লা দিভিনা কোম্মেদিয়া ও বোধ পরীক্ষণ : অনির্বাণ বসু
লা দিভিনা কোম্মেদিয়া
ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে আনমনে হেঁটে চলে সআদত। ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে রকমারি মদের বোতল, থরে-থরে সাজানো, হরেক কিসিম; ততরকমের আফসানা, হাতছানি─তবু রাস্তার ধারের সেই মদের দোকানের কাচের শো-কেসগুলোর দিকে তাকায় না সে; তার বহুদিনের চেনা, পরদা-ঝোলা দেশি মদের দোকানের দিকেও, এমন-কি, নয়। অপরিচিত নতুন কেউ এই অবস্থায় যদি তাকে দেখে ফেলে, বিলক্ষণ ভাববে, মদ বস্তুটা আদতে কী তা যেন সআদতের জানা নেই, যেন জানতও না কখনও। সে যে কস্মিনকালেও মদ খায়নি, এমনটা নয়; কিন্তু এই মদের কারণেই সে ন্যালাখ্যাপা হয়ে ঘুরে বেড়ায় আজকাল─এটাও সত্যি৷ তবে কি সে মদ খেয়ে তার যাবতীয় স্নায়বিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছে? দীর্ঘদিন অপরিমিত মদ্যপানের পর আজ এই মুহূর্তে তবে কি সে বিকারগ্রস্ত? শরাবি? কম্পমান ঈষৎ? অথচ আর-পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে যখন, গলার স্বর খাদে থাকলেও জড়ানো শোনায় না, চায়ের দোকানে গিয়ে যখন গ্লাসে চা খায়, তখন সআদতের হাত কাঁপে না একটুও, ফলত তাকে ওই গোত্রেও ফেলা যায় না।
তবু এহেন সআদত, আজ বহু বছর হল, মদ থেকে ঢের দূরে। পাড়ার ঘিঞ্জি হয়ে-যাওয়া রাস্তা দিয়ে সে হেঁটে যায় যখন─জোরে আজকাল আর হাঁটে না সে, ধীর-মন্থর ছন্দহীন হাঁটে খানিক বেখেয়ালে─পাড়ার টেনিয়ারা কেউ-কেউ টিটকিরি দেয়, কেউ বলে পাগল, কেউ-বা নাক সিঁটিয়ে সঙ্গে জুড়ে দেয় বিশেষণ : সেয়ানা। আলাভোলা একা সআদত পথ হাঁটে তবু; মাথাটা ঈষৎ নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে। একদা সংখ্যাগুরুর দলে-থাকা সআদত এখন, সর্বার্থেই, সংখ্যালঘু। তবু বাটোয়ারার সময় দেশ ছেড়ে সম্পূর্ণ না-জানা আর-একটা দেশে চলে-আসা নিয়ে তার কোনও আফশোস ছিল না কখনও। সে তো আর একা আসেনি, সঙ্গে এসেছিল তার প্রিয় মানুষটি, যে-প্রিয়জনের জন্য নির্দ্বিধায় পারিবারিক ঘর-দুয়ার টপকে যাওয়া যায়, তেমনই একজনের জন্য; তেমনই একজনের সঙ্গে শলা করে পালিয়েছিল দু’জনে। নিজের গ্রাম পরশমণি ছেড়ে আসতে কম কষ্ট হয়নি তার, কিন্তু তখন তার সামনে ইসমত ছিল, সে-ও তো আসলে পালাচ্ছিল; সআদত পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যাচ্ছিল আর ইসমত পশ্চিম পাকিস্তান।
সিন্ধু নদকে ছেড়ে ইসমত আর কীর্তনখোলা নদীকে ছেড়ে সআদত এসে পড়েছিল এক নতুন দেশে, যেখানে তারা সংখ্যালঘু। তবু তারা বেছে নিয়েছিল এই দেশটাকে, কেন-না, মাঝখানের এই দেশটাই জুড়ে রেখেছিল পরস্পরের জন্মভূমিকে। পালানোর আগে স্থির হয়েছিল, দু’জনের দেখা হবে দিল্লিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে─সবে পঁচিশ বছর বয়স তখন তার, সেভাবে সেজে ওঠেনি তখনও, ওরা চিঠিতে জানিয়েছিল, জেনেছিলও এমন-কি, সেই প্রায় সদ্যোজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনেই থাকবে তারা; সেখানেই দেখা হবে তাদের, বহুদিনের দাবদাহের পর বৃষ্টি নামবে চোখের পাতায়─আনন্দজল। সআদত তাকে বাংলা ভাষাশিক্ষার কিছু প্রাইমার রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠালেও ইসমত তখনও বাংলা ভাষাটা পুরোপুরি আয়ত্তে আনতে পারেনি, কারণ যেহেতু তার বাড়িতে সবাই উর্দুতে কথা বলে, ফলত তার বাংলা বলার অক্ষম চেষ্টায় ক্রিয়াপদ গুলিয়ে যায় এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে উর্দু শব্দ। সআদত যে তাকে বাংলা শেখার জন্য জোরাজুরি করেছিল, তা নয়; বরং ইসমত নিজেই চেয়েছিল ভাষাটা শিখতে : ওদের বিয়ের পর সআদতের আম্মি-আব্বুর সঙ্গে সম্পর্ক সহজ করে তোলার উপায় হিসাবেই বিষয়টাকে দেখেছিল ইসমত আর তাই বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই মোটামুটি চলনসই একটা কথোপকথনের ভাষা, নিজের মতো করে, তৈরি করে নিতে পেরেছিল সে।
কথামতো ট্রেনে চেপে বসার আগে মাথার উপর থেকে ওড়না সরিয়ে বুকের উপর ফেলে দিয়েছিল ইসমত, বোরখা খুলে ফেলে দিয়েছিল পথে আর মোটা একটা বিনুনি করে নিয়েছিল চুলে। সঙ্গে ছোটো কোনও ছোরা─কৃপাণ─না-থাকলেও তখন তাকে হঠাৎ করে দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সে মুসলমান, না শিখ। এদিকে সআদতকে এত কিছু করতে হয় না, শুধু নির্দিষ্ট অঞ্চল পার হয়ে সে জোগাড় করে নেয় একখানা নেহরু-টুপি। দিল্লির দিকে যত এগোয় সে, ছোটো-বড়ো-মাঝারি কংগ্রেসি নেতাদের আলাপ থেকে আগাম সুসংবাদের ঘোষণাটুকু─ঘোষণাই মনে হয় তার─শুনে ফেলে : স্বয়ং নেহরু নাকি ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, একবার ইংরেজরা বিদেয় হোক, তারপর তারা, মাথারা, আবার সব ঝগড়া ভুলে মিটমাট করে নেবে; পাকিস্তান রেডিয়োয় নয়, আকাশবাণীতে বড়ে গোলাম গাইবেন বন্দেমাতরম্।
দিল্লি পৌঁছানোর বাকি পথটা এরপর দ্রুত পেরিয়েছিল সআদত, এক তো ইসমতের সঙ্গে দেখা না-হওয়া পর্যন্ত মনের ভিতর তিরতির করে বয়ে-চলা খচখচানি, বহুবিধ বিপদের আশঙ্কাজনিত ভয়, উপরন্তু এই এত খারাপের মধ্যেও সামান্য যেটুকু আলোর আভাস তার নজরে পড়েছে, প্রিয় মানুষটার সঙ্গে কতক্ষণে তা ভাগ করে নেবে─তা নিয়ে ছটফটানি। যে-রাতে তারা উপনিবেশের কবল থেকে মুক্তি পাচ্ছিল, সেই রাতেই যে চুপিচুপি আবারও ডানা মেলছিল উপনিবেশের প্রভু আর দাসের সম্পর্ক, ওরা দু’জনেই বুঝে গিয়েছিল তা। ওরা চেয়েছিল, ওদের উত্তরপুরুষ এক স্বাধীন দেশে জন্ম নেবে, নিজের মৃত্যুর বিনিময়ে আপনজনের রোগব্যাধি আর ধারণ করতে হবে না, শুকনো ভবিষ্যৎবাণীর ভিতর থেকে তারা তুলে আনতে পারবে জীবনের সম্ভাবনা।
বাউন্ডারি কমিশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পূর্ব আর পশ্চিম─দুই পাকিস্তান─কীর্তনখোলা আর সিন্ধু নদ─সেদিন আরাবল্লীর উপর এক হয়ে গিয়েছিল; গোটা অগ্রদ্বারনগর তার ষোড়শ শতকীয় সুমহান ফতেপুর সিক্রির মধ্যবর্তী লাল পাথরের সৌধ নিয়ে উঠে এসেছিল সেলিম চিস্তির কবর থেকে। জ্যোৎস্না-তমসা ভেদে তাদের এহেন অভিসারযাত্রার ব্যথিত অহংকারের সামনে শ্রদ্ধায় প্রণত হয়েছিল বুলন্দ দরওয়াজার জোড়া লৌহকপাট। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে প্রেমের আনন্দগান রচনা করেছিল জীবনের মধুর সঙ্গীত, যখন ইসমত ‘আসসালাম আলায়কুম’ বলে ডান হাত নিজের মুখের কাছে এনেছিল আর একই কায়দায় ‘ওয়ালেকুম আসসালাম’ বলেছিল সআদত। এরপর ওরা দু’জনেই, নিজের-নিজের বাড়িতে, টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিয়েছিল, ওরা সহিসালামত পৌঁছে গেছে এক নতুন দেশে─ইন্ডিয়ায়।
দিল্লি, ভারতের রাজধানী, ফলত আগস্টেই স্বাধীনতার উৎসব-আয়োজনের মধ্যে শুরু হয়ে যায় উদ্বাস্তু খেদানোর কাজ। যারা এর মধ্যে তবু দল বেঁধে আশ্রয় খুঁজছিল, তারা কোনও-না-কোনওভাবে পরিত্যক্ত কোনও বাড়ি জুটিয়ে নেয় কিংবা নিজেদের মতো করে গড়ে নেয় ঝোপড়পট্টি। সআদত আর ইসমত, ওরা শুধু একে-অপরের; কোনও দলেই ঢুকতে পারেনি, ওই পরিস্থিতিতে কী করবে মনস্থির করতে না-পেরে উঠে পড়েছিল হাওড়াগামী কোনও-একটি ট্রেনের ভিড়ে-ঠাসা কামরায় এবং নির্দিষ্ট সময় অতিক্রমণের শেষে ভালোয়-মন্দে দুলতে-দুলতে পৌঁছে গিয়েছিল আর-এক নদীর পারে─গঙ্গায়; বিস্ময়ে দেখেছিল ওরা, হিন্দুদের পৌরাণিক এবং লোকায়ত─যুগপৎ─দেবতার গলায় জড়ানো সাপের মাথার দিকখানা নড়ে উঠতেই তাঁর জটা থেকে তীব্র বেগে নেমে আসে জলধারা এবং সেই খরস্রোতাকে শঙ্খধ্বনি করে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে সেই রাজর্ষি, পুরুষের ঔরস ছাড়া শুধু দুই বিধবার মিলনে জন্ম যার :
মাতঃ শৈলসুতাসপত্নি বসুধা-শৃঙ্গারহারাবলি
স্বর্গারোহণবৈজয়ন্তি ভবতীং ভাগীরথীং প্রার্থয়ে |
তত্ত্বীরে বসতস্ত্বদম্বু পিবতস্ত্বদ্বীচিমুৎপ্রেক্ষতঃ
স্ত্বন্নাম স্মরতস্ত্বদর্পিতদৃশঃ স্যাম্মে শরীরব্যয়ঃ ||
মা, তুমি শৈলসুতা পার্বতীর সপত্নী। পৃথিবীর বিলাসহারস্বরূপা। তুমি স্বর্গারোহণের বিজয়পতাকা। হে ভাগীরথি, তোমার কাছে এই প্রার্থনা─আমি যেন তোমার তীরে বাস করতে পারি। তোমারই জল যেন পান করতে পারি। তোমার তরঙ্গ দেখতে-দেখতে, তোমার নাম উচ্চারণ করতে-করতে, তোমাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে যেন আমার শরীরব্যয় হয়।
জন্ম হওয়া ইস্তক নদ-নদীর স্পর্শধন্য ইসমত ও সআদত অতঃপর নেমে আসে সেই নদীর লাগোয়া ঘাট ধরে, জলে ডুবিয়ে নেয় নিজেদের পায়ের পাতা, আঁজলা ভরে জল তুলে মুখে মাখে। পুবাকাশে তখন নতুন সূর্যোদয়।
নতুন সেই প্রদেশ জুড়ে তখন বাক্স থেকে উপচে-পড়া দেশলাইকাঠি─শরণার্থী স্রোত, একদল মানুষের কাঁধে লাল পতাকা আর হাতে কৌটো অথবা লাল শালুর খুট; তাদের সঙ্গে ভিড়ে যায় সআদত এবং নিজেদের পরিচিত করে তোলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে─ময়মনসিংহ থেকে─হিন্দুদের তাড়া খেয়ে চলে-আসা হতভাগ্য মুসলমান দম্পতির পরিচয়ে। কমিউনিস্ট পার্টির লাগাতার আন্দোলনের ফলেই হল কিনা, তা ঠিকমতো বুঝে উঠতে না-পারলেও, আহিরীটোলায় মোটামুটি একটা দু’ কামরার বাসা, মোটের উপর, জুটে যায় ওদের। এমন-কি, ওই কমিউনিস্ট পার্টিরই একজন, শাহিদ লতিফ, তার আব্বাজান কংগ্রেসের মেম্বার, বিধান রায়ের পাশে মাঝেমধ্যেই দেখা মিলে যায়, তদ্বির করে নিম্ন-বুনিয়াদি স্কুলে পড়ানোর একটা চাকরি জুটিয়ে দেয় ইসমতের।
বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করা হলে উদ্বাস্তু আন্দোলনের উপরই আঘাত নেমে এল শুধু, তাই নয়, নিজে পার্টির মেম্বার না-হলেও আন্ডারগ্রাউন্ড হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রধানত ওরাই ছিল সআদতের বন্ধু, ইসমতও ব্যস্ত তার স্কুল, স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে─ফলত সে, সআদত, ভিতরে-ভিতরে অনেকখানি একা হয়ে গেল। ঠিক এই সময়ই─প্রথম-প্রথম কালেভদ্রে, পরে প্রায় নিয়মিত─মদ গিলতে শুরু করে সআদত। অথচ এই দেশে আসার পর কবিতা লেখা ছেড়ে গল্প-উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিল সে; চারপাশের গৃহহীন মানুষের মিছিল, লঙ্গরখানার বাইরে গয়ংগচ্ছ কিউ তার ভিতরের কবিসুলভ মনটাকে নিংড়ে ফেলেছিল এবং সে, অতএব, কাব্যকে বিদায় জানিয়েছিল মনে-মনে। সে শুধু লিখছিল না, ‘প্রবাসী’ ‘পরিচয়’ ‘নতুন সাহিত্য’ ‘অরণি’ ‘চতুরঙ্গ’ বা ‘পূর্ব্বাশা’-র মতো কাগজে সেগুলো ছাপাও হচ্ছিল দিব্য। সংসারে সামান্য হলেও, টাকা দিতে পারছিল তখন : গল্প পিছু দশ টাকা। কাগজের অফিস থেকে টাকা পেলে সোজা ঘরে এসে ইসমতের হাতে গুঁজে দিত সআদত। কিন্তু এই মদ ধরার পর থেকে ছেদ পড়ল সেই নিয়মে। টাকা পেলেই তখন সে চলে যেত হাড়কাটায়; রাত বেশি হয়ে গেলে সোনাগাছি। দেশি মদের বোতল কিনে মোটামুটি ফাঁকা একটা জায়গা দেখে বসে পড়ত। তারপর বোতলটা শেষ করে টলোমলো পায়ে ফিরে আসত ঘরে : মাতালরা কখনও বাড়ির পথ ভোলে না।
প্রথম-প্রথম সআদতকে বোঝানোর চেষ্টা করত ইসমত, মদের ঘোরে দমকে-দমকে কাঁদতে-থাকা নিজের ভালোবাসার মানুষটার মাথা তুলে নিত কোলে, এক হাত পিঠে ঘুরে বেড়াত, অন্য হাত বিলি কেটে দিত চুলে। একটা সময় ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়ত সআদত, রাতের খাবার─ঢাকা কিংবা আঢাকা─পড়ে থাকত যেমন-কে-তেমন, আরশোলা হেঁটে বেড়াত অবাধে আর সেইসব সময়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ত ইসমতের। তারপর একদিন সেই দীর্ঘশ্বাসটুকুও যেন কর্পূরের মতো উবে গেল ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে হাওয়ায়। খাওয়া নিয়ে পীড়াপীড়িও কমে এল। মাতাল সআদতকে কিছু বললে খুব কমই উত্তর মেলে, আর যদি-বা কিছু বলেও ফেলে কখনও, তবে সেসবের কোনও মাথা-মুণ্ডু খুঁজে পায় না সে, উলটে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায় যা সহজে থামে না। এমন-কি সআদত যে রোজ রাতে বাড়ি ফেরে, তেমনটাও নয়। সেইসব রাতগুলোয় শুধু জল খেয়ে শুয়ে পড়ত ইসমত। শুলেও ঘুম আসত না। বরং তার মনে চেপে বসত ভয় : রাতবিরেতে সআদতের জন্য-না আবার থানা থেকে ডাক আসে!
মন তো আগেই ভেঙেছিল, ক্রমে শরীরও ভাঙছিল ইসমতের : দিনে একবেলা খেলে যা হয়। আহিরীটোলার ঘাটটায় বিকেলের দিকে কখনও-সখনও গিয়ে বসত সে। রোগা শরীরে নদীর হাওয়া বেশ লাগত৷ জলের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ে যেত সম্পর্কের শুরুর দিনগুলোর কথা। সবে চাকরিটায় যাওয়া শুরু করেছে, একদিন স্কুলের একটা বাচ্চা মেয়ের পিরিয়ড হয়ে যায় ক্লাস চলাকালীন। মেয়েটার যত্ন নিতে গিয়ে কথায়-কথায় সে জেনে গিয়েছিল তার পরিবারের গল্প; জানলা দিয়ে সকলের অলক্ষ্যে উঁকি মেরে বুঝি-বা দেখে নিয়েছিল তাদের সাংসারিক বন্দোবস্ত। বিকেলে বাড়ি ফিরে পুরোটা সআদতকে বলেছিল সে। সবটা মন দিয়ে শুনেছিল সআদত, তারপর বলেছিল : ‘এই গল্পটা তুমিই লেখো। যেভাবে বললে, আমি সবটা যেন দেখতে পাচ্ছিলাম চোখের সামনে।’ ইসমত কিছুতেই লিখবে না, শেষমেশ সআদতের জেদের কাছে হার মানতেই হল। নিজের ফাউন্টেন পেনে কালি ভরে কাগজ সমেত তার হাতে ধরিয়ে মিছিলে চলে গিয়েছিল সআদত। রাতে আড্ডা মেরে ফিরে দেখে, ইসমত ততক্ষণে বাবা আর মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে লিখে ফেলেছে তার প্রথম গল্প : ‘পুট্’।
সে-গল্প কুটিকুটি করে ছিঁড়ে এই গঙ্গার জলেই ভাসিয়ে দিয়েছে ইসমত। কী হবে আর সেইসব সুখের স্মৃতি বয়ে! ওতে মন আরও খারাপ হয়। সুখস্মৃতির বাহ্য প্রমাণ মানুষকে কষ্ট দেয় শুধু। সে যে গল্পটা নষ্ট করে দিয়েছে─সআদত যখন শুনেছিল, তার মুখে কি কোনও বেদনার প্রকাশ দেখেছিল সে? এখন মানতে না-চাইলেও সে বিলক্ষণ জানে, সআদত সেদিন সত্যিই কষ্ট পেয়েছিল। পরে অনেকবার আবার করে লিখতেও বলেছে তাকে, আবেগে হয়তো সম্মতিও জানিয়েছে কখনও, কিন্তু ওই গল্প কেন, কোনও গল্পই আর কখনও লেখেনি ইসমত। সে বরং কবিতার কাছে যেতে চায়, মুক্তি খোঁজে কাব্যের মধ্যে। সআদতকে বহুবার বলেওছে সে-কথা, কিন্তু তার এক গোঁ : কবিতা সে লিখতে পারে না। অমন অক্ষম চেষ্টার মানেই নেই কোনও।
শাহিদ কবিতা লেখে─অন্ত্যমিলে মূলত। পার্টি তখনও নিষিদ্ধ হয়নি, সে দেওয়াল লিখত। দেওয়ালে ফুটিয়ে তুলত তার নিজের দু’ লাইন, চার লাইন। হাতের লেখাখানাও তার দেওয়াল লিখনের সঙ্গে মানানসই; সআদতের মতো টান না-থাকলেও, বর্গীয় ‘জ’ বাদে, ছাপা হরফের মতো হাতের লেখা তার। একদিন বিকেলের দিকে ইসমত যখন চুপচাপ বসেছিল গঙ্গার ঘাটে, হাওয়া ছিল না তেমন, গুমোট ভাব চারপাশে, শাহিদ এসে বসেছিল উলটোদিকে। তাকে দেখে গলা আর মুখের ঘাম মোছার অছিলায় চোখের কোলে ধরে-রাখা টলটলে জল হাতের রুমালে মুছে নিয়েছিল ইসমত। সেদিন কথাবার্তার পর সেই সাদা রুমাল চেয়ে নেয় শাহিদ এবং ওই কাটা-কাটা অক্ষর দিয়ে বুনে তোলে চার লাইন :
তার ঘর পুড়ে গেছে অকাল অনলে
তার মন ভেসে গেছে প্রলয়ের জলে
তবু এখনও সে মুখ দেখে চমকায়
এখনও সে মাটি পেলে প্রতিমা বানায়
রুমালখানা আর কাচেনি ইসমত, চন্দনের সুগন্ধী দিয়ে তুলে রেখেছে একান্ত করে। এই দম-বন্ধ-করা সংসারে ওইটুকুই তার কাছে বিশুদ্ধ প্রশ্বাস, প্রাণদায়ী নিশ্বাস। এভাবেই শাহিদের সঙ্গে ধীরে-ধীরে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে গেল তার, যে-বন্ধুকে প্রাণ খুলে বলা যায় প্রতিটি খারাপলাগা।
শাহিদ ভালোবাসত রাজাবাজারের রুকসানাকে─ব্যাপারটা রুকসানার আম্মি ছাড়া কেউ জানত না আর; এমন-কি, শাহিদের তরফেও কেউ কখনও জানতে পারেনি কিছু। বিধান রায়ের কথায় তার আব্বাকে রিপন স্ট্রিটে পরিবার নিয়ে চলে আসতে হলে শাহিদ কংগ্রেসে নাম লেখায় আর রুকসানার সঙ্গে যাবতীয় যোগাযোগ ছিঁড়ে ফেলে। রুকসানাকে এরপর বেশ কয়েকবার দেখা গিয়েছিল আহিরীটোলার গলিতে, কিন্তু ইসমত যেহেতু সেইসব সময়ে সাধারণত স্কুলে থাকত, তাই তার সঙ্গে কখনওই দেখা হয়নি রুকসানার। কমিউনিস্ট পার্টির ছোঁয়াচ গা থেকে মুছে ফেলতে চাইছিল শাহিদ, ফলে তার আব্বা-আম্মিও কাউকে জানায়নি তাদের নতুন ঠিকানা, জানার মধ্যে জানত একমাত্র ইসমত; আহিরীটোলা ছাড়ার কথা চলছে যখন, শাহিদ নিজেই গঙ্গার ঘাটে তাকে জানিয়েছিল সে-কথা। আহিরীটোলার দেওয়াল লিখন চলে গেল রিপন স্ট্রিট, ওয়েলিংটন স্ক্যোয়ার, বউবাজার চত্বরের দেওয়ালগুলোয়; শুধু লাল পতাকার বদলে সেই হাতের লেখার পাশে স্পষ্ট হয়ে উঠল আশীর্বাদী দক্ষিণ হস্ত─উদ্যত আশীর্বাদ, কিন্তু কবজি থেকে কাটা। স্কুল থেকে ফেরার সময় ট্রামলাইন ধরে হেঁটে আসতে-আসতে শাহিদকে দেওয়ালের সেই কাটা হাত দেখিয়ে ইসমত বলেছিল : দেশভাগ, বাটোয়ারা। জবাবে মুচকি হেসে শাহিদ বলেছিল : ‘চোখ দিয়ে যতটা দেখো, মন দিয়ে তার থেকে বেশি দেখার চেষ্টা করো। বাটোয়ারা হোক আর যাই হোক, কংগ্রেস না-থাকলে আমরা স্বাধীন হতাম না। বিয়াল্লিশের আগস্টে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল কমিউনিস্টরা। নয়তো এতগুলো দিন আরও থাকতে পারত নাকি ব্রিটিশরা? এখন দেখো, যখন আমরা স্বাধীনতা পেলাম, ওই কমিউনিস্টগুলো চেঁচামেচি জুড়ে দিল─ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। মাগনায় আসে না সব?’ এর বেশি বলে না শাহিদ, উত্তেজনায় রাশ টানে, ইসমত তাকে ভদ্র বলেই জানে, তার সামনে তাই সে মুখখারাপ করে না, সমঝে চলে। ভালোবাসায় এইটুকু লুকোচুরি চলেই।
সআদতের মাতলামি, নিত্যদিনের অশান্তিতে ভিতরে-ভিতরে গুটিয়ে যাচ্ছিল ইসমত। তবু সআদতের জন্য ঘর ছেড়েছে, দেশ ছেড়েছে, তাকে ভালোবাসে─এই ভালোবাসাটুকুর জন্যই দাঁতে দাঁত চেপে দিন কাটাচ্ছিল সে। তখন সকাল হলেই বাসি জামাকাপড় নিয়ে কলঘরে ঢুকে পড়ত সে, কল থেকে জল পড়ত বালতিতে আর হাতে-ধরা সআদতের গতরাতের শার্টে বমির দাগ দেখে তার দিন শুরু হত বিরক্তি দিয়ে। পুরো দিন জুড়ে মাথার মধ্যে খচখচানি থেকে যেত, মন বসত না কোনও কাজে, ভুল হয়ে যেত অজান্তে, তবু মাথা থেকে তাড়াতে পারত না বিরক্তিগুলো। যেদিন বাড়াবাড়ি করে ফেলে সআদত, পরদিন খোঁয়ারি কেটে গেলে, গুম হয়ে বসে-থাকা ইসমতকে দেখে এসে বসত তার সামনে, জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করত তাকে, চোয়াল শক্ত করে শরীর কঠিন করে তুলত সে আর অনন্যোপায় মানুষটা হাতের মধ্যে ভরে নিত তার হাত : ‘আমি আর মদ খাব না─কথা দিচ্ছি তোমায়। তুমি দেখো, আমি সত্যিই আর ছোঁব না ওসব। আমি আসলে খুব একা। আমি একা থাকতে ভয় পাই, ইসমত। শুধু তুমি আমাকে ছেড়ে যাবে না, বলো।’ ওই শীর্ণ হাতের কাঁপুনিতে কপালের দুই রগ তখন দপদপ করত ইসমতের, যন্ত্রণা উঠে আসত মাথায়, তবু নিজের কাঠিন্য থেকে বিন্দুমাত্র সরত না। একটা সময় পর নেতিয়ে পড়ত সআদতের ক্ষয়াটে শরীরখানা। বাকি রাত তারপর আধো ঘুমে, আধো জাগরণে কোনওমতে কেটে যেত ইসমতের।
এইভাবে চলতে-চলতে গল্পের থেকেও ক্রমশ দূরে সরতে থাকে সআদত। তখন কখনও-কখনও তাকে ভোরের দিকে গঙ্গাস্নান করতে-আসা ব্রাহ্মণেরা দেখতে পেত আহিরীটোলা ঘাটে, মৃতবৎ পড়ে আছে, আকাশের দিকে চোখ বুজে, ঈষৎ ফাঁক হয়ে-থাকা ঠোঁটের কষ বেয়ে গড়িয়ে-পড়া লালার শুকনো হয়ে-যাওয়া দাগ। এইভাবেই চলছিল তবু, একপ্রকার অভিমানে-বিরক্তিতে কোনওরকমে চলে যাচ্ছিল ইসমত আর সআদতের ছোট্ট সংসার; কিন্তু সআদতের উপর বিরক্তি আর বন্ধুর মতো শাহিদের পাশে-থাকা─ভিতরে-ভিতরে ভেঙে যাচ্ছিল ইসমত। রোজকার এই মাতলামি, এই একঘেয়ে অভ্যাসের গতানুগতিক যাপনে সে নিজেকেই হারিয়ে ফেলছে না তো─প্রশ্ন তৈরি হচ্ছিল তার মনে। অবশেষে একদিন সে ঠিক করে, কিছুদিনের জন্য একা ছেড়ে দেবে সআদতকে, বাড়িয়ে দেবে দূরত্ব; শাহিদের তৎপরতায় জানবাজারে থাকার একটা ব্যবস্থাও হয়ে যায় তার, এসে পড়ে স্কুলের আরও কাছাকাছি।
তখন স্কুল থেকে ফিরে কখনও জানবাজারের বাসায়, কখনও-বা এসপ্ল্যানেড ঈস্টের ট্রামডিপোয়─দেখা হয়ে যেত শাহিদ আর ইসমতের। আপনমনে গুনগুন করত ইসমত, একসময় দারুণ ছিল তার গানের গলা। আবারও নতুন করে গাইতে বলত শাহিদ, উৎসাহ দিত প্রত্যেক মুহূর্তে। মনে তো গান ছিলই, বাইরে থেকে উদ্যোগের অভাব ছিল এতদিন, সেটা মিটতেই একদিন সত্যিই আবার গান উঠে এল ইসমতের গলায়। যেদিন একটা পুরো গান গেয়েছিল ইসমত, শাহিদ কাঁধের ঝোলা থেকে ফ্ল্যাট-ব্রাশ আর সাদা রং দিয়ে─দেওয়াল লেখার কারণে ওর ঝোলায় সবসময়ই গেরুয়া সাদা আর সবুজ রং থাকত─জানবাজারের ওই ছোট্ট ঘরের দেওয়ালে লিখে দিয়েছিল :
পাগলী, তোমার সঙ্গে পাপবিদ্ধ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধর্মমতে কাটাব জীবন।
লিখেছিল, কিন্তু একটিও কথা বলেনি; রং-তুলি ব্যাগে ভরে ব্যাগ নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল নীরবে। ইসমতের ভালো লেগেছিল তার এই নীরবতা; সআদতের মতো জাঁহাবাজি অতিকথন অথবা অকারণ ঔদ্ধত্য কিংবা প্রগলভতা নেই ছেলেটার। বরঞ্চ আছে একটা শান্ত-সমাহিত মন, গোছানো জীবন। সআদতকেও তো গোছানো একটা সংসারই দিতে চেয়েছিল সে, অথচ সআদত তার নিজস্ব জীবনেই দিব্য বেঁচে থেকেছে। দেশ-পরিবার ছেড়ে-আসা ইসমত ভাবে, সেও তো আখেরে ঘর চেয়েছিল, ছোট্ট অথচ গোছানো সংসার যা শুধু হবে তার আর সআদতের : এখন সব অলীক। সে বেরিয়ে এসেছে সআদতের থেকে। যাই হয়ে যাক-না-কেন, অভ্যাসের ওই জাহান্নামে আর সে ফিরবে না। আর-এক আরম্ভের জন্য বরং প্রস্তুতি চলুক, যুদ্ধ চলুক তার মনে─ইসমত ভাবে। তবে এও ঠিক যে, ওই দু’ লাইন লিখে চলে-যাবার পর তার প্রথমেই মনে পড়েছিল সআদতের কথা, তাকে লেখা সআদতের চিঠির কথা, যে-চিঠি সে রেখে এসেছে আহিরীটোলায়─তার ছেড়ে-আসা সংসারে─সআদতের জিম্মায়। পরাধীন ভারতের ডাক বিভাগের সরকারি শিলমোহর আঁকা, রাজা পঞ্চম জর্জের মুখ ছাপা সেই ইনল্যান্ডে─ভালোবাসার নীল খামে─কবি সআদত ছিল, আর ছিল অমোঘ একটা প্রশ্ন :
বাড়িটি থাকবে নদীর কিনারে, চৌকো,
থাকবে শ্যাওলা রাঙানো একটি নৌকো,
ফিরে এসে খুব আলতো ডাকব, বউ কই…
রাজি?
এই ঘটনার পর থেকে সআদতের সঙ্গে, ন্যূনতম যোগাযোগও, বন্ধ করে দেয় ইসমত। মনের সব ক’টা জানলা এঁটে দিয়ে অতঃপর নিজের সঙ্গে নিজের আলাপে ডুবে যায় সে। নিজের জন্য, নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে তাকে।
কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ার পর চারপাশ থেকে একা হয়ে পড়েছিল সআদত, তখনই মদ ধরেছিল সে, তবু গল্প লেখাটা ছাড়েনি সেদিনও। ইসমত নিয়ম করে কালি ভরে রাখত পেনে, ইসমতের প্রিয় কালি : টার্কোয়াইজ ব্লু। ইসমত স্কুল চলে গেলে পর গঙ্গার ধারের চায়ের দোকানে গিয়ে একটা চা আর সিগারেট খেত সআদত, তারপর বিড়ির একটা বান্ডিল নিয়ে ঘরে ফিরত। ঘরে ফিরে লিখতে বসত সে। কাগজের উপর অশক্ত হাতে পেন চালাত; হাত কাঁপত, ফলত অমন সুন্দর টানা-টানা হাতের লেখারাও একটা সময় বিদ্রোহ করে উঠত। প্রেসের লোকেরা হাতের লেখা বুঝতে পারত না অনেক জায়গায়, গালিগালাজ করত আড়ালে।
ইসমত চলে যেতে গল্পও তাকে ছেড়ে গেল। ততদিনে কাঁপুনির ভাবটা শরীরের অনেকটাই ধরে ফেলেছে। তবু তারই মধ্যে পেনে কালি ভরত। দোয়াতে চুবিয়ে ব্লাডার চিপত কোনওরকমে, জোর পেত না সেভাবে। কালি ভরা হয়ে গেলে কাগজ নিয়ে বসত বিছানায়। হিজিবিজি কাটত বেখেয়ালে, কাঁপা হাতের লেখায় কখনও-বা লিখত : ইসমত। গল্প লিখত না। গল্প আসত না। যেমন পরে বহুবার বলে-বলেও ইসমতকে দিয়ে আর ‘পুট্’ লেখাতে পারেনি সে। যৎসামান্য গন্ধ তো সেই হাতেও থেকে যায়, যে-হাত গোলাপ তুলে দিয়েছিল অন্য হাতে। লিখতে বসলেই, প্রথম-প্রথম, সআদতের এইসব মনে পড়ত আর চুলোয় উঠত লেখার কাজ : কিচ্ছু মনে পড়ত না, মাথায় আসত না পরের বাক্য, কোথায় শেষ হবে অনুচ্ছেদ আর কোথায়ই-বা শুরু হবে─ঠিক করতে পারত না, বহু যত্নে-শেখা বানান ভুল হয়ে যেত, এক চরিত্র উঠে বসত অন্যের ঘাড়ে। সআদত জানত ইসমত তার লেখা পছন্দ করে, ভালোবাসে; ইসমতের জন্যই কাগজ-কলম নিয়ে জোর করে বসত রোজ, দিনের মধ্যে একবার অন্তত, কিন্তু অশক্ত শরীর এবং ততোধিক ভাঙা একটা মন নিয়ে গুছিয়ে তুলতে পারত না কিছুই। শেষমেশ অসহায় সে তাদের শাদির আগে খুলে-রাখা বিসমিল্লাহর তাবিজখানা, ইসমত কাগজে মুড়িয়ে যা রেখে দিয়েছিল তোষকের তলায়, বের করে চেপে ধরেছিল হাতের মুঠোয় এবং অনুপস্থিত বিসমিল্লাহর উদ্দেশে বিড়বিড় করে বলেছিল : ‘ইসমতকে আমার ফিরিয়ে দাও। আমি আর কখনও মদ খাব না, কবুল করছি। ইসমতকে ফিরিয়ে দাও শুধু।’
এই ঘটনার পর থেকে সআদত, চিরতরে, মদকে বিদায় জানায়। যে-ইসমত তার সঙ্গে থেকে তাকে নেশার কবল থেকে সরাতে পারেনি, সেই ইসমতের চলে-যাওয়াই তাকে মদের প্রতি নিস্পৃহ করে দেয়। মদ ছাড়লেও লেখা ছাড়তে চায়নি সে, তার লেখা ভালোবাসে ইসমত, তার লেখার মধ্যে বেঁচে থাকবে ইসমত─ভেবেছিল সে; কিন্তু সেই লেখাই তাকে ছেড়ে গেল। সে মদ ছাড়ল আর লেখা তাকে ছাড়ল : তার সব কিসসা নিয়ে, তাকে ছেড়ে কোথায় যেন চলে গেল ইসমত।
এর মধ্যে পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে ফিরে আসছিল পুরোনো বন্ধুরা। উদ্বাস্তু কলোনিগুলোতে মিটিং-মিছিল, টিনের চাল আর দরমার ছোটো ঝুপড়ি ঘরের দরজায় লাল পতাকা─কোনওমতে মাথা তোলা পার্টি অফিস। মাঝে-মধ্যে হাতিবাগান অবধি হেঁটে এসে এসপ্ল্যানেডগামী ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের পাদানিতে উঠে পড়ত সআদত। নেমেও যেত তেমনই─কাউকে বিরক্ত না-করেই। একদিন বিকালের দিকে হ্যারিসন রোডের উপর দ্বারিক ঘোষের মিষ্টির যে-দোকানখানা, তার সামনে একদা-পরিচিত কিছু মুখের ভিড় চোখে পড়েছিল তার। ছোটোখাটো সেই জটলাটা ভিতরে চলে গেলে সে গিয়ে ঢুকেছিল দোকানে, একজন কর্মচারীর থেকে জেনেছিল, ধর্মতলা স্ট্রিটের ছেচল্লিশ নম্বর বাড়ির ঠিকানা বদলে গেছে, এখন ওই মিষ্টির দোকানের দোতলা থেকেই আবারও নিয়ম করে বেরোচ্ছে ‘পরিচয়’ পত্রিকা। শুনে সে মলিন চোখে তাকিয়েছিল উপরে উঠে-যাওয়া সিঁড়িটির দিকে, কিন্তু যায়নি। কী হবে আর গিয়ে, যখন তার গল্পই ছেড়ে গেছে তাকে! ওদের সঙ্গে তো তার পরিচয় গল্পের কারণেই; সেই গল্পই যখন নেই, তখন ওরাও আর নেই তার জীবনে।
পার্টির ছেলেরা খবর দিয়ে যায় : ট্রামভাড়া বেড়েছে এক পয়সা। ইসমতের ছেড়ে-যাওয়া ঘাটে বসে উদাস হয়ে শোনে সআদত, ভাবে, তাতে তার কী, তার জন্য তো ট্রামের পাদানি─ভাড়া চাইলে নেমে গেলেই হল। বড়োজোর দুটো মুখখিস্তি করবে। তবে যেদিন শুনেছিল, শিক্ষকদের মাইনে বাড়ানোর দাবিতে পার্টি আন্দোলন করছে, সেদিন সে অবস্থানে এসেছিল, ইসমতকে খুঁজে পাবে─আশায়। ভিড়ের মাঝে সে শুধু মুখ দেখছিল, অগণন মানুষের মুখ; কিন্তু ইসমতকে খুঁজে পায়নি ওই ভিড়ে। ছোটো থেকে হয়তো এ-কারণেই বাড়ির বড়োরা হাত ধরে থাকে, যাতে হারিয়ে না-যায়; হারিয়ে গেলে খুঁজে-পাওয়া একেই দুঃসাধ্য, তায় যে নিজে থেকে হারিয়ে যায়, তাকে পাওয়া অসম্ভব। মঞ্চে তখন বক্তৃতার মাঝে-মাঝে গান চলছিল, সআদত এমন-কি, সেখানেও খুঁজেছিল। ইসমত থাকবে আর গান গাইবে না, এ তার ভাবনারও অতীত। কিন্তু সে জানত না, জানবাজারের ওই স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকার ফলে অ্যাকিউট ল্যারিংজাইটিস বাসা বেঁধেছিল ইসমতের গলায়, সুস্থ হয়ে উঠলেও আর কখনও গান গাইতে চাইত না সে; তারপর থেকে স্কুলের অনুষ্ঠানে বড়দি বাচ্চাদের দিয়ে গান গাওয়ানোর কথা বললে, গলার দোহাই অথবা ডাক্তারের নিষেধ বলে এড়িয়ে যেত। সেদিনের সেই আন্দোলনের উপর পুলিশ লাঠি চালানোর আগে কিংবা পরে─কখনওই─ইসমতকে দেখতে পায়নি সে।
পার্টির ছেলেদের দৌলতেই সে জানতে পারছিল, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে রায়বাড়ির ছেলেকে কী-সব সম্বর্ধনা দেওয়া হবে; ছোকরা বিভূতিবাবুর কোন-একটা বইকে নিয়ে বায়োস্কোপ বানিয়েছে, চারদিকে তার প্রশস্তি। যেমন আড়ালে-আবডালে সে শুনে ফেলছিল, উৎপল, সলিল আর ঋত্বিককে দলের ভিতরেই মার্কিনী দালাল ও ট্রটস্কাইট বলে দেগে দেওয়া চলছে─তেমনই। কেউ-কেউ তাকে বলেছিল, একসময় সে-ও তো গল্প লিখত, সে তো যেতেই পারে ওই সভায়। জবাবে শুকনো হাসি হেসেছিল সআদত, তারপর সেই দরমার পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে গঙ্গার ঘাটে এসে বসেছিল। বায়োস্কোপের কথায় তার পুরোনো দিন মনে পড়েছিল, মনে পড়েছিল অভাবের সংসারে চেয়ে-চিন্তে বাঁচানো টাকায় ইসমতের সঙ্গে বায়োস্কোপ দেখতে-যাওয়া : অহীন্দ্র চৌধুরীর ‘মাইকেল মধুসূদন’, উত্তমকুমারের ‘মর্যাদা’, আর কী-কী সব নাম ছিল যেন! পর্দায় উত্তমকে দেখে অন্ধকারে ইসমত বলেছিল : ‘কী দারুণ দেখতে, না! হাসিটা দেখো। ওই হাসি দেখেই তো প্রেমে পড়ার জোগাড়!’ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল সআদত। বাড়ি ফেরার পথে ইসমত বলেছিল : ‘আমি না-থাকলে তুমি ঠিক আজ বাদে কাল অন্য সম্পর্কে জড়াবে। তোমাদের লেখক জাতটাই এমন। তুমি যদি না-ও থাকো, আমি কিন্তু পারব না।’ ইসমতের কাঁধ জড়িয়ে অস্ফুটে সআদত শুধু বলেছিল : ‘পাগলি আমার!’
কলকাতা শহরে ইসমতকে ছাড়া কখনও কোনও বায়োস্কোপ দেখেনি সআদত, আর তাই ইসমত চলে যাওয়ার পর বায়োস্কোপ দেখতে যাওয়াটাও ছেড়ে দেয় সে। তবু সে বায়োস্কোপ ভালোবাসে, অপেক্ষা করে ইসমতের ফিরে-আসার। তার বিশ্বাস : ইসমত ঠিক ফিরে আসবে একদিন, যেমন হঠাৎ করে চলে গিয়েছিল, তেমন হঠাৎ করেই ফিরে আসবে আবার। বছর কয়েক আগে বিধানসভা নির্বাচনে বউবাজারে বিধান রায়ের হয়ে প্রচারে যখন বক্তৃতা দিচ্ছিল শাহিদ, সামনের সারিতে দুই মেয়েকে নিয়ে বসেছিল তার স্ত্রী─এটা জানতে পেরে সআদত নিশ্চিত হয়েছিল, কবিতা বিরহেই ভালো লাগে, জীবনটা আসলে কঠোর গদ্য, সেই দৈনন্দিনে কবিতা আসে আর যায়, চিরকাল থাকে না : সআদতই ইসমতের একমাত্র ভালোবাসা।
সআদত মদ খায় না আর, ঠেকের পুরোনো কোনও স্যাঙাত জোরাজুরি করলেও এড়িয়ে যায় শরীর খারাপের অজুহাতে। ইসমত চলে যাওয়ার পর প্রথম দিকে যে-পেনে কালি ভরে লিখতে বসেছিল সে, সেই কালি একইরকম রয়ে গেছে, একটুও খরচা হয়নি। রান্নাঘরে বাসনকোসনে মাকড়সার বাসা, ঝুল, ধুলোর আস্তর, কুচো আরশোলাদের লম্ফঝম্প। কানাউঁচু থালায় খেতে ভালোবাসত ইসমত, সে-ও একইরকম, ধুলোয় ভরা। সকালে গ্লাসে চিনি দিয়ে ছাতু গুলে নেয় সআদত, তাছাড়া দু’ বেলা চাল-ডাল ধুয়ে হলুদগুঁড়ো আর নুন দিয়ে ফুটিয়ে ওই ডেকচিতেই খেয়ে নেয়; ফলত গ্লাস চামচ আর ডেকচির উপরই যা ধুলো জমেনি। সাধ্যের মধ্যে একটু ভালো চা খেতে পছন্দ করত ইসমত, কৌটোয় সেই চা যেমন রেখে গেছে সে, তেমনই আছে। সেই চায়ের গন্ধে ইসমতের কথা মনে পড়ে। যখন চা খেতে ইচ্ছা হয় সআদতের, গঙ্গার ঘাটের কাছের চায়ের দোকানটায় চলে যায় সে। ঘরের চায়ের মতো ভালো নয় সেই চা, বিস্বাদ─তবু খায়। দুপুরে হোক বা রাতে, তেলচিটে বিছানায় শরীর ছেড়ে দেয়, তখন সে জড়িয়ে থাকে ইসমতের বানানো ভাঁজ-করা কাঁথাখানা। ইসমতকে জড়িয়ে শোয় সে।
সংসারে সআদতের যে কী ছিল আর কী ছিল না, যতদিন ছিল, কখনও ভাববার অবকাশ দেয়নি ইসমত। ফলত সে জানত না, তার একটি পেন, কালো রঙের─ওদের দু’জনেরই প্রিয় রং─যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়ে গেছে ইসমত; রোজ স্কুলে সেটা নিয়ে যায়, ওটা দিয়ে সইসাবুদ থেকে খাতা-দেখা─সব কাজ সারে শুধু তাই নয়, রাতে ঘুমোনোর সময় মাথার কাছে সেটাকে নিয়েই চোখ বোজে সে। সআদত একা নয়, সে-ও সর্বদা জুড়ে থাকে, আঁকড়ে থাকে তার সআদতকে।
ইসমতের অপেক্ষায় ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে আনমনে হেঁটে চলে সআদত। পথে এ ওটা বলে, ও সেটা বলে, কিছুই কানে যায় না। বাহ্যজ্ঞানরহিত সে হেঁটে চলে। রাস্তায় যে-কোনও মেয়ের মুখের দিকে হঠাৎ চোখ পড়ে গেলে, সেইসব মুখগুলোয় ইসমতের মুখ দেখতে পায়। নতুন করে কাউকে ভালো লাগে না আর৷ বাহ্যজ্ঞান লোপ পেলেও ইসমতের লেখা গল্পখানা ভুলতে পারে না; বিশ্বাস করে, ইসমত একদিন ঠিক আবার লিখবে গল্পটা : পাণ্ডুলিপিরা হারায় না। ঘরে ফিরে তোরঙ্গ খুলে ইসমতের চিঠি আর ছবি দেখে, বলে : ‘তুমি বলেছিলে তুমি যদি কোনওদিন চলে যাও, আমি ঠিক নতুন কাউকে খুঁজে নেব৷ তুমি দেখো, তুমি দেখছ, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালো লাগে না আমার? আমি মদ ছেড়ে দিয়েছি, আমি পেরেছি, ইসমত! এবার তো ফিরে আসো!’ তারপর কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে। একটা সময় সেই চিঠি আর ছবি জড়িয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যায় চিঠির কিছু শব্দ, কিছু শব্দের অংশ।
একদিন রাতে ওই স্বাদহীন খিচুড়ি খাওয়ার সময়, খিচুড়ি আর দলা-করা কষ্ট গলা দিয়ে কোনওক্রমে ঠেলে পাকস্থলীর দিকে নামছিল যখন, বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করে সআদত। প্রথম কাশিতে মুখের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে পুরোটা তখনও না-চেবানো ডাল-ভাতের টুকরোটাকরা। খানিকক্ষণ একটানা কাশির পর হাতে-ধরা ডেকচির হলুদ খিচুড়িতে লাল রঙের ছিটেদাগ নজরে পড়ে তার। গলা দিয়ে খিচুড়ির লোনা তরল বেরোচ্ছে, তখনও পর্যন্ত তেমনই ভেবেছিল, ডেকচির গায়ে লাল দেখে সে মুখের তলায় হাত রাখে। গলা দিয়ে রক্ত বেরোয় সআদতের। প্রথমে রক্ত দেখে অতটাও ঘাবড়ায় না সে, বরং ভাবে, কাশতে-কাশতে গলা চিরে গেছে হয়তো, এমন তো কতই হয়।
সআদতের মৃত্যুভয় প্রথম চাগাড় দেয় এর পরের দিন সকালে। চায়ের দোকানে তখন ‘যুগান্তর’ আর ‘স্বাধীনতা’-র হাতবদল চলছিল, এমন সময় আবার কাশি ওঠে তার। কাশির সময় দু’ হাত মুখের কাছে জড়ো করেছিল, কাশি থামতে মুখ থেকে হাত সরাতেই সে দেখে, সাদা পাঞ্জাবির হাতায় রক্তের দাগ। সকালবেলার গঙ্গার জলে তখন সূর্যের সদ্যস্নাত কৈশোর; যতদূর ধরা পড়ে চোখে, নদীর জল লাল, সআদতের পাঞ্জাবির হাতায় লাল, অথচ মুখ তার রক্তশূন্য তখন। সে বুঝে যায়, আর বেশিদিন সে এই পৃথিবীতে নেই; যেইমাত্র সে এটা বুঝে যায়, পাঞ্জাবির পকেট থেকে ছেঁড়া রুমাল বের করে হাতে লেগে-থাকা রক্তের দাগ মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করে। বারকয়েক রুমালটা ঘষবার পর যখন দেখে, দাগ ধরে নিয়েছে কাপড়, গুটিয়ে ফেলে পাঞ্জাবির হাত আর তারপর হাতিবাগানের দিকে হাঁটতে শুরু করে, চারমাথার মোড়ে পৌঁছে ঠিক করবে, ইসমতকে খুঁজতে কোনদিকে যাবে─যত দ্রুত সম্ভব সে ইসমতকে খুঁজে বের করবেই।
যে-মানুষটা রুমাল নিতে ভুলে যেত, ইসমত মনে করে কাচা রুমাল গুঁজে দিত হাতে, সেই মানুষটা, সআদত, কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠার পর থেকে, রুমাল রাখে সঙ্গে। আর-পাঁচজনের সামনে চেপে রাখতে চেষ্টা করে, বুঝতে পারে, যক্ষা থাবা বসিয়েছে তার শরীরে; তাই লোকচক্ষুর সামনে ব্যাপারটাকে পাঁচকান করতে চায় না। যক্ষা শুনলেই তাকে ধরে-বেঁধে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবে পাড়ার লোকেরা, পার্টির ছেলেরা। ইসমত এলে তাকে তখন কোথায় খুঁজে পাবে, খুঁজবে তখন? তার চেয়ে এই ভালো বরং। পুরোনো বন্ধুরা, সবাই না-হলেও অনেকেই, বোঝে না, সআদত এড়িয়ে যেতে চায় তাদের। বোঝে হয়তো-বা, তবু গায়ে পড়ে জানতে চায় সবকিছু; অসীম কৌতূহল তাদের। এদের অনেকেই জানত, কেন তাকে ছেড়ে গেছে ইসমত, তবু তারা বারবার জানতে চাইত। তাকে জোর করত, একবার মদ খাওয়ার জন্য, সে বারণ করলে শুরু হয়ে যেত অবজ্ঞা। তাতে অবশ্য কিছু যেত-আসত না সআদতের। মুখ ফুটে কাউকে কিছু না-বললেও, তার মনে হত, বন্ধুরা এতই উদ্যোগী যখন, তখন তারা ইসমতকে খোঁজার একটু চেষ্টাও তো করতে পারে! যদিও সে বিলক্ষণ জানত, এমনটা করবে না কেউ; ইসমত থাকাকালীন যে এরা তেমন পাত্তা পায়নি কখনও, কেউ তো আর নিজের জায়গা নিজের হাতে নষ্ট করতে চায় না।
এইভাবে চলতে-চলতে, নির্বিকার, বিনা চিকিৎসায়, ঘরের মধ্যেই একদিন, পট করে মরে যায় সআদত। ঘর থেকে পচা গন্ধ বেরোচ্ছিল বলে পাড়ার সবাই একজোট হয়ে ভেঙে ফেলেছিল দরজা। ভিতরে, বিছানার ঠিক পাশটায়, নিচে, নিঃসাড়, পড়েছিল সআদত। ঠোঁটের কষ জুড়ে রক্তের দাগ শুকিয়ে খটখটে। ডান হাত বুকের কাছে। চোখ খোলা। মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট। খাটের উপর তাড়া কাগজ আর খাপখোলা ফাউন্টেন পেন। উপরের কাগজে লেখা─সআদতের শেষ লেখা :
ধ্রুপদী দুঃখের পাহাড়ে বসো
দুঃখ চারিদিকে জলের মতো
শুধুই মুছে যায় বিধুর অভিমান
প্রেমিক মাত্রেই অপরিণত
লেখাটার এককোণ জুড়ে কালির দাগ─টার্কোয়াইজ ব্লু। পেনের সবটুকু কালি শুষে নিয়েছে কাগজ। পাড়ার ওরাই তদ্বির করে ডেকে এনেছিল কলোনির ডাক্তারকে। উপস্থিত ভিড় দেখছিল, ডাক্তার হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করছে সআদতের, কিন্তু─রিগর মর্টিস্─তার চোখ স্থির দেওয়ালের দিকে, ইসমতের ছবির দিকে; এমন-কি খোলা থাকে হাঁ-মুখও। সম্পূর্ণ অনাত্মীয় সআদত, তায় অমন ছোঁয়াচে অসুখ, ফলত পাড়া-প্রতিবেশীদের ভিড় পাতলা হয়ে আসে কিছুক্ষণেই। ডাক্তারের উদ্যোগে পুলিশ এসে নিয়ে যায় বেওয়ারিশ লাশ। চালান করে দেয় মর্গে। বিচ্ছিন্ন স্বদেশভূমি, যত দিন যায়, মিলনের সম্ভাবনা থেকে দূরে সরে। সিন্ধু আর কীর্তনখোলার মাঝে বড়ো হয়ে ওঠে রক্তের দাগ।
ইসমতকে দেখবে বলে, চোখখোলা, সআদত, হিমঘরে শুয়ে থাকে চুপিচুপি, একা-একা। ইসমতকে ছাড়া বেহেশত নসিব হবে না তার, তাই ওই গভীর চোখ নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে বেহেশতের প্রধান ফটকের সামনে, ইসমতের অপেক্ষায়। ইসমত এলে পর, ওরা একসঙ্গে, একে-অপরের হাত ধরে প্রবেশ করবে এক নতুন জগতে─জন্নতে। ইসমতের না-আসা পর্যন্ত শেষ হবে না সআদতের অপেক্ষার অন্তিম প্রহর।
[ঋণ : দান্তে আলিঘিয়েরি, পদ্মাপুরাণ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, মৃদুল দাশগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।]
বোধ পরীক্ষণ
পূর্ণমান : সময় :
নিম্নলিখিত অংশটি পড়ে প্রদত্ত প্রশ্নগুলির যথাযথ উত্তর দাও।
ঈষৎ গোলাপি কমোডের উপর বসে-থাকা নন্দিনীর যোনিদেশ থেকে থোকা-থোকা রক্তের ডেলা টুপটাপ ঝরে পড়ছিল জমা-জলে আর ওইটুকু সময়ের জন্য চলকে উঠে সেই নোংরা জল ছুঁয়ে যাচ্ছিল তার সৃষ্টিরহস্যের গোমুখ-উৎস; যেহেতু তার স্বামী স্টিফেন হকিং সেভাবে পড়েনি, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মাত্রেই যেমনটা হয়, নয়তো নিজের স্ত্রীর যোনিপথকে ব্ল্যাকহোল ভাবলেও ভাবতে পারত সে, আর সেই মুহূর্তে তাহলে গোটা ব্যাপারটাই চিহ্নিত হয়ে থাকত ব্ল্যাকহোল ট্র্যাজেডি বলে। অথচ সেই মুহূর্তে প্রবল যন্ত্রণা সহ্য করে নন্দিনী দেখছিল তার চার সপ্তাহের অজাত সন্তানের মৃতশরীর নেমে যাচ্ছে কমোডের জলে, যা দেখে এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটিকে শাস্ত্রজ্ঞের গঙ্গাপ্রাপ্তি মনে হয়েছিল কিনা জানা নেই, তবে সন্তানের লাশ ভেসে-যাওয়া জলকে নন্দিনীর─মা অথচ ঠিক মা নয় এমন এক নারী─মনে হয়েছিল, তার নাভিকুণ্ড থেকে উত্থিত সহস্র ফণাবিশিষ্ট সাপ মিশে যাচ্ছে সরযূর প্রস্রবণে।
এই হত্যাকাণ্ডটি গোটাটাই হয়েছিল ডাক্তারের পরামর্শ মাফিক : একটি ক্যাপসুল খেয়ে অন্য একটি ক্যাপসুল, দুটো ওষুধ, গরম জলে আধ ঘণ্টা রেখে তারপর ঢুকিয়ে দিতে হয়েছিল যোনিমুখে। আস্তে-আস্তে ঠেলা দিয়ে পুরোটাই ঢুকিয়ে দেওয়া হয় ভিতরে। তারও মিনিট কুড়ি-ত্রিশ পর ছটফটানির শুরু; প্রত্যেকেই নিজেকে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা করে, সে জাতই হোক আর অজাত।
উপরের অনুচ্ছেদ দু’টি আসলে একটানা যতটা আমায় বলতে পেরেছিল নন্দিনী, তার সারাৎসার। যেহেতু সাবলটার্ন কথা বলতে পারে না, অন্তত গায়ত্রী চক্রবর্তী যেমনটা জানিয়েছেন আমাদের, তেমনই যদি হুবহু তুলে দিতাম নন্দিনীর জবান, তবে সেখানে অবধারিত ঢুকে পড়ত নন্দিনীর মাঝে-মধ্যে নাক টানার শব্দ, কোটরে সেঁধানো ছলছল চোখ, ঘন-ঘন চোখের কোলে রুমালের উঠে-আসা, আর বাঁ চোখের নিচে, গালের কাছটায় জেগে-থাকা ছোট্ট একটি তিল : জন্মদাগ। তখনও অবধি এইটুকু ঘটনাই বলে উঠতে পেরেছিল নন্দিনী, এই পর্যন্ত শুনে ছিটকে সরে গিয়েছিলাম, সরে গিয়েছিলাম ওর সামনে থেকে; ওর সেই সময়ের শারীরিক কষ্ট কিংবা একটি ভ্রূণের অকালমৃত্যু অথবা ওকে কিছুটা একা থাকতে দেওয়া─যে-কারণেই হোক-না-কেন, আমি আড়াল খুঁজি। কিন্তু সিসিডি-র ভিতর আড়াল বলতে ওই একচিলতে ওয়াশরুম, যেখানে বেশিক্ষণ কাটানোটা সভ্য সমাজের সঠিক বিজ্ঞাপন নয়, ফলত খানিক বাদেই বেরিয়ে এসে আবারও যেন-কিছুই-হয়নি গোছের ভাব নিয়ে বসে পড়ি নন্দিনীর সামনের চেয়ারটায়। ততক্ষণে আমাদের কফি এসে গেছে, প্যাকেট ছিঁড়ে প্রয়োজনমতো চিনি গুলে চামচটা ট্রে-র উপর নামিয়ে রাখে নন্দিনী। উদাস দৃষ্টিতে তাকায় বাইরের দিকে। ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকতে-থাকতে আমারও চোখ যায় বাইরের দিকে : হলুদ-সবুজ অটো, রাস্তার উলটো পাড়ে খাঁ-খাঁ বাজারের কঙ্কাল যা সকাল হলেই সরগরম হয়ে উঠবে, তার পিছনে খাল, খালের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে মেট্রোরেল। কফির কাপের দিকে ফিরে নন্দিনী এরপর যা বলেছিল, তা অনেকটা এরকম :
ঋতেশের সঙ্গে নন্দিনীর বিয়েটা, পরিচিত লোকেদের চোখে, প্রেম করেই। আত্মীয়-প্রতিবেশীরা তাদের স্বভাব-কৌতূহলে সবই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি জানে, এমন-কি যা কিনা উদ্দিষ্ট ব্যক্তি স্বয়ং জানে না, তাও তাদের নখদর্পণে লেগে থাকে জলের ফোঁটার মতো। তারা জানত, ওদের বিয়েটা হচ্ছে প্রেম করে। নন্দিনী জানত, বিয়ের পর সে সুখী হবে না : ঋতেশের মায়ের ব্যবহার, ওর বড়দির ধীরে-ধীরে বাড়তে-থাকা মানসিক ব্যাধি এবং বাড়ির প্রশ্নে ঋতেশের নীরবতা তাকে আগামীতে সুখী হতে দেবে না কিছুতেই। ততদিনে ছোটাছুটি করে কোনওমতে দু’ কামরার একটা ভাড়াবাড়ির বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল সে। ঋতেশও নয়ডা থেকে ট্রান্সফার হয়ে চলে এসেছিল কলকাতায়। দুই বাড়ির মধ্যে কথাবার্তা চলেছে যখন, অবাক চোখে নন্দিনী তখন দেখে গেছে, নিজের রোগা শরীরকে লুকিয়ে রাখতে একটা-দুটো-তিনটে-চারটে─ছ’টা─ছ’টা গেঞ্জি পরে তার উপর শার্ট চড়াচ্ছে ঋতেশ, উচ্চতায় নন্দিনীর মাথায়-মাথায় বলে মোটা সোলের জুতো, আঙুলে পাথর; তার বাড়ি বরাবর এসবের থেকে ঢের-ঢের দূরত্বে। ঋতেশের বাবা-মা-দিদিরা যখন তাকে দেখতে আসে, ওদের বেশ কিছু প্রশ্ন এবং প্রশ্নের ধরন ভালো লাগেনি তার। গায়ের রং তার একটু চাপার দিকে, এই নিয়ে ছোটোবেলায় পিসি খুব খ্যাপাত ‘তুই কালো’ ‘তোর বিয়ে হবে না’ ইত্যাদি বলে, ঋতেশরা প্রত্যেকেই বেশ ফরসা, কাছে এসে ওর বড়দি নন্দিনীর হাতের দিকে আড়চোখে তাকিয়েছিল কয়েকবার। কিছু বলেনি যদিও; নন্দিনী ভেবেছিল, কিছু বললে তবু না-হয় একটা প্রমাণ থাকত। বিয়ের পর ভাড়াবাড়িতে এসে উঠবে বলে নতুন খাট আর একটা ম্যাট্রেস কিনে রাখা হয়ে গেছে তখন, আর আঠেরো দিন বাকি বিয়ের, নন্দিনী তার বাবাকে বলেছিল : ‘বাবা, বিয়েটা ক্যানসেল করে দাও। ওই ফ্যামিলির সঙ্গে আমি কিছুতেই মানাতে পারব না। ওদের সঙ্গে আমাদের কালচারের কোনও মিল নেই। প্লিজ, বাবা। বিয়েটা করলে আমি একদমই ভালো থাকব না।’ নন্দিনীর বাবা ভদ্রলোক─বরাবর নিজের ভাবনা-চিন্তা অনুযায়ী কাজ করা মানুষ, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত সম্মানবোধ─মুখভঙ্গিতে ন্যূনতম বিচলিত ভাব না-এনে বলেছিলেন : ‘সেটা আর সম্ভব নয়। এই ছেলেকে তুমিই পছন্দ করেছ। আমরা কোথাও কোনও জোর করিনি তোমায়। আজ যখন কার্ড ছাপা হয়ে গেছে, নিমন্ত্রণ করা চলছে, তখন এসব বলে কোনও লাভ নেই, আরও আগে ভাবা উচিত ছিল। পাড়াপড়শি আত্মীয়স্বজন সবাই জেনে গেছে, এই অবস্থায় বিয়েটা ভণ্ডুল হলে আমার সম্মানটা থাকবে? পাড়ায় দেখানোর মতো আর মুখ থাকবে আমার? ওসব চিন্তা মাথা থেকে বাদ দাও।’ নন্দিনী মাকেও বলেছিল, মা তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, মা নিশ্চয় বুঝবে─এই আশায়; সব শুনে মা বলেছিল : ‘বাবা তো ঠিকই বলছে রে, রিলেটিভরা কী বলবে? পাড়ার লোক? বাবার অফিসের লোকজন? সবাই আড়ালে হাসবে। এখন ভাবছিস, থাকতে পারবি না। পরে দেখবি থাকতে-থাকতে সব ঠিক হয়ে যাবে। এসব নিয়ে এত ভাবিস না।’
এরপর নন্দিনী আর কোনও কথা বলতে পারেনি। দেখতে-দেখতে বিয়ের দিন এসে গেল। অনেক বছর পর, সেই শীতে আবার, বরফ দেখেছিল দার্জিলিং, কলকাতাতেও প্রবল শৈত্যপ্রবাহ, ধমনীর অন্তর্গত উষ্ণ রক্তস্রোতও শরীরের তাপমান বাড়াতে অক্ষম ছিল সেই দিনগুলোয়; শরীর, বুঝি-বা, মৃতদেহের মতোই হিমশীতল।
মধ্য জানুয়ারির নির্দিষ্ট দিনে ঋতেশকে আনতে গিয়ে নন্দিনীর জ্যাঠামশাই দেখেছিলেন বরের পোশাকে তখনও প্রস্তুত হয়নি পাত্র, ঘরের আবহাওয়া গুমোট, বড়োমেয়েকে জড়িয়ে ধরে ছেলের মায়ের ডুকরে কান্না : ‘ঘরে দু’-দুটো মেয়ে আইবুড়ো, এদিকে ছেলের বিয়ে! মেয়ে দুটোর আমার আর বিয়ে হবে না!’ নন্দিনীর জ্যাঠামশাইকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ঋতেশ, ফিসফিস করে জানিয়েছিল, যেন কোনও গুপ্তকথা : ঋতেশের বড়োদিদি খানিক অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়ে মাঝে-মধ্যে, সে ভাবে, একদিন ঠিক তার জন্য তার রাজপুত্র আসবে পক্ষীরাজে চেপে, পার হয়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী, তেপান্তর; ঘাবড়াবার কিছু নেই, ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়, এবং নন্দিনী সবটাই জানে, কিছুই তার অজানা নয়।
বিয়ে বলতে শুধু সইসাবুদ। সেসব মিটে গেলে, অভ্যাগতরা খেতে বসে গেলে নন্দিনী সেখানে যাওয়ার জন্য কনের জন্য ডেকরেটারের দেওয়া লাল ভেলভেটের বড়ো চেয়ারটা ছেড়ে দরজার দিকে এগোনোর সময় শুনতে পায় ঋতেশের বড়দির চাপা কণ্ঠস্বর : ‘মা, এই বউটা কেমন পারা যেন! বিয়েতে সাদা শাড়ি পরেছে, দেখো, মনে হচ্ছে যেন বেধবা!’ কথাটা কানে গেলেও গা করেনি নন্দিনী, মা বলেছিল, যতই যাই হোক, অন্য সংসার, অন্যের বাড়ি, সেখানে সব মনোমতো হবে এমন কথা নেই, একটুআধটু মানিয়ে-গুছিয়েই চলতে হয় মেয়েদের। নন্দিনী জানত, বাঁকুড়ার বেলেতোড়ে তারা থাকবে না, ওই মাঝে-মধ্যে, উৎসব-অনুষ্ঠান কি অসুখে-বিসুখে, এক-আধবার যাওয়া বছরে; নাকতলায় যে-বাড়িটা তারা ভাড়া নিয়েছে আপাতত, বছর ঘুরতে-না-ঘুরতে মহামায়াতলায় যে-ফ্ল্যাটে উঠে যাবে ও আর ঋতেশ, বস্তুত, সেখানেই শুরু হবে তাদের সংসার।
সংসার শুরু হয়েছিল। জানুয়ারির হিমরাতে ফুলশয্যায় ফুল ছিল না; ভাড়াবাড়ির একমাত্র খাটে ঋতেশ তার বাবার সঙ্গে, মোটা ম্যাট্রেসটায় ঋতেশের বড়দি আর মা, লেপ পেতে মোটের উপর শোওয়ার একটা ব্যবস্থা করে শুয়ে পড়েছিল নন্দিনী; ফুলশয্যার রাতে উত্তেজনায় ঘুম আসে না মেয়েদের, তারও আসেনি। শুধু সে বুঝেছিল, সংসার শুরু হয়ে গেল : পুতুলখেলা-রান্নাবাটির ঘরকন্না নয়, জীবন্ত সংসার।
শুরুর খারাপ-লাগাগুলো ধীরে-ধীরে ঝেড়ে ফেলছিল নন্দিনী : মধুচন্দ্রিমার শিলং, সপ্তাহান্তের শান্তিনিকেতন─ছোটো থেকে ঘুরতে-ভালোবাসা সে একান্ত নিজের করে চিনছিল ঋতেশকে, ভালো লাগছিল তার। একটি বেসরকারি স্কুলে সে পড়াচ্ছে তখন, ঋতেশ যা মাইনে পায় তার অনেকটাই চলে যায় স্টুডেন্ট-লোন শুধতে, মেয়ের কষ্ট হবে ভেবে মা ততদিনে কিনে পাঠিয়ে দিয়েছে ফ্রিজ আর ওয়াশিং মেশিন, মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে মহামায়াতলায় দু’ কামরার ফ্ল্যাটটাও কিনে দিয়েছে বাবা, ঋতেশ আর নন্দিনী সেখানে সংসার পেতেছে; শুধু নন্দিনীর খারাপ লেগেছে মা-বাবার এই দান─হ্যাঁ, ও ‘দান’ই বলেছিল─ঋতেশ নির্দ্বিধায় গ্রহণ করায় : আসলে সে চেয়েছিল, তাদের ঘরের প্রতিটি কোণ একেবারেই তাদের হবে। অন্যদিকে, বেলেতোড়ে পাগলামির লক্ষণ ক্রমেই প্রকট হচ্ছিল তার বড়ো ননদের; ফলত মাসের পাঁচ-সাতদিন বেলেতোড়ের অন্দরমহল উঠে আসছিল তাদের দু’ কামরার ফ্ল্যাটে। ততদিনে ঋতেশ তার আঙুলে সেই ছোটোবেলা থেকে বসে-থাকা গোমেদের আংটিখানা খুলে ফেলেছিল; নন্দিনী এইসব পাথর-ফাথরে বিশ্বাস করত না এবং স্ত্রীর বিশ্বাসকে মর্যাদা দিয়ে সে এটা করেছিল, না সে নিজেই যুক্তি দিয়ে বুঝেছিল গ্রহরত্নের অসাড়তা─সঠিক কারণটা হলফ করে বলা যায় না; কেন-না, তার মা যখন বিষয়টি নিয়ে অনুযোগ করে, ঋতেশ তখন কোনও কথাই বলেনি। মায়ের কিংবা দিদিদের সামনে ঋতেশের এই নীরবতা নন্দিনীর ভালো লাগত না; তার মনে হত, এতে ঋতেশের বাড়ির লোকেরা নিশ্চিত ভাবছে যে, তাদের ছেলেকে সে পালটে দিচ্ছে, অধিকার করে নিচ্ছে সম্পূর্ণ এবং চালনা করছে ইচ্ছেমতো।
টেবিলের উপর-রাখা নন্দিনীর ব্যাগটার ভিতর থেকে গোঁ-গোঁ আওয়াজ হতে থাকলে, ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলি : ‘তোর ফোন বাজছে বোধহয়।’ থেমে গিয়ে ব্যাগ খোলে নন্দিনী, ফোনটা বের করে এক ঝলক দেখে ব্যাগে ঢুকিয়ে দিতে গেলে জিজ্ঞাসা করি : ‘কার ফোন?’
‘শুভায়নের। পরে কথা বলব।’
‘ধরে নে। দেখ, হয়তো কোনও দরকারে ফোন করছে।’
নন্দিনী ফোনটা নিয়ে চেয়ার ছেড়ে ওঠে, বেরিয়ে আসে দাঁড়ায় সিসিডি-র বাইরেটায়। কাচের এপার থেকে আমি দেখতে পাই, ওর কানে ফোন আর ঘন-ঘন ঠোঁট নড়া।
শুভায়ন, নন্দিনীর বন্ধু; মানে, ও তাই বলেছে আমায়, যদিও আমি যতটা দেখেছি শুভায়নকে, আমার মনে হয়েছে, নন্দিনীকে সে ভালোবাসে এবং শুধু তাই নয়, নন্দিনীর সঙ্গে অন্য কাউকে সে ঠিক মেনে নিতে পারে না। শুভায়নের সঙ্গে ওর পরিচয় হয়েছিল ওর বিয়ের দ্বিতীয় বছরে; তার আগেই ঋতেশ আর ওর, দু’জনেরই পক্স হয়েছিল, সেরে-ওঠার পর এক মাসও হয়নি, মুহূর্তের অসাবধানতা থেকে শরীরের ভিতর আর-এক শরীরের বেড়ে-ওঠার আঁচ পেয়েছিল নন্দিনী। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ও ঠিক করে নিয়েছিল, সে কিছুতেই এই সন্তানের জন্ম দেবে না; তার এমন সিদ্ধান্তের পিছনে মূলত দু’টি কারণ ছিল :
১| যে-কোনও বড়ো অসুস্থতার পর অন্তত একটা বিরতি যে কাম্য, তারা সেটা মানেনি এবং সেক্ষেত্রে যে-সন্তান জন্মাবে, জন্ম থেকেই বিবিধ জটিলতায় সে আক্রান্ত হবে।
২| ঋতেশের সঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও, বিশেষত ঋতেশের বাড়ির প্রশ্নে ঋতেশের অবস্থানের কারণে, ঠিকমতো অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না সে। তাদের মধ্যে যৌনতা বলতে তখন শুধুই শরীর, ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও আর অনুভব করে না নন্দিনী। তার মনে হয়েছিল, যে-সন্তান আসতে চলেছে, সে অপ্রেমের স্মারক : প্রেমহীনতায় কোনও সৃষ্টিই সম্ভব নয়।
নিজের কাছে পরিষ্কার হয়ে-যাওয়ার পর আর দেরি করেনি নন্দিনী। শরীর মোচড়ানো কষ্টকর প্রক্রিয়ার সময় থেকে ঋতেশ আরও চুপচাপ হয়ে যায়। নন্দিনীর বন্ধুবান্ধবদের কাছে, নন্দিনীর আড়ালে, ও নন্দিনীকে খুনি বলে সাব্যস্ত করতে চেয়েছে শুধু; নন্দিনী যখন শুভায়নের কথা শুনে মহামায়াতলার ফ্ল্যাট ছেড়ে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে এবং কেটে যায় আরও-কিছু মাস, যখন ওর বাবার একবার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে গেছে, যখন প্রতি সপ্তাহে শুভায়ন ওকে নিয়ে যায় মনোবিদের কাছে, ওর বন্ধুরা তখন ওকে ঋতেশের এইসব কথাগুলো জানায়। এতদিন ধরে নন্দিনী এই অংশটুকুই বলেছে আমায়। আজই প্রথম, যখন এতগুলো কথা, কোনও-কিছু না-ভেবেই হয়তো, আমার সামনে উজাড় করে দিচ্ছে ও।
ফোন সেরে ফিরে এসেছে নন্দিনী। মোবাইলটা ব্যাগে ভরে মুখ তুলল : ‘তো, এই হচ্ছে আমার অতীত। এখনও রোজ রাতে ঘুমোনোর আগে সেডাটিভ নিতে হয়। ভয়ংকর ওই সময়টায়, বাবার অসুস্থতায়, আমার ওই সিচুয়েশনে শুভায়ন সবসময় আমার পাশে থেকেছে। শুভায়ন আমার খুব ভালো বন্ধু। ইনফ্যাক্ট ও সাহস না-জোগালে আমি হয়তো ওই বাড়ি থেকে বেরোতেই পারতাম না, এখনও ওখানেই পচতাম, কিংবা কে জানে, হয়তো সুইসাইড করে নিতাম।’
‘এমন বন্ধু পাওয়াও তো ভাগ্যের ব্যাপার।’ মুখে হাসি এনে কথাটা বললেও ওই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারছিলাম, নিজের যে-আন্তরিকতাকে আমি ভালোবাসি, হয়তো নিজের চেয়েও বেশি, সেই আন্তরিকতাকেই আমি সন্দেহ করছি। মুখে আলতো একটা হাসি এনে নন্দিনী বলল : ‘সামনের মাসেই ডিভোর্স ফাইল হবে। তারপর ছ’ মাসের একটা টেনিওর। অথচ আজ প্রায় তিন বছর আমরা আলাদা।’
সিসিডি থেকে বেরিয়ে একটা উবর্ নিল নন্দিনী। গাড়িতে উঠে যাওয়ার আগে আমরা পরস্পর হাত মেলালাম। প্রতিশ্রুতি থাকল দেখা করার, একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার। গাড়ি ছেড়ে দিলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করলাম। সিগারেট ধরালাম। কেন জানি না মনে হল, উবর যখন মহামায়াতলা পেরোবে, একবার হলেও ডানদিকের ফ্ল্যাটবাড়িটার চারতলার বারান্দায় উঁকি দেবে নন্দিনী, কাচের আড়াল থেকে, দেখতে চাইবে নিজের হাতে-লাগানো অকৃত্রিম গাছগুলোকে।
অনুশীলনী
১| এখানে সর্বমোট কতগুলি হত্যার উল্লেখ আছে?
২| নন্দিনীকে কি খুনি বলা যায়─পক্ষে/বিপক্ষে আলোচনা করো।
৩| নন্দিনীর বাবার কী-কী ত্রুটি ছিল?
৪| ঋতেশ নন্দিনীর যে-যে বন্ধুদের কাছে অভিযোগ করেছিল, তাদের কি প্রকৃত বন্ধু বলা যায়?
৫| নন্দিনী এবং ঋতেশের বিচ্ছেদে কাদের ভূমিকা প্রধান বলে মনে করো।
৬| নন্দিনীর মায়ের ভূমিকা কি সঠিক ছিল?
৭| নন্দিনী-ঋতেশের সম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষণ করো।
৮| নন্দিনী-শুভায়নের সম্পর্কের স্বরূপ বিশ্লেষণ করো।
৯| অযৌক্তিক জেদ কীভাবে মানুষকে পতনের দিকে নিয়ে যায়, নন্দিনীর বাবা চরিত্রের নিরিখে আলোচনা করো।
১০| আমাদের দেশের আইন কি প্রায়োগিক ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত জটিল─আলোচনা করো।
Posted in: February 2021 - Cover Story, STORY