ক্লোরোসিস ও ইসবুটুপ : অভিষেক ঝা

ক্লোরোসিস

সকরকন্দের মাটি লাগা এক ভোর বা সন্ধ্যায় বড় তৃপ্তি করে মাংস প্রেম ঠুকরে ঠুকরে পেটে চালান করছিল একটি কাক। দুটি তার ভাগ পাচ্ছিল। আরও দুটি ভাগ না পেয়ে, না-থাকা জিভবা দিয়ে লাল ঝরাচ্ছিল । প্রয়োজনের সময় তৃপ্তি সহকারে খাদ্যগ্রহন — এর চেয়ে সহজিয়া নিষ্পাপ দৃশ্য আর কীইবা রয়েছে খাদ্যাভাবের এই পৃথিবীতে? তাই এই সহজ ভাবে নামতে থাকা সন্ধ্যা যা আবার ভোরও হতে পারে সেখানে সবচেয়ে বেশী করে ছড়িয়ে রয়েছে প্রেম ।ঠোঁটে মাংসের কুচি লেগে থাকা কাকের চোখের যে সুগভীর আনন্দ তা দেখে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পিঠালু গাছটা দুটি পাতা ঝরিয়ে দিল পারা প্রতিফলিত করে চলা রাধিকার পুকুরের বুকে । এক পাক নিষ্পাপ আনন্দে আরেক ঠোকরে খানিক মাংস ছিঁড়ে নিল আরেকটি কাক। কয়েক ঠোকর পর মাংস পিণ্ডটা ঝুপ করে পড়ে গেল জলে । হোঁৎকা মাগুর ঘাই মারল। তার নাগাল এড়িয়েও দু-এক কুচি চায়ের পাতার মত থিতোতে থিতোতে তলার পাঁকে সবসময় স্বপ্ন দেখার মরিয়া চেষ্টায় চোখ মুদে থাকা সেই কাছিমের গায়ে এসে বসল । এখানে শ্যাওলা, পাঁক , মরে যাওয়া মাছের কাঁটা , বালু, গুগলির কঙ্কাল , শামুকের খোল, ছেঁড়া শাড়ির পাড়, এয়োতি চিহ্ন, ডুবে মরা রাধিকার গল্প —- সব কিছু কাছিম-শরীর হয়ে আছে ।

এই বাড়িতে যেদিন বউ হয়ে আসল সে, অঝোর বৃষ্টি হচ্ছিল। বকুলফুলের গাছের দিকে একভাবে তাকিয়েছিল তার জন্য বরাদ্দ হওয়া ঘরটা থেকে।বকুলফুলের গাছটাও বোধহয় একমনে দেখছিল তাকে। পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলে চোখ খুলে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে খানিক পর। বকুলের গন্ধে চোখ খুলে রাখা মুশকিল হল তার।চোখ বন্ধ করলেই ঘিরে ধরে দুপুর। এ জন্মেই ছিল তো? নাকি অনেক জন্মের আগের সেইসব দুপুর? শালুকের শিকড়ে পৌঁছতে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ডুবে যাচ্ছে সে। কালচে সবুজ জলের নিচে শণের মত ঘাস পেরিয়ে সাপের দল হয়ে একভাবে দুলে যাচ্ছে শালুকদের শিকড়। একসাথে প্রার্থনা করছে যেন শিকড় পাওয়ার। গলার কণ্ঠায় চিনচিনে এক কামড় আর হিসহিস ভাবে গোলাপ বলে চলেছে, “ বকুলের মালা, বকুলের তাগা, বকুলের টিকলী, বকুলের বিছা , বকুলের তোড়া পরতে হবে তোকে। পরবি তো?”… সবুজ জলের নিচে তার চোখ নরম ভাবে বন্ধ হয়ে আসে। পনেরোতে’তে পা দিতে তার তখনও এক বছর বাকি। “কী গো ফুলবউ, মায়ের কথা মনে পড়ছে বুঝি?” পপিতা’মাঈ জিজ্ঞাসা করে। তার চোখ জুড়ে হিসহিসে ভাবে নড়ে চলেছে শালুকের শিকড় আর বকুলের গন্ধে ম-ম করছে এই ঘরের বিহান বেলা। তিল মোদক হাতে নিয়ে লাল পাড় ঘিয়া ঢাকাই-এর খুঁটে পয়সা বেঁধে এই বাড়ির মহিলারা ভিড় জমাতে শুরু করেছে নতুন বউ দেখতে। “ এই নাও বিবির আনা”, “ রাখো এই আকবরী মোহর”, “ মহীপালী মুদ্রাটা রাখো দেখি”।

তেঁতুল দিয়ে চকচকে করে নিচ্ছে সে তার প্রাপ্ত ভিক্টোরিয়ার মুদ্রা, আকবরের মোহর, মহীপালের রৌপ্য মুদ্রা। তার জন্য গামারি কাঠের ছোট্ট একটা ঠাকুর সিংহাসন বানিয়ে আনা হয়েছে। সেখানে সে লক্ষ্মী, সরস্বতী, চৈতন্য, কালীর সাথে এই মুদ্রাগুলিকেও রাখে। সংসারে সুখ শান্তি থাকে তাহলে, আসার আগে তার মা ,আসার পর তার শাশুড়ি বলে দিয়েছে। সেই সিংহাসনের এক কোণে ছোট্ট লাল রঙের পুঁটুলিতে বাঁধা আছে শুকিয়ে যাওয়া কিছু শালুকের শিকড়, তার বাপের বাড়ির দেশের দিঘি থেকে তুলে আনা।

অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাড়িটার সব জায়গায় তার অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল না।ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদত খুব প্রথম প্রথম । শাশুড়ি নিজ হাতে হাতিপাউয়া লুচি আর বোঁদে খাইয়ে দিত। সে নিজের যাতায়াতের জায়গাটুকুকে খুব গভীর ভাবে চিনতে লাগলো প্রাথমিক কান্নাকাটি মিটে যাওয়ার পর।পিছনের বাগানের কাগজি লেবুর গাছের শিকড়তলে এক শঙ্খিনী বাস করে। সে জানত না; কেউ তাকে বলার প্রয়োজন বোধ করেনি। প্রথম প্রথম ভাবত গন্ধগোকুল। চাঁদের রাতে আতপ চালের গন্ধে ভরে উঠছে পুরো বাগানটা। হঠাৎ পরিত্রাহি চিৎকার ঝোপের টুনটুনির বাসা থেকে। সে দেখে একটি টুনটুনির বেরিয়ে থাকা মাথা নিয়ে সরে যাচ্ছে বিশাল সেই লতা। গায়ে চাঁদ পড়ে অদ্ভুত এক রামধনু ছিটকে আসছে। তার খুব ভাল লাগছে । সে একমনে তাকিয়ে দেখছে সাপের খাদ্যগ্রহন। ঝিম মেরে স্থির থাকার সময়টুকুর দিকে তার সমস্ত মন। তারপর ধীরে ধীরে চোখ যাচ্ছে কাগজি লেবুর শিকড়তলে সাপের পুরো দেহটির উধাও হয়ে যাওয়ার পুরোটায়। তার কোনো ভয় আসে না। লেবুর পাতার গন্ধ বুক ভরে নেয়।

“চলো, একদিন রাধিকার পুকুরে চুপিচুপি স্নান করে আসি”, পপিতা’মাঈ লোভ দেখায়। সে তো বরাবরের লোভী।সুবিশাল এক দিঘির সামনে আরও সুবিশাল হয়ে যে দুপুর পড়ে আছে, তাদের ছেদবিন্দুতে তারা স্নান করছে। পাশে একটা পিঠালু গাছ। সে ডুব দিয়ে বুড়বুড়ি কেটে যেতে চাইছে ভিতর জলে। এইসব জলের তলে অজস্র অবদমন মুখ বুজে মাটি হয়ে বুদ্বুদ হওয়ার ক্ষণের অপেক্ষায় কত কাল ধরে চুপ হয়ে থাকে।যারা শ্বাস বন্ধ করে জলের তল অবধি যেতে পারে তাদের ঘিরে ধরে সেই দমবন্ধকর অবদমনরা।এই সুবিশাল দু্পুরের সামনে সুবিশাল এই দিঘি সেইসব অবদমনকে খানিক ভুলতে চেয়ে তাদের সাহায্য নেয়। স্বপ্নসম হয়ে ওঠে সময়। সে ও পপিতা’মাঈ স্থির চোখে দেখে দিঘির তলে জমা হওয়া সবকিছুকে। স্থির চোখে তারা মুগ্ধ হয়ে দেখে তাদের শরীর। স্থির চোখে জলের তল থেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে এক কচ্ছপ। মাটি ও বালির মত সে চোখ। স্থির। স্থি্র একসময় বুকে চাপ দেয়, ধরপড়িয়ে ভেঙে যায় সব। অনেক অনেক দিন পর ঘরে বসে সে হেসে গড়াতে গড়াতে সেই চুপস্নানের গল্প আবার করছিল তার বোনের সাথে।ঘর জুড়ে তখন দিঘির তল। আর একটা ছোট্ট বুদ্বুদ সুবিশাল দুপুরের দিঘি হয়ে যাওয়া অংশটা শরীরে নিয়ে উপরে উঠতে শুরু করেছে তার শরীর জুড়ে।

“ওর মা কেমন আছে রে?”

“তোর কথা জিজ্ঞাসা করে। জানতে চাই কেমন আছিস।”

“আর কিছু বলে না?”

“কী?”

“আমায় দেখা করতে বলে না?”

“চন্দ্রপুলি করলে দিয়ে যায়। তখনও তোর কথা বলে তো।”

চন্দ্রপুলি খেতে বড় ভালো লাগে তার। বাইরের খোলসটায় মৃদু দাঁত বসিয়ে কামড় দিলেই জিভ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষীর।তার গোলাপেরও খুব ভালো লাগত চন্দ্রপুলি। লাবণ্যের কন্যাপুতুলের সাথে সে তার কন্যাপুতুলের বিয়ে দিত। ভাদ্রের গুমোট বিকেলে তার মা হাতিপাউয়া লুচি ভাজত কন্যাপুতুলের বিয়ের খাতিরে। সে আর লাবণ্য বড় যত্নে সাজাতো ভাসিয়ে দেওয়ার ডালা। ঘাস, পাতা, খড়ি, লতা, টগর দিয়ে। খড়ি আর হলুদ দিয়ে আলপনা আঁকত ডালায়। আতপ চালের পিটুলি দিয়ে বিড়াল বানিয়ে দিত। বিড়াল না থাকলে কি আর লক্ষ্মীশ্রী লাগে একটা সংসার? কাপড় দিয়ে একটা ছাউনিও করে দিত। পুতুলগুলো যাতে রোদজলে কষ্ট না পায় ভাসতে ভাসতে। ডালাটা যখন বড়কা জোলার রোদ গোলা জলে ভাসতে ভাসতে রোদ মতো হয়ে আসত শেষ বিকালের আলো তখন। তার আর লাবণ্যের খুব কান্না পেত এইসব সময়। তার সেইসব কান্না ভুলিয়ে দিত গোলাপ। ঘাম জ্যাবজ্যাবে তার শরীরে জিভ ঘষে ঘষে জাগিয়ে তুলত যাবতীয় গ্রন্থি।এত জল, এত জল তার শরীরে! তার আর গোলাপের হাতের রেখাগুলো তখন পরস্পরের হাতের ঘাম চিনতে ব্যস্ত।

খোলা চোখে কড়িবর্গার দিকে তাকিয়ে আছে সে। গুনছে পঞ্চান্ন, চুয়ান্নো, তিপ্পা… । ঠাকুরদালান থেকে সন্ধ্যা আরতির আগেই চলে এসেছে । শরীর খারাপ শুনে চলে যেতে বলেছে সবাই। পপিতা’মাঈকেও সে আসতে বলেছ দ্রুত। দরজায় টোকা পড়ে। পিলসুজ নিয়ে পপিতা’মাঈ।

“তোমার তো এখন শরীর খারাপ হওয়ার কথা নয় ফুলবউ?”। “তুমি যে সেদিন বললা, তোমার নীলাম্বরী পরার ইচ্ছে খুব এয়োতি সাজে?” । “পাগল!”। “ কেউ আসবে না এখন”, “না”, “পরো বলছি…রাধিকার পুকুরে স্নান করতে যাবো না কোনোদিন আর…” , “ কেউ দেখে ফেললে?”। পিলসুজের আলো ঠিকরে পড়ছে আয়নায়।সে নীলাম্বরী জড়িয়ে দিয়েছে পপিতা’মাঈয়ের গায়ে। নিজ হাতে পরিয়ে দিচ্ছে সব এয়োতি চিহ্ন। “ভাতারখাকির শখ দেখো ”, তার চোখের গভীরে ছায়া মেলেছে কাগজি লেবুর শিকড়তল। অনেকদিন আগে বর মরে যাওয়া পপিতা’মাঈ সালঙ্কারা লাজে তাকিয়ে আছে তার দিকে।বাইরে সান্ধ্যকালীন উলুধ্বনি।

বিয়ের তিন বছরের ভেতর এই বাড়ির ভিতর ঘর অবধি চিনে ফেলেছিল সে। বিশাল জাম গাছটার কোটরে বাস করা চারটে প্যাঁচা কখন ইঁদুর নিয়ে আসে মুখে সে জানে।হেমন্তের মরা জ্যোৎস্নায় ধানের গোলায় ঘুরে বেড়ানো এই বাড়ির মরে যাওয়া কুমারী মেয়েদের ছায়াদের সাথে তার আলাপ পরিচয় হয়ে গিয়েছিল।সে জানে কুবো পাখির ডাকের ফাঁকে ফাঁকে এই বাড়ির দাইমা পপিতা’মাঈ মুখ দিয়ে হাত চেপে কী এক ব্যথায় খানিক কেঁদে নিচ্ছে।

ঠাকুরের পায়েস রান্নার সময় সে তার জা-এর পায়ের তোড়ার দিকে বুকঝিম নিয়ে তাকিয়ে থাকে । পায়েস খানিক ধরে যায়। শাশুড়ী ঝাঁঝিয়ে ওঠে। অল্প ঘি গলিয়ে লোহার কড়াইয়ের ভিতর কাঠের খুন্তি দিয়ে নাড়াতে থাকে সে। তবু বারবার চোখ যায় ।চোখ যাওয়া আটকাতে গোলাপের বুকের কথা ভাবতে শুরু করে। শীতের হিম ঝুরা রাতে ঝুমঝুম করে কেবল শজারু ঘুরে ফেরে না সেরেস্তা ঘরের চালে, মরে যাওয়া লাবণ্যময়ী তার খোলা চুল দেখতে আসে সেই ঝুমঝুমের ভিতর দিয়ে। তুলসীর পাশে বসে বসেছিল তাদের মা, জ্যাঠাইমা, ন’পিসি।তিল বিনিময় করে সে আর লাবণ্য ফুল হয়েছিল। তারা দু’জনেই তখন দশ। সাত বছর পর লাবণ্য আত্মহত্যা করলে নিয়ম মেনে অশৌচও পালন করেছিল সে। উনুনের কাঠ শব্দ করে ফাটে। পায়েসের খানিক ধরে আসা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে বাড়িময়। আর এইসবের মধ্যিখানে সে দুই বার পোয়াতি হয়ে যায় । এত যত্নআত্তি , কত্ত খাতির — তারপরেও দুইবারই পেট ঝরে যায় । আবার পেট হয় ।

“এইগুলো যে করিস ভয় লাগে না গোলাপ?”, ইঁদারার জল থেকে এইসব রাতে লাবণ্যময়ী তার গা ধোয়ার সময় উঠে আসে ।সে ভারি অবাক হয়ে ভাবত প্রথম প্রথম যে লাবণ্য তো এই ইঁদারায় ঝাঁপ দেয়নি। তাহলে সে কী করে এই ইঁদারা থেকে উঠে আসে! ভাবার কোনো কিনার না পেয়ে সে এই নিয়ে ভাবা ছেড়ে দেয় একসময়। “পাপের ভয় নাই তোর?” , লাবণ্যের গলায় উষ্মা। চুল ঝাড়তে ঝাড়তে শোনে সে।“আমার নিজেকে পাপী ঠেকত গোলাপ, তোর মত এতকিছু না করেও”, লাবণ্য যেন নিজেকেই বলছে।“ আমার মনে হত আমি একটা খারাপ মেয়ে আর তোকেও খারাপ করে দিচ্ছি। বিয়ের পরেও আমরা…”, লাবণ্যের গলা দলা পাকাচ্ছে। ইঁদারার যে শ্যাওলাময় জগৎ থেকে উঠে আসে সে, সেই শ্যাওলারা ইঁদারার গা বেয়ে উঠে লাবণ্যকে আবার শ্যাওলায় পরিণত করছে। চারদিকে তাকিয়ে ভেজা শাড়িটা ছেড়ে গামছা জড়িয়ে নেয় সে। “ আমরা কি পাপ করতাম গোলাপ?” প্রায় শ্যাওলা হয়ে আসা লাবণ্যের জিজ্ঞাসা। “ অ বউমা সর্দি লেগে যাবে তো, এখন অসাবধান হোয়ো না ”, খানিক দূর থেকে তার শাশুড়ি গলায় উদ্বেগ নিয়ে বলে ওঠে।

এইসব ভোর বা সন্ধ্যায় পপিতা’মাঈ বড় যত্ন করে তার চুলে বিলি কেটে দেয় । তার থোক থোক বুক থেকে চোষে কত্ত নিচের ঘরে থাকা যখের জীবন । পপিতা’মাঈ ঠোঁট চিপে কিছু বলতে চায়, সে ঠোঁট দিয়ে বন্ধ করায় সে ঠোঁট । দক্ষ দাইয়ের হাত জানে কোথায় কতটুকু চাপ দিয়ে চিরে দিলে বেরিয়ে আসবে হাত পায়ের আভাস না হওয়া সেই রক্তমাখা মাংসপিণ্ড । তারা জানে কোথায় সে মাংসপিণ্ড রেখে আসলে কেউ খুঁজেই পাবে না তার বারবার পেট ঝরে যাওয়ার কারণ। সে জানে এইবার নিশ্চিত তার সতীন আসবে।পপিতা’মাঈয়ের ফোঁপানি থামাতে সে মুখ খোলে। “সেই শুরুর দিন থেকে ওঁকে বারবার বারণ করে আসছি। আমার শরীর ছোঁবেন না। ঘিনঘিনে লাগে…” , আগের দুইবারের মত আবার বলে ওঠে সে।

ইসবুটুপ

এমন নরম বিকালে নয়ানজুলির গন্ধ মেখে পাল কে পাল মেঘ বুনা হাতির মত ঝুরতে থাকে। অনেক চেষ্টা করে বোনা ক্ষেতি,বাড়ি, সংসারের উপর বুনা যা কিছু তাদের হুই রাগ সেই কবে থেকে! এখানে তো এখন শেষদুপুর রঙা ব্যাঙের গা এলানো আত্মসমর্পণের কথা ছিল সাঁঝ লাগতে শুরু করা গহুমার আধ-চিরা জিভে। ইসবুটুপ নামের হুরের বসে থাকার কথা ছিল এসব মেঘের জন্য; মেঘ আর ইসবুটুপের ভিতর এমনই কথা হয়েছিল। এসব কিছু না মিললে সব রাগ গিয়ে পড়ে গোছানো সবকিছুর উপর। প্রবল দাপাদাপির শেষে পোয়াটাক রোদ উঠেছে। ছড়িয়ে থাকা খেসারির ডাল, খুন্তির গায়ে লেপ্টে থাকা সাঁটি মাছের ভর্তা, মোচড়ানো তোরঙ্গ , ক্রমাগত পিছু ডেকে যাওয়া একমনে কোঁকাতে থাকা সংসার — এই সবকিছু ফেলে সে বাদাড়ে ঢুকতে থাকে হামাগুড়ি দিয়ে। জল ঝরছে উপরের রোদ লেপ্টে থাকা পাতাগুলোর কিনার দিয়ে। আর একটু ভিতরে গেলেই শেয়ালের বিয়ের ঝুনুর শোনা যাবে। সে সময়ের রোদ চোখে ধরে নিয়ে আসতে পারলে আজব সব বাখোয়াজি হয়। রামধনুর কিনার খুঁজে পাওয়া যায়। তারা নাকে গেঁথে , কাকরঙা রেশম পরে পুরা গ্রাম জুড়ে উড়ে বেড়াতে বেড়াতে আয়নায় সব মরে যাওয়া মানুষদের ছায়া নিয়ে কিসসা শুরু করে এক মেয়ে। মাজারের কোণের শিরিষ গাছটা থেকে কিসসা শুনতে নেমে আসে বকরঙা এক জ্বিন। আর এই সবকিছু মিললেই সবকিছু ঠিক হয়ে যায় আবার। সে জানে।

“তিন আঁটি দশে দিবা কি?”

“আচ্ছা চার আঁটি পনেরোতে লিয়ে যান” ।

এসব সময় তাকে দেখতে বড় আজব লাগে। আশেপাশের লোকজন না বুঝতে পারলেও সে দিব্যি বুঝতে পারে তার চোখের ভিতরের ঝিল দেখতে পাচ্ছে না সামনের এই তিন আঁটি দশের দরদাম করা লোক। তাই রাজিও হচ্ছে না চার আঁটি পনেরোতে নিতে। অথচ একটু ঠাওর করলেই লোকটা দেখতে পেত তার রসুন কোয়ার মত সাদা চামড়ার নিচে উঁকি মারা নীল নদীগুলো ছাপিয়ে পুদিনা পাতার মতই শান্ত একটা সবুজ রঙের ঝিল জুড়ে আছে তার চোখ। মোম ফর্সা এক সবুজ চোখের মেয়ে বড় শান্তভাবে রেগে উঠছে দরাদরি করা লোকটার উপর। এই পাতা বুনতে তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। তার বাড়ির পিছনে যেখানে শীত শুরুতে ফুলকপি আর শীত শেষে টমেটো বোনা হয় নিয়ম মেনে তার মাঝামাঝি এক ফালি মাটি রয়েছে। তার মাটি। এখানে সে ইচ্ছামতো বুনে। তার যা যা ভাল লাগে, যখন যেটা ভাল লাগে। লাল শাক, পালং,ছোলা, মটর, চকুই। কখনো হয়,আবার কখনো হয় না।কিন্তু ইচ্ছার চাষ এখানটা জুড়ে তার বরাবর। তাই এটা চষতে বেগও বেশি। তার ইচ্ছাকে তিন আঁটি দশে নামিয়ে আনা লোকটার এসব জানার কথা নয়।সে খুব ভালো করে জানে এই লোকটা তার দেশ চেনে না। তাকেও চেনে না। তাই এত সহজে নিচ্ছে তাকে। “লিয়ে জান, চারটা বারো”। ফেরার জন্য চট গুটায় সে।

ঘুম ভেঙে সে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে মশারির উপর কালচে টিনের চালের দিকে। এতটাই স্থির সে চোখ মনে হয় বুঝি জলের তলে মাছ বা গোরে শুয়ে নিজের শরীরের দিকে ঝুপ ঝপ করে মাটি পড়তে দেখা মড়া। এমন ভাবে চোখ খুলে সে মনে করছে তার ছোটোবেলায় শোনা গল্পগুলো। তার আম্মা বলত তাকে। তার আম্মা তার আম্মার কাছ থেকে শুনেছিল। তার আম্মা তার আম্মার কাছে। তার আম্মা তার আম্মার কাছে। তার আম্মা…

সে অনেককাল আগের কথা। উদিকের ধানীজমিগুলান তখন বন আছিল। নমুরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলকে দল আসে নাই তখনো। অসম থেকে খ্যাদা খায়ে তখনো ভঁইষের পালের মতন ভাগান দিতে দেরি আছে বহু। ছুঁড়ি রে ! দেশভাগ তো সেদিনের ব্যাপার! এই গল্প কত্তদিনের পুরানা জানিস! বনগুলান সাফা হয়ি যাবে – একথা তখনো ভাবতে পারে এমন গাছ একখানাও ছিল না। সেই সময়ে ভূত, দানো কোনো গজবের ব্যাপার ছিল না। ওই না-গজবীয়া দুনিয়াতে ফকসী ধরেছিল তার আম্মার আম্মার আম্মার আম্মার আম্মাকে। হুই রাতে যে কেন বেরিয়েছিল মাগী সেটা গল্পে বলা ছিল না। বনের কিনার , নদী আর ক্ষেতির মাঝে তখন ছায়া খেলতেছে বাতাসে। হুইট করে ফ্যাকসিয়ে উঠে আগুন। দ্যাহে চারডে মেয়েছেলান আর ছ’ডা ব্যাটাছেলান ন্যাংটা হয়ে নাচতেছে। তার আম্মা বলেছিল এরে ফকসী কয়। যে মাগীরা বাড়ি ছাড়ি , ভাতারের ইচ্ছামতো ভাতারেরে গুদ না দিয়া রাইতে বনবাদাড়ে যায় উয়ারা এর খপ্পরে আসে। আগুনের পাশে ফেলে তাদের গুদে লাঠি ঢোকানো হয়। তারপর ছুরি গরম করে কেটে নেওয়া হয় গুদের জিভবা। গুদের দাঁত নাই; তাই গুদ মুখের মত কামড়াইয়ে, চিল্লায়ে বাধা দিতে পারে না। তারপর? তারপর আর কী, মন দিয়া ক্ষেতি বাড়ি করে। বনবাদাড়ে যায় না। ভাতার যখন ভাত চায় ভাত দেয়, ভাতার যখন গুদ চায় গুদ দেয়, গুদের হক ভাতারের। তা সেই মাগী তখন ভাবছিল এখন বাড়ি ফিরি ক্যামনে? বাড়ির চেয়ে বনকে কাছের ঠেকে তার; মনে হয় বনই তার বড়দাদি। বড়দাদির কোলে গেলে বেঁচে যাবে। পা দু’ডায় সরপট লাগায়। পা দু’ডা কখন যে মাটি ছেড়ে উঠে গেছে সে টেরও পায় নাই। আকাশে বুনা হাতির পালের মত মেঘ জমেছিল। বৃষ্টিতে ফকসীর আগুন নিভে যায়। ফকসীরা সব বাড়ি চলে যায় । বাড়ি ফিরে আসে সে বড়দাদির কাছ থেকে। অনেকদিন পর তার মেয়েকে সে এই গল্প শোনাবে। তার মেয়ে শোনাবে তার মেয়েকে। তার মেয়ে তার মেয়েকে। তার মেয়ে তার মেয়েকে। তার মেয়ে…

তার মেয়ে নেই। তার আছে জামির। সকালে জামিরের হাগার পর, গাঁড়ের চেরা জায়গার দু’পাশে লেগে থাকা মিহির হলুদ দানাদার আস্তরণকে তার একফালি জমিতে চাষ করা সর্ষার ক্ষেত মনে করতে থাকে সে। প্রথম প্রথম গন্ধে অসুবিধা হত। অন্যের শরীরের খইলের গন্ধ বড় বেশি করে পায় মানুষ। তার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। এখন গন্ধটাকেও নিজের শরীরের গন্ধ মনে হয়। সে জানে নিজের শরীরে খইলের গন্ধ আছে যতদিন তার মেয়ে হতেও পারে। একটা মেয়ে হলে সে কী সুন্দর গল্পটা শুনিয়ে দিতে পারে। জামিরকেই নিজের মেয়ে ভেবে সে গল্প শুরু করে কোনো কোনো রাতে। খানিক গল্প এগাতেই জামির শুরু করে, “হাইল্লে এট্টু পা টিপে দে, পায়ে বড় ব্যথা”। জোনাকির মত জ্বলে ওঠে তার চোখ, জামির টেরই পায় না। দু এক সেকেণ্ড। জোনাকি নিভে যায়। বড় যত্নে সে জামিরের পা টিপতে শুরু করে। জামির গোঙাতে থাকে, “মাঈ গে মাঈ”।

“ইসবুটুপ বিবি, হাসব্যান্ড জামির প্রধান , বয়স ছত্রিশ, ১৭ নং খাসজমা”, এক মাঝবয়সী সরকারি কর্মীর নির্লিপ্ত বলে যাওয়াকে বাধা দেয় সে, “ইসবুটুপ হুর”। “অই হল”, আবার নির্লিপ্তি। সে বোঝে তার মাটিতে পায়ের পাতা না ছুঁইয়ে হেঁটে আসা দেখতে পায়নি এই অফিসের কেউ। সে খানিক হতাশ হয়। তারপর নিজেকে নিজের আম্মা বানিয়ে বোঝায় যে এতে রাগ করতে নেই, দুঃখ পেতে নেই, সংসারের কথা সে না ভাবলে চলবে? খানকির ছেলে জামির তো বিছানায় শুয়ে কোঁকানো আর হাত দিয়ে বাঁড়া ঝাঁকানো ছাড়া শেখেনি কিছুই। শুধু অই একফাল জমিতে পুদিনা, পালং, লাল, চকুই বুনলে চলেক? তাই এরা তার মাটিতে না ছুঁয়ে চলা পা দেখতে না পেলেও এখানে বারবার আসতে হয় তাকে। শুনতে হয় তার জন্য সরকার কোনো টাকাপয়সা, ত্রিপল, টাটির বেড়া বরাদ্দ করেছে কিনা। একটা গুয়া হাতে ধরাতে হয় চেয়ারে বসা লোকজনকে। শুনতে হয় হরেক কথা। এবং প্রত্যেকবার তাকে বুঝতে হয় সে আসলে সে না, সে আসলে অনেকগুলান লোক। আর হেই লোকগুলানের জন্যই সরকারের দম বার হয়ি আসছে। সে অবাক হয়ে ভাবে তার কত দম যে সরকারের দম বার করি দিচ্ছে! তাই সরকার বাহাদুর ঠিক করিছে এই লোকগুলানের ভিতর যারা এখানকার লোক তাদের ছাড়া কারো দায়িত্ব লিবে না। এনার্ছি হইবেক।

সে যে অই জমির মালিক তা প্রমাণ করিতে তাকে এই নিয়ে সাতবার আইতে হল। প্রতিবার হাতে গুয়া ধরায় আর শোনে , “অই এক ডেসিম্যাল জমির পর্চা আছে? ওটা কি তোমার বাপের?”। সে উত্তর দেয় , “আম্মার”। “ এই তো হল মুশকিল। তা মা কি তার বাপের কাছ থেকে পেয়েছিল জমিটা?”। সে উত্তর দেয়, “ আম্মা তো পায়েছিল তার আম্মার কাছ থেকে”। “ তোমার বাপের কোনো কাগজপত্র আছে? ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, বিপিএল?”, “ আব্বা’কে দেখি নাই কোনোদিন”, সে খানিক শ্বাস নিয়ে বলে। এতক্ষণ পর পাশের টেবিল থেকে গোঁসাই চুপচাপ সব শুনছিল। গুয়াটা মুখ থেকে ফেলে ওই টেবিলের গোঁসাই এই টেবিলের দত্তকে বলে, “ শালা! এতদিন এই এলাকায় চাকরি করছো আর কিচ্ছুটি জানো না! ও নিজের নাম কী বলেছিল?” । “ ইসবুটুপ বিবি”, দত্ত গুয়া চিবাতে চিবাতে বলে। ইসবুটুপ বলে ওঠে, “ ইসবুটুপ হুর”। গোঁসাই-এর মুখে পণ্ডিতি ঝিলিক দিচ্ছে। “দত্ত , বেশ্যার ইংরাজি কী?” । দত্ত’র চিবানো থামে, “ কল গার্ল? স্লাট?” । “আর?” গোঁসাই ভুরু নাচায়। “ হোর”, দত্তর চোখ জুড়ে জিজ্ঞাসা।

“দাও , একখান সিগারেট দাও তোমারে গল্প শুনাই”, দত্তের দিকে হাত বাড়ায় গোঁসাই। “এই অঞ্চলের নদী আর বনের মাঝের দোয়াবে বংশ পরম্পরার মুস্লা রেণ্ডিদের ‘হুর’ পদবি হয় হে”, দাঁতে আটকানো মাংসের ছিবড়া বার করে আরাম পায় এই অফিসের সবচেয়ে সিনিয়র ক্লার্ক। এই অঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাসের উপর চারখানা বই আছে তার। অথচ এই অফিসে সেই কারণে কোনো আলাদা খাতির তার জোটে না। আজ সুযোগ এসেছে সে কে তা বোঝাবার। আরেকটা মাংসের টুকরো দাঁতে আটকে আছে; সেটা নিয়ে ব্যস্ত হতে হতে গোঁসাই বলে, “এরা ছিল সব ১৮৬৫ এর পর ইংরাজদের ফূর্তি। কাঁহাতক চা-বাগানের গোর্খা আর মদেশীয় ‘ছুকড়িদের’ নিয়ে খুশি হবে? তাছাড়া ‘ছুকড়ি’রা সবাই চা-বাগানে কোম্পানির বেতন পাওয়া বেশ্যা, তাদেরকে করতে করতে ‘ব্লাডি হোর’ বললে নিজের বেতনটাকেও বেশ্যাবৃত্তি ঠেকে। তাই ইংরাজ বাবুদের জন্য চাটগাঁ থেকে ঔরঙজেবের আমলে ভেগে আসা মোছলমান রেণ্ডিদের রেডি রাখত চা-বাবুরা। সুজার হারেম থেকে ভেগেছিল সব। এদেরই পুতিটুতিকে ‘ব্লাডি মহামেডান হোর’ বলে করতে করতে সুখ নিত ইংরাজ। ব্যাস হোরেরা নিজেদের হুর ভেবে বসল গুদে ইংরাজদের বাড়া , জুতার বাড়ি, হিলহিলা চাবুক, থুতু, মুত সব নিতে নিতে”। মাংসের টুকরোটা দাঁত থেকে বেরিয়ে সোজা বাতাস কেটে ইসবুটুপের চোখের কোণে এসে আটকায়। “সেই পদবি নিয়ে এই শালিদের লজ্জা ছিল না , লোকলজ্জা পেল সরকার। এদের ‘হুর’ পদবি তুলে খাতুন, বেগম বানায়ে দিল। তা হুরের বেটির কাছে তুমি কিনা খুঁজছো বাপের ডকুমেন্ট!”, আর কোনো মাংসের টুকরো নাই দাঁতে, গোঁসাই আরাম বোধ করে। “ তাহলে একে কী জোগাড় করতে বলব, গোঁসাই’দা?”, দত্ত বিপন্ন হয়ে জিগায়। গোঁসাই সিগারেট ফুঁকতে বার হয় । সে গোঁসাইয়ের পিছন পিছন। আধা সিগারেট খেয়ে গোঁসাই বলে “ এই ইসবুটুপ! তুই যা। তোর কোনো চিন্তা নাই। ওই জমি তোর বাপের নামে করে দেব। শুধু কয়েকটা কথা শুনে রাখ। এখন বোরখা পরে, কলমা পরতে পরতে রেণ্ডিগিরি করিস। যদি কোনোদিন এখানে এন আর সি হয় আর এন আর সি’র পর মুস্লাদের তাড়ায়ে দিতে চাইলে শাঁখা-সিঁদুর পরা রেণ্ডি হয়ে যাস। মনে রাখবি , শাস্ত্রে আছে মাগীর কোনো জাত নাই। আমি বলছি মাগীর ধর্ম নাই , দেশও নাই। চুদতে দিলে সব মাগীই আপন, আর চুদতে না দিলে… এই কথাটা ভালো করে মাথায় গেঁথে নে”, গোঁসাই তাকে কদম তলায় একা রেখে অফিস ঘরে চলে যায়। সে গোঁসাইয়ের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব অবাক হয়ে কদম গাছটার দিকে তাকায় সে। নিচে কদম পড়ে আছে অনেক। থেঁতলে গেছে, কাদা মাখামাখি। নেশা লাগানো গন্ধ নাকে আসছে। তার অবাক হওয়া ধীরে ধীরে রাগে পরিণত হয়। প্রথম রাগ হয় আম্মার উপর। রাগ করতে গিয়ে মনে আসে আম্মা মরে গেছে অনেক দিন। তারপর রাগ ছুটে যায় গুয়া চিবানো সরকারি লোকজনের উপর। ভয়ের চোটে রাগ আসে না তেমন এদের উপর। রাগটা থেকে যায় । তা নিয়েই বাতাস কেটে কেটে সে এগোতে থাকে শিরিষ গাছওয়ালা মাজারের দিকে। সে বোঝে তার পা এখন শূন্যে।

মাজারের ধারের কবরখানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে। এখানে যে কেউ মাটি পায় না। মেঘ জমছে আকাশে। তুফানি বৃষ্টি হতে পারে হতে পারে এমন এক দুপুর আজ । শীতের ভোরে সে অনেকদিন আগে এসেছিল এখানে।চুপটি করে তাকিয়েছিল সদ্য মাটি দেওয়া একটা কবরের দিকে। একটু দূরে একটা হ্যালানো শিরিষ। চুপ করে সবকিছু দেখছিল সে। কাকরঙা বোরখার ফাঁক দিয়ে । তার আম্মাকে কবরের ভিতর শুইয়ে দিচ্ছে নীল রঙের বোরখা পড়া অনেকগুলান মেয়ে। কোনো মৌলভী নাই।নীল রঙের বোরখা পরে বেরোলে তার আম্মা অনেকদিন পর বাড়ি ফিরতো। সেই সকালেও বাড়ি ফিরে এসে সে দেখে তার আম্মা লাল শাক লাগাচ্ছে। অনেক বছর আগে, পাশের দোগাছির জঙ্গলে নাকি চাঁদের রাতে হুররা নামত, এই গল্প করছে শাকেদের সাথে ।কবরে শুয়ে থাকতে থাকতে মানুষের কী কী ইচ্ছা হতে পারে আম্মাকে জিগাতো সে। ভরা মেঘের দিকে তাকিয়ে আম্মা বলতো, “আসমান দেখা” । “ কবরের বাইরে যতদিন ছিল তখনও কি হেই একই আকাশ দেখে দেখে শখ মেটে নাই!! এখানে খালি ধূ- ধূ ক্ষেতি আর আকাশ , ব্যাস”, মাজারের ভিতরে জ্বলতে থাকা অনেক মোমের রঙের একটা আলোয় ভরছিল চারপাশ। মাজারের দিকে হাঁটা দিল সে। সে হাঁটছিল একটা জলার পাশ দিয়ে। খানিক পিছিয়ে তার আম্মা, অনেকদিনে আগের শীতের ভোরে কবরে চলে যাওয়া আম্মা। জলা থেকে বুড়বুড়ি কেটে উঠে আসছে কে যেন। দেখে তার মরে যাওয়া আম্মা সেই জল থেকে উঠে আসা তারই বয়সী এখন। তারই বয়সী তার আম্মা এখন তাকে আম্মা বলে ডাকছে। গোটা জলা জুড়ে বুড়বুড়ি কাটা শুরু হয়েছে। উঠে আসছে হরেক বয়সী আম্মারা, উঠে আসছে হরেক বয়সী মেয়েরা। হেলানো অশত্থের পাতারা মানুষের গলায় ফিসফিসাচ্ছে। তার আম্মা, তার আম্মার আম্মা, তার আম্মার আম্মার আম্মা সবাই জলের তলার গলায় তাকে ডাকছে, “ ইসবুটুপ! ইসবুটুপ! তুই হুর…”

এইসব দুপুরে মাজারে কারো ঢোকা মানা। এখন বকরঙা জ্বিন কিসসা শুনতে নামবে। সেজলা হুজুর জ্বিনকে গল্প শোনায় এইসব দুপুরে এই মাজারে। সেই জ্বিনের হাওয়া লাগলে বংশ লোপাট হয়। তাই কেউ এখানে আসে না এইসময়। এসব লাল ঠাণ্ডা মেঝে আর সাদা গম্বুজের সংসারে দুপুর এক জানলা বন্ধ অথচ পরতের পর পরত খুলতে থাকা ঘরের ভেতর সব ভিতর-ঘর নিয়ে আসে । মাজারের ঘুলঘুলি দিয়ে যেটুকু সামাজিক আলো আসার বাধ্যতা রয়ে যায় সেখানে সামাজিকতার চলাফেরা অনেকক্ষণ পরপর উল্টোনো মানুষের ছায়ার মত লাগে । সে আগে ভয় পেত খুব কখন সেজলা হুজুরের খিল দেওয়া দরজায় টোকা দিয়ে এই বুঝি কেউ ঢুকে পড়বে। জামির যদি ওল্লাউল্লি করে পাশের বাড়ির রুখসানাকে তার খোঁজে পাঠায় আবার! “আল্লাহ!”, সেজলা হুজুর থামে। জ্বিন চলে গেছে গল্প শুনে। সব মিটে গেলে প্রতিবারের মত হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেয় সেজলা হুজুর। টাকার নরমে ভরে উঠে ইসবুটুপের মন।

জামির ঘুমাচ্ছে। খেসারির ডাল নামিয়ে সাঁটির ভর্তা রসুন দিয়ে মাখছে সে। এই শেষ দুপুরে কালো করে আসছে চারদিক। হাতিয়ার বৃষ্টি নামবে এখনই। হাওয়া দিচ্ছে খুব। ঘোলা চোখ মেলে তাকাচ্ছে জামির। ঘোলা গলায় বলছে, “মাংসের জোগাড় হইবেক না আইজ? মাস তো পেরুতে চলল। মাজারে যাবা না? এনার্ছি বাবুরা কোন কগজ নিয়া যেতে বললো? সেজলা হুজুরের কাছে কিন্তু সময়মতো যাইয়ো”। রাগটা ফিরে আসে। সেজলা হুজুরের উপর রাগ।গোঁসাইয়ের উপর রাগ। জামিরের উপর রাগ। সবাই সবকিছু জানে। কেউ যেন কিছুই জানে না। সে চোখ রাখে জামিরের চোখে। মাংস খাওয়ার ইচ্ছে বড় প্রবল সেই চোখে।

তার চোখে ঝিল জাগছে। তার মেয়ের মেয়ের মেয়ের মেয়ে দেখতেছে ছ’ডা মেয়েছেলান আর চাইরডা ব্যাটাছেলান অই একফালি জমিটায় আগুন জ্বালায়ে নাচতেছে। গুদের জিভভা কেটে নেওয়ার লগে আঙটা গরম হইতেসে। বোঝে ফকসীর পাল্লায় পইড়ছে সে। তারে বাঁচতে হলে ভাগতে হবে। বন অনেক কাছের ঠেকে তার , মনে হয় বড়দাদির কোল। বাড়িকে মনে হয় অনেক দূরের । নিপুন বাতাস কেটে উড়ে যায় ইসবুটুপ হুর । হাতে হাঁসুয়া। হাঁসুয়ার কোপ নেমে আসছে জামিরের গলায়। ফিনকি মেরে রক্ত বেরিয়ে আসছে। এতদিনের নড়াতে না পারা শরীরটা নিয়ে কী তীব্র ভাবে ছটপট করছে জামির!

সে জানে এই মেঘে শিয়ালি বৃষ্টি হবে। ছটপটাতে থাকা সবকিছু নিশ্চল হবে খানিক পর। তখন বাদাড়ে ঢুকতে হবে হামাগুড়ি দিয়ে। বাদাড়ে খানিক দূর এগোলে শেয়ালের বিয়ের ঝুনুর শোনা যাবে। সে সময়ের রোদ চোখে ধরে নিয়ে আসবে সে। আজব সব বাখোয়াজি হবে। রামধনুর কিনার খুঁজে পাবে । তারা নাকে গেঁথে কাকরঙা রেশম পরে পুরা গ্রাম জুড়ে উড়ে বেড়াতে বেড়াতে আয়নায় মরে যাওয়া মানুষদের ছায়া নিয়ে কিসসা শুরু করবে সে। মাজারের কোণের শিরিষ গাছটা থেকে কিসসা শুনতে নেমে আসবে বকরঙা এক জ্বিন। আর এই সবকিছু মিললেই সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে।

Facebook Comments

Leave a Reply