রবীন্দ্রনৃত্য ভাবনাঃ প্রেক্ষিত ও চলন – সোমা দত্ত
চতুর্থ পর্ব
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রথম যুগঃ
১৯০৪ (১৩১০) সালে শীতের ছুটির শুরুতে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে ছিলেন শিলাইদহে,মাঝে পৌষ উৎসব শান্তিনিকেতনে কাটিয়ে এলেন কলকাতা।কলকাতায় মাঘোতসবে কবি ভাষণ দিলেন ‘মনুষ্যত্ব’ বিষয়ে, তারপর দিন সিটি কলেজে “ধর্মপ্রচার” প্রবন্ধ পাঠ করলেন।তখনো পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রমে তিনি যে আদর্শকে সফল করবেন বলে ভেবেছিলেন তারই ব্যাখ্যা করলেন এই প্রবন্ধে।এইখানে তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করব।“ব্রহ্ম মানুষের নিকট একমাত্র মনুষ্যত্বের মধ্যেই সর্বাপেক্ষা সত্যরূপ,প্রত্যক্ষরূপে বিরাজমান… উপাসনার দ্বারা আমরা ক্ষণে ক্ষণে ব্রহ্মকে স্পর্শ করতে পারি; কিন্তু ব্রহ্মকে লাভ করতে পারিনা।মানুষই মানুষের পক্ষে সর্বাপেক্ষা সমগ্রভাবে প্রত্যক্ষ- এবং সেই সর্বাপেক্ষা প্রত্যক্ষের মধ্যে ব্রহ্মেরই আবির্ভাবকে প্রত্যক্ষতম করিয়া জানা মানবজীবনের চরম চরিতার্থতা।“
পিতা দেবেন্দ্রনাথের প্রভাবেই হোক অথবা বেদ,উপনিষদ পাঠের ফলশ্রুতি, প্রাচীন বর্ণাশ্রম ও ব্রহ্মচর্যের আদর্শও গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল রবীন্দ্রনাথের মনে।ছেলেবেলা থেকেই কঠিন শ্রম ও নিয়মের দ্বারা, সংযম ও ধৈর্য-বীর্যের সাধনার দ্বারা সত্যভাবে সংসারের মধ্যেই ব্রহ্মের উপলব্ধির দ্বারা মানবজীবনকে সার্থক করতে পারা যাবে, এমনটা মনে করতেন তিনি।প্রাথমিকভাবে সেই আদর্শ মাথায় রেখেই শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম গড়ে তোলা।১৯০১ থেকে অল্প ছাত্র নিয়ে আশ্রম একরকম চলছিল, কোদাল চালিয়ে, ব্যবহারিক কাজের মধ্যে দিয়ে, গল্পচ্ছলে বিজ্ঞানশিক্ষার মধ্যে দিয়ে।
১৯০৪ সালে শীতের ছুটির পর বিদ্যালয় স্থানান্তরিত হল শিলাইদহে।এখানে মোহিতচন্দ্র সেন যোগ দিলেন বিদ্যালয়ের হেডমাষ্টার হিসেবে।এখানেই সন্তোষচন্দ্র,রথীন্দ্রনাথ,সন্তোষ মজুমদার ও সরোজ মজুমদার , এদের ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা দেওয়া হল।মোহিতচন্দ্র সেনের হাতেই শিলাইদহে বিদায়তনের রূপ ফুটে উঠল।এরপর আশ্রম বিদ্যালয় যখন আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে এল তখন তার সম্পূর্ণ দায়িত্বভার দিলেন মোহিতচন্দ্র সেনের ওপর।তিনি তার নিজস্ব আদর্শে বিদ্যালয়ের আকৃতি বাড়িয়ে তুললেন,সিলেবাসের চাপে কঠোর করে গড়ে তুলতে চাইলেন বিদ্যালয়টিকে। কিন্তু এত কর্মভার গ্রহণে ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠলেন এবং অসুস্থ হয়েও পড়লেন।সুস্থ হওয়ার পরও তিনি আর বিদ্যালয়ে ফিরলেন না।
প্রায় সাত আটমাসের ছন্নছাড়া অবস্থা কাটিয়ে ১৯০৫ এর গোড়ার দিকে বিদ্যালয় আবার অল্পসংখ্যক ছাত্র নিয়ে তার যাত্রা শুরু করল অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে। এইসময় রবীন্দ্রনাথ এসে বাসা বাঁধলেন দেহলি বাড়িতে।
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে গোড়ার সময় থেকেই গান ও নাটকের চর্চা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।সকলেই যে গায়ক হয়ে উঠবে তা নয়, সুর তাল ছন্দ, লয় জীবনে অনেকখানি মাধুর্যে ভরিয়ে দেবে তা তিনি নিশ্চিত ছিলেন।এ বালক কবির নরম্যাল স্কুলে নিয়ম করে ইংরাজী গান গেয়ে যাওয়া নয় যাতে খানিক কায়দা ও উন্নাসিক মানসিকতা তৈরি হওয়া ছাড়া মনের কোনো বিকাশ হয়না।বালক বয়সের সে তিক্ত অভিজ্ঞতা যে তিনি ভোলেননি তা তিনি নিজেই জানিয়েছেন বহুবার।শান্তিনিকেতনে তিনি সংগীতের আনন্দময় যাত্রা শুরু করেছিলেন। সংগীত চর্চায় যাতে কোনো ফাঁকি না পড়ে সে দিকে সর্বদা নজর থাকত তাঁর, এমনকি শান্তিনিকেতনে না থাকলেও চিঠিপত্রে বারবার এ বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন তিনি।
এর আগের অংশ শেষ করেছিলাম যে কথা দিয়ে, জীবনকে ভোগ নয় উপভোগ করে বাঁচার সমস্ত রকম আয়োজন একেবারে পাকা করছিলেন ধীরে ধীরে।এবার এর চলন কিরকম ছিল তাই দেখব আমরা।প্রথম যুগে নিয়মিত সংগীত চর্চার জন্য শিক্ষক নিয়োগ করার আর্থিক সংগতি ছিলনা, তাই রবীন্দ্রনাথ নিজেই আবাসিক বালকদের গান শেখাতেন।যখন তিনি শান্তিনিকেতনে অনুপস্থিত থাকতেন চিঠিপত্রে খোঁজ নিতেন গানের চর্চা সম্পর্কে,তখন অন্যান্য অধ্যাপকদের ওপর থাকত সে দায়িত্ব।একটু একটু করে নাটকের গানের সাথে নাচ ও পরিক্রমা শুরু করেছিলেন তিনি।
১৯০৭ সালে কবিপুত্র শমীন্দ্রনাথের স্বাভাবিক আনন্দ উদ্যোগে শান্তিনিকেতনে প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ঋতু উৎসব।শমীন্দ্রনাথ ও আরো দুই ছাত্র বসন্ত সাজে, তারা মাথায় ফুলের মুকুট পরে মঞ্চে এসেছিল।‘আদি কুটির’ হলঘরে ষ্টেজ করে অভিনীত হয়েছিল শান্তিনিকেতনের প্রথম ঋতু উৎসব।পরে রবীন্দ্রনাথ ‘বসন্তোৎসব’ নামকরণ করে এই উৎসব পুনরায় চালু করেন।২৩ শে নভেম্বর ১৯০৭ সালেই শমীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়।
১৯০৮(মুকুট ও শারদোৎসব)সালে “আমার নয়ন ভুলানো এলে” গানের সাথে নৃত্যের আভাষ পাওয়া যায় বালকদের উপস্থাপনায়। ১৯১১ সালে রবীন্দ্রনাথের ৫০ বছর পূর্তি উৎসবে রাজা নাটকের অভিনয় হয়।এই অভিনয়ে প্রায় প্রত্যেকটি ‘গীতাভিনয়ের সাথে নৃত্যব্যঞ্জনা’ জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি।‘গীতাভিনয়ে নৃত্যব্যঞ্জনা’ কথাটায় একটু নজর দেওয়া দরকার।বহু প্রাচীন সময় থেকেই নৃত্য, গীত বাদ্য অভিনয়ের সাথে ওতোপ্রোতভাবেই জড়িয়ে ছিল, যার প্রমান আমরা পাই ভরত নাট্যশাস্ত্রে।পরবর্তী সময়ে যা পৃথক পৃথক শিল্পরীতিতে পরিণত হয়েছে এবং নাচ সাধারণ ভদ্রসমাজে ব্রাত্য হয়ে পড়েছে।রবীন্দ্রনাথ নাচকে আবার একটু একটু করে অভিনয়ে যুক্ত করতে থাকলেন।
১৯০৯ এ ক্ষিতিমোহন সেন যোগদান করেন শান্তিনিকেতনে।এইবছর থেকেই শান্তিনিকেতনের উৎসবে বৈদিক মন্ত্র প্রচলনের সূত্রপাত হয়।ব্রহ্মচর্যে দীক্ষার কথা আগেই বলেছি, এবার শান্তিনিকেতনের উৎসবেও বৈদিক রীতির প্রচলন ঘটল, এর কতটা আংগিকগত আর কতটা আদর্শগত সে আলোচনায় পরে আসব।জ্যৈষ্ঠমাসে বিদ্যালয় খুললে বর্ষা উৎসবের প্রস্তুতি শুরু হয়।ক্ষিতিমোহন সেন ও বিধুশেখর ভট্টাচার্য বেদ প্রভৃতি গ্রন্থ ঘেঁটে বর্ষার উপযোগী শ্লোক ও স্তোস্ত্র সংগ্রহ করে ছাত্রদের দিয়ে আবৃত্তি করিয়েছিলেন।
সেসময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শিলাইদহে গ্রামসংস্কারের কাজে এবং তখনি তিনি পরবর্তী শারদোৎসবের কথা ভেবে গান রচনা করছিলেন বলে জানা যায়।শারদোৎসব রচনার সময় বালকদের জন্য নাটিকা রচনা করাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য।এরপর থেকে প্রতিবছর শারদোৎসব তিনি নতুন নতুনভাবে সাজিয়ে তুলেছেন।
১৯১১ সালে কবির পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘রাজা’ নাটকের অভিনয় হয়।রাজা নাটকের অভিনয়ে ছেলেদের মাঝে ঠাকুরদারূপী রবীন্দ্রনাথ নাচ করছেন এমন কথাও আমরা জানতে পাই।“ঘুর লেগেছে তাধিন তাধিন” গানটি নৃত্যের জন্যই রচিত হয়েছিল তা এর কথা থেকেই বুঝতে পারছি।“আজি দখিন দুয়ার খোলা” গানটির অভিনয়ে কবি এবং “আমার সোনার হরিণ চাই” গানটির সাথে দীনেন্দ্রনাথ নৃত্যের আভাষ জুড়ে দিয়েছিলেন।
১৯১২ সালে অচলায়তনে অপাংক্তেয় শোনপাংশুরা অভিনয়ের সময় পায়ে পায়ে নৃত্যছন্দ তৈরি করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিক্ষায়।১৯১৩-১৪ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রশ্রয়ে পিয়ারসন সাহেব পাশ্চাত্য ছাঁদের নাচ জুড়ে দিচ্ছেন অচলায়তনে।১৯১৬ সালে ‘ফাল্গুনী’ নাটকে কবি অভিনয় করছেন অন্ধ বাউলের ভূমিকায়।শান্তিনিকেতনের পরে ফাল্গুনী আবার অভিনীত হয় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, এবারে ‘বৈরাগ্য সাধন’ নামক আর একটি ছোট নাটিকা অভিনীত হয় একইসাথে। এখানে কবি অভিনয় করেছিলেন কবিশেখরের ভূমিকায়। কবিশেখরের ভূমিকায় অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ সকলকে অবাক করে দিয়েছিলেন।
এইভাবে প্রতি বছর তিনি একটু একটু করে এগিয়ে চলেছেন। ১৯১৫ এবং ১৯১৬ সালে ফাল্গুনী নাটকে অন্ধ বাউলের ভূমিকায় নাচ করছেন তিনি।
১৯১৯ শে শারদোৎসবে শান্তিনিকেতনের ছেলেদের দিয়ে সারি বেঁধে গানের তালে তালে পরিক্রমা করিয়েছিলেন মঞ্চে, দুটি গানের সাথে,আমার নয়ন ভুলানো এলে’আর ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ।এই পরিক্রমার একটা চেহারা আমরা এখনো দেখতে পাই বসন্ত উৎসবে ‘ওরে গৃহবাসী”গানটির সাথে পরিক্রমায়।
এরপর ১৯২৩ শে –বসন্ত নাটিকা ; এখানে অনেকগুলি গানের সাথে তার ভাব অনুযায়ী নাচ হয়েছিল। বসন্ত, বনভূমি আম্রকুঞ্জ, এই সব চরিত্রের সাজে ছেলেমেয়েরা মঞ্চে প্রবেশ করে হাতপা নেড়ে, যে যেভাবে পারে গানের ছন্দ মিলিয়ে নাচতে বলা হয়েছিল,কথার অর্থ প্রকাশ করতে হচ্ছে না এখানে। সেখানে সুর তাল ছন্দই প্রধান নাচের জন্য।নৃত্যের বিবর্তনের ইতিহাসের প্রথম যুগে যেমনটা আমরা দেখতে পাই।আজকের কথ্য ও লেখ্য ভাষা সৃষ্টির আগেই চিত্র, নাচ, নাট্য, মাইম, এগুলির জন্ম, ভাব প্রকাশের নানা মাধ্যম হিসেবেই তখন এসবের প্রয়োজনীয়তা শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠা অনেক পরের বিষয়।
তাল ও ছন্দ খুব স্বাভাবিক যেভাবে জীবনে আছে,নানান দৈনন্দিন কাজে আছে সেভাবেই ছিল তাদের ভাবের প্রকাশে, বানিয়ে তোলা ছিলনা যেমনটি এখন ঘটে শিল্পমাধ্যমে, সাজানো বিষয়,ঝকঝকে উপস্থাপনা। কবির কাছে মূল বিষয় ছিল নানাভাবে ছেলেমেয়েদের ভিতর জগতকে জাগিয়ে দেওয়া, নাড়িয়ে দেওয়া। সংস্কারের বাইরে গিয়ে যখন সে নিজেকে প্রকাশ করতে শিখবে, তখন সে নিজের জীবন-যাপনের গতি নিজেই ঠিক করে নিতে পারবে।চলাই তখন হবে মূলমন্ত্র।
এভাবে প্রথম পর্ব কাটল, শরীরকে তাল লয় ছন্দে প্রকাশ করার অনুশীলনে এবং রক্ষণশীলতা দূর করতে। এরপর এল নৃত্যশিক্ষা পর্ব।এই পর্বে যাওয়ার আগে একটু নজর রাখব শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে ছাত্রী হিসেবে মেয়েদের প্রবেশের বিষয়ে।
দেশ তথা বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ও রবীন্দ্রনাথঃ
১৯০৫ থেকে দেশের যে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা ও আন্দোলন সঙ্ঘঠিত হয়েছিল তাতে রবীন্দ্রনাথ কখনো সরাসরি আবার কখনো পরোক্ষে জড়িত ছিলেন,কখনোই সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে থাকতে পারেননি।১৯০৫ এ বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা হলে রাখি উৎসব পালন করছেন তিনি সকলকে সাথে মিলে।১৯০৪ সালে চৈতন্য লাইব্রেরীর উদ্যোগে ‘স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধ পাঠ করছেন।বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে যে বয়কট আন্দোলন শুরু হচ্ছে তার ফলে ব্রিটিশ সরকারের আঘাত নেমে আসছে সরাসরি ছাত্রসমাজের ওপর।রাজনৈতিক আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ বন্ধ করতে কার্লাইল সাহেব(তৎকালীন বাংলা গভর্নমেন্টের প্রধান সেক্রেটারি)সার্কুলার জারি করছেন।জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনের দাবী উঠছে কলকাতা ও সারা বাঙ্গলা জুড়ে।তার সূচনাপর্বেও বক্তব্য রাখছেন রবীন্দ্রনাথ।ডন সোসাইটির বৈঠকে তিনি স্পষ্টত বলছেন, আগামীতে সরকার এই সার্কুলার প্রত্যাহার করে নিলেও যেন জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।শিক্ষাকে স্বাধীন করতে জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন জরুরী। আবার ব্রিটিশের ছাঁচে বিদ্যালয় গড়ে তাকেই জাতীয় বিদ্যালয়ের তকমা দেওয়াকেও তিনি সমর্থন করছেননা।এই সভায় উপস্থিত ছিলেন হীরেন্দ্রনাথ,মোহিতচন্দ্র,ব্রহ্মবান্ধব প্রমুখরা। ।ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় এবং রবীন্দ্রনাথ, এক বহু বিতর্কিত সম্বন্ধ, যা নিয়ে বিশেষ আলোচনাও হতে পারেনি মূলত তথ্যের অভাবে।
১৯০৬ সালেই মুসলিম লীগ গঠিত হচ্ছে, অপরদিকে জাতীয় কংগ্রেসে হিন্দুত্ববাদীদের প্রভাব বাড়ছে। হিন্দু জাতিয়তাবাদকে কেন্দ্র করেই স্বাধিনতা আন্দোলনকে পরিচালিত করার চেষ্টা হচ্ছে।১৯১৫ সালে অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা গঠিত হবে যার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মদন মোহন মালব্য, জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট (৩বার মনোনীত)।
১৯০৬ সালে ‘গোরা’ উপন্যাস লিখছেন রবীন্দ্রনাথ প্রবাসী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে।গোরা চরিত্র অনেকটাই ব্রহ্মবান্ধবের চরিত্রের কাছাকাছি বলে মত প্রকাশ করেছেন বহু বিশেষজ্ঞ। সেই গোরা চরিত্রকে তিনি অবশেষে কট্টর হিন্দুত্ববাদী অবস্থান থেকে সরিয়ে আনছেন।গোরা বলছে, “আপনি আমাকে সেই দেবতারই মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান ব্রাহ্ম সকলেরই- যার মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে কোনো ব্যক্তির কাছে, কোনোদিন অবরুদ্ধ হয়না- যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।“
দ্বন্দ্ব,চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ।একদিকে মহর্ষির উপনিষদ ও বৈদিক শিক্ষা আবার আরেকদিকে তাঁর নিজস্ব অর্জিত জ্ঞান বিজ্ঞান, যুক্তিবোধ,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বোধ।এই দুয়ের দ্বন্দ্ব চলছে নিরন্তর।
শান্তিনিকেতনে বালিকা বিদ্যালয়ঃ
১৯০৮পূজার ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর দুই মেয়ে মীরা ও বেলা এবং আরো একটি বাল্যবিধবা বালিকা লাবণ্যরেখাকে নিয়ে শিলাইদহে বাস করছিলেন।এইসময়েই তাঁর মধ্যম জামাতা সত্যেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়। নিজের মেয়ের মৃত্যুর পর আর একটি বালিকা, ছবির সাথে তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে তার বিবাহ দিয়েছিলেন।পরিবারে তখন আরো একটি বাল্য বিধবা প্রতিমা রয়েছে(গগনেন্দ্রনাথের ভাগ্নী বিনয়িনীর কন্যা)।এতগুলি বাল্যবিবাহ কবি নিজে দিয়েছেন এবং আরো কত বিবাহের সাক্ষী তিনি।এই বাল্যবিধবাদের জীবন ও ভবিষ্যত নিয়ে যারপরনায় ভাবিত তিনি।
সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোয় মেয়েদের অবস্থান কি, তা নিশ্চিত অজানা ছিলনা তাঁর।সে চিত্র তিনি নিজেও এঁকেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে।আবার ব্রাহ্মধর্মের মেয়েদের যে স্বতন্ত্র অবস্থান খুব ধীরে হলেও গড়ে উঠেছে, যে ছবি তিনি আঁকছেন গোরা উপন্যাসে সুচরিতা ও অন্যান্য নারী চরিত্রে,শিক্ষিতা, রুচিশীল, ব্যক্তিত্বময়ী তা কোনোভাবেই তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের কাঠামোতে পড়তেই পারেনা। তবে তিনি কি করছেন?এতগুলি বাল্যবিধবা বালিকা তাদের প্রতি কি ন্যায় করছেন তিনি?অন্তঃপুরের অন্ধকারেই কি কাটবে তবে এদের জীবন?বাইরের আলো,মুক্ত বাতাস কি তবে কোনোদিন প্রবেশ করবেনা এদের জীবনে?
১৯০৯ এর নতুন সেশনে শান্তিনিকেতনে ‘বালিকা বিদ্যালয়’ গড়ে ওঠে।রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে লিখছেন, আগে বহুবার এ ভাবনা এলেও তিনি তাকে রূপ দিতে ভয় পেয়েছেন।এবার এতগুলি মেয়েকে তিনি ফেলতে পারলেন না।ভগিনী নিবেদিতা কলকাতায় নারীশিক্ষার জন্য স্কুল স্থাপন করেন ১৮৯৮ সালে।নারীশিক্ষার জন্য নিবেদিতা নিরন্তর প্রচেষ্টা করে চলেছেন। নিবেদিতা, রবীন্দ্রনা্থ, জগদীশ বোস, ওকাকুরা প্রমুখের সখ্যতা সর্বজনবিদিত।
বালিকা বিদ্যালয়ের প্রথম কয়েকজন ছাত্রী ছিলেন লাবণ্যরেখা,মোহিত সেনের দুটি বালিকা কন্যা, অরুনেন্দ্রনাথের কন্যা সাগরিকা,ঢাকার প্রসন্ন কুমার সেনের দুই কন্যা হিরণবালা ও ইন্দুলেখা,গয়ার তারকনাথ রায় ও শ্রীশচন্দ্রের দুই কন্যা প্রতিভা ও সুধা ও মধুসূদন সেনের কন্যা হেমলতা।কিন্তু বছর দু’য়েকের মধ্যে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়।
‘গোরা’ উপন্যাসে পরেশবাবুকে অনেক অংশে তাঁর দ্বন্দ্ব তিনি দিয়েছেন বলে মনে হয়।বিরোধ শুধু বাইরে নয় তার অন্তরেও উপস্থিত।কঠিন সময়ে যিনি ধ্যানমগ্ন হন,কখন সুচরিতাকে সংগে নেন কখনো একা।দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে যে নতুন ভাব ভাবনা উঠে আসবে তার জন্য তো নিজের কাছে একাকী বসা প্রয়োজন।ধ্যান শেষে তিনি সুচরিতা ও গোরার পাশেই দাঁড়াচ্ছেন। গোরা তাঁর কাছেই আসছে ‘ভারতবর্ষের দেবতার মন্ত্র নিতে’।হিন্দু ব্রাহ্ম বৌদ্ধ,খৃষ্টান মুসলমান এভাবে যত খন্ডিত হতে থাকবে মানুষ,তত ভাগে আসলে ভেংগে যাবে দেশ সমাজ, ভারতবর্ষ।রাজনৈতিক নেতার রাষ্ট্র ও শাষনব্যবস্থা নিয়ে ভাবিত,সমাজ সংস্কারকরা সমাজের হিতসাধনে ব্রতী,শুধু মুষ্টিমেয় ভাবুকের দল মনে করেন মানুষের জীবনকে এভাবে খন্ড খন্ড করে দেখা যায় না।রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই শেষোক্ত দলে পড়েন।তাই তাঁর মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে নিরন্তর।
তিনি শুধু হিন্দুত্ববাদী নেতা নন,তিনি যে এতগুলি বাল্যবিধবার পিতা,পিতা সমান।তিনি বৌঠাকুরানীর আদরের কিশোর দেবরটি।তিনি সেই কিশোরটিও যে, বিলাত যাওয়ার আগে বোম্বাইয়ের আনা তরখড়ের কাছে ইংরাজী বলা ও আদব কায়দায় পারদর্শী হতে থাকেন।তিনি সেই মানুষটিও যে বিলাতে নাচের সভায় সঙ্গিনীর সাথে গ্যালপ নাচছেন।তিনি কবি, তিনি সৌন্দর্যের পূজারী।
“নারীকে আপনভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার, হে বিধাতা” যখন তিনি লিখছেন, নিশ্চিত জানেন যে, বিধাতা এই অধিকার হরণ করেননি,হরণ করেছে মানুষ ধার্মিকতার নামে।তাই ধর্মের চেয়ে ধার্মিকতাকে বড় করতে পারছেননা যেমন তেমনি মানুষের চেয়েও ধর্মকে উচ্চস্থান দিতে পারছেননা।তাঁর কাছে ব্রহ্মের সবচেয়ে প্রত্যক্ষরূপ মানুষের মধ্যেই প্রকাশিত।‘মানুষের ধর্ম’ যখন তিনি লিখছেন তখন মানুষকেই সবার উপরে স্থান দিচ্ছেন।
“…আমার বুদ্ধি মানববুদ্ধি, আমার হৃদয় মানবহৃদয়, আমার কল্পনা মানবকল্পনা।তাকে যতই মার্জনা করি,শোধন করি,তা মানবচিত্ত কখনোই ছাড়াতে পারেনা।আমরা যাকে বিজ্ঞান বলি তা মানববুদ্ধিতে প্রমাণিত বিজ্ঞান, আমরা যাকে ব্রহ্মানন্দ বলি তাও মানভের চৈতন্যে প্রকাশিত আনন্দ।এই বুদ্ধিতে, এই আনন্দে যাকে উপলব্ধি করি তিনিভূমা কিন্তু মানবিক ভূমা।তাঁর বাইরে অন্যকিছু থাকা বা না থাকা মানুষের পক্ষে সমান। মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি ,তবে মানুষ হলুম কেন।“
Posted in: ARTICLE, January 2021 - Serial