দ্বিশতজন্মবর্ষে এঙ্গেলস : একটি মহাবিতর্কের পুনর্বিচার – শোভনলাল দত্তগুপ্ত
১
না, বিতর্ক তার পথ ছাড়ে নি। যতটা না তার জীবদ্দশায়, তার চেয়ে অনেক বেশী তার মৃত্যুর পরে। জন্মের ২০০ বছর অতিক্রম কবেও তার নিস্তার নেই। তাকে ঘিরে যে বিতর্ক উৎসারিত হয়েছিল, তা জারি আছে আজও। মার্কস এঙ্গেলস না মার্কস বনাম এঙ্গেলস, — সহজ কথায় এঙ্গেলসকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক, তার মূলে রয়েছে এই দু’টি প্রশ্ন এক পক্ষ, মূলত যারা সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির পেশ করা ভাষ্যকেই প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে নিতে অভ্যস্ত, তাঁদের ভাবনায় এঙ্গেলসের অবস্থান মার্কস-এঙ্গেলস, এই শব্দবন্ধের দ্বারা নির্মিত হয়ে এসেছে। অর্থাৎ, প্রথমে মার্কস, তার পরে এঙ্গেলস এবং এঙ্গেলস মার্কসেরই ছায়া মাত্র, উভয়ের ভাবনাও যে কারণে অভিন্ন, যা প্রশ্রয় দেয় না ভিন্নতা বা ভিন্নতা উদ্রেককারী কোনও চিন্তাকে। এঙ্গেলস তাই অবস্থান করেন মার্কস-এঙ্গেলস এই শব্দবন্ধের ঘেরাটোপে অপর পক্ষ, যারা সোভিয়েত ভাষ্যের সম্পূর্ণ বিরোধী, এঙ্গেলসকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেন, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক। বিজ্ঞানমনস্কতার নামে, মার্কসবাদের অঙ্গে বিজ্ঞানের তকমা আঁটতে গিয়ে তিনি মার্কসবাদকে এক ধরনের যান্ত্রিক বস্তুবাদে, প্রায় দৃষ্টবাদে রূপান্তরিত করেছেন। মার্কসের অবর্তমানে তিনি মার্কসের বিভিন্ন রচনা সম্পাদনা করতে গিয়ে তার অতিসরলীকরণ শুধু নয়, তার বিকৃতি ঘটিয়েছেন। Anti-Duehring এবং Dialectics of Nature — এই দুটি রচনায় এঙ্গেলস প্রকৃতি ও সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই দ্বন্দ্বতত্ত্ব সমভাবে প্রযোজ্য এই ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে প্রকৃতিজগৎ ও মনুষ্যজগৎ যে চরিত্রগতভাবে ভিন্ন সেটাই অস্বীকার করেছেন। মাক্সিমিলিয়েন রুবেলের মত মহাপন্ডিত অভিযোগ করেছেন যে মার্কসের জীবদ্দশায় যাঁরা মার্কসকে “মার্কসবাদী”, মার্কসের তত্ত্বকে “মার্কসবাদ” আখ্যায়িত করে তাকে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতেন, সেই শ্লেষাত্মক শব্দগুলিকেই এঙ্গেলস মান্যতা দিয়ে “মার্কসবাদ” কথাটিকে বৈধতা প্রদান করলেন, মার্কসের মুক্ত চিন্তাকে এঙ্গেলস এই শব্দবন্ধ দিয়ে শৃঙ্খলিত করলেন। আর এঙ্গেলস কৃত মার্কসবাদের তথাকথিত “বৈজ্ঞানিক”, অতিসরলীকৃত, একরৈখিক ভাষ্যই একদিকে যেমন মান্যতা পেল দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে, অপরদিকে মার্কসবাদের এই যান্ত্রিক ভাবনাকেই শিলমোহর দিল সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি, যার চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হল স্তালিনবাদ। স্তালিনবাদ বিজ্ঞানমনস্কতার নামে প্রশ্রয় দিল অনিবার্যতা ও একরৈখিকতার যে ভাবনাকে, সেখানে স্থান পেল না কোন ভিন্নতার স্বর, যার ভিত্তিটি গড়ে দিয়েছিলেন এঙ্গেলস। নিঃসন্দেহে এইসব অভিযোগ অতীব গুরুতর এঙ্গেলস তাহলে ক্ষমার অযোগ্যই।
তবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবার আগে দু’টি বিষয় একটু খেয়াল করা দরকার। একঃ এঙ্গেলসকে নিয়ে বিতর্ক যে দু’টি শিবিরকে ঘিরে, তাদের মধ্যে একটি জায়গায় কিন্তু আশ্চর্য এক মিল আছে। যাঁরা মার্কস-এঙ্গেলস এই শব্দবন্ধ উচ্চারণ করতে অভ্যস্ত, তাদের কাছে এঙ্গেলসের স্বকীয়তা যেমন গুরুত্বহীন, মার্কস বনাম এঙ্গেলস এই ভাবনায় যাঁরা বিশ্বাসী, তাদের দৃষ্টিতেও এঙ্গেলস ছিলেন নিছকই একজন সাধারণ মেধাজীবী, যিনি নাগাল পান নি মার্কসের মেধা ও সৃজনশীলতার এবং তার সুবাদে এঙ্গেলস ঘটালেন মার্কসের তত্ত্বভাবনার যাবতীয় বিকৃতি। মার্কসীয় মহাআখ্যানে এঙ্গেলস এভাবেই পর্যবসিত হন গুরুত্বহীন এক ব্যক্তিত্বে। দুইঃ সাম্প্রতিক কালে, বিশেষত তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষকে কেন্দ্র করে এই জায়মান বিতর্ক পুনর্বিশ্লেষিত হচ্ছে, এঙ্গেলসকে দেখা হচ্ছে নতুন তথ্যের নিরিখে, তাকে বিচার কার হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে, যা কিন্তু বদলে দিচ্ছে এঙ্গেলসকে নিয়ে আমাদের চিরাচরিত ভাবনাকে, পুরনো এই বিতর্ককে সংজ্ঞায়িত করছে নতুন আদলে। এঙ্গেলসকে আসামী সাব্যস্ত করার আগে এই দিকটার প্রতি বোধ হয় একটু নজর দেয়া প্রয়োজন।
২
তবে এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে নেয়া ভাল। এঙ্গেলস মার্কসের ছায়া সঙ্গী মাত্র, কিংবা তিনি মার্কসকে অনুসরণ করেছিলেন মাত্র, – এই ভ্রান্ত ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যে অনেকটা এঙ্গেলসকেই দায়ী করা চলে। ১৮৮৬ সালে রচিত Ludwig Feuerbach and the End of Classical German Philosophy প্রবন্ধের একটি পাদটীকায় এঙ্গেলস লিখলেন যে, চল্লিশ বছর ধরে মার্কসের সহযোগী হবার সুবাদে মার্কসীয় তত্ত্বের প্রসারণে তার কিছু নিজস্ব অবদান থাকলেও এই তত্ত্বভাবনার মূল কাঠামোটি গড়ে দিয়েছিলেন মার্কসই। তিনি ছিলেন এঙ্গেলসের থেকে অনেক এগিয়ে এবং মার্কস যা করতে পেরেছিলেন এঙ্গেলসের পক্ষে সেটি করা সম্ভবপর ছিল না, কারণ মার্কস ছিলেন একটি প্রতিভা; তুলনায় এঙ্গেলস এবং তার মত অনেকেই ছিলেন বড় জোর গুণী মানুষ মাত্র। তিনি এখানেই থামলেন না। ১৮৯০ সালের ৫ ডিসেম্বর Barliner Volksblatt পত্রিকার সম্পাদকদের কাছে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখে বসলেন যে, তার সত্তরতম জন্মবর্ষে তিনি অসংখ্য অভিনন্দনবার্তা পেয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু তার ভাগ্যে যে ফসল উঠল, তাকে রোপণ করে স্বীয় মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছিলেন মার্কস, যিনি ছিলেন তার চেয়ে অনেক বড়।
সমস্যা হল এঙ্গেলস চরিত্রগতভাবে ছিলেন এতটাই আত্মপ্রচারবিমুখ, এতটাই বন্ধুবৎসল এবং এতটাই বিনয়ী ও নিঃস্বার্থ যে তার পক্ষে এই ধরনের মন্তব্য করাটা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। তাঁর পক্ষে এটা বোঝা সম্ভব ছিল না যে এর ফলে তিনি ভবিষ্যতের এক মহাবিতর্ক – যার মূল কথা হল মার্কসের বিপ্রতীপে এঙ্গেলসকে প্রতিষ্ঠা করা, -.তার সূচনা করে গেলেন। কিন্তু এই বিতর্কের অন্য একটি দিকও আছে, দুর্ভাগ্যবশত যার প্রতি এঙ্গেলস সমালোচকরা একেবারেই নজর দেন না। সেটি হল এঙ্গেলস সম্পর্কে মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল তা কিন্তু আমার ভেবে দেখি না। মার্কসের একাধিক লেখা ও চিঠিপত্রে এঙ্গেলস সম্পর্কে এমন অনেক চমকে দেবার মত মন্তব্য আছে যা মার্কস-এঙ্গেলস সম্পর্ককে নতুনভাবে দেখার সুযোগ করে দেয়। মার্কসের কাছে বুদ্ধিজীবী হিসেবে এঙ্গেলসের গুরুত্ব ছিল এতটাই বেশী যে তিনি এঙ্গেলসকে সমকালীন ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মেধাজীবী আখ্যা দিয়েছিলেন। মার্কস-এঙ্গেলস সমগ্র রচনাবলীর ইংরেজি সংস্করণের শেষ পর্বের খণ্ডগুলি মার্কস এঙ্গেলস পত্রবিনিময় সংক্রান্ত। এই চিঠিগুলি খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায় মার্কস এঙ্গেলসের মতামতকে শুধু যে গুরুত্ব দিতেন তা নয়, বহ ক্ষেত্রে তিনি এঙ্গেলসের ওপর নির্ভর করতেন। ১৮৬৪ সালের ৪ জুলাই মার্কস এঙ্গেলসকে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন যে তিনি (মার্কস) সব ব্যাপারেই একটু ঢিলেঢালা এবং অবধারিতভাবে তিনি এঙ্গেলসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেন।
৩
মাক্সিমিলিয়েন রুবেল কিছুটা শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে এঙ্গেলসকে মার্কসবাদের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে চিহ্নিত করে বলেছেন যে তাঁর হাত ধরেই মার্কসের মুক্ত চিন্তা মার্কসবাদ শব্দবন্ধটির মাধ্যমে একটি মতাদর্শে রূপান্তরিত হল। আপাতদৃষ্টিতে কথাটা সত্যি ঠিকই। কিন্তু এ কথাও বোধ হয় অনস্বীকার্য যে মার্কসবাদ যদি মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হত তাহলে পৃথিবীটাকে, সমাজকে বদলানোর ভাবনাও কি কখনও বাস্তবায়িত হত? সেদিক থেকে বিচার করলে রুবেলের মতকে গ্রহণ করার সমস্যা আছে।
আরও একটু তলিয়ে দেখলে এঙ্গেলসকে মার্কসবাদের অন্যতম প্রধান স্থপতি হিসেবে আখ্যায়িত করাটা বোধ হয় খুব ভুল হবে না। সাম্প্রতিক গবেষণার আলোকে বিষয়টিকে দু’টি দিক থেকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। একঃ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনার নিরিখে বিচার করলে দেখা যাবে যে এঙ্গেলস ছিলেন মার্কসের পূর্বসূরি। যেমন, ১৮৪৩ সালে লেখা Outlines of A Critique of Political Economy এবং ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত The Condition of the Working Class in England এই দুটি লেখাই মার্কসকে ধনতন্ত্রের স্বরূপ ও তার চরিত্র বিশ্লেষণের গুরুত্ব সম্পর্কে প্রথম সজাগ করে দেয়। প্রথমে পারিবারিক ব্যবসা ও পরে ইংল্যান্ডে ম্যাঞ্চেস্টারের শিল্পাঞ্চলে বসবাসকালে শ্রমিকশ্রেণীর দুর্দশা সচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতার সুবাদে পুঁজিবাদকে প্রত্যক্ষভাবে অবলোকন এঙ্গেলস যেভাবে করেছিলেন তেমন সুযোগ মার্কসের ছিল না। তাই পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে এঙ্গেলসের বিশ্লেষণ ছিল মার্কসের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই একই কারণে “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো”র মূল পাণ্ডুলিপিটি যদিও মার্কসের লেখা, এর মধ্যে অর্থনীতির অংশটি (প্রথম অংশ) পুরোটাই ছিল এঙ্গেলস ভিত্তিক।
দুইঃ মার্কসীয় তত্ত্বের বিশ্লেষণ ও সম্প্রসারণের অন্তত চারটি ক্ষেত্রে এঙ্গেলসের অবদান ছিল একাধারে অনন্য। প্রথমত, ভিত্তি উপরিসৌধের সম্পর্কটি যে নেহাত কোনও একরৈখিক অর্থনৈতিক নিয়তিবাদ নয় এঙ্গেলসই সেটি প্রথম স্পষ্ট ব্যাখ্যা করেন। ২১-২২ সেপ্টেম্বর, ১৮৯০তে এবং ২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯৪তে যথাক্রমে J. Bloch এবং H. Starkenburg-কে লেখা এঙ্গেলসের দু’টি চিঠি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয়ত, সাম্যবাদের ভাবনার মূল কথাগুলোর প্রথম উদ্গাতা ছিলেন এঙ্গেলস। প্রায় অনালোচিত ১৮৪৭ সালে রচিত The Draft of a Communist Confession of Faith এবং Principles of Communism এই দুটি লেখাতে এঙ্গেলসই প্রথম রাষ্ট্রের অবলুপ্তি, শ্রমজীবী মানুষের স্বায়ত্তশাসনের ভাবনাগুলিকে তাত্ত্বিক স্তরে পরিবেশন করেন। মার্কসের একেবারে শেষ পর্বের লেখা Critique of the Gotha Programme-এর অনেক ভাবনারই আদি রূপের খোঁজ মিলবে তরুণ এঙ্গেলসের এই প্রথম পর্বের রচনা দুটিতে । ফলিত সমাজতন্ত্রের নামে যে পার্টিতন্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বিশ্বের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তার পরিণতিতে রাষ্ট্রের যে দানবায়ন ঘটেছিল, তার সঙ্গে এঙ্গেলসের ভাবনার কোন সম্পর্কই ছিল না। যাঁরা স্তালিনীয় অতি-রাষ্ট্রের বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে এঙ্গেলসকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান, তাদের তাই স্মরণ করিয়ে দেয়া প্রয়োজন যে এঙ্গেলসের রাষ্ট্রভাবনার সঙ্গে, শ্রমজীবী মানুষের স্বায়ত্তশাসনের ভাবনার সঙ্গে স্তালিনীয় রাষ্ট্রচিন্তার কোন সাদৃশ্যই নেই, কারণ এঙ্গেলসীয় রাষ্ট্রভাবনার অবস্থান স্তালিনীয় চিন্তার সম্পূর্ণ বিপ্রতীপে । তৃতীয়তঃ Dialectics of Nature এবং Anti-Duehring প্রসঙ্গে এঙ্গেলস সম্পর্কে যে অভিযোগ তোলা হয় যে, তিনি মনুষ্যজগত ও প্রকৃতিজগৎ এই দুই-এর মধ্যে একটি যান্ত্রিক সমীকরণ প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট ছিলেন, সেই যুক্তিটিকে খণ্ডন করে বিশিষ্ট মার্কসীয় পরিবেশবিদ Bellamy Foster এই বিষয়টিকে একটি বিকল্প দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে বলেছেন। তার মতে, পরিবেশবাদী আঙ্গিকে বিষয়টিকে দেখলে এঙ্গেলসীয় ভাবনাকে একটি সম্পূর্ণ নতুন প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করা যায় মানুষ ও প্রকৃতির যে নৈকট্য, উভয়ের মধ্যে যে সাযুজ্য প্রতিষ্ঠার কথা বর্তমানে বলা হচ্ছে, এঙ্গেলসীয় চিন্তা ছিল সেই ভাবনারই দ্যোতক মাত্র । মানুষ ও প্রকৃতির অবস্থানকে যে অন্বিত করা প্রয়োজন, এই দুই জগৎ যে গভীরভাবে সম্পর্কিত, ঘা মান্যতা দেয় বর্তমান কালের পরিবেশভাবনাকে, সেই ভাবনাই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল এঙ্গেলসের চিন্তায়। চতুর্থত, প্রথিতযশা তাত্ত্বিক Douglas Kellner এঙ্গেলসের লেখাগুলি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে ধনতন্ত্রের উত্থানের সুবাদে ইউরোপীয় শিল্পবিপ্লব যে আধুনিকতার সূচনা করেছিল, তার তাৎপর্য প্রথম অনুধাবন করেছিলেন এঙ্গেলস। এই তাৎপর্য ছিল দ্বিবিধ। একদিকে সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ধনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। অপরদিকে তিনি এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে ধনতন্ত্র যে আধুনিকতার জন্ম দেয় সেটি শ্রমজীবী মানুষের মুক্তি আনতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন এক বিকল্প আধুনিকতা, যার ভিত্তি হবে সমাজতন্ত্র এবং যার আদি তাত্ত্বিক রূপকার ছিলেন এঙ্গেলস।
৪
মাক্সিমিলিয়েন রুবেল এঙ্গেলসের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ তুলেছিলেন যে, তার কাছে মার্কসের সব লেখাপত্রের হদিশ থাকলেও তার জীবদ্দশায় তিনি মার্কসের Economic and Philosophical Manuscripts 1884 জাতীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ রচনাকেই প্রকাশ করার বা জনসমক্ষে আনার চেষ্টা করেন নি। প্রত্যুত্তরে বলা দরকার যে এর নেপথ্যে এঙ্গেলসের কোন দুরভিসন্ধি ছিল এ কথা কোনভাবেই কি বলা চলে? Capital-এর প্রথম খণ্ড মার্কসের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হবার পরে বাকি সমস্ত খণ্ডগুলি সম্পাদনা করে প্রকাশ করার একক দায়িত্ব এঙ্গেলস গ্রহণ করেছিলেন, যা না হলে আমরা বঞ্চিত হতাম মার্কসের সর্বশ্রেষ্ঠ গবেষণাকর্মের সান্নিধ্যে আসা থেকে। তাঁর এমনটাই হয়ত মনে হয়েছিল ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপির তুলনায় Capital সম্পূর্ণ করার গুরুত্ব আরও বেশী।
তবে এঙ্গেলস সমালোচকরা আরও গুরুতর যে অভিযোগটি করেন সেটাও কিছু কম নয়। তাদের মতে, মার্কসের অনেক লেখাই সম্পাদনা করতে গিয়ে এঙ্গেলস হয় তার সরলীকরণ নতুবা তার বিকৃতি ঘটিয়েছেন। কথাটা কিছুটা সত্য হলেও এ কথা বলা যাবে না যে এঙ্গেলস মার্কসের রচনার ইচ্ছাকৃতভাবে বিকৃতি ঘটিয়েছিলেন কিংবা এই সরলীকরণ এঙ্গেলসের নিম্নমেধার পরিচায়ক। এ কথাটি অবশ্যই স্বীকার করা দরকার যে বিভিন্ন বিষয়ে মার্কস ও এঙ্গেলসের মতামত অভ্রান্ত ছিল এ কথা তাঁরা নিজেরাও কোনদিন দাবি করেন নি, বিশেষত এঙ্গেলস। ইতিহাসের অতি দ্রুত পটপরিবর্তনের প্রতি এঙ্গেলসের অত্যন্ত তীক্ষ নজর ছিল এবং বারেবারেই তিনি নিজের মতামতকে তাই সংশোধন করতে কসুর করেন নি। কিন্তু তাসত্ত্বেও তার সব বক্তব্যই সঠিক ছিল এ কথা কেউই বলবেন না। যেমন, ল্লাভ জাতীয়তাবাদকে বা স্লাভ সংস্কৃতিকে তিনি কোনদিনই সুনজরে দেখেন নি। ম্যানচেস্টারকে কেন্দ্র করে ব্রিটেনে পুঁজিবাদের বিকাশের যে মূল্যায়ন তিনি করেছিলেন, তার অনেকটাই ইতিহাসগতভাবে সঠিক ছিল না।
কিন্তু তার ভিত্তিতে একথা বলা চলে না যে এঙ্গেলস মার্কসের লেখাপত্র সম্পাদনা করতে গিয়ে তার বৌদ্ধিক সীমাবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই সম্পাদনা হয়ত কিছুটা বাড়াবাড়িও হয়ে গিয়েছে। এরকম অন্তত দু’টি বিপরীতমুখী দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। ১৮৪৫ সালে মার্কস যে ফয়েরবাখ সন্দর্ভ রচনা করেছিলেন, যেটি ১৮৮৮ সালে এঙ্গেলসের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়, সেখানে এঙ্গেলস বেশ কিছু সম্পাদকীয় পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন, যা মার্কসের মূল ভাষ্যের পাঠকে অবশ্যই কিছুটা বদলে দেয়। এই সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ তিনি কেন করেছিলেন তার উত্তর জানা নেই। তবে এর হয়ত কোন প্রয়োজন ছিল না। আবার Capital-এর তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদকীয় ভূমিকাতে এঙ্গেলস অকপটে ঘোষণা করেন যে মার্কসের মূল পাণ্ডুলিপিটি ছিল এতটাই অবিন্যস্ত যে সেখানে সম্পাদকীয় হস্তক্ষেপ ছাড়া এই পাণ্ডুলিপিকে মুদ্রণযোগ্য করা অসম্ভব ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এ কথাও বললেন যে এই সম্পাদনার পূর্ণ দায়ভার তাঁর নিজের, মার্কসের নয়।
এই তথ্যগুলির দিকে যদি নজর দেয়া যায় তাহলে এ কথা বলতে অসুবিধা নেই যে মার্কস-এঙ্গেলস অভিন্ন এক শব্দবন্ধ এ কথাটা যেমন ভুল, অপরদিকে মার্কস বনাম এঙ্গেলস এই ধারণাটিও ভ্রান্ত। এঙ্গেলসকে বিচার করতে হবে তাঁর স্বকীয়তা ও ভিন্নতার চিন্তাকে মর্যাদা ও স্বীকৃতি দিয়ে। তাকে উপেক্ষা করে কিংবা মার্কসের ছায়ায় পর্যবসিত করে নয়। এই কাজটা করা দরকার ছিল অনেক আগেই। আরও বিলম্ব হবার আগে এঙ্গেলসের পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটা অন্তত তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষে শুরু হোক। মার্কসবাদের স্বার্থেই এই পদক্ষেপটি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
সহায়তা স্বীকার:
১. Paul Blackledge, “Engels vs. Marx? Two Hundred Years of Frederick Engels”, Monthly Revies, 72(1), May 2020.
২. Osvaldo Coggiola, “The Quieter of the Two: Friedrich Engels and Political and Internationalist Marxism”, https://www.researchgate.net/publication/287205737 (December 2015).
৩. George R. Boyer, “The Historical Background of the Communist Manifesto”, Journal of Economic Perspectives, 12(4), Fall 1998.
৪. Kaan Kangal, “Engels’ Intentions in Dialectics of Nature”, Science and Society, 83(2), April 2019.
৫. Douglas Kellner, “Engels, Modernity and Classical Social Theory”.
http://www.gseis.ucia.edu/faculty/kellner/kellner.html
৬. ‘The “Marx Legend”, or Engels, founder of Marxism’, in Joseph O’Malley and Keith Algozin (eds), Rubel on Karl Marx. Five Essays (Cambridge: Cambridge University Press, 1981).
Posted in: ARTICLE, November 2020 - Cover Story