কাশবনের ভাস্কর্য : শুভংকর গুহ
“নিজের কিছু কথা ভোরের পাখির মতো সত্য হয়, এই পড়ে পাওয়া জীবনে অস্বীকার করি কি করে? নিজের স্মৃতিকথার সাথে এক ঝাঁক ছাতারে উড়ে আসার দৃশ্যকে মেলাতে গিয়ে দেখি, সবটাই বাতাসে উড়ে যাওয়া খইয়ের মতো লুটোচ্ছে বসতখানার উঠোন জুড়ে। কিছু কথা তুলে নিলে অনেক কথাই আবার যেন থেকে যায়, বাকি শুধু কল্পনা কৃষিজমি কর্ষণের মতো এক অভ্যাস, আত্মকথাকে ক্রমশ উর্বর করে তোলে।”- কথাসাহিত্যিক শুভংকর গুহের আত্মকথা ‘কাশবনের ভাষ্কর্য’। বাবার কর্মসূত্রে পানাগড়, আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, মথুরা, কানপুর, এলাহাবাদ সহ ভারতের বিভিন্ন শহরে বসবাস করেছেন লেখক। সেই যাপনের অভিজ্ঞতা, স্মৃতি এক সময়ের দলিল নিঃসন্দেহে।
৫
ইস্তানিয়া গুস্তাভ।
আমি ডায়েরির পাতায় এক কোণে, লিখে রেখেছিলাম।
নীল রঙয়ের ডায়েরি। প্রথম দিকে, লিখেছিলাম একটি বিখ্যাত ফরাসি উপন্যাসের মহিলার চরিত্রের নাম, মদাম মোয়েজল। অনর দ্য বালজাক অথবা সমারসেট মম দুই মহান ঔপন্যাসিকের আখ্যানে মদাম মোয়েজল যেন ছড়িয়ে আছে। কোনো না কোনো শহর বা পল্লীর রাস্তা ধরে ভারি গাউন পড়ে হেঁটে যাচ্ছে। মধ্যবয়সী মহিলার অসম্ভব গোলাপি গাল, চোখের দৃষ্টিতে কেমন এক বিষণ্ণ লেক বা সরোবর। আর আলো আঁধারি একটি কুটির বা অভিজাত মহলের এক কোণে বসে কালো কফিতে চুমুক দিচ্ছে। বিকেলের চার্চের ঘণ্টা বাজছে, আর পড়ে যাওয়া সোনালি রোদ তাজা ফুল ও কেকের গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
তারপরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের অমিত। সমস্ত যুক্তিকেই বা সংলাপের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বুদ্ধি চিন্তার নতুন সমীকরণ গড়ে তুলছে। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে আমাদের সনাতনী রক্ষণশীল মনোভাবের চারদুয়ার। এরপরে গাব্রিয়েল ওক ও বাথসেবা। টমাস হার্ডির এই দুই চরিত্র আমার যৌবনের ধানমাঠকে প্রগাঢ় হলুদ করে দিয়েছিল। মিখাইল সলোকভের ‘ধীরে বহে ডন’ – এই মহাকাব্যিক উপন্যাসের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম, প্রেমের অন্য সংজ্ঞা। ভিওশোনস্কায়া জেলার একটি ফসলের ক্ষেত ও খামারবাড়ি সমৃদ্ধ একটি গ্রাম। গ্রামটির নাম তাতারস্কি। কাহিনী জুড়ে ছড়ানো আছে মেলেখভ পরিবারের যুবক গ্রিগোরির সঙ্গে পড়শী আস্তাখভ পরিবারের বৌ আক্সিনিয়ার গোপন প্রেম। বিষয়টি গ্রিগোরির পরিবার জানতে পারল। অবস্থার সামাল দিতে, গ্রিগোরির বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল, গ্রামেরই অবস্থাপন্ন চাষি কোরশুনভ বাড়ির মেয়ে নাতালিয়ার সঙ্গে। এই উপন্যাসের আখ্যানের ভাবনাকে, আমি নিজেই সেই ভাবনার সাথে আমার দেশীয় আচরণকে মেলাতে চেয়েছি। আমিও একটি ধানমাঠে বসে খড় পুড়িয়ে কেটলিতে চায়ের জল গরম করছি। আমার পাশে বসে আক্সিনিয়া ফু দিয়ে যাচ্ছে, আগুন উসকোবার জন্য। আক্সিনিয়ার গোলাপি গাল, ফুলে উঠেছে, বহুদূরে কসাকরা ছুটে যাচ্ছে ঘোড়ার পিঠে চেপে, ডন নদীর দিকে। ডন যেন প্রশান্ত এক প্রবাহ। শুকনো স্তেপভূমি এক প্রেমহীন পাণ্ডুলিপির মতো। আমাকে আর আক্সিনিয়াকে কেউ দেখছে না। আমি আক্সিনিয়াকে বললাম, তোমাকে যে একটি ফার কোট দিয়েছিলাম, সেইটি তুমি পড়োনি কেন? আক্সিনিয়া বলল, সেটি আগুনে পুড়ে গেছে। আমি চুপ করে গেলাম, তারপরে আক্সিনিয়া আমাকে একটি চুমু দিয়ে বলল, দক্ষিণ দিকের স্তেপভূমির ওই দিকে একটি ভীষণ নির্জন স্থান আছে। বলগা হরিণগুলি মিথুনের জন্য জোট বাঁধে। যাবে ওইদিকে। আক্সিনিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষণ। সে হাসতে হাসতে বলল, তোমার চোখ দুটি বসন্তের সকালের আলোর মতো চকচক করছে।
মানুষের মন দিনের বিভিন্ন সময়ে কোনো না কোনো উপন্যাসের চরিত্র হয়ে ওঠে। আমারও তাই হত, কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায়, চরিত্রগুলি আমার ঘরের চৌকাঠের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। অভাবের সংসার ছিল আমাদের, পাঁচ ভাই মা, তখন পূর্ববঙ্গ বা পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ দেশের বাড়ি থেকে অতিথিদের আগমন – বাবার একা টেনে তোলা সংসার যেন একটি খামার, মা সারাদিনের কাজের অবসরে, সন্ধ্যায় সুই সুতো দিয়ে আমাদের ঘরে পড়ার জন্য ফতুয়া রিপু করতেন বা মেশিনে মার্কিন কাপড় সেলাই করতেন। বোবা কথা বলতে পারেন না, খুব প্রয়োজনে দরজি কাকু বড় কিছু সেলাই করার জন্য বাবার তরফ থেকে বায়না পেতেন। কিন্তু সেই শৌখিনতার জন্য অর্থ বরাদ্দ কম কিছু নয়।
রাত হয়ে এলে, যখন খেতে বসতাম, আমার স্মরণে একটি দুঃখী চরিত্র রান্না ঘরের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকত। তার নাম কুন্তা। ভারতীয় উপন্যাসে কুন্তার সন্ধান যেন আমাদের ভাতের থালার ওপরে এক হাহাকার। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের কুন্তা আমার রাতের ভাতের থালাকে এখনও যেন বিব্রত করে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই লিখছেন,- “মানুষ কি চায় – উন্নতি, না আনন্দ? উন্নতি করিয়া কি হইবে, যদি তাহাতে আনন্দ না থাকে?…যাহারা জীবনে উন্নতি করিয়াছে বটে কিন্তু আনন্দকে হারাইয়াছে। অতিরিক্ত ধার ক্ষইয়া ক্ষইয়া ভোঁতা জীবন তাহাদের নিকট একঘেঁয়ে, একরঙা, অর্থহীন – মন শান বাঁধানো, রস সেখানে ঢুকিতে পারে না।”
সাহিত্য পাঠজীবনের একটি বিস্তৃত অধ্যায় আমাকে শায়িত জীবনের এমারজেন্সি ওয়ার্ড থেকে বারে বারে তুলে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একটি উঠোনে, যাকে আমি ভরা চৈত্রের উঠোন মনে করি, কী ভীষণ একা একা বাতাস আর হাহাকার, জীবন জুড়ে এত বন্ধুবান্ধব প্রেম সখ্য সে পরের কথা না হয় পরে বলা যাবে, তবুও লিখে ফেলার লোভ কি করে পার হই। কিন্তু লিখতে বসলে, স্মৃতির সাথে মিথ্যাচারণ করলে, নিজের জীবনের সাথে গুপসুপ প্রেম হয় না। সারাজীবন সমর্পিত প্রেমের জন্য হাহাকার করে গেলাম। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রেম এক ছলনা, পর্বত দেখার মতো আনন্দ কোনোদিন পেতে চাই নি, চেয়েছি একটি নিরহঙ্কারী ক্ষীণ ছোটো নদী দেখার আনন্দ। কিন্তু সত্যি এই জীবনে সেই প্র্যতাশা পূরণ হল না। দেখি আবার যদি মানবজন্মের জন্য আমার প্রয়াত মা একটু তাঁর গর্ভে স্থান দেন… তা হলে !!! আমিও গৌতম বুদ্ধের কাছে আশ্রয় নেব। তাঁর শরণাপন্ন হব।
শুরু করেছিলাম ইস্তানিয়া গুস্তাভর কথা দিয়ে। ইস্তানিয়া গুস্তাভ আমার কল্পনায় এক আলোছায়ার সমন্বয়, আমার গভীরে সে হেঁটে চলে বেড়াত। রাতে ঘুমিয়ে তাকে অনেকবার দেখেছি। আমার সঙ্গে চমৎকার আমাদের পারিবারিক ভাষায় সে কথা বলত। আমার সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতায় সেই সব কালজয়ী চরিত্রের সঙ্গে ইস্তানিয়া গুস্তাভর কোনো মিল ছিল না। ওই যে হয় না, পার্বতী, শশী ডাক্তার, কুসুম, হেরম্ব সুরেশ, দামিনী, শ্রীবিলাস বিখ্যাত উপন্যাসের চরিত্রগুলি প্রবীণ স্মৃতিতে বিস্তর আলোছায়া ফেলে চলেছে আজও। ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রায় সাড়ে নয় বছর পরে আমার জন্ম। যৌবন বয়স থেকে সেই সময়ের প্রবীণ শ্রদ্ধেয় মানুষদের মননে যে ঔপনিবেশিক হ্যাংওভার ছিল, আমার মনেও সেই বীজ পুঁতে দিয়েছিল আমারই দেখে যাওয়া ও সহবাসের সাথে চারপাশ।
ইস্তানিয়া গুস্তাভ কোন দেশের মানুষ, আর কেনই বা তার নাম ইস্তানিয়া গুস্তাভ, আর কেনই বা তার গায়ের রঙ বর্ণ আমি সঠিক ভাবে আজও বুঝে উঠতে পারি নি, তা বলতে পারব না। কারণে অকারণে আমি উচ্চারণ করতাম ইস্তানিয়া গুস্তাভ, জানি না, এই ধরা না ছোঁয়া মানুষটি, আমাকে কোনো সময়ে বিব্রত করত, আর বলত,- উঠে পড়ো, চলো ঘুরে আসি। আমি বলতাম কোথায় যাবে এই রাত্রে? সে পরের পর কতগুলি দেশের নাম করে যেত যেমন,- পর্তুগাল, মিশর, সুদান, আলবেনিয়া, কাজাকিস্থান এমন অনেক। তারপরে বলত,- দেখ একবার যদি তুমি একটি দেশের নাম মনের মধ্যে বসিয়ে নিতে পারো, তা হলে দেখবে সেই দেশটি তোমার সামনে হাজির হয়েছে। ইস্তানিয়া গুস্তাভর কথা শুনে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলাম, পৃথিবী হল মহাকাশের মধ্যে একটি অতি ক্ষুদ্র একটি ছোটো গ্রাম, যার নামের ভিতরে বসবাস করছে নানান জনপদের ভাবনা।
একদিন হল কি, আমাদের বাড়ির উঠোনে, সে একটি চারপাই পেতে তার ওপরে বসে শুরু করল কথা বলা। সে বলতে থাকল,- “অনে, হল কি আমি তোমাদের শহরের বন্দরে নেমে, যখন একটি মহাসড়ক অতিক্রম করছি, দেখলাম অনেক মানুষ সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। তাদের কাউকেই আলাদা করে চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না। দেখলাম সব মানুষ কি অসম্ভব নীরবতা পালন করছে। সবাই মিলেমিশে একটি আকার নিয়েছে, আমি কারও ভিতরে আশ্রয় নিয়ে তার শরীর ধারণ করতে চাইছিলাম। সেই সময় খুঁজে পেলাম তোমাকে, তুমিও সবার মধ্যে দাঁড়িয়ে মিলে মিশে গেছ।
আমি ইস্তানিয়া গুস্তাভ কি ভাবে জানি তোমার ভিতরে আশ্রয় নিলাম নিজেই জানি না। তারপর থেকে তুমি আমাকে লালন করে চলেছ। আমি জানি তুমি কোনোদিন কোনো বন্দরে যাও নি, কিন্তু আমি তবুও তোমাকে খুঁজে পেয়েছিলাম একটি বন্দরে। সে ভারি মজার। আসলে কি জানো, আমাদের কল্পনাই ঘটিয়ে চলে সমস্ত দুর্ঘটনা, আর স্মৃতিকে তোলপাড় করে তোলে। নিজের জীবনের কথা লিখতে গিয়ে দেখবে সব কল্পনাই কেমন বহু দূরের নক্ষত্র হয়ে গেছে। আমি কল্পনায় তোমার ঘুম জাগরণে চেতন অবচেতনে মিশে আছি। তুমি এবার ভাবো ইস্তানিয়া গুস্তাভকে কতটা আশ্রয় দেবে, আর দেবে না। আমি তোমার অন্দরে একটি ঔপনিবেশিক চরিত্র, এই আছি এই নেই, সবটাই তোমার স্মৃতির ইচ্ছে অনুযায়ী। আমাকে তুমি তোমার কল্পনা দিয়ে বুনে যাচ্ছ। সেখানে ইস্তানিয়া গুস্তাভর কোনো হাত নেই। আসলে তার অস্তিত্বই নেই।”
এখন কত রাত্রি, জানি না, জোনাকি মিট মিট আলোর সাথে ঘরের ভিতরে আসবাব ছুঁয়ে যাচ্ছে। কী ভীষণ একাকী এই মধ্যরাত্রি, জানালার ওপারে জলাশয়ের মধ্যে গাছের ছায়াগুলি, স্তব্ধতার সাথে তনহাইয়া ভাঙ্গছে। ভোররাত্রের দিকে প্রতিদিন একটি বিড়াল ঘরের ভিতরে এসে পায়চারি করে। কোনো কিছু পতনের শব্দ হল ঝন ঝন, তারপরে গড়িয়ে গেল। উঠে বসলাম। ফিরে গেলাম একটি জলাশয়ের ধারে। পানাগড় থেকে ফেরার পরে কলকাতার শহরতলী অঞ্চলে সেই সময় আবিষ্কার করেছিলাম দূরে জলাশয়ের থেকে ভালো আয়না আর কিছুই নেই। নিজের মুখ দেখছিলাম আর বাবাকে মনে মনে বলছিলাম,- বড় হয়ে তোমার মতো আমিও সামরিক বাহিনীতে যোগদান করব।
বাবা বলেছিলেন,- কোনো কিছুই আগে থেকে বলতে নেই। এখন যেটা করার মনোযোগ দিয়ে করো, তা হলেই যা ভাবছ তাই হতে পারবে।
Posted in: November 2020 - Serial, PROSE