রবীন্দ্রনৃত্য ভাবনাঃ প্রেক্ষিত ও চলন – সোমা দত্ত
তৃতীয় পর্ব
বাল্মীকি প্রতিভা (১৮৮১): ১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দের ২৬ শে ফেব্রুয়ারি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে বিদ্বদজ্জন সমাগম সভার বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষ্যে অভিনীত হয় ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ গীতিনাট্যটি। বাল্মীকি প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ রচিত প্রথম গীতিনাট্য এবং জোড়াসাঁকো বাড়ির যৌথ প্রযোজনা বলা যেতে পারে। গানে সুর সংযোজনে সহায়তা করলেন খোদ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ,অভিনয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ (বাল্মীকি) ও ভাতুষ্পুত্রী প্রতিভা(সরস্বতী) এখানে সমস্ত কথাবার্তা হয় গানের মাধ্যমে।সেইসময় প্রকাশিত বিহারীলালের ‘সারদামংগল’ মংগলকাব্যের অনুপ্রেরণায় তিনি দস্যু রত্নাকরের কাহিনীকে গীতিনাট্যের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করলেন।
এ’প্রসংগে আবার একটু ফিরে দেখব সেই সময়ের রবীন্দ্রনাথের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ। বিলাত যাওয়ার আগে থেকেই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরে কথা বসিয়ে তাকে গানে বেঁধে ফেলার একরকম অনুশীলন শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। পিয়ানোতে দেশি বিদেশি সুরে তুলে সুররচনা করতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর সেই সুরে কথা বসাতেন অক্ষয় চৌধুরি, ক্রমে রবীন্দ্রনাথেরও ডাক পড়ে এ কাজে। বিলাত থেকে ফিরে এসে দেখলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘মানময়ী’ গীতিনাট্য রচনার কাজ শেষ। রবীন্দ্রনাথ শেষে ‘আয় তবে সহচরি’ গানটি যোগ করে তাতে নাচ জুড়ে দিলেন। ‘মানময়ী’ গীতিনাট্য রচনার প্রথম প্রচেষ্টা, যদিও এখানে সংলাপ ছিল গদ্যে। ‘মানময়ী’ তে রবীন্দ্রনাথ মদনের, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ইন্দ্র ও কাদম্বরী দেবী উর্বশীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন।
বিলাত থেকে নাচ সম্বন্ধে যে বিপুল অভিজ্ঞতা ও কিছুক্ষেত্রে পারদর্শিতা নিয়ে ফিরেছিলেন তাকে কাজে লাগালেন ফিরেই। দেশি বিদেশী সুর নিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ যে নতুন সুরসৃষ্টিতে মন দিয়েছিলেন তা কোথাও রবীন্দ্রনাথকেও প্রভাবিত করেছিল। আবার সেই সময় হারবারট স্পেন্সসরের লেখা পড়ে সংগীত সম্বন্ধে নতুন সব ধারণা গড়ে উঠছে তাঁর মনে। সেসব ভাবনা পরবর্তীকালে বদলেও গেছে স্বাবভাবিক নিয়মে। ভাঙ্গাগড়ার সৃজনশীল খেলায় যেন মেতে উঠেছিলেন দুইভাই সাথে পরিবারের সদস্যরাও।
‘মানময়ীর’ একবছর পর ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ পূর্ণাঙ্গ গীতিনাট্য হয়ে উঠল যেখানে সংলাপও হল গানের মাধ্যমেই। সেই একইভাবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সুরের ধারায় কথা বসিয়ে গান রচনা করলেন রবীন্দ্রনাথ, অক্ষয় চৌধুরিও যোগ দিয়েছিলেন সে কাজে। তারপর তা অভিনীত হল জোড়াসাঁকো বাড়িতেই যা প্রচুর আলোড়নও তুলেছিল তৎকালীন বিদ্বৎসমাজে। জোড়াসাঁকো বাড়িতে এমন যৌথ সৃষ্টি ও অভিনয়ের প্রচলন ছিলই বাড়ির সদস্যদের মধ্যে, যা ক্রমে বাইরের দর্শকের রুচি ও বোধে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করল।
‘বাল্মীকি প্রতিভা’ সমসাময়িককালেই তিনি সংগীত বিষয়ে তিনটি প্রবন্ধ রচনা করছেন। সুরের সাথে কথা বসিয়ে গান রচনার যে ধারা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ শুরু করেছিলেন তাই কতটা তিনি অনুসরণ করেছেন এখানে এবং তার স্বপক্ষে যুক্তিও হাজির করেছেন প্রবন্ধগুলিতে। আবার এরই ত্রিশ বছর পরে নিজের মত পরিবর্তন করেছেন জীবনের স্বাভাবিক নিয়মেই।
মানুষের মনোজগৎ যা তার পারিপার্শ্বিক ঘটনা অভিঘাতে গড়ে ওঠে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। সেই স্বাভাবিক নিয়মেই গড়ে উঠছিলেন রবীন্দ্রনাথও, চিন্তাশীল দাদাদের অভিভাবকত্বে, সাহচর্যে, শিক্ষায় আর বৌ ঠাকুরানীর স্নেহে আদরে। এরই মধ্যে প্রেমও এসেছে তাঁর জীবনে। সে অনুভূতি নিজে রেখে গেছেন তাঁর কাব্যে।
তৎকালীন সময়কালে নাট্যচর্চা:
১৭৯৫ কলকাতার আধুনিক থিয়েটরের জন্ম রাশিয়ান মিউজিশিয়ান গ্রাসিম লেবেদেফের উদ্যোগে। অভিনীত হয় তাঁরই অনুবাদ করা দু’টি নাটক। শুধুমাত্র এতটুকুই যদি বলি তাহলে এই বোঝা যায় যে নাট্যের কোনো আদর্শই আমাদের বুঝি ছিলনা কোনকালে। তা একেবারেই ঠিক ভাবনা নয়। প্রতিটি গোষ্ঠীর মাঝে তাদের নিজস্ব নাচ গান নাট্য প্রবলভাবেই উপস্থিত ছিল, এখন প্রায়শই বিলুপ্তপ্রায় লোকশিল্প বলে যাদের আমরা ব্যাখ্যা করে থাকি। আলকাপ, খন, আখরাই, হাফ আখরাই, যাত্রা আরো আরো অনেক নাট্যধারা ছিল। কিন্তু ইংরাজি শিক্ষিত, আদব কায়দায় রুচিতে বিদেশি মিশেলে যে নব্য বাঙালি সমাজ তৈরি হচ্ছে তার রুচি অনুযায়ী নয় সেসব।
ব্রিটিশ শাষকের সাথে মনান্তরের ফলশ্রুতিতে লেবেদেফ এ দেশ থেকে বিতাড়িত হলেও কলকাতা কেন্দ্রিক থিয়েটারের সূচনা কিন্তু করেই দিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর নানা রথী মহারথী এসেছেন কলকাতা থিয়েটারের মঞ্চে। সংস্কৃত থেকে পাশ্চাত্য নাটক নানা প্রভাবের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে দেশি বিদেশি মিশেলে বাংলা নাটক ও থিয়েটারের (কলকাতা কেন্দ্রিক) যাত্রা শুরু হয়েই গিয়েছে।
বাল্মীকি প্রতিভার যে সময়কাল (১৮৮১) তখন বাংলা থিয়েটারের অঙ্গনেও সংস্কৃত নাটক থেকে পাশ্চাত্য থিয়েটারের প্রভাবে, কখনও প্রভাব কাটিয়ে স্বনির্ভর হওয়ার প্রচেষ্টায় নাটক রচনা ও তার অভিনয় হচ্ছে। আবার জাতীয়তাবাদী (হিন্দু) ও রোম্যান্টিক নাটকের শুরুও হচ্ছে কাছাকাছি এই সময়েই। কালীপ্রসন্ন সিংহের প্রহসন (বাবু), অনুবাদ নাটক (বিক্রমোরবশী, মালতী-মাধব,১৮৮৫) ছাড়াও স্বদেশ চেতনা উদ্বোধক নাটক রচনার সূচনা হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শুরু করেছিলেন তাঁর উপন্যাসে, হেমচন্দ্র (ভারত সংগীত, ভারত ভিক্ষা,বৃত্র সংহার) ও নবীনচন্দ্র (অবকাশ রঞ্জিনী, পলাশীর যুদ্ধ) শুরু করলেন নাটক রচনায় এবং সেই নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে এই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন যে হিন্দুমেলার সময় থেকেই তিনি ভাবতে শুরু করেন কিভাবে দেশের মানুষের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগ্রত করা যায়। দেশের অতীত গৌরবময় কাহিনীর সাহায্যেই এই কাজ সম্ভব বলে মনে করে ঐতিহাসিক চরিত্রের বীরগাথা মূলক কাহিনী নিয়ে নাটক রচনায় প্রবৃত্ত হন। সে উদ্দেশ্যেই দেশাত্মবোধক গান ও নাটক রচনার শুরু। তাঁর নাটকগুলি পুরুবিক্রম (১৮৭৪) সরোজিনী (১৮৭৫) অশ্রুমতী (১৮৭৯) ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে হলেও সেখানে তাঁর নিজস্ব কল্পনা মিশ্রিত কাহিনী নাটকে রোম্যান্টিকতার জন্ম দিয়েছিল। ‘অশ্রুমতী’র কাহিনী নিয়ে অবাঙ্গালী সমাজে যথেষ্ট আলোড়ন উঠেছিল কারণ এখানে প্রতাপসিংহের কন্যা অশ্রুমতী সেলিমের প্রেমে আচ্ছন্ন ছিলেন।
‘বাল্মীকি প্রতিভা’ রচনার সময়েও এই মনোভাব কাজ করেছিল এবং বিহারীলালের তৎকালীন প্রকাশিত মঙ্গলকাব্য থেকে কাহিনী সংগৃহিত হয়েছিল। বলা বাহুল্য যে বিষয়ের সাথে সাথে নাটক ও গীতিনাট্যের গঠনঙ্গত দিক নিয়েও নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে চলেছিল। নব্য উদ্বোধিত বাঙালির রুচি অনুযায়ী, বাংলা নাটক-গীতিনাট্য কেমন হবে তার আদর্শ তারাই গড়ে নিয়েছিলেন। সবটাই গড়ে নেওয়ার উদ্যোগ চলছিল শিক্ষিত মননশীল বাঙ্গালীদের প্রচেষ্টায়।
আরও গভীর বিষয় ছিল যে দেশ বলতে আমরা কি বুঝব? ব্রিটিশ অধিকৃত যে ভূখন্ড তাই তখন এক দেশ হিসেবে গণ্য হতে শুরু করেছে। বৃটিশের আগে পর্যন্ত যা ছিল মোঘল সাম্রাজ্য এবং ছোট বড় রাজার রাজ্য। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ দেশ বলতে বোঝে সে নিজে যে অঞ্চলে বাস করে সেই অংশটুকুকেই। সাধারণ বাংগালীর উত্তর, দক্ষিণ পশ্চিমের প্রভিন্স বা ভূখন্ড সম্বন্ধে ধ্যানধারণা প্রায় ছিলনা বললেই চলে। নতুন ধারণা গড়ে তুলছিলেন দেশের ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ, একথা বললে মোটেই অত্যুক্তি হবেনা।
এই সময় থেকেই একটা বৃহৎ পার্থক্য শুরু হয় একই দেশ কাল সময়ে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে, আদর্শের, ভাবনার পার্থক্য। পাশাপাশি বাস করা দু’টি মানুষ একে অপরের ভাষা, ভাবনা বোঝে না। পরস্পরের ভাবনার আদান প্রদান ঘটে ওঠেনা। তাই সমস্ত দেশের এক হয়ে ওঠা কখনোই ঘটে ওঠেনা।
ধীরে ধীরে বিভাজন স্পষ্ট হতে থাকে। জাত-পাত, ধর্ম,ধনী-দরিদ্র, কুলীন- অকুলীন এমন অজস্র ভেদের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের নয়া ভেদ দেখা দিল বাঙালি সমাজে। মুলত ইংরাজী শিক্ষা ও ব্রিটিশ ও অন্যান্য বিদেশি আদব কায়দায় রপ্ত নতুন বাঙালি অভিজাত শ্রেনীই শিল্প সংস্কৃতির সমস্ত ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব রুচি ও বোধ অনুযায়ী পরিবর্তন করতে শুরু করলেন।
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি এই নব্য শিক্ষিত অভিজাত বাঙালি সমাজে অগ্রগণ্য পরিবার তাতে কোনো সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথও এই পারিবারিক শিক্ষা সংস্কৃতিতেই বড় হয়ে উঠেছেন এবং এই নতুন ভাবধারার গঠনকাজে দাদাদের সাথে নিজেও যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যতিক্রমী অবিস্মরনীয় হয়ে উঠছেন তাঁর বোধের জায়গা থেকেই। ইংরাজী শিক্ষা ও তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থার বিরোধীতায় যখন তিনি সুচিন্তিত দৃঢ় মতামত ব্যক্ত করছেন এবং তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অন্যধারার শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে উদ্যোগী হচ্ছেন তখনই তিনি দেশ কাল সমাজের থেকে অনেকদূর এগিয়ে থাকা একজন চিন্তাশীল মননশীল ব্যক্তি হিসেবে নিজের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করছেন।
১৯০১ শান্তিনিকেতন বিদ্যালয় স্থাপন:
১৯০১ সালে মাত্র পাঁচজন ছাত্র নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বোলপুরের শান্তিনিকেতন বাড়িতে ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। শিক্ষা সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা তিনি প্রকাশ করেছেন শিক্ষা সম্বন্ধীয় নানা প্রবন্ধে। তৎকালে ব্রিটিশ সরকার দ্বারা যে শিক্ষা চালু হয়েছিল তার ঘোরতর বিরোধী ছিলেন তিনি। শিক্ষা নামক প্রবন্ধে তিনি স্পষ্টতই বলছে যে এই শিক্ষা ব্যবস্থায় ছেলে মানুষ হইবেনা। এই শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষ কেরানী তৈরি হইতে পারে কিন্তু জাতির অগ্রগতির জন্যএ শিক্ষা কাজে লাগবে না।
প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশের প্রয়োজন ছিল কিছু দক্ষ কর্মচারী যারা কিছুটা ইংরাজী বোঝে ও কাজ চালানোর মত বলতে পারে।বেশকিছু ইংরাজ সাহেব পরিচালিত স্কুল তারা খুলে বসে, যেখানে প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল প্রয়োজনীয় কিছু ইংরাজি শব্দ বাঙালিদের গিলিয়ে দেওয়া। যে যত বেশি ইংরাজি শব্দ জানে সে তত বড় শিক্ষিত। শব্দের সাথে ভাষার সাথে পরিচয় করানো তার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠা সম্পূর্ণ অন্য বিষয়, সে উদ্দেশ্য তাদের কখনো ছিলনা। ওরিয়েন্টাল সেমিনারি ও নর্মাল স্কুল এই গোত্রেরই দু’টি স্কুল যেখানে রবীন্দ্রনাথ কিছুকাল গিয়েছিলেন এবং স্কুল সম্বন্ধে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেরেন।
“অত্যাবশ্যক শিক্ষার সহিত স্বাধীনপাঠ না মিশাইলে ছেলে ভালো করে মানুষ হতে পারেনা – বয়ঃপ্রাপ্ত হইলেও বুদ্ধিবৃত্তি সম্বন্ধে সে অনেকটা পরিমাণে বালক থাকিয়াই যায়।” শিক্ষা নামক প্রবন্ধে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের মত। এখানে তিনি আরো বলেছেন, “দেশের রোগ আর বিদেশের শিক্ষা, ঘরের দারিদ্র্য ও পরের দাসত্ব এই সব-কটায় মিলিয়া আমাদের স্বল্পায়ু জীবনটাকে শোষণ করিতেছে।”
শুধুমাত্র প্রবন্ধ লিখে সমালোচনা করেই খালাস হননি, হাতে কলমে করে দেখিয়েছিলেন কেমন হতে পারে প্রকৃত শিক্ষা। প্রথম যুগের শান্তিনিকেতনে কিরকম ছিল ছাত্র শিক্ষকের জীবনযাত্রা, কেমন ছিল শিক্ষাদানের পদ্ধতি আগে একটু দেখে নিই।
শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের প্রথমযুগের ছাত্রদের সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেদের বিছানা ও ঘরঝাট দেওয়া দিয়ে দিন শুরু হত। তারপর প্রাতঃকৃত্য, স্নান ও সাঁতার শেখা। নিজেদের থালাবাটি নিয়ে খাবার ঘরে গিয়ে খাওয়া, তারপর নিজেদের থালা বাটি মেজে ধুয়ে জায়গায় রাখা, প্রতিবার খাওয়ার একই নিয়ম।
ভাষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার পাশাপাশি ব্যায়াম শিক্ষা, বাগান ও চাষের পদ্ধতি শেখা, মাটি কেটে সমান করে রাস্তা বানানো, ঘানী থেকে তেল বার করা, কাঠের কাজ, তাঁতের কাজ, শ্রম সাপেক্ষ সমস্ত কাজ তাদের দল ভাগ করে করতে হত। সন্ধ্যেবেলা বিজ্ঞান শিক্ষকের কাছে টেলিস্কোপে তারা দেখা ও তাদের গল্প শোনা, গান, উপাসনা, নাটকের মহড়া এই ছিল তাদের রুটিন। নাটকের মহড়া দিতেন খোলা জায়গায় যাতে আশেপাশের মানুষ দেখে এবং তাদের মন তৈরি হয় নাটকের অনুকূলে। এখানেও শেষ নয়। ছাত্রদের দলে নিয়ম বানানো ও তার পালনের দায়িত্ব ছিল তাদের নিজেদের।কেউ নিয়ম পালন না করলে ছাত্ররাই বিচারসভা বসাবে এবং তাদের সংশোধনের চেষ্টা করবে।
বড় ছাত্রদের এবং অধ্যাপকদের একটি দল গড়া হত যারা কাছাকাছি সাঁওতাল, ও হিন্দু ও মুসলিম গ্রামগুলিতে গিয়ে তাদের অভাব অভিযোগ শুনবে, দৈনন্দিন জীবনের সাথে পরিচিত হবে, তাদের কি প্রয়োজন জানবে এবং সেই প্রয়োজন পূরণের জন্য কাজ করবে।রবীন্দ্রনাথ বলছেন এইভাবে হবে প্রকৃত শিক্ষা, মানুষ হয়ে ওঠার পথ এই।
প্রথম পর্বে আলোচনা করেছিলাম, নগর সভ্যতায় আমরা সরে এসেছি কায়িক শ্রম থেকে। যত সরে গেছি ততই জীবন গড়ার থেকে সফলতার দিকে চলে গেছে আমাদের নজর। একটি একটি জীবন গড়ার মধ্য দিয়ে জাতি গঠনের যে প্রক্রিয়া বহুলাংশে তার থেকে সরে এসেছিল দেশের শিক্ষা পদ্ধতি। অথবা জাতি গঠন বা ছাত্রদের জীবন গঠনের দিকে নজর একেবারেই ছিলনা বলা যেতে পারে। শান্তিনিকেতনে প্রথমেই নজর দেওয়া হল কায়িক শ্রমের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের শরীর ও মানসিকতা গড়ার দিকে।
প্রকৃতির মধ্যে থেকে প্রকৃতি ও তার নিয়ম তার চলনের সাথে পরিচিত হতে পারলে ছাত্রদের কল্পনা শক্তি ও পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং প্রকৃতির সাথে যোগ তৈরি হয়।মানুষ প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ করে, তার রহস্য উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়েই তার জ্ঞান ভান্ডার তৈরি করেছে। শুধু চর্বিতচর্বণ নয় নতুন সত্য উদ্ঘাটনের জন্য তাই প্রকৃতির সাথে যোগ স্থাপন করাই একমাত্র পথ।
প্রাচীনকাল থেকেই সাধারনের মধ্যে সামাজিক, ধর্মীয় ও নীতিশিক্ষার জন্য নাট্যের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, নগর জীবনে অনেকাংশে যা থেকে সরে এসেছিল বাঙালি জীবন। খোলা জায়গায় নাটকের মহড়ার মধ্যে দিয়ে ছাত্র শিক্ষক ও ওই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মনকে তৈরি করতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নাট্যচর্চার একটি বিরাট স্তম্ভ নাচ,নৃত্য। ক্রমশ নৃত্যের ছন্দে-সৌন্দর্যে-আন্দোলনে মাতিয়ে তুলবেন তার শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়। পরের পর্বে আসব সে আলোচনায়।
মুখস্থ বিদ্যা নয় বিষয় সম্বন্ধে আগ্রহ তৈরি করার উদ্দেশ্যেই সম্যকরূপে সেই বিষয়ের সাথে পরিচয় করানো ছিল শান্তিনিকেতনের শিক্ষার আদর্শ। জীবনে নিয়মানুবর্তিতা জরুরি কিন্তু তা কখনোই বাইরে থেকে চাপিয়ে দিয়ে হয় না, তাই নিয়ম তৈরি করত ছাত্রেরা নিজেরাই। আবার কেউ নিয়ম পালন না করলে তারা নিজেরাই বিচার সভা বসাত ও তাকে সংশোধনের চেষ্টা করত। শাস্তি নয় সংশোধন, এবং ছাত্রদের মধ্যে দ্বায়িত্ববোধ গড়ে তোলার এ অবিস্মরণীয় পথ।
নিজেদের চারদিকে গন্ডি কেটে শুধু নিজেদের মধ্যে মগ্ন থেকে জীবনের সার্থকতা নেই, তাকিয়ে দেখা দরকার চারপাশের মানুষজনের দিকে,তারা আমার দেশেরই মানুষ, তাদের অভাব, প্রয়োজন, জীবনযাত্রা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা না থাকলে দেশ কি দেশের ভালো কিসে তা সম্যকরূপে জানা সম্ভব নয়। দেশ শুধু আমাদের কল্পনায় নিজেদের মত করে গড়ার বিষয় নয়, তার বাস্তব রূপ বাস্তব চরিত্রের সাথে পরিচিত হওয়া জরুরী। জরুরী হৃদয় দিয়ে অনুভব করা, তবেই দেশের ভালো দশের ভালো করার অধিকার জন্মায়।
শিক্ষিত নব্য বাঙালি এবং আপামর সাধারণ বাঙালির ্মানসিকতার,ভাবনার যে দুস্তর ব্যবধান তার মধ্যে যেন একটা সেতু বাঁধবার চেষ্টা করেছিলেন বলে বার বার মনে হয়েছে আমার।জীবনকে ভোগ নয় উপভোগের সুরে ছন্দে তালে বাঁধতে চেয়েছিলেন বলেই আমার অনুভব।
[ক্রমশঃ…]
Posted in: ARTICLE, November 2020 - Serial