মাগভেরুয়া : শুভ্র মৈত্র
রাগটা ক্রমশ গাঢ় হচ্ছে সিরাজের। সেই শেষ রাতের সেহরি মুখে দিয়েই হয়েছিল, যত বেলা বাড়ছে তত জমে ঘন হচ্ছে। গরম ভাতের সাথে একটা মরিচ চেয়েছিল। পায় নি। রাগ হচ্ছে নিজের উপর, আম্মি’র উপর। এই যে পাশে শুয়ে আছে, নেড়ি কুত্তাটা, ওটার উপর। মনে হচ্ছে, এক লাথ মেরে শালাকে হাঁকিয়ে দেয়। এই সকালবেলাতে এতো যে ঝিমানি কিসের! টাউনে দেখেছে, এই সকালবেলাও কুত্তাগুলি মারপিট করে খাওয়ার নিয়ে। এখানে সবসময় ঝিমায়। নিজেদের মধ্যে এলাকা দখলের মারপিটও নাই। পাশে যে এতো মানুষের কাঁইকিচির, তাতেও যেন কোনও ভ্রুক্ষেপ নাই।
আসলে সিরাজের সবচেয়ে বেশি রাগ আলিনুরের উপর। ওর বিবি। সেহরির আলু-চাল সব ওই সিদ্ধ করে। গরম ভাত, তার সাথে একটা লাল মরিচ…আহা। নাহ, শালী দিলে না। বলে, ‘রোজার টাইমে পেট ঠান্ডা রাখতে লাগে।‘ আর আম্মিও মাথা নাড়ে পাশে বসে। যেন আব্বুকে, সিরাজকে ভাতের সাথে লাল মরিচ ভেজে দিত না আম্মি! মরিচটা থালায় ডলে ডলে সবটা ভাত লাল হয়ে যেত। কী সুন্দর একটা গন্ধ। ঐ একটা ঝাল দিয়েই তো এক সানকি পান্তা উঠে যেত বাপ-ব্যাটার। এখন নাকি ঐ শালীর কথায় খেতে হবে। ও জানে কিছু কহিলেই শালী শুরু করবে, ঐ যে কার্তিক মাসে সিরাজের পেটে ব্যাথা হয়েছিল, টাউনের ডাক্তার দেখেছিল, ছবি তুলেছিল পেটের। আর তখনই নাকি কী কী সব কহ্যে ওর জিভের উপর রশি বেঁধে দিয়েছে। ধ্যুস।
আম্মি কিছু কহ্যে না, আসলে আম্মিকে ভালোই জাদু করেছে আলিনুর। বচ্ছর ঘুরতে চলল সাদির, এখনও যে কোল ভরল্য না বিবির, কই আম্মি তো কিছু কহ্যে না! আম্মি কী জানে, রাতে কাছে ভিড়তেই দেয় না বিবি। জোর করল্যে কহ্যে শরীল খারাপ। ব্যাটাছেলে মানুষের তো আর শরীল খারাপ হয় না!জোরও করেছে প্রথম প্রথম। দেখেছে আমগাছের মরা ডালটার মতো পড়ে থাকে, চোখ খোলা। ধুর। তারপর থেকে ও নিজেও এখন লক করে শুয়েই থাকে একপাশে। গাঁয়ের লোক তো তা বলে আর শুয়ে থাকে না। জয়নালের আম্মি তো সেদিন সিরাজকে কহ্যেই দিল, ‘কী রে সিরাজ, পোতার মুখ দেখব্যো না?’ —‘উঁ, কত্ত যেন পোতা-পুতি দেখার শখ, ঘরেই তো আছে, জয়নালের নিজেরই তো দুটা, সাথে ওর বহিনেরটাও তো ঐ বাড়িতেই থাকে, দ্যাখ না যত্ত খুশী।‘ আসলে ও জানে, কথাটা গ্রামের এই ধুলা-বালির সাথে উড়ছে। ও তো ব্যাটাছেলে, ওর তো আর দোষ নাই, দোষ ওর বিবির। এখনও কেউ মুখের উপর কহ্যেনি, কিন্ত হাওয়াটা তো টের পাওয়া যায়। এরপরে মুখের উপরেই বিবিকে বাঁজা কহ্যিবে, ওকে আরেকটা নিকাহ করার লিগ্যে শলা দিবে। জানে না সিরাজ! কিন্তু কাকে বুঝাবে, আলিনুর ঐ থ্যাবড়া নাকের পাটা ফুলিয়ে আগেই কহ্যে রেখেছে, ‘আরেকটা ঘর না তুল্যা, কাউকে এঠি আনা যাবে না।‘ শালী!
কিন্তু বিবির মুখের উপর কিছু কহত্যেও জি হয় না। রাগ হলেও গিলে নেয়। এই যে এখন প্রধানের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে, তা ঠিক দাঁড়িয়েও নেই, একটু ছায়া দেখে ধুলার উপর বসেই আছে, সেটাও তো বিবির বুদ্ধিতেই। রোজার মুখে টাইম ঠিক থাকে না। কতক্ষন আছে? সিরাজের মনে হচ্ছে যেন এক বেলা চলে গেল বসে বসে। আসলে হয়তো এক ঘন্টাও হয় নি, কিন্তু ঐ যে, রোজার মুখে টাইমের হিসাব থাকে না। ঘুম থেকে উঠিয়ে সেহরি দিয়েছিল বিবি। গরম ভাত, ডাল, আলু সিদ্ধ, সাথে ছোট মাছের ঝোলও ছিল বুঝি। কিন্তু ঐ যে, মরিচটা না পেয়ে রাগে আর স্বাদটাই পায় নি খাওয়ার। গপগপ করে গিলে কোনওমতে উঠে গেছিল। ফের ঘুমিয়ে পড়ে সিরাজ। ঘুম থেকে উঠলো যখন, দাওয়াতে ফকফক করছে রোদ। আলিনুরকে দেখে বোঝার উপায় নেই, আর শুয়েছিল কিনা। কিন্তু, নাহ, শুধায় নি, বরং দেখেই মনে পড়ে গেছিল ভোর রাতের মরিচ না দেওয়া। হনহন করে সিরাজ বেরিয়ে আসে বাড়ি থেকে। তারপর এই প্রধানের দাওয়ায় এসে ধর্নায় বসেছে। ধর্নাই তো! বাবু’র কখন বাহ্য পরিস্কার হবে, টাইম হবে আসার– সবাই বসে থাকো তার জন্য। চিৎকার করতে ইচ্ছা করে, ‘বাপের জমিদারি পেয়্যাছো? ভোট লিব্যার সময় মনে ছিল না? কতক্ষন ধরে বস্যে আছি সে খেয়াল আছে?’ ও শুধু একাই আছে নাকি! আরও তো কত্তজন। কারও ঘরের চাল দিতে হবে, কারও বিবি পোয়াতি হয়েছে, কেউ বা একশো দিনের কাজের টাকা পাবে। সবাই বসে, দাঁড়িয়ে আছে। কখন প্রধান সাহেব বাইরে আসবে, বসবে চেয়ারে। টেবিলের উপরে থাকবে ছোট যন্ত্রটা। মাঝে মাঝে ঐটা তুলে কহ্যিবে, ‘হ্যাঁ বিডিও সাহেব…’। এখনও আসেনি।
না, সিরাজ এখন অনেক সমঝে চলে। সব জায়গায় মুখ খুলতে নেই। পইপই করে কহ্যে দিয়েছে আলিনুর, ‘পরধানের দাওয়ায় দাঁড়ায় ফের বুলত্যে যেও না, হরিবোল ক্যানে পেলে ঘরের টাকা। অই কি তুমহারে ভোট দুটা বেশি দিহ্যাছে? থাক হরিবোলের পাকা ঘর, তুমার তাতে কী? লিজের টা বুঝ্যা লিবা, আম্মির ভাতা প্যালেই হল, আর সবাই যদি ঘর পায়, হামরা কী দোষ কর্যাছি?।‘ —নাহ, আলিনুরের বুদ্ধি আছে। স্বীকার করে সিরাজ। বিবির বুদ্ধি নিয়ে চলে লাভও হয়েছে ও তো নিজেই বোঝে। আগে আগে প্রধানের লোকের সাথে ঝুট ঝামেলা লেগেই থাকতো, আর সিরাজের দাওয়াতেও আসত না কিছুই। জি-আর বলো, ত্রিপল বলো, ঘরের টাকা—সব ঐ সামনের রাস্তা দিয়েই হেঁটে চলে যেত। মাটি কাটার কাজও পেত প্রধানের নিজের লোক, আর সিরাজ কে ঝুড়ি-কোদাল নিয়ে দাঁড়াতে হতো টাউনের রাস্তায়।
এখন আর চিৎকার করে না। আলিনুর কহ্যেছে। শুধু কি কহ্যেছে, নিজেই তো একদিন ঘোমটা টেনে প্রধানের দাওয়ায় গিয়ে কেঁদে এসেছে, সংসারের হালৎ বলে। খবরটা শুনে মাথায় খুন চেপে গেছিল। এতবড় সাহস! ঘরের বিবি হয়্যে অন্যের দুয়ারে, তাও ফের ঘরের কথা কহিছ্যে। টাউনের বাস থেকে নেমেই হনহন করে হাঁটা দিয়েছিল ঘরের দিকে। শিক্ষা দিতে হবে।
নাহ, সেদিনও বিবির গায়ে হাত তুলতে পারেনি সিরাজ। পারবে কি করে? ঘরে ঢুকে দেখে আম্মি’র ঐ শনের মতো চুলগুলান পিছনে টেনে টেনে বাঁধছে। আর দুজনার কী হাসি! রাগ আরও বেড়ে গেল। —-‘পরধানের দাওয়াতে গেছিলি?’ হুঙ্কারের মতোই শোনাচ্ছিল সিরাজের গলাটা। কিন্তু ওই পাড়ে তেমন হেলদোল দেখা গেল না। আলিনুর কিছু বলার আগেই আম্মি বলল, ‘গিছ্যে তো কী হয়্যাছে? হামিই কহ্যাছিলাম যাবার লেগ্যে।‘ যাঃশালা, মায়ের সাথে মিলে বিবিকে শিক্ষা দেবার প্রথম ছকটাই তো ভেস্তে গেল। আম্মি কহ্যেই চলেছে, ‘হামিদা’র ঘরে লতুন তিরপল ঢুকল, সাজ্যুরা লতুন ঘরের টাকা প্যেহ্যাছে। আমি কী চোখ মুন্দ্যে আছি? হামিই কহ্যিলাম বেটিকে, যা একবার পরধানের দাওয়ায় যা। কী ভুল কহ্যাছি?’ আম্মির মুখে ‘বেটি’ শুনে তো হাতের কোদালটাও রাখতে ভুলে গেছিল সিরাজ। এরমধ্যেই যে কখন আলিনুর উঠে চলে গেছে খেয়ালই করে নি। করলো, যখন ঠক করে মুড়ির বাটিটা নামিয়ে রাখলো সামনে, ঘোমটার নিচ থেকেই মিনমিন করল, ‘পানি রেখ্যাছি কলের পাড়ে, মুখ হাত ধুয়্যা নিলেই হয়।‘ তখনও ভাববাচ্যেই কথা সারতো শাশুড়ির সামনে। এরপর আর সবক শেখাবার কথা ভাবে নি সিরাজ।
আর এখন তো সব সময় বিবির বুদ্ধি নিয়েই চলে। সফিক, জয়নাল’রা যে সিরাজকে মাগভেরুয়া কহ্যে, সেটাও জানে। তবু আলিনুরকে অমান্য করার সাহস জুটাতে পারে না। ওর কথা শুনেই তো মাটি কাটার কাজটা জুটেছে, ব্যাঙ্কের বই হয়েছে, গেলবার বন্যার টাইমে তিরপল, চিঁড়ার সাথে দুধও পেয়েছিল। আর এই সব কথাগুলান মন্যের মধ্যে চিরিক দিলেই, মনটা নরম হয়ে যায়। নাহ, আজ আর নরম হচ্ছে না। বরং যখনই মনে পড়ছে ঐ না পাওয়া লাল মরিচটা’র কথা, রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছে। সিরাজ জানে ওর জীবনে এখন মরিচ নেই, নুন নেই, সব বিস্বাদ আলুনি। শরীরের ঝাল-নুন সব গেছে, জিভেও নেই।
এখন এসে চুপ করে বসে আছে। কুত্তাটা শুয়েই আছে এখনও। ঘুমাচ্ছে। ঘরে ঢোকার অনুমতি নাই কারও। ভিতর থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। হবে কোনও বই চলছে। তাও ভালো যে গান হচ্ছে, নইলে এখানে তো শুধু চিল্লামিল্লি। কতজন একেবারে পুরা সংসার নিয়ে এসেছে, বাচ্চা কাঁদছে, মা গাল পারছে, আর বেশিরভাগ এই রোদের তাপে ঝিমাচ্ছে সিরাজের মতো। টিভি সিরাজ লিজেও লিয়্যাছে ঘরে। সেও তো সেই আলিনুরের বুদ্ধিতেই হলো। ওর দিদির টাউনের শ্বশুরবাড়ির পাশে কোন মাষ্টার ভাড়া ছিল, চলে যাচ্ছে। টিভিটা বেচে দিয়ে যাবে। সব ব্যবস্থাই তো করলো আলিনুর। খানিক খ্যাঁচম্যাচ যে করেনি সিরাজ তা নয়, মেয়েমানুষের বুদ্ধিকে কী একবারে মানতে আছে ! কিন্তু ওই যে প্রথম কয়েকদিন শুধু, তারপর সবাই তো টিভিতে সেন্ধিয়ে গেল। এখন তো ও নিজেও সন্ধ্যায় ঘরে ঢুকে দেখে, ঐ দজ্জাল বৌটা কেমন শাশুড়িকে জ্বালাচ্ছে, কত্তটি গয়না পরে ঘুমায় বউ-বিবিরা বা সোজা-সরল মেয়েটাকে সবাই মিলে কীরকম সান্তাচ্ছে! হাঁ করে দেখে সিরাজ, মুখে কিছু কহ্যে না, কিন্তু মনে মনে মেনে নিয়েছে, ওর বিবির খুপরিতে দম আছে।
এমনিতে আলিনুর যে সফিক জয়নালদের বিবি’র চেয়ে আলাদা কিছু, তা কখনোই মনে হয় নি সিরাজের। গায়ের রঙ কালোর দিকেই, গ্রামের সব মেয়ের মতোই রোগা, নাকটা একটু থ্যাবড়া মতো। ইস্কুলে শাড়ি পড়ে যায়, বুকটা সবে একটু উঁচু হতে শুরু করেছে, এই সময়েই সব বাপ মেয়ের বিয়ের জন্য মরীয়া হয়, ওর বাপও হয়েছিল। বয়স আঠারো হয়েছিল কি হয়নি, কেউ জানে না, নিকাহ কবুল করার সময় ওর গলা শোনা যায় নি। কারই বা শোনা যায়! হাতে তো মেহেন্দি ছিল! তাতেই হবে। বাপ-মা ঘাড় থেকে নামালেই বাঁচে, তাছাড়া সিরাজ পাত্র হিসাবে খারাপ কী? লেবারের কাজ করে, নেশা ভাং নাই, তার চেয়েও বড় কথা বাড়িতে মা ছাড়া কেউ নাই। আলিনুরের জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্র পাবে নাকি ওর বাপ? তাই নিকাহ হয়ে গেছিল।
সাদির পর সবাই যেমন আশনাই করে বিবিকে নিয়ে সিরাজও করেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরার তাগাদা থাকতো। শুধু একটাই পার্থক্য, বেশি কথা কহ্যে না। অন্যের বিবিরা ঝগড়া করে, মার খায়, তারপর বাচ্চা বিয়ায়। কিন্তু আলিনুরের এখানেই সমস্যা। ঝগড়া করে না, আম্মির দেখাশুনা করে, সিরাজকেও দেখে, কিন্তু বেশী কথা না কহ্যেই। কিছু পুছ করল্যে হ্যাঁ বা না। মেরেছে সিরাজ, তেমন কোনও কারণ ছাড়াই মেরেছে, কিন্তু তাতেও খুব বেশি মুখ ফুটে নি আলিনুরের। যেন মার খাওয়াটাও ওর কামের ভিতরেই ছিল। এক্ষেত্রে যা হয়, খেস্তে গিয়ে থেমে যেত সিরাজ।
অবশ্য কথা কি একেবারেই কহ্যে না! আসতে আসতে মুখ তো ঠিকই খুলল। যখন জেনে গেল সিরাজের কাম না পাওয়ার কথা, টাউনের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কাহিনি, তখন তো মুখ খুলল। যেন হিসাবটা বুঝে নেওয়ার জন্যেই লক করে ছিল এতদিন। আর সিরাজও আগে যেমন হামলে পড়ত শরীলটার উপর, এখন কেমন থেমে যায় আগেই। সত্যি কথা কহত্যে কী, প্রধানের ঘরে যাওয়ার শলা, ওর নামে গালিগালাজ বন্ধ করার শলা, শেষমেশ নিজেই প্রধানের দাওয়ায় যাওয়া—-সব মিলিয়ে সিরাজ একটু ঘাবড়ে গেছে, ডর লাগে এখন বিবিকে । আজকাল বিছানায় ঢুকেও একপাশে শুয়ে থাকে। আর সকাল হলেই দাঁড়িয়ে থাকে ‘আজ কি কহ্যাছে দেখি। টাউনেই যাবো নাকি অঞ্চল অফিসে।‘ সব দিন যে বিবির কথায় কাজ হয় তা নয়, তবু ঐ যে, বিবিকে অমান্য করতে ডর লাগে। এই জন্যেই যে মাগভেরুয়া কহ্যে সবাই তাও তো জানে। কহব্যে না কেন? শালা’র একটা মরিচ…! উফ!আবার মনে পড়ে গেল। টাউন যাওয়া মানে কী শুধু কাম? আরও কত কিছু আছে। কাম না পেলে বই দেখা যায়, বিলাতির দোকানে ঢুঁ মারা যায়। তারপর ইয়ার দোস্ত মিলে যা কিছু ইনকাম সব ফুটিয়ে আসা যায়। পিঁয়াজ-রসুন দিয়ে মরিচ তেল দিয়ে ভেজে থালায় ঘসে ঘসে থালার ভাতটি লাল রঙ করে ফেলতে ইচ্ছা করে ওর। আহ! রাগ চড়চড় করে বাড়তে থাকে এ সব কথা মনের মধ্যে ভুরুক দিলে।
—‘কিরে সিরাজ?’ প্রধান বেরিয়ে এসেছে। লাল ভটভটি লিয়্যে পাশে এসে পাশে দাঁড়িয়েছে একটা ছোঁড়া। প্রধান সাহেব বাইরে যাবে, বিডিও অফিস, মিটিং আছে। সকাল থেকে যারা লাইন দিয়ে বসে আছে, সবাইকে হাঁকাতে লাগলো। সিরাজকেও হাঁকাতে এসেছিল, তখনই প্রধানের চোখে পরে গেল। সিরাজ উঠেই আসবে সবার মতো। প্রধানের ডাকে দাঁড়ালো একটুক। নেড়িটাও উঠেছে। সামনের পা দুটো লম্বা করে শরীরটা ঝুঁকিয়ে আড়মোড়া ভাঙছে এখন। এরপর গা ঝাড়বে। এতক্ষন রেস্ট ছিল যেন, এখন কাজে বেরাবার টাইম। রাগ হচ্ছে সিরাজের। নেড়িটার চাল দেখে, মনে লিছ্যে, এক লাথ লাগাই শালাকে। কিন্তু প্রধানও তো ওর পানেই চেহ্যা আছে। কী কহব্যে সিরাজ? কী কী ভেবে এসেছে সব গুলিয়ে গেল। হঠাৎ সবগুলো রাগ একসাথে জড়ো হয়ে… ‘হামাক বিবির থিক্যে ছাড়ান দে পরধান!’
সবাই এখন সিরাজকেই দেখছ্যে। প্রধান নিজেও। মন্ডল প্রধানের দাওয়ায় ঘরের সালিশী নতুন কিছু নয়। বাপ-ব্যাটা, বর-বউ –—এসব ঝামেলা মিটাতে হয় প্রধানকে। কিন্তু অঞ্চলের ঠিকা নিয়ে এইটুকু জেনে গেছে, এসব ক্ষেত্রে মত দিতে নাই। যা হবে, বিচারে হবে। আর মুসলমানের বর-বউয়ের ঝামেলা নিয়ে তো এখন সরকার ফের কীসব বিল আনছে। প্রধান জানে এখন বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হয় সিরাজদের, ‘ঠিক আছে, পরে না হয় দেখা যাবে, এখন ঘর যা দেখি।‘ মোটর সাইকেলে উঠতে লাগলো প্রধান। ভটভটি চলার সাথেই প্রধান চিৎকার করল, ‘একবার ব্যাঙ্কে যাস, অনেকের তো টাক্যা ঢুকেছ্যে।‘ শালা, হারামি, ওর কথাটাকে পাত্তাই দিল না, এখন কহ্যাছে ব্যাঙ্কে যেতে! ব্যাঙ্কে কী সিরাজ যায়, ওঠি তো ঐ শালীই ঢুঁ মারে। কয় ক্লাস পড়ালিখা করেছে কি করেনি, মাগী ব্যাঙ্কে যায়!
বাড়ির দিকে হাঁটা দেয় সিরাজ, শালা সারাটা সকাল এখানে বসে বসে নষ্ট হলো। আরও রাগ বাড়ে বিবি’র উপর। বাড়িতে ঢুকেও তো সেই বসে থাকা, নাহলে টিভি দেখা। কখন নামাজ শুনা যাবে, কখন পেটে কিছু পড়বে। অবশ্য তখনও তো খেতে লাগবে ওই শালীর হাতেই। শশা, মুড়ি—যা দিবে! ঝাল-নুন কিচ্ছু না। শালা, এর চেয়ে টাউনে গেলে কতো ভালো হতো! সব ওই ছুঁড়ির জন্য। নাঃ, এবার একটা কিছু করতেই হবে! বসুক বিচার!
বিকালের দাঁতন- পানি, তারপর ফল, মুড়ি। আলিনুরই সব ব্যবস্থা করে। করবে না তো কী? মিয়াছেল্যের কাম করবে না? রোজার টাইমে প্রথম দু একদিনের পর খিদাও কম্যে যায়। রাতে খাওয়ার পরই বিছানা টানে। বিড়িটায় শেষ টান দিয়েই শুতে গেল সিরাজ। বিবির আসতে দেরি আছে। আর এলেই বা কী! চোখ বন্ধ করে সিরাজ। কাল ঠিক টাউন যাবো, আর কিছু না হোক, ঐ শালীকে তো সারাদিন দেখতে হবে না!
ঘুম তখনও আসে নি, ঝিমুনি। তখনই গায়ে খোঁচা লাগে। ধড়পড় করে উঠে বসতে যায় সিরাজ, দেখে বিবি এসেছে। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে কেমন একটা হাসি লেগে আছে মুখে। ‘এত্ত নিদ ক্যেনে? শুল্যো কি শুল্যো না, নিদ।‘ সিরাজের উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না। সরে আসে বিছানার এক কোনে। কহ্যে না, চেতন থেকে লাভ কী ? শরীলকে তো ঘুম পারিয়েই রাখত্যে হয়।
–‘শুনো না’ আলিনুরের গলা। গলাটা একটু অন্য রকম লাগছ্যে। সিরাজের কথা বেরায় না। শুধু চেতন আছে বুঝাবার জন্য আওয়াজ করে, ‘উঁ….’।
— কহছি, ব্যাংকে গেছিনু। টাকা ঢুক্যাছে। পুরা আশি হাজার। পর়ধানকে ভাগ দিয়্যাও থাকব্যে মেলাটি। এবার ঘরটা তুলবা না? শুনো না, একটা ছাদ লাগবে কিন্তু…..আরো কী কী সব বিড়বিড় করছ্যে বিবি। সিরাজের ঘুম ছুটে গেছে। আশি হাজার? কত্তটি একশো’র নম্বরি!
—এদিকে আসো না জী, দ্যাখো বুকের ভিতরটা কেমন ধকধক কৈরছ্যে—- বলে, নিজেই হাতটা টেনে নিল সিরাজের। হঠাতেও পারলো না সিরাজ। গলাটা আরো ঘন হয়েছে আলিনুরের, সিরাজের নাকে আসছে ওই লাল ভাজা মরিচের গন্ধটা, সাদির পর প্রথম প্রথম যেটা পেত। ‘এখন এত দূরে দূরে ঘুমাও ক্যানে?’ সিরাজ ওই গন্ধটায় ডুবে যেতে যেতে শুধু বলতে পারল, ‘তুই তো কহ্যাচিস…’. আলিনুর সিরাজের মুখটা নিজের বুকের ভিতর গুঁজে দিতে দিতে বলছে, ‘শালা, মা গ ভে রু য়া…’
Posted in: January 2021 - Cover Story, STORY