যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে : নীলাব্জ চক্রবর্তী

যখন সবাই ছিল সংখ্যালঘু অথবা বাথরুমের জানলা থেকে চাঁদ দেখা যাচ্ছে

অষ্টাদশতম পর্ব

৩২

পুনর্ব্বার কেমন স্খলন স্খলন ভাবিতেছে একটি তিথির প্রকারভেদ এবং এইসকল স্বোপার্জিত অভ্যাস ও ধাতব মুগ্ধতাসমূহ। সাতিশয় আবশ্যক সে সমুদয় খননকার্য, বস্তুতঃ, স্বীয় অভ্যন্তরস্থ রুদ্ধতায়। অতএব, স্মৃতি এক নাতিশীতোষ্ণ অপরাহ্নবিশেষ যাহা অ্যাকশন বলিলে এক উপদ্রুত ক্যালেণ্ডার বরাবর নিরবচ্ছিন্ন এক শান্ত গলি। তুমি অর্থাৎ এক উপাসনাস্থল। তদনুরূপ প্রমিত ভাষাবৃক্ষ এবম্বিধ সাক্ষ্যতায়। এবং প্রতিদিন অধীত দৃশ্যার্জন ক্রমে এক ব্যবহার হইল উপায় হইল। কেন না যে অন্তর। অপেক্ষাকে স্বাদ করিতেছি। কেহ উপত্যকা বলিল এবং ম্লান অক্ষরসমূহ। ফলতঃ, বর্ণ, প্রকারান্তরে, যে ক্রমে এক অনিবার্য রাজনৈতিক সম্ভাবনায়। অহো, উপনীত সেইসব মুহূর্তেরা! উপবিষ্ট হইয়া চা পান করিবার এক বিপণীতে ঈষৎ লালাভ প্রাচীরগাত্রে লিপিবদ্ধ হইল ‘এই স্থলে কেহ কোনোরূপ রাজনৈতিক আলোচনা করিবেন না।’ বস্তুতঃ, আমাদিগের যাপন ব্যবহারকে সম্পর্ক করিতেছে আর সম্পর্ককে ব্যবহার। ন্যারেটিভে তারিখ পড়িতেছে। নীল। ক্যাম্বিসের স্মৃতিতে কেমন ঘন এক রৌদ্রাবকাশ পড়িতেছে। অভেদ্য। পুনরায় সে তিথি। ক্রমে, বিস্ময় বিস্ময়… মনুষ্য অর্থে তিন পরিমাণ অংশ স্মৃতি এবং একাংশ লবণাক্ত নীরমাত্র হইয়া। নৈকট্য, বস্তুতঃ, এক সাতিশয় “নিকটজন”, স্পষ্টই প্রতীয়মান, কেন না যে দ্রাক্ষাফল, ইত্যবসরে, কিঞ্চিদধিক অম্লতা ও মাধুর্যে, ক্রমেই, অনির্ব্বচনীয় হইতে হইতে এইসব অসমাপিকা…

# * # * #

— সর্ষের তেলে অমলেট ভাল হয়। আর, নামানোর ঠিক আগে অমলেটের পাশ দিয়ে চাটুর ওপর সামান্য তেল ঢেলে একটা খুন্তি নিয়ে অমলেটটার ওপর অল্প অল্প চাপ দিতে হয়… অমলেটটা, ফুলে ওঠে তখন… সে একেবারে অপূর্ব একটা ব্যাপার…

— আর একটু প্রশ্রয়… মানে, এই ধরো আর জাস্ট এএএকটুখানি প্রশ্রয় আর কী, বেশী না, অল্প একটু… এ কিন্তু আমি পেতেই পারতাম, কী বলো?

— দ্যাখো, কবির দালাল তো আর কবি হয় না… ইনফ্যাক্ট, কবির দালাল কবি হবে না, এটাই স্বাভাবিক, তাই না? দালাল কী করে কবি হবে! তবে, ফ্যাসিস্টের দালাল কিন্তু ফ্যাসিস্টই… হবেই…

— আমার একটা টাইম মেশিন লাগবে…

— মোস্টলি, পরিচিত মৃতমানুষদেরই দেখি স্বপ্নে… আর, ধরো, যেখানে কখনও আর যেতে পারব না, বা যে জায়গাগুলো হারিয়ে গেছে, পুরোপুরি অন্যরকম হয়ে গেছে, সেগুলো দেখি…

— কবিতা বানান দিয়ে লেখা হয় না। শব্দ দিয়েও না। এবং, কবিতা ভাষা দিয়েও লেখা হয় না। এবার তুমি আমায় মারবে, বা খিস্তি দেবে। বুঝতেই পারছি। বিরক্তও হচ্ছ হয়ত… তবে এটাই ঘটনা কিন্তু। কবিতা আসলে কবিতা দিয়েই লেখা হয়। দাঁড়াও দাঁড়াও, এটা খুব ন্যাকা-ন্যাকা শোনাচ্ছে বুঝি? বেশ, বড়জোর এভাবে বলা যায়, কবিতা সিনট্যাক্স দিয়ে লেখা হয়…

— বলো কী! সত্যি সত্যিই তোমার প্রথম বইয়ের দঅঅঅশ বছর হয়ে গ্যালো?

— দেখবে, ভোটের ঠিক আগে ফাঁপা অথচ উগ্র জাতীয়তাবাদের পিনিক তোলার জন্য নিশ্চয়ই আবার চীন কী পাকিস্তান কারো সাথে সীমান্ত সীমান্ত যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হবে একচোট… এনটায়ার মিডিয়া সেই নিয়ে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে…

— সে কী গো! শীতকাল ভাল লাগে না তোমার?

— তুমি তো নিজেই একটা জ্যান্ত বিপ্লব… একটা… একটা জ্যান্ত কবিতা…

— বালের মতো কথা বোলো না তো…

— আচ্ছা, এরপর আবার কবে একাদশী পড়ছে?

— মাইরি ফাইরি বলে আর কী হবে… খৈনী খাওয়া তো ধরোইনি কখনও, ছাড়বে কী করে? হা হা…

— নিজের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আসলে। মাইলস্টোন বলে কিছু নেই তো… একটা একটা গাছ… দেখি…

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =
যখন আমরা সবাই একটা সিনেমার মধ্যে
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

৩৩

পেপস লাল জেল টুথপেস্ট

বছর পঁয়ত্রিশ আগে আমাদের বাড়িতে টেলিভিশন আসে। তার কিছু পরে আসে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। সেদিন আমার জ্বর, গাভাসকারেরও। নিউজিল্যাণ্ডের সাথে খেলা। গাভাসকার সেঞ্চুরী করলেন। একদিনের ক্রিকেটে ওঁর একমাত্রটি। সেদিন হ্যাট-ট্রিক করেছিলেন চেতন শর্মা। মনে আছে। যেমন, মনে আছে, ‘রামায়ণ’ চলতো রোববার সকালবেলা। পরে, ‘মহাভারত’। ক্রিকেট খেলা শুরু হতে দেরী হয়ে যেত। ছিল সপ্তাহে একদিন হিন্দি সিনেমা আর একদিন বাংলা। রোববার দুপুরে ভারতের কোনও না কোনও আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা। ছোট একটা অ্যান্টেনা আর গোলমতো একটা বাক্স ব্যবহার করলে এই টিভিতে বেলঘরিয়ার প্রফুল্লনগরে বসেও বাংলাদেশের প্রোগ্রাম দেখা যেত দিব্যি। আটের দশকের শেষদিকে আর নয়ের দশকের একদম শুরুর দিকের সেসব দিনে বাংলাদেশের চ্যানেল দেখার জন্য ধাতুর তৈরী দ্বিমুখী সিস্টেম ব্যবহার করা হতো। তাকে টেকনোলজিক্যাল পরিভাষায় কী বলা হত ভুলে গেছি! আংটা টাইপের এক জিনিস। তাকে তুলে এদিকে বসালে কলকাতা-দিল্লীর প্রোগ্রাম আর ওদিকে বসালে ঢাকার প্রোগ্রাম। ঈদের নাটক হতো, সিরিয়াল দেখতাম বহুব্রীহি আর দেখতাম খালামণির গানের আসর। মণ্টি-মিঠু নামের দুটি পুতুল কি ওই প্রোগ্রামেই থাকত? মনে নেই ভাল, স্মৃতি তো এক দুরারোগ্য নদী। বিকেলবেলা সেই প্রোগ্রামের আগে বা পরে মাগরেবের আজান হতো। সুন্দর গম্ভীর পুরুষকণ্ঠ গমগম করতো… ‘নিশ্চয়ই তুমি ভঙ্গ করোনা অঙ্গীকার…’। ঢাকা টিভির বিজ্ঞাপন মনে পড়ে। মনে পড়ে বিজ্ঞাপনের সুর… কোকোলা লজেন্স… পেপস লাল জেল টুথপেস্ট… হ্যালো, তোমার মনে আছে ওই সুর? ‘পেপস লাল জেল টুথপেস্ট!’…

= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

তিনখানি উপযুক্ত প্লট ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় আছে… একটি করে ছোটগল্প, বড়গল্প ও উপন্যাসের প্লট… আগ্রহী লেখকরা সরাসরি যোগাযোগ করবেন… দালাল নিষ্প্রয়োজন
= = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = = =

নীল ডায়েরিতে ২২/০৪-এর এন্ট্রি

আজ বাইশে এপ্রিল। ২২/০৪। কি মনে করে হাতের কাছে থাকা একটা বইয়ের ২২ নম্বর পাতায় গেলাম। সেই পাতার ৪ নম্বর লাইনটা পড়লাম। লেখা আছে, ‘একটা কাগজ উড়ছে ললিত মাখা’। আচ্ছা। হাতের কাছে থাকা আরও কয়েকটা কবিতা আর গদ্যের বই খুলে ফেললাম। তাদের প্রত্যেকের ২২ নম্বর পাতায় গিয়ে ৪ নম্বর লাইন লক্ষ করি। সেই লাইনগুলোর পুরোটা বা অংশ পরপর জুড়ে গেলে এরকম দাঁড়ালো ব্যাপারটা —

“একটা কাগজ উড়ছে ললিত মাখা
সিনেমার ভাষা সেটাকে প্রত্যক্ষ রূপ দিতে পারে
যখন আমরা রাজোদ্যান পথ থেকে নেমে আসছি
যা কিছু ভিতর বাহির
সোজা ঢুকে পড়া আজ সার্থক হল
পাখিদের গানে স্বপ্নের ভোর হচ্ছে খুব
পা ফেলতেই পা বলছে এরকম নয় অন্যরকম রাখো”

অবিশ্বাস্য লাগে আমার পুরো ঘটনাটা। হয় নাকি এরকম? হ’তে পারে নাকি? বয়স হচ্ছে আমার। বিস্মিত হই। এ-ও সম্ভব! যাই হোক, বইগুলোর নাম, যথাক্রমে — ঋতু দ্বিপ্রহর, বিষয় চলচ্চিত্র, আনীলের জার্নাল ও অন্যান্য রচনা, জুলাইওয়ালা, পুব আর ফুরোয় না, ছায়া পিয়ারি এবং উদ্দেশ্য বিধেয়। বিশ্বাস না হয় মিলিয়ে দেখুন। ভাল কথা, ওই বইগুলির লেখকেরা, যথাক্রমে — শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়, আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল ঘোষ, বারীন ঘোষাল, দেবাদৃতা বসু এবং প্রবীর রায়।

(চলবে)

Facebook Comments

Leave a Reply