ভাজা-পোড়া : ভাস্বতী গোস্বামী

রান্নাঘরে ব্রহ্মচারী অবস্থানে সেক্স নাকি শতকরা পঁচানব্বই ভাগ রেজাল্ট দ্যায়। এমনই বিশ্বাস বিনায়কের। পরমকিশোর রামাবর্তীজী মহারাজের কাছে ইদানীং সে আর উজ্জ্বয়িনী যাতায়াত শুরু করেছে। তো পরম কিশোরজী, বিনায়কের কানে কানে দাম্পত্যজীবনের এই গুপ্ত মন্ত্রটি দান করেছেন। সন্তানলাভে ‘মিশনারি’ আর কন্ট্রোলে ‘কুত্তি’-ই শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি। ভোরের দিকে আদর খেতে ভালোবাসে ‘জুন’। কিন্তু ‘কিরপা’ পেতে গিয়ে, খাটের পিছনে জানলা দিয়ে ভোরের উঁকি আর সঙ্গমরত প্রেমিকের মুখে নরম আলো একসঙ্গে দেখা হয় না তার। আজব রাতের গজব কাহানীর মতোই তারা নিখুঁতভাবে রান্নাঘরে তৃতীয় প্রহরের দাম্পত্য শুরু করে। মহারাজের উপদেশমতো পরপর এই উপপাদ্যগুলো মেনে চললেই কৌশল পরিবারের ‘হীরের টুকরো’ আসমান থেকে টুপ ক’রে খসে পড়বে যে কোন দিন।
‘আরে, হররোজ ভ্যানিলাহি চাহিয়ে, ডিনার কে বাদ… কিঁউ? বাটার স্কচ তো কভি কভা’ —
রান্নাঘর থেকে গভীর রাতে, রুটিন শেষের আয়োজন গোটাতে গোটাতে ব্যাজার জুনকে বোঝাতে চেষ্টা করে বিনায়ক। কিন্তু তার ওই ‘আংরেজি মিডিয়াম’ বৌ-কে কিছুতেই এতে খুশি রাখতে পারছে না সে। তবে ভরোসা আছে, হয়ে যাবে। বাবুজীর ইচ্ছে যখন হয়েছে। আর জুনের বাপ আংকেলজী তো বাবুজীর ল্যাঙ্গোটিয়া দোস্ত্। গেঁহুর খামার তাঁর। নাকি বিশেষ ফুলের চাষও চলে গেঁহুর আড়ালে। তো কোই প্রবলেম? ইয়ে ভি ক্ষেতি উয়ো ভি ক্ষেতি। সবই এগ্রিকালচার। রোদ-জল-মিট্টি-সার লাগে একইভাবে। তারপর জন্মায় বেড়ে ওঠে, তাই না?

একবছর হলো তাদের বিয়ের। ঘটা করে কাঠমাণ্ডুতে এ্যানিভার্সারির পার্টি দিয়েছেন আংকেলজী। ঋতু কুমার আর মনীশ মালহোত্রা লেবেলের ডিজাইনার ড্রেস গিফট করেছেন মেয়ে-জামাইসহ বেয়াই-বেয়ানকে। তো, সেখানেই সাধু মহারাজ পরমকিশোর রামাবর্তীজীর পদধূলি পড়েছিল। একটি আলাদা কক্ষে উজ্জ্বয়িনী-বিনায়ককে নিয়ে গিয়ে তাদের আশীর্বাদ করেছিলেন মহারাজ। দীক্ষাও নাকি খুব শিগগিরই হয়ে যাবে।

জনার্দন কৌশলের সাকসেসফুল আর বিশাল বিজনেস চেইন ‘পরমা’-র নবীনতম বোর্ড অফ ডিরেক্টর্সে রয়েছে পুত্র বিনায়কের নাম। পিতৃপুরুষের ভিটে, কোট-মালকা থেকে জনার্দন কৌশল হয়তো শিগগিরই এ্যাসেম্বলি ইলেকশনে দাঁড়াবেন। সরকার পক্ষের সঙ্গে মসৃণ চলছে তাঁর ‘গিভ এ্যাণ্ড টেক’ এর লেটেস্ট মডেল।

সস্ত্রীক বিকাশ ভাদানাকে দেখলেই গ্রামের বেত্তমিজ ছেলেগুলো ‘সবকা বিকাশ সবকা বিকাশ’ ক’রে চ্যাঁচাতে থাকে। ছ’ ফুটিয়া দশাসই বিকাশের সাথে চার ফুট সাত ইঞ্চির ববিতা সত্যিই বেমানান। কিন্তু ববিতা, ধানী লঙ্কা। ছেলেদের চৌদ্দো পুরুষ তুলে এলোপাথাড়ি ইঁট মারে সে। বিকাশকে দারুণ ভালোবাসে ববিতা। বিকাশ তার জন্যে কোম্পানি থেকে পরমা তেল, সাবান আর পারফিউম নিয়ে আসে রেগুলার। নিজে, পরমা ইসবগুলে বিয়ার মিশিয়ে চুমুক দ্যায় রোজ। ববিতা সুখে ভাসে।

কোট-মালকা থেকে বুলেটে চেপে, বিকাশ পাঁচ কিলোমিটার দূরে জনার্দনের ‘মোক্ষপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল বেল্ট’ সামলায়। তার কোমরে চকচকে বেল্ট, রঙচঙে টি-শার্টের নীচে বিলিতি কাট্টা, জিনসের পকেটে চ্যাপ্টা বোতল, বোতলে বিলিতি বিয়ার। মুকররম, গণেশ, বাবুরাম, লক্ষ্মী, শাকিলরা তার আজ্ঞাবহ। কেউ দ্যাখে সাবান-তেল-পারফিউম ইউনিট, কেউ দ্যাখে দেব-দেবী মার্কা টিস্যুপেপার, আসন, টাওয়েল ম্যানুফ্যাকচারিং, কেউ দ্যাখে মেডিসিন -ন্যাপকিন-ডায়াপার-ইসবগুল মার্কেটিং, কেউ বা পুজোর সবরকম বাসনকোসন অর্থাৎ ধূপদান টু বঁটি-কাটারির ‘বিজিনেস’। পরমকিশোর মহারাজের নির্দেশে প্রোডাকশন-ডিস্ট্রিবিউশন-সেলসের গাইডলাইন বানানো হয়। সঙ্গে আবার তাঁর কথামতো, অবিবাহিত, বিবাহিত, মধ্যবয়স্ক ও অস্তযৌবনের জন্য ওয়ার্কশপ ব্যবস্থা করেন জনার্দন কৌশল। ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্র‍্যামও আছে এতে। সব মিলিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকার অফিশিয়াল টার্নওভার। তো, এবার একটু পরমার মেনু-কার্ডে চোখ রাখা যাক—-

পরমা ক্যাপসুল,ট্যাবলেট —- সহজ গাই বিয়ানো
পরমা সাবান, তেল —- রতিসুখ
পরমা পারফিউম —- ওজন কমানো
পরমা আইসক্রিম —- ফার্টিলিটি বাড়ানো
পরমা ডায়াপার —- বীর্য কন্ট্রোল
পরমা মিল্কশেক —- স্পার্ম কাউণ্ট বাড়ানো
পরমা ইসবগুল —– বলবর্ধক
পরমা চা —– দাম্পত্য শান্তি
পরমা কফি —- বশীকরণ
পরমা ঘি —– জমি, বাড়ি, দোকান দখল
পরমা চূরণ —- ফাটকাবাজিতে লাভ
ইত্যাদি বিবিধ সম্ভার…

সম্প্রতি জেনেটিক রিসার্চ ডেভেলপমেণ্টের জন্য পরমা রিসার্চ ইউনিট খুলেছেন কৌশলজী। ইচ্ছে আছে, বায়োকেমিস্ট্রিতে রিসার্চ করা বহু উজ্জয়িনীকে বসাবেন তার ‘এম ডি’ পদে। তার আগে ক’টা বাল-বাচ্চা হয়ে যাক উজ্জয়িনীর। বেয়াই-বেয়ানেরও তাতে সায় আছে। কিন্তু বহুবিটিয়া বড় জিদ্দি, বড় স্বাধীনচেতা মেয়ে। তো, ইউনিভার্সিটির এক রিসার্চ স্কলার আপাতত দেখছে এখানকার ব্যাপারটা। আর, বিনায়ক তো আছেই, তার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলার জন্য। ইন্সটিটিউটের সব রিসার্চই দারুণ সিক্রেট আর লং টার্মে ফায়দেমন্দ্।

আসলে, পরমা-র ল্যাবরেটরিতে ‘ডি. এন. এ’ সংক্রান্ত রিসার্চ চলছে জোরকদমে। বাঁধাকপি, বরবটি, শিম, তেঁতুল, পেঁয়াজ, মাশরুম সব এক ‘ডি এন এ’ ধারী হয়ে যাবে। এতে কৃষকের সুবিধা —- সারাবছর একরকমের ফসল ও একরকমের মূল্য। সমস্ত দেশের কল্যাণ হবে এতে। এক জাতি, এক পেট, এক হাজমা, এক বোলি। আর সবজিতে একবার এই টেকনোলজি সফল হলে মশলাপাতির ওপরেও এর প্রয়োগ হবে। পরমা, ইন্টারন্যাশনাল ব্র‍্যাণ্ড হয়ে যাবে তখন।

উজ্জ্বয়িনী আর বিনায়কের সেদিন ছিল ‘কভি কভা বাটার স্কচ নাইট’। রাতশেষে তৃপ্ত জুন যখন জানলার বাইরে তাকালো, দেখলো ভোরের আলো নয় পৃথিবী যেন এক অন্নপূর্ণার কড়াই। সেখানে একসঙ্গে নরম আলো, মেঘ, বৃষ্টি, ভেজা বাতাস, জল-ঝরানো গাছের পাতা রান্না হয়ে চলেছে। শয্যায় প্রশান্তি আর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন শিশুর মতো লাগছে তার প্রেমিকের মুখ। বৃষ্টি থেমেছে। পাখি ডাকছে ডালে ডালে। ধীর পায়ে জুন এসে দাঁড়ালো টাটকা হাওয়ায়, এলোমেলো বাগানে। পেয়ারা গাছে পাতার ফাঁকে মা শালিক, বাচ্চাগুলোর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে নাইট গাউনের পকেট থেকে ‘আই-পিলের’ প্যাকেটটা বার ক’রে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো জুন।

Facebook Comments

Leave a Reply