মোহমুক্ত সমাজতাত্ত্বিকের চোখে দেবীপ্রসাদ : ড. কৌশিক চট্টোপাধ্যায়
ভূমিকা
শৈশবে অনেক কবিতার সঙ্গে একটি কবিতা আনন্দের সঙ্গে আমি আবৃত্তি করতাম। আমার মতো অনেকেই তা করতো। শৈশবের সরল চিন্তায় ভাবতাম, বাবা আমার মনের মধ্যে থাকেন। বাবার কথা মনে হলে তার চেহারাটা মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। ভাবতাম, তাহলে এটিই কবিতাটির অর্থ। মাথা একটু গুলিয়ে যেত যখন মায়ের কথা মনে পড়ত, তার স্নেহভরা চেহারাটা মনের আয়নায় ভেসে উঠত।
কবির ওপর একটু অভিমানও হতো। কবি কেন লিখলেন না, “ঘুমিয়ে আছে শিশুর মাতা, সব শিশুরই অন্তরে”। নিজের মনেই বুঝে নিতাম, কবি তো একজন বাবা। তাই বাবার কথাই লিখেছেন। মা হলে মায়ের কথা লিখতেন।
আজ পরিণত বয়সে শৈশবের খেয়ালি চিন্তা আর কবিতার সরল অর্থগুলোর কথা মনে পড়লে হাসি পায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষ কবি তো পিতার কথাই লিখবেন, যদিও মা তার সবচেয়ে আপন। কবি মায়ের কোলেই বড়ো হয়েছেন। মনীষীরা মায়ের কথাই বেশী বলেছেন।
সেখানেও গণ্ডগোল। গোল বাঁধালেন ফ্রয়েড। এই ফ্রয়েড সাহেব “লিবিডো”র কথা বললেন। সব ধরনের সম্পর্কের মধ্যে যৌনতা খুঁজলেন। তাত্ত্বিক দিক থেকে সেটা প্রতিষ্ঠাও করলেন। মা-ছেলে, বাবা-মেয়ে, ভাই-বোন, সকল সম্পর্ক বন্ধনে তিনি যৌনতা দেখলেন। সামাজিক মূল্যবোধের বন্ধনকে অস্বীকার করলেন। এমন সমালোচনা যাই থাকুক, তিনি তা করলেন।
ফ্রয়েড সফল হলেন একটা কুয়াশার জন্ম দিতে। ভাবনার মধ্যে আচ্ছন্ন রাখতে। যে ভাবনায় একজন শ্রমিক তার শ্রমিকের চেতনায় বাঁচেন না। প্রতিবাদী সেখানে এক ধরনের বিতন্ডাকারীর “অস্বাভাবিক” চরিত্র হয়ে সংজ্ঞায়িত হন। ফ্রয়েড সেই সংজ্ঞা নিরূপণে এবং বিজ্ঞানের অবদানে প্রতিষ্ঠা পেলেন। সমাজের একটা অংশের এতে সুবিধা হল। আমরা প্রত্যক্ষ করলাম প্রতিবাদীর কণ্ঠস্বর প্রচলিতের বিরুদ্ধাচরণে পাগল সাজতে বাধ্য থাকছে। সামাজিক রীতিনীতি, শাস্ত্রের ভাবনা, তাকে সেটা সাজাচ্ছে।
ব্যক্তিকেন্দ্রিকতায় ব্যক্তি স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার বৈধতা দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে ওঠে। সামাজিক ঘটনার কার্যকারণ ব্যাখ্যায় নৈর্ব্যক্তিকতা পক্ষ নিতে পারে। আশঙ্কাপূর্ণ জীবনের মর্ম কথা আমরা শুনতে চাইলাম না, বরং মনের বিকাশ, স্বপ্ন, যৌনতা এবং সৃষ্টি ও ধ্বংসের নতুন সংজ্ঞায় সজ্ঞান ও নির্জ্ঞানের দ্বন্দ্বকে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা বলে ভুল করলাম। মানসিক নিয়তিবাদের জালে আটকা পড়লাম। এই বিশ্বাসে মনে করলাম যে মনোজগতেই বস্তুর উপস্থিতি এবং সেটাও তার অতীত ঘটনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
সুখপাঠ্য সমাজতত্ত্ব
মানব সম্পর্কের সংযোগ ধারার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ সমাজতত্ত্বে করা হয়। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতির প্রয়োগ, সেই বিজ্ঞানসিদ্ধতাকে প্রতিষ্ঠা করে। মানব সমাজের নানান আঙ্গিক গবেষণার বিষয় হয়। ব্যক্তি মানুষ থেকে গোষ্ঠীবদ্ধতার রূপগুলি শুধু নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক এবং বিষয়গত দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষিত হয় না, সেই সবের বিষয়ীগত পরিসরগুলিকেও সেখানে দেখতে হয়। ফলে সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সামাজিক শক্তির নিয়ন্ত্রণী উপায় এবং তার প্রকৃতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয়। শুধু তাই নয়, এই জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটিয়ে বৃহত্তর ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যক্তি-ক্রিয়ার প্রত্যক্ষ সংযোগ গড়ে তোলা সম্ভব হয়। সমাজবিজ্ঞানের অন্যান্য ধারাগুলির সঙ্গেও তখন সম্পর্ক স্থাপিত হয়।
নৃতত্ত্ব, অর্থনীতি, মনোবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চিন্তাধারা, তার ইতিহাসকে দেখার যে ধর্মতত্ত্বের আগল, সেটাকে ভেঙে প্রকৃতিবিদ্যায় বিজ্ঞান চর্চার প্রসার কিভাবে ঘটে –তা দেখা হয় সমাজতত্ত্বে। এখানে বোঝা যায় বিশুদ্ধ সমাজবিজ্ঞান সেই বিজ্ঞান চর্চাকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অন্বয় সাধনে কিভাবে ব্যবহারিক করে তোলে। পদ্ধতিবিদ্যার পেশাদার প্রয়োগ সেই ফলিত দিকটি নির্দেশ করে। বিশুদ্ধ সমাজতত্ত্বের বাইরে ফলিত সমাজতত্ত্ব সামাজিক সংস্কারের বিবর্তনী ছন্দ সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠে। সামাজিক প্রকৃতির এক যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যায় সামাজিক ঘটনার বর্ণনা ও সামাজিক সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান পথ-নির্দেশনা, সমাজতত্ত্বকে ব্যবহারিক দিক থেকে কার্যকরী করে।
এই ফলিত সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব ও মনোবিদ্যার ব্যবহারিক গবেষণামূলক দিকগুলিকেও পুনর্মূল্যায়ন করে। ফলিত মনস্তত্ত্ব, নিদানিক মনোবিদ্যা, শিল্প সংগঠনের মনোবিজ্ঞান ব্যক্তি সদস্যের মানসিক ও আচরণগত বৈশিষ্ট্যের নিরিখে নবাগত সদস্যের সামাজিকীকরণে নিয়তিবাদের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠা করে। মনোজগতের সকল ঘটনা পূর্বনির্ধারিত – সেই ব্যাখ্যাকে সমাজতত্ত্বের এই ব্যবহারিক ধারা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে। ব্যক্তিত্ব, চরিত্রের প্রলক্ষণ যদি পূর্ব নির্ধারিত হবে, তবে তার পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব? কার্যকে পরিবর্তিত করতে হলে তো কারণকে আগে পরিবর্তন করতে হবে! তবে বর্তমানে দাঁড়িয়ে সেই অতীতকে আমরা পরিবর্তিত করতে পারবো কিভাবে?
এইখানেই সমাজতত্ত্বে সুখপাঠ্য অস্ট্রিয়াবাসী নিদানিক মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড প্রশ্নচিহ্নের মুখোমুখি হন। শুধু ফ্রয়েড নন, ফ্রয়েডের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা জার্মান সমাজ মনোবিজ্ঞানী হগো মুনষ্টারবার্গও সমালোচনার মুখোমুখি হন। মুনষ্টারবার্গ ফ্রয়েডের মতো অবচেতন স্তরের কথা স্বীকার করতেন না। বরং মানসিক প্রক্রিয়ার এক সমান্তরাল দৈহিক প্রক্রিয়ার হাজিরাও যে মানুষের মাথায় অবস্থান করে, তা তিনি মানতেন। মানসিক অসুস্থতার নেপথ্যে দৈহিক কারণগুলিকে তিনি খুঁজতে চাইতেন। কিন্তু সামাজিক কারণগুলি তাঁর সেই আলোচনায় গরহাজির থাকে। এই অসম্পূর্ণতা সমাজতত্ত্বের পাঠ্যে ধরা দিল, কিন্তু কোন সদুত্তর দিল না।
মোহমুক্ত সমাজতত্ত্ব
সমাজতত্ত্বকে হতে হবে মোহমুক্ত। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি হবে নৈর্ব্যক্তিক। মূল্যবোধ নিরপেক্ষ অবস্থানে একজন সমাজতাত্ত্বিক সামাজিক ঘটনার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করবেন। সহানুভূতিমূলক অন্তর্দর্শনে সমাজতাত্ত্বিক সেই কাজটা করতে পারেন। জার্মান তাত্ত্বিক ম্যাক্স হ্বেবার ‘ব্যক্তি স্তরের ক্রিয়া’ অনুসন্ধানে সেই নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান প্রসঙ্গে সমাজতাত্ত্বিকদের নির্দেশ করেছেন। ভারতের মাটিতে সমাজতত্ত্বের সেই বিকাশধারার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেছেন দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। তিনি সামাজিক ঘটনার যথার্থ বিশ্লেষণ মোহমুক্ত সমাজতাত্ত্বিকদের কাছ থেকে আশা করেছেন।
প্রশ্ন হল, ফলিত মনোবিদ্যার সমালোচনায় ব্যবহারিক সমাজতত্ত্বের দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার গুণেই কি দেবীপ্রসাদ একজন মোহমুক্ত সমাজতাত্ত্বিক? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানী হয়ে সমাজতত্ত্বের আলোকে দেবীপ্রসাদকে আমরা দেখতে পারি। তাঁর দার্শনিক চিন্তার স্রোতে নিজেদের একবার বইয়ে নিতে পারি। “মানুষের ভাগ্যবিধাতা” কিভাবে মানুষ হয়ে উঠছে তা দেখে নেওয়া যেতে পারে।
সেই আলোচনাকে আমরা তিনটি উপধারায় ভেঙে নিতে পারি। বোঝার সুবিধার্থে এই বর্গীকরণকে ধরে নেওয়া যেতে পারে। প্রথমেই দেখে নেওয়া যেতে পারে যে সমাজ মনোবিদ্যার পরিসরে নিদানিক দিকটি কতটা প্রাসঙ্গিক? মার্কসীয় দৃষ্টিকোণে ফ্রয়েডীয় মতবাদের আলোচনা কেমন হওয়া উচিৎ? এই প্রথম উপধারায় দেবীপ্রসাদের সমাজতত্ত্বকে মার্কসীয় সমাজতত্ত্বের আঙ্গিনায় উপলব্ধি করা যেতে পারে।
ফলিত সমাজতত্ত্বের ভারতীয় ধারাকে খুঁজতে দেবীপ্রসাদকে আমাদের কোথায় প্রয়োজন? সেই প্রশ্নকে সামনে রেখে দ্বিতীয় উপধারাটি হাজির হয়। এখানে তিনি ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষিতে ভাববাদের উৎসমুখগুলি শুধু খোঁজেন না, “বিষয়গত ভাববাদের” গুরুত্বকে স্বীকার করে নিয়ে “কিভাবে ভারতীয় ঐতিহ্যে বস্তুবাদী দর্শনের ধারাকে আমরা বুঝবো?” – সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানী হচ্ছেন।
তৃতীয় ও শেষ উপধারায় দেবীপ্রসাদ নিজে “মোহমুক্ত” সমাজতাত্ত্বিকদের কেন প্রশংসা করেছেন তা জানার চেষ্টা করা দরকার। এখানে মেঠো বা “র্যা ঙ্ক-এন্ড-ফাইল” মার্কসবাদী কিভাবে হওয়া সম্ভব তার সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। দেখা হতে পারে সাধারণ জ্ঞানের বিজ্ঞানাশ্রয়ী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দর্শনের প্রয়োগ কেমনভাবে সমাজটাকে পরিবর্তন করতে পারে।
প্রসঙ্গত, দেবীপ্রসাদ গল্প বলার মতো অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্যময় প্রাঞ্জল কথা কাহিনীতে বিজ্ঞানের প্রসারকে নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। পদ্ধতিবিদ্যার অন্বেষণ এবং ভারতীয় সমাজ-ইতিহাসে পরিক্রমা ধুর্জটিপ্রসাদ, অক্ষয় রমনলাল দেশাই-এর ঘরানায় দেবীপ্রসাদকে ভারতীয় সমাজতত্ত্বের একজন করে তোলে। এস সি দুবের মতো, অথবা এম এন শ্রীনিবাসের মতো দেবীপ্রসাদ ভারতীয় সমাজ, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলার অনুসন্ধান করলেও তিনি ক্রিয়াবাদের তুলনায় বস্তুবাদে বেশী আস্থাশীল। রাধাকমল মুখার্জীর অধ্যাত্মবাদী দর্শনেও তিনি ভরসা করেন না। বিনয় কুমার সরকারের প্রত্যক্ষবাদী ধারণার সহযাত্রী হন না দেবীপ্রসাদ।
ক) ফ্রয়েডীয় মতবাদের আলোচনায় দেবীপ্রসাদের সমাজতত্ত্ব
মন বলে আমাদের দেহ ভিন্ন আলাদা কোন অস্তিত্ব আছে কিনা অথবা মন আদতে আমাদের দেহের বিশেষ কতকগুলো ক্রিয়া কিনা সেই প্রসঙ্গে দার্শনিকদের মধ্যে দীর্ঘ বিতর্ক আছে। ফ্রয়েড সেই তর্কে যোগ দেন না। তিনি মানসিক বৃত্তিগুলোর কথা বলেন যেগুলি মনের বিভিন্ন প্রকাশ।
দার্শনিক নীৎসের ভাবনায় প্রভাবিত হয়ে ফ্রয়েড দাবি করেন যে সেই মনের পরিপূর্ণ বিকাশ এবং সামাজিকীকরণের পর্যায় সম্পর্কিত আলোচনায় মনোবিকার সমাজতত্ত্বের আর এক আলোচনা ক্ষেত্র যেখানে ফ্রয়েডের ধারণা মুখ্য।
মনের স্তরায়ন ঘটাচ্ছেন ফ্রয়েড। মনের নিগূঢ়তম স্তর হল নিজ্ঞান। এটি অদস। এই অদস-এর মধ্যে স্থান-কাল বলে কোনো কিছুর প্রভেদ নেই। এটি সুখানুভূতির নীতি মেনে চলে। সুখভোগের বাইরে তার আর কোনো নীতি নেই। স্বপ্নে অদস কাল্পনিকভাবে সুখ উপলব্ধি করে থাকে। জন্মের পর শিশু তার মুখনির্ভরতায় খাদ্যের জন্য মায়ের স্তন চোষে। অথবা মুখ পর্বের পরে পায়ু পর্বেও শিশু পায়খানা চেপে রেখে আনন্দ পায়। মনের বিচারে এই সময় অদস মিতব্যয়িতা পছন্দ করে। সকল শক্তির উৎস হল এই অদস। অদস-র শক্তিকে ফ্রয়েড কামপ্রেরণা বা লিবিডো বলছেন। বিষয়াকর্ষণে ব্যক্তি সুখ উপভোগ করে যার মূল আধার হল অদস। অদস থেকেই অহং জন্ম নেয়। ফলে অদস যখন অন্ধ, সে না বোঝে বাস্তবতা, না বোঝে নৈতিকতা; তখন অহং সুখভোগের নীতিকে বাস্তবতার নীতিতে বিচার করে।এই অবচেতনেই নিজ্ঞানের ছাঁকনি বর্তমান থাকে। ঈডিপাস এষণা ও ইলেক্ট্রা এষণা পর্বে শিশুর সামাজিকীকরণ বহির্জগতের সঙ্গে সংঘাতকে অনিবার্য করে। এই পর্বে শিশুর যৌন চেতনা অহং-এর কাজের সমালোচনায় নৈতিকতার নীতি মেনে চলা অধিশাস্তার জন্ম দেয়। অধিশাস্তা হল সজ্ঞান। শিশুর ব্যক্তিত্ব বিকাশের পূর্ণকাল। অপরাধবোধ বা উৎকণ্ঠার জন্ম ব্যক্তি শিশুর মধ্যে যখন লক্ষ্য করা যায় তখনই তার প্রাথমিক সামাজিকীকরণ সম্পূর্ণ হতে চলেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। সজ্ঞানের সঙ্গে নির্জ্ঞানের পরিপূর্ণ পারস্পরিক সম্পর্ক বন্ধনের সামাজিক রূপটি তুলে ধরেন ফ্রয়েড।
ফ্রয়েডীয় মনোবিক্ষায় অহং ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে, যদি না সে সোজাপথে মনের ইচ্ছাপূরণ করতে পারে। আক্রোশ-আবেগ-উত্তেজনা-এই সবই আত্মহারা অবস্থা যেখানে নির্জ্ঞানের উপস্থিতি। আকর্ষণ হল স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিবাদ সমালোচনা হল অস্বাভাবিক – মনোবিকার। ঈর্ষা ও ভালোবাসাকে স্বাভাবিক প্রবৃত্তি বিবেচনা করেও ফ্রয়েড বিরুদ্ধাচরণকে মনোবিকার বলছেন। ফ্রয়েডীয় মনোবিকার = সজ্ঞানের সঙ্গে নির্জ্ঞানের দ্বন্দ্ব।
১৯৫২ সালে অনুষ্টুপ, কলকাতা-৯ থেকে দেবীপ্রসাদ একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ফ্রয়েড প্রসঙ্গে শীর্ষক এই গ্রন্থে দেবীপ্রসাদ নিদানিক মনোবিজ্ঞানের ফ্রয়েডীয় দুর্বলতাকে তুলে ধরেন। তিনি মার্কসীয় সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে ফ্রয়েডীয় মতবাদের আলোচনা করেন। সেই বিশ্লেষণে দেবীপ্রসাদ দেখান যে ফ্রয়েডীয় কলা-কৌশলে বহির্বাস্তবকে সবচেয়ে নিরুপদ্রবে সহ্য করবার উদ্দেশ্য ছাড়া এর অন্য কোনো সত্য নেই।
দেবীপ্রসাদ দেখাচ্ছেন যে ফ্রয়েডের আলোচনাকে আমরা গ্রহণ করি, ত্রুটিমুক্ত ভাবি। কারণ এই আলোচনায় আমরা কেবল সিদ্ধান্তগুলিকেই যাচাই করার চেষ্টা করি, মার্কসবাদের দিক থেকে সম্যকভাবে বিচার করার ঝোঁকটা আমরা দিই না। আমরা আরও ভুল করি যখন সিদ্ধান্তগুলির দিকে আমরা মনোনিবেশ করলেও কলা-কৌশলের প্রতি আমরা উদাসীন থাকি! সিদ্ধান্ত ও কলা-কৌশল একসঙ্গে যাচাই না করলে ধরা যায় না যে “ফ্রয়েডীয় মতবাদের অন্তঃপুরের মধ্যে যা-কিছুর আয়োজন, তারই উপর পুঁজিবাদী সভ্যতার, পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির নিঃসন্দেহে স্বাক্ষর” রয়েছে।
কিন্তু কিভাবে? এখানে দেবীপ্রসাদ বস্তুবাদী সমাজতাত্ত্বিক। সামাজিক পরিসরে জ্ঞানের প্রয়োগ এবং তার কার্যকারণ পরিসরের নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণে তিনি আগ্রহী। ফ্রয়েড প্রসঙ্গে আলোচনায় দেবীপ্রসাদ সমালোচনায় ফ্রয়েডকে দীর্ণ করছেন। ফ্রয়েড পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত থাকা শ্রম-শোষণ ও বিচ্ছিন্নতার অনিবার্যতাকে মনোবিকার বলে দাগিয়ে দিয়েছেন। দেবীপ্রসাদ বলছেন, ফ্রয়েডীয় মনোবিকারের সিদ্ধান্তে কোপার্নিকাস থেকে দিদেরো, ফয়ারবাখ্ থেকে এঙ্গেলস সকলেই পরে যান। ধর্মগ্রন্থগুলি যখন দাবি করছে যে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্যের আবর্তন, তখন কোপার্নিকাস সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর আবর্তনের কথা বলেছেন। বৈজ্ঞানিক চর্চা ও জ্ঞানে এই বিরুদ্ধাচরণ তিনি করছেন। ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণ সেই ধর্মাশ্রয়ী পথকেই বৈধতা দিচ্ছে।
ফ্রয়েড সেই বিকারগ্রস্ত ব্যক্তি মানুষের নিদান হিসেবে “অবাধ-অনুষঙ্গ” কৌশলের কথা বলছেন। এই অবাধ-অনুষঙ্গ বা ‘ফ্রি এ্যাসোসিয়েশন’ পুঁজিবাদী সভ্যতায় ‘বিচ্ছিন্নতার’ শিকার যে ব্যক্তি মানুষ, তাকে “রোগী” বলে চালিয়ে “ফি” (ফ্রয়েডীয় কলা-কৌশলের একটা অঙ্গ) নামক শোষণের মধ্যে নিয়ে আসার আসল ফন্দি। এই ফাঁদ ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব পাতে, যা আমরা বুঝি না। বুঝতে হবে যে এটাই বুর্জোয়া মতাদর্শের নির্ভুল স্বাক্ষর।
ফ্রয়েডের সিদ্ধান্তগুলি এবং কলাকৌশলগুলির পুনর্মূল্যায়নে দেবীপ্রসাদ দেখান যে কেন বস্তুবাদী ধারণায় ফ্রয়েড সমালোচিত হন। প্রথমত, সামাজিক পরিসরের যে একটা বাস্তবতা আছে তা ফ্রয়েড মানেন না। দ্বিতীয়ত, ফ্রয়েড ব্যক্তি মানুষের সচেতনতায় তার সামাজিক উপস্থিতিকে দেখছেন। তৃতীয়ত, ফ্রয়েড কখনই সামাজিক উপস্থিতি যে পরিসর ও পরিস্থিতি সাপেক্ষে সজ্ঞানের জন্মদাতা, তা তিনি বুঝছেন না। চতুর্থত, শাসকের অবস্থান এবং তার শাসন প্রণালীর স্বার্থে ফ্রয়েড সর্বদাই নতুন ধরনের সংজ্ঞায় ধারণা গঠনে প্রয়াসী হয়েছেন। এই সংজ্ঞা প্রচলিত ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানায় না, বরং শাসকের শোষণ প্রণালীর পক্ষে সুবিধাজনক হাতিয়ার সরবরাহ করে।
ফ্রয়েডের মনোবিজ্ঞান ও তার ব্যবহারিক দিক, বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান অনুশীলন ইতিহাসের সেই দিকটির পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। মানব মনের নানা ক্রিয়া-প্রক্রিয়া এবং মানসিক গঠনের একটা সুস্পষ্ট সম্পর্কে ফ্রয়েড যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পেশ করেছিলেন তা পৃথিবীর সর্বত্র স্বীকৃতি লাভ করলেও দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাকে সমালোচনায় দীর্ণ করেন। দাবি করেন যে এই তাত্ত্বিক কৌশল নতুন ধরনের ধারণা অবতাড়নায় ব্যক্তি মালিকানা নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় শোষিতের যন্ত্রণা লাঘব করে না, বরং নিপীড়িতের ক্ষতে প্রলেপ হয়ে শোষণের মাত্রাকে মসৃণ করার আয়ুধ সরবরাহ করে।
দেবীপ্রসাদ বলছেন, “যেভাবে সহজ বৃত্তিকে সনাতন মনোময় আভ্যন্তরিক তাগিদ বলে প্রচার করবার চেষ্টা করছেন, সেটা নেহাতই তাঁর মনগড়া ব্যাপার”। আব্রাহাম ম্যাসলোর গবেষণাকে ব্যবহার করে তিনি ফ্রয়েডের এই মনগড়া বিষয়কে খণ্ডন করেছেন। আমার সমাজতত্ত্বের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে আমি ম্যাসলোর চাহিদা ক্রমোচ্চ পর্যায় এবং প্রেষণার মনস্তত্ত্ব প্রসঙ্গে দীর্ঘ অধ্যায় লিখেছি ও আলোচনা করেছি। এখানে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটালেও এটুকু বলতেই হয় যে প্রাণীজগতের সার্বভৌম নিয়ম হিসেবে জিঘাংসাবৃত্তিকে ধরে নেওয়া ঠিক নয়। শিশুর প্রতি আচরণ সংস্কারমুক্ত রাখলেই তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার তুলনায় ভালোবাসা ও একাত্মতার চাহিদা বাড়িয়ে তোলা যায় যেখানে স্নেহ, মমতা ও প্রীতির বিকাশ খুব কম নয়।
গ্রন্থের শেষ অংশে দেবীপ্রসাদ আবার করে ঈডিপাস এষণার কথা তুলেছেন। ঈডিপাস এষণা অর্থাৎ মায়ের প্রতি ছেলের যৌন আকর্ষণ, যেখান থেকেই শুরু হয় অধিশাস্তা। যখন শিশুর [ঈডিপাস ও ইলেকট্রা] বল্গাহীন যৌনতাকে মা-বাবা বাধা দিতে আরম্ভ করেন তখন থেকেই অধিশাস্তা পরিণত রূপ লাভ করতে থাকে। এটা সর্বজনীন বিষয় এবং সমস্ত যুগের সমস্ত মানুষের মধ্যেই এই মানসিক জটিলতা সমানভাবে বর্তমান। ফ্রয়েডের এই ধারণা নৃতত্ত্বের আধুনিক গবেষণায় বাতিল হয়েছে। দেবীপ্রসাদ নৃতাত্ত্বিক রুথ বেনেডিক্ট, নারীবাদী সমাজতাত্ত্বিক মার্গারেট মিড এবং নিদানিক মনোবিদ আব্রাম কার্ডিনার-এর রচনা উল্লেখ করে দেখান যে ফ্রয়েডের ঈডিপাস এষণা হল পিতৃপ্রধান আধুনিক বুর্জোয়া পরিবারের অভ্রান্ত প্রতিবিম্ব। দেবীপ্রসাদের প্রশ্ন, “ফ্রয়েড তাকে সর্বকালীন মানব চরিত্র বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করলে কেমন করে চলবে?”
দেবীপ্রসাদের আগে কোনো ভারতীয় সমাজতাত্ত্বিক সেই প্রশ্ন তোলেননি।
খ) ভারতীয় ঐতিহ্যে বস্তুবাদী দর্শনের ধারা
সমাজ-বিকাশের পটভূমিতে ভারতীয় সংস্কৃতিকেও দেবীপ্রসাদ দেখেছেন। সেই আলোচনা এতোটাই বিস্তৃত যে এই নিবন্ধে তা কুলিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। তাই মূলত চারটি গ্রন্থের আলোচনাতেই এই বর্ণনা সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।
এই চার গ্রন্থের মধ্যে দুটি ইংরাজিতে এবং দুটি বাংলায়। বাংলার দুটি ছাড়া ইংরাজির একটি দেবীপ্রসাদের নিজের রচনা। যার একটি আবার বাংলা থেকে ইংরাজিতে অনুদিত হয়েছিল। এবং চতুর্থটি ইংরাজিতে সম্পাদিত গ্রন্থ। ১৯৭৮ সালে কে পি বাগচি এন্ড কোম্পানি, কলিকাতা থেকে হিষ্ট্রি এন্ড সোসাইটি: এসেজস ইন অনার সব প্রফেসর নীহাররঞ্জন রায় শিরোনামে সেটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে নীহাররঞ্জন রায়ের যেমন একটি মূল্যবান সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে, তেমনি পাঁচটি অধ্যায় জুড়ে প্রায় চৌত্রিশ জন প্রথিতযশা সমাজ গবেষকের নিবন্ধে সূচীপত্র গঠিত হয়েছে। সেই সকল নিবন্ধ একদিকে যেমন প্রাচীন ভারতের সঙ্গে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি-শিল্প-কলার পরিচয় ও পুনর্মূল্যায়ন করছে, ঠিক তেমনি পদ্ধতিবিদ্যার অন্বেষণে ভারতীয় সমাজকে দেখতে ও দেখাতে চেয়েছে। আধুনিক ভারতের শিল্প-কলার বিধিবদ্ধ অসুবিধা সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এখানে আলোচিত হয়েছে। ভারতীয় ভাববাদী ধারার উৎস সন্ধান করে দেবীপ্রসাদ নিজেও এখানে একটি নিবন্ধ লিখেছেন।
প্রায় ৩১ পাতা জুড়ে (২৩৯ থেকে ২৭০ পাতা) থাকা সেই নিবন্ধে দেবীপ্রসাদ জ্ঞানের গোপন ধারাগুলিকে খোঁজার চেষ্টা করেছেন, এবং সেই উৎসের সন্ধানেও তিনি সফল হচ্ছেন। ২৪৪ পাতায় জ্ঞানের তাৎপর্য অন্বেষণে ও বিশ্লেষণে সনাতনী সমাজ প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন, “কার্যকারণের ক্ষমতা উপলব্ধি এবং সচেতনতার সৃজনশীল ভূমিকা অনুধাবনেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জ্ঞান আহরিত হয়।” ভারতীয় সমাজে দাস দাসত্বের চেতনায় বেঁচে থাকেন।
এই ভাববাদ ও বস্তুবাদের বিতর্ক এবং পদ্ধতিবিদ্যার প্রয়োগে সমাজবিজ্ঞানকে তার ব্যবহারিক দিক থেকে সফল ও সক্ষম করে তোলার চেষ্টায় দেবীপ্রসাদ অনন্য। দ্বিতীয় যে গ্রন্থটির কথা আমি বলতে চাইছি সেই গ্রন্থে দেবীপ্রসাদ উপরের নিবন্ধের দীর্ঘ ব্যাখ্যা প্রায় দু’বছর আগেই করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে পিপলস পাবলিশিং হাউস, নিউ দিল্লী থেকে প্রকাশিত হোয়াট ইজ লিভিং এন্ড হোয়ট ইজ ডেড ইন ইন্ডিয়ান ফিলজফি শীর্ষক গ্রন্থে তিনি জ্ঞান তত্ত্বের দর্শনকে অনুধ্যান করছেন। দেখতে চাইছেন সংখ্যাবাচক বিশ্লেষণের পাশাপাশি গুণবাচক ব্যাখ্যাকেও তিনি কেন গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। প্রাচীন ভারতের সমাজ-সংস্কৃতিকে খুঁজতে তিনি দার্শনিক খণ্ডন থেকে দার্শনিক বর্ণনে যেতে চেয়েছেন। একের বিপরীতে আর একের অবস্থানকে আগে স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে চাইছেন। এই দ্বান্দ্বিক অবস্থান বুঝতে তিনি উপনিষদের ধারাগুলিকেও খণ্ডন করেছেন। বিতর্ক কি ছিল, বাকবাক্য (Vakovakya) কি ছিল, সেগুলিকে দেখতে চেয়েছেন। এই কাজে প্রথমে “নির্ণয়” এবং তার পর “পরীক্ষা” পদ্ধতির প্রয়োগ চেয়েছেন। পদ্ধতিগত দিক থেকে সময়ের নিরিখে প্রাচীন গ্রন্থগুলির আলোচনায় ব্যবহৃত শব্দ চয়নের ধারাগুলিকে তিনি খণ্ডন করেছেন। সেই ধারায় শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞানে সমাজ-সংস্কৃতিকে না দেখে তার কালিক বিচারে সকল জ্ঞান তাত্ত্বিক উৎসকে তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছেন। একাধিক দার্শনিক অবস্থান যে ঘটনার পিছনে আছে সেগুলি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে চিহ্নিত করতে হবে। সমালোচনামূলক বিশ্লেষণগুলি স্ববিরোধগুলোকে এবং অসংগতিগুলোকে সামনে নিয়ে আসবে। দেবীপ্রসাদের গুরুত্ব এখানেই।
পদ্ধতিগত দিক থেকে ঘটনার যুক্তিসিদ্ধতাকে উভয় আঙ্গিকে দেখার ধারণায় তিনি ভারতীয় সমাজ বিজ্ঞানের অগ্রগতি চান। ইতিহাস বিজয়ীর জয়োল্লাসের মর্মবাণী যেন না হয়ে যায়, তাই দেবীপ্রসাদ অসংগতিগুলির পরিসরকে বাদ-প্রতিবাদের আঙ্গিকে দেখতে চান। খণ্ডনের নিরিখে বর্ণনকে গঠন করতে চান। বস্তুজগতের গতিশীলতার ধারণায় তাই তিনি উপনিষদের মতো ব্রহ্মকে দৃশ্যমান জগতের চালিকা শক্তিরূপে বর্ণনা করা অংশের পাশাপাশি দ্বান্দ্বিক বিরোধিতার বর্ণনাগুলিকে খণ্ডন করতে চান। জনসাধারণের দর্শনটাকে তিনি বুঝতে চান। নেতির নেতিকরণ সূত্র সেই পদ্ধতি মেনে চলে।
ফলিত সমাজতত্ত্বের ভারতীয় ধারায় দেবীপ্রসাদ বস্তুজগৎ ও ভাবজগতের পারস্পারিক সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে এক ঐতিহাসিক সম্ভাবনার জন্ম দেন। তিনিই প্রথম এই পদ্ধতির সার্থক প্রয়োগ ও বিকাশের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এই বস্তুবাদী পদ্ধতির সাহায্যে তিনি কখনই বিতণ্ডার পরিসরগুলিকে বাড়াতে চাননি, বরং এই বিষয়ে প্রচলিত সিদ্ধান্তগুলির বিচার এবং প্রকৃত সমস্যাবলীর স্বরূপ অনুসন্ধান করেছেন। ১৩ পাতায় বলেছেন, “কিছু সময় অলীক কল্পনায়, অথবা অজ্ঞতার কারণে মুক্তির অন্বেষণে নির্বাণ কিংবা মোক্ষকেই প্রকৃত রূপ বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু তা বস্তুজগতের পরিসরে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদনে সহায়তা করতে ব্যর্থ হয়েছে।”
বিরুদ্ধ ভাবনার পরিসরকে তাই খুঁজেছেন দেবীপ্রসাদ। তিনি দেখতে চেয়েছেন কিভাবে তাচ্ছিল্য করে পালি পুঁথির মনুবাদী বর্ণনায় জনসাধারণের দর্শনকে বিতন্ডাবাদ বলা হয়েছে। তিনি একটু খণ্ডন করে দেখিয়েছেন যে বিতন্ডা শব্দের অর্থ ঝগড়া না ধরে বিরুদ্ধ ধরা যেতে পারে। এবং সেই অর্থে বিরুদ্ধ মতবাদ ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির প্রথম দিন থেকেই ছিল। এই বিরুদ্ধ মতবাদকে তিনি বস্তুবাদী ভিত্তির ওপর দাঁড় করান। দাবি করেন যে জনসাধারণের দর্শনে যখন বস্তুবাদী দর্শনের ধারা নির্ণায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন তার পরিচয় হয় লোকায়ত দর্শন।
ইংরাজি বই দুটোর পর বাংলায় লেখা অপর দুটো বইয়ের কথা এখানে বলতে হয়। প্রথমটি নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড থেকে ১৯৫৬ সালে লোকায়ত দর্শন শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এটি এতটাই জনপ্রিয় হয় যে পাঠকের প্রয়োজনে ১৯৫৯ সালে পিপলস্ পাবলিশিং হাউস, নিউ দিল্লী থেকে এটি ইংরাজিতে অনুদিত হয়। নাম রাখা হয়, লোকায়ত : এ স্টাডি ইন এনসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান মেটেরিয়ালিজম। এই গ্রন্থটির বাইরে দ্বিতীয় যে বাংলা বইটির কথা আমি এখানে বলতে চাইছি সেটি দেবীপ্রসাদ লেখেন ১৯৮৭ সালের আগস্টের শেষদিকে। তবে প্রথম অনুষ্টুপ সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। শিরোনাম হয়, ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে।
লোকায়ত দর্শন এবং ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে গ্রন্থে তিনি মূলত সেই বিরুদ্ধ স্বরের ভিত্তিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই কাজে তিনি শুধু পদ্ধতি নির্ভর হয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, বস্তুবাদী দর্শনের সঙ্গে জনসাধারণের দর্শনকে সংযুক্ত করেছেন। সাধারণ জ্ঞানের সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিচারের পথে তিনি দেখিয়েছেন যে কিভাবে ভারতবাসীর চেতনার নাম “লোকায়ত” হয়ে ওঠে।
মোহমুক্ত সমাজতাত্ত্বিকগণ জানেন যে জনসাধারণের সাধারণ জ্ঞান রয়েছে। সাধারণ জ্ঞান বিজ্ঞান নির্ভর নাও হতে পারে। জনসাধারণ যখন প্রত্যক্ষ বিচারবাদে আশ্রয় নেয়, তখন তাদের মধ্যে দার্শনিক চেতনা জেগে ওঠে। এই দার্শনিক চেতনা সাধারণ জ্ঞানকে বিজ্ঞানাশ্রয়ী করে তোলে। নানা মাত্রিক বিশ্লেষণে জনসাধারণ সামাজিক ঘটনাকে দেখতে সক্ষম হন। জনসাধারণের এই বাস্তবজ্ঞান, বস্তুবাদী চেতনাসিদ্ধ। আর এই প্রায়োগিক দর্শনের পথই হল “লোকায়ত”।
দেবীপ্রসাদ তাঁর পূর্বসূরিদের ধারণাকেও খণ্ডন করেছেন। সনাতনী গ্রন্থ, পাণ্ডুলিপির বাইরে লোকায়ত প্রসঙ্গ তাঁর পূর্বসূরিদের বক্তব্য ও রচনাকে তিনি পুনরায় বিশ্লেষণ করেন। পাশ্চাত্য দর্শনের বাইরে প্রাচ্যের সনাতনী ধারায় কোথায়, কিভাবে বস্তুবাদী চেতনা মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিল, কোন সময়ে তাকে ভাববাদী, আধ্যাত্মবাদী সক্ষমতায় দমিয়ে রাখার চেষ্টা হল, তা তিনি খুঁজে বের করেন।
অধ্যাপক রাধাকৃষ্ণণ, গবেষক জে মূয়ার, বাংলার প্রথিতযশা দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, সংস্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অধ্যাপক তুর্চি, রিস ডেভিডস্ প্রমুখের ধারণা খণ্ডন করে তিনি দেখান যে ভারতীয় দর্শন কখনই অনাবিল আধ্যাত্মবাদ ও ভাববাদী দর্শনের পরিপূর্ণ রূপ নয়। ভারতীয় দর্শনে অবশ্যই আধ্যাত্মবাদ, ভাববাদ আছে। কিন্তু তা বৃহত্তর জনসাধারণের নাড়ির সঙ্গে যুক্ত নয়। আপামর জনসাধারণ সেই চেতনায় বাঁচে যেখানে দাস দাসত্বের শৃঙ্খল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।
সনাতনী ভারতীয় সমাজ, বিদ্যার প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করতো। সেই বিদ্যা শুধু ধর্ম হিসেবে জীবনাচারে ‘বার্ত্তা’কে নির্দেশ করতো। বার্ত্তাই হল আসল বিদ্যা। বার্ত্তা=কৃষিকাজ। খাদ্যে নিরাপত্তার ধারণা প্রকৃতিবাদের পথে সকলকেই কৃষিকাজে যুক্ত রাখতো। শাসকের সুবিধার্থে ধর্ম, সংস্কারের মায়াজালে বিভাজনের পথকে সুগম করে। জাতের ভিত্তিতে কাজ এবং তার নিরিখে বর্ণশ্রেষ্ঠ খেতাব মনুবাদে এসে বদলে যায়। মনু বলছেন বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের পক্ষে কৃষিকাজ নিষিদ্ধ। শাসক বেদজ্ঞানে পারদর্শী, তার সঙ্গে কর্মের সঙ্গতি নেই। কি অদ্ভুত ভাবনার আচ্ছন্নতা!
মনু পূর্ব, এবং মনু পরবর্তী ভারতীয় সমাজে আপামর সাধারণ ভারতবাসী ফসল ফলায়। তাদের জ্ঞানে দৈনন্দিন বাস্তবতার যে উজ্জ্বল ছবি প্রতিফলিত হয়, তাদের সেই চেতনার নাম লোকায়ত। এই চেতনার সঙ্গে সাংখ্য-দর্শনের এবং বৈদিক ঐতিহ্যের অবশ্যই সম্পর্ক আছে। তবে সেই সম্পর্ক হল বিরুদ্ধতার। সাংখ্য-দর্শন, ভাব আর বস্তু জগতকে আলাদা করতে সক্ষম। এই আলাদা করার সক্ষমতায় তারা শাসকের অনুগামী হন যখন তারা ভাবকে প্রাথমিক সত্তায় বৈষয়িক জ্ঞানে গুরুত্ব দেন। বৈদিক-ঐতিহ্য যথার্থ জ্ঞানের কথা বলে, প্রত্যক্ষ প্রমাণের ওপর আস্থা রাখে। কিন্তু উপনিষদে এসে তা কল্পনাশ্রয়ী বিধানে পরিণত হয়। ফলে ঐতিহ্য পরিবর্তিত হয়ে উপনিষদে আধ্যাত্মবাদের রূপ নেয়। তারও পরে শঙ্করাচার্য্যের দার্শনিকরা তাকে ভাববাদে পেশ করেন।
দেবীপ্রসাদ বলছেন ভারতীয় দর্শন বস্তুবাদকে ‘চৈতন্য’ রূপকের সাহায্যে চিনেছেন। চৈতন্য এখানে একান্তই আত্ম-ধর্ম। এটাকে আত্ম-স্বরূপের উপলব্ধি হিসেবেও দেখা যেতে পারে। তবে সবটাই মানুষ তার দৈনন্দিন জীবন অভিজ্ঞতায় লাভ করে। সেই অভিজ্ঞতাকে দৃষ্টিবাদী ধারণায় দেখতে রাজী নন দেবীপ্রসাদ। বরং ভারতীয় সমাজের গড়ন এবং সেই আঙ্গিকে গড়া কাঠামোয় আপামর জনগণের চেতনার উৎস হল বিপক্ষ মত। সেই বিপক্ষ জীবনধারার একটা সময় হল চার্বাক।
দেবীপ্রসাদ চার্বাকের নামকরণের বিতর্কিত ব্যুৎপত্তিকে পরিবর্ধিত করতে চাননি। কিন্তু তিনি দেখিয়েছেন খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে ভারতবাসী তার জীবন অভিজ্ঞতায় বাস্তবকে বুঝতে চাইতো। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে, দার্শনিক কমলশীল থেকে মাধাবাচার্য, বস্তুবাদী দর্শনেই চার্বাকের সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছেন। পরকাল-পরলোক ভূলুণ্ঠিত হয়েছে সেই সিদ্ধান্তে। পাল্টা চৈতন্যে পরজন্মবাদ প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়েছে। দেবীপ্রসাদের মতে এই বিরুদ্ধ মত বৃহত্তর জনগণের বস্তুবাদী চেতনার লোকায়ত দর্শন। এটি সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োগমুখী। দ্বান্দ্বিক। এবং সেই কারণেই গতিশীল।
লোকশ্রুতির ধারা ভারতীয় সমাজে জ্ঞান কাঠামোর প্রবাহকে সচল রাখে। লোককথা, দর্শনের ধারাগুলিকে বয়ে নিয়ে চলে। লোকায়তিকদের কাছে চৈতন্য হল দেহধর্ম। বর্ণাশ্রমের বিরোধিতায় স্বর্গ, মুক্তি, পরলোক, আত্মা – এই সকল কিছুকেই অস্বীকার করে খেটে খাওয়া মানুষ। শাসিত অংশের কাছে তাই সামাজিক বাস্তবতার উপস্থিতি বস্তুগত সত্তায় গুরুত্বপূর্ণ হয়।
এখানেই দেবীপ্রসাদ প্রত্যক্ষবাদ বা দৃষ্টবাদী ধারণাকে খণ্ডন করে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির গবেষণায় বস্তুবাদের উৎস সন্ধানী হন। “বিষয়গত ভাববাদ” তাই তাঁর কাছে ত্যাজ্য হয় না। হেগেল পুনঃপাঠের প্রয়োজনীয়তা তাই তিনি অনুধাবন করেন। মোহমুক্ত সমাজতাত্ত্বিকের সেটা কাজ বলেও দাবী করেন।
গ) মেঠো কর্মীর চেতনায় সামাজিক পরিবর্তন
মোহমুক্ত সমাজতাত্ত্বিক পরজন্মে বিশ্বাস করেন না। এই সমাজতাত্ত্বিক তাবিজ কবজেও বিশ্বাস রাখেন না। বরং চৈতন্য জাগানিয়া গান গাইতে পারেন। মোহমুক্ত সমাজতাত্ত্বিক শুধু ধর্মীয় মোহ থেকে নিজেকে নিরপেক্ষ রাখবেন তা নয়, তিনি যেকোনো ধরনের আচ্ছন্নতা, পক্ষপাত এড়িয়ে চলবেন। মেঠো কর্মীর চেতনায় সমাজের গতিশীলতাকে সত্ত্বাতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে তিনি উপলব্ধি করতে পারেন।
দেবীপ্রসাদ সেই মোহমুক্ততায় বিশুদ্ধ ভাববাদ থেকে পরিপূর্ণ বস্তুবাদে উত্তরণের পথ খুঁজছেন। তাই তিনি হেগেলকে একেবারে দূরে সরিয়ে রাখছেন না। প্রকৃতির সজীব বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিয়ে হেগেলের পুনঃপাঠে ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ধারণাকে তিনি লেনিনের মতো করে দেখতে চান। দেবীপ্রসাদের দাবি মার্কস- এঙ্গেলস বস্তুবাদী জ্ঞানে জীব বিজ্ঞানের ধারণাগুলিকে বিচার করার সুযোগ পেলেও তাঁরা উভয়েই পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলিকে দেখে যাননি।
১৯৬৩ সালে মনীষা, কলকাতা থেকে দেবীপ্রসাদ দার্শনিক লেনিন শিরোনামে যে গ্রন্থ প্রকাশ করেন সেখানে তিনি দাবি করেন যে এঙ্গেলস যে বছর মারা যান, সেই ১৮৯৫ সালে এক্স-রে আবিষ্কৃত হয়। পরের বছর তেজস্ক্রিয়তা, এবং তারও পরের বছর ইলেকট্রন আবিষ্কার করা হয়।
পদার্থ বিজ্ঞানের এই সকল যুগান্তকারী আবিষ্কার মোহমুক্তিতে সাহায্য করে। চর্চার ধারা হিসেবে দর্শন ও বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সাহায্য করতে পারে এই প্রয়াস তার মোহমুক্তির কারণেই। মোহমুক্ত বিজ্ঞানীদের গল্প কথায় দেবীপ্রসাদ দার্শনিক আর্নেষ্ট মাখ-এর দার্শনিক মত “প্রত্যক্ষ-বিচারবাদ”-এর কথা বলেন। এই দার্শনিক ধারায় দাবি করা হয় যে বিশুদ্ধ প্রত্যক্ষই হলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রকৃত ভিত্তি। অতএব দর্শনের ক্ষেত্রেও ভুল-ভ্রান্তি এড়িয়ে সত্যানুসন্ধান করতে চাইলে শুধুমাত্র বিশুদ্ধ প্রত্যক্ষর বিচারই বাঞ্ছনীয় হবে।
ইউরোপের বিজ্ঞানী মহল মাখ-এর প্রভাবে আচ্ছন্ন ছিলেন। স্বয়ং আইনস্টাইনও তার ব্যতিক্রম নন। যদিও আইনস্টাইনের মোহমুক্তি ঘটান ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক। পদার্থবিজ্ঞানী না হয়েও আগে থেকেই মোহমুক্তির কারণে লেনিন যা দাবি করেছিলেন, প্ল্যাঙ্ক-এর ধারণাও সেটাতে সহমত পোষণ করে। উভয়েই প্রমাণ রাখেন যে মাখ-এর দার্শনিক মতের সঙ্গে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রকৃত ভিত্তির ঐকান্তিক অসঙ্গতি আছে।
এমনটা ঘটলো কিভাবে? দেবীপ্রসাদ এখানেই প্রত্যক্ষবাদী বা দৃষ্টবাদী দর্শনের ধারাগুলির সঙ্গে বস্তুবাদী ধারার বিজ্ঞান নির্ভরতাকে পার্থক্য করেছেন। প্রত্যক্ষ-বিচারবাদ আপাতভাবে বস্তুবাদের ভিত্তি হতে পারে। এঙ্গেলস তাঁর ডায়ালেক্টিক্স অব নেচার গ্রন্থে প্রকৃতিতে গড়ে ওঠা স্তরগুলির স্বীয় বৈশিষ্ট্যের এবং তাদের পারস্পারিক বিপ্রতীপ সম্পর্ক সংযোগের মধ্যে আন্তঃ নির্ভরশীলতা দেখেন। লেনিনের সময় বস্তুবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে এই সম্পর্ক সংযোগ আবশ্যিক ছিল। কারণ তখন প্রত্যক্ষবাদ বিকশিত হয়েছে। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানের বিপ্লব বস্তুর প্রগাঢ় হাজিরায় অনুধ্যানের জ্ঞানগর্ভ প্রত্যক্ষবাদকে ত্যাজ্য করে বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠাকে আরও প্রায়োগিক করে তোলে। লেনিন বলছেন, “মন-নিরপেক্ষ বস্তুসত্তাকে অস্বীকার করা চলে না”। “প্রত্যক্ষ-নিরপেক্ষ বহির্জগতের অস্তিত্ব স্বীকার বস্তুবাদী জ্ঞানতত্ত্বের প্রথম কথা”। বস্তুর গুণাবলীকে আপেক্ষিক মাত্রায় দেখা উচিৎ।
দেবীপ্রসাদ বস্তুবাদী দর্শনের ধারাগুলিতে ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতির পরিসরগুলিকে দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি অখণ্ড ইস্পাত থেকে ছাঁচে ঢালা কোনো রূপকে শাশ্বত বা সনাতন সত্য বলেও ধরে নেননি। তিনি শুধু বাস্তব সত্যের শাশ্বত রূপকে মোহমুক্ত করতে চান। এই কারণেই লেনিন তাঁর কাছে মেঠো বা ‘র্যা ঙ্ক-এন্ড-ফাইল’ বস্তুবাদী। দেবীপ্রসাদের ধারণায় এই মেঠো মানুষটি জনগণের দর্শনে বোঝেন যে শাশ্বত রূপের কল্পনা মানেই দার্শনিক গোঁড়ামি। লেনিনের মতো দেবীপ্রসাদও এই মোহের উচ্ছেদ চান। প্রতিষ্ঠা করতে চান মার্কসীয় বস্তুবাদী দর্শন যা মার্কস-এঙ্গেলস-এর যুগ্ম অবদান। এটা হল মানুষের মুক্তি সংগ্রামের হাতিয়ার।
প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি সংলগ্ন হয়ে সমাজ বিজ্ঞানের ধারা, সামাজিক ঘটনার বিশ্লেষণ করবে। পর্যবেক্ষণ, নিরীক্ষণ, পরীক্ষণ পদ্ধতি বিজ্ঞানের যুক্তিসিদ্ধতায় সামাজিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেবে। এই দৃষ্টবাদী দর্শনের ধারায় ফরাসী তাত্ত্বিক অগস্ত কঁৎ যে সমাজতত্ত্বের জন্ম দেন, দেবীপ্রসাদ তাকে বস্তুর প্রগাঢ় হাজিরায় বাস্তবতার অনুধ্যানে বিজ্ঞানসিদ্ধ করে তোলেন। স্পষ্টভাষায় দাবি করেন যে প্রত্যক্ষবাদ বিজ্ঞানের বিকাশে কুয়াশা ঘনায়। প্রকৃতির সমস্ত ঘটনার পেছনে যেমন আছে বস্তুজগৎ কারণ, মানব সমাজের বিকাশও তেমন বস্তুগত, উৎপাদন শক্তি বিকাশের শর্তাধীন। গবেষকের জ্ঞানে নেহাত সংবেদন-পুঞ্জ ছাড়াও বাস্তব বস্তুর অস্তিত্ব আছে।
এই অনুভব মোহমুক্তির পথ। এখানে তত্ত্বের সঙ্গে প্রয়োগের সরাসরি সংযোগ। সমাজতাত্ত্বিকগণ সেই আঙ্গিকেই দেবীপ্রসাদকে দেখবেন। শতবর্ষ পরেও দেবীপ্রসাদ সমাজবিজ্ঞানের বহুধারায় আলোচিত হবেন। মোহমুক্ত সমাজতাত্ত্বিকের অন্বেষণ এবং তার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনিই প্রথম এই উপমহাদেশে দাবি জানিয়েছিলেন। বহির্জগতের বাস্তব অস্তিত্বকে মেনে নিয়ে তিনিই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে পেশাদার সমাজবিজ্ঞানের পরিসরটি উদ্ঘাটন করেছিলেন।
শেষের কথা
মার্কসের জন্ম-শতবর্ষে দেবীপ্রসাদের জন্ম হয়। ১৯১৮র ১৯ নভেম্বর, কলকাতা। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের থেকে তিনি ৯৮ বছরের ছোট। ১৯৩৯ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে স্নাতক এবং ১৯৪২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন তিনি। ১৯৪৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। যান্ত্রিক বস্তুবাদের বাইরে, বুর্জোয়া লেনিনবাদের বিপরীতে বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের শুধু প্রতিষ্ঠা চাননি দেবীপ্রসাদ, তিনি ভারতের মাটিতে তার শেকড়গুলোকেও খুঁজে দিয়েছেন।
ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বাংলার মাটিতে যে সমাজবিজ্ঞান চর্চার পরিসর প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন তাকে বিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রসারিত করেন দেবীপ্রসাদ। সমাজতত্ত্বের আঙ্গিনায় রাহুল সাংকৃত্যায়ন এবং দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁদের অবদানে পাঠ্যভুক্ত হতেই পারেন। তত্ত্ব এবং প্রয়োগের সংমিশ্রণে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের অভিমুখ রচনার অবদানে তাঁরা তা হতে পারেন। অপরদিকে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেবীপ্রসাদ স্মরণীয় হন সেই আপ্তবাক্যে, যেখানে তিনি বলেন যে মানব-সংস্কৃতির উত্তরাধিকার অগ্রাহ্য করে শুধু কমিউনিস্ট বুলি কপচে সাধারণভাবে ভুঁইফোড় বিপ্লবী সাজবার প্রয়াসটাও কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক। ক্ষতিকর।
তিনি নিজেও তাঁর ব্যক্তিজীবনে ভুঁইফোড়দের এড়িয়ে চলেছেন। নিজের কাজটা দায়িত্বের সঙ্গে সফলভাবে করে গেছেন। কাজের পরিসরে পেয়েছেন সমর সেন, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য, ভবানীশঙ্কর সেনগুপ্ত, সুশোভন সরকার প্রমুখকে। যুক্তিবাদে দীক্ষিত হয়েও বিদ্যাসাগরের তুলনায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে তিনি অনেক বেশী লোকায়তিক বিবেচনা করেছেন। বই উৎসর্গ করেছেন।
চারের দশকের মাঝামাঝি থেকে একের পর এক গ্রন্থে তিনি বাঙালী পাঠককে, তরুণ গবেষকদের এবং কিশোর-কিশোরীদের তাঁর মনের কথা জানিয়েছেন। জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, দর্শন, সমাজতত্ত্ব সহ অন্যান্য ধারায় তিনি সাবলীলভাবে বিচরণ করেছেন। আধুনিক য়ুরোপীয় দর্শন, শোনো বলি মনের কথা, নিষিদ্ধ কথা আর নিষিদ্ধ দেশ, ক্ষুদে শয়তানের রাজত্ব, জীবনী বিচিত্রা, বিজ্ঞান বিচিত্রা, সত্যের সন্ধানে মানুষ, সে যুগে মায়েরা বড়ো, জানবার কথা, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল, আমরাও হতে পারি, বিজ্ঞান কি ও কেন ইত্যাদি গ্রন্থে তিনি সেই কাজটা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভারতীয় বিজ্ঞান সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এই সম্ভাবনা আগামীর প্রতিযোগিতায় ভারতবাসীকে সমৃদ্ধ করবে এইভাবে নয় যে আমরা বিশ্বসেরা আসন লাভ করবো, প্রয়োগ এক ইতিবাচক মতাদর্শে সামাজিক অন্ধকার ঘুচিয়ে দেবে।
ভারতবাসী তার ধর্মান্ধতায়, উন্মত্ততায়, সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতায়, যৌন লিপ্সায় যে সাংস্কৃতিক উপাদানগুলিকে নেতিবাচক পথে সঞ্চালিত করেছে, জনগণের দর্শন অতীত থেকে আজও তার প্রতিরোধে বাঁধ দেওয়ার সফল চেষ্টা চালিয়েছে। দেবীপ্রসাদের মৃত্যুর [১৯৯৩র ৮ মে, কলকাতা] পঁচিশ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর, জন্ম শতবর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার দু’বছর পর, আজকের উত্তাল ভারত সেই বক্তব্যের সমর্থনে জোরালো প্রমাণ রাখে। শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে ঢাল হয়ে আজও দাঁড়ায় জনগণের দর্শন।
[লেখক – এম. এ, পি এইচ. ডি, সহকারী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ববিভাগ, প্রফেসর নুরুল হাসান কলেজ, ফারাক্কা, মুর্শিদাবাদ]
Posted in: ARTICLE, February 2021