মণিদীপা সেন-র গদ্য

আত্মচারণাঃ ভোর পাঁচটা প্রায়। অন্ধকার নিস্তব্ধ ঘর৷ এক কপাট খোলা জানলায় শ্যাওলা ধরা আকাশের ডাক আর হালকা রঙচটা আলো, ফুটছে; সাথে অবিরাম বৃষ্টির মাটি ছোঁয়ার শব্দ। চোখ বুজে, বহুদিন আগের রোগা রোগা, গুমসানো মনখারাপ মনে পড়ে। জামাকাপড়ে তখন চটক নেই, লাবণ্য ছিল। চুলের নেমে যাওয়া লম্বা সরলতা আর সবেতেই হালকা ভয় পাওয়া চোখ, যাকে তাকে ভরসা করে বন্ধু ভেবে ফেলার মতো বোকা আত্মবিশ্বাস, হঠাৎ ভালোলাগাটুকুতে স্পন্দন স্তব্ধ করা অনুভূতি। এসব আর হয় না এখন। শুধু কিছু মুহূর্ত মনে আসে। হালকা অথচ কত গভীর ছিল তার অভিঘাত!
জীবনে একবারই ওই সময়টায়, একজনের জন্যই ভাত রান্না করা সম্ভব হয়। কেউ কেউ তা করার সুযোগ পায়। সে জানে না, এই সবটা সাজিয়ে গুছিয়ে থালায় পরিবেশন করার খেলাটা একবারই হয়। যার জন্য করা, সে শেষ পর্যন্ত না খেয়ে শুধু ভাতের সুঘ্রাণটুকু নিয়ে উঠে চলে যায়। ওই পাতে এরপর হাজার জন এসে বসে। কিন্তু ভাতের হাঁড়ির ঢাকা খোলার সাথে সাথেই সেই টাটকা সেদ্ধ গন্ধ আর তৈরি করা যায় না। সারাজীবন চেষ্টা করা যায় শুধু।
কৈশোর…বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাখিদের আলোয়ান গায়ে দিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকি তার দিকে। আসলে সেই আকাশ- তার পাখোয়াজি দ্রিম, কাঠের ঝুমঝুমির মতো বেজে চলা বৃষ্টি …যেটুকু নিটোল গোল ঘুঙুরের এক আধফোটা কলি আঁকড়ে রাখে, সেটুকুই বেঁচে থাকা। একটু ফাঁক পেলেই, পাপড়ি আর একটু ফুটে গেলেই, গল্প শেষ।

কোয়ারেন্টিনঃ… একটা ভেনিসিয়ান শব্দ কোয়ার্যান্টা থেকে এসেছে যার অর্থ চল্লিশ। যেকোনো মহামারী বা রোগ প্রকোপ কালে ইটালির ভেনিস বন্দরে বাইরের থেকে আগত জাহাজের নাবিকদের বন্দরেই চল্লিশ দিন ধরে থাকা- খাওয়ার ব্যবস্থা করা হত যাতে তাদের সাথে অজান্তে আসাও প্লেগ ইত্যাদি রোগের প্রকোপ ইটালির শহরের ওপর না পড়ে। তা সেই কোয়ার্যাকন্টা শব্দ থেকেই এসেছে কোয়ারেন্টিন শব্দটা।
আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশের ঘটনা বা ভাষা থেকে উদ্ভূত, সেখানেই সঠিক সময়ে কোয়ারেন্টিন শব্দটার বাস্তবিক প্রয়োগ না করায় এত মানুষ মহামারীর কবলে পড়ল এবং মৃত্যুই তাদের কাছে শেষ দরজা প্রতিপন্ন হল।

মহামারী। এও এক অদ্ভুত ব্যাপার। সময়ের এক আশ্চর্য অধ্যায়। ইতিহাস বলে, প্রতি একশো বছর অন্তর এক প্রবল মহামারী আসে এবং কিছু অর্থে, আমার মনে হয়, তা প্রাকৃতিক। মনুষ্য জাতির অকালবৃদ্ধি রোধ করতে প্রকৃতি কি নিজেই এই একশো বছর অন্তে একটা মহামারীর চৌকাঠ রচনা করে রেখেছে? যা হয়ত ভারসাম্যের কাঁটা ঠিক রাখছে?

চৌকাঠ। আরও এক গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। পৃথিবীর প্রতিটা গল্প শেষ হয় ও শুরু হয় অথবা নতুন কোনো গল্পের দিকে ঘুরে যায়, একটা চৌকাঠের কিনারা থেকে। এই অর্থে যে কোনো কিনারাই খুব গুরুত্বপূর্ণ গল্প রচনা করে। সেই কিনারা কোনো দেশের হোক, পাহাড়ের হোক বা নোনা জল থেকে মিষ্টি জলে যাওয়ার সেই ফাইন লাইনটা হোক, যা একমাত্র মাছেরা জানে। আর জানে মেছুরেরা।

আলো ও দোলাচলঃ হীরের চমকের উৎস আলো আর আলোর উৎস আঁধার… আঁধারের এক পোঁচ, দুই পোঁচ পেরিয়ে ফুটি ফুটি ঔজ্জ্বল্য… যাতে পথ দেখা যায়। ফিরে আসে কাছের লোক। আলোর সার্থকতা এখানেই। জীবনের মূল যাত্রা, তার পথ, আর সেই পথের আলো – প্রবেশ করে মাটির গহীনে; হাজার বছরের মৃত্যুর টুকরোয় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে।

আমার কাছে আলো এমনই। আমার ভেতরের যে হুবহুকে আমি গলা টিপে রাখি, চুপ করিয়ে রাখি, বলি, ” না, দেরি হয়ে গেছে। সব রূপকথা আচরণ বন্ধ করো”, সে, এই আলো, পাথর আর অন্ধকার নিয়েই যে আবর্তন, তা এড়িয়ে যেতে পারছে কই? আলোকে এড়িয়ে যেতে, পারছে কই? বিশ্বের অবস্থান যে অথৈ আঁধারে, তা মানতে, পারছে কই?

রিবনঃ

মাখন ও কুসুম ফেটিয়ে ক্লান্ত হুইস্কার
কেলাসিত বিকেল নিয়ে চঞ্চু উড়ে যায়

জড়িয়ে গেছে। খুব। তবু দেখা হওয়া কম। খুব। উৎসব খুঁজতে হয় ক্যালেন্ডার আগলে। কবে লেগে আছে তারিখের গায়ে বাসন্তী রঙ? কত শত ভাবি।
বৃদ্ধাঙ্গুল ও কনিষ্ঠার মতো আমরা; আর তার মাঝের যত দূরত্ব, সেখানে গল্প লেখা। সেটুকু পরিসরেই আকাশ, ঘুড়ি, আমাদের বিচ্ছেদের যোজন।
এ সংসার, হাতফেত্তা হয়ে থাকে আমাদের শরীরে।
তুই না থাকলে, আমি না থাকলে, এ সংসারের সব সুতোই
ভীষণ আলগা
খুঁটি হীন!

প্যারিসে বাঁধানোঃ  সিগারেটের আগায় গোলাপ ফুটে ওঠে সন্নিবিষ্ট টানে।
দুটো মানুষ, সঙ্গমরত অবস্থায়
গাছ হয়ে যায়

বৃষ্টিকে তুমি বন্ধ করতে পারো না। তার শব্দকে রোধ করতে পারো শুধু। তার শব্দ, পুরাতন গ্রামোফোনে রঙিন মার্বেলের হারিয়ে যাওয়ার গল্পের মতো, ভুলে যাওয়া কঠিন, ফিরে যাওয়াও।

Facebook Comments

Leave a Reply