দাফন অথবা দাহের কিছু আগে : ইশরাত তানিয়া

দাফন

পায়ের তলায় ইটের খোয়া পড়লে হঠাৎ বেশ জোরে ঝাঁকি খায় শরীর। ডান পা মুচড়ে তখন ভারসাম্য ঠিক থাকে না। অনেকটা হেলে যায় ডান দিকে। ফের সোজা হয় শরীর। লাথি খেয়ে ফুটপাথ থেকে ছিটকে পড়ে ইটের খোয়া। এই তিন সেকেন্ডের মধ্যে আরো কিছু ঘটে। স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যায়। রাস্তার অপর দিকে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা বেলুনওয়ালার দশটি বেলুনের একটি সশব্দে ফেটে যায়। মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় কলাবিক্রেতা। আরো দূরে মর্গের ভেতর আরো একটু ঠাণ্ডা হয়ে আসে জান্নাতের লাশ। তিন সেকেন্ডে পৃথিবী নিজ কক্ষপথে এক হাজার কিলোমিটারের বেশি ঘুরে গেলে দুপুরের রোদ সামান্য নরম হয়ে যায়।
এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা লক্ষ্য করার মতো অবস্থায় নেই আশিকুজ্জামান। উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটে সে। এমনকি স্যান্ডেলের ছেঁড়া ফিতা বার বার পিচের রাস্তায় ঘষা খেলেও তার অস্বস্তি হয় না। রোদ নরম হয়ে আসার অনুভব চামড়ার উপলব্ধিতে ধরা পড়ে না। সমস্ত মনযোগ অন্য কোথাও কেন্দ্রীভূত কিংবা কোথাও স্থির হতে না পেরে আশিকের অন্যমনস্কতা বাড়িয়ে তোলে। সেদিন রমনা পার্কে হাতে গোলাপ দিতেই গালে টোল ফেলে হেসে ফেলে মিতালি। যেন এই প্রথম পৃথিবীতে ফুল ফোটা। অথচ আশিক পত্রিকায় দেখেছে পৃথিবীর প্রথম ফুল ফুটেছিল আজ থেকে ১৭ কোটি ৪০ লাখ বছর আগে। অবশ্য পত্রিকা পড়ার সময় আর অভ্যাস কোনটিই আশিকের নেই। কখনো পত্রিকায় চোখ পড়লে বা চোখের সামনে পত্রিকা পড়লে কিংবা একই সাথে এ দুটো ঘটনা ঘটে গেলে সহজে কিছু ভোলে না আশিক। পত্রিকার দিকে তাকিয়ে কয়েক মুহূর্ত সে ভেবেছিল ১৭ কোটি বছর আসলে ঠিক কতটা পেছনে।
বিন্দু লেডিজ টেইলার্সের পাশে লাগোয়া মুদী দোকান। ফোন রিচার্জ করারও ব্যবস্থা আছে। এইট পাশ আশিক দোকানের ম্যানেজার কাম কর্মচারী। দোকানদারি নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মিতালি বিশ্বাসকে টেইলার্সে ঢুকতে দেখলে ক্যাশবাক্সে তালা দিয়ে বেরিয়ে আসে। বাকি ক্রেতা আর সদাইপাতি সামলায় আরেক কর্মচারী সুমন। মিতালি সবই টের পায়। স্কুল ছুটি হলে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে বান্ধবীদের সাথে কাঁচা আমভর্তা খায়। পয়লা বৈশাখের জন্য লাল রেশমি চুড়ি কেনে। কখনো দর্জির দোকানে আসে দিদি রূপালিকে নিয়ে। জামার ডিজাইন এঁকে মাস্টারকে বুঝিয়ে দেয়। কামিজের ঝুল কতটা লম্বা হবে বলে দেয়। নিচের হেমের কাটিং হবে লম্বাটে। যাকে বলে অ্যারোপ্লেন কাট। গজফিতা দিয়ে মাস্টার ওর শরীরের মাপ নেয়। পাশে রূপালি দিদি দাঁড়িয়ে। দোকানের বাইরে আশিক সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ায়। গজফিতার সাথে সাথে তার চোখও ওঠেনামে মিতালির কোমরে কাঁধে বুকে বাহুতে মনিবন্ধে। অস্তিত্ব জুড়ে আশ্চর্য অসাড়তা আশিকের। গলা শুকিয়ে আসে। ধোঁয়া যেন শরীরের সব জলীয় পদার্থ শুষে নিয়ে নাকমুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
জামা বানাতে দেবার ছল করে আশিকের সাথে দেখা করে মিতালি। কখনো বা মোবাইল ফোন রিচার্জ করার বাহানায় ঘর থেকে বের হয়। রমনা পার্কের বকুল গাছের তলে বসে থাকে দুজন। গোলাপ দেখে উচ্ছ্বসিত হয় মিতালি। বড় বড় নরম মখমলি পাপড়িতে আঙুল বোলায়- ফুল পাইলা কই? আশিকের হাত থেকে চিনা বাদামের লাল পাতলা আবরণ উড়ে যায় এক ফুঁয়ে। ১৭ কোটি ৪০ লাখ বছর থেকে সে ফের রমনা পার্কে ফিরে আসে। জান্নাতের হুর মিতালিকে ছাড়া এই জীবন ল্যাবেন্ডিশ। মিতালির দিকে তাকিয়ে আশিকের সমস্ত যুক্তিবুদ্ধি অবশ হয়ে যায়। আসন্ন সন্ধ্যায় বকুল গাছ আকুল হয়ে সুবাস ছড়িয়ে দেয়- জান্নাত… জান্নাত…
মিতালি স্বেচ্ছায় উচ্চারণ করে- লা ইলাহা… জান্নাতুল ফেরদৌস হয়ে বলে- ‘কবুল’ আর আশিককে জীবনমরণ আর ইহকাল পরকালের সঙ্গী করে। আলাদা ঘর নেয় আশিক। মিতালির ক্রমশ জান্নাত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় সে বরং কিছুটা অস্বস্তিতে। আশিকের পরিবার খুব খুশি। সুরা ফাতিহা বলতে পারে জান্নাত। নামাজ পড়ে, আশুরার নফল রোজা রাখে, শবে বরাতে হালুয়া রুটি বানায়। জান্নাত… মিতালি… মিতালি… জান্নাত… এই ধন্দ না কাটতেই আশিক দেখে ছেলে কোলে নিয়ে জান্নাত ইফতারের জন্য কাগজীলেবুর শরবত বানায়। ঈদে সাদার ওপর সোনালি জরির কাজ করা টুপি আর আতর কিনে আনে বাপ আর ছেলের জন্য।
মিতালি জান্নাত হয়ে যাবার পর বাবা মায়ের সাথে যোগাযোগ করেনি। ছেলে হবার খবরও দেয়নি। ছেলের নাম রেখেছে আদিল। আশিকের নামের সাথে অদ্যাক্ষর মিলিয়ে। তসবিহ হাতে নিয়ে মুখে উ উ শব্দ করে আদিল। ঝাঁকায়। আলোগোছে তসবির দানাগুলো ছেলের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয় জান্নাত। বালিশের তলায় সরিয়ে রাখে। একরত্তি ছানাটিকে গোসল করিয়ে চোখে কাজল এঁকে দেয়। অথচ চোখের নিচে দিন দিন কালি বাড়ে জান্নাতের। ইদানীং নিজে কিছু আয় রোজগারের কথা ভাবে। পার্লারে ট্রেনিং নিয়ে যদি কাজ করতে পারত ভাত-কাপড়ের দুশ্চিন্তা তাকে গিলে খেত না। এমনকি একটা আলমারি কি একটা শোকেসই হয়তো কিনতে পারত। সোনালি লটারি হাউজে টাকা উড়িয়ে আসে আশিক। চাল-ডাল এমন কি আদিলের দুধ না কিনে লাকী কুপন কেনে। জায়নামাজ ভেসে যায় জান্নাতের চোখের পানিতে। কিছু টাকা জমলে পার্লারে ট্রেনিং নেয়ার টাকাটা যোগাড় হয়ে যেত। সামান্য ভালো থাকার স্বপ্ন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে জান্নাতের চোখের সামনে। প্রতিরাতেই দিনের কামাই চলে যায় হাঁ-মুখ জুয়ার জঠরে।
জুয়ার নেশায় প্রায় সারারাত আশিক ঘরের বাইরে। যদিও সে বলতে চায় জান্নাতকে ভালোবাসায় কোনোদিন তার টান পড়েনি। আশিকের মন যেদিন ভালো থাকে মোঘলাই পরোটা আর মালাই চা কিনে আনে। হঠাৎ একটা গোলাপ। আশিক বোঝাতে চায় সে জুয়া খেলে বলে জান্নাত আর আদিলকে কম ভালোবাসে না। অথচ সন্ধ্যা ঘনালেই টাকা জিতে নেয়ার ধান্ধায় সে নেশাগ্রস্তের মতো জুয়ার টেবিলে হাজির হয়ে যায়। হাতে পায়ে ধরেও জুয়ার আসরে যাওয়া থেকে আশিককে ফেরাতে পারে না জান্নাত। রোজ ঝগড়া খিটিমিটি লেগে যায়। আশিক নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। প্রায় দিনই জান্নাতের চুলের মুঠি ধরে বেদম মার মেরে জুয়া খেলতে বেরিয়ে যায়। সারা গায়ে কালশিটে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে জান্নাত।
আশিক বোঝে না কোন ভুতে ধরল জান্নাতকে। ইঁদুর মারার বিষ গিলতেই হলো। নাকি ইঁদুর মারার লাল দানাগুলো স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল হয়ে প্ররোচিত করেছিল জান্নাতকে? যেন এখনই পেটের ভেতর চালান করে দিতে পারলে জীবনটা ডালিমদানার মতো রঙিন সরস আর মিষ্টি হয়ে উঠবে। মহল্লায় ফিসফাস চলে। পার্লারে চাকরি করতে না দিলে যে মেয়ে বিষ খায় সে কত বড় বেআক্কেল হতে পারে! মাসুম বাচ্চার দিকে তাকিয়ে যার দিল নরম হয় না সে কেমন বেরহম মা? দাদীর কোলে আদিল এদিক ওদিক তাকায় মায়ের খোঁজে। আশিকের পরিবার আফশোস করে আদিলের জন্য। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় জান্নাতের লাশ পাওয়া গেলে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হবে।
আজ ২০ দিন হলো হিমঘরে ফ্রিজের ভেতর পুলিশের হেফাজতে আছে জান্নাত। কারণ জান্নাত ওরফে মিতালির বাবা মেয়েকে হত্যার জন্য আশিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার সাথে কথা বলেন আশিকের বাবা আর ভাই। জান্নাতের ময়নাতদন্ত হয়ে গেছে। ভিসেরা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট এলে বলা যাবে জান্নাত আত্মহত্যা করেছে নাকি হত্যা করা হয়েছে।
মর্গ থেকে বেরিয়ে উদভ্রান্তের মতো হাঁটে আশিক। ১৭ কোটি ৪০ লাখ বছর ধরে হাঁটতেই থাকে। পায়ের তলায় ইটের খোয়া পড়লে হঠাৎ বেশ জোরে ঝাঁকি খায় শরীর। হ্যাঁচকা টান লেগে স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে যায়। ফের সোজা হয় আশিক। এরই মধ্যে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা বেলুনওয়ালার দশটি বেলুনের একটি সশব্দে ফেটে গেলে মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকায় কলাবিক্রেতা আর পৃথিবী নিজ কক্ষপথে এক হাজার কিলোমিটারের বেশি ঘুরে যায়।
ঝাঁঝালো দুপুর এখন কিছুটা নমনীয়। মর্গের ফ্রিজে জান্নাতের লাশ। আতর-লোবানের সুবাস ছড়িয়ে মাটিতে মিশে যাবার অপেক্ষায় আরো একটু ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

দাহ

সেদিন ঝুম বৃষ্টি! হেঁটে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যাবার উপায় নেই। রিকশাওয়ালারা হুড তুলে নিজেদের পলিথিনে মুড়ে রিকশার ভেতর বসে আছে। অরূপ কুমার বিশ্বাস থানার গেট থেকে বেরিয়ে কিছুটা পথ এগিয়েছিলেন। আচমকা এমন দমকা হাওয়া ছুটলো যে এদিক ওদিক তাকিয়ে থানার বারান্দায় ফিরে এলেন। বালু আর বাতাসের খেলায় ততক্ষণে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা এসে যোগ দিয়েছে। বারান্দায় পা রাখতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি।
বেঞ্চির ওপর বসে আছেন অরূপ বাবু। হাতে বাদামী খাম। খামের ভেতর এফআইআর আর মামলার কপি। তাঁর মুখের ভেতর ধুলো কিচকিচ করে আর অস্বস্তি বাড়ে। কিছু না ভেবেই উঠে গিয়ে থুথু ফেলেন। এতে ধুলোকণা বা অস্বস্তি কোনোটাই কমে না। জল পেলে কুলি করে নিতেন। ক’দিনেই মুখের চামড়ায় বুড়োটে ছাপ স্থায়ী হয়ে গেছে। গাল আর থুতনির খাড়া খাড়া কাঁচাপাকা দাঁড়িতে আরো রোগাটে ভাব। এসব অবশ্য তাঁর উপলব্ধিতে নেই। চোখ দুটো বেশ জ্বলজ্বলে, একটু যেন পর্যবেক্ষণশীল। এখন জলে টলমল। সম্ভবত তিনি ঈশ্বরকে স্মরণ করছেন কিংবা মেয়েকে। যা ভাবতে চান না সেই দুর্ভাবনাগুলোই হিমশীতলতায় তাঁকে জড়িয়ে ধরে। পেটের ভেতর থেকে ঢেউয়ের মতো কাঁপুনি উঠে আসে।
সন্ধ্যাগুলো এমনই যে আহ্নিক শেষে ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারা ঘরজুড়ে। মিতালি পড়ার টেবিলে ইংরেজি বই খুলে রাখে কিন্তু পড়ে না। খাতায় ট্রান্সলেশান লেখে না। দাঁতের মাঝে কলম চেপে দিদির দিকে তাকিয়ে থাকে। রূপালি বিছানার সাথে লাগোয়া জানলার পাল্লা খুলে দেয়- কী গরম রে বাবা!
প্রতিদিন দুপুরে রত্না জানলা বন্ধ করে দিয়ে লু হাওয়াটা আটকে দেয়ার চেষ্টা করে। রূপালি তখন কলেজে। টেস্ট পরীক্ষার পর মিতালি এখন ঘরেই থাকে। মাধ্যমিকের আর তিনমাস বাকি। সন্ধ্যার আগে আগে জানলা খুলে ঘুরে বসে রূপালি- কালকে বিন্দুতে যাবো। দোকান থেকে জামা তুলতে হবে। তুই সাথে যাবি কিন্তু। মনে মনে আঁতকে ওঠে মিতালি। যতদূর সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে- আমি যাইতে পারব না। আশিক দোকানের বাইরে দাঁড়ায় থাকে। আমি কথার উত্তর দেই না ক্যান জিজ্ঞেস করে।
হুম… আশিক এর সাথে আরো কয়েকটা ছেলে থাকে দেখলাম।
সবগুলাই ফালতু পোলাপান। গলির মোড়ে মাস্তানি করে।
দুই বোন চুপ করে থাকে। একটু পর মিতালি বলে- আমি আর কোচিং ক্লাসে যাইতে চাই না। আশিক আমার পিছে পিছে কোচিং ক্লাসে যায় আবার আমার পিছু নিয়া বাসা পর্যন্ত ফিরা আসে। আজকে রাস্তায় সবার সামনে আমার গাল ধইরা টান দিছে। কত সাহস দেখছ! সালমা আর বন্যাও ভয় পাইছে। বলছে আমার সাথে আর কোচিং এ যাবে না।
অরূপ বাবু আর রত্না যে ব্যাপারটা জানেন না সেটাও না। সকালে কোচিং থেকে ফিরে শুয়ে থাকে মিতালি। ততক্ষণে রত্নার রান্না স্নান ঠাকুরের ভোগ দেয়া শেষ। ন্যাতান্যাতা ম্যাক্সির বদলে তখন ধোয়া শাড়ি পরনে। চুলের আগা থেকে বাড়তি জলটুকু আঁচলে মুছে নেয় রত্না। দাঁত ব্যথা কমানোর জন্য একটা লবঙ্গ মুখে দেয়। আড় চোখে দেখে মিতালির মুখটা শুকনো। বিছানায় মেয়ের কাছে গিয়ে মেয়ের চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। মিতালি মায়ের কোলে মুখ গুঁজে থাকে। শাড়ির চেনা গন্ধে নিরাপত্তা পায়। মুখ না তুলেই বলে- আমার ভয় লাগে মা। আর কোচিং এ যাব না। সব কিছুতেই ভয় লাগে মিতালির। বারান্দায় দাঁড়াতে ভয়। একা স্নান করতে ভয়। গায়ে মাথায় ঝপাঝপ জল ঢেলে সে বেরিয়ে আসে। রঙ আরো উজ্জ্বল করার হলুদ আর ডাল বাটা তেমনি পড়ে থাকে। বিছানা বালিশ কাঁথা মশারির জালেও লেপ্টে থাকে অদৃশ্য ভয়। ঘুমের ঘোরে রূপালির আঙুল খোঁজে মিতালি। দিদির তর্জনী মুঠোতে ধরে ঘুমায়। রত্না মেয়ের অবস্থা দেখে শঙ্কিত হয়ে ওঠে। মনে মনে বলে- ঠাকুর! ঠাকুর!
রূপালি কলেজ থেকে ফিরলে দুবোন একসাথে ভাত খায়। কাছেই চকবাজারে অরূপ বাবুর কাপড়ের দোকান। বিশ্বাস বস্ত্রালয়। অল্প পুঁজির গজ কাপড়ের দোকান। তিনিও দুপুরে বাড়ি এসে খেয়ে যান। সময় পেলে দুদণ্ড জিরিয়ে নেন। অর্থকষ্ট থাকলেও রত্নার সাংসারিক নৈপুণ্যে সেটা সহনীয় পর্যায়ে থাকে। ঠা ঠা রোদ মাথায় নিয়ে ফেরা স্বামী আর দুই কন্যার জন্য ঘোলের শরবত বানিয়ে রাখে। গরম তেলে মাছের টুকরা ফোঁস ফোঁস করে আর রত্না ভাবে- কলকাতা না গিয়ে কি ভুলই হলো? বহরমপুরে বড়দি’র ছেলে দোতলা দালান করেছে। মিঠুর মেয়ে আইসিএস না কি যেন অফিসার। এই তো সেদিন রিটায়ার করে মহাদেব কাকু সপরিবারে কলকাতা চলে গেল। আগে থেকেই অবশ্য সব গুছিয়ে এনেছিল। দুপুরে ভাত খেতে এসে অরূপ বাবু দুঃখ করে বলেন- চান্দাবাজির জ্বালায় তো দেখি ব্যবসা করাই যাইব না। বাতাসে মিশে যায় তাঁর দীর্ঘশ্বাস। দিন দিন চাঁদার রেট বাড়ায় আশিক। প্রকাশ্যে হুমকি দেয়। টাকা বুঝে না পেলে মিতালিকে তুলে নিয়ে যাবে। পরিস্থিতি বিপজ্জনক হয় ওঠে। ঘুরে ফিরে কেবলই রত্নার মনে হয় রিফিউজির জীবন কি এর চেয়ে স্বস্তিকর হতো না?
থানার দিকে অরূপ বাবু গেলেন না। সে পথ মাড়িয়ে লাভ নেই। চাঁদার বখেরা ন্যায্য হিসাবে পার্টির ভোগেই লাগে। বাড়িওয়ালার সাথে পরামর্শ করেন অরূপ বাবু। ওয়ার্ড কমিশনারের সাথে দেখা করেন। বাড়িওয়ালার বহুমূত্র রোগ। পেশাবের বেগ সামলাতে সামলাতে তিনি অরূপ বাবুর কথা শোনেন। পেশাব করতে করতে মগজে বিবেক ও মানবিকতার স্নায়ুগুলো উজ্জীবিত হলে তিনি ফ্ল্যাশ করেন আর আশিকের সাথে ফোনে কথা বলেন। আশিক যেন বাড়াবাড়ি না করে সেজন্য নাম কা ওয়াস্তে বারণ করে দেন। ওয়ার্ড কমিশনারেরও প্রস্রাব চাপে। তিনিও পেশাব করেন কিন্তু আশিককে কিছু বলেন না। না বললেও কথাটা আশিকের কান পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আশিক আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
বিকেলে রূপালি একাই বিন্দু টেইলার্সে যায়। অরূপ বাবু রত্নাকে নিয়ে যান দাঁতের ডাক্তারের কাছে। মিতালি গরম চায়ে টোস্ট বিস্কুট ডুবিয়ে খায়। পার্সেল আসে তাই দরজা খুলে দেয় তারপর অদৃশ্য হয়ে যায়। পাড়ার লোকজনের মনে হয় তারা কেউ কোনো দিন কিছু দেখেনি। জানে না আশিকের সাথে রুহুল আমিন, সুমন আর আজমল এসেছিল। বোঝে না মাইক্রোবাসে কেনো তোলা হলো মিতালিকে এবং এক সময় বিশ্বাস করতে শুরু করে মিতালি বিশ্বাস নামে কেউ ছিল না। এমন অবিশ্বাস্য বিশ্বাস তাদের স্বস্তি দেয় আর এতে রোজকার জীবন স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। একটি পরিবারের তিনজন শুধু অবিরাম শূন্যতায় ঘোরগ্রস্ত হয়ে থাকে। চারপেয়ে টেবিল একটি পা হারিয়ে যেন ভারসাম্যহীন। মেয়ের শোকে রত্না বিছানায়। রূপালি কোনো মতে ঘরদোর সামলায়। মাঝে মাঝেই বিশ্বাস বস্ত্রালয়ের শাটার তোলা হয় না। সেদিন হয়তো অরূপ বাবু থানায় কিংবা আদালতে।
অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে অপহরণের জন্য এফআইআর দায়ের করেন অরূপ বাবু। আশিকের বিরুদ্ধে জজ কোর্টে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। পুলিশ ব্যাপক তল্লাশি চালায়। মিতালি নেই। কোথায় পাবেন তিনি মিতালিকে? এই শহরে থিক থিক করে মানুষ। মেয়েটা যেন ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় মিশে গেছে। বেঁচে আছে কী মরে গেছে সেটাও জানা যায় না। মাধ্যমিকের ফল প্রকাশিত হয়। মিতালির জন্মদিন আসে। চলেও যায়। বাড়িতে কারো জন্মদিন উদযাপন করা হয় না। রত্না টোস্ট বিস্কুট ভিজিয়ে চা খায় না। রূপালি বিন্দু লেডিজ টেইলার্সে যায় না।
একদিন থানা থেকে খবর আসে। সদর হাসপাতালের মর্গে ঘুমিয়ে আছে মিতালি। নাম লেখা আছে- জান্নাতুল ফেরদৌস। তবুও তো সম্ভাবনা ছিল কোনো এক দিন মিতালিকে ফিরে পাবার। যত ক্ষীণই হোক না কেন। সূক্ষ্ম সেই সম্ভাবনাটুকু হারিয়ে ফেলে সত্যিকার অর্থেই যেন নিঃস্ব হয়ে যায় সবাই। শোনা যায় পাঁচ মাসের একটা ছেলে আছে মিতালির। পাড়ার লোক পত্রিকা পড়ে জানতে পারে এক হিন্দু তরুণীকে অপহরণের পর ধর্ষণ করে হত্যার খবর এবং তাদের আবছা মনে পড়ে মিতালি বিশ্বাস নামে হয়তো বা কেউ ছিল।
অরূপ বাবু চোখের জল মোছেন। নিশ্চিতভা5৫বে তিনি জানেন তাঁর মেয়েকে অপহরণ করে, জোর করে বিয়ে করা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে মিতালিকে হত্যা করা হয়েছে। এটাও তিনি জানেন আদরের মেয়েকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। ২০ দিন ঘরে হিমঘরে ফ্রিজের ভেতর পুলিশের হেফাজতে আছে মিতালি। অরূপ বাবু এখন শুধু ধর্মীয় রীতি অনুসারে মেয়ের শেষকৃত্যটুকু করতে চান। না হলে বিদেহী আত্মার মুক্তি ঘটবে না। দাহ সম্পন্ন হলে মিতালির মরদেহ অগ্নি রূপ ঈশ্বরের নৈবেদ্য হবে। জীবাত্মা দেহবিচ্ছিন্ন হয়ে পরমাত্মার দিকে অনন্ত যাত্রা শুরু করবে। বিজ্ঞ আদালত নিহত মিতালি বিশ্বাসের অপহরণ আর ধর্মান্তরকরণ ঘটনা তদন্ত করে শেষকৃত্য করার দায়িত্ব দিয়েছেন র‍্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটেলিয়ানকে। এরই মধ্যে তদন্তকাজ প্রায় শেষ করে এনেছে র‍্যাব। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পর জানা যাবে মরদেহ শেষ পর্যন্ত কার জিম্মায় যাচ্ছে।
ঝুম বৃষ্টিতে চারপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন। বৃষ্টি থামার অপেক্ষায় থানার বারান্দায় বসে থাকেন অরূপ বাবু। মর্গের ফ্রিজে মিতালির লাশ। মাটি কিংবা আগুনে বিলীন হবার অপেক্ষায় আরেকটু ঠাণ্ডা হয়ে আসে।

Facebook Comments

Leave a Reply