হেমিংওয়েকে নিয়ে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একটা স্মৃতিচারণের অনুবাদ : জুয়েল মাজহার

গুরু হেমিংওয়েকে এক ঝলক দেখা : গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস

অনুবাদ: জুয়েল মাজহার

দেখামাত্র চিনে ফেললাম তাঁকে। ১৯৫৭ সালের বসন্তের এক মেঘলা দিনে স্ত্রী ম্যারি ওয়েলসকে নিয়ে পারির (Paris) সঁত মিশেল (Saint Michel) বুলভার ধরে চলেছেন। হেঁটে চলে গেলেন রাস্তার ওপাশটায়, লুক্সেমবুর্গ উদ্যানের দিকে; পরনে জরাজীর্ণ কাউবয়-পাতলুন, দীর্ঘ পশমি জামা আর মাথায় বলপ্লেয়ারদের টুপি। বেমানান মনে হচ্ছিল কেবল ধাতব রিমের ছোট্ট গোল চশমাজোড়া, যা অকালে তাঁর চেহারায় এনে দিয়েছে পিতামহসুলভ একটা ভাব। সবে তিনি ৫৬ বছরে পা রেখেছেন; আর তাঁর সুবিশাল বপুখানি বেঢপ হয়ে দৃশ্যমান। অবশ্য তাঁর অবয়বে জান্তব কোনও ভাব ফুটে ওঠেনি। আর অবধারিতভাবে সেটাই তাঁর কাম্য ছিল; বিশালকায় বপুর তুলনায় তাঁর নিতম্বদেশখানা ছিল বেশ চিমসে। আর মোটা বুটজোড়ার —যা কেবল করাতিদের পায়ে মানায়– ওপর প্যাকাটির মতো শোভমান তাঁর দু’খানা পা। পথপাশের সারি সারি পুরনো বইয়ের দোকান আর সরবোর্নের তরুণদের স্রোতকল্লোলের ভেতর বেশ উৎফুল্ল আর চনমনে দেখাচ্ছিল তাঁকে। তখন কেইবা জানতো, তাঁর আয়ু বাকি আছে মাত্র চারটি বছর!

মুহূর্তের একটিমাত্র ভগ্নাংশের মধ্যে— সচরাচর যেমনটা হয়— নিজেরই দুই পরস্পরবিরোধী ভূমিকার জাঁতাকলে, এক উভয়-সংকটের মধ্যে পড়ে গেলাম আমি। কী করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। একটা সাক্ষাৎকার চাইবো, নাকি রাস্তা পেরিয়ে কাছে গিয়ে তাঁর কানে অকাতর প্রশংসা ঢালবো।

মস্তবড় এক সমস্যায় পড়া গেল। ওই সময়টায় আমি ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে কথা বলতাম —আজও সেভাবেই বলি; আর ”ষাঁড়-লড়াইয়ের স্প্যানিশ”-এর চলতি বুলি তাতে তাঁর নিজেরইবা কতোটা দৌড় সে বিষয়েও কোনো নিশ্চিত ধারণা ছিল না। তাই এ-দুটো কাজের কোনোটাই করলাম না— করলে বরং সবকিছু মাঠে মারা যেতো। আমি বরং মুখের সামনে দু্ই করতল জড়ো করে— জঙ্গলে টারজান যেমনটি করে— ওপাশের ফুটপাথ লক্ষ্য করে জোরসে চেঁচিয়ে উঠলাম: ‘‘মা-ই-য়ে-স্-ত্রোওওও !’’ আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বিলক্ষণ বুঝে গেলেন, এতো-এতো ছাত্রছাত্রীর ভিড়-জটলার ভেতরে আর কেউ নয়, তিনিই ‘গুরু’। ঝটিতি ঘুরে দাঁড়ালেন, হাতখানি উঁচিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে কাস্তিলিয়ান ভাষায় ছোট্ট বাচ্চাদের মতোন তিনিও চেঁচিয়ে উঠলেন: ”আদিয়স আমিগো”—‘‘বিদায়, বন্ধু!’’। এই একটিবারই তাঁকে চোখের সামনে দেখবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার।
ওই সময়টায় আমি ছিলাম ২৮ বছর বয়েসী এক সংবাদকর্মী; ততোদিনে আমার একটা উপন্যাস বেরিয়ে গেছে; আর আমি কলম্বিয়ায় একটা সাহিত্যপুরস্কারও বাগিয়ে নিয়েছি। অথচ পারিতে (Paris) তখনও আমি চালচুলোহীন, উদ্দেশ্যহীন আর ছন্নছাড়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার প্রিয় দুই সাহিত্যগুরুর দু’জনই উত্তর আমেরিকান ঔপন্যাসিক। যাদের মধ্যে তিলপরিমাণ সাদৃশ্য আছে বলে মনে হয় না। ওই সময়পর্বে প্রকাশিত তাঁদের যতো লেখাজোখা ছাপা হয়ে বেরিয়েছিল, সেসবের প্রায় সবই আমার পড়া হয়ে গেছে। তবে মোটেই তা পরিপূরক পাঠ ছিল না — বরং ছিল তার উল্টো। একদমই স্বতন্ত্র আর সাহিত্য-সম্পর্কে-ধারণা-লাভের জন্য অনেকাংশে সেই পঠনটুকুন ছিল বিপরীতধর্মী এক উপায়।

আমার দুই সাহিত্যগুরুর একজন হচ্ছেন উইলিয়াম ফকনার; যাকে আমি সামনে থেকে কখনো দেখিনি। কল্পনাই শুধু করতাম তাঁকে নিয়ে; তিনি যেন কার্টিয়ের ব্রেসোঁর তোলা সেই বিখ্যাত পোর্ট্রেট-ছবির লম্বা হাতাঅলা জামাপরা সেই কৃষক; পাশে ছোট্ট একজোড়া শাদা কুকুর নিয়ে যে কৃষক তার হাতখানা চুলকোচ্ছে।
অপরজন হচ্ছেন সেই ক্ষণজীবী পুরুষ, যিনি রাস্তার ওইপাশ থেকে এইমাত্র বিদায়সম্ভাষণ জানালেন আমাকে; তাতেই যেন সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটে গেছে আমার জীবনে। আর তা ঘটে গেছে চিরকালের জন্য। তিনি আমার ভেতরে এই বোধটুকু চারিয়ে দিয়ে গেলেন।

ঔপন্যাসিকেরা অন্য ঔপন্যাসিকদের উপন্যাস পড়েন স্রেফ লিখন-প্রক্রিয়াটুকু কি সেটা পরখ করে দেখতে ও বুঝতে। জানি না কথাটা কে বলেছিলেন। কথাটাকে সত্যি বলেই বিশ্বাস করি আমি। যে গোপনীয়তাকে শাদা পৃষ্ঠার ওপরে খুলে-মেলে অনাবৃত করা হয়েছে, তা দিয়ে আমাদের মন ভরে না ; আমরা বইটাকে নেড়েচেড়ে দেখি, এর সেলাই করা অংশটা অব্দি উল্টেপাল্টে দেখি। ব্যাপারটাকে এককথায় বুঝিয়ে বলা অসম্ভব। আমরা বইটাকে খুলে-মেলে দিয়ে এর অপরিহার্য অংশগুলোকে মনেমনে আলাহিদা করে নিই ; এরপর এমন একটা সময় আসে যখন আমাদের মনে হয়, বইটির নিজস্ব চলনঘড়ির সব রহস্য আমরা জেনে-বুঝে ফেলেছি। আমরা তখন ফের একে জোড়া লাগাই। ফকনারের বই নিয়ে একাজটা করতে গেলে হতাশই হতে হবে; কেননা লেখালেখির কোনো বাঁধা গৎ তিনি একদমই মেনে চলতেন না; বরং অন্ধের মতো নিজস্ব এক বাইবেলীয় জগতের ভেতর দিয়ে তিনি হেঁটে চলতেন; —অনেকাংশে সেই ছাগপালের মতো, যে ছাগপাল স্ফটিকের পণ্যঠাসা কোনো বিপণিতে আতকা ঢুকে পড়ে মেতে উঠেছে তাণ্ডবে।কেউ যদি তাঁর লেখা কোনো একটি পৃষ্ঠাকে কাটাছেঁড়া করতে সক্ষম হয়ও, তথাপি সে দেখতে পাবে সেখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে স্প্রিং আর স্ক্রু ; সেসবকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব।

এর বিপরীতে, হেমিংওয়ে তুলনামূলকভাবে কম প্রেরণা, কম ভাবাবেগ আর কম বাতিকগ্রস্ত ছিলেন।
এ-সত্ত্বেও অত্যুজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় স্ক্রুগুলোকে তিনি আগাপাশতলা খুলে-মেলে ধরেছিলেন। মালটানা গাড়ির স্ক্রু-র মতোন। হয়তো এ-কারণেই লেখক হিসেবে ফকনার সবচে’ বেশি প্রভাবিত করেন আমাকে; কিন্তু হেমিংওয়ে প্রভাবিত করেন আমার লিখনশৈলীকে। সেটা কেবল তার লেখা বই দিয়ে নয়; বরং লিখনশৈলীর বিষয়ে তাঁর বিস্ময়জাগানো জ্ঞানগম্যি দিয়ে।

পারি রিভিউতে (Paris Review) জর্জ প্লিমটনকে (George Plimpton) তিনি দিয়েছিলেন এক ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি সৃজনশীলতার ভাবালু ধারণার (Romantic notion) বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিলেন। স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিলেন আর্থিক সাচ্ছন্দ্য আর সুস্বাস্থ্য দুটোই লেখালেখির পক্ষে সহায়ক ভূমিকাই পালন করে; শব্দকে যথাযথভাবে বিন্যস্ত করাই হচ্ছে আসল কথা; লেখার কাজটা যখন কঠিন হয়ে পড়ে তখন নিজের বইগুলোকে আবার পড়ে নেওয়া ভালো। লেখালেখি সর্বদাই যে একটা দুরূহ কাজ, সেটা নিজেকে মনে করিয়ে দেবার জন্যই এটা করা জরুরি; যতক্ষণ কেউ দেখা করতে না আসে বা কোনও টেলিফোন কল না থাকে সে অব্দি যেথা-ইচ্ছে বসে লেখালেখির কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়; সাংবাদিকতা লেখালেখির বারোটা বাজায় —এমন একটা আপ্তবাক্য বাজারে বেশ চালু। কথাটা একদমই ঠিক নয়। উল্টোটাই বরং সত্যি।

যতক্ষণ না কেউ একে দ্রুত পেছনে ফেলে এগোয় ততোক্ষণ। তিনি বলেছিলেন, ”লেখালেখি যখন হয়ে ওঠে সবচে’ বড় অশুভ আর সর্বোত্তম আনন্দ, তখন কেবল মৃত্যুই পারে এতে চিরতরে ছেদ টেনে দিতে।’’
শেষমেষ তিনি আবিষ্কার করলেন, পরের দিন কোন জায়গা থেকে শুরু করতে হবে তা জানার আগ পর্যন্ত লেখায় ছেদ টানা যাবে না, বিরতি টানা যাবে না। আমি মনে করি না, লেখালেখি নিয়ে এর চেয়ে বড় কোনও হিতোপদেশ কখনো দেওয়া হয়েছে। এ-হচ্ছে গিয়ে লেখকদের সামনে— স্বরূপে আবির্ভূত সবচে’ কিম্ভুত প্রেতের প্রাপ্য—- সর্বোত্তম নিদান; — একরত্তি কমও না, আবার বেশিও না;
সেই প্রেত আর কিছু নয়, বরং হলো সেই প্রেতটি হচ্ছে প্রত্যেক সকালবেলায় শাদাপাতার মুখোমুখি হওয়ার যাতনা।

হেমিংওয়ের সমুদয় সৃষ্টিকর্ম থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর প্রাণশক্তির প্রখর উজ্জ্বলতা সত্ত্বেও তা ছিল স্বল্পায়ু, ক্ষণজীবী।কারণটাও সহজেই অনুমেয়। টেকনিকের অতি-বাড়াবাড়ি, তাঁর ভেতরের উত্তেজনা আর স্নায়ুচাপকে উপন্যাসের বিরাট-বিপুল আর অতি-ঝুঁকিবহুল পরিসীমায় জিইয়ে রাখা ছিল এক অসম্ভব কর্ম। অবশ্য এই ছিল তাঁর স্বভাবধর্ম। আর নিজের ‘উজ্জ্বল সীমাবদ্ধতা’কে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাও ছিল তাঁর তরফে মস্ত এক ভুল। অন্য যে কোনও লেখকের চেয়ে তাঁর ছিল বাহুল্যদোষের বাড়াবাড়ি; যা আমাদের চোখে প্রকট হয়ে ধরা দেয়। তাঁর খাপছাড়া আর বাহুল্যদুষ্ট উপন্যাসগুলো যেন ছোটগল্পের মতো। বিপরীতে, তাঁর গল্পগুলোর সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, এরা কিছু-একটা-নেই —এমন ধারণা দেয়; এখানেই নিহিত এদের সুন্দরতা আর রহস্যময়তা। আমাদের কালের মহৎ লেখকদের একজন হোর্হে লুইস বোর্হেসেরও রয়েছে একই রকম সীমাবদ্ধতা। তবে সে সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম না করবার জরুরি কাণ্ডজ্ঞানটুকু বোর্হেসের ছিল।

ফ্রান্সিস ম্যাকম্বারের এক-গুলিতেই-ঘায়েল হয়েছিল সিংহ। এতেই শিকারবিদ্যার কতোকিছু বলা হয়ে যায়! বলা হয়ে যায় লেখালেখির ব্যাকরণ সম্পর্কে মোদ্দা কথাটাও। নিজের একটি গল্পে হেমিংওয়ে লিখেছেন, লিরিয়ার ষাঁড়টি মাতাদোরের বুক ঘেঁষে তীব্র বেগে ছুটে যাবার পরপরই ‘‘কোণঠাসা বেড়ালের মতোন’’ ফিরে আসে। আমি মনে করি, এই পর্যবেক্ষণটাই হচ্ছে প্রেরণাসঞ্জাত বোকামিগুলোর একটি, যা সবচে’ চমৎকার আর সবচে’ অনুপম লেখকদের কাছ থেকেই কেবল আসতে পারে। এরকম সরল আর চোখ-ধাঁধানো আবিষ্কারেই ভরপুর হয়ে আছে হেমিংওয়ের সৃষ্টিসম্ভার; যেগুলো এই যুক্তিই তুলে ধরে, যে-যুক্তিবলে তিনি সাহিত্যিক লেখালেখির সংজ্ঞাকে মেলান। যুক্তিটা হচ্ছে, আইসবার্গের মতোন লেখাটিরও ভিত মজবুত তখনই হবে, যখন কিনা দশভাগের সাত-আট ভাগ থেকে যাবে আড়ালে।

এহেন আঙ্গিক-চেতনা সম্বল করে রচিত উপন্যাস হেমিংওয়েকে কোনও গৌরবমুকুট এনে দেবে না— একথা প্রশ্নাতীত। বরং তাঁর লেখার গৌরব নিহিত রয়েছে সুশৃংখল গল্পগুলোতে। ‘‘ফর হোম দ্য বেল টোলস’’—এর ব্যাপারে তিনি বলেছিলেন, বইটি কিভাবে সাজাবেন সে-ব্যাপারে আগাম কোনও ধারণা তাঁর ছিল না। বরং লিখতে-লিখতে তিনি একে একটু-একটু করে আবিষ্কার করেছিলেন তা। ”এ আর এমন কী!”— এমন কথা তাঁকে বলতে হয়নি।
বিপরীতে তাৎক্ষণিক প্রেরণা-বশে-লেখা তাঁর ছোটগল্পগুলো অনুপম আর নিখুঁত। মাদ্রিদের এক সরাইখানায় বসে মে-মাসের এক পড়ন্ত বিকেলবেলায় রচিত তিনটি ছোটগল্পের কথা বলা যায়। তুষারঝড়ের কারণে বন্ধ করে দিতে হয়েছিল সান ইসিদ্রো উৎসবের ষাঁড়লড়াই। এ-ধারার গল্পগুলোর
কথাই তিনি বলেছিলেন জর্জ প্লিম্টনকে (George Plimpton) —– ‘‘দ্য কিলারস’’ (”The Killers,”),”), ‘‘টেন ইন্ডিয়ানস” (”Ten Indians”) এবং ‘‘টুডে ইজ ফ্রাইডে ’’ (”Today Is Friday” ); সবক’টিই ছিলো প্রতিনিধিত্বশীল কাজ। এধারার গল্পগুলোর মধ্যে তাঁর নিজের পছন্দের একটি গল্প হচ্ছে ‘‘বৃষ্টিতে বেড়াল’’(Cat in the Rain); এতে তাঁর ক্ষমতা সবচেয়ে সংহত আর ঘনীভূত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এটি তাঁর সবচেয়ে ছোট কলেবরের গল্পগুলোর একটি।

‘আখ্যানের পরিহাস’ বলে বিবেচিত তাঁর সবচে অসফল গল্পটিই হচ্ছে আমার বিবেচনায় সবচে অনুপম আর মানবিক গল্প: ‘অ্যাক্রস দ্য রিভার অ্যান্ড ইনটু দ্য ট্রিজ” (Across the River and Into the Trees)। তিনি নিজে যেমন বলেছেন, গল্পের আকারে শুরু হ’য়ে এটি উপন্যাসের ম্যানগ্রোভ অরণ্যে পথ হারিয়েছে, অধ:পতিত হয়েছে। এমন নিপুণ টেকনিশিয়ানের হাতে, বর্ণমালার ইতিহাসে সবচে’ মেধাবী সোনারুদের একজনের হাত দিয়ে সাহিত্যিক কারিগরির দিক থেকে এতো বেশি ত্রুটি, আঙ্গিকের এতো বেশি ফাঁক-ফোকর আর কৃত্রিম, আড়ষ্ঠ-প্যাঁচালো সংলাপ কীভাবে যে রচিত হলো বোঝা বড়ো দায়!

১৯৫০ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর চারদিকে প্রচণ্ড বিরূপ আর অন্যায় সমালোচনার তুবড়ি ছুটল; আর হাভানা থেকে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তিনি পাঠালেন এক আবেগময় তারবার্তা; যা ছিল তাঁর মতো মহান লেখকের জন্য চরম অমর্যাদাকর। এটা তাঁর সেরা উপন্যাসই শুধু ছিল না, সেইসঙ্গে ছিল সবচে’ ব্যক্তিগতও; এটি তিনি লিখেছিলেন এক অনিশ্চিত শরৎকালের শুরুতে, ‘ফিরে-পাওয়া-অসম্ভব’ সেইসব দিনের স্মৃতিকাতরতা নিয়ে। আর কোনও বইতে এতোটা নিবিড় করে পাওয়া যায় না তাঁকে; এমন সৌন্দর্য, এমন কোমলতা সত্ত্বেও আপন জীবন ও কর্মের অপরিহার্য ভাবাবেগকে, বিজয়ের অর্থহীনতাকে রূপ দেওয়ার সঠিক উপায় খুঁজে পাননি তিনি। তাঁর নায়কের শান্তিপূর্ণ আর স্বাভাবিক মৃত্যুর এমন ভণিতাময় উপস্থাপনা ছিল তাঁর আত্মহত্যারই এক ছদ্ম পূর্বাভাস।

লেখকের কাজ নিয়ে, এমন তীব্র সংরাগ নিয়ে এতো সুদীর্ঘকাল কেউ যখন বেঁচে থাকে, তখন তাঁর কল্পনা ও বাস্তবে ফারাক করবার ক্ষমতাটি লুপ্ত হয়ে যায়। সঁত মিশেল প্যালেসের ওই কাফেতে কতো দিন, কতো-কতো ঘন্টা যে কাটিয়েছি আমি! ওই কাফেটাকে লেখালেখি করবার জন্য উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচনা করতেন তিনি। জায়গাটাকে তাঁর মনে হতো চমৎকার, উষ্ণ, পরিচ্ছন্ন আর অনুকূল; আর আমি সবসময়ই আশা করতাম তাঁর-দেখা সেই তরুণটিকে উদ্দাম, হিমেল, হাওয়া-উত্তাল দিনে অবিকল সেই জায়গাটায় ফের আমি দেখতে পাবো। খুবই সুষমাময়, লাবণ্যমাখা চেহারা ছিলো ওর। কাকের পাখনার আদলে মুখের ওপর আড়াআড়িভাবে লেপ্টে থাকতো অলকদাম। ‘‘তুমি আর পারি (Paris) —দু্ই-ই আমার,’’—ওকে, সেই তন্বীকে, উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন তিনি; লিখেছিলেন কোনও-কিছুকে-একান্ত-নিজের-করে-পাবার বিরামহীন সেই ক্ষমতা নিয়ে। যে ক্ষমতা ছিলো তাঁর লেখায়। যা কিছু উঠে এসেছে তাঁর বর্ণনায় প্রতিটি পল-অনুপলে, চিরকালের জন্য তা হয়ে গেছে তাঁর একান্ত নিজের।

যতোবারই পারির(Paris) ১২ নম্বর রু দ্য আই’দিওঁর পাশ দিয়ে গেছি, তিনি সিলভিয়া বিচের সঙ্গে বইয়ের দোকানটায় বসে তিনি আলাপে মগ্ন নন —- আমি আমার মানসচক্ষে এমন দৃশ্য একবারও দেখিনি; সেই দোকানটা এখন আর আগের মতোন নেই। সন্ধে ৬টা অব্দি তিনি সেখানে কাটাতেন। আর এক ফাঁকে সেখানে এসে ঢুঁ মেরে যেতেন স্বয়ং জেমস জয়েস। কেনিয়ার বিস্তৃত তৃণভূমির—যা তিনি জীবনে একবারমাত্র দেখেছিলেন– সবক’টি মোষ আর সিংহের মালিক বনে গিয়েছিলেন। আর বনে গিয়েছিলেন শিকারের একান্ত গোপন সব বিষয়ের অধীশ্বর। হয়ে উঠেছিলেন প্রত্যেক বুলফাইটার আর প্রাইজফাইটারের অধীশ্বর। হয়ে উঠেছিলেন প্রত্যেক ক্ষণজীব শিল্পী আর বন্দুকধারীর সদগুরু; তারাও হয়ে উঠেছিল একান্তই তাঁর নিজের লোক। ইতালি, স্পেন, কু’বা (Italy, Spain, Cuba)—স্রেফ তিনটে নামের উল্লেখ করেছিলেন তিনি; আর তাতেই গোটা দুনিয়ার অর্ধেকটাই হয়ে গেল তাঁর।

হাভানার খুব কাছের ছোট্ট গ্রাম কোহিমারে(Cojimar )—যেখানে বাস করতো ‘‘দ্য ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’’র নি:সঙ্গ বুড়ো জেলে— তাঁর বীরত্বগাথার বর্ণনা করে একটি স্মৃতিফলক আছে; পাশেই আছে গিল্টিকরা তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি। কু’বায় (Cuba) তাঁর ডেরা ফিংকা দে লা ভিগিয়ায় (Finca de la Vigia) — মৃত্য পর্যন্ত যেখানে তাঁর অন্তিম দিনগুলো কেটেছে— ছায়াদায়ী তরুদের ছায়া গায়ে মেখে তাঁর সেই বাড়িটা বিচিত্রসব বইপত্রের বিপুল সংগ্রহ নিয়ে রয়ে গেছে সেই আগেরই মতো। তাঁর শিকারের ট্রফি, তাঁর পড়ার ঢালু ডেস্ক, তাঁর বিশাল বুটজোড়া, সারা দুনিয়ার নানা-প্রান্ত-থেকে-সংগ্রহ-করা আর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সযতনে-আগলে-রাখা নানা টুকিটাকি জিনিস নিয়ে; এসবের ওপর তাঁর জাদুকরি মালিকানা আজও অটুট। তিনি এসবের ভেতর পুরে দিয়ে গেছেন আত্মা; আর সেই আত্মাই তাঁর উপস্থিতি ছাড়াই আজও এগুলোকে রেখেছে জীবন্ত।

বছরকয় আগে আমি ফিদেল কাস্ত্রোর–যিনি সাহিত্যের এক পাঁড় পাঠক—গাড়িতে চডি; সে-গাড়ির সিটের ওপর চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা লালরংয়ের ছোট্ট একটা বই দেখতে পাই। ‘‘এ হচ্ছে গিয়ে আমার গুরু হেমিংওয়ের বই” —আমাকে বললেন কাস্ত্রো। আসলেই, লোকে যেখানটায় তাঁকে দেখতে চায়, মৃত্যুর ২০ বছর পর সেই সমীহের জায়গাটিতে আজও সমাসীন আছেন হেমিংওয়ে; একইসঙ্গে স্বল্পায়ু আর চিরজীবী সেই সকালবেলায় যেমনটি আমি তাকে দেখেছিলাম— হয়তো সেটা ছিল মে মাস— সঁত মিশেল বুলভারের ওই পাশ থেকে তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে বলছেন:
“আদিয়স, আমিগো!”——”বিদায়, বন্ধু।”

(২৬ জুলাই, ১৯৮১)।

#
[গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের এ-লেখাটি মূল স্প্যানিশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন ‘‘দ্য টাইমস’’ কালচারাল নিউজ ডেস্কের কর্মী র‌্যান্ডল্ফ হোগ্যান (Randolph Hogan)। সে-লেখারই বাংলা অনুবাদ]]

Facebook Comments

Leave a Reply