হাসন রাজা ও তাঁর গান : ইন্দ্রনীল সান্যাল
অবিভক্ত বাংলার মরমী কবি-বাউলদের মধ্যে কুষ্টিয়ার লালন শাহ বা লালন ফকিরের নাম আমাদের কাছে অনেক বেশি পরিচিত। তুলনায় শ্রীহট্ট বা সিলেটের হাছন রাজা বা হাসন রাজার কথা এপার বাংলায় অনেক কম আলোচিত ও চর্চিত। কিন্তু কাব্যগুণে ও দার্শনিক গভীরতায় হাসন রাজা লালন ফকিরকেও কখনো বা ছাপিয়ে গেছেন। বাংলাদেশে সর্বজন পরিচিত নাম হলেও পশ্চিমবঙ্গে হাসন রাজা ও তাঁর গান কবিতা ও মরমীয়া দর্শন সেভাবে চর্চিত হয়নি। অথচ এমনটি হবার কথা ছিলনা, কারণ সেই ১৯৩০ সালেই অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ভাষণ প্রদানকালে রবীন্দ্রনাথ হাসন রাজার কথা উল্লেখ করে বলেছেন “ We realize it through admiration and love, through hope that soars beyond the actual, beyond our own span of life into an endless time wherein we live of all men…….It is a village poet of East Bengal who preaches in a song the philosophical doctrine that the universe has its reality in its relation to the Person.”
হাসন রাজার পরিচয়
হাসন রাজার জন্ম ৭ পৌষ, ১২৬১ বঙ্গাব্দ (২১ ডিসেম্বর, ১৮৫৪) অবিভক্ত সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমার লক্ষণশ্রী পরগনার তেঘরিয়া গ্রামের এক জমিদার দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরীর পরিবারে। সেই সময়কার অধিকাংশ মুসলমান পরিবারের মতই হাসন রাজার পূর্বপুরুষরাও ছিলেন হিন্দু। হাসন রাজার পূর্বপুরুষরা মুঘল আমলে তৎকালীন অযোধ্যা প্রদেশ থেকে বাংলায় এসে প্রথমে কিছুদিন যশোরে বসবাস করে পরে সিলেটে এসে পাকাপাকি ভাবে বাস করতে থাকেন। তাঁর এক পূর্বপুরুষ রাজা বীরেন্দ্র চন্দ্র সিংহদেব সিলেট সুনামগঞ্জ এলাকায় বড় জমিদারির পত্তন করেন। জাতে ক্ষত্রিয় বীরেন্দ্র চন্দ্র রাজা বাবু রায়চৌধুরী নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। পরে তিনি ইসলাম ধৰ্ম গ্রহণ করে রাজা বাবু খান চৌধুরী নাম নেন। হাসন ছিলেন তাঁর পিতা আলী রাজা ও তাঁর পঞ্চম পত্নী হুরমত জাহাঁ বিবির প্রথম সন্তান।
জমিদারি দেখাশোনার কাজে পিতা বেশিরভাগ সময় ৩০ মাইল দূরে বিশ্বনাথ পরগনার রামপাশা গ্রামে থাকতেন বলে হাসনের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতে মায়ের কাছেই হয়েছিল। এই মায়ের কাছেই হাসনের ধৰ্ম শিক্ষাও হয়েছিল। পরিণত বয়সে হাসনের মানসিক পরিবর্তনেও তাঁর মায়ের প্রভাব ছিল অনস্বীকার্য। খুব বেশি প্রথাগত শিক্ষা না থাকলেও হাসন বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষা শিখেছিলেন। তাঁর বাংলা হাতের লেখাও ছিল খুব সুন্দর। বাংলায় “দেওান হাছন রাজা চৌধুরি” হিসেবে স্বাক্ষর করলেও আরবিতে হাসন রেজা নামে স্বাক্ষর করেছেন। এখানে দেওান ও হাছন বানানদুটি লক্ষ্যণীয়।
একটি কথা এখানে মনে রাখা দরকার। হাসন রাজা যখন জন্মেছিলেন সেই সময় বাংলার নবজাগরণের যুগ। সেই যুগে পূর্ববাংলার কয়েকটি মুসলিম জমিদার পরিবারও এই নবজাগরণে সামিল হয়েছিলেন। ঢাকার এক জমিদার পরিবারের সন্তান মীর মোশাররফ হোসেন সেইযুগে মূল ধারার বাংলা সাহিত্য রচনা করে বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু জমিদার পরিবারে জন্মেও হাসন রাজা প্রথাগত ও আধুনিক শিক্ষায় বঞ্চিত ছিলেন, এটি খুব বিস্ময়ের ব্যাপার !
হাসনের যখন মাত্র ১৫ বছর বয়স, তখন মাত্র ৪০ দিনের ব্যবধানে তাঁর বৈমাত্রেয় বড় ভাই উবায়দুর রাজা ও পিতা আলী রাজার আকস্মিক মৃত্যু হলে জমিদারির সমস্ত দায়ভার বালক হাসনের ওপর এসে পরে। হাসন অবশ্য এই দায়িত্ব ভালোভাবেই সামলেছিলেন। দীর্ঘদেহী, সুদর্শন ও সুপুরুষ হাসন এরপর ধীরেধীরে ভোগ বিলাসে ডুবে যান। মা তাঁর বিবাহ দিলেও তিনি একাধিক নারীসঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। হাসন নিজেই লিখে গেছেন যে তিনি অনেকবার বিবাহ করেছিলেন। হাসন রাজার অন্ততঃ পাঁচজন স্ত্রীর নাম পাওয়া যায়। এছাড়া তাঁর ১৬ জন সহচরী ছিলেন যাদের মধ্যে বিনোদিনী নামে এক সঙ্গিনী ছিলেন হাসনের খুব প্রিয়। হাসনের চার পুত্র ও চার কন্যা ছিলেন, তাদের কথা আমরা পরে আলোচনা করবো। হাসনের হবি ছিল হাতি , ঘোড়া এবং পাখি পোষা এবং এগুলির পেছনে হাসন বহু অর্থ ব্যয় করতেন। অত্যাচারী জমিদার হিসেবেও তাঁর কুখ্যাতি হয়। কিন্তু এরই মধ্যে হাসন রাজার মনের কোণে একটু একটু করে জাগতিক ভোগ বিলাস সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ জমতে শুরু করে। তাঁর কুকার্যের জন্য আল্লাহ তাঁকে শাস্তি দিতে পারেন এই ভয়ে হাসন ভীত হয়ে ওঠেন। কথিত আছে হাসন একদিন হাওর অঞ্চলে (লেখক : পূর্বতন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ , হবিবপুর ও সিলেট সদর এবং ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ মহকুমায় অবস্থিত বিস্তীর্ণ নিচু জলা জমি যা বর্ষাকালে সাগরের রূপ নেয়। হাওর কথাটি এসেছে সাগর থেকে। ) জেলেদের মাছ ধরা দেখছিলেন। তিনি দেখলেন যে মাছগুলি যতক্ষণ জলের মধ্যে স্থির হয়ে থাকছে, জেলেরা ততক্ষণ তাদের হদিস পাচ্ছে না। কিন্তু মাছেরা নড়ে উঠলেই জালে ধরা পড়ে যাচ্ছে। হাসন ভাবলেন জীবনে তিনিও যদি বেশি নড়াচড়া করেন অর্থাৎ বিপথগামী হন তাহলে আল্লাহর কাছে ধরা পড়ে যাবেন। হাওর থেকে হাসন ফিরে এলেন এক অন্য মানুষ হয়ে।
হাসন ধীরে ধীরে পার্থিব জগতের সুখ স্বাচ্ছন্দ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন ও বেশি করে ঈশ্বর চিন্তায় ডুবে গেলেন। শোনা যায়, নামাজ পড়তে বসে তিনি সারাদিন কাটিয়ে দিতেন, ভাবের ঘোরে বিহ্বল হয়ে যেতেন, বলতেন আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করছেন। নিজের জমিদারি প্রাসাদ ত্যাগ করে হাসন সাধারণ মাটির বাড়িতে বাস করতে লাগলেন। পিতার মৃত্যুর পর যে জমিদারির সীমা হাসন বহুগুণ বাড়িয়েছিলেন, সেই জমিদারিতে তিনি এখন স্কুল, মসজিদ, মন্দির এমনকি গীর্জাও স্থাপন করলেন এবং আর্তের সেবায় মন দিলেন। ১৯১৮ সালে তিনি তাঁর মোট সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ ওয়াকফ বোর্ডকে দান করেন।
শোনা যায় এক সুফি সাধকের প্রভাবে তিনি আধ্যাত্মিকতাপূর্ণ এবং মরমীয়াবাদী গান রচনা শুরু করেন। এই গানগুলি তাঁর দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক চিন্তার প্রতিফলনে উদ্ভাসিত এবং তাঁর সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় । সহজ ভাষায় আধ্যাত্মিক জ্ঞান প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ত শৈলী সাধারণ মানুষের কাছে তাদের জনপ্রিয় করে তোলে।
হাসন রাজার জীবন দর্শন ও গান
হাসন রাজার জীবন দর্শন ও গান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে তিনি কোনও লোকগীতিকার ছিলেন না , হাসন ছিলেন এক সাধক কবি।
হাসন রাজার কথা প্রথম জনসমক্ষে নিয়ে আসেন প্রভাত কুমার শর্মা । ১৯২৪ সালে তিনি এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে হাসন রাজার কথা জানান। সেই বছরই প্রভাত কুমার মুরারীচাঁদ কলেজ ম্যাগাজিনে হাসন রাজাকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন। পরের বছর তিনি রবীন্দ্রনাথকে হাসনের ৭৫ টি গান পাঠান। কবিগুরুর বিলম্ব হয়নি হাসনের গান কবিতার মহত্ব উপলব্ধি করতে। তাই অক্সফোর্ডের বক্তৃতায় হাসনের কবিতাকে বাংলা ভাষার এক অমূল্য সম্পদ বলতে তিনি দ্বিধা করেননি।
হাসন রাজার গানের একটি সংকলন হাসন উদাস নামে ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হয়। মোট ২০৬টি গান এই বই-এ সংকলিত হয়। গান গুলির প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ঈশ্বরের ধারণা, তাঁর প্রতি ভক্তি এবং স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক। এ ছাড়াও, মানব জীবনের দুর্বলতা, পার্থিব জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব এবং উপাসনা ও ধ্যান-ধারণায় অক্ষমতার জন্য তাঁর বিষন্নতা ও অসহায়তা আত্ম-উৎসর্গীকৃত ও ঈশ্বরকে নিবেদন করা এই গানগুলিতে প্রকাশ পেয়েছে । ঈশ্বর ও আত্মার জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তাঁর এই শরীর-ভিত্তিক আধ্যাত্মিক তত্ত্বের ধারণা সূফীবাদ , ভক্তিবাদ, চিরাচরিত ভাববাদ ও তার নিজস্ব মরমীয়াবাদের সংমিশ্রণে তৈরি। সিলেটের কথ্য ভাষায় রচিত এই গান কবিতায় মধ্যযুগীয় ও প্রাক আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের মেলবন্ধনকারী (syncretic) ও অসাম্প্রদায়িক ভাবধারাটি বারবার ফুটে উঠেছে। অনেক গবেষক হাসনের গানে বৌদ্ধ সহজিয়া দর্শন ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করেছেন।
দর্শন ,ধর্ম ও লোক সংস্কৃতিকে ব্যাখ্যা করার সময় রবীন্দ্রনাথ প্রায়শই হাসন রাজাকে উদ্ধৃত করেছেন । বাংলা কাব্যের চিরন্তন ঐতিহ্য বহন করে হাসন বাংলার ভূপ্রকৃতির মধ্যে এক আত্মাকে অনুভব করেছেন। তাই রবীন্দ্রনাথ হাসনকে বলেছেন The Man of My Heart । রবীন্দ্রনাথ তাঁর গান মম আঁখি হইতে পয়দা আসমান জমিন এবং রূপ দেখিলাম রে নয়নে ইত্যাদি থেকে উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেছেন যে এই কবি বৈদিক ঋষিদের মতই পরম ব্রহ্মের মধ্যে আত্মার লয় হওয়ার কথা বলেছেন। তবে হাসনের কবিতায় সেই পরম ব্রহ্ম কখনো আল্লাহ, হরি, কৃষ্ণ প্রভৃতি হিসাবে প্রকাশিত হয়েছেন। কবির সমস্ত আকর্ষণ, আবেগ ও উদ্বেগ এই ঐশ্বরিক সত্ত্বাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। হাসন রাজার মনের এই ভাবটি প্রকাশিত হয়েছে এই বিখ্যাত গানটির মধ্যে দিয়ে :
হাসন রাজায় কয় , আমি কিছু নয় রে , আমি কিছু নয়
অন্তরে বাহিরে দেখি , কেবল দয়াময়
প্রেমের বাজারে হাসন রাজা হইয়াছে লয়
তুমি বিনে হাসন রাজায় কিছু না দেখয়
তুমি আমি , আমি তুমি ছাড়িয়াছি ভয়
উন্মাদ হইয়া হাসন নাচিয়া বেড়ায়
হাসন রাজায় কয় , আমি কিছু নয় রে , আমি কিছু নয়
অন্তরে বাহিরে দেখি , কেবল দয়াময়
হাসনের অন্যান্য বিখ্যাত গান গুলির মধ্যে আছে:
লোকে বলে, বলেরে ঘর বাড়ি ভালা না আমার ; সোনা বন্ধে আমারে দিওয়ানা করিল ; আঁখি মুদিয়া দেখো রূপ ; নেশা লাগিল রে বাঁকা দুই নয়নে ; মাটির পিঞ্জরা ; বাউলা কে বানাইলো; একদিন তোর হইবো রে মরণ; আগুন লাগাইলো কেনে; কানাই তুমি; আমি যাইমু আল্লাজির সঙ্গে; ভবের খেলা; রঙ্গে মজেছি রে; শ্যামের রাঙা চরণ ইত্যাদি।
একটি গানের কথা বিশেষ ভাবে বলতে হয়।
১৮৯৭ সালের ১২ জুন আসাম ও সিলেট অঞ্চলে একটি ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে ৮.৮ মাত্রার ভূকম্পনটি ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ। ভূমিকম্পের ফলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও সিলেটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ভূমিকম্পে হাসন তাঁর বহু আত্মীয় স্বজন ও পোষা পশু পাখিকে হারান। তাঁর নিজের বসত বাড়িটিও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ভূমিকম্প তাঁর মন, জীবন, দর্শন এবং তাঁর সঙ্গীতের উপর একটি বড় প্রভাব ফেলে । জীবনের স্বল্প দৈর্ঘ্য ও অনিশ্চয়তার বিষয়ে তাঁর এক গভীর উপলদ্ধি হয়। এটি তাঁর এই জনপ্রিয় গানের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে:
লোকে বলে বলেরে ঘর-বাড়ি ভালা না আমার
কি ঘর বানাইমু আমি শূণ্যেরও মাঝার
লোকে বলে বলেরে ঘর-বাড়ি ভালা না আমার।
ভালা করি ঘর বানাইয়া কয়দিন থাকুম আর
আয়না দিয়া চাইয়া দেখি পাকনা চুল আমার
লোকে বলে বলেরে ঘর-বাড়ি ভালা না আমার।
এই ভাবিয়া হাসন রাজা ঘর-দুয়ার না বান্ধে
কোথায় নিয়া রাখব আল্লায় তাই ভাবিয়া কান্দে
লোকে বলে বলেরে ঘর-বাড়ি ভালা না আমার।
আগে যদি জানত হাসন বাঁচব কতদিন
বানাইত দালান-কোঠা করিয়া রঙিন
লোকে বলে বলেরে ঘর-বাড়ি ভালা না আমার।
গানের এই ছত্রগুলির মধ্যে হাসন রাজা নিজেকে এবং তার বাসস্থানকে এমনভাবে সম্পৃক্ত করেছেন যে গানের বিষয়বস্তু এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটি অবিচ্ছেদ্য বলে মনে হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে এই গানটির প্রথম কয়েকটি ছত্র হাসন রাজার সমাধি ফলকে উৎকীর্ণ আছে। যদিও তিনি তাঁর গানগুলিতে পূর্ব বাংলার বিশেষ করে সিলেটের কথ্য ভাষা এবং লোক সংগীতের সুর ব্যবহার করেছেন, তাঁর গায়কী অপূর্ব, অনন্য এবং বিশেষভাবে তাঁর নিজস্ব। তিনি কেবল একজন অসাধারণ কবিই ছিলেন না, হাসন রাজা ছিলেন এক ‘সাধক কবি’, কোনও ‘লোক গীতিকার’ বা ‘পল্লী কবি’ নন। তাঁর গান সুস্পষ্টভাবে এবং বিশেষভাবে ‘হাসন রাজার গান ‘ হিসাবেই গণ্য করা উচিত।
মার্কিন গবেষক এডওয়ার্ড ইয়াজিহিয়ান তাঁর হান্ড্রেড পোয়েমস অফ হাসন রাজা গ্রন্থে বিষ্ময় প্রকাশ করে বলেছেন যে একজন গ্রাম্য প্রায় অশিক্ষিত কবির কবিতায় এই উচ্চমার্গের দর্শন প্রায় অবিশ্বাস্য (লেখক: অবশ্য ভারতীয় উপমহাদেশে এমন ঘটনা বিরল নয়, কবীর বা রামকৃষ্ণ এর উল্লেখযোগ্য উদাহরণ । তাই মাক্সমুলার সাহেব বলেছিলেন যে, যে অর্থে ইউরোপে বহু মানুষ অশিক্ষিত, সেই অর্থে কোনো ভারতীয়ই অশিক্ষিত নয়।)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড: মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী তাঁর হাসন রাজার গানের তরী গ্রন্থে হাসনের চরিত্রে বৈপরীত্যের সমাগমের কথা উল্লেখ করেছেন। একদিকে হাসন ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন , অন্যদিকে একদিন হইব রে তোর মরণ কবিতায় তিনি মৃত্যুভয়ে কাতর। আবার ড: নূরে মালিকি হাসনের দর্শনে নবম শতাব্দীর ইসলামী চিন্তাবিদ মনসুর হাল্লাজের দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। প্রয়াত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হাসন রাজার গান কবিতার ভক্ত ছিলেন। দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হাসন রাজার বাড়ি কবিতায় তিনি লিখেছেন
কও তো হাসন রাজা
কী বৃত্তান্তে বানাইলে এ মনোহর বাড়ি।
ধর্মপ্রাণ মুসলমান হলেও হাসন রাজা ছিলেন প্রকৃতই অসাম্প্রদায়িক। ইসলামি সুফিবাদী যোগ তান্ত্রিক ও শ্রীহট্টের গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাব আন্দোলনের প্রভাব হাসনের গান ও জীবন দর্শনে লক্ষ্য করা যায়। মধ্যযুগের বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলিম কবি, যেমন আলী রেজা, কমর আলী, চাঁদ কাজী প্রমুখের পরম্পরা বজায় রেখে হাসন রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান রচনা করেছেন। যেমন এই গানে ঈশ্বরকে রাধা রূপে কল্পনা করে হাসন তাঁর প্রেমে বিভোর হয়েছেন:
হাছন রাজা বাঙ্গালী হয়ে কাঙ্গালী
প্রেমানলে জ্বালিয়ে যায় প্রাণ
আমি তোমার কাঙ্গালী গো সুন্দরী রাধা।
আমি তোমার কাঙ্গালী গো।
তোমার লাগিয়ে কান্দিয়া ফিরে
হাছন রাজা বাঙ্গালী গো ।।
হিন্দুয়ে বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা।
রাধা বলিয়া ডাকিলে মুল্লা মুসল্লিয়ে দেয় বাধা।।
হাসন রাজার বিভিন্ন জীবনীকারদের রচনা থেকে জানা যায় যে হাসন গোহত্যা পছন্দ করতেন না। কালীপুর মৌজা পত্তনের সময় হাসন কালীপূজা করেছিলেন এবং এই পূজায় ৭০০ টাকা ব্যয় করেছিলেন। এখানেও হাসন মধ্যযুগের বাংলার লৌকিক ইসলামের উত্তরাধিকারই বহন করেছেন। এই ঐতিহ্য মনে হয় হাসনের পরিবারেই ছিল, কারণ হাসনের এক বৈমাত্রেয় বোন ছরিফা বানুও উৎকৃষ্ট বৈষ্ণব পদাবলী রচনা করেছিলেন।
হাসন রাজার গানের ভাষা নিয়ে কিছু বলা দরকার। হাসন যখন জন্মেছেন বা বড় হয়েছেন তখন বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের যুগ। কিন্তু তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য মুসলমান লেখকদের মত হাসন আধুনিক বাংলায় লেখেননি। তাঁর ভাষা বরং খানিকটা ফকির গরীবুল্লাহ – সৈয়দ হামজা প্রবর্তিত দোভাষী পুঁথির আরবি ফার্সি উর্দু মিশ্রিত ভাষা। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হাসন এমন ভাষা লিখলেন কেন ? হাসনের মুসলিম পারিবারিক প্রেক্ষাপট, তাঁর প্রথাগত শিক্ষার অভাব বা কলকাতা থেকে সিলেটের দূরত্ব দিয়ে কেউ এর ব্যাখ্যা করার বৃথা চেষ্টা করতে পারেন, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে হাসনের জন্মের দুশো বছরেরও বেশি আগে সুদূর আরাকানের রাজসভায় বসে দৌলত কাজী বা সৈয়দ আলাওল বিশুদ্ধ সংস্কৃতানুসারী সাধু রীতির বাংলায় উৎকৃষ্ট কাব্য রচনা করেছেন।
বরং এক্ষেত্রে অধ্যাপক সুকুমার সেন যা বলেছেন, অর্থাৎ, সিলেটের ভাষা এরকম হবার আসল কারণ উত্তর ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগ, সেটি অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। মনে রাখতে হবে যে হাসন রাজা হিন্দি ভাষাতেও অনেকগুলি গান রচনা করেছেন। চতুর্দশ শতকে পীর শাহজালাল সিলেটে আসার পর থেকেই সিলেটে পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের চিস্তিয়া, আউলিয়া বা সোহরাবর্দীয়া সুফী সাধক গোষ্ঠীগুলির আনাগোনা অনেক বেড়ে যায়। এর ফলে সিলেটি ভাষায় প্রচুর পরিমাণে আরবি, ফার্সি, উর্দু ও হিন্দি শব্দ প্রবেশ করে। সিলেটি ভাষাও একটু অন্যভাবে গড়ে ওঠে। উত্তর ভারতের প্রভাব এতখানিই ছিল যে সিলেটে বাংলা বর্ণমালা থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র সিলহোটি নাগরী (Sylhoti Nagari) নামে একটি বর্ণমালা তৈরী হয় যা ছিল আসলে বাংলা ও দেবনাগরী বর্ণমালার মিশ্রণ।
হাসন রাজা সৌখিন বাহার নামের একটি গদ্যগ্রন্থও প্রকাশ করেছিলেন , তবে রুচিতে বা সাহিত্যগুণে তা মোটেই উচ্চস্তরের নয়। হাসন রাজা তাঁর কর্মক্ষেত্র সিলেটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, কলকাতায় এসেছেন, ঢাকায় এসেছেন, আরো বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেছেন।
উত্তরাধিকার
২২ অগ্রহায়ণ, ১৩২৯ বঙ্গাব্দ (৬ ডিসেম্বর, ১৯২২) তারিখে হাসন রাজার মৃত্যু হয়। লক্ষণশ্রী গ্রামে তাঁর প্রিয় মায়ের কবরের পাশেই হাসনকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
হাসন রাজার চার পুত্র, খান বাহাদুর দেওয়ান গনিউর রাজা, হাসিনুর রাজা, খান বাহাদুর দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী (কাব্য বিশারদ) এবং আফতাব রাজা। দেওয়ান একলিমুর রাজা তাঁর পিতার পদচিহ্ন অনুসরণ করে কবিতা ও গান রচনা করেন । তিনি সিলেট অঞ্চলের আধুনিক কবিতার স্থপতি হিসেবেও পরিচিত । হাসন রাজার পরিবারের চতুর্থ পুরুষে সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত ও কানাডা ও ইংল্যান্ডে থাকেন। পরিবারের কয়েকটি শাখা সিলেট ও পাবনায় বসবাস করেন।
হাসন রাজার স্মৃতিতে বাংলাদেশে দুটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটি সুরমা নদীর তীরে লক্ষ্মণশ্রীতে হাসন রাজা মিউজিয়াম , যার পরিচালনায় আছেন হাসন রাজা মিউজিয়াম ট্রাস্ট। অন্যটি সিলেটে হাসন রাজার সাবেক বসত বাড়ি রাজা কুঞ্জে স্থাপিত মিউজিয়াম অব রাজাস, যেটি এডুকেশনিস্ট দেওয়ান তালিবুর রাজা ট্রাস্টের অর্থানুকূল্যে প্রতিষ্ঠিত। মিউজিয়াম দুটিতে বহু মূল্যবান আর্টিফ্যাক্ট আছে।
হাসন রাজার গানকে পশ্চিমবাংলায় প্রথম জনপ্রিয় করে তোলেন প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী। নির্মলেন্দু চৌধুরীর একটি প্রতিকৃতি হাসন রাজা মিউজিয়ামে রাখা আছে। এছাড়াও স্বপন বসু গেয়েছেন, তপন রায় গেয়েছেন । বলিউডের শিল্পীদের মধ্যে কুমার শানু , কবিতা কৃষ্ণমূর্তি ও অলকা যাজ্ঞিক গেয়েছেন। বাংলাদেশে অবশ্য হাসন রাজার গানের অনেক বেশি সিরিয়াস চর্চা হয়েছে। ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকেই বাংলাদেশের সংগীতশিল্পী ও গবেষক আকরামুল ইসলাম ও হাসন রাজার নাতি তৈমুর রাজা হাসনের হারিয়ে যাওয়া গানগুলি এবং তাদের মূল সুর সংগ্রহের কাজে ব্রতী হন। একাজে তাঁরা বিদেশ থেকেও অনেক সাহায্য পেয়েছিলেন। পরে আকরামুল বাংলাদেশ রেডিওয় যোগ দিলে তৎকালীন প্রধান শহিদুল ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতায় গানগুলি জনপ্রিয় করার কাজে মন দেন । প্রথম দিকে যে সব শিল্পী এই গানগুলিকে জনপ্রিয় করেন তাদের মধ্যে নাম করা যায় উজ্জীর মিয়াঁ, বিদিত লাল দাস ( ওরফে পটল বাবু , যিনি সাধের লাউ বানাইলো মোরে .. গানটির রচয়িতা ) ও আরতি ধরের। পরবর্তী কালে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের মধ্যে সেলিম চৌধুরী, ফেরদৌসী রহমান, রুনা লায়লা, সাইদা তানি প্রমুখ হাসন রাজার গানকে জনপ্রিয় করেন। ইন্দ্রমোহন রাজবংশীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ লোকসঙ্গীত পরিষদ হাসন রাজার গানের ওপর মূল্যবান গবেষণা করছে।
কয়েক বছর আগে একলিমুর রাজার পৌত্র তাছাওয়ার রাজা ঢাকার পাঠক সমাবেশ বুকস প্রকাশনা সংস্থা থেকে ‘হাছন রাজা সমগ্র’ নামে একটি বৃহদায়তন ও মূল্যবান আকর গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এতে হাসনের প্রকাশিত গান গুলি ছাড়াও প্রায় ৩০০টি অপ্রকাশিত গান, হাসন রাজার জীবনী ও হাসন রাজার গান, জীবন ও দর্শন বিষয়ক পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ সহ বহু মূল্যবান তথ্য সংকলিত হয়েছে।
হাসন রাজাকে নিয়ে এযাবৎ দুটি সিনেমা হয়েছে। প্রথমটি ২০০২ সালে বাংলাদেশের পরিচালক চাষি নজরুল ইসলাম করেন। এই সিনেমায় নাম ভূমিকায় হেলাল খান ও অন্য মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন অভিনেত্রী ববিতা । সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন সুজেয় শ্যাম। দ্বিতীয় ফিল্মটি অতি সম্প্রতি নির্মাণ করেছেন লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশী পরিচালক রুহুল আমিন। মুখ্য চরিত্রদুটিতে আছেন বলিউডের স্বনামধন্য তারকা মিঠুন চক্রবর্তী ও রাইমা সেন। উৎসাহী পাঠক লন্ডনের হলবোর্ণ এলাকায় হাসন রাজা নামে একটি জনপ্রিয় ভারতীয় বাংলাদেশি রেস্তোরাঁও খুঁজে পাবেন।
[লেখক – সিনিয়র কিউরেটর, ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়ামস (ভারত সরকার)]
Posted in: ARTICLE, January 2021