পকেট ভর্তি নুড়িপাথর : অলোকপর্ণা

দশ টাকার কয়েন

রাস্তার ধারেই টিউব ওয়েলটা। প্রজ্জ্বলের একচেটিয়া আধিপত্য ওর উপর। দুই হাত দিয়ে কষে চেপে টিউব ওয়েলের হাতল ধরে ওঠা নামা করে প্রজ্জ্বল তিনবেলা। মন্থন শেষে পাতাল থেকে ভক ভক করে জল বেরিয়ে আসে। বালতি উপচে যায়। প্রজ্জ্বল কপাল থেকে ঘাম মোছে। এই সমস্ত অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকতে পাড়ার কেউ এখানে জল নিতে আসেনা। ডানহাতে বালতি আঁকড়ে বাঁ হাতে দেহের ভারসাম্য বজায় রেখে ব্যালে ডান্সারের মতো প্রজ্জ্বল রাস্তা অসামান্য পার হয়ে এপারে আসে। রাস্তার এপারে ঝোপের হৃদয়ে একটা বোর্ড গজিয়েছে সদ্য। তাতে হলুদের উপর লাল তুলিতে লেখা,

প্রজ্জ্বলদার কোচিং সেন্টার
ক্লাস IV থেকে X পর্যন্ত
ইংলিশ, ইতিহাস, বাংলা পড়ান হয়।

কেটে যাওয়া বাল্বের মতো ছেলে মেয়েরাই শুধু প্রজ্জ্বলের কাছে আসে। একই ঘরে একসাথে ইতিহাস, ইংরেজি আর বাংলা মিলেমিশে ঘ। শাস্তি পেলে তবে তারা চুপ হয় আর হেলে দুলে পড়া মুখস্থ করে। এই ঘরের কোনো পড়ুয়াই দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে না, এমনকি এরা কেউ আজীবন প্রধানমন্ত্রীর মুখোমুখিও হবে না। এরা প্রজ্জ্বলের ছাত্র ছাত্রী। এদের মায়েরা মাসের শুরুতে কাচুমাচু মুখ করে প্রজ্জ্বলের সামনে দাঁড়ায়। তাদের সবুজ ব্লাউজের নীচ থেকে লাল ব্রা বেরিয়ে থাকে আর প্রজ্জ্বল ধর্মযাজকের মতো প্রশান্ত মুখে মায়না বাকি রাখতে সম্মতি জানায়। মাঝে মাঝে ঘরভর্তি পড়ুয়া দেখে বাজারের ট্রে তে রাখা জিওল মাছদের কথা তার মনে পড়ে। অল্প একটু জলে মুখ ডুবিয়ে সে কী তাদের বাঁচার প্রয়াস! এসব মিছা মিছা পড়া পড়া খেলা দেখে প্রজ্জ্বলের আমোদ হয়। মিছা মিছা পড়ুয়াদের মাঝে নাড়ুগোপাল হয়ে বসে থাকে মিছা মিছা প্রাইভেট টিউটর। যেন কোচিং নয়, কোচিং- এর ঝুলন চলছে।

মেয়েটাকে আজ প্রথমবার দিয়ে গেছে তার মাসি। আনকোরা চোখে সে প্রজ্জ্বলের ক্লাসঘর দেখছে। দুটো ছেলে ইরেজারের ভাগ নিয়ে হাতাহাতি করছে ঘরের কোণায়। জুয়াড়িদের মতো জটলা পাকিয়ে তিনটে মেয়ে ফিসফিস করে অনেককিছু বলছে একে অন্যকে, আরেকদিকে, একটা ছোটো আট নয় বছরের ছেলে সামনে খুলে রাখা বইয়ের উপর ঘুমে ঢলে ঢলে পড়ছে।
প্রজ্জ্বল এক ধমকে ঘরের টনক নাড়ায়। তারপর একে একে সবাইকে কিছু না কিছু কাজ গছিয়ে ব্যস্ত করে দিয়ে মেয়েটার প্রতি নজর দেয়। আগের ক্লাসে রেজাল্ট খারাপ নয়। বানান পরিস্কার। বাক্যগঠনও। তার হাতের লেখা দেখে প্রজ্জ্বল অবাক হয়ে যায়। এতই অবাক হয় যে অপ্রস্তুত বোধ করে। নিজের আপাদমস্তক রোমন্থন করে। আড়চোখে দেখে নেয় প্যান্টের চেন খোলা কিনা।
তারপর গলা পরিস্কার করে বলে, “ঠিক আছে, প্রথম প্রস্তর যুগের অস্ত্র সম্পর্কে টীকা লেখ, দশ মিনিট সময়” বলেই চুপ হয়ে যায়। তার চোখের সামনে দিয়ে মুক্তোর মতো হরফে বছর আটের মেয়েটা ইতিহাস লিখতে থাকে। প্রজ্জ্বল তাজমহল দেখার মতো হাঁ করে সেই লেখা দেখে। একসময় লেখা শেষ হয়। পুরোটায় চোখ বুলিয়ে কোনোরকমে একটা রাইট মেরে প্রজ্জ্বল হাঁফ ছাড়ে। সবাইকে পড়া মুখস্থ করতে দিয়ে প্রজ্জ্বল গুম মেরে থাকে। মেয়েটাকে দেখে তার মনে হয় এক ব্যাগ একটাকা, দুটাকা, পাঁচ টাকার কয়েনের ভিড়ে পড়ে একখানা সোনালি দশটাকার কয়েন এসে পড়েছে। বেখেয়াল হলেই তা বেহাত হয়ে যাবে। প্রজ্জ্বল মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে, “আমার খবর তোর মাসিকে কে দিল রে?”
“মাসি ওই সাইনবোর্ডটা দেখেছিল স্যার…”
প্রজ্জ্বলের আনন্দ হয় প্রচন্ড। ইচ্ছে করে বাইরে ছুটে গিয়ে সাইনবোর্ডটা জাপটে ধরে, টিউকলকে চুমু খায়। অনাবিল আনন্দের মাঝে প্রজ্জ্বল হঠাৎ আবিষ্কার করে, এই ঘরের দেওয়ালগুলোয় অনেক অনেক বছর হয়ে গেছে, কোনো রঙ পড়েনি। রঙ চটে গিয়ে জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট বালবিধবার মতো বোবাচোখে চেয়ে আছে। চটজলদি কিছু ঝুলের প্রতিও নজর পড়ে তার। “অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন আর কিছুই করার নেই। বড্ড দেরি হয়ে গেল।” মনে মনে আওড়ায় প্রজ্জ্বল আর আফশোসে মাথা নাড়ে। তারপর মেয়েটাকে সে সম্রাট অশোক সম্পর্কে লিখতে দিয়ে চোখ বোজে আর দেখতে পায় অশোকের অষ্টাদশ শিলালিপির গায়ে মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে উৎকীর্ণ লিপি,-

প্রজ্জ্বলদার কোচিং সেন্টার
ক্লাস IV থেকে X পর্যন্ত
ইংলিশ, ইতিহাস, বাংলা পড়ান হয়।

পড়া শেষ হলে মেয়েটাকে লোলুপ স্বরে প্রজ্জ্বল বলে, “পরের দিন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা নিয়ে লিখতে দেবো, তৈরি হয়ে আসিস।” প্রজ্জ্বলের চোখমুখ চকচক করে। মেয়েটা ঘাড় নেড়ে মাসির সাথে বাড়ি চলে যায়। আর কোনোদিন প্রজ্জ্বলদার কোচিং সেন্টারে- এ সে ফেরে না।

বক মধ্যে হংস কথা

পুরসভা একদিন এসে টিউব ওয়েলটা হজম করে ফেলল। তারপর একটা লোহার কল লাগিয়ে দিয়ে গেল তার জায়গায়। প্রজ্জ্বল গামছা গায়ে এক হাত দিয়ে কলটা একবার খুলল- একবার বন্ধ করল। জল- জলের মতো সহজ এখন। টিউকল থেকে পুরসভার কল হয়ে যাওয়ায় তার মান বেড়ে গেছে এখন। কিছু মহিলা বুকের উপর নাইটি জড়ো করে রাস্তার ধুলো কাদাকে ঘেন্না পেতে পেতে বালতি নিয়ে কলতলায় এসে জুটেছে, তারা প্রজ্জ্বলকে তাড়া দেয়। কল খুলে তার নিচে বালতি বসিয়ে প্রজ্জ্বল বালতির সহজ উপচে পড়া দেখে। তারপর একহাতে বালতি নিয়ে আরেক হাতে দেহের ভারসাম্য বজায় রেখে রাস্তা পার হয় সে পেঙ্গুইনের ভঙ্গীমায়। গামছা পরা পেঙ্গুইন দেখে নাইটি পরা বউদের আমোদ হয়। তারা আদিরসাত্মক মন্তব্য করে কলতলা পিছল করে তোলে। প্রজ্জ্বল পিছন ফিরে দেখে তার একান্ত কলতলা তার হাত গলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
আগে প্রজ্জ্বলের সর্বশক্তির কাছে হার মানা জল পাতাল থেকে উঠে আসত বালতিতে, সেই জল এখন পুরসভার মর্জি মতো আসে ভোর ছটা থেকে আটটা আর বিকেল চারটে থেকে পাঁচটায়। সময় সময় এসে না পড়লে মহিলাদের লাইন লেগে যায়। প্রজ্জ্বল রাতে স্বপ্ন দেখে,- সে গামছা পরে বালতি হাতে রাস্তা দিয়ে ছুটছে তো ছুটছেই, রাস্তা শেষ হচ্ছে না, কলতলা নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আর কলতলায় নাইটি পরা, হাতে বোতল বালতি কলসি ধরা মহিলাদের ভিড় বাড়তে বাড়তে পুরো মহকুমা ছেয়ে যাচ্ছে। সেইসব অগুনতি তেতাল্লিশ বছর বয়সী হিংস্র মহিলা তাকে দেখে হেসেই চলেছে, কলতলা সেই সম্মিলিত হাসিতে হড়হড়ে পিচ্ছিল হয়ে যাচ্ছে।

ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে প্রজ্জ্বল বালতি হাতে কলতলায় এসে কলের নিচে বালতি বসিয়ে কল খুলে দেয়। অনাগত জলের আত্মা মুক্তি পেলে কলের গলা দিয়ে বিচিত্র সব শব্দ উঠে আসে। প্রজ্জ্বল পাইপের উপর গভীর মমতায় হাত রাখে। পুরসভার পাইপ। পুরসভার কল। জলটাও পুরসভারই। জলের অপেক্ষায় বালতি বসিয়ে রেখে প্রজ্জ্বল রাস্তার ধারের রোয়াকে বসে পড়ে। ধীরে ধীরে সূর্য উঠে আসে। নাইটি পরা মহিলারা টুথ ব্রাশ, মাজন, জিভছোলা আর বালতি হাতে কলতলায় ভিড় জমায়। পুনরায় আদিরসাত্মক মন্তব্য প্রজ্জ্বলকে একঘরে করে। মাথা নিচু করে গামছা পরা প্রজ্জ্বল জলের জন্য একনিষ্ঠ অপেক্ষা করে।
ছটার পর কলের পেট পরিস্কার করে জল বেরিয়ে আসে। কোনোরকমে বালতি ভরা হলে, প্রজ্জ্বল ভরা বালতি নিয়ে কলতলা থেকে পালিয়ে যায়।

যেদিন পুরসভা ঠিক করে জল দেবে না, একটা অটো এসে তার আগেরদিন সবাইকে সেকথা জানিয়ে দেয়। মহিলাদের ঝাঁকে সেদিন আলোড়ন পড়ে। সবাই ঘটি বাটি কাপ, যা পায় তাতে জল ভরে রাখে আগামিকালের জন্য। প্রজ্জ্বলের বালতি ভরা হলে সে গামলাটাও ভরে নেয়। পরের দিন কলতলা জনহীন। পড়ানোর ঘরে বসে সারাদিন মুগ্ধ চোখে নির্জন কলতলার সৌন্দর্য উপভোগ করে প্রজ্জ্বল। কিশোরের কৌমার্য মেখে কলতলাটা খটখট করে। পরের দিন জল এলে, আবার কাকের ঝাঁকের মতো মহিলারা এসে বসে সেখানে। প্রজ্জ্বলের জল নেওয়া দায় হয়ে যায়।
বেলা চারটের সময় কলতলার ভিড় তুলনামূলক কম। এই সময় প্রজ্জ্বল একটু আড় ভাঙতে পারে। আজকে কলতলায় মহিলাদের দলে একজন নতুন মানুষকে দেখল প্রজ্জ্বল, ভিড়ের মধ্যে তাকে আলাদা করে সে চিনতে পারছে কারণ বউটার মুখ চোখ তেতাল্লিশ বছর বয়সী মহিলাদের মতো হিংস্র না। বউটি জল ভরার জন্য ব্যস্তও নয়। প্রজ্জ্বলকে সে রেষারেষি ব্যতিরেকে জল ভরতে দেয়। বাকি মহিলাদের টিটকিরি সে গায়ে মাখে না। সম্ভবত পাড়ায় নতুন- মনে করে প্রজ্জ্বল বালতি হাতে রাস্তা পার হয়ে আসে।
বউটা ভোরে আসেনা। শুধুই বিকেলবেলায়। প্রজ্জ্বল মুখিয়ে থাকে কলতলার দিকে। বেলা চারটে বাজলে সে অপেক্ষা করে বউটা কখন সেখানে আসবে আর সে গামছা গায়ে বালতি হাতে হাজির হবে কলতলায়। বউটার নাম স্বপ্না। বাজারে বরের আলুর গোডাউন। একটা ছেলে আছে ছোটো। এতকিছু মহিলাদের মুখে জানতে পারে প্রজ্জ্বল। মহিলারা অনর্গল কা কা করে কলতলায়। ডানা ঝাপটায়। ঠোঁট দিয়ে পা ঘষে। পালক খুঁটে দেয়। কলের জলে মাথা ভিজিয়ে নেয়। বালতি ভরে জল নিয়ে ছলাৎ ছলাৎ করে প্রজ্জ্বল ঘরে ফিরে আসে।
স্বপ্না প্রতিদিন বিকেলবেলায় প্রজ্জ্বলকে তার প্রাপ্য জল ভরার সুযোগ দেয় আর প্রজ্জ্বলের চোখ বুজে আসে কৃতজ্ঞতায়, মাথা নুয়ে যায়। বালতি উপচে পড়ে। একদিন এরকম জল ভরার মুহূর্তে মহিলারা কা কা করছে আর প্রজ্জ্বল ভরছে জল। স্বপ্না তার পরে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে, হঠাৎ গলা থেকে খক করে এক ডেলা কফ তুলে থুঃ করে ফেলে দিল। কলের থেকে কিছু দূরে, প্রজ্জ্বলের চোখের সামনে কলতলাতেই কফটা পড়ল। কিন্তু কেউ ভ্রুক্ষেপ করল না। দাঁতে দাঁত চেপে প্রজ্জ্বল বালতি ভরে, এক হাতে দেহের ভারসাম্য বজায় রেখে দ্রুত ফিরে আসে ঘরে। পিছু ফিরে দেখে, মহিলারা কলতলা ঘিরে কফ বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর স্বপ্না জল ভরে নিচ্ছে কলসিতে। একচুলও টলেনি কোনোকিছু।
প্রজ্জ্বল সারা সন্ধ্যা ওঁত পেতে থাকে। রাত আটটার পর কলতলা ফাঁকা হয়। রাস্তায় লোকজন কমে যায়। বালতি আর ঝাঁটা হাতে রাস্তা পার হয়ে কলতলায় এসে সে অন্ধকারেও কফটা দেখতে পায়।- কলতলার গায়ে জলৌকার মতো লেগে আছে।
প্রজ্জ্বল এক মগ জল ঢালে কফটার উপর, তারপর ঝাঁটা মারে। স্যাট স্যাট আওয়াজ হয়। কলতলা চমকে চমকে ওঠে। অন্ধকারের মধ্যে গামছা পরা পেঙ্গুইন নিপুন হাতে কলতলা ঝাঁটতে থাকে। ঝাঁটানো হলে তার উপর আরও কয়েক মগ জল ঢেলে নিশ্চিন্ত হয় সে। পুরসভার কল মুগ্ধ চোখে প্রজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কলতলা সাফ হয়ে এলে প্রজ্জ্বল সোজা হয়ে দাঁড়ায়। কপালের ঘাম মোছে। পিঠের আড় ভাঙে। কোথাও কোনো শব্দ নেই। কেউ এখন তাকে, তাদের দেখছে না। আকাশে শুধু,- শুধুই আকাশে শব্দ করে ধ্রুবতারা ফাটছে, স্বাতী নক্ষত্র ফেটে যাচ্ছে। ফাটছে কালপুরুষ, মৃগশিরা। ফাঁকা বালতি, মগ আর ঝাঁটা হাতে কলপুরুষ প্রজ্জ্বল কাজ সেরে ফেটে চৌচির আকাশের নিচ দিয়ে আপন মনে ঘরে ফিরে আসছে।

Facebook Comments

Leave a Reply