কাশবনের ভাস্কর্য : শুভংকর গুহ
“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।
৬
কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না। যেখানে যাচ্ছি, যা কিছু করছি তার মধ্যে পানাগড়ের কাশবন বসে ছবি হয়ে যাচ্ছে। মা বলতেন,- যাও তো নিরঞ্জনের মুদির দোকান থেকে নুন নিয়ে এসো, সাথে তেজপাতা। আমার মুদির দোকান খুব ভালো লাগত, সেখানে সন্ধক লবণের গন্ধ আমাকে তৃপ্তি দিত। দাঁড়িপাল্লার কাঁটা দেখে নোখের টোকায় জিনিসকে সঠিক মাপে আনার মধ্যে অদ্ভুত এক অর্থ খুঁজে পেতাম।
মা বলতেন,- বেশি দেরি কোরো না, অন্য পথে যেও না। সোজা দোকানে যাবে আর আসবে। কারও সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন নেই। আমরা নতুন এসেছি, কে কোনজন ভালো কি খারাপ কিছুই জানি না।
এই অন্যপথের অর্থ বলতে, মুদির দোকানে যাচ্ছি বলে, অন্য কোথাও আর কি। কারণ বাড়ির অনুমতি না নিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার অনুমোদন যে একেবারেই ছিল না। তাই এদিক সেদিক যাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সাহসে কুলোত না।
নিরঞ্জন কাকু? যার দোকানে যাই সেই কাকু?
কে জানে?
মা তাঁর উত্তরকে, কেমন অনিশ্চয়তার মধ্যে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন।
অনেক অনেক বছর পরে মাক্সিম গোর্কির লেখায় সেই উত্তর পেয়ে গেছিলাম, – “মানুষ স্বভাবতই ভালো, পরিবেশ এবং পরিস্থিতি মানুষকে ভালো খারাপ করে তোলে”।
একেবারেই নতুন শহর, চারদিকে কলমের নিবের মতো দেশলাইয়ের বাক্সের মতো বাড়িঘর। আর বাড়ি ঘরগুলির মধ্যে আলোর প্রাচুর্য নেই। স্যাঁতস্যাঁতে। গায়ে গা লেগে থাকা বাড়িগুলিকে দেখলে আমার দমবন্ধ হয়ে আসত। কোনোকিছুই করতে ভালো লাগত না। আমার খালি মনে পড়ত পানাগড়ের কোয়ার্টারের সেই থামে বসে থাকতাম, সেখানে এখন কেউ না কেউ নতুন অতিথি এসেছে। যারা আমার সমস্ত জায়গা দখল করে নিয়েছে।
মাধবীলতার মাচার নিচে আমার কল্পনার শহর এখন কেমন আছে, না কি কোয়ার্টারের নতুন অতিথি এসে ভেঙ্গে দিয়েছে। প্লাস্টিকের চৌকো বাক্স, দেশলাইয়ের খোল, কাঠের টুকরো দিয়ে বানানো সেতু এইসব কিছু আর হয়তো নেই। আর সেই ঘর যেখানে তক্তপোষের ওপরে শুয়ে থাকতাম, নতুন ফ্লেক্স কোম্পানির জুতোর বাক্স, সেই সব কিছুর সাথে রেললাইনের ওপরে পড়ে থাকা ভাঙ্গা ওয়াগনটি চলে গেছে পানাগড় ছেড়ে বহুদূরে। ক্যাপ্টেন ব্রজেন মিশ্রাজির চলে যাওয়ার কথা ছিল। না এখনও আছেন আর বিকেলের দিকে নিজের কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে এ্যাকোরডিয়ান বাজিয়ে চলেছেন। এখানে ফিরে এসে প্রায়ই মাকে আমি মনে করিয়ে দিতাম ক্যাপ্টেন ব্রজেন মিশ্রার কথা, মা তখন কেমন কুঁকড়ে সুই দিয়ে ফ্রেমের মধ্যে পাখি রঙ্গিন সুতো দিয়ে একজোড়া টিয়া পাখি আঁকতেন।
বুঝতে পারতাম, আর সবার পানাগড়ের জন্য কতটা কষ্ট হচ্ছে কি না, তবে মা যে পানাগড়ের স্মৃতিতে অনেকটাই বেলা শেসের রোদের মতো হেলে গেছিলেন, সেইটি বুঝতে আমার অসুবিধা হত না। আমি একদিন মাকে বলেছিলাম, আমরা কি আর কোনোদিনই পানাগড়ে ফিরে যাব না? বাবাকেও বলেছিলাম একই কথা, বাবা শুনে হাসলেন, তারপরে বললেন, – সবটাই কর্তাদের ইচ্ছা। কর্তা মানে ওপরওয়ালাদের ইচ্ছা। একবার এক জায়গা থেকে বদলি হয়ে গেলে আবার যে সে একই স্থানে ফিরে যায় না, এমন নয়। কিন্তু ফিরে গেলেও একই কোয়ার্টার থাকা ভাগ্যে নাও বা জুটতে পারে।
তবে বাবা জানিয়েছিলেন, এখানে তো আমি কয়েক মাসের জন্য এলাম। ইস্টার্ন কমান্ড পুনরায় বদলির অর্ডার দিলেই আমাকে চলে যেতে হবে। এরপরে আমরা চলে যাব সেন্ট্রাল কমান্ডে। এখানে আমাকে নিয়েই আসা হয়েছে কিছু কাজ বুঝে নেওয়ার জন্য, তারপরে আমাকে সেন্ট্রাল কমান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। বাবা যা বললেন, আমার বুঝতে একেবারেই অসুবিধা হল না, আমরা এখানে সাময়িক এসেছি।
কাজেই যে সব জিনিস প্যাক করে আনা হয়েছিল, সেই সবের অনেক কিছুই তেমনিই আছে, মা যদিও কয়েকবার বলেছিলেন, কিন্তু বাবা বলেছিলেন, যে সব প্রয়োজনীয় জিনিস খুব বেশি দরকারি নয়, তেমনিই প্যাক করা থাকুক, ঘরেও জায়গা নেই। খুব প্রয়োজনীয় যা সেইগুলিই হাতের কাছে রাখো। বাকিগুলি এখন খুলতে হবে না। বাবার কথা শুনে আমার ভীষণ আনন্দ হয়েছিল। এই জায়গাটি আমার মোটেই ভালো লাগছিল না।
সেই জীবনে প্রথম শহরের দুর্গাপূজা দেখলাম, চারদিকে বেশ আলো ঝলমল করছে, রাস্তঘাটে কত মানুষ। কত দোকানপাট, মেলার মতো। হারমোনিয়ামের মতো দেখতে বাক্স নিয়ে চলে এসেছে বায়স্কোপওয়ালা। ফুঁকোর ভিতরে চোখ রাখলে গানের সঙ্গে কি সুন্দর ছবি ভেসে উঠত। এখনও মনে আছে সেই গান,- দো হন্সো কা জোড়া বিছর গয়োঁ রে…আর… যে বাড়িতে ছিলাম তার পিছনে ছিল হোগলাবন। পাশে একটি জংলা মাঠ। সেই মাঠে দেখলাম সারি সারি কাশফুল ফুটে আছে। লম্বা। ঠিক যেন দোয়াতে রাখা কলমের মতো। আর কাশফুল দেখলেই, চারদিকে বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ শোনা যায়। যদি কোথাও বাতাস না থাকে কাশফুল যেখানে ফুটে উঠেছে, সেখানে বাতাস থাকবেই। এ বড়ই অদ্ভুত।
বর্ষাকাল চলে যাওয়ার পরে মনে হয় গোটা বিশ্বের উঠোন পরিষ্কার হয়ে গেছে, তার মধ্যে উৎসব, আলো, নতুন জুতো জামাকাপড় সব কিছু নিয়ে মেতে উঠলাম, এখন আর সবসময় মনে পড়ে না পানাগড়ের কথা। কিন্তু মনে পড়ার রেশটি যেন নিজে থেকেই তফাৎ গড়ে নিচ্ছে। কখনো কখনো মনে পড়লেও আগে যেমন কষ্ট হত, এখন আর হয় না।
এখানকার জীবনের সঙ্গে, পল্লীমঙ্গল সমিতির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রদের সঙ্গে বেশ জমে গেল সখ্য। স্কেল পেনসিল খাতা বই বিদ্যালয়ের গেটের সামনে ছোটো ছোটো কালো কুলের আচার আর ছাতা মাথায় দিয়ে হেডস্যারের আসা যাওয়া বান্ধবীদের নোখের রঙ নিজের নোখে লাগিয়ে, প্রতিযগিতায় নামা,- কে প্রথমে নিজের আঙ্গুলের ডগায় ব্লেডের কোণ দিয়ে খুঁচিয়ে রক্ত বার করতে পারবে? সেই খেলায় আমিই প্রথম সবসময়, তারপরে থিন এ্যারারুট বিস্কুট মুখে নিয়ে তার সঙ্গে বাতাসা ফেললেই মুখের ভিতর সোনপাপড়ির স্বাদে ভরে উঠত যেন।
জীবন অন্যরকম হয়ে উঠতে থাকল। চারদিকে দেখতাম, কেমন ধূতি শার্ট পড়ে আছেন বাবুগোছের মানুষজন, প্যান্ট বা ট্রাউজার পড়ে আছেন যেমনটি দেখতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম, যেমন বাবাকে ও বেসক্যাম্পে দেখতাম সবাইকে, বাবা যেমন পোশাক পড়েন, তেমন ঠিক নয়, চারদিকের পোশাক পড়ে মানুষজনকে দেখার স্বাদ পাল্টে দিল যেন।
বাবা ভোররাত্রে চলে যেতেন কাজে। ফিরে আসতেন বিকেল তিনটে চারটের সময়। খুব ক্লান্ত থাকতেন। আহার ও বিশ্রাম করে মায়ের সঙ্গে যেতেন দোকান বাজারে। একদিন বাবা মাকে বললেন, হেস্টিংসে কোয়ার্টার আছে, আমরা কি সেখানে চলে যেতে পারি?
মা বললেন,- কি হবে গিয়ে? আবার তো চলে যেতে হবে? তুমিই তো বলছিলে, তোমাকে সেন্ট্রাল কমান্ডে পাঠানো হবে। এখানে সব আত্মীয়স্বজন আছে। কোয়ার্টারে একা একা আর ভালো লাগে না। তা ছাড়া ওরা স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে, পুজো চলে গেল, বছরও ফুরিয়ে আসছে, আর সংসার নিয়ে টানাটানি কোরো না। নতুন জায়গায় সব গুছিয়ে নিতে অনেক পরিশ্রম।
ভোরে উঠতে হয় বলে, বাবা তাতে অনেক তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তেন। আমরা ঘুমিয়ে থাকতাম বলে, বাবার কাজে যাওয়া নিয়মিত চোখে পড়ত না। এখানে এসে বাবার সঙ্গে একদিন রেল স্টেশনে গেছিলাম। আর গেছিলাম শিয়ালদহ স্টেশনে। বাবাই নিয়ে গেছিলেন। খুবই আশ্চর্য লাগত কলকাতাকে শিয়ালদহ না বলে কলকাতা কেন বলা হত? কোথায় যাচ্ছেন? সবাই বলতেন কলকাতায় যাচ্ছি। কেউ বলেন না শিয়ালদহতে যাচ্ছি। অনেক পরে আমাকে একজন সম্মানীয় ইতিহাসের মাস্টারমশাই জানিয়েছিলেন, শিয়ালদহ যেখানে অশ্বত্থ গাছের ছায়ার নিচে বসে জোব চার্নক তামাক খেতেন। সেটি ছিল শিয়ালডিহি গ্রাম। তখন চারধারে জলাভূমি, কিছু কিছু দ্বীপের মতো জেগে থাকা জমি, আর যে অশ্বত্থ গাছটির কথা বলা হল, সেখানে জব চার্নক ও অনেক সাহেবই আসতেন বিকেলের দিকে গল্পগুজবের জন্য। সেইজন্য স্থানটির নাম হয় বৈঠকখানা। এই বৈঠকখানা ছিল শিয়ালডিহি গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। আজকে যা বৈঠকখানা বাজার নামে পরিচিত।
তখন কয়লার ইঞ্জিন ছিল। দেশভাগের আগে, যে ট্রেনটি অধুনা বাংলাদেশ থেকে আসত, সেই ট্রেনটিকে বলা হত, পাকিস্তানের ট্রেন। এখনও সেই কথা ভাবলে দেশভাগ ও দাঙ্গার সব চিরায়ত কাহিনি ও সাহিত্য বিশেষ ভাবে স্মরণে আসে। এই অবকাশে, শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক সত্যপ্রিয় ঘোষের ‘স্বপ্নের ফেরিওয়ালা’ প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকো’ ও অতীন বন্দপাধ্যায়ের ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’ এই তিনটি উপন্যাসের উল্লেখ না করে পারছি না। পূর্ববঙ্গে নিজের গ্রাম ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত গলগণ্ডা গ্রামের স্মৃতি ও মায়ের টাঙ্গাইল শহরের নতুন উকিলপাড়ার স্মৃতি বাবা মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। যদিও আমার জন্ম চিত্তরঞ্জন হাসপাতালে। সেই সময় আমাদের পরিবার থাকত বালিগঞ্জে। সেখান থেকেই বাবা বদলি হয়ে যান রাঁচি ক্যান্টনমেন্টে, তারপরে সেখান থেকে পানাগড়ে। রাঁচির স্মৃতি আমার মনে নেই। ছেলেবেলার স্মৃতি বলতে পানাগড় থেকেই আমার মনে আছে। পানাগড় থেকে ফিরে, একদিন রেল স্টেশনে দাঁড়িয়ে বাবাকে বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিলাম, স্টেশনের নাম ‘বেলঘড়িয়া’ কেন? বাবা বলেছিলেন, গ্রামটির নাম বেলঘর ছিল বলেই ক্রমে ক্রমে মানুষের উচ্চারণে ভদ্রস্ত হয়ে, ‘বেলঘড়িয়া’ উচ্চারিত হয়। তাই এখন বেলঘড়িয়া।
বাবা সৈনিক বাহিনীতে চাকরি করতেন, বলে, আমাদের পরিচিত যারা ছিলেন, আমাদের পরিবারকে অন্য নজরে দেখতেন। বাবাও খুব বেশি কথা বলতেন না। তিনি সবসময় আমাদের জন্য উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু আমরা বিশেষ করে আমি তাঁর সেই স্বপ্নকে সফল করতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। বিদ্যালয়ের স্তরের পড়াশুনোকে আমি সবসময় ভাবতাম, এ এক বেরাগের খেয়াল, যার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তবুও প্রাথমিক স্তরে আমার পরীক্ষার ফল ভালো হল, সব বিভাগ মিলিয়ে নিজের শ্রেণিতে দ্বিতীয় হলাম, প্রধান শিক্ষক পুরস্কার দিলেন, একটি বাঁধানো খাতা, কাঠের বার্ণিশ করা একটি স্কেল, পেনসিল রাবার। কি আনন্দ। বাড়িতে এনে মাকে দেখালাম। মা জড়িয়ে ধরলেন। আমি মায়ের শরীরে মুখ লুকিয়ে শাড়ির ঢেউয়ের গন্ধ নিলাম। মায়ের শাড়ি থেকে চমৎকার পাঁচ ফোড়নের গন্ধ নাক জুড়িয়ে দিল।
জীবনে অনেক বড় বড় ঘটনা আমার মনে নেই। কিন্তু ছোটো ছোটো ঘটনা, বিশেষ করে যে সব ঘটনাগুলির মধ্যে নিসর্গ খুঁজে পেতাম, সেই সব ঘটনাগুলিই আমার স্মৃতিতে কি ভাবে উকি দিয়ে যায়, বুঝতে পারি নি। কাশবন পুকুর জলাশয় রাস্তা বাড়িঘর আশেপাশে মানুষজন এই সমস্ত কিছু নিয়েই আমাদের নিসর্গ, স্মৃতিও একপ্রকার নিসর্গ, যার অভ্যন্তরে অতীতের এক ভূমিকা আছে। আর আমরা যেন এক অতি ক্ষুদ্র অস্তিত্ব সাঁতার কেটে চলেছি, সময় প্রবাহর সাথে।
দেখতে দেখতে শীতকাল এসে গেল। পানাগড়ের হাড় কাঁপানো শীতের কথা মনে আছে। কিন্তু এখানকার শীতের মধ্যে শুকনো কনকনে একদম নেই। কুয়াসা পড়লে জলের মতো জলজ এক পরিবেশ, খুব সকালে পুকুর পাড়ে দাঁড়ালে পুকুর বা জলাশয় থেকে ধুয়ো উঠতে দেখা যেত। পানাগড়ে তা দেখি নি। কিন্তু সকালে শীত একেবারে কামড়ে ধরে। বাবা বলতেন, এখানকার শহরতলীর শীত এমনই। একটু বেলা হলে, পাঠ্য বইয়ে যেমন দেখতাম, কালি কলমে আঁকা অনেকটা বিমূর্ত ভুতের ছবি, তেমনিই মানুষগুলি উদলা শরীরে মাটির হাঁড়িতে খেজুরের রস ফেরি করতে আসত। একে একে আসত আশেপাশের অঞ্চল থেকে। বাবা আমাদের সাবধান করে বলতেন,- একদম নয়, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। আর কাঁপুনি ধরবে। কিন্তু একদিন গোপনে খেজুরের রস গলা দিয়ে নামিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম, কি চমৎকার স্বাদ আর গন্ধ। খেজুরের রস গলা দিয়ে নামালে না কি শরীর ঠাণ্ডায় হু হু করে ওঠে। টের পেয়েছিলাম, কথাটি মিথ্যে নয়। যুবক অবস্থায় সমুদ্রের সৈকতে দাঁড়িয়ে খেজুরের রস খাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা আমার আজও মনে আছে।
এই শীতে ভোর অন্ধকারে বাবা চলে যেতেন কাজে। আমাদের তখন মনে হত মধ্যরাত্রি। পুজো চলে যাওয়ার পরেই শীতের তোরজোড় শুরু হয়ে যেত। কালীপুজোতে একেবারে শীতকাল। মায়ের উলের কাঁটা ব্যস্ত হয়ে উঠত। মা বলতেন,- একটু এখানে এসে, পিঠ দিয়ে দাঁড়াও তো। মায়ের সামনে দাঁড়াতাম। মা শাসনের স্বরে বলতেন, দম চেপে থাকবে না। স্বাভাবিক দাঁড়াও। কি করব, যেহেতু মা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের ওপরে শাসন চালাতেন, দম যে নিজের থেকেই বন্ধ হয়ে আসত।
বাবার বদলির অর্ডার হয়ে গেল, মথুরা ক্যান্টনমেন্ট এরিয়াতে। জানতে পারলাম, সরস্বতী পুজোর আগের দিন রাত্রে। এখানে থেকে একপ্রকার অভ্যাস হয়ে আসছিল, মানিয়ে নিয়েছিলাম বেশ এখানে। সহপাঠীদের সঙ্গে সখ্য গভীর হয়ে উঠছিল। কিন্তু এখানকার ছন্দেও আবার, অন্য বার্তা এল। সরস্বতী পুজোর দিন আবার মন খারাপ হয়ে উঠল।
বিদ্যালয়ে গেলাম, অঞ্জলি দিলাম, পাত পেতে খাওয়ার আনন্দ যে কতখানি, সেই প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম। সহপাঠীদের বললাম, আমাদের চলে যেতে হবে বহুদূরের দেশে। বিদ্যালয় থেকে বাড়িতে ফেরার পথে দেখলাম আকাশে মাছির মতো ছেয়ে আছে শত শত ঘুড়ি, বেশ তো নাম জেনেছিলাম, পেটকাট্টি, মুখপোড়া, ময়ূরপঙ্খী, মোম, শতরঞ্চি, দোভাঁজ, চাপরাশ, বল, লাট্টু কত কি !! সব বিচিত্র নাম। মাইকে বেজে চলেছে, সেই গানের শব্দ কানের ভিতরে ডানা মেলে আজও ক্রেংকার তোলে, – ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’… অভি না জায়োঁ ছোড় কর কে দিল অভি ভরা নহী…তুমি যে আমার…সেই ছেলেবেলার স্মৃতি কেন জানি এই প্রবীণ বয়সেও ঘুড়ির উড়ানের সাথে আজও সংগীতমুখর করে রেখেছে। অনেক বছর পরে আমার স্মৃতির সঙ্গে আরও একটি চমৎকার গান জুড়ে দিয়েছিলাম… কি মিষ্টি দেখো মিষ্টি কি মিষ্টি এ সকাল… সেই বয়সে যেমন জনপ্রিয় গানগুলি আমাদের তোলপাড় করে তুলত, আমি তাই উল্লেখ করলাম। যা সত্য শ্রবণস্মৃতি তাই… মাইকে শুনে শুনে গান যেন মনের আনন্দের শরিক হয়ে উঠল। ঘরে তখনও আমাদের রেডিও আসে নি। এসেছিল বহু বছর পরে, একটি মারফি রেডিও। বেশ মনে আছে খুব কম বাড়িতেই সেই সময়ে রেডিওর সন্ধান পেতাম। দেখেছি কারও না কারও বাড়িতে যে বাড়িতে রেডিও আছে, বয়োজ্যেষ্ঠরা সেই বাড়িতে কান পেতে খবর শুনতেন আর পল্লীমঙ্গলের আসর।
নিজের লেখাকে কৃত্তিম অভিজাত করে তুললাম না, কারণ ছেলেবেলার গান শোনার স্মৃতির উল্লেখ করলেই রবীন্দ্রনাথের গান উল্লেখ করা যেন অভিজাত রীতি। রবীন্দ্রসংগীত আমার দুঃখ বিষণ্ণ রাতের এক মহাসঙ্গী, কিন্তু তা বুঝে উঠতে আমাকে অনেকটা সময় পেড়িয়ে আসতে হয়েছিল। কারণ রবীন্দ্রনাথের গানের কথার দর্শন উপলব্ধি করতে গেলে, জীবনের অনেকটা অভিজ্ঞতা পাড় হয়ে আসতে হয়। বোধ ও মস্তিষ্কেরও মাইল কিলোমিটার আছে।
রবীন্দ্রনাথের সেই গান আজও আমার জীবনে মন্ত্র হয়ে আছে…’এসো গো জ্বেল্বে দিয়ে যাও প্রদীপখানি বিজন ঘরের কোণে, নামিল শ্রাবণ সন্ধ্যা’… এই গান আজও আমি কল্পনায় প্রেমিককে নিবেদন করি। প্রতিটি মানুষের কল্পনার প্রেমিক বা প্রেমিকা বাস্তবে হয় না। আমারও তা হয় নি। বুঝতে অনেক দেরি হয়ে গেল যে,… জীবনের সম্পূর্ণ উঠোন প্রায় পাড় হয়ে এলাম। বেশ কিছু গল্প লেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ব্যক্তিগত স্তরে প্রেম হল এক আদর্শের মতো যাকে ছোঁয়া যায় না, স্পর্শ করা যায় না। কিন্তু প্রেমের গল্প যে কলমে আসে না, তবুও কয়েকটি লেখার সামান্য চেষ্টা থেকে বলতে পারি, প্রেমের গল্প বলে কিছু হয় না। তবুও একজন না একজন থাকেন বাস্তবে বা কল্পনায় তাকে নিয়েই আখ্যানের প্রস্তুতি চলে। অনেক সম্মানীয় পাঠক আমার বেশ কয়েকটি গল্পকে তাঁরা প্রেমের গল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আমি বুঝেছি, মনের গভীর অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। মনের গভীর স্তর থেকে মৃদু আপত্তি থাকলেও, বুঝেছি যে কোনো মানুষের মনের গভীরে হাহাকার থাকে, সেই হাহাকারকে ব্যক্ত করার জন্য তুলি রঙ ও ক্যানভাস উপযুক্ত মাধ্যম। অক্ষর যাপনের মাধ্যমে তা কতদূর সম্ভব। ছবিতে আলো অন্ধকারের খেলাকে আমার মনে হয়েছে প্রমের সেরা অভিব্যক্তি। সেই কথা আমার বুঝতে একটি দীর্ঘতর জীবন যে ফুরিয়ে এল। অতএব দীর্ঘশ্বাসে এক গভীর আরাম, এই আরামের মধ্যে কোনো ধর্মীয় আচার নেই, ভক্তি আছে, আছে আলো অন্ধকার বাতাসের উষ্ণতা।
এক জায়গায় থেকে একটি পাড় গড়ে ওঠে, আবার সেই পাড় ভেঙ্গে যায়। জীবন প্রবাহ অন্যদিকে বাঁক নেয়। জীবন বারে বারে বাঁক নিয়েছে, আশ্রয় চেয়েছে এক মোহনার, কিন্তু যত কাছে গেছি মোহনা দূরে, বহুদূরে সরে গেছে। শুধু নদীদাগ পড়ে আছে, কুড়িয়ে নিতে গেলে অনেক অনেক বেশি বিদ্ধ হতে হয়।
Posted in: January 2021 - Serial, PROSE
পাঠকের হৃদয়ে হাজারো ঘন্টা টাঙানো থাকে। আপনার বেল স্টিকের এক টোকায় সবগুলো রিনরিনিয়ে উঠলো । প্রেম নিয়ে ছোট্ট ব্যখ্যা.. সুগভীর ।