মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের নতুন ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
৭
আইজ্যাক আসিমভের আপ্তবাক্য :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পার ক’রে ১৯৫০ সালে আমি যে পৃথিবীতে জন্মেছিলাম, তার সাথে আজকের এই পৃথিবীর সামান্যই মিল আছে। তবে যা এখনও রয়ে গেছে, পাল্টায়নি, তা হোল মানুষের অসহায়তা; প্রকৃতির রোষের মুখোমুখি, ক্ষমতার অত্যাচার-অবিচার-শোষণের মুখোমুখি যে মানুষ। হাজার রকমের অশিক্ষা ও কুসংস্কারের জালে জড়িয়ে থাকা, নিরুপায় আর্ত নথিহীন মানুষ। দেশহীন পরিচয়হীন গৃহহীন বিচারহীনের কান্নাকাটি আজও পৃথিবীর সর্বত্র। কারণ মানুষ অনেককাল ধরে অনেক অনেক ভুল করে এসেছে। সংশোধনের আর পথ নেই। যখন সবকিছু ক্রমে সুন্দর হয়ে উঠছে মনে করেছে মানুষ, তখনই, ঠিক তখনই কোথা থেকে আবার একরাশ অসুন্দর এসে ঢেকে দিয়েছে সংসারকে। এর বিরাম নেই। প্রকৃতই মৃত্যুহীন এই অসুন্দর।
এর মধ্য দিয়েই আমিও বেড়ে উঠেছি ছেলেবেলা থেকে। একশো বছর আগে বসিরহাটের গ্রামে আমার ঠাকুমা পালকি করে শ্বশুরবাড়ি গেছিলেন। গ্রামে কোনও পাকা রাস্তা ছিল না। ডাকহরকরা চিঠি নিয়ে চলাচল করতো, তার হাতে থাকতো বল্লম আর লন্ঠন। আর এখন রাজ্যজুড়ে অনেক সিক্স-লেন হাইওয়ে হয়েছে, আছে টোল প্লাজা আর ফ্লাইওভার। আমি প্রথম শাদা খাতায় লিখতে শিখি খাগের কলম দিয়ে। এখন আমার করায়ত্ত স্মার্টফোন আর গুগল সার্চ ইঞ্জিন। আর আমার ছ-বছরের নাতনি তার ট্যাবে সিম্যুলেশান গেম খেলে।
এখন এবিশ্বের অনেক রোবটের মধ্যে একজনের নাম সোফিয়া, যে সৌদি আরবের নাগরিক। তার পাসপোর্ট আছে। সে অনেক ভাষায় কথা বলে, গান করে, লজ্জা পায় প্রশংসা শুনলে। এখন কলকাতার রাজপথের ওপর দিয়ে ড্রোন উড়ে যায়। গ্যাস মাস্ক পরে স্কুলে যায় শিশুরা। গহ্বরবাসী কবিরা আজও কবিতা লেখেন; একই রকমের কবিতা, যা প্রতিদিন রাশি রাশি ছাপা হয়, আবৃত্তি হয়, বাহবা হয়, পুরস্কৃত হয় মঞ্চে। প্রাবন্ধিকেরা সেই কবিতারই উদ্ধৃতি দেন। মিছিল হয়, স্লোগান হয়, বন্ধুবিচ্ছেদ হয়। তবু সংকট কাটে না। পৃথিবী জুড়ে ধ্বংস হতে থাকে বৃষ্টিবন, প্রতিদিন বিলুপ্ত হতে থাকে কত প্রজাতি, উদ্ভিদ, বন্যপ্রাণ। ফুরিয়ে আসে কয়লা আর তেলের ভান্ডার। ক্রমে শেষ হয় হিমবাহগুলো। ভূগর্ভে দ্রুত নেমে যাচ্ছে জলের স্তর, বাড়ছে উষ্ণতা। মহাজাগতিক বিকিরণ এসে ঢুকে পড়ছে পৃথিবীর বায়ুস্তরে।
যখন সমগ্র পৃথিবীই ক্রমে বাসযোগ্যতা হারাতে বসেছে, তখনও আলোচনা চলছে কে কোন দেশের নাগরিক, কোথায় কত উঁচু দেওয়াল তুলতে হবে। কার কোথায় কতখানি জনসমর্থন। আজ ষোড়শী স্কুলবালিকা গ্রেটা থুনবারি বিশ্বমঞ্চে উঠে চীৎকার করে বলছে—এতদিন এসব তোমরা দেখেও দেখনি, ভুল শুধরোওনি, আমাদের মতো ছোটদের ভবিষ্যতের কথা ভাবোনি, পৃথিবীটাকে জাহান্নমে পাঠিয়েছো, এতখানি স্পর্ধা তোমাদের হয় কী করে ? তার সেই চিৎকৃত কন্ঠস্বর আল্পসে, হিমালয়ে, কারাকোরামে, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে।
*
স্টিফেন হকিংয়ের লেখা আমাকে আগ্রহী করে তুলেছিল কৃষ্ণ গহ্বর নিয়ে। মৃত্যুর অল্পকাল আগে তিনিও চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ ভেবে। তাঁর উপদেশ ছিল, পৃথিবী থেকে মানুষ লুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগেই উচিত হবে মঙ্গলগ্রহে গিয়ে অন্ততঃ কিছু মানুষের বসতিস্থাপন। কারণ পরিবেশদুষণ নিয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ক্রমশই দায়িত্ব এড়িয়ে চলেছিল, ঘনিয়ে আসছিল শেষের সেদিন।
আমাদের মতো সাধারণের কাছে এগুলো ছিলো কল্পবিজ্ঞানের বিষয়। কিন্তু বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ সত্যিই এইসব নিয়ে কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছিলেন। আসলে প্রয়োজন ছিল নতুন প্রজন্মের বিপুল মেধাবী, জেদি, একবগগা কিছু মানুষজন, যাঁরা হাজার সমস্যাকে নিমেষে সমাধান করবেন, যাঁদের চিন্তাপদ্ধতি অপ্রচলিত পথে চলে, যাঁরা নির্ভীক, লড়াকু, প্রতিস্পর্ধী; তাঁদের হাতেই আগামী দিনের ভুবনের ভার। খুঁজতে খুঁজতে আমি সম্প্রতি পেয়ে গেলাম, জানতে পারলাম এমন একজন মানুষের কথা, যিনি—ঢের হয়েছে, এবার আমাকে বিষয়টা দেখতে দাও—বলে, কাজে নেমে পড়েছেন। এই বিশ্ব তাঁর কথা শুনতে আরম্ভ করেছে বিশ বছর আগে থেকে। এখন তিনি এক কিংবদন্তি। তরুণ আঁত্রেপ্রেনারদের কাছে তিনি এক রোল মডেল, আইকন, অবিশ্বাস্য হিরো।
মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সী এই যুবককে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান পঁচিশজনের একজন ধরা হয়। এঁর নাম ইলন মাস্ক (Elon Musk)। এঁর একমাত্র উদ্দেশ্য, এই পৃথিবীকে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে তোলা এবং মানবজাতিকে নিশ্চিত বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো। এর জন্যে এখনই মঙ্গলগ্রহে গিয়ে বসতিস্থাপনের কাজ শুরু করে দিতে হবে। কারণ, এই পৃথিবী থেকে তিনভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে মানবসভ্যতা। এক, বিশালাকার কোনও গ্রহাণু এসে অদূর ভবিষ্যতে আছড়ে পড়বে পৃথিবীতে, ভয়ংকর ধ্বংস হবে, নেমে আসবে হিমযুগ। দুই, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে দুর্যোগে, দাবানলে, জলোচ্ছ্বাসে, মহাজাগতিক বিকিরণে নিশ্চিহ্ন হবে প্রাণজীবন। তিন, অদূর ভবিষ্যতে যখন শেষ হয়ে আসবে শক্তির ভান্ডার, শেষ হয়ে আসবে কয়লা, পেট্রোলিয়াম, পেয় জল, তখন রক্তক্ষয়ী কাড়াকাড়ি শুরু হবে আর ছড়িয়ে পড়বে পারমাণবিক যুদ্ধ, যাতে অংশ নেবে রোবটরাও। সেই অন্তিম যুদ্ধই তার শেষ। -গভীর মহাবিশ্বের কোটি কোটি আলোকবর্ষ জুড়ে কোটি কোটি গ্রহ নক্ষত্র নীহারিকাপুঞ্জের কোথাও আজও উন্নত জীবনের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মানুষ রয়েছে শুধু আজকের এই একটি নীলসবুজ ছোট্ট গ্রহে, যার নাম পৃথিবী। সেই মানুষ শেষ হয়ে যাবে ?
যদি কয়েক হাজার বছর পরে পৃথিবী আবার কখনো নিজেই সারিয়ে তুলতে পারে নিজেকে, তখন নাহয় মঙ্গলগ্রহ থেকে মানুষ ফিরে এসে, শুভবুদ্ধির বশে আবার বসতি স্থাপন করতে পারবে এই পৃথিবীতে। হয়তো মাত্র দশ-পনেরো হাজার মানুষ। ততদিন মঙ্গলগ্রহে মানুষের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তৈরী করতে হবে মানুষের বাসযোগ্য কলোনি, তৈরী করতে হবে বিদ্যুৎ শক্তি, আর রকেটে করে পৃথিবীতে পাড়ি দেওয়ার জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা। কেমন দেখতে হবে সেই রকেট, কী হবে তার জ্বালানি? সেখানে যদি মাটির তলায় তেলের ভান্ডার না থাকে ? কেমন হবে সেখানে সমাজব্যবস্থা ? উন্মুক্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা, নাকি প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র ? এসবই ভেবে নিয়ে কাজ শুরু করেছেন ইলন মাস্ক ও তাঁর সহযোগীরা।
হয়তো কখনো প্রাণজীবন ছিল মঙ্গলে। এখন সব নিশ্চিহ্ন, জ্বলে পুড়ে আংরা। লাল পাথুরে জমি, পাহাড়ি পাথুরে চট্টান, বৃক্ষহীন, ছায়াহীন, বৃষ্টিহীন, অক্সিজেনহীন। রাতের তাপমাত্রা মাইনাস ১০০ ডিগ্রী। বায়ুমন্ডলের স্তর খুব হাল্কা, আর তার ৯৫% কার্বন ডাইঅক্সাইড। আর আছে ভয়াবহ মহাজাগতিক বিকিরণ রশ্মি। এর মধ্যে মানুষ ঘর বানিয়ে বসবাস করবে, পড়াশোনা করবে, কৃষিকাজ করবে, খেলবে, ভালবাসবে, জন্ম দেবে সন্তানের। আর মানুষকে সাহায্য করবে যন্ত্রমানব, রোবট।
ইলন মাস্কের সকল কর্মকান্ডের প্রতি অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকে পৃথিবীর তাবৎ মিডিয়া, প্রযুক্তিবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। প্রতিদিনের প্রত্যেকটা ট্যুইট তাঁর ফলোয়াররা খুঁটিয়ে পড়েন, আর প্রত্যেক ইউটিউব ভিডিও ভাইরাল হয়ে যায়। আমি তাঁর সকল কর্মকান্ডের বিবরণ খুঁটিয়ে পড়ে চলেছি, আর বিস্মিত হচ্ছি। তাঁকে নিয়ে ২০১৯ সালে যখন আমি প্রথম লিখি, তখন অব্দি বাংলা ভাষায় তাঁকে নিয়ে আর কোনও লেখা কোথাও চোখে পড়েনি। বড় মেজো ছোট কোনও কাগজে, বা সোশ্যাল মিডিয়াতেও নয়। এই ভুখন্ডে তিনি এতদিন ছিলেন অনাবিস্কৃত, অনালোচিত।
অথচ এই মানুষটাকে দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিখ্যাত মঞ্চগুলোয়, তাঁকে ঘিরে প্রশ্ন করছেন বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা। আমেরিকার নাসা তাঁর সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে অনেক আগেই। কারণ নাসার চেয়ে অনেক অনেক কম খরচে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার উপযোগী প্রযুক্তি আবিস্কার করেছেন ইলন মাস্ক। ২০২২ সালে চাঁদে এবং ২০২৪ সালে মঙ্গলগ্রহে পৌঁছে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন তিনি। প্রথমে সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল, ঠাট্টা করেছিল অনেক। পরপর তিনবার তার রকেট ভেঙ্গে পড়েছিল টেস্ট ফ্লাইটের শুরুতেই। অনেকে বলেছিল—ঢের হয়েছে, এবার নিশ্চয় তুমি হাত গোটাবে, মন দেবে অন্য কোনও কাজে। আমি সেই ইন্টারভিউয়ের ভিডিওতে দেখেছিলাম হার-না-মানা এক যুবকের দৃপ্ত মুখ আর স্মিত হাসি। সে বলেছিল— না, এর পরের বার আর ফেল করবো না।
কে এই ইলন মাস্ক ? কিভাবে তার এই দৃঢ় প্রত্যয় ? আমি তার বড় হয়ে ওঠার কাহিনীতে মনোযোগ দিই। তার জন্ম হয়েছিল ২৮ জুন, ১৯৭১। জন্মস্থান প্রিটোরিয়া, ট্রান্সভাল, সাউথ আফ্রিকা। দুই ভাই, এক বোন। তাদের বাবা ছিলেন ব্রিটিশ, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, পাইলট, নাবিক। মা কানাডিয়ান, মডেল ও ডায়েটিসিয়ান। ছোটবেলায় বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হলে, ইলন বাবার সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। বড় হয়ে বনিবনা না হওয়ায় ছেড়ে আসেন বাবাকেও। ছোটবেলায় ভালোবাসতেন কল্পবিজ্ঞানের বই আর কম্পিউটার। প্রিয় আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভের (জন্মঃ১৯২০রাশিয়া, মৃত্যুঃ১৯৯২ব্রুকলিন) লেখা‘ফাউন্ডেশান সিরিজ’ গোগ্রাসে পড়েছিলেন। আসিমভের উপদেশ ছিল—তুমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাও যাতে মানবজাতি কিছুতেই বিলুপ্ত না হয়, আর যেন অন্ধকার যুগকে আমরা ঠেকিয়ে রাখতে পারি। আসিমভের এই আপ্তবাক্য ভীষণভাবে ভাবিয়ে ছিল বালক ইলন মাস্ককে।
মাত্র ১২ বছর বয়সে কম্পিউটারে ‘ব্লাস্টার’-নামে একটা ভিডিও গেম বানিয়ে, ৫০০ ডলারে সেটা বিক্রি করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন। স্কুলে ডানপিটে ছেলেদের কাছে নানা অজুহাতে মার খেয়েছেন অনেক, কিন্তু বই পড়ার নেশায় ডুবে থেকেছেন। হাইস্কুল পাশ করার পরে, বাবার অমতে প্রিটোরিয়া ছেড়ে প্রথমে কানাডা, তারপরে স্বপ্নরাজ্য আমেরিকায় পড়াশোনা করতে চলে যান। সেখানে বিখ্যাত হোয়ার্টন থেকে ইকোনমিক্সে এবং পরে পেনসিলভেনিয়া থেকে পদার্থবিদ্যায় তিনি স্নাতক। এর পরেই সব বদলে গেল।
১৯৯৫ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে পিএইচডি শুরু করে দুদিন পরেই ছেড়ে দিলেন। তখন তার মাথায় রয়েছে আসিমভের সেই উপদেশ—মনুষ্যজাতিকে বিলুপ্ত হওয়া থেকে বাঁচাতেই হবে। ইলনের মনে হল, এখনই বেসরকারী উদ্যোগে কাজ শুরু করা দরকার, এবং দরকার প্রচুর অর্থের। প্রথমেই খুললেন Zip2 নামে একটা সফটওয়্যার কোম্পানি। মাত্র কয়েক বছর পরে, ১৯৯৯ সালে বিখ্যাত Compaq কোম্পানি সেটা ৩৪০ মিলিয়ন ডলারে কিনে নিল। হাতে এল অনেক টাকা। এর পরে X.com নামে একটা অনলাইন ব্যাঙ্ক খুললেন, পরে যেটা PayPal নাম হয়, এবং কয়েক বছর পরে, ২০০২ সালে, তাকেই ১.৫ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয় বিখ্যাত eBay কোম্পানি।
এর পরে ইলন ঠিক করেন রকেট তৈরীতে মন দেবেন। তাঁর মনে হল, মঙ্গলগ্রহে একটা গ্রীনহাউস বানানো প্রয়োজন (Mars Oasis) যেখানে চাষবাস, কৃষি-গবেষণা হবে। কলেজের দুজন বন্ধুকে নিয়ে মাস্ক চললেন রাশিয়ায়, উদ্দেশ্য সস্তায় কয়েকটা সেকেন্ড হ্যান্ড ব্যালিস্টিক মিসাইল কেনা। কিন্তু তাদের কথাবার্তা শুনে, আনাড়ি মনে করে, পাত্তাই দিলেন না রাশিয়ানরা। খালি হাতেই ফিরতে হোল। কিছুদিন পরে আরও অভিজ্ঞ এক বন্ধুকে নিয়ে মাস্ক আবার গেলেন রাশিয়ায়। এবার রকেটপিছু রাশিয়ানরা দর হাঁকলো ৮-মিলিয়ন ডলার। সে তো অনেক টাকা, মাস্ক ভাবলেন এভাবে হবে না। ফিরে এসে হিসেব কষে দেখলেন তৈরী রকেটের দামের মাত্র ৩% হচ্ছে তার নির্মাণের মালমশলার দাম। ঠিক করলেন নিজেই বানাবেন।
তাঁর মূল মন্ত্র হোল ‘র্যা পিড ইনোভেশান’। চটপট কয়েকটা বড়সড় কোম্পানি খুলে ফেললেন, তারা আজ বিশ্ববিখ্যাত। রকেট তৈরী করে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার জন্য SpaceX কোম্পানি। তিনিই প্রতিষ্ঠাতা, সিইও, এবং প্রোডাক্ট আর্কিটেক্ট। রকেটের খরচ কমিয়ে ১০%-এ নামিয়ে আনা হোল, আর লাভ রইলো বিস্তর। তবুও মঙ্গলগ্রহে যাত্রী পরিবহণের খরচ তো অনেক। মাস্ক বুঝলেন এমন বিশাল রকেট বানাতে হবে যাতে অনেক যাত্রী ধরে, আর যাকে বারবার ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ, মহাকাশে কক্ষপথে যাত্রীবাহী উপগ্রহকে পৌঁছে দিয়ে রকেট যেন আবার সোজাসুজি ফিরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে পরবর্তী ট্রিপের জন্য। লোকে হাসাহাসি করলো, নাসাও বললো এমনটা সম্ভব নাকি?
মাস্ক তাঁর সঙ্গীদের বললেন, লেটাস মেক আ বিগ ফাকিং রকেট। ব্যাস, রকেটের নাম হয়ে গেল BFR ;পরে অবশ্য নাম পরিবর্তন করে রাখা হোল ‘ফ্যালকন’। ক্রমশঃ তার ডিজাইন আর ক্ষমতা উন্নত ক’রে, ফ্যালকন-১ থেকে এখন ফ্যালকন-৯ অব্দি। নাসা উৎসাহিত হয়ে বরাত দিল, মহাকাশে তাদের ‘আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশান’-এ জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে হবে। ফ্যালকন-৯ রকেট সত্যিই সফলভাবে করে দিল সেই কাজ। আর প্রতিবারই সেই রকেট ফিরে এসেছে পৃথিবীর মাটিতে, তার লঞ্চপ্যাডে, যেখান থেকে তার উৎক্ষেপণ হয়েছিল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য (নীচের ছবি)।
এই সময়ে মাস্ক মেতে উঠলেন আরও কয়েকটা প্রকল্পে, যেমন সৌর বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেল বানানোর কম্পানির নাম দেওয়া হোল ‘সোলার সিটি’। আর খোলা হোল পৃথিবীর সবচেয়ে নামী ইলেক্ট্রিক কার কোম্পানী ‘টেস্লা’। উনিই তার প্রতিষ্ঠাতা, সিইও, চীফ প্রোডাক্ট ডিজাইনার। তৈরি হোল মাস্কের অতি প্রিয় লাল রঙের টেসলা রোডস্টার কার।
মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশে নাসা তার ‘মার্স রোভার’ পাঠিয়েছে জুলাই ২০২০তে, যার নাম ‘পার্সিভিয়ারেন্স’। সেই যান মঙ্গলে নামবে আগামী মাসে, ফেব্রুয়ারী ২০২১। [আগেই জানিয়েছি, সেই যানে করে আমি মঙ্গলগ্রহে পাঠিয়ে দিয়েছি ৩৫ বছর আগে লেখা আমারই প্রথম গল্পের শিরোনামটি, যা ছিল- ‘আহ্, দোজ ট্রাইসাইক্ল্স’, যেটা কৌরব পত্রিকায় তিনবার প্রকাশিত হয়েছিল, সম্পাদকের মতে তার লেখনশৈলী ছিল নাকি মঙ্গলগ্রহের। নাসা ইতিমধ্যেই আমাকে ওই নামে মহাকাশযানের ‘বোর্ডিং পাস’ পাঠিয়ে দিয়েছে।]
ইলন মাস্কও পিছিয়ে নেই। এবারে চাঁদ বা আরও দূরে মঙ্গলে যাওয়ার জন্যে মাস্ক বানাচ্ছেন আরও অতিকায় রকেট, যার নাম ‘ফ্যালকন হেভি’। যার নীচের অংশে তিনটে ফার্স্ট স্টেজ বুস্টার রকেট (ফ্যালকন-৯), এবং উর্ধাংশে আছে সেকেন্ড স্টেজ রকেট ‘স্টারশিপ’। টেক্সাসের ‘বোকাচিকা’-র প্ল্যান্টে নির্মিত হচ্ছে সে। ইতিমধ্যেই একবার টেস্ট হয়ে গিয়েছে। মহাকাশের কক্ষপথে কয়েকটা ছোট উপগ্রহ ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসা গেছে নিরাপদে। এছাড়াও, মহাকাশে ছেড়ে আসার জন্যে আর একটা জিনিস মাস্ক পাঠিয়েছিলেন ‘ফ্যালকন হেভি’-র ওই যাত্রাতেই। সেটা হোল তাঁর প্রিয় হুড-খোলা লাল রঙের দারুণ একটা ‘টেসলা’-কার, যার চালকের আসনে বসে আছে হেলমেট পরা একটি ডামি (নীচে ছবিতে)। সেই উৎক্ষেপণের দিনটা ছিল ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮। সারা পৃথিবী বিস্মিত হয়ে দেখেছিল মহাকাশে সেই মনোহর মস্তানি। মহাশূন্যে ছেড়ে আসা সেই লাল টেসলা কার ক্রমে মঙ্গলের কক্ষপথ অতিক্রম করে এখন গভীর মহাকাশে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এভাবেই নাকিসে ছুটে চলবে লক্ষ কোটি বছর। কয়েক লক্ষ ভিঊ এবং রিট্যুইট হয়েছিল সেই খবর।
ফ্যালকন হেভি-র পরবর্তী গন্তব্য চাঁদ ২০২২ (‘ডিয়ার মুন’ প্রজেক্ট) এবং তার পরেই ২০২৪-এ মঙ্গলগ্রহ। এছাড়াও আছে ‘স্টারলিঙ্ক’ প্রজেক্ট। ইলন মাস্ক সাধারণ মানুষের জন্যে পৃথিবীর প্রত্যন্ত কোণাতেও ইন্টারনেট যোগাযোগের সুফল পৌঁছে দিতে চান। তার জন্যে প্রায় বারোহাজার ছোট ছোট জিওস্টেশনারী উপগ্রহের জাল দিয়ে ঘিরে ফেলতে চান গোটা পৃথিবীকে (নীচে ছবিতে) যাতে পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মুহূর্তেই রিলে- পদ্ধতিতে যোগাযোগ সম্ভব হয়।
ইলন মাস্কের আরেকটা প্রকল্প হোল আমেরিকার নিউইয়র্ক, শিকাগো বা লস এঞ্জেলেসের রাস্তায় ভয়াবহ ট্রাফিক জ্যাম থেকে নাগরিকদের মুক্তি দেওয়ার জন্যে মাটির নীচে সরু টানেলের নেটওয়ার্ক তৈরী করা, যার মধ্যে দিয়ে বিনা বাধায় ২৫০ কিমি স্পীডে গাড়িকে নিয়ে যাওয়া যাবে। এর জন্য মাস্ক যে কোম্পানি খুলেছেন, তার নাম ‘দা বোরিং কোম্পানি’। ইতিমধ্যেই কিছু টানেল তৈরী হয়ে টেস্ট করা হয়ে গেছে, কাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুত। টানেল বোরিং মেশিনগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে মাস্কের প্রিয় নাটক বা কবিতা থেকে ; যেমন, Godot বা Prufrock.
এছাড়াও ইলন মাস্কের গভীর মনোযোগে আছে ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’-কে দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর জন্যে ‘নিউরালিঙ্ক’ নামে একটা কোম্পানীও খুলেছেন। সেখানে কাজ হচ্ছে ‘ব্রেন ইমপ্লান্ট’ নিয়ে। চুলের চেয়েও অনেক বেশি সূক্ষ্ম ইলেকট্রোড আর ছোট্ট একটা চিপ খুব সহজেই বসিয়ে দেওয়া হবে মানুষের মাথার স্কিনের একটু নিচে (নীচে ছবিতে), যার দ্বারা সে যুক্ত হতে পারবে কোনও মেশিন বা কম্পিউটারের সাথে। এর ফলে বিশাল বড় হবে তার স্মৃতিভান্ডার, আর তীব্র গতিতে অনেক গণনার কাজ করতে পারবে সে। এটা করার পেছনে মাস্কের উদ্দেশ্য হোল, সাধারণ নাগরিককে এমনভাবে শক্তিমান ও সুরক্ষিত করে তোলা, যাতে কোনও বিপুল ক্ষমতাধর ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রশক্তি তার ওপরে খোদকারি বা নজরদারি করতে না পারে।
মাস্কের অন্তর জুড়ে আছে আইজ্যাক আসিমভের সেই আপ্তবাক্য– কোনও ভাবেই যেন মানুষ বিলুপ্ত হয়ে না যায়, অন্ধকার যুগ এসে যেন গ্রাস না করে ভালো মানুষদের। সবদিক দিয়ে সেই ব্যবস্থা করে রাখতে হবে, করতে হবে দ্রুত গতিতে। পৃথিবীর আজ ঘোর দুর্দিন, হাতে সময়ও খুব কম। দেশে দেশে গ্রেটা থুনবারিরা জবাব চাইছে, বলছে- তোমাদের এত স্পর্ধা হয় কী করে?
এই বিপুল ব্রহ্মান্ডে আমরা কি সত্যিই একা ? আর কোথাও কোনও গ্রহ নেই যা পৃথিবীর মতো ? কোথাও আর মানুষের মতো কোনও চিন্তাশীল, সংবেদনশীল, উদ্ভাবনী প্রাণজগত নেই? এও কি সম্ভব ? মাস্ক বলছেন- জানি না, তাহলে হয়তো আমরাও সত্য নই। যা কিছু হচ্ছে, হয়তো তার সবটাই একটা বিশাল সিম্যুলেশান গেম। কিন্তু কে সেই গেমের রচয়িতা,কারাতারনিয়ামক, কেতারঅ্যাড্মিন ? এই যে মঙ্গলগ্রহে বসতিস্থাপনের কথা ভাবছে মানুষ, এও কি সত্যিই ? মাস্ক বলেছেন, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে খুব সাবধানে চলা উচিত, বেশি নাড়াঘাঁটা না করাই ভালো, বিপদ হতে পারে। আর সতর্ক থাকতে হবে কাছে পিঠে হঠাৎ কোনও সূক্ষ্ম ব্ল্যাক হোল গজিয়ে উঠছে কিনা।
*
ইলন মাস্ক যখন মঙ্গলগ্রহে মানুষের পাকাপাকি বসতি স্থাপনের পরিকল্পনা করছেন (নীচে ছবিতে), তখন নাসাও পিছিয়ে নেই।
মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে এখন ছুটে চলেছে নাসার পাঠানো সেই মহাকাশযান, যাকে বিখ্যাত ‘আটলাস’-রকেটে চড়িয়ে ফ্লোরিডার ‘কেপক্যানাভেরাল’ মঞ্চ থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল গত বছর, ২০২০ সালের ৩০-জুলাই,যখন পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহ নিজ নিজ কক্ষপথে বিশেষ সুবিধাজনক দূরত্বের মধ্যে চলে এসেছিল। আর কয়েকদিন পরে, আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১, মঙ্গলগ্রহে ‘জেযেরো ক্র্যাটার’ (Jezero Crater) নামক অঞ্চলে তার অবতরণের কথা। নাসারও উদ্দেশ্য অদূর ভবিষ্যতে মঙ্গলগ্রহে মানুষের বসতিস্থাপন।
পৃথিবীতে বসে মানুষ অন্য গ্রহ নিয়ে যত আলোচনা করেছে, বা উৎসাহ দেখিয়েছে, তার মধ্যে সর্বপ্রথম হোল মার্স, বা মঙ্গলগ্রহ। গত পঞ্চাশ বছর ধরে মানুষ সেখানে যাওয়ার জন্যে চেষ্টা করে চলেছে। প্রধানতঃ রাশিয়া ও আমেরিকা। অনেক পরে ইউরোপ, চীন, জাপানও কাজে নেমেছে, তবে অভিযানের সংখ্যানগণ্য। আজ অব্দি পৃথিবী থেকে মঙ্গলগ্রহের উদ্দেশে যতগুলো অভিযান হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই অসফল। অজস্র দুর্ঘটনা। যাত্রার মুহূর্তে, মাঝপথে, অথবা একেবারে শেষক্ষণে। যান্ত্রিক গোলযোগ, অথবা কম্পিউটারের সমস্যা, যোগাযোগ ছিন্ন হওয়া, এমনকি কখনও জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার জন্যেও পরিত্যক্ত হয়েছে অভিযান। এইসব অভিযানের অনেকগুলো অধ্যায় আছে; সহজ অভিযান থেকে ধাপে ধাপে এগিয়ে, ক্রমশঃ আরও এগিয়ে যাওয়া। এর ১, ২, ৩, ৪, ৫ হয়ে, সর্বশেষ ৬ নং ধাপে আছে মানুষকে নিয়ে যাওয়া।
মঙ্গল অভিযানের প্রতিটি ধাপে সাফল্যের খতিয়ান নিম্নরূপ।
১। ফ্লাইবাই, মানে মঙ্গল গ্রহের খুব কাছ দিয়ে, ছবিটবি তুলে, উড়ে চলে যাওয়া। [নাসা, ১৯৬৫ সাল]
২। মঙ্গল গ্রহের কাছাকাছি পৌঁছে, তাকে কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করতে থাকা ‘অরবিটার’। [নাসা, ১৯৭১ সাল]
৩। প্রদক্ষিণরত অরবিটার থেকে প্যারাসুটের সাহায্যে মঙ্গলের ভূমিতে যন্ত্রপাতি সজ্জিত একটা বাক্সকে নামিয়ে দেওয়া, যাকে বলে ‘ল্যান্ডার’। এই ল্যান্ডার মঙ্গলের জমিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে পাঠাবে,আর তার যন্ত্রপাতি দিয়ে নানা তথ্য সংগ্রহ করবে। [প্রথম সফল হয় রাশিয়া, ১৯৭১ সাল। সেটাই মঙ্গলে প্রথম অবতরণ, কিন্তু মাত্র ১৫ সেকেন্ড পরে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপরে অবতরণ করে নাসা, ১৯৭৬ সাল। সেটাই প্রথম সফল অভিযান, মঙ্গলের মাটিতে ছ’বছরেরও বেশি সময় ধরে সেই ল্যান্ডার কর্মক্ষম ছিল।]
৪। অবতরণের পরে ল্যান্ডারের পেটের মধ্যে থেকে একটা চাকা লাগানো গাড়ি বেরিয়ে আসবে, যাকে বলা হয় ‘রোভার’, যার কাজ হবে কিছুটা আশপাশে ঘুরে বেড়িয়ে ছবি তোলা, মাটি খুঁড়ে কিছু মাটি-পাথর সংগ্রহ করা, বিশ্লেষণ করা, এবং পৃথিবীতে তার ছবি ও তথ্য পাঠানো। [নাসা, ১৯৯৭ সাল]
এর পরবর্তী পঞ্চম পর্বটা আরও উন্নত, এবারে নাসার Mars 2020 অভিযানে যা হতে চলেছে। এবারে থাকছে– অরবিটার, ল্যান্ডার, রোভার, হেলিকপ্টার।
এবারে চাকা লাগানো ‘পার্সিভিয়ারেন্স’ রোভারের সাথে এই প্রথম পাঠানো হয়েছে একটা ছোট্ট হেলিকপ্টার, যার নাম ‘ইনজেনুইটি’, যে নামটি বেছে নেওয়া হয়েছে আমেরিকার স্কুল ছাত্রীদের দেওয়া অনেক নামের মধ্য থেকে। এটা মঙ্গলের আকাশে কিছুক্ষণ ওড়াউড়ি করে নানা তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করবে। এছাড়াও, ছ-চাকার রোভারের আছে রোবোটিক আর্ম, যা দিয়ে সে পছন্দের মতো জায়গা থেকে মাটি খুঁড়ে স্যাম্পল কালেক্ট করবে এবং একটা ক্যাপ্সুল-ব্যাগে ভরে রাখবে। (পরবর্তী কোনও অভিযানে সেগুলোকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হবে পৃথিবীতে, যেটা এখনই সম্ভব নয়)।
এই ‘পার্সিভিয়ারেন্স’-রোভারটা মঙ্গলের বুকে কার্যক্ষম থাকবে ৬৮৭ দিন। এই সময় ধরে অনেক রকম পরীক্ষা চালানো হবে। ৩৬০-কোটি বছরের পুরানো মঙ্গল গ্রহের উত্তর গোলার্ধে আছে ৪৯-কিলোমিটার চওড়া বিশাল ‘জেযেরো’ হ্রদ। জলশূন্য সেই হ্রদের ৮০০ ফুট গভীরে নেমে মাটিপাথর খুঁড়ে দেখা হবে কোনও জৈব ফসিল, জল, বরফ, বা প্রাচীন কোনও প্রাণের চিহ্ন পাওয়া যায় কিনা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই শুকনো হ্রদে এক সময় জল ছিল, যা পরে শুকিয়ে গেছে, আবহাওয়ার পরিবর্তনে। হয়তো তখন কোনও প্রাণীও ছিল এইসব হ্রদের জলাভূমিতে। হয়তো।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, মঙ্গলের ক্ষীণ বাতাসে অক্সিজেন ও জলীয় বাস্প অতি সামান্য; প্রায় শূন্যের কাছে। সেই বাতাসের ৯৫-ভাগই কার্বনডাইঅক্সাইড, যার থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে অক্সিজেন তৈরী করার চেষ্টা করবে এবারের রোভার। ভবিষ্যতে মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করার জন্যই এই প্রচেষ্টা। মঙ্গলঅভিযানের এইসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্ভব হতে চলেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা যুগান্তকারী আবিস্কারের কারণে, যা নানা ভাবে উপকৃত করবে আমাদের পৃথিবীবাসী মানুষকেও।
এই মুহূর্তে মঙ্গলের বুকে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে, নাসার আগের অভিযানগুলো থেকে পাঠানো তিনটে রোভার। কয়েক বছর অন্তর মঙ্গলে যে ভয়ংকর লাল ধুলোর ঝড় ওঠে, তাতেই তারা বিগড়ে গিয়েছে সম্ভবত। তবে ২০১২ সালে পাঠানো ‘কিউরিয়োসিটি’ নামের শেষ রোভারটা এখনও কর্মক্ষম। ২০২৩-২৪ সালে নাসার পরিকল্পনা আছে, মঙ্গল গ্রহে প্রথমবার তারা মানুষ নিয়ে যাবে। তারজন্যই অনেক কিছু পরীক্ষা চালাবে এবারের অভিযান।
মহাকাশ অভিযানকে পৃথিবীর মানুষের কাছে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে নাসা বহুদিন ধরেই চেষ্টা করে চলেছে। সাড়াও মিলেছে অভাবনীয়। এবারের অভিযান নিয়ে যারা খুব উৎসাহ জানিয়েছে নাসা-কে, তাদের সবার নাম লেখা হয়েছে এই ‘পার্সিভিয়ারেন্স’ মহাকাশযানের গায়ে। নাসার জেট প্রোপালশান ল্যাবরেটরিতে (JPL), একটি মাইক্রোচিপের ওপরে অতি সূক্ষ্ম লেসার বীম দিয়ে লেখা হয়েছে তাদের নাম। আশির দশকে কৌরব পত্রিকায় প্রকাশিত আমার প্রথম অ্যান্টি-ন্যারেটিভ গল্প ‘আহ, দোজ ট্রাই সাইকলস’– যার লিখন শৈলীকে সে সময় মঙ্গলগ্রহের বলা হয়েছিল—আমার অনুরোধে সেই নামটিও লেসার বীম দিয়ে খোদাই করা হয়েছে মহাকাশ যানের সেই প্লেটে (নীচে ছবিতে)।
নাসা আমায় তার জন্য একটা সুন্দর বোর্ডিং পাস (নং M2M670591313739) পাঠিয়ে দিয়েছে আগেই, যাতে লেখা আছে উৎক্ষেপণ ও অবতরণ স্থানের নামও (নীচে ছবিতে)। বাংলা সাহিত্যে আর কোনও রচনা এভাবে মঙ্গল গ্রহের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছে কিনা জানি না। মনে হচ্ছে, কয়েকটা গ্রহ আমি ঘোরালাম সামান্য লেখাকে!
নীচে ছবিতে, ছয়-চাকাওয়ালা ‘পার্সিভিয়ারেন্স’ নামক রোবোটিক সেই রোভার। পাথরের গায়ে একবিন্দু ধাতুকেও যে ৭-৮ ফুট দূর থেকে লেসারবীমের সাহায্যে পরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করে জেনে নিতে পারে।
নীচে ছবিতে, ছোট্ট হেলিকপ্টার—‘ইনজেনুয়িটি’ (আমেরিকার এক স্কুলবালিকার রাখা নাম)—যা উড়ে উড়ে ছবি তুলে, নানা তথ্য পাঠাবে পৃথিবীতে। মনে রাখা যাক, মঙ্গলগ্রহের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর মাত্র ৩৮% শতাংশ, এবং তার বায়ুমন্ডলের ঘনত্ব পৃথিবীর মাত্র ১% শতাংশ। সেই পরিবেশে উড়তে পারার জন্যে ছোট্ট হেলিকপ্টারটির ওজন রাখা হয়েছে মাত্র ২-কেজি।
*
চাঁদের মাটিতে প্রথম পা রেখেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং। সমগ্র মানবজাতির হয়ে তিনিই প্রথম। তবে আগামী দিনে মঙ্গলের মাটিতে প্রথম পা রাখতে চলেছে পুরুষের বদলে একজন নারী, যাকে এখন বালিকাই বলা যায়। যে মেয়েটি অনুপ্রাণিত করতে চলেছে এই প্রজন্মের সমস্ত মেয়েকে, তার বয়স এখন মাত্র ১৮, অর্থাৎ এখনও সে টিন এজার (নীচে ছবিতে)। নাম অ্যালিসা কারসন (Alyssa Carson)। জন্ম আমেরিকার লুইসিয়ানায়। ‘বেটন রুজ ইন্টারন্যাশনাল’ স্কুলের ছাত্রী সে। মাত্র তিন বছর বয়সে টিভিতে তার খুব পছন্দের অনুষ্ঠান ছিল ‘দা ব্যাক ইয়ার্ডিগান্স’ নামের একটা মিউজিকাল কার্টুন শো। তারই একটা এপিসোডে ছিল ‘Mission to Mars’ নামক দারুণ এক অভিযান, যা অ্যালিসাকে মুগ্ধ করেছিল।
সেই থেকে তার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে মহাকাশচারী হবার। এবং শুধু স্বপ্নই সে দেখেনি, সেই লক্ষ্যে প্রচুর পরিশ্রমে নিজেকে তৈরী করেছে ভীষণ সাহসী ও স্বপ্নিল এই বালিকা। এই বয়সেই Advanced Space Academy-র সর্বকনিষ্ঠ স্নাতক সে (নীচে ছবিতে)।
আগামী ২০৩০ সালে তাকে মঙ্গল গ্রহে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে আমেরিকার নাসা। মহাকাশে প্রায় আট কোটি কিলোমিটার পথ রকেটে চড়ে পাড়ি দিতে সময় লাগবে প্রায় এক বছর। অর্থাৎ দুবছরেরও বেশী সময় লেগে যাবে মিশান শেষ করে পৃথিবীর বুকে ফিরে আসতে। ফিরে আসা যাবেই এমন কোনও নিশ্চয়তাও তো নেই।
মঙ্গলগ্রহে অক্সিজেন নেই। কনকনে শীত। রাতের তাপমাত্রা মাইনাস একশো (-১০০) ডিগ্রি। কিন্তু এই ছোট্ট অদম্য হাসিখুশি উচ্ছ্বল মেয়েটার সে-নিয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। এখনই সে মানসিকভাবে প্রস্তুত। যদিও হাতে আরও দশ বছর সময় আছে, কিন্তু ইতিমধ্যেই তার প্রাথমিক ট্রেনিংয়ের অনেকটাই সে শেষ করে ফেলেছে। এর মধ্যে আছে নাসার সাত-সাতটি বিশেষ প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের সবগুলো। এদিকে তার বাবার মন ক্রমে খারাপ হতে শুরু করেছে– হাসিখুশি মেয়েটা অতদূর যাবে, যদি সে ফিরতে না পারে, যদি আর তার সাথে দেখা না হয় এ-জীবনে!
(ক্রমশঃ)
Posted in: January 2021 - Serial, PROSE