আজকে একই দিনে আবার জন্মদিন। বেশ মজার। আপনাদের দুজনের দুটো ছেলেমেয়ে। আর সেজদিদির তো খুব শিগগিরই হবে। আহামদুল্লিলা।”
কেয়া নিজের ফোলা পেটের উপর একটা হাত রেখে হাসত লাগলো।
বিদিশা- “নাগো, পুচকে দুটোই আমার এই মেজ বোনের। সীতা আর আদর।”
হটাৎ তিন বোনেরই সম্বিৎ ফিরলো। তারা দূরে তাকিয়ে দেখে সীতা একা একা একটা গাছের নিচে চুপচাপ বসে মাটিতে কি সব আঁকিবুঁকি কাটছে। তার সারা লাল ফ্রকে, হাতে, পায়ে বালি ভর্তি। মুমু- “সীতা, ভাই কই?”
সীতা- “আমার পিছন পিছনই আসছিল। তারপর পিছন ফিরে দেখলাম নেই। একটা লেংটো মেয়ে, নিচটা মাছের মতো, সমুদ্রের ধারে আমাদের ডাকছিল।”
সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। মুমু সীতাকে কাছে ডাকে। তারপর সীতা মুমুর কাছে আসতেই, সীতার ছোট্টো নরম গালে জোড়সে একটা চড় বসিয়ে দেয়।
মুমু- “কতবার বলেছি চোখের আড়াল হবিনা? কথা কানে যায় না? তোদের জন্যে ক্যরিয়ারটা তো বিসর্জন দিয়েইছি, একদিন একটু মনের সুখে মদ খাবো তার জো নেই। এখন এই বাতের পা নিয়ে আমি আদরকে কোথায় খুঁজতে যাবো?”
বিদিশা- “মুমু চেঁচামেচি করিস না। ছেলেরা শুনতে পেলে এক্ষুনি তুইই বোকা খাবি। তুই বোস, এদিকটা সামলা। আমি সীতাকে নিয়ে আদরকে নিয়ে আসছি। যাবে আর কোথায়, দেখবি এখানে কোথায় লুকিয়ে আছে। ওমা সেই বাপন ভাই কোথায় গেলো?”
কেয়া- “দেখো কোন ঝাউবনের পিছনে হাগতে বসেছে। সারাক্ষণ এখানে কথা বলতে বলতে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে গেলো। ভেবেছে আমি ধরতে পারবো না।”
বিদিশা সীতাকে নিয়ে ঝাউবনের মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগলো।
সীতা- “সত্যি বড়মাসি, তুমি বিশ্বাস করো আমি নিজে চোখে দেখেছি। মেয়েটার মাথায় লাল চুল। চোখের একটা মণি নীল অন্যটা সবুজ। আর গায়ের রং সোনার মতো হলুদ।”
বিদিশা- “ওদেরকে মৎসকন্যা বলে।”
সীতা- “তুমি মৎসকন্যা দেখেছো?”
বিদিশা- “আমি ছোটবেলায় একবার পাহাড় দেখতে গিয়েছিলাম। তখনো তিস্তা, তোর ছোটো মাসি মায়ের পেটে। পরপর তিনটে মেয়ের পর যাতে এবার একটা ছেলে হয় তাই বাবাকে কে বললো পেডংয়ে এক প্রাচীন গুহার মধ্যে এক বনদেবতা থাকেন, সেখানে গিয়ে মানত করতে। মূর্তির মাথাটা হরিণের মতো, তাতে হাজার হাজার সিং ডালপালা মেলেছে। মুর্তিটার গলা থেকে পা অব্দি কুচকুচে কালো পাথরে তৈরি, খাঁজ কাটা গ্রীক দেবতাদের মতো। দেবতার গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। তার দুই কাঁধে তার দুই বউ। তাদের শরীর দুটো সাপের, কিন্তু মাথা মানুষের মতো। তোর মা আর সেজোমাসিকে মায়ের কাছে হোটেলে রেখে বাবা আমাকে নিয়ে চললেন সেই গুহার উদ্দেশ্যে। একহাজার বত্রিশটা সিঁড়ি ভেঙে উঠলে প্রথমে এক ঝর্না। ঝর্ণার ভিতর দিয়ে গুহার মুখ। ঝর্ণা পেরিয়ে গুহার ভিতর ঢুকে দেখি চারিদিকে যেনো লক্ষ লক্ষ মাটির প্রদীপ জ্বলছে। দেবতার সামনে এক বৃদ্ধ বসে। তার বয়স নাকি দেড়শো ছাড়িয়েছে। বাবাকে সে ভাঙা ইংরেজি, ভাঙা বাংলা, ভাঙা হিন্দি আর নেপালী মিলিয়ে যা বললো, তার অর্থ হলো যে পুত্র সন্তান পেতে হলে তার বদলে নিজের একটি কন্যা সন্তানকে বনদেবতার হাতে পূর্ণিমা রাতে সোপে দিতে হবে। সেই মতো দুদিন পর বাবা কাউকে কিছু না জানিয়ে ভরা পূর্ণিমার রাতে আমাকে রেখে এলো ঝর্ণার মুখে। রাত যতো বাড়তে লাগলো মূর্তি যেনো জেগে উঠতে লাগলো। তারপর বনদেবতা যতো এগোতে লাগলো আমার সারা শরীর পাথরের মতো হয়ে যেতে লাগলো। এমন সময় হঠাৎ দেখি সিঁড়ির দিক থেকে বাবা ছুটে এসে আমাকে নিচে ফেলে দিলো। আমি গড়িয়ে নীচে পড়তে শুরু করলাম আর কানে এলো বাবার বীভৎস আর্তচিৎকার। আমি শুধু নীচে গড়িয়ে পড়ছি তো পড়ছি, পড়ছি তো পড়ছি, পড়ছি তো পড়ছি, পড়ছি তো পড়ছি, পড়ছি তো পড়ছি। পরদিন তিস্তা নদীতে বাবার লাশ পাওয়া গেলো। হোটেলের কামরায় একটা ফুটফুটে মেয়ে হল আমার মায়ের। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করলোনা। মা সদ্যজাত মেয়েটার নাম রাখলো তিস্তা।”
ওরা চুপচাপ দুজনে ঝাউবনের ভিতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। সামনেই কৌরব বংশ আর টিউডর বংশের কেচ্ছা কাহিনী যেকোনো সময় মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়তে পারে। এদের সেদিকে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। মনের ক্ষেতে ভুট্টাদানার মতো দুঃখ রোদের নীচে হা করে বসে আছে। সমুদ্রের আওয়াজটা চারিদিকের নিরাবতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। ঝাউবন পেরিয়ে সমুদ্রের ধারে আসতেই, দ্বীপের আরেক প্রান্ত থেকে অদ্ভুত গোঙানি আর চাপা কান্নার আওয়াজ আসতে লাগলো। ওরা সমুদ্রের পার ধরে হাঁটতে শুরু করলো। দ্বীপের একটা বাঁক ঘুরতেই দুজনে থ মেরে দাঁড়িয়ে পড়লো। প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় তিস্তা সমুদ্রের পাড়ে অর্ধ অচেতন হয়ে পড়ে আছে। তার মুখ থেকে একটা চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। বালির ওপর মদের গ্লাস দুটোতে সমুদ্রের জল খেলা করছে। আর বালির ওপর পড়ে থাকা অর্ণবের সম্পূর্ণ নগ্ন দেহের ওপর বাপন উঠে একটা বড় পাথর দিয়ে তার মাথায় ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে। বাপনের নাক ফেটে সারা মুখে রক্ত আর বালি লেগে আছে। বিদিশা তাড়াতাড়ি তিস্তাকে তুলে ধরলো। তার গায়ে নিজের ওড়নাটা খুলে জড়িয়ে দিলো। পিছনে বাপন পাথর দিয়ে অর্ণবের মাথাটা বালির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। বিদিশা ধীরে ধীরে তিস্তা আর সীতাকে নিয়ে ঝাউবন ভেদ করে এগিয়ে চলেছে আর মাঝে মাঝেই ঝাউবন চিড়ে ডাক ছাড়ছে,
বিদিশা- “আ-দ-র…”
সীতা- “আ-দ-র…”
তিস্তা প্রলাপের মতো বকতে থাকে,
তিস্তা- “আচ্ছা, যদি বৃষ্টি শুরু হয় আমরা কোথায় যাবো? আমরা কি ছাতা এনেছি? একটা বড় ছাতা। লাল রঙের ছোটো ছোটো হার্ট আঁকা। একটা বিরাট বড় ছাতা, যার তলায় আমরা সবাই ধরে যাবো।”
দূর থেকে মুমু আর কেয়ার গলা ভেসে আসছে। ওরা গাইছে, “তুমি ছেড়ে ছিল বলে, ভুলে ছিলে বলে, হেরোগো কি দশা হয়েছে …”। ওরা জানেনা মৎসকন্যা একসঙ্গে হাজার জনের গলা নকল করে গান গাইতে পারে। গান গেয়ে সে তার জন্যে যৌনসঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। এক জন্মে একটা মৎসকন্যা একবারই মাত্র যৌন সঙ্গম করতে পারে। তারপর সে মাছ হয়ে যায়। সত্যিকারের মাছ। মানুষ সেই মাছ জাল ফেলে গভীর সমুদ্রের পাতাল থেকে তুলে আনে। মানুষের সন্তানেরা ক্ষিদে পেটে অপেক্ষা করতে থাকে সেই মাছ খাবে বলে। মায়েরা কাঁচা লঙ্কা, পোস্ত আর টক দই দিয়ে মাছের কালিয়া রান্না করে। গরম গরম ভাত রান্না করা হয়, অপেক্ষারা অপেক্ষাকে খাবে বলে। জিৎ, সৌরভ আর তন্ময় গানের সুর ধরে এগোতে থাকে। তারাও কানাঘুষো শুনেছিলে, এই দ্বীপে নাকি মৎসকন্যা আছে। তারা পাগলের মতো ছুটতে শুরু করে। গানের সুরে তাদের নেশা ধরে গেছে। তারা বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে গায়ের সব জামা কাপড় খুলে ফেলেছে। ঝাউবনের মধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়েছে। দুটো দল একে অপরকে দেখতে পাচ্ছেনা। কেয়া আর মুমু ঘুমিয়ে রয়েছে অনেকক্ষণ হলো।

Facebook Comments

Leave a Reply