চোখ ও শুঁয়া : দেবার্ঘ্য গোস্বামী
চোখ
বিড়ির ফুঁক তিরতির পুকুর নরমে কেঁপে উঠলে, ওপাড়ের বাবলা ঝোপে এক ফাল হাওয়ার চমক লাগে। আসছে। আজ কাল বড় অপেক্ষা করায়। এত বছর হল! সজনা গাছের হলদা পাতার ভিতর দিয়ে তারা পশ্চিমে ঢলতে থাকলেই, সাঁই সাঁই করে বুকের ভিতর। শুধু ত একবার দেখা। কথা নাই। ছোঁয়া নাই। টের পাওয়ান নাই। শুধু ছানি চোখ পাতা আবডালে। এটুকুই। ওইটুকুর জন্যই বাতে ফোলা হাঁটুতে রিক্সার প্যাডেল গুঁতান যায়। বিড়ি-হীন সকালে সোনা মুখে নিমের দাঁতন চিবান যায়। জ্বর পোড়া রাতে, কুয়াশায় চুবে, থম বসে বসে ঢুলে পরা যায় পুকুর পাড়ের ঝোপে। শুধু ত এক বার দেখা।
বয়স হল। শিয়াল ঘুমান রাতে পুকুর ভেজা কনকনা হাওয়ায় হাঁটু কটমটায়। ঘাসের ডগায় ঝুলে থাকা সিকনির মতন টোপাটোপা জলে পাছার কাপড় চুপসায়। ঘোলা ঘোলা কুয়াশায় ন্যাতায় পড়ে ছানি লেপা চোখ। উবু হয়ে দুই হাঁটু বুকে চেপে ধরেও গুনগুন কাঁপুনি লাগে গায়ে। চাঁদের ঢলানি দেখে মাপা প্রহরের হিসাব গুলায় যায়। ঝিম আসে। তখনি গায়ের লোমে ঝাঁটের বালে তাফাল টান লাগে। আসছে। আসার আগের এই সমস্ত ত্যানা পাকানি নশকা, হাতের তালুর মতন চিনা নিছে চ্যামটা বর্মণ। এত বছর হল! পুকুর ফুঁড়ে দুই পাড়ের সেই নিয়ম মতন দাঁড়ায় থাকা আর শুঁয়াপোকার গুটির মতন পর্দা ঘেরা ফ্যালফ্যালানি ঠাহর। কত রাত হল?
প্রথম পক্ষর মুখটা মনে নাই। কালো নরম গা হাত পা বুক পাছায় গরম বিছানা, গোবর গুলান জলের বালতির ভিতর ভিজান পাটের মুঠা, তকতক মেঝে, পাটের প্যাল্কার সুড়ুত ঝোল এই সব কিছু ধোঁয়া ধোঁয়া মনে আছে। ব্যাটার মুখের দিকে আর একটু ঘন তাকানির সুযোগ থাকলে হয়ত বা মুখের আদল টাও খানিক মনে পড়ত। তা নাই। আন্ত্রিক। রাতের বেলায় মহাজনের বাড়িতে রিক্সা তুলে দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বার চল্লিশ পাতলা হাগায় ক্যাথায় মিশে গেছিল বউয়ের শরীর। ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে সদর পর্যন্ত নেওয়ার টাইম পাওয়া যায় নাই। অত রাতে বাস থাকে না। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়ার টাকা চায় মহাজনের কাছে।
“আরে জোয়ান মরদ! ঐ টুকু রাস্তা রিক্সাত টনি নিয়া যাবার পাবু না? ফাঁকা রাস্তাত আধা ঘন্টাত টানি দিবু তুই। রিক্সা নিয়া যা”।
রিক্সা জোটে। ১৭ কিলোমিটার। তেমন কিছু না। টানা সাড়ে পাঁচ ঘন্টায় চব্বিশ চব্বিশ আটচল্লিশ কিলোমিটার রিক্সা টানার ঠাটানি গল্প দিনে দুই বার শোনায় ব্লক অফিসের শৌখিন বড় বাবুর বাঁধা রিক্সাআলা।
১৭ কিলোমিটার। কিছুই না।
৭ কিলোমিটার পর হাঁফ ওঠে। ১২ কিলোমিটার পৌঁছানর আগেই পায়ের ড্যানা ছেড়ার অবস্থা হয়। আর কিলোমিটার খানেক পর কাশতে কাশতে রাস্তায় উবু হয়ে বসে চ্যামটা। আরও একটু কোঁত দিলে পৌঁছান যেত বা। কিন্তু চাড় পায় না চ্যামটা। ন্যাতায় ছড়ায় পড়ে থাকে রাস্তায়।বিড়ি ফোঁকে। খাড়া হওয়ার ইচ্ছা না শক্তি কোনটা যে পায় না, এত দিনে আর সে হিসাব নাই। রিক্সার সিটে মিশে থাকা ধুকপুকানি, বন্ধ হওয়ার আগে খুব আয়েশ করে এক ফালি ভোর ভোর হাওয়া টানে মুখে। তারপর একমুখ বাসি হাওয়া আর খানিক লালার বুদবুদ ফুরফুর করে মুখ দিয়ে ছেড়ে অবশেষে বন্ধ হয়। আবার বিড়ি ধরায় চ্যামটা। আধা ঘন্টা রাস্তায় থেবড়ে থেকে, বাড়ির দিকে রিক্সা ঘোরায়।
ব্যাটার মুখের দিকে আরেকটু তাকানির সুযোগ থাকলে হয়ত……
জন্মানর পর ব্যাটার নাম ছিল লাভলু বর্মণ।তারপর যোগেশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস ফাইভের অ্যাডমিসন টেস্টে এক আজব কাইন্ড ঘটি যায়। ন্যাতন্যাতা পাঁজরার ভিতর হুড়মুড়ায় আসা ঠাটানির বলক সামলাতে না পেরে কাঁপ দিয়ে ওঠে বুক। যোগেশ চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাস ফাইভের অ্যাডমিসন টেস্টে লাভলু বর্মণ তৃতীয় আর মহাজনের মেজ নাতি তীর্থাঙ্কুর বসাক প্রথম। এরপর ব্যাটার ঐ চার ফুটিয়া লিকপিকা গতর, কোঁকড়ান চুলে আলুথালু মাথা – আর লাভলু তে আঁটান যায় না। সে খুব কঠিন ব্যাপার। দিন চার কাজের পুটকি মাইরে দৌড়া দৌড়ি, ঘটক বাড়ির লিচু গাছের কলম চারা, দুই জোড়া কবুতর, ৫০০ খানেক টাকা খরচের পর হেডমাস্টার বলে ‘পোক্ত কাম হইল। আজ থেকে তোর ব্যাটার নাম তীর্থঙ্কর বর্মণ’।
এর বছর বহু পর তীর্থঙ্কর বর্মণ (বি এসসি) মাথাপিছু দেড়শ টাকার টিউশনে রিক্সা টানার ইনকামের সাথে টায় টায় পাল্লায় মাঝে মধ্যে হাত, আধ হাত পিছাবে আগাবে। এস এস সি তে প্রতি বার ফেল করে টোটোর দাম দর খোঁজ করবে। আই টি সেলে ম্যাসেজ ফরওয়ার্ড করে মাসে তিন চারশো জুটাবে। বাড়ি ফিরে টিউশনের নোট বানাবে। ছাত্রীর সাথে প্রেম করার চেষ্টা করবে। দুর্গাপূজার চাঁদা কাটবে।রাস্তার তিন নেড়িকে বিস্কুট খাওয়াবে। ঘরের ভিতর বাড়তে বাড়তে সে বারান্দা থেকে মাচার পাশের পড়ার টেবল হয়ে উল্টা দিকের দেওয়াল পর্যন্ত ছড়াবে। আর প্রতিদিন ঘুমের ভিতর খুব খুব চেষ্টা করবে অন্য কারো উল্টান স্বপ্নের ভিতর নাক গুঁজে দিয়ে ভোঁতভোঁত শ্বাস নিতে। শেষে থাবড়া থাবড়া অন্ধকারে এলোমেলো হেঁটে ভোরভোর উঠে টিউশন পড়াতে যাবে।
তখন ঘরের ভিতর জায়গা কমবে চ্যামটার। ঘরের ভিতর থেকে গুটাতে গুটাতে মাচার শেষ কিনারে লেপটে যাবে চ্যামটা। রাত বাড়লে বাঁশের দেওয়ালের ফাটলের ভিতর দিয়ে ফুরফুরায় ছড়াবে বারান্দায়। তারপর ঘরের পিছনের কচু ঝোপের ভিতর মিশবে মাঘের থম কুয়াশার মত। শেষ মেশ জমাট বাঁধবে পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে।
চ্যামটার ৫৫।
দ্বিতীয় পক্ষ ২২।
কন্ট্রোলের বদলে সিল্কের শাড়ি। নরম। পিছল। ফাল হওয়া অংশটা পাছার দিকে ফেলে তার উপর এক ঘোর দিয়ে আয়না দেখলে দিব্যি শতাব্দী শতাব্দী লাগে। ঘোষাল বাড়ির ঠিকা কাজ শেষে, নিয়ে আসা সেই সবুজ সিল্ক মনে আছে কনকের। চোখ ঢাকা কাজল মনে আছে। হাড় জিরজিরা গতর, খাট ধুতি, কোটর কোটর চোখ আর দাড়ি পাল্লায় ফ্যাড় খোঁজা চাউনি মনে আছে। বাঁ পায়ের ভ্যাকড়া পাতার কথা জানা ছিল। ঠোঁট ফোড়ান দুইটা উঁচু দাঁত জানা ছিল না। দশে রফা হয় না। পনের হাজার লাগে। দ্বিতীয় পক্ষ তাই একটু কমের উপর গেল। প্রথম দেখার আর কিছু মানে নাই তেমন।
পুকুরের পূব পচ্চিম কাঁদাল পাড়ে জোর ছাড়া নিশ্বাসের মতন বুড়বুড়ি ওঠে। এরপর খুব হাঁসফাঁস একটা ঝাপটানি দিয়ে ফের ঝোপে জুবুথুবু হবে ডাহুক পরিবার। নিবতে ভুলে গিয়ে খানিক একটানা জ্বলে থাকবে জোনাকির ঝাঁক। আঁশটা গন্ধে চাপ ধরবে বুকে। তিরতির ঘাম জমবে কপাল নাকে। আসবে। দুই পাড়ে আসবে।
কনক রে! এত নরম হয় মানুষ! এত আঁকড়ানি জানে এত নরম!এত ভিজায় দিয়ে জড়ায় ধরা যায়! জাবনার ভিতর পুঁতে দেওয়া জিভ এমন প্যাঁচায় ধরা যায় জিভে!লোহার হাত এমন আগুনে গলায় মাই!ব্যাঁকা পায়ের চাবুকে প্রায় সারা শরীর গাইড়ে নেয় নিজের ভিতর! কনক রে! রিক্সা প্যাঁদানর শেষে আর বাংলার পাইট টানে না। রেল লাইনের তিনপাত্তির চট, পাছার শুল হয়। কনক রে রাত হইল! শুবি চল!
এক ঘর। তিন লোক। আগের পক্ষের ব্যাটা শোয় বারান্দায়। বয়স হল। রিক্সা টানতে হাঁসফাঁসায় বুক। পায়ের ড্যানায় ফুলে ওঠে শিরা। ভবানী হলে ফুল ফুল জামা, ব্যালকনি সিট, কনক। আটটা ভাড়ার পয়সায় দুই টিকিট। সব হাসফাসানি, মুখের ভিতর দিয়ে, হাতের ভিতর দিয়ে, জিভের ভিতর দিয়ে বার হয়ে জমা হয় কনকের শরীরে।ব্যাঁকা বাঁ পায়ে এক সাইজ বড় চপ্পল ঢোকে।তাই দুপায়ের জন্যে দুই জোড়া চপ্পল কেনে চ্যামটা।
প্রথম পক্ষ মরার বছর দুই আগে থেকেই আর শক্ত হয় না চ্যামটা। সাপের তেল, ফকিরের শিকড়, রাম কবিরাজের অশ্বগন্ধা সব হজম হয়। “লুপ্ত যৌবন পুনরুদ্ধারঃ বিফলে মূল্য ফেরতঃ জি এইচ জেনিটাল” এর ক্যাপসুল প্রায় তিন মাসের চেষ্টায় কেনা যায়।চার মাস পড়ে মূল্য ফেরত না পায়ে রাতে গেটে মুতে আসে। চোখের কোটর শিরশির ধারাল হয়। থরথর কাঁপে হাত। দাঁত জিভ ঠোঁটে ছিঁড়া ফেলার তড়পানি মাথা কোটে। তল পেটে জমা হয় ভয়ানক কোঁত। শরীর তবু শক্ত হয় না। আঁচড় কামড় শেষে ন্যাতায় ছড়ায় পড়ে চ্যাটচ্যাটা আঁশটা ভেজা। একখান মেয়েছেলের দরকার পড়ে। আর কিছু না। ব্যাটা পড়াশুনা করে। ভাল করিয়া দেখি শুনি রাখা নাগে। তাই কনক আসে। হুড়মুড়ায় ভাইঙ্গে পড়া সমস্ত ন্যাতানিকে কি ভীষণ গায়ে চড়ায় কনক!আঁচ দিয়ে দিয়ে বলক ওঠা এত তেজ, সারা দেহের কোথাও জমাট বাঁধার জায়গা না পেয়ে, দাঁত নখ খরখর করে তোলে চ্যামটার। মাইয়ের বোঁটা প্রায় ছিঁড়ে নেয় দাঁতে। চুল আঁকড়ে ধরে কনক। দাবনা আঙ্গুলে পিষে নীল ছাপ ফেলে দেয়। পালটা কামড়ে ঠোঁট থেকে রক্ত বেড় করে দেয় কনক। কেল্লার মতন জড়সড় কুকরামোর এই সমস্ত ছোবল, কি আদরে মাথায় তোলে কনক! সাহস দেয়। নিজের ফাটা পায়ে এখন বোরোলীন লাগায় চ্যামটা। হাতে নারকেল তেল। ঠোঁটে ভেসলিন। রিক্সার পাশে দাঁড়ায় থাকলে লোকে রিক্সাআলা খোঁজে।
সময় হয়ে গেছে। পুকুরের মাঝে গা ভাসায় তেলাপিয়া। চাঁদ গায়ে উষ্টান আলোয় চিকচিকায় তার শরীর। তখনি পূব পচ্চিম পাড়ে জলের ভিতর থেকে আঁচড়ায় কামড়ায় বুক ঠেলে ওঠে দুই কাঁদাল শরীর। মুখ হা করে বাতাস টানে। পূব পচ্চিম পাড়ে কন্ট্রোলের শাড়ি গায়ে মুখামুখি দাঁড়ায় দুই জন। কি ফ্যালফ্যাল দাঁড়ায়! নাক দেখে। চোখ দেখে। মাই দেখে। ব্যাঁকা পায়ের পাতা দেখে। অবিকল দেখে। এক জোড়া কনক – এক আরেক কে দেখে। আর কিছু দেখে না। আর কিস্যু দেখে না। কাদায় টোপা টোপা লেপা থাকে গা। চামড়ায় সেঁধে থাকে কাপড়। শরীরের সমস্ত খাঁজ খুব ন্যাংটা মতন জড়ায় নেয় কাদা। চুল বায়ে টুপটুপায় জল। হাতে পায়ে কত যুগের শ্যাওলা। চোখ বলে কিছু বোঝা যায় না এত দূরে। তাকান তবু সারা শরীরে জানা যায়। দক্ষিণ পাড়ে চার ঘন্টা অপেক্ষার পড় একটা বুড়া শরীর জুড়ে হাজারটা চোখ গজায়। দুই পাড়ের দুই কনকের মধ্যে চুল পার্থক্য নাই। তবু প্রতি রাত সে পলকে বুঝে যায় কোন জনের কাছে চাইবে আজ রাতে। হা মুখ দিয়ে কষ গড়ায় ঘাসের শিশিরে গিয়ে মেশে। হাতের তালুতে টাইট হয়ে উঠে আসে মাটি। গোড়ালি গেঁড়ে যায় কাদায়।
“শক্ত কর মাগী, আমারে তুই ঠাটায়া দে।আমি আর পারি না।”
হাউ হাউ উঠে আসে গলা বায়ে।
আঁশটা নরমে ভিজতে চায় চ্যামটা। হাতে তোলা মাটি জিভ নাক ঠোঁটে ডলে।
থরথর চোখ পিছলায় যায় উত্তর আরও উত্তরে।
কেউ নাই। কেউ নাই।
সামনের চাকার দলাপাকান রিং আর চোয়াল খুলে পড়া হামুখ মার্গার তেরচা হয়ে শূন্যে ঝুলে থাকে। পিছনের চাকা দেওয়ালে ঠেসে বেশ কয়েক বছর ছেদরে ছিল সেই পুরাণ রিক্সা মহাজনের ঘরে। ও আর ঠিক করার জায়গায় ছিল না। দুই দিন আগেই মাঝ রাস্তায় বউ মরায় বাঁচে চ্যামটা।না হলে কাজ টেকে না তার। কেউ দেখল না জানল না ফাঁকা রাস্তা , অথচ এমন তুবড়ায় ড্রেনে পড়ল রিক্সা। বলে ব্রেক ফেল। চ্যামটার বাঁ পা জুড়ে লম্বা কাটার দাগ বহু দিন পর্যন্ত ছিল।
দ্বিতীয় বিয়ার পর ছয় নম্বর পূজা। দুর্গা পূজার ট্রিপ শেষ করে দুই পাইট বাংলা টেনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় পশ্চিমে ঝুঁকে পড়ে। তবু খানিক জলদি হয় আজ।ভোর ফোটে নাই। এত রাতে মহাজনের বাড়িতে রিক্সা দেওয়া হেস্কারি। বাড়িতেই নিয়া আসে রিক্সা। আবজান বাঁশের দরজার ভিতর থেকে নিশ্বাসের দাপাদাপি খুব আঠাল হয়ে বারান্দায় চুয়ায় আসে। প্রায় ভুলে যাওয়া এক খান তালে ঘন ঘন কাঁপে ঘর। ঘরের সাথে বুঝি কাঁপে সামনের সজনা গাছ। পায়ের তলায় মাটির গায়েও সেই কাঁপুনির খানিক আঁচ লাগে।সজনা গাছের হলদা পাতার ভিতর দিয়ে পশ্চিমে ঢলতে গিয়ে মিটমিটান তারার গায়ে সেই কাঁপ পৌঁছায়। ডুবে যাবার আগে এক দুই জোনাকি হয়ে তারা ফিরে আসে চ্যামটার গায়ে। চ্যামটা ঘরে ঢোকে না। দরজার ফাঁকা দিয়ে দেখে বাঁশের মাচার উপর সিলাই হওয়া দুই শরীরের মিশ। তোলপাড় চাগাড়ে ঠিকরায় ওঠে কনক। আঁকড়ানির চাপে ধার হয়ে ওঠে ব্যাটা। চ্যামটা ঘরে ঢোকে না। থ্যাবড়ার দেখে। আলুথালু কোঁকড়ান চুল- লিকপিকা শরীরের চাগানো তেজে আঁট বাঁধে কনকের সব নরম। টুপটুপ মাই এমন আদরে পিষে দেওয়া যায়! দাবনার মাঝে এমন আপসে বেঁধা যায় নিজেকে! হা মুখ দিয়ে কষ গড়ায় চ্যামটার। হাতের তালুতে টাইট হয়ে উঠে আসে মাটি। ঠাটায় ওঠে বাঁড়া।
আট বছর পর এই প্রথম শক্ত হয় চ্যামটা।
আদাল বাদাল ফেউ ফেউয়ের ভিতর হাঁটুর ধুলা, কনুইয়ের আঁচড়ের সাথে আর কি কি য্যান লাইগে থাকে সারা গায়ে। ওকড়ার চিটিরপিটিরের মতন টের পাওয়ায়, কিন্তু চোখে ঠাহর হয় না। কি য্যান একটা করে ফেলাইচে সে! কি য্যান একটা করবার পারে নাই। কি য্যান একটা ছুঁচাল তেষ্টা আঙ্গুল ফুইড়ে দাঁত বসায় দিছে নিজের গলায়। কেমন যে একটা আঙ্গুল- চিনবার পাড়ে নাই। টালমাল ঘরে ঢোকে চ্যামটা। ঘুম জাগনা বোঝার উপায় নাই। উদাম অবশ কনক ছ্যাদরায় আছে মাচায়। ব্যাঁকা পা ঝুলে থাকে মাচার নীচে। অগোছাল মাই থেবড়ে হাঁফায়। হা ঠোঁট থেকে থিতায় সিদোলের বাসি গন্ধ। কোমরে খুব আলগা ল্যাটকায় থাকে শাড়ি। মাচার নীচে, সারা রাত ধরে ঝরান মুরগির পালকে লেগে থাকা গুয়ে, থিকথিকায় পিঁপড়া। বাঁশের দেওয়ালে ছাঁকা স্ট্রিট ল্যাম্পের হলুদে সোনা গলায় কনকের ঠোঁট। নরম করে কোমর থেকে শাড়ি সরায় চ্যামটা। দুই হাতের মাঝে সব শক্তি দিয়ে গুটায় শাড়ি। একে যে এতটা গুটায় নেওয়া যায়, না দেখলে বিশ্বাস করত না সে। কনকের মুখ দিয়ে গলা পর্যন্ত গুঁজে দেয় শাড়ি। চোখ, নিশ্বাস, গত রাতের সিদোল, বাসি গু হুড়মুড় করে একসাথে বার হতে গিয়ে খেই হারায় ফেলে। নাভি থেকে উঠে আসা একটা কাশি শাড়ির দলায় খাবি খায়। ভেজা ভেজা একটা গোঙ্গানি, সুতার মতন, বিছানার চাটাই থেকে বারান্দা হয়ে ঘরের পিছনের কচুর ঝোপ হয়ে পুকুর পাড় পর্যন্ত দাগ টেনে দেয়। পুকুরের দক্ষিণ ধারে, ঘাড় ধরে মাথা জলে ডুবায় দেয় চ্যামটা। হাত পা বুকের খলবলানিতে ডর খায়ে চিল্লায় ওঠে পাড়ের ডাহুক। নাক মুখ দিয়ে বুদবুদায় বার হওয়া শ্লেষ্মা পিত্তে, খাবার অভ্যাসে নাক গোঁজে তেলাপিয়া। হাত পা নখের আছড়ানিতে আঁচড় লাগে না জল শরীরে। ঢেউ যা ওঠে তা পাড়ে গুঁতা খায়ে আবার ফিরে আসে কনকের গায়ে। পুকুরের ভিতর বাতাস হ্যাংলামোয় হাফর জল টেনে নেয় মুখ। পূবের হালকা লাল এসে পৌঁছায় পুকুর তোলপাড়ে। ছেঁড়া ভাঙ্গা জলে বার বার তৈরি হয় ছায়া। হাত পায়ের তড়পানিতে ফোঁটা ফোঁটা গুলে যায় এক কনক আরেক কনকের শরীরে।
শান্ত হয় জল।
থামে হাত পা শরীর।
ঘোলা জলের নীচে, পুকুর তলে পেট ঠেকায় তেলাপিয়া।
ফিনকি দিয়ে শক্ত থেকে নরম হয়ে আসে চ্যামটা। আট বছর পর।
শুঁয়া
ফাল্গুনের চুরচুরা দোলা জমির মতন ফাটলে ফাটলে জল চায় গলা। জল হ্যাংলামোয় হাফর বাতাস টানে মুখ। অনেকটা চিল্লানি এক তরাসে বের হতে গিয়ে ভসভস করে হাওয়া হয়ে মিলায় যায় দাঁতের খাঁজে।পাঁজরায় জমান দম, সারা শরীরের উগরানি নিয়ে নিশপিশ করে জিভের গোড়ায়। বার হয় না। ঘুমের ভিতর ফের তাল তাল জমে ওঠে স্বপন। এক স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন।বহু যুগ আগে শেখা রান্নায় – সম্বার তেলে ফেলার পলক আগেই যেমন নাকের মনে পড়ে আংশানির গন্ধ, তেমনই প্রতি রাতে স্বপ্নের থেকে আধা হাত আগে চলে কনক। স্বপ্নের মধ্যেই বুঝে ফেলে রাত কত হল। আর কতটা দাঁড়ানর পরে হাজার হাজার চোখের কোপানিতে ফালফাল হবে শরীর। বুক ফাটা দমের চাড়ে ঘুম ভাঙ্গার আর কত বাকি।
বহু বছর আগে এমন আঁশ ওঠা রাতের ভোর ভোর বেলাতেই কচি হাতে টের পাওয়া গেছিল আধ খান ঠান্ডা বিছানার নাইমানুষি ফতুরামি। আলগা করে খোলা দরজা চুয়ান হাওয়ায় যে চলে যাওয়ার ফুরফুরানি ছিল, ঘরে ঢুকে তা খুব জমাট গরম হয়ে দেওয়ালের খাঁজ, বিছানার চাদর, লন্ঠনের সলতা কিম্বা গলার ব্যথার কোটরে কাঁটা কাঁটা থমক খায়। ভোর রাতে ভেগে যাওয়া মায়ের খোঁজ না পায়ে, সেদিন বিকালেই মাতাল বাপ ঠ্যাঙ্গায় তার বাঁ পা ব্যাঁকায় দেয়। ঠ্যাঙ্গানিটুকু ছাড়া বাকি কিছু আর তেমন নিশ্চিত মনে পড়ে না। বার বার শোনা গল্পের মতন এক এক বার দরজার ফাঁক, রাতের ঠান্ডা, বিছানার চাদর, কুত্তার ভৌ, মায়ের মুখ এক এক রকম মনে পরে। শুধু ঠ্যাঙ্গানি টা বাপ বাপ মনে আছে। দাবনার থ্যাতলানি জুড়ে নীল দাগ, হাড্ডিতে দপদপানি, পা ফেলতে গেলে ছিঁড়া যাওয়া চিৎকার – সবটুকু কানায় কানায় মনে আছে। এরপর আরও কয় বছরের সব কয়টা ঠ্যাঙ্গানি, আর ঠ্যাঙ্গানির পরে তাক জড়ায় কাঁপতে কাঁপতে বাপের ঘুমায় পড়া মনে আছে।ঘুম থেকে উঠে তেল হলুদ মালিশ করে দেওয়া মনে আছে। চ্যালা কাঠের বাড়িতে ফাটা পায়ের চামড়ার ভিতরে উঁকি মারা মাংসর তিরতিরানি জ্বালা আর তেল হলুদে মাখা থ্যাবড়া আঙ্গুলের ঠান্ডা লেলপা বুলানির মধ্যে কোনটা বেশি মনে আছে বলা শক্ত। অমন আঙ্গুলের অমন বুলানির অপেক্ষা থাকে মানুষের। তারও ছিল।
ব্যথার নীল দাগের কুসুম কুসুম গরম, আঁচড় কামড়ের কাইলচা লাল নশকার লতা পাতা ফুল, তার গায়ে সাঁটা থাকে আরও বহুদিন। তারপর তার বিয়া হয়। হাড় জিরজিরা গতর, খাট ধুতি, কোটর কোটর চোখ আর দাড়ি পাল্লায় ফ্যাড় খোঁজা চাউনি। বাঁ পায়ের ভ্যাকড়া পাতার কথা জানা ছিল। ঠোঁট ফোড়ান দুইটা উঁচু দাঁত জানা ছিল না। দশে রফা হয় না। পনের হাজার লাগে। চ্যামটার এটা দ্বিতীয় পক্ষ। তাই একটু কমের উপর গেল। প্রথম দেখার আর কিছু মানে নাই তেমন।
ফুসফুসে দলা পাকান শ্বাস বার হতে না পেরে গলার কাছে কাঁটা কাঁটা জমাট বাঁধা শুরু করে। মাথার উপর কাঁদাল জল টের পাওয়া যায়। ছিঁড়ে ফেলার মতন টানলে, খোলার বদলে আরও টান টান আঠা হয় চোখের পাতা। কাদায় ডোবা ঠান্ডা ফুরে বার হতে গিয়ে বালিশ চাপা ঘুমে আরও কোমর গাঁথে শরীর। উঠতে হবে।
“সতী নারীর পতি যেমন পর্বতের চূড়া। অসতী নারীর পতি তেমন ভাঙা নায়ের গুড়া”।…… ‘ এই কথা খান মনত রাখিও। বাপ তোমাক ডাঙায়া ভাল পায় ভাব? শাংনি মাইয়ার সোয়ামী তায়। বাপে তোমাক ভালোবাসে। তাক ডরাইয়ো না’…… মানকচু বাটার দলায় পুটির শুটকির গুঁড়া মিশাতে মিশাতে পাশের বাড়ির কেচুন ঠাকমার এমন গুনগুনানিতে কিছুতেই মন যেতনা কনকের। কাঁচা জল জল মন্ড দেখেই, সিদলের ভর্তায় মাখা গরম ভাতের ঝালের ঝিলিকে জিভে জল আসত। সিদলের ভিতরের ভেজা যেমন রোদে নিংড়ানির পরই ভর্তা বানান যায়, মেয়েছেলের এমন পুড়ানি লাগে। না হইলে ঘর ভাসি যাইবে বুঝলা?
ঘরের বাইরে বারান্দায় বিকাল বিকাল বসে থাকে কোঁকড়ান চুল আলুথালু চোখ সতীনের পো লাভলু। বিয়ার দ্বিতীয় মাসের এক বিকাল বেলায় খাটিয়ায় নিজের ছড়ান পায়ের ভিতর যখন আঙ্গুল ঢোকায় কনক, সেদিন দরজা ফাঁকা রাখা ছিল নাকি ঠিক ঠাক বন্ধ করার কথা মাথায় ছিল না তা আর মনে পড়ে না। তারপর আর কোন দিন আঁটসাঁট থাকত না। দুই জোড়া চোখ দরজার দুই ফাঁক বরাবর আড়াল দিত নিজেদের। খাটিয়ার তেল কাইস্টা চাদর আর খবরের কাগজের মলাটের ভিতরে বইয়ের পাতা আলাদা আলাদা ভাবে আংশায় উঠত ভাপে।
পুড়ানি লাগে।
চ্যালা কাঠে পায়ের চামড়া থ্যাতলায় না আর। থাপ্পড়ে ঝিমঝিমায় না মাথা। নীল লাল কালা ফুল পাতার উল্কিতে তাও সাজা থাকে গা। রাতে খাটিয়ার উপর ছড়ায় থাকা কালে, তল পেটে যখন খা খা চুমুক গজায়, তখনই শরীরের উপর আছড়ায় পড়ে নখ দাঁত কড়া পড়া হাতের তুমুল দোমড়ানি। দাঁতের টানে বুকের মাংস শিরা উপড়ে যাবার উপক্রম হয়। হাতুড়ির মতন পিষে দেওয়া হাতের চাপে তড়পাতে গিয়ে অসাড় হয় দাবনা। বিড়ালের দাঁতে উঠে আসা টান টান লাল নাড়িভুঁড়ির কাঁপুনি – মরা চড়াইয়ের চোখে যেমন বাঁচা বর্তার গুড়া হয়ে ঝরে পড়ে; তেমনই কঁকায় ওঠা হাতে চ্যামটার চুল আঁকড়ায় ধরে কনক। ব্যথা। ছিঁড়া ফেলা ব্যথা। দ্যাহের রোমে রোমে ব্যথা ছাড়া আর কিচ্ছু টের পাওয়া যায় না। পুরান সব তিরতিরানি জ্বালা আর নীল গরম ব্যথার পর যেমন আসে থ্যাবড়া আঙ্গুলের ঠান্ডা বুলানি, তেমনি এই সব দাবনা চাপা ডাঙের পরে নিশ্চই ব্যথার ভিতর দিয়ে খুব সপাটে ঢুকে যাবে মানুষ। ফাল্গুনের চুরচুরা জমির মতন ফাটলে ফাটলে ভিজাবে তাকে। ব্যাঁকা পায়ের চাবুকে শরীরে গাইড়ে নিতে চায় চ্যামটা কে। ন্যাতায় ছড়ায় পরে চ্যামটা।
ব্যথার তলায় কিচকিচ করে অপেক্ষা পড়ে থাকে তার।
পুড়ানি লাগে। পুড়ানি লাগে।
মাথা খানিক উঠে আসে জলের তলা থেকে। হাত পা টেনে ধরে কাদা। জলের তলা থেকে পুকুর পাড়ের সবজা আলো খুব স্থির লাগে। জোনাকির মতন মিটমিটায় না। হাত – মুখ- পিঠ- পেট- বুক – পাছা – পায়ে মরণ টান লাগে। চামড়া – মাংস – রক্ত থেকে চুয়ায় চুয়ায় আলদা হয় দুই কনক। সারা দিন ধরে চলা বুকের ভিতরের দুই ঢিবঢিবানি দুই বুকে সিন্ধায়। কাঁটায় কাঁটায় জানে কনক কত রাত হল। আর কত বাকি ঘুম ভাঙ্গার। ঘুম ভাঙলেই পই পই জিগির উঠবে ভিতরে “ উষ্টা খায়া……পাথরে……পুকুর”…… কনক জানে।
শিব রাত্রিতে চ্যামটার ঠ্যাঙ দুধ দিয়া ধুয়ে সেই দুধ খাওয়া নিয়ে খানিক হাসাহাসি হয় আশেপাশে।বাল ছেঁড়া যায়। বিয়ার আগে ঘোষাল বাড়িতে কাজ করার সময় শেখা। বামন বাড়ির নিয়ম কানুন এদিকে লোকের জানা নাই। একচিডেন্টে ডোবাত পড়ি গেচিল বাস। কায়ও বাঁচে নাই। এক ঘোষাল ছাড়া। সাঁতার না জানা মানষি, বাসের জানলা ভাঙিয়া, ১০০ গজ সাঁতরায়া পাড়ে ওঠে। গায়ের ছালটাও যায় নাই। এমন সিঁন্দুরের জোর ঘোষাল বউয়ের। রোগা মানুষটা সারাদিন রিস্কা চালায়। রাস্তাঘাট খুব খারাপ আজকাল। আশপাশের হাসিতে বাল ছেঁড়া যায়।
“তুলসি তলায় দিয়া বাতি কত মাগিই হইল সতী”। কোঁকড়ান চুল আলুথালু চোখ ফোড়ন কাটে। নাকের ডগা কানের লতি লাল হয় খানিক। পেটের ভিতর খা খা করে। দাবনার কালশিটায় হলুদ তেল লাগায়, মাচায় শোয় কনক। রাত হইল।
খুব ছোটবেলা থেকেই স্বপন পায় কনক। দম বন্ধ করা, গলায় পা পেষা স্বপন। দম বন্ধ করে মুখ দিয়ে ফুসফুস বার করে নেওয়া স্বপ্ন। একি স্বপ্ন। বিয়ার কয় বছর পরের সেই ভোর ভোর রাতের পর থেকে নতুন এই পুকুরের স্বপ্নে কাদায় প্যাচপ্যাচা হয় প্রতি রাত। বিয়ার আগে ছিল অন্য রকম। খাটিয়ায় শুয়ে থাকে সে। খাটিয়ায় ঘুমায় সে। বুকের উপর পাছা থ্যাবড়ায় বসে থাকে এক ন্যাংটা মাগী। ঝাপসা ঝাপসা যে মুখ টের পাওয়া যায়, তা এত চেনা কিন্তু ভুলে যাওয়া যে মা বলেই বোধ হয়। গলা চাইপে ধরে মাও। ভারী শরীরের চাপে নিশ্বাস বন্ধ হয়। কাঁচা জল জল সিদলের মন্ড দুই হাতে আঁকড়ায় ছুঁড়ে দেয় মায়ের চোখে। গুজে দেয় নাকে মুখে। হালকা হতে হতে ন্যাংটা মাগী এক পাল ঝিঁ ঝিঁ হয়ে আকাশে মিলায় গেলে, ঘাম দিয়ে ঘুম ভাঙত কনকের।
“তোর সতী নাগে! না মাগিত চইলবে?”
দুপুর বেলা ভাতের থালায় উপুড় হয়ে পড়া লাভলুর পিঠে বুক ঠেকায় হিস হিসায় কনক।
দিন দিন পড়ার নেশা আরও আঠাল হয় লাভলুর। সকালের স্কুলের আগে পুকুরে দাপানি নিয়ম মাত্রে এসে ঠেকে। স্কুল ফেরতা বিকালে কলেজের মাঠের ক্রিকেট ম্যাচ বন্ধ হয়। বিকাল থেকে ঘরে থাকে লাভলু। বই পড়ে।
পুকুরের মাঝে গা ভাসায় তেলাপিয়া। দুই আলাদা ঢিপঢিপানি দুই বুকে নিয়ে জলের তলায় কাদায় ডোবা শরীর খুব কোঁত দেয়। তাল তাল কাদায় ভারী দ্যাহ দুইটা নিয়ে দুই পাড়ে ছ্যাঁচড়ায় কনক। উঠতে হবে। উঠতেই হবে। আর এক পলক দেরী হলে বুক ভরে যাবে পাক জলে। গেঁড়ি – গুগলি – কচুরিপানার বাল বাল শিকড় নাক গলায় গুঁজে গিয়ে ভিতরের কোন বুড়বুড়ি আর বার হতে দিবে না। বুক ফাটবে হাসফাসায়। উঠতেই হবে। পূব পচ্চিমে পাড়ে ভুতের মতন খাড়া হয় কনক। গাব গাব বাতাস গেলার পড়ে একে অন্যকে দেখে। নিজেকে দেখে। নিজের গা পা মাথা খটখটা শুকনা লাগে হাতে। উল্টা পাড়ের জনের মাথা থেকে টপ টপ জল পড়ে। হাত পায়ে চুয়ায় নামে ভেজা কাদা। অন্য পাড়ের জনকে আর নিজ বলে চেনা যায় না। অনেকক্ষণ তাকায় থাকলে পড়ে হঠাৎ এক সময় হাত দিয়ে টের পাওয়া যায় টইটই ভেজা নিজের মাথা – অন্য পাড়ের জন খা খা ফুটিফাটা। এমন তাক দিয়ে থাকতে থাকতেই এক সময় কাইলচা নীল ছোপে ভরে উঠবে গা হাত পা বুক — যখন পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে জোনাকির সুই ফোটা আলোর মতন হাজার চোখ জ্বলে উঠবে। হাত পা বুকের চামড়া ফেটে কষ বের হবে। বুক ফাটা দমের চাড়ে ফিনকি দিয়ে ঘুম ভাঙ্গবে কনকের।
খাটিয়ায় উঠে বসে ঘাম মুছতে মুছতে বারান্দায় শোয়া ব্যাটাকে ডাকবে কনক।
ভোরে রওনা না দিলে অত সকালে টিউশন পড়াতে পৌঁছান যাবে না। অনেক দূর।
সারা দিন ধরে হাজার হাজার চোখ জুড়ে একটা মুখ বানাবার চেষ্টা করে কনক। ঘুমাবার আগ পর্যন্ত।
দুর্গা পূজার ট্রিপ শেষ করে বাড়ি ফিরতে সাধারণত সকাল হয় চ্যামটার। ভোর রাতের অমন নরম ঘন আদরের মাঝে যে রিক্সার আওয়াজ কানে আসে তা কনক বা লাভালু কারওই তোয়াক্কা ছুঁতে পারে না। পায়ের মাঝের মুঠায় অমন শক্ত ঠাটানিকে বাগে নিয়ে ঝরঝরনার সময়েই দরজার ফাঁকে চোখ যায় কনকের। চোখে কি চোখ পড়ে? তা চোখেও জানে না। ঠোঁটে আরও ঠোঁট ডুবায় দেয় কনক। নখ দিয়ে নরমে আঁচড়ায় দেয় লাবলুর পিঠ। মাইয়ের মাঝে ডুবায় নেয় লাভলুর মাথা। ফতুর সুখে নোয়ান লাবলু খাটিয়া ছাড়তে চাইলে হাত টানে কনক।
কানে ফিসফিসায় কয় “বাপে দেখচে”।
বাটুলের ছিলার মতন কাঁপ দিয়ে ওঠে লাবলু। কাঁপতে কাঁপতে উবু হয়ে গুটলি পাকায় মেঝেতে। আধা ঘন্টা গুনগুন করে কি কয় কিছু বোঝা যায় না। ফের দরজার দিকে ছ্যাঁচড়ায় আগায়।
খাটিয়ায় ফিরে আসে কনক। নীল লাল কাল ব্যথা – খুব ব্যথার – অপেক্ষায় কেমন অবশ হয়ে আসে শরীর। একটু সময় পেলেই সে ঘুমাবে। তার বুকের উপর উঠে বসবে তার মা। মায়ের নরম চাপে নিশ্বাস আটকায় আসবে। বুকে পেটে গলায় ফুলে ফুলে উঠবে নীল নীল ঢিপ। কয়েক জোড়া থ্যাবড়া আঙ্গুল খুব যত্নে বুলাবে হলুদ তেল। আরামে চোখ বুজে আসবে তার……
পুকুর দক্ষিণে আরও দক্ষিণে ফেলে হনহনায় চ্যামটা। খা খা মাঠের পশ্চিমে ছেদড়ান ছাতিমের উপচান ঝাঁ ঝাঁ গন্ধে টাল লাগে মাথায়। ভোর রাতের লাখ ধুলায় পায়ের থোর পর্যন্ত ধারাল হয়ে থাকে রোম রোম। কি য্যান একটা জাগান দেয় শরীর জুড়ে।কোঁকড়ান চুল, আলুথালু মাথা দলা পাকায় কুঁকড়ায় আছে ছাতিমের পিছে। গনগনা গরমে নাক কান ঠোঁট মুখে ভীষণ খুন খুন পায়। কোমরের নীচে অচেনা একটা ঠ্যাটানি নিয়ে খাড়ায় থাকে বাঁড়া।হাত পা কাঁপে কি একটা কোঁতে – রাগ – শিরশিরানি – ভয়ের চিনা জানা রাস্তায় হাঁটে না সে কোঁত। পাথর হাতে নিয়া আগায় চ্যামটা।পিছন থেকে খামচায় ধরে ব্যাটার ঘাড়। জাপটায় ধরে তুমুল থাপড়ায় ব্যাটার গালে। হাত থেকে ছিটকায় পড়ে পাথর। অচেনা অজানা সব হাঁটা হাঁটি গুলান হঠাৎই ন্যাংটা শরীরের মতন সহজ হয়ে ওঠে। দুই হাতের লোহার বাঁধ এত নরমে জড়ান যায় কোন দিন জানা আছিল না। ঠোঁটের ভিতর ঠোঁট ছুয়ালেই এমন করে গলার নীচে হু হু জমে! কত দিনের জমে থাকা থরথরানিতে হাত অন্ধ মতন কি যেন খোঁজে ব্যাটার কোমরের তলায়।
“লাভলুরে আমার বুক খান খুব পুড়ায় বাপ!” ভাঙ্গা নিঃশ্বাসে নোনতা নোনতা কাইন্নার বিনুনির মতন কি সব আওয়াজ বাড়ায় গলা থেকে।
কোমরের তলায় চমক দিয়ে জমে ওঠে লাভলু। বমি আর চুমুকের থতমতানির আঠায় ঝিমঝিম ডুবতে ডুবতেই ছিঁড়া ফেলায় গায়ের উপর বিঁধে যাওয়া গা। ছিটকায় হুড়মুড় ভাঙ্গে চ্যামটা। খড়খড় হয় চোখ। ব্যাটার চোখের দিকে তাকান যায় না।
টালমাল ঘরে ঢোকে চ্যামটা। শুঁয়াপোকার গুটির ভিতর খুলে ফেলা চোখের আবছা ঘোরে টান টান হয়ে থাকে গায়ের শুঁয়া। খড় খড় করে গা। ‘এমন হবার না…এমন.. না…চেনা যায় না’। নাভি থেকে উঠে আসা দলা দলা নতুন হাত…নতুন চোখ……এত সহজে চেনা দিতে চায়, যে বমি উগরানর খুব চেষ্টাতেও বুক বুক হাওয়া বের হয়। রাগ! রাগ আসে!ঘরের পিছনের হলুদ ঝরান সজনা গাছের উপর রাগ আসে। কোটরে স্যাদায় যাওয়া কুইষ্টা জোনাকির উপর রাগ আসে। দরজায় ঘুরঘুর করা মোরগের উপর রাগ আসে।
উদাম অবশ কনক ছ্যাদরায় আছে মাচায়। ব্যাঁকা পা ঝুলে থাকে মাচার নীচে।
“বান মারিস মাগী!”
…………… গলার ভিতরে আলা-জিহ্বা পর্যন্ত গুঁজে যাওয়া কাপড়ের অলিগলিতে টুকরা টাকরি বিঁধে যায় মায়ের ন্যাংটা শরীর- উপচান শ্বাস-নীল কাল ব্যথা- লেলপা আঙ্গুলের তেল হলুদ দাগ। চুল হিঁচড়ায় যখন চ্যামটা তারে পুকুর পাড়ে নিয়া আসে, তখনও বুকের ভিতরের দুই ঢিবঢিবানি। এক গলায় পা দেওয়া ভয় আর এক খলবলানি আনন্দে অবশ শরীর।
পুকুরের দক্ষিণ ধারে, ঘাড় ধরে মাথা জলে ডুবায় দেয় চ্যামটা। হাত পা বুক ভীষণ মতন কিবা খুঁজতে গিয়ে তোলপাড় করে জল। নাক মুখ দিয়ে বুদবুদায় বার হওয়া শ্লেষ্মা পিত্তে, খাবার অভ্যাসে নাক গোঁজে তেলাপিয়া। হাত পা নখের আছড়ানিতে আঁচড় লাগে না জল শরীরে। ঢেউ যা ওঠে তা পাড়ে গুঁতা খায়ে আবার ফিরে আসে কনকের গায়ে। বাঁচার শেষ খড় কুটায় খুব জোরে বুড়বুড়ি কাটে পুকুর। জলের ভিতর এমন ছেঁড়া ভাঙ্গা হাঙ্গামার ভিতর চ্যামটার ঘাড়ে ধেবড়ে নামে শালের বাটাম। কোঁকড়ান চুল আলুথালু চোখ কোমর জলে চ্যামটাকে জলে ডুবাতে দেখে টের পায় – মরতে চলা মানুষের চোখের দিকে তাকান যায় না।
“হামাক তুই ঘেইন্না পাইস বাউ!”
এমনি কিছু একটা বোধহয় পূবের হালকা লালের সাথে গুলতে থাকে জলে।
শান্ত হয় জল।
থামে হাত পা শরীর।
ঘোলা জলের নীচে, পুকুর তলে পেট ঠেকায় তেলাপিয়া।
মাথার পিছনে ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্ত হাত পায়ের তড়পানিতে এক দুই ফোঁটা লাগে কার কার গা হাত পায়ে।
শক্ত থেকে নরম হয়ে আসে চ্যামটা।
“বাংলা খায়া পাওত উষ্টা খায়া পড়ি যায় পুকুরত!তলার পাথরে মাথা ফাটে। ভুইল না এইটা”। ঠান্ডা লেলপা আঙ্গুল বুলানর মতন আরাম আরাম গলায় লাভলুরে বুঝায় কনক।
সজনা গাছের হলদা পাতার ভিতর দিয়ে তারা পশ্চিমে ঢলতে থাকে। পুকুর পাড়ে আইসে দাঁড়ায় কনক। পাথর-উষ্টা- রক্ত- পুকুর……… ঘোলা ঘোলা মিশে যায় ঘুমে। মনে থাকে না। কিছুতেই মনে থাকে না।
ঘরের ভিতর বাড়তে বাড়তে বারান্দা থেকে মাচার পাশের পড়ার টেবল হয়ে উল্টা দিকের দেওয়াল পর্যন্ত ছড়াবে লাভলু। ঘুমের ভিতর এক ন্যাংটা মরদ তার বুকে বইসে রোজ রোজ ফিসফিসাবে “ হামাক তুই ঘেইন্না পাইস বাউ!”
Posted in: February 2021 - Cover Story, STORY