বিটকয়েন : সহস্রলোচন শর্মা
বিটকয়েন : পর্ব ৪
বিটকয়েনের বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য পরিবেশনই করা হয় নি এখনও পর্যন্ত। সেই সব তথ্যর মধ্যে তিনটে বিশেষ তথ্য পেশ করা যাক। সেই তিন বিশেষ তথ্য হলো- ১) সাতোশি নাকামোতো ঠিক করে দিয়েছেন পৃথিবীতে ২ কোটি ১০ লক্ষের (21 million) বেশি বিটকয়েন বাজারে ছাড়া হবে না। ২) প্রতি ২,১০,০০০টা ব্লক তৈরি হওয়ার পর মাইনিং রেট বা পুরস্কার মূল্য অর্ধেক করে দেওয়া হবে। ৩) ৩রা জানুয়ারি ২০০৯ সালে যেদিন প্রথম বিটকয়েন বিনিময় হয়েছিল তখন মাইনিং রেট বা পুরস্কারের পরিমাণ ছিল ব্লকপ্রতি ৫০ বিটকয়েন। এবার এই তথ্য গুলোকে নিয়ে একটু আলোচনা বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যাক।
প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, কেন সীমিত সংখ্যক বিটকয়েনের কথা বলেছেন নাকামোতো? নাকামোতো নিজে অবশ্য এই প্রশ্নের কোনও ব্যাখ্যা দেন নি। তবে তাঁর কর্মপন্থাকে বিশ্লেষণ করে অন্যান্য গবেষকরা একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন বটে। তাঁরা বলছেন, টাকা বা ডলার বা অন্যান্য ফিয়াট কারেন্সি (হুকমি মুদ্রা[৭]) সর্বদাই সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের অধীনে পরিচালিত হয়, অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে ‘সেন্ট্রালাইজ পাওয়ার’ বলা হয়। সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক প্রয়োজন মনে করলে নতুন টাকা ছাপাতে পারেন বা প্রচলিত টাকাকে বাতিল বলে ঘোষণা করতে পারেন, ঠিক যে ভাবে ২০১৬ সালে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল বলে ঘোষণা করেছিলেন মোদী সরকার। যেহেতু ফিয়াট কারেন্সি বা টাকার ক্ষেত্রে একটা কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে সমস্ত দায়িত্ব থাকে তাই নোট ছাপানো বা বাতিল করাটা অনেকটাই তাদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। অর্থনীতির চাহিদা-যোগানের তত্ত্ব অনুযায়ী, বাজারে যে কোনও পণ্যর যোগান বেশি হলে তার দাম কমে যায়। টাকা বেশি ছাপালে টাকার মূল্য কমে যায়। তাই অধিক পরিমাণে টাকা ছাপানো যায় না। অর্থনীতির এই তত্ত্ব মেনেই ক্রিপ্টো দুনিয়ায় বিটকয়েনের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছেন নাকামোতো। এতে বিটকয়েনের দৈনিক দর কিছু উপর নিচ করলেও মোটের উপর বিটকয়েনের দর কমবে না উল্টে বাড়বে। উদাহরণ হিসেবে সোনার কথাই ধরা যাক। পৃথিবীতে সীমিত পরিমাণে সোনা রয়েছে। সোনার ক্ষয় নেই। তাই সোনাকেই মাপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সীমিত সোনা এবং টাকার ইছামতো যোগান বা বাতিলের তত্ত্ব মাথায় রেখেই বিটকয়েন যোগানের ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিয়েছেন নাকামোতো। তবে এই সমস্ত ব্যাখ্যাতে খুশি নন বহু অর্থনীতিবিদ। বিটকয়েন সংখ্যার ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দেওয়ার সার্থকতা নিয়ে সন্দিহান তাঁরা।
অনেকেই প্রশ্ন করেন বিটকয়েনের সংখ্যাটা ২ কোটি ১০ লক্ষেই কেন স্থির করলেন নাকামোতো? সংখ্যাটা তার বেশি বা কম করলেন না কেন? এই সংখ্যার বিশেষ কোনও তাৎপর্য আছে কি? যথারীতি এই প্রশ্নেরও কোন ব্যাখ্যা দেন নি নাকামোতো। তবে ক্রিপ্টোকারেন্সির গবেষকরা এই প্রশ্নের একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা অবশ্য তৈরি করেছেন। উপরোক্ত দ্বিতীয় ও তৃতীয় তথ্য সংক্রান্ত আলোচনায় তার সন্ধান পাওয়া যবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তথ্য দু’টো এক সাথে আলোচনা করা প্রয়োজন। ৩রা জানুয়ারি ২০০৯, প্রথম যেদিন বিটকয়েন বিনিময় হয় সেই দিন থেকে ব্লক প্রতি ৫০ বিটকয়েন মাইনিং রেট কার্যকর করা হয়। নাকামোতো বলেছেন বিটকয়েনের এই মাইনিং রেট ততদিন পর্যন্তই জারি থাকবে যতদিন না পর্যন্ত মোট ব্লক সংখ্যা ২,১০,০০০ পৌঁছচ্ছে। ২,১০,০০১ নাম্বার ব্লক থেকে বিটকয়েনের মাইনিং রেট অর্ধেক করে দেওয়া হবে। এই নিয়ম অনুযায়ী সেই দিন থেকে নতুন মাইনিং রেট হবে ২৫ বিটকয়েন/ব্লক। ২৮শে নভেম্বর ২০১২ সালে ব্লক সংখ্যা পৌঁছয় ২,১০,০০০ ধার্য মাত্রায়। ওইদিন থেকে চালু হয় মাইনিঙের নতুন হার, ২৫ বিটকয়েন/ব্লক। নাকামোতোর শর্ত মোতাবেক, মাইনিঙের এই নতুন হার ততদিন পর্যন্তই বহাল থাকবে যতদিন না পর্যন্ত আরও ২,১০,০০০টা নতুন ব্লক যুক্ত হচ্ছে সে চেইনে। ব্লকচেইনে আরও ২,১০,০০০টা নতুন ব্লক যুক্ত হলে মাইনিং রেট আবার অর্ধেক করে দেওয়া হবে। ৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে আরও ২,১০,০০০ নতুন ব্লক যুক্ত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ হয়। ওইদিন থেকে মাইনিঙের নতুন হার কার্যকারী হয়। এবার নতুন মাইনিং রেট দাঁড়ায় ১২.৫ বিটকয়েন/ব্লক। ১১ই মে ২০২০ সালে ফের পূর্ণ হয় ২,১০,০০০ নতুন ব্লকের লক্ষ্যমাত্রা। ওইদিন থেকে, মানে বর্তমানে বিটকয়েন মাইনিং রেট হলো ৬.২৫ বিটকয়েন/ব্লক। এই তথ্যগুলোয় নজর রাখলে বোঝা যায়, মাইনিঙের নতুন হার চালু হতে গড়ে ৪ বছর মতো সময় লাগছে। বিষয়টা জটিল কোনও গণনা নয়। আমরা আগেই জেনেছি, একটা নতুন ব্লক যুক্ত হতে সময় লাগে ১০ মিনিট মতো। ঘন্টায় ৬টা নতুন ব্লক আর দিনে ৬×২৪টা বা ১৪৪টা নতুন ব্লক যুক্ত হয়ে চলেছে। তাহলে বছরে ৩৬৫×১৪৪ বা ৫২,৫৬০টা নতুন ব্লক তৈরি হয়ে চলছে। সুতরাং ২,১০,০০০ ব্লকের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে সময় লাগবে ২,১০,০০০/৫২,৫৬০ = ৩.৯৯৫৪ বছর বা প্রায় ৪ বছর। সেই হিসেবে, ২০২৪ সালের প্রথম দিকেই নতুন মাইনিং রেট হবে ৩.১২৫ বিটকয়েন/ব্লক। ২০২৮ সালের শুরুতেই নতুন মাইনিং রেট হবে ১.৫৬২৫ বিটকয়েন/ব্লক। আরও ৪ বছর পর মাইনিং রেট আবার অর্ধেক হয়ে যাবে। এই ভাবেই ক্রমেই কমতে থাকবে পুরস্কার বাবদ প্রাপ্য বিটকয়েনের সংখ্যা। একটা সোনার খনি থেকে ক্রমাগত সোনা তুলতে থাকলে যে ভাবে খনিতে সোনার পরিমাণ কমতে থাকে, ঠিক সেই ভাবে বিটকয়েনের খনি থেকে যত বিটকয়েন উঠবে ততই কমতে থাকবে নতুন বিটকয়েন পাওয়ার সম্ভাবনা। খনি থেকে সোনা তোলার সাথে বিটকয়েন সংখ্যার সাদৃশ্য দেখেই ‘মাইনিং’ বা ‘মাইনার’ কথা গুলো চালু হয়েছে ক্রিপ্টো দুনিয়ায়।
এবার আরেকটু গণিতে প্রবেশ করা যাক। একদম প্রথমে মাইনিং রেট ছিল ব্লক পিছু ৫০ বিটকয়েন। এই হার প্রযোজ্য ছিল প্রথম ২,১০,০০০ ব্লকের জন্য। হিসাব অনুযায়ী সেই প্রথম পর্যায়ে মোট খরচা হয়েছে ২,১০,০০০×৫০ বিটকয়েন। দ্বিতীয় পর্যায়ের ২,১০,০০০ ব্লকের মাইনিং রেট ছিল ব্লক প্রতি ২৫ বিটকয়েন। সেই অনুযায়ী শুধুমাত্র দ্বিতীয় পর্যায়ে খরচা হয়েছে ২,১০,০০০×২৫ বিটকয়েন। একই ভাবে শুধুমাত্র তৃতীয়, চতুর্থ ও পরবর্তী পর্যায়ের মোট বিটকয়েন খরচের হিসাব পেয়ে যাবো আমরা। প্রতি পর্যায়ের মোট খরচ গুলো যোগ করে পাই-
২,১০,০০০×৫০ + ২,১০,০০০×২৫ + ২,১০,০০০×১২.৫ + ২,১০,০০০×৬.২৫ + ২,১০,০০০×৩.১২৫ + ২,১০,০০০×১.৫৬২৫ + …
= ২,১০,০০০×(৫০ + ২৫ + ১২.৫ + ৬.২৫ + ৩.১২৫ + ১.৫৬২৫ + … )
প্রথম বন্ধনীর ভিতরে অবস্থিত শ্রেণীকে গণিতের ভাষায় অসীম গুণোত্তর শ্রেণী বলা হয়। এক্ষেত্রে, শ্রেণীর প্রথম পদ ৫০ এবং সাধারণ অনুপাত ½. অসীম গুণোত্তর শ্রেণীর যোগফলের সূত্র প্রয়োগে পাই-
২,১০,০০০×(৫০ + ২৫ + ১২.৫ + ৬.২৫ + ৩.১২৫ + ১.৫৬২৫ + …)
= ২,১০,০০০×[৫০/(১-½)] = ২,১০,০০০×(৫০×২) = ২,১০,০০০×১০০
= ২,১০,০০,০০০ বা ২ কোটি ১০ লক্ষ।
আর ঠিক এই ২ কোটি ১০ লক্ষ বিটকয়েনই বাজার ছাড়ার লক্ষ্যমাত্র ধার্য করেছেন নাকামোতো। এই গণিত থেকে এটা স্পষ্ট যে কেন ২ কোটি ১০ লক্ষ সংখ্যাটাকে বেছে ছিলেন নাকামোতো। তবে প্রথম পর্যায়ের নতুন ব্লকের পুরস্কার মূল্য ৫০ বিটকয়েন কেন ধার্য করেছিলেন তা অবশ্য জানা যায় নি।
এবার আরেকটা হিসাব দেখা যাক। ১১ই মে ২০২০ সালে তৃতীয় বারের জন্য ২,১০,০০০ লক্ষ্য মাত্রা স্পর্শ করেছে বিটকয়েন। এখন আমরা জানতে চাই, ঠিক ওইদিন পর্যন্ত, পুরস্কার হিসেবে কটা বিটকয়েন খরচা হয়ে গেছে। হিসেব বলছে ওইদিন পর্যন্ত মোট ২,১০,০০০×(৫০ + ২৫ + ১২.৫) = ১,৮৩,৭৫,০০০ (১ কোটি ৮৩ লক্ষ ৭৫ হাজার) বিটকয়েন ইতিমধ্যেই খরচা হয়ে গেছে। ১১ই মে’র পর থেকে আজ পর্যন্ত আরও কিছু দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে। যার অর্থ, তারপরও খরচা হয়ে চলেছে আরও কিছু বিটকয়েন। আমরা দেখেছি প্রতিদিন ১৪৪টা নতুন ব্লক সংযোজন হয়ে চলেছে। আমরা এও জেনেছি, বর্তমান মাইনিং রেট হলো ৬.২৫ বিটকয়েন/ব্লক। ১৪৪টা ব্লকের জন্য দৈনিক ১৪৪×৬.২৫ বিটকয়েন বা ৯০০টা বিটকয়েন খরচা হয়ে চলেছে। এবার ১১ই মে থেকে ৩১শে ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত আরও ২৩৫ দিন অতিবাহিত হয়ে গেলো। এই ২৩৫ দিনে, ২৩৫×৯০০ বা ২,১১,৫০০ বিটকয়েন খরচা হয়েছে। অর্থাৎ, শুরুর প্রথম দিন থেকে ৩১ই ডিসেম্বর ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট খরচা হলো ১,৮৩,৭৫,০০০ + ২,১১,৫০০ বিটকয়েন বা ১,৮৫,৮৬,৫০০ (১ কোটি ৮৫ লক্ষ ৮৬ হাজার ৫ শ’) বিটকয়েন। তাহলে হাতে পড়ে রইল ক’টা কয়েন? হাতে রইল (২,১০,০০,০০০ – ১,৮৫,৮৬,৫০০) বিটকয়েন বা ২৪,১৩,৫০০ (২৪ লক্ষ ১৩ হাজার ৫ শ’) বিটকয়েন। এই ২৪ লক্ষ বিটকয়েনের ফান্ড থেকেই আগামী ৩ বছর ধরে প্রতিদিন ৯০০ বিটকয়েন খরচা হয়ে চলবে। ২০২৪ সাল নাগাদ, ফের পুরস্কার মূল্য অর্ধেক হয়ে ৩.১২৫ বিটকয়েনে দাঁড়াবে। তখনও দৈনিক ১৪৪টা নতুন ব্লক যুক্ত হয়ে চলবে। তবে তার জন্য দৈনিক ব্যয় হবে ১৪৪×৩.১২৫ বিটকয়েন বা ৪৫০ বিটকয়েন। তার ৪ বছর পর পুরস্কার মূল্য আবার অর্ধেক করে দেওয়া হবে। তখন দৈনিক বিটকয়েনের খরচের পরমাণ হবে ২২৫ বিটকয়েন। এইভাবে ততক্ষণই পুরস্কার প্রদানের প্রথা চালু থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত বিটকয়েনের ভাঁড়ার শূন্যে পরিণত হচ্ছে। হিসাব বলছে, ২০৪৫ সাল নাগাদ বিটকয়েনের ভাঁড়ার শূন্যে পরিণত হবে।
বিটকয়েনের ভাঁড়ার শূন্য! অর্থাৎ, মাইনিং করলেও তখন আর কোনও পুরস্কার পাবেন না কেউই! তাহলে কি বন্ধ হয়ে যাবে মাইনিং? না মাইনিং বন্ধ হবে না কখনই। কারণ মাইনিং ছাড়াও মাইনারদের আয়ের আরেক উৎস হলো ট্রান্সাকশন ফি। কেবলমাত্র মাইনাররাই পেয়ে থাকেন এই ট্রান্সাকশন ফি। পুরস্কার বন্ধ হলেও ট্রান্সাকশন ফি বন্ধ হবে না কোনও দিনই। আশা করা যায়, যতদিন যাবে বিটকয়েন ট্রান্সাকশন তত বেড়ে চলবে। ফলে মাইনারদের আয় কিছুটা কমলেও বড় একটা ক্ষতি হবে না। পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০৪৫ সাল নাগাদ, ১ বিটকয়েন মূল্য দাঁড়াবে ৩,৫০,০০০ ডলারে, যেখানে আজ ১ বিটকয়েন মূল্য সাড়ে ১১ হাজার ডলারের মতো। ২০৪৫ সাল নাগাদ ১ ডলারের দাম ১০০ টাকা ধরে, টাকার অঙ্কে ১ বিটকয়েনের মূল্য কত দাঁড়াবে নিজেই একটু হিসাব করে দেখেই নিন না। ফলে কয়েক সাতোশির মূল্য তখন কিছু কম দাঁড়াবে না।
বিটকয়েনের বাজার দর দেখেও, বিটকয়েনে বিনিয়োগের ব্যাপারে আমরা তো মনস্থির করে উঠতে পারি নি এখনও, কিন্তু ২০৪৫ সাল নাগাদ আমাদের ছেলে মেয়ে বা নাতি নাতনিরা যদি বিটকয়েনে বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে তাঁরা কি ভাবে বিটকয়েনে বিনিয়োগ করবেন? কেননা, ২০৪৫ সালের পর তো বাজারে আর নতুন কোনও বিটকয়েন ছাড়া হবে না। আর ইতিপূর্বে যত বিটকয়েন বাজারে ছাড়া হয়েছে বা পরে ছাড়া হবে তার সবগুলোই তো পুরানো গ্রাহকদের দখলে চলে গেছে বা যাবে। ২০৪৫ সালের পর কোনও নতুন গ্রাহক কি আর বিটকয়েন কিনতে পারবেন না তাহলে? হ্যাঁ, পারবেন, যে কোনও গ্রাহকই বিটকয়েন কেনতে পারবেন তখনও। সেই বিটকয়েন পাওয়া যাবে কি করে? ওই যে সুদের আশায় কয়েনবেস, উনোকয়েনের মতো প্ল্যাটফর্মে বিটকয়েন জমা রেখেছন কিছু গ্রাহক। তাঁদের রাখা বিটককয়েন থেকেই নতুন গ্রাহকদের বিটকয়েন সরবরাহ করবেন সংস্থাগুলো। যদিও তখন বিটকয়েনের থেকে মিলি বিটকয়েন, মাইক্রো বিটকয়েন বা সাতোশি এককে কাজ বেশি হবে। ফলে ১টা বিটকয়েন দিয়ে ৪-৫ জন গ্রাহকের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।
একটা বিটকয়েন কিনেই ফেলি তাহলে। শুধু একটা ব্যাপারই একটু খচ্ খচ্ করছে মনের ভিতরে। বিটকয়েন কেনার মধ্যে কোনও ঝুঁকিই কি নেই তাহলে? হ্যাঁ, ঝুঁকি তো আছেই। যে কোনও বিনিয়োগে যেমন ঝুঁকি থাকে বিটকয়েন বিনিয়োগেও তেমন ঝুঁকি আছে। মানুষ যদি বিটকয়েন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, তাহলে বিটকয়েন দিয়ে বেচাকেনা কমতে থাকবে। ফলে বিটকয়েন বা অন্য যে কোনও ক্রিপ্টোকারেন্সির দর পড়তে থাকবে হুহু করে। তবে পর্যবেক্ষকদের ধারণা, উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। উপরন্তু ক্রিপ্টো দুনিয়ার সাথে বড় বড় মাফিয়াদের মাখো মাখো সম্পর্কের কথা প্রায় সবারই জানা। যেহেতু সরকারের কাছে ক্রিপ্টোকারেন্সি বিনিময়ের কোনও রেকর্ড থাকে না, তাই বড় বড় কালো বাজারিদের ভারি পছন্দের প্ল্যাটফর্ম হলো ক্রিপ্টোকারেন্সি। ক্রিপ্টোকারেন্সির এই দুর্নামের জন্যই সাধারণ মানুষ কিছুটা মুখ ফিরিয়েই রয়েছেন ক্রিপ্টো দুনিয়া থেকে। তাতে অবশ্য ক্রিপ্টো দুনিয়ার তেমন কিছু এসে যায় না। কারণ, ১০ জন মধ্যবিত্ত ক্রিপ্টোকারেন্সিতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করবেন একজন কালো বাজারি তাঁদের মোট বিনিয়োগের ১০ গুণ বিনিয়োগ করে থাকেন ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে। ফলত সাধারণ মানুষ ক্রিপ্টো দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখলেও মোটের উপর বড় একটা প্রভাব পড়বে না ক্রিপ্টো দুনিয়ায়।
বরং বিটকয়েনে বিনিয়োগের বড় ঝুঁকি হলো তার বয়স। মাত্র ১২ বছর আগে শুরু হয়েছে বিটকয়েনের যাত্রা। এতো অল্প সময়ের মধ্যে বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ নিয়ে স্পষ্ট কিছু ধারণা করা মুশকিল। সভ্যতার আদি যুগের বিনিময় পদ্ধতি আর আজকের বিনিময় পদ্ধতি কি এক? প্রাচীন কালের কোনও তামার মুদ্রা দিয়ে আজ কি আর বিনিময় করা সম্ভব? সে পদ্ধতি আজ সম্পূর্ণই অচল হয়ে গেছে। শুধু কারেন্সি কেন, বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কারই প্রতি নিয়তই আপডেট হয়ে চলেছে, তা সে বা প্লেনেরই ক্ষেত্রেই হোক বা পেনিসিলিনের ক্ষেত্রে, তা সে মোটর গাড়ির ক্ষেত্রেই হোক বা মোবাইলের ক্ষেত্রে, পরিবর্তন আসছে সর্বত্র। প্রথম এরোপ্লেনের মডেলের সাথে আজকের এরোপ্লেনের মডেলের আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। প্রথম যুগের সাড়া জাগানো পেনিসিলিন দিয়ে কি আজ আর চিকিৎসা করেন কোনও চিকিৎসক? প্রথম যুগের বোতাম টেপা মোবাইলের কথা আমাদের সকলেরই স্মরণে রয়েছে। বিনা পয়সায় বিক্রি করলেও আজ আর কেউ কিনবে না সেই মোবাইল। ফলে যার কাছে সেই যুগের একটা মোবাইল রয়ে গেছে, আজকের দিনে সেই বিনিয়োগের কার্যত কোনও রিটার্নই নেই। ঠিক তেমনই, বিটকয়েন হলো ক্রিপ্টোকারেন্সি যুগের প্রথম মুদ্রা। তারপর থেকে দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে ইদুনিয়া, ইকমার্স। আর আজ থেকে ৫০ বছর পর ক্রিপ্টোকারেন্সির দুনিয়ায় এতোটাই পরিবর্তন আসবে যে প্রথম মোবাইলের মতো, শিশুদের খেলার একটা পদ্ধতি ছাড়া বিটকয়েনের অন্য কোনও মূল্যই থাকবে না হয়তো। হয়তো। হয়তো বলতে হচ্ছে এই কারণে, যুগের সেই পরিবর্তনের সাথে কি ভাবে নিজেকে অভিযোজিত করবে বিটকয়েন তা এক মোক্ষম প্রশ্ন। যুগের পরিবর্তনের সাথে যদি নিজেকে অভিযোজিত করে নিতে পারে বিটকয়েন তাহলে আজকে বিটকয়েনে বিনিয়োগ সেদিন সোনা ফলাবে। আর যুগের পরিবর্তনের সাথে নিজেকে যদি অভিযোজিত করতে না পারে বিটকয়েন, আজকে বিটকয়েনের বিনিয়োগ এক বিরাট লোকসানের মুখে পড়বে সেদিন। ফলে বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যায় না। কালের গর্ভেই রয়েছে তার হদিশ। তবে পূর্বাভাস বলছে, বিটকয়েন মানেই সোনার ভবিষ্যৎ।
জন্মলগ্ন থেকেই ভারতে নিষিদ্ধ ছিল বিটকয়েন। ফলে বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে বেচাকেনায় এখনও অভ্যস্থ হয়ে উঠে নি বাঙালি তথা ভারতবাসী। তার থেকেও বড় কথা বিটকয়েন নিয়ে কোনও স্পষ্ট ধারণাই গড়ে উঠে নিয়ে ভারতবাসীর। বিটকয়েন নিয়ে প্রায় অন্ধকারে রয়েছেন তরুণ প্রজন্ম। বিটকয়েন নিয়ে সন্দিহান প্রবীন নাগরিকরা। ফলে অতি ক্ষুদ্র একটা গন্ডির মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে আছে বিটকয়েন। তবে ধীর গতিতে হলেও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে বিটকয়েন নিয়ে। এই মুহূর্তে সেটাই একমাত্র আশার আলো। আগামী দিনের নতুন কোনও ক্রিপ্টোকারেন্সি হয়তো প্রথম পছন্দ হয়ে উঠবে তরুণ প্রজন্মের। আজকের যুগের নাগরিক হিসেবে আমরাই বা পিছিয়ে থাকবো কেন? সময় হয়েছে এখন মাঠে নেমে, থুড়ি, গুগলে নেমে বিটকয়েন নিয়ে খোঁজ খবর করার। ওওও, সার্চ ইঞ্জিনে ‘বিটকয়েন’ টাইপ করে ফেলেছেন? বহুত খুব, মারুন ‘এন্টার’ এবার। প্রবন্ধ রচনাটা সার্থক হলো মনে হচ্ছে!
সমাপ্ত
[৭] প্রচলিত কাগজের নোট বা ধাতুর মুদ্রাকে ফিয়াট কারেন্সি বা হুকমি মুদ্রা বলে। সরকার বা কোনও কেন্দ্রীয় সংস্থার হুকুমে ছাপা হয় বলে এই জাতীয় কারেন্সিকে হুকমি মুদ্রা বলা হয়।
Posted in: ARTICLE, January 2021 - Serial