কার্ল ইয়ুং – কুণ্ডলিনী যোগের মনস্তত্ত্ব : অনুবাদ – অর্ঘ্য দত্ত বক্‌সী

১৯৩২ সালের সেমিনারে প্রদেয় এ বক্তৃতার মূল উদ্দেশ্য ছিল অপরিচিত ভারতবর্ষকে জানা চেনার জন্য পাশ্চাত্যের অপরিসীম কৌতুহলকে কিছুটা পূরণ করার চেষ্টা। এখানে কুণ্ডলিনী সাধনাকে পাশ্চাত্যের মনোবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে; এমনভাবে যা কিনা হয়তো সিদ্ধ তান্ত্রিকরাও করেন না। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত যেমন ভারতেরই সাধারণ মানুষের কাছে শুধু সেই “আ আ আ আ …” তেমনই কুণ্ডলিনী বা তান্ত্রিক সাধনা বিষয়ে জ্ঞান আপামর ভারতবাসীর কাছেও প্রায় শূন্য, কিছুটা ভয়-ভীতি-ভক্তির ব্যাপার! সেই ধারণাগুলি প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের আপামর জনতার কাছেই আজও ৮০% অধরা। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি যে ধর্ম-সাধনা-যোগ বা দেবদেবী বলে যদি কিছু আসলে থেকে থাকে তার মূল আকর হল কুণ্ডলিনী যোগ। তার থেকেই প্রতীকায়নে দেবমূর্তি, পুজোয় শঙ্খ কাসর ঘণ্টা, তার থেকেই প্রতীকে বলা পুরাণ কী সৃষ্টিরহস্য (সমুদ্র মন্থন)। ব্রাহ্মণ্যবাদের নিপীড়নে বিকারগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার আগে ধর্ম বলতে শুধু এটাই বোঝাতো। এগুলি দেহগত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। আবার এই অভিজ্ঞতা এক একজনের কাছে এক একরকম, তবে দেহগত বলে ( কোন আইডিয়া নয় ) সব ধর্মেই তাই এর প্রভাব কমবেশি আছে। তাই প্রাচীন ধর্মগুলির ‘গল্প’গুলো খানিকটা একরকম।
ব্যস এটাই, এখানে শুধু শরীরী-সংস্থানগতভাবেই নয়, প্রতিটি চক্রের চিত্রিত প্রতীকগুলিকে মনোবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীতে বিশ্লেষণ করে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে যে এই শরীরী চক্রস্থানে বীর্য উঠে এলে যা অনুভূতি হয়, তার সঙ্গে সঙ্গে মনেও এক আলাদারকমের ভাব জেগে ওঠে। সেই ভাবগুলিকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন ইয়ুং। তিনি নিজে যোগাসন প্রাণায়াম সবই করতেন। এছাড়াও এই বক্তৃতাগুলো গ্রন্থরূপে ও ইংরেজিতে আমেরিকায় প্রকাশিত হচ্ছে নব্বইয়ের দশকে। এবং বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা। এইসব চর্বণগুলি তাই প্রাসঙ্গিক থেকে যায়। কারণ কুণ্ডলিনী এক শাশ্বত জিনিষ ও যা যা শাশ্বত তাতেই অনুবাদকের আগ্রহ।

বক্তৃতা ১

ডঃ ইয়ুংঃ ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহোদয়াগণ, তান্ত্রিক যোগের বিষয়ে একটি আলোচনা সভায় সবে আমরা অংশগ্রহণ করেছি। এজাতীয় বিষয়ে সবসময়ই একপ্রকার ভ্রান্তি থাকে। তাই এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বা কোনো প্রশ্ন থাকলে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার জন্য আমি কিছুটা সময় চেয়ে নেব। সেই আলোচনা সভায় যারা ছিলেন না তারাও আগ্রহী হবেন, কারণ চক্রগুলিকে নিয়ে আমি আগেও আলোচনা করেছি। আমরা সেই পর্যায়ে এসে গেছি যেখানে তান্ত্রিক যোগ আমাদের মধ্যে ক্রিয়া করতে শুরু করে দিয়েছে। আপনাদের স্মরণে থাকবে যে কীভাবে একজন রোগীর স্বাভাবিক ও মোটেই বিশেষ কিছু দ্বারা প্রভাবিত নয় এমন বিকাশেও প্রথম মণ্ডলটির দর্শন এসেছে। গত বসন্তের আলোচনাসভাতেও আপনাদের আমি দেখিয়েছিলাম একটি মণ্ডল যা নিজেকেই নির্মাণ করে নিয়েছে, বৃত্তের মধ্যে এক শিশুর মণ্ডল চিহ্ন এবং সেই রোগিনীর শিশুটির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা। ( তার দর্শনটি ছিল এরূপঃ আমি কালো প্রেক্ষাপটে দুটি স্বর্ণাভ বলয় দেখলাম। ছোট বলয়টিকে তদাপেক্ষা বড় একটি বলয় ঘিরে রেখেছে। ছোট বলয়টির কেন্দ্রে একটি ছোট্ট ছেলে শুয়ে রয়েছে, যেন ওটি একটি মাতৃগর্ভ। সে গর্ভরসে আবৃত। আমি শিশুটিকে ধরতে গেলাম, সেও আমার দিকে তার দুবাহু বাড়িয়ে দিল, কিন্তু আমি বড় বলয়টির মধ্যে ঢুকতেই পারলাম না।) এর অর্থ মণ্ডলে প্রবেশের চেষ্টা, আর এখান থেকেই তান্ত্রিক যোগ শুরু হচ্ছে। এখান থেকে তাই বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। আগের আলোচনাসভা যা আধারিত ছিল ও নিয়ে গিয়েছিল তান্ত্রিক মনস্তত্ত্বের দিকে তাকে আমি এখন মণ্ডল মনস্তত্ত্ব বলতে চাইব।
বেওয়ার্ডের প্রশ্ন থেকেই শুরু করিঃ ‘ক্লেশ অস্মিতা’য় সুপ্ত থাকে ‘ব্যক্তি-আমি’র বীজ আর ‘ক্লেশ দ্বেষ’এর ইচ্ছাই হল দ্বিধা বিভক্ত হওয়া বা ঘৃণা। ( হেয়ার ক্লেশকে বর্ণনা করেছেন অন্তর্জ্ঞানের মূলগত শক্তি রূপে এবং আমি এটাকে দেখি ‘রোগ বা যে শক্তি রোগের দিকে নিয়ে যায়’ সেই অর্থে। ক্লেশ দ্বেষ প্রভৃতিকে তিনি দ্বিত্বে ভাগ হয়ে যাওয়ার শক্তি হিসাবে দেখেছেন যেখানে ‘আমিত্ব’ ও ‘ব্যক্তিত্ব’ দ্বিধান্বিত হয়ে যায়। অস্মিতা হল অহং এবং ‘আমি ভাবি, আমি করি, আমি অভিজ্ঞতা অর্জন করি’ ইত্যাদি বোধই হল ‘অস্মিতা’।) সুতরাং যখন এই ঘৃণাই আসলে ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে, তাহলে কী করে একে নির্মূল করা সম্ভব?
দ্বিধাবিভক্তি ও বৈষম্যতাই ক্লেশ, ব্যক্তিত্ব তৈরি করা ছাড়াও ঘৃণার অন্য আঙ্গিক রয়েছে। ক্লেশের মাধ্যমেই প্রাথমিকভাবে মানসশক্তি অবচেতন থেকে বেরিয়ে আসে। তান্ত্রিক মতেও ব্যক্তিত্ব তৈরি করার তাগিদ থাকে, যা আত্মগত এবং অন্যান্য সত্তা থেকে পৃথক আর তাকেই বলা যায় বিচ্ছিন্ন হওয়ার ক্লেশ। একেই পাশ্চাত্য বলবে ব্যক্তি রূপায়ন প্রক্রিয়া।
পৃথক স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা হিসাবে গড়ে ওঠার তাগিদ এই পৃথিবীতে সব প্রাণীরই রয়েছে। জীবনের অন্যতম প্রচেষ্টাই হল ব্যক্তিসত্তাকে যতটা পারা যায় পরিপূর্ণ করা। একটি পাখি যেমন নিজের প্রজাতির সম্পূর্ণ দৈহিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট প্রকাশ করে; তেমনই নিজের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতার জ্ঞান, আত্মজ্ঞান লাভের প্রবল ইচ্ছা মানুষকে তার নিজস্বতার দিকে নিয়ে যায়। সুযোগ দিলেই ব্যক্তি উপলব্ধির মাধ্যমে নিজের স্বরূপ প্রকাশের চেষ্টা করবে। সুতরাং যে ক্লেশ ব্যক্তিত্বের বীজ বহন করে তাকে স্বাতন্ত্রের বীজও বলা চলে। হয়ত পূর্ণসত্তা কখনই বিকশিত হয় না, কিন্তু একটি ব্যক্তি-একক থাকে। সমগ্র সত্তার জ্ঞান কারও নাও থাকতে পারে, কিন্তু অন্যান্য ব্যক্তিরা ব্যক্তিসত্তাটিকে তার নিজের থেকে বেশি চিহ্নিত করতে পারে। এই পৃথিবীতে সবাই স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা হতে চায়, এমনকি মানবেতররাও। কিন্তু কুকুরের মোট যে সত্তা তার বিষয়ে তার নিজের কাছে অতি অল্পই ধারণা থাকে। ব্যক্তি-রূপায়ন প্রক্রিয়া তখনই শুরু হয় যখন ব্যক্তি তার বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে, নাহলে ব্যক্তিসত্তা জন্ম থেকেই বিদ্যমান।
জনৈকাঃ এখানে দ্বেষের প্রাসঙ্গিকতা কী?
ইয়ুংঃ ঘৃণা বিভক্ত করে, বৈষম্যতা বানায়। দুজন যখন প্রেমে পরে তখন তারা একাত্ম হয়ে যায়। তাদের তদাত্মতাকে ভাঙতে তখন প্রবল ঘৃণার শক্তি লাগে। নাহলে তাদের মধ্যে এক সাধারণ অবচেতন তৈরি হবে যা বেশিদিন চলতে পারে না। মনোচিকিৎসার ক্ষেত্রেও তাই। প্রথমে সমীক্ষকের সঙ্গে প্রবল মানস-সংলগ্নতা তৈরি হয়, তারপর কিছুদিন এভাবে চলার পর তৈরি হয় এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ।
প্রাচীন গ্রিকেরা ভয়কে ঘৃণার স্থানে বসিয়েছে। হয় জীবনীশক্তি নয় ভয়। এবং ভয় ঘৃণার থেকেও বেশি শক্তিশালী অনুভূতি কারণ তা ঘৃণার থেকেও বেশি পৃথগীকরণের চেষ্টা করে। মানুষকে পলায়নবাদী করে তোলে। এবং ভারতবর্ষে বিশ্বাস করা হয় যে ভালবেসে ঈশ্বরকে সাত জন্মে পাওয়া যায় আর আর ঘৃণা করলে তিন জন্মেই তার দর্শন হয়। কারণ কাউকে ঘৃণা করলে তার কথা ভালবাসার মানুষের থেকেও অনেক বেশি করে সর্বদাই মনে পরে। সুতরাং ঘৃণা এক প্রবল অনুভূতি। কিন্তু পাশ্চাত্য মন যেহেতু অনেক বেশি ভেদযুক্ত আত্মপরায়ণ তাই গ্রিকদের মতো সে সভ্যতায় ভয়ই ঘৃণার থেকে বেশি প্রযোজ্য অনুভূতি।
জনৈকাঃ তাই হয়ত চক্রগুলি সাংকেতিকভাবে ভয় দূর করার সবচেয়ে ভালো উপায়।
ইয়ুংঃ কিন্তু সেখানে দেবতাদের হাতে অস্ত্রও রয়েছে, আর অস্ত্র ভালবাসার প্রকাশভঙ্গী নয়।
জনৈকাঃ প্রফেসর হেয়ারের মতে বিভক্ত বা দ্বিত্ব হওয়ার অর্থ আলাদা হওয়া নয়; বরং বিষয় থেকে বিষয়ী হয়ে ওঠা। বস্তুর থেকে নিজেকে পৃথক করা।
প্রশ্নঃ তাহলে যোগীর কাছে ব্যক্তি-রূপায়ণে ঘৃণা কি এক প্রয়োজনীয় জিনিষ?
ইয়ুংঃ তাছাড়া উপায়ও নেই, তান্ত্রিক বা অন্য যোগীদেরও প্রধান ঝোঁক থাকে স্বতন্ত্র এক ব্যক্তিসত্তা হয়ে ওঠা। এমনকি ঈশ্বরও একা, ব্রহ্ম যিনি অখণ্ড অস্তিত্বহীন অস্তিত্ব।
জনৈকাঃ এবং যখন সে নিজের ব্যক্তিসত্তাকে গঠন করে তখন কীকরে ঘৃণা সমূলে উৎপাটিত করে?
জনৈকাঃ হেয়ার ক্লেশের দুটি দিক দেখিয়েছেন। দোষযুক্ত অবস্থায়- স্থূল অর্থে- বিষয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বিষয়ী হওয়ার ইচ্ছা যা ঘৃণার সঙ্গে সংযুক্ত। আর সূক্ষ্ম অর্থে সেই ইচ্ছাই ব্যক্তিরূপায়ণের শক্তি হয়ে ওঠে।
ইয়ুংঃ এই সমগ্র পরিভাষায় এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকারী শব্দগুচ্ছ এই সূক্ষ্ম ও স্থূল- ও তাদের ধারণার পার্থক্য করতে পারা। আমি ‘পরা’র ধারণার বিষয়ে কিছু বলব না কারণ হেয়ার তাকে অধিবিদ্যিক বলেছেন। কারণ সেখান থেকে আমার চিন্তা কুয়াশাচ্ছন্ন হয়েছে- সেই ঝুঁকি আমি নেব না। স্থূল দশা হল যা আমরা দেখি শুনি। আর সূক্ষ্ম দশা হল যা আমরা অনুমান করি বা যা বিমূর্ত বা কিছু পর্যবেক্ষণজাত সত্য থেকে কোন দার্শনিক সিদ্ধান্তে আসা। মানুষ দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় তারপর তাদের অহং প্রতিরোধ ও ঘৃণা জাগায়; এ হল স্থূল দশা। এবং আমরা শুধু ঘৃণার ক্লেশকেই চিনি যাকে দ্বেষ বলা হয়। আরো অগ্রসর হলে বোঝা যায় যে এই বোকার মতো ঘৃণা, যাবতীয় ব্যক্তিগত প্রতিরোধ আসলে অনেক বড় আর গভীর কোনো জিনিষের বাহ্যিক রূপ।
কখনও কখনও মানুষেরা অভিযোগ করে যে যাদের তারা ভালবাসে তাদের সঙ্গেই সবসময় ঝামেলা ঝগড়া লেগেই থাকে। তাদের মনোবিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে তারা নিজেদের সত্তা ভালবাসার মানুষের মধ্যে একেবারে মিশিয়ে দিয়েছিল যতক্ষণ না তাদের সঙ্গে একেবারে একাত্ম হয়ে যাওয়া হয়। এবং এটাই স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তার নিয়মের পরিপন্থী। সেখানে আলাদা হওয়ার জন্য প্রতিরোধ গড়ে উঠবেই। এই প্রতিরোধ এক স্বাভাবিক ব্যাপার। এই ঝামেলা ও নৈরাশ্যের মধ্যে একজন তার সত্তা বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠে; তখন আর তার মধ্যে ঘৃণার কোন অস্তিত্ব থাকে না।
এবং সেটাই হল সূক্ষ্ম দশা।
সুতরাং একজন যখন বুঝে ফেলে যে যেখানে ভালবাসা সেখানেই অবশ্যম্ভাবীভাবে ঘৃণার উদ্রেক হয় তখন সম্পর্কের ওঠাপড়াগুলো নিয়ে সে আর প্রভাবিত হয় না। এটাই জীবনের বিরোধাভাস যে কেউ সম্পূর্ণ নির্ভুল নয় ও সে সবসময় আত্মগতও থাকতে পারে না। এটা আমাদের ধারণামাত্র যে আমরা জীবনে সবসময় পরিপূর্ণ স্বচ্ছ অবস্থার মধ্যে থাকব। কিন্তু এটা অসম্ভব- এটা খুব বেশিভাবেই একতরফা, কিন্তু আমরা তো আর একতরফা নই। মনোসমীক্ষণ সূক্ষ্ম দশার কথা বলে এই ঘৃণাকে মূল থেকে উৎখাত করে, সেই দশার কথা বলে যেখানে আছে অনুভব, বিমূর্ততা, তত্ত্ব ও প্রজ্ঞা। এভাবে আমরা শিখি যে যা অনুশোচনাময় অভ্যাস বা সহ্যাতীত মানসিক অবস্থা বা অবর্ণনীয় মতভেদ তা সবই স্থূল দশাজাত, সেগুলিই সূক্ষ্মদশায় অনেকটা অন্যরকম।
তার পরের বিষয় হল তৎত্ব ( বা thatness – হেয়ার – পৃথিবীর সেই আন্তরশক্তি যা সৃষ্টি ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে – সেই সে এবং সেই মহৎ সে) ও সংস্কারের কি কোন মনস্তাত্ত্বিকভাবে সমতুল্য ব্যাখ্যা আছে? তৎত্ব হল বিষয়ের নিহিতার্থ, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে যা সূক্ষ্ম দশার। যৌনশক্তি বা প্রাণশক্তি এর একটি ভালো উদাহরণ। শক্তি কোনও বস্তু নয় বরং একটি বিমূর্ত ধারণা। শক্তিকে প্রকৃতিতে প্রত্যক্ষ করা যায় না, এর কোন অস্তিত্ব নেই। আমরা যা দেখি তা হল প্রাকৃতিক জিনিষে শক্তির প্রকাশ; যেমন আগুন, আলো, ঝর্ণা ইত্যাদি। আমরা শক্তি শব্দটি ব্যবহার করি কিন্তু তা বাস্তব নয়, যদিও বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে তা কেনা বেচা করা যায়। সেগুলি হল শক্তির রূপকমাত্র। কিন্তু প্রকৃত শক্তি হল শক্তির বিমূর্তভাব, একটি প্রাবল্যবিশেষ। তাহলে শক্তি মূলত হল প্রাকৃতিক বলের সূক্ষ্ম দশা। আমরা জানি যে প্রাচ্যের মন হল মূর্ততাময়- যখনই তারা কোনও সিদ্ধান্ত নেয় বা একটি বিমূর্ত ধারণা করে তা তাদের কাছে বস্তুগত – তাদের তারা দেখতে ছুঁতে পারে। পাশ্চাত্যের কাছে এইসব ধারণা এতই কৃত্রিম ও ভ্রান্ত যে শক্তির মতো তত্ত্বকে তারা মনে করে খুবই সহজ, এতই সহজ যে একজন বিদ্যুত-কারিগরও মনে করে যে সে শক্তির বিষয়ে সব জানে। একে তো কেনা যায়, বেচা যায় তাই এতো খুবই বাস্তব। কিন্তু আসল বাস্তবে এর কোন অস্তিত্বই নেইঃ এটি প্রথানুযায়ী একটি ধারণা মাত্র, বিবিধ বস্তু বা পদার্থের মধ্যে বিক্রিয়ার এক প্রাবল্য বই তো নয়। কিন্তু প্রাচ্যমন যখন তৎত্বের কথা বলে তখন তারা একে ধারণ করে আছে, তা পূর্ণ বাস্তব অস্তিত্বময়- যেন তৎত্বকে তারা প্রত্যক্ষ দর্শন করতে পারে। তারা কোনও ধারণাকে, যতই বিমূর্ত হোক প্রত্যক্ষ করে। সুতরাং যেখানে প্রাচ্যের কাছে তৎত্ব প্রত্যক্ষজ ও স্থূল, আমাদের কাছে তাই সূক্ষ্ম একটি ধারণা। মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বা অণুর ধারণা বা ইলেকট্রনের ধারণা – এরাই হল তৎত্বের মতো। মনোবিদ্যায় একে বলা যায় যৌনশক্তি যাও কীনা একটি ধারণাই।

Facebook Comments

Leave a Reply