পাঁউরুটি : অভিষেক ঝা
——- এত বড় সাদা চিনামাটির প্লেটের উপর বন’টা বেমানান—––
সে জানে এইসব দেখলেই তার বছর চল্লিশের ভাতিজা বলে উঠবে, “কাক্কা রে! দিমাগ কি পুরা চুদি গেইল!”। তখন এই শিশু কাঠের উপর পাতা হলুদ ফিনফিনানি থেকে চুঁইতে থাকা সবকিছু সত্যিই চুদে যাবে। বিকাল তিনটার রোদ থাকতে থাকতে ঘরের তিনটা জানলা বন্ধ হতে লাগে এক মিনিট। কপাটে খিল আধা মিনিটে। পিছনের জানলার একটা পাল্লা খোলা আছে খালি। ওখানে জল-জংলা। উল্টো দিকের দেওয়ালের মাঝারি সাইজের একটা আয়নায় ওখানকার খানিক ধরা পড়ে। কুকুর, শূয়োরই আসে খালি ওইখানে; যদি কিছু খেতেটেতে পাওয়া যায়।
“বুঝন হো জলু, ই যো করুনা আইলহো; ভগবানকা জপ করনা পারি হো। জপ না কইরলে পে হামরারি গাঁড় মে ভি করুনা ঘুসি যাইবে। আচ্ছা করিকে জপ করনা পারি হো”, কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সাতষট্টি বছরের গলা একটুও না কেঁপে বলতে পেরেছিল হপ্তা চার আগের সেই রাতে। বুক ঢিবাচ্ছে। জলু যদি বলে বসে যে ভাগ্যিস এই তল্লাটে আর কোনো অর্জিনাল বামণা নাই বলেই সে প্রায় বিনা খাটনিতে করে কম্মে খেতে পাচ্ছে আজ বিশ-পঁচিশ বছর। ভগবান এই ধান্দাবাজির খোঁজ কি আর রাখে না! সব রকমের কালী পূজায় নিয়ম মেনে মদ আর গাঁজা খাওয়া ছাড়া সে ধর্মটা করলো কবে যে এখন জপ করলে ভগবান শুনবে! কিন্তু ভয় বড়োই আজরাইল চিজ। সবচেয়ে আগে মানুষের কাছ থেকে দিমাগ কাড়ি নেয়। দিমাগ ভেবলে যাওয়া জলু অড়হড়ের ডালে রুটি চুবানো থামায়, “কাক্কা তুয়ারিহিকো হি করনা পারে হো। হামরারি তো তু আসলি জনেউ নাহি দেহেল থে”। যাক; তার যেটুকু দরকার সেইটুক দিমাগ জলুর আছে দেখে স্বস্তি এল। যপের আগে পরের কিছু সময় কোনো নাপাক ছায়া না থাকায় ভালো; জলুকে সে বরাবর বলে এসেছে এই কথা। “ কাক্কা! যপ কা টাইম হাম্মে বাহারই থাকনুস”, জলু ডালে চুমুক দেয়। স্বস্তিটা একটু থিতোতে না থিতোতে জলুর কথায় পুরানো অস্বস্তি খোঁচ হয়ে ফিরে আসে। ডালের দিকে তাকিয়ে রুটি ছিঁড়তে থাকে সে।
‘নাসির বেকারি’র গন্ধে তার নাক সেই কবে থেকে অভ্যস্ত! একটা মিঠা পোড়া গন্ধ নাকে ঘুরপাক খায় ভরদুপুরে। হলুদ ধুতিতে সাইকেলের চেনের তেল লেগে যায় নামতে গিয়ে। একটু আগের মানে না বুঝে আউড়ে আসা মন্ত্রগুলোর চেয়ে এই গন্ধকে তার আপন ঠেকে। কেমন একটা ঝিম আছে সরু চিমনি থেকে বেরিয়ে আসা ইস্টের ধোঁয়ায় । চারপাশের বাতাস ধীরে ধীরে সেই ঝিমকে মুছে দিচ্ছে। মুছে যাওয়ার আগে তার নাক যতটা পারে ধরে রাখছে সেই ঝিমের স্মৃতি। নাকের ভিতর থেকে উঁকি মারা রোমগুলো বকের মত একমনা। বাতাসে ভেসে বেড়ানো বনের গন্ধের ঝাঁককে তারা খেয়াল রাখছে এক মনে। নাকের পাশ দিয়ে সেই ঝাঁক পেরোবার সময় জাল হয়ে নাক টানছে শিকার। গেঁড়ি মাছের ঝাঁক হয়ে কিছু গন্ধ পেরিয়ে যাচ্ছে নাকের পাশ দিয়ে। এক ফোঁটা গন্ধও কিছুতেই যেন তার নাক পেরিয়ে না যায় তার জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে বকরঙা রোমগুলি। জালে ধরা পড়ে গন্ধের ঝাঁক। গন্ধের ঝাঁকটা রোমের শিকড় বেয়ে উঠছে। একসময় পথ খুঁজে পেয়ে ধাক্কা মারছে মাথায়। ডুমো হয়ে ফুলে উঠছে ময়দার লেই। ঝাঁকটা রক্ত জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সমস্ত শরীর ঘুরে বেড়িয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে মরিয়া হয়ে। শরীরে থেকে গেলে মন জুড়ে ছটপট বাড়তে থাকে খালি। মাথা কুটে কুটে ঝাঁক ফিরে ফিরে আসছে রক্তস্রোতে। মরার সময় এলে তো সে রক্ত বমি করে, রক্ত পায়খানা করে উগলে দিত ঝাঁকটাকে; কিন্তু এখন তো সে আর মরতে পারে না এই জন্য! সমস্ত দাপাদাপি শেষে তার চোখের সাদায় নাম না দিতে পারা একটা অস্পষ্ট দাগ হয়ে স্থির হল সেই ঝাঁক। তখনই তাড়ির শেষটুকু টানার শুরুর দিক তৈরি হওয়ার আগেই মুছে যায় ‘নাসির বেকারি’। সাইকেলের প্যাডেলে পা ঘোরে আবার। বন পাঁউরুটি সে আর খায় না।
এই তল্লাটে প্রায় তিরিশ বছর আসা হয়ে গেল তার ও জলুর। জলুর মা-বাপ মরে গেছে তারও দশ বছর বছর আগে।জলু তখন বছর চার। এখানে আসার আগেই পৈতা খুলে ফেলেছিল সে। ঝামেলার জিনিস খুব। শালা লোকে জানতে পারলে কামলার কাজে রাখতে চায় না। খাবার দোকানে এঁটোকাটা তোলার কাজ দিতে রাজি হয় না। একবারই সে দেখেছিল তার তল্লাটের বাগান, ক্ষেত থাকা জনেউধারীরা হাইরোডে গাড়ি আটকে জুতা পালিশে বসে পড়েছিল কাতার কে কাতার। তাকে আর জলুকেও দলে ভিড়িয়ে নিয়েছিল। দিন শেষে কিছু টাকা নিশ্চয় পাওয়া যাবে এই আশায় মন দিয়ে জুতা পালিশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল সে। জুতা পালিশ করতে করতে কোনো এক মণ্ডলকে সবাই মিলে গাল দিচ্ছিল। মণ্ডলকে গালি দিয়ে টাকা পাওয়া গেলে তো ভালোই ব্যাপার। গালিগালাজে গলা মিলাল সে। “ জুত্তা পালিশ করকে কি মণ্ডলকো জুত্তা মারনে পরেহো? জুত্তা মারিকে কিত্তা পয়সা মিলবেক?”, সে বড় নিরীহ ভাবে প্রশ্ন করেছিল তার তল্লাটের সবচেয়ে নিরীহ দেখতে বাভণ’টিকে। “ধ্যার বে মাধধা! দিমাগ কি গাঁড় মে ঘুসি গ্যায়ো! চামারুয়াকো ভি জজ, কালেক্টর করলহে নিকালহো মণ্ডল আর তু ধান্দাবাজি করিছেও!”, উত্তর পেয়ে খানিক বেকুব ঠেকেছিল নিজেকে। মণ্ডলের চেয়েও বেশি রাগ হচ্ছিল সদানন্দ মিশ্রের উপর। শালা বাড়ি থেকে সদানন্দ মিশ্রই তাকে আর জলুকে তুলে এনেছিল। সে বুঝতে পারলো জুতা পালিশ করা হচ্ছে যেন ইস্কুলমাস্টার, জজসাহেব, প্রফেসর, ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি জনেউধারীদের হাতেই থাকে। রাস্তায় নেমে জনেউধারীরা জুতা পালিশ না করলে এইসব চাকরি চলে যাবে চামারদের হাতে। নিজেকে বোকাচোদা ঠেকছিল তার। মওকা বুঝে জুতা পালিশ ছেড়ে উঠে পড়েছিল জলুকে নিয়ে। তার কি ওইসব চাকরি নিয়ে ভাবারও সময় আছে!
সে কি চেষ্টা কম করেছিল নিজ তল্লাটে একটা কাজ জোটাবার! দুটো উত্তর শুনে শুনে সে তল্লাট ছেড়েছিল। প্রথমটাঃ “জনেউধারীকো ইসব কাম পে রাখি কে পাপ না কইরল পারে হো”, দ্বিতীয়টা: “দিমাগ নাহি হ্যায় কি হাম্মার! শালা দ্বারভাঙিয়া বাভণ! দো দিনমে হামরারিহি গাঁড় মে গহুমা হোকে ডসিবি…” । প্রথমটা সে শুনত বেজাত-কুজাতদের কাছ থেকে। দ্বিতীয়টা বলতো স্বজাতের মানুষজন। তিনদিন টানা ভাত হয় নি সেইবার তার বাড়িতে। ভাবছিল জলু সমেত মুসলমান হয়ে যাবে। মসজিদে থাকা খাওয়াটা পাবে অন্তত। ছোটোবেলায় কী একটা হয়েছিল যেন তার, নুনু তো ডাক্তারই সুন্নত করে দিয়েছিল। পাশের গ্রামের মৌলভীর সাথে বাতচিত চালায় এই নিয়ে দু-একদিন। ভাতও জুটে । মৌলভীর কথায় চাল-ডালও জুটে যায় মাস দুয়েকের। তখনই জলুর মরে যাওয়া মা এক রাতে কালী হয়ে স্বপ্নে আসে। “হাঁ রে ছেনাল কা পুত! তোরারি হিম্মত ক্যায়সে হইনু হাম্মার বেটাকে নুনু ছুন্নত করিবার! তোরারিহি নুনু কাটি লিব!”, তার বৌদি একটা রাম-দা হাতে নিয়ে তার দিকে এগোতে এগোতে বলে। তড়াক করে ঘুম চৌপাট। গলায় হাজার জন্মের তেষ্টা । লুঙ্গি ভিজে চ্যাটচ্যাট। পরদিন সকালেই তার মুসলমান হওয়ার সাহস চলে যায়। পরে সে স্বপ্নটা নিয়ে অনেক ভেবেছে। তার বৌদি কখনোই গলা তুলে কথা বলতো না। তাহলে মুসলমান হওয়ার কথায় হাতে যে হাঁসুয়া কেন তুলে নিয়েছিল কে জানে!
নাম জিজ্ঞাসা করেছিল নাসিরের বাপ বেকারিতে কাজে ঢুকাবার আগে। তিনশো মাইল দূর চলে আসার পর এই তল্লাটে এই কাজের খোঁজ যে দিয়েছিল সে বলেই দিয়েছিল মালিক ধর্মকর্ম করা মুসল্লি। ফেজ টুপি পরে কাকা, ভাতিজা হাজির। “ আসরাফুল মহম্মদ, সাথে ভাতিজা জলু মহম্মদ”, সে ভালো করেই জানতো প্যান্ট খুলে ভাতিজার নুনু দেখতে চাইবে না নাসিরের বাপ। ইস্টের সাথে তার আলাপ শুরু তখন থেকেই। খাটনি ছিল খুব। খাটনি শেষে বনের লোভ তার চেয়ে খুব কম ছিল না। পায়ে প্লাস্টিক বেঁধে ময়দার তালে নাচকুঁদ। আর খানিক বাদ বন হবে। ডেক থেকে মিঠুনদার গান ভেসে আসছে। “আই অ্যাম আ ডিস্কো ডান্সার”। নাসিরের বাপ এই ঘরে কাজ চলাকালীন খুব একটা ঢোকে না। বনের লেই পাকানো চলছে। লাল হয়ে থাকা মাটির উনানের ভিতর লোহার ডান্ডি দিয়ে সাবধানে ট্রে ঢোকাচ্ছে। কচি মেয়েদের মাই-এর মতো ডুমো ডুমো হয়ে উঠছে বন। জলুর দিকে নজর রাখছে; অল্পবয়সী ছেলে, তাড়াহুড়ায় গড়বড় না করে ফেলে। এইসব করতে করতে দু-একবার যা ছ্যাঁক খেয়েছে সে! “তো ঝুমো তো নাচো…”। এখনো তালুর উপর সে দাগ আছে। বন মুখে দিলেই সেই সব ছ্যাঁকে মলম বুলিয়ে দেয় যেন কেউ। চোখ খুলে রাখতে পারা যায় না। বন্ধুর কথা মনে পড়ে। নুনুতে যখন লোম আসছে তখনকার ইয়ার। “যখন মাগীর ঠোঁট চুষবি, চোখ এমনি এমনি বন্ধ হয়ে যাবে”, নুনুতে হাত বোলাতে বোলাতে বলেছিল দোস্ত। “দো দিন কি হসতি মে, সাদিয়ো কি মস্তি মে…”। মিঠুনদা নাকি নিজে এইসব গান করে নি। ময়দার তালে নাচতে নাচতে সে জানছিল বাপ্পিদাকে। কোনো মাগীর ঠোঁট তার চোষা হয় নি আজ অবধি। মাগীর ঠোঁটের স্বাদ কি বনের চেয়েও ভালো? হতেই পারে না। নাচনকোঁদন, ছ্যাঁকের ভয় আর লোভের চোটে রাম-দা হাতে বৌদির নুনু পুরা কেটে ফেলার ভয়ও একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছিল। ইস্টের গন্ধ নাক দিয়ে সবটুকু ধরে রাখতে মরিয়া হয়ে উঠত। এই বেকারির মতো ক্রিম বন সে কোনোদিনও খায় নি। নাসিরের বাপ ওটাকে বান পাঁউরুটি যে কেন বলে আজ অবধি সে জানে না। সবচেয়ে কম ওটাই তৈরি হয় এই বেকারিতে।কখনো কখনো কিনে খায়। আর বেশিরভাগ সময় চুরি করে সাঁটায়। দু-চারবার ঝুল পাঞ্জাবির পকেটে লুকিয়ে নিয়ে যেতে গিয়ে নাসিরের বাপের কাছে ঝাড় খেয়েছে। একবার তো আয়েস করে গরম বনে চিলতে কামড় দেওয়ার সময় নাসিরের বাপ এসে হাজির।
“কোয়ি ইঁহা আহা নাচে নাচে”… মুখ ঘুরিয়ে বাকি বন’টা মুখে পুড়ে নেয় সে…“ কোয়ি উঁহা আহা নাচে নাচে”… গলা ফেটে আসা চিল্লানি জিভ দিয়ে ভিতরে ঠেলে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে… “সারে হাসিন আহা নাচে নাচে”…সামনে গনগনা মাটির বিশাল চুলা…“সারে জওয়া আহা নাচে নাচে” …গরম ময়দার লেই ভেদ করে আরো গরম ক্রিম জিভকে পুড়িয়ে দিচ্ছে… “ আউয়্যা আউয়্যা… আউয়্যা আউয়্যা…” ।
কয়েক মাস পর নাসিরের বাপ বেকারির সব কর্মীকে এসে ফরমান দিল ভোটার লিস্টে নাম তুলতে হবে । বিডিও অফিস থেকে এসে বলে গেছে। শেষনের হুলিয়া। কংগ্রেসিদের সাথে পা মিলিয়ে সেও দু-একটা মিছিলে গিয়েছিলঃ “টি.এন. শেষনের খবর্দারি মানছি না, মানবো না” । তারপর ভোটার কার্ড পাওয়ার জন্য ফেলে আসা তল্লাটের রেশন কার্ড বার করতেই হয় তাকে। জলুর নামও ওঠে। জৌলুশ পাঠক। জলুকে কান ধরে শ বার উঠবস করায় নাসিরের বাপ। আর তাকে মুখের উপর বলে দেয়, “ তুই শালা আমাকে খুনও করে ফেলতে পারস। কাইল থেকে কামে আসতি হবে না। আর এক ছটাক শরম থাকলে কোনোদিন ই দোকানে আসবি না”। সেই থেকে পূজা সেরে ফেরার পথে চিমনি দিয়ে বেরিয়ে আসা ইস্টের গন্ধ শোঁকা—- এটাই এক মাস আগে অবধি ‘নাসির বেকারি’ আর তার ভিতর সম্বন্ধ । লোভ ঠেলা মারে। পকেটে পয়সা থাকলে কখনো কখনো নাসিরের বাপের মুখে পয়সা ছুঁড়ে পঁচাশ’টা ক্রিম বন কেনার ইচ্ছাও আসে। কিন্তু ওই মুস্লার দোকান থেকে পাঁউরুটি কেনা তাকেও আর মানায় না। জলুর সামনে যেটুক ইজ্জত আছে সেটাও আর থাকবে না।
এই সমস্ত সময়ে তাকে কেউ দেখুক, সে একদমই তা চায় না। এখানে কেউ নেই। কেউই কি নেই? ভিতর ঘরের কোণ দিয়ে যাতায়াত করা তিন-চারখান কালো পিঁপড়া, স্যাঁতস্যাঁতে কোণায় ঘাপটি মেরে থাকা একটা আরশোলা, ঘরের কোথাও একটা লুকিয়ে থাকা জানলা বন্ধ করলেই ডাকতে শুরু করা ঝিঁঝিঁ, টিউবের নিচে মুখ বার করে রাখা টিকটিকি , টিউবের আলো, তার চারপাশ দেখতে পাওয়া চোখ —– এই সবকিছুই দেখছে তাকে। সাবধানী চোখ জরিপ সেরে নেয় একবার। টিপে টিপে মারে চারটা পিঁপড়াকে। আরশোলাটা খাটের নিচে সিঁধিয়ে যায়। টিকটিকিটা মুখটুকুও ঢুকিয়ে নেয় টিউব আর দেওয়ালের মাঝখানের অন্ধকারে। টিনের একটা মাঝারি বাক্স বার করে খাটের তল থেকে। কিচ্ছুটি সে ফেলে না। যত্নে আছে সব। তার সবটুকু। ঝিঁঝিঁ ডাকতে শুরু করে।
“ই তল্লাটে কোনোকালে কোনো অর্জিনাল বামুণ নাই। যে কয়ঘর মৈত্র আছে সব আসলে আনন্দমার্গী নমু। চামার, চাঁড়াল সবার হাতে এখন পয়সা ঢুকছে। পৈতাটা পরে পুরুতিতে লাগি যাও”, যে তাকে এই পরামর্শ দিয়েছিল তাকে সে ভগবান মানে। সরকারি চাকরিবাকরি ছুটছাট করে এদিকের রবিদাস, সরকার, বিশ্বাস, মণ্ডলরা পেতে লেগেছে তখন। বাড়ি দেখলেই চেনা যাচ্ছে কার বাড়িতে সরকারি চাকরি নারায়ণ ঢুকছে। দু’টা কাঁচা দেওয়াল, টিনের ছাদ; একটা টাটি আর টিন; দালান আর টিনের ছাদ, ফের তিনটা কাঁচা দেওয়াল আর টিন; দুইটা টাটি আর টিন; পুরা দালান তিনটা পাশাপাশি তিন ভাইয়ের; ফের চারটা কাঁচা দেওয়াল… । মাঠ ছেড়ে বাড়িতেই হাগে সব এখন। টাকা বাড়লে ঘরে গোপালও আসে এদের। রাধামাধব মন্দিরের সিঁড়িতে এদের বাপ-পিতিমো’রা পা ঠেকাতে অবধি পেত না । তাই টাকা দিয়ে গোপাল এনে বাপ-পিতিমো’র যন্ত্রণা দূর করতে চায়। “আমাগো মা-ঠাকুমারা তো এইগুলা জানতোই না। কিসুই শিখাইতে পারে নাই। আমাগো ছেড়িছ্যাড়াদের এই হক্কলই শিখা উচিত। না হইলে কি আর জাতে উঠা যায়?”, গোপালের জন্য সোয়েটার বুনতে বুনতে বলে অজিত রবিদাসের বউ। বাড়িতে গোপাল এনে নিত্যপূজার চল তারাই করেছে এই তল্লাটে প্রথম। প্রথম প্রথম পুরুত জুটাতে পারতো না। তারপর দিনে দশ দিয়ে ধনেশ মৈত্রকে রাখা হল। যতদিন পাঠক পুরুতের খোঁজ পাওয়া যায় নি, কাইলা বামুণ দিয়েই কাজ সারতে হতো। সেই খচখচানি দূর করেছে সে। এখন দিনে পঞ্চাশ পায়। এ তল্লাটে আটটা বাড়িতে এখন গোপালের নিত্যপূজা হয়। তল্লাটের হিন্দুরা তাকে ভগবানের দানই ভাবে। যত্ন করে সে গ্রন্থি দেয় পৈতায় ।
“মাল ফেলে অর্জিনাল বামুণ পুরুত পালতে পারলে নিজেকে বেশ বামুণ-বামুণ ঠেকে”, মক্ষীৎ-এর কুশিয়ারের টুকরা মুখে চালান করে নিজের সম্বন্ধীকে বলছিল অজিত রবিদাস, এ.ই. , পি.এইচ.ই। পুরুতি করে দশ বছর ততদিনে পার করে ফেলেছে সে। অজিত রবিদাস এ কথা বলতেই পারেন, সে ভাবে। কত সাহায্য তাকে করেছেন অজিত বাবু। চোখে ছানি পড়ল যখন টাকা তো উনিই দিয়েছিলেন সবকিছুর। অজিত বাবুর কথায় লুঙ্গি পরা সে ছেড়ে দিয়েছে। ধুতি ছাড়া তাকে এ তল্লাটে দেখে না কেউ। ক্লাস সেভেন অবধি পড়া অবশেষে কাজে লেগেছে। পণ্ডিত সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্যের ‘পুরোহিত-দর্পণ’ কিনে মন্ত্র আর পূজা পদ্ধতি মুখস্ত করার চেষ্টা করেছে রাতের পর রাত। ভুলে গেছে কতদিন! ভুলে গেলে গলা গম্ভীর করে “স্বোয়াহা, স্বোয়াহা” করে গেছে টানা দশ মিনিট। এইসবের ফসল পেয়েছিল জলু। সে মারা গেলে এই তল্লাটের কী হবে এই ভেবে তল্লাটের হিন্দুরা চাঁদা তুলে দশ হাজার টাকা দিয়েছিল তার হাতে। জলুর পৈতার খরচ । দেওঘরের ট্রেনেও টিকিট কেটে তুলে দিয়েছিল। একশো কিমি রাস্তা যেতে যেতে সে পঞ্চাশ চীনাবাদাম নুনঝাল সহ, দুই কাপ চা আর একটা ডিম সেদ্ধ খায়। দুইবার মুততে যায়। মুতে একবার থুক ফেলে। শেষবেলার চৈতের হাওয়া লাগছে মুখে। কিছু জায়গায় মুথা নুড়িয়ে জমি চষা হয়ে গেছে। অনেক দূরে গম ক্ষেতের মুথায় আগুন দেওয়া হয়েছে। বাড়ির খাওয়ার জন্য রাখার পর বেঁচে থাকা ফসল বস্তায় ভরে সাইকেল চালিয়ে বেচতে যাচ্ছে চাষারা। চারবার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ক্ষেতি, মাঠ ও এইসব দেখে। এই টাকা বালের পৈতার পিছনে খরচের কোনো মানে নাই। ফিক্সড ডিপোজিট করে দিলে লাভ আছে। “ বেটা রে! একঠো বাত কহিবার ছাও”, জলু নুনঝাল মাখানো তর্জনী সবে জিভের টাকরায় ঠেকিয়েছে। “তোরারিকা মা মুস্লা ছইলেন। ই কথা কভু না কইবি কিসিকো”, জলুর জিভ নুনঝাল চাইছে অথচ আঙুল নুনঝালে স্থির। “তোরারি আসলি জনেউ দেওয়া ঠিক না হইবো, তোরারি মা’কা আতমা যাতনা পাইবেক আর হাম্মার ভি পাপ হো যাইবেক আধা-মুস্লা’কা জনেউ দেনে পে”, জলুর জিভে আবার নুনঝাল ঠেকেছে জীবন মেনে। “তো কী করলহো কাক্কা?”, জলু অসহায়। ন্যাড়া মাথায় ছোট্টো টিকিওয়ালা জলুকে দেখে এ তল্লাট নিশ্চিন্ত হয়েছিল যে আরো অনেক বছরের জন্য একটা অর্জিনাল বামুণ পুরোহিত দিয়ে তারা বাড়ির পূজা করাতে পারবে। জলু নিশ্চিন্ত হয়েছিল, কাকা তাকে জোর বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছে। এক বছর স্বপ্নে বৌদি হাঁসুয়া হাতে না আসায় নিশ্চিন্ত হয়ে আট হাজার টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করে দিল সে।
এই তল্লাটের বাকি লোকদের মতোই করোনার কথা ততদিন অবধি সে বিশ্বাস করে নি যতদিন না দশ মাইল দূরের তল্লাটের আলিফের গল্প ঘুরপাক খেতে খেতে তার কাছে আসে। আলিফের গল্পে নিজের বোনের লাশ নিয়ে আলিফনূর পারভিন দেড় হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে নিজের ভিটায় এসে হাজির হয়। এই পথ অতিক্রম করতে তার নাকি লেগেছিল সতেরোদিন। ট্রাক, নৌকা আর ট্রাক্ট্ররে আধেকের বেশি পথ ; বাকিটা পোঁটলা পেঁচিয়ে বোনকে কাঁধে নিয়ে। লাশের গন্ধ লুকাতে গোবরে লেপে দিত বোনের বডি। কখনো কখনো নাকি নিজের গু-মুত দিয়েও কাজ চালিয়েছে বডি লেপার। চার রাজ্যের পুলিশকে দিতে হয়েছে চৌত্রিশশো টাকা। “বু লাগতো না তোর?”, মৌলভীর প্রশ্নে আলিফ নাকি জানায়, “লাগতো তো প্রথম প্রথম। তারপর অভ্যাস হয়ি গেল। তারপর আর কোনো বু-ই পাই না” । “বহিনের শেষ সাধ রাখতে বহিন ছাড়া আর কে করবে?”, মৌলভীর কথায় সকলেই যুক্তি খুঁজে পায়। “বহিনের হতে যাবে কেন! আমার সাধ আমার বহিন ভিটাতেই কবরে নিদ যাবে”, সকলেই আলিফের কথায় যুক্তি খুঁজে পায়। সাতদিন পর বোনের পাশেই কবর দেওয়া হল আলিফকে। তা মরার পরেও দুই-বোনকে পাশাপাশি নিশ্চিন্তে শুয়ে থাকতে দিলে তো! কোন শালা যেন বিডিও অফিসে গিয়ে খবর দিয়ে দেয়। প্লাস্টিক পরা লোকজন এসে কবর থেকে লাশ তুলে কোথায় নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মৌলভীসহ যারা মাটি দিয়েছিল সব ঘরবন্দী। পুরা টোলা বাঁশ দিয়ে ঘিরে নোটিশ ঝুলে গেল। আজরাইল আসি গেছে যেন বলে লোকে। আলিফের গল্প পুরা বিশ্বাস করতে চেয়েও সে পারে না। তবে আলিফের আর আলিফের বোনের শেষ ইচ্ছাটুকুর কথা ভাবতে গিয়ে ভয় আসে। মরার ভয় সমস্ত বোধবুদ্ধি কেড়ে নেয়। শুধু লোভটুকু কাড়তে পারে না। তার নিজের সাধটুকু চাগাড় দিয়ে চলে। ল্যালঠামি আসে।
কাতার কে কাতার এই তল্লাট থেকে দিল্লি, বোম্বে, কেরল যাওয়া জোয়ান মগামাগী ফিরছে। দু-চারটা ছুটকোছাটকা মরার খবর আসে। তার চেয়েও বেশি আসে কাজ না পেয়ে খিদার ভয়। মুখপট্টি দিয়ে মুখ ঢেকে ঘুরছে সবাই। সেও মাস্ক চাপায়। যজমানি বন্ধ হয়। টিনের বাক্স খোলে। আড়াই মাস নিশ্চিন্ত । “তল্লাটে ঘরফেরতা মানষিলাগুলানের সাথে সাথে নয়া জনমানুষও বেড়েছে না চাচা?”, আনছারুল পাঁউরুটি প্লাস্টিকে ঢুকিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে পুছে। “হ। বিয়াশাদি তো অনেকেই করে ফেলাইছে ওখানে। বিবি, বাচ্চা, বিবির আব্বা-আম্মা এমনকী বিবির দাদা-দাদিও চলে আসিছে অনেকের সাথে। ওসব জায়গায় তো মড়ক লেগেছে, দশ ট্যাকা দাও”, নাসিরের বাপ হাতের দুই তালু খুলে দশ দেখায় এবং এমন নির্লিপ্তি নিয়ে বলে যে মড়ক আর দশ টাকার ভিতর তেমন দূরত্ব থাকে না। দশ টাকার কয়েন রেখে খরিদ্দার একটা বান পাঁউরুটি নিয়ে যায়। “এ নিশ্চিত বাইরের মাল, বাংলা বোঝে না”, আনছারুল নিশ্চিত। “হ। দেখছস না পুরা মাস জুড়ে খালি আসে, টাকা দেয় আর মাল নিয়ে চলে যায়। নাই কোনোও বাতচিত। মালটার চোখও খারাপ আছে বুঝলি। তবে সাচ্চা মুসলমান, একদিনও ফেজ ছাড়া আসে নাই”, নাসিরের বাপের গলায় সম্ভ্রম।
এই সমস্ত সময়ে তাকে কেউ দেখুক, সে একদমই তা চায় না। এখানে কেউ নেই। কেউই কি নেই? ভিতর ঘরের কোণ দিয়ে যাতায়াত করা এক সারি লাল পিঁপড়ে, স্যাঁতস্যাঁতে কোণায় ঘাপটি মেরে থাকা একটা ঝিঁঝিঁ, টিউবের নিচে মুখ বার করে রাখা টিকটিকি , টিউবের আলো—- এই সবকিছুই দেখছে তাকে। সাবধানী চোখ জরিপ করে নেয় একবার। টিপে টিপে মারে দশটা লাল পিঁপড়া। আরশোলাটা খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে। চপ্পল দিয়ে আরশোলাটাকে মেরে ঝিঁঝিঁর দিকে নজর যায় তার। সিঁধিয়ে যায় ঝিঁঝিঁ বাক্স প্যাটরার পিছনে। টিকটিকিটা মুখটুকুও ঢুকিয়ে নেয় টিউব আর দেওয়ালের মাঝখানের অন্ধকারে। টিনের একটা মাঝারি বাক্স বার হয়ে আসে খাটের তল থেকে। কিচ্ছুটি সে ফেলে না। যত্নে আছে সব। তার সবটুকু। মুখ থেকে মাস্ক খুলে ফেলেছে খানিক আগেই। নাসিরের বাপের দেওয়া একমাত্র ইদি চিনামাটির একটা বড় থালা বাক্স থেকে বার করে আনে। বাক্সে ঢুকে শুয়ে পড়ে তার একসময়ের ফেজ টুপি। চোখ অপারেশনের চশমাও চোখ থেকে তার পাশে রেখে দেয় সে । শিশু কাঠের পূজার সিংহাসন থেকে নামিয়ে দেয় ছবিছাবা ও পাথরটাথর। পূজা করতে যাওয়ার হলুদ ধুতিটা অতি যত্নে বিছায় সেখানে। চিনামাটির থালাটা রাখে সিংহাসনে। পাঞ্জাবির পকেট থেকে বার করে আনে একটা বন পাঁউরুটি। থালায় পাঁউরুটি রেখে পাঞ্জাবি খুলে ফেলে সে। চিমসে যাওয়া ভুঁড়ির নিচে চুস্ত পাজামা। পৈতাটা কানে পেঁচিয়ে নেয়। এমন করে নাক টানে যেন এই ঘর থেকে পাঁউরুটির গায়ে লেগে থাকা এক ফোঁটা গন্ধও বার হতে দেবে না। চোখ বুজে যায়। চোখের ভিতর নাম না জানা অস্পষ্ট দাগটা আবার ঝাঁক হয়ে রক্তের ভিতর সাঁতরাতে শুরু করে। তার লোভের বয়স মাপতে পারে না সে। বেঁচে থাকার সুতীব্র লোভ ঝাঁক বেধে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার ভিতর। কত দিন ধরে? সাতষট্টি বছর এক মাস? নাকি এর সাথে মায়ের পেটে কাটানো চ্যাটচ্যাটে আঁধার মাখা আরো আট মাস সাত দিন যোগ হবে? নাকি আরো পুরানো এই লোভ? কত হাজার বছর ধরে এই ঝাঁক রয়েছে তার শরীরে? চল্লিশ হাজার বছর?
ঘরের দেওয়ালে থাকা আয়নায় তার মুখ ধরা পড়ছে। সে জানতেও পারছে না আপাতত একমাস ধরে বিকট ভাবে বাঁচতে চাওয়া একটি হাড় জিরজিরে কুকুর ও একটি রঙ না জানা ফুল একসাথে ফুটে আছে সেখানে। তীব্র ভাবে নাক টানে সে। কোনো গন্ধ পাচ্ছে না বনের। ঝিঁঝিঁ ডাকতে শুরু করেছে। চোখ মেলে কুকুরফুল।
Posted in: January 2021 - Cover Story, STORY