রাজস্থান ডায়েরিস : সিন্ধু সোম
পর্ব-১৬
রাজস্থান ডায়েরিস—৩১
সিঁড়ির নীচে জানু পেতে রাখে সিঁড়ি। দুল। ছম ছম। কানের পায়ে শিকল দিল কে? নামার বারান্দায় কারাগার পথ। কাঁটা। চমকে চমকে ওঠে। সুড়ঙ্গ। প্রকৃতির পথ। দিতি আর আমি এগিয়ে চলেছি। সংক্ষুব্ধ আবদ্ধতা ফুঁসছে। আঁশটে গন্ধের শুঁটকি বিছিয়ে চামচিকের সমাজ। উল্টো ঘূর্ণন। পাশ বালিশ। পেরিয়ে আসে পা। উত্তুরে হাওয়া নিরুদ্দেশে আসে। এই মাটির বুকে। পৃথিবীর যত পাথর সব রাজপুত্র বুকে রাখে। ডিমের মতো। কিরণমালার অপেক্ষায়। সুনীল হাতড়ে ফেরেন। নীরার থেকে শক্তি। বড়র কম্পাঙ্কে গভীরতা আসে বহুদূর। সুড়ঙ্গ প্রতিধ্বনি ঢালে—”……রাখেনি রাখেনি রাখেনি।” তেত্রিশ ছত্রিশ একঘেয়েমি। আখর থেকে প্রতিবন্ধকতার পথটা আবর্তের। দিতি ছুঁতে পারে। ঘাঘরার ঘায়ে ঘায়ে জড়িবুটির মূর্ছনা। ওষুধের থেকে মোরব্বার চাহিদা। ঘটি ডোবায় অহং। দিতি চু চু করে ডাকে। অহং লেজ নাড়ে।
এই দুই তিন। ছুব। তারার পিঠে তারার খই। দেয়াল হাজিরা দেয়। কালো মোষের পিঠে আড়মোড়া ভাঙে অনন্ত। দিতি আমার কান কামড়ায়। বলে,
“অবশেষে
মৌমাছির পরিচিত এ নিভৃত পথপ্রান্তে এসে
যাত্রা তার হবে অবসান;
খুলিবে সে গুপ্ত দ্বার কেহ যার পায় নি সন্ধান।” [১]
চমকায় স্থিতি। এই তবে! খস খস। মুক্তির বুকে বিশেষের দাসখত। বন্ধন আর বিচ্ছেদের অতি ধীর স্তব্ধ রাত। এক একটা নক্ষত্রের মতো ঝরে জন্মায়। জন্মিয়ে ঝরে। এগোনোর কান্না। কারোর পাতে পড়েনা। ওর জন্য বুফের খানসামার একাগ্র প্রতীক্ষা। রোলা বার্থ আর বনফুল হাত ধরাধরি করে হেঁটে যান। লেখক আর পাঠক। দুজনের দুহাত ধরে একফুটি মৃত্যু টলায়মান। জুতোর পদ্য। পঁ পঁ। আমি শিষ দিয়ে ফেলি। মৃত্যু একগাল ফোকলা হাসি নিয়ে ফিরে তাকায়। শুধু নেওয়া যায় না চোখ। জরা আর শৈশবের পাঠশালা একই। যৌবনের ভারে বুকের সঙ্গে প্রখরতা মেলে দৃষ্টি। খাসমহল পেরিয়ে। ধুলোর আঘ্রাণ নিই আমরা।
অন্ধকারের ছাদ। ফট ফট ফট ফট। স্টিলশটে ঢুকে পড়ে বাদুড়। ত্রুফো বিরক্ত হন। গুঁফো নাজিনোভাও বিরক্ত হন। পেনরোজ অ্যানুয়ালে একটা মোম জ্বালিয়ে রেখে গেছে কেউ। গতজন্মে। জন্মে জন্মে। বারবার। ছোপ ছোপ দাঁত। হাঁ বিছিয়ে রাখে গন্তব্য। টুং টুং। পিয়ানোর বাজনা আসছে শেষ খেয়া থেকে। সুড়ঙ্গ রাতের বাসর। দিন অচ্ছুত। আমরা তাই পায়ে পায়ে তারা মেপে চলি। কামিনীর পায়ে। ঝর ঝর। ঝর্না। সাদা মোম গালিচা। সুগন্ধ সাপের মতো পা বেয়ে ওঠে।
ঘোষণা। মোহের নীলকুঠি। শৈলবাণী বৃষ্টির কাছাকাছি। “বিদায় পথিক। প্রান্তে এলে। শুভেচ্ছার বরফ দিতে ভুলো না! বেলা পড়ে এলে বিদায়ের স্কচে নাহলে রক্ত জমে ওঠে না।” আবার ক্যানভাস। ছিঁড়ে খুঁড়ে দূরে কোথাও ফেলল কেউ। আমি দিতির হাতে চাপ দিলাম। আখেরন। রণের শেষ তীর্থ। দৈত্যপুরী পিছনে। বহুদূর। এভাবেই মোড় আসে জীবনের। অন্ধের হাত। শুঁড়ের পরে লিঙ্গের ঠাওর পায় না শব্দ। বালির সমুদ্রে ঘাসের শ্যাওলা ধরছে। ক্লান্তি ঠেলে ঘাটের পথ। বেয়ে চলে দিগন্ত। আমাদের পদ-পদ্য কাঁকড়ার মতো ঘুরে ঘুরে আলপনা দেয়। এখন পাহাড় সবুজ হচ্ছে ধীরে। দূর থেকে আসে খেয়ার তরঙ্গ। আমি স্বাভাবিকের মতো দৌড়ই। পড়ি। দৌড়োই। একটা পুরো জীবনের সহধর্মিতা দেখে বালি। বালির ঘাস। মুচকি মুচকি হাসে। সে হাসিতে চিহ্ন রাখে চিরদিনের অপরাহ্ন। ঐ টুকুই থাকে। ঐ টুকুই থাকবে। জীবনের চাঞ্চল্য দেখে প্রকৃতির নিভৃত হাসি। যার মহাকাব্য লেখার জন্যেও জীবনের দুটো আঙুল চাই। শুধু মাত্র দুটো। এর নাগাল শাজাহানেরা পায় না কোনও দিন। পায় নি কোনওদিন। পেলে মমতাজ মিউজ় হয়ে উঠবে। কবর নয়।
আলোকলেখ্য—স্বয়ং
৪ঠা নভেম্বর ২০১৮
সকাল ৯টা ৪৪
উৎসের থেকেও দামী কিছু প্রতিফলন বুদ্ধের কারণ পিয়েছে
বিদায়ান্বিত (১)
বিদায়ালোকিত (২)
জীবনের পথে চমকে পিছনে দেখি পদরেখ নাই, পদরেখ নাই! কেন? আহা! কৃষ্ণের পদযুগে তীর বিঁধেছিল
রাজস্থান ডায়েরিস—৩২
শেষ খেয়া। প্রশ্ন করেছিল। করে আসছে বাউলের নাভির কাছাকাছি। উত্তর নিরুত্তর। ঋত্বিকের চশমা। ধূলোমাখা। পদদলিত। একা একা সূর্যাস্ত দেখে। এক একটা যুগ পেরিয়ে জন্ম আর মৃত্যু চুমু খায় পরস্পর। সেখানে চেতনার মাছবাজার নেই। ছিল না। কোনো দিন। চাদরে ঢাকা দুটো পা। লাল আলতা। শুয়ে আছে অবজ্ঞা। ক্ষুদসেদ্ধর গন্ধ আসে। নালারও তৃষ্ণা থাকে। আখেরন আর তিতাসে জড়িয়ে যায়। চ্লক চ্লক। মাড় চাটে অহং। আসলে চেতনার চর্বণে অবচেতনের স্তন্য ফেলে এসেছে মানুষ। মরুভূমি পাশে খোলস দেহ সেজে বসেছে কিছুদূর। তাই রাত কাঁদে প্রতিরাতে। অন্ধকার জমে না সভ্যতার আধিক্যে। ধীরে ধীরে কাঁধে বোঁচকা ফেলে বিদায় নেয় ছড়া। মায়েদের আঁচলে তার আর গন্ধ লেগে থাকে না— “এ বলে খাবো খাবো…”! খাওয়াই সার। লবডঙ্কার ঢেকুর ওঠে না। গলা জ্বালা। বুকে ব্যথা। বদ্যি বলে, “চাটনি খান।” চাটনি চাখতে গিয়ে শুক্তো লাগে দাঁতে। থুঃ থুঃ। “ওমা! মায়ের আদর ফেলতে আছে?” ঘোমটা টেনে হাঁ হাঁ করে ওঠে বিস্মৃতি। আমি নামতা আর মাতৃস্নেহে গুলিয়ে ফেলি আবার। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝে পাটা পেতে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন ঋত্বিক। “কেন চেয়ে আছো গো…”!
ফেলে রাখা পাটাতন বায় ভেজা ধূলো। দিতি একাই এগিয়ে গেছে আগে। আমি ঋত্বিকের পাশে গামছাটা নামাই। আকাশের জন্মদাগ নেমে আসে গভীরতার ঠোঁটে। “এলে তবে?” চোখ ফিরাই। “আমাকে বলছেন?” ঋত্বিক আকাশে নামিয়ে রেখেছেন ঐ দৃষ্টির ভার। ব্যাঙ্গমী। উড়ে এল পাশে। কথাটা তাকেই বলা। শশার নাভির মতো ব্রাত্য আমি। ক্যাঁচ ক্যাঁঅ্যাঅ্যাচ। দুলুনির আপত্তির মুখে ছাই। নৌকোয় উঠে আসা গেল। নজরুল। নিভে আসা চুরুটের ছায়ায় ধোঁয়ার সান্তনা দিলেন একমুঠো। “হল?” দিতির মুখে লাজুক সম্মতির হাসি। বুলবুল। কে জানে কবে ছইয়ের বুকে পাঁজরের মতো বাসা বেঁধেছে আড়াল। ছড়া হৈ হৈ করে ওঠে। লাল লাস্যে আখেরন নিশ্চুপ।
“একদা পরম মূল্য জন্মক্ষণ দিয়েছে তোমায়
আগন্তুক! রূপের দুর্লভ সত্তা লভিয়া বসেছ
সূর্য-নক্ষত্রের সাথে। দূর আকাশের ছায়াপথে
যে আলোক আসে নামি ধরণীর শ্যামল ললাটে
সে তোমার চক্ষু চুম্বি তোমারে বেঁধেছে অনুক্ষণ
সখ্যডোরে দ্যুলোকের সাথে; দূর যুগান্তর হতে
মহাকালযাত্রী মহাবাণী পুণ্যমুহূর্তেরে তব
শুভক্ষণে দিয়েছে সম্মান; তোমার সম্মুখদিকে
আত্মার যাত্রার পন্থ গেছে চলি অনন্তের পানে—” [২]
শান্তিনিকেতন বেয়ে দিতির কাছে আসি। “জানি না, ও ঘাটে যাব কিনা! এপাড়ের গুঁড়ো জীবনের বড় কাছাকাছি।” দিতির বুকে হাসি। গলা জড়িয়ে বলে,”তবে কাজ নেই। নদীতেই ভাসি বরং। বালি হিংসেয় জ্বলে পুড়ে যাবে। বেশ হবে!” আমার কান চুঁইয়ে অস্থিরতা নামে। সেই গ্রাম। সেই মাটি। এই নদীর সিঁদুরে সিন্নি ভাসিয়ে রেখেছে চিরকাল। নদী কাঁটাতার রাখে নি কোনো দিন। সেই জল শিরায় শিরায়। আমি দেখি। নৌকোয় উঠে আসেন ভাঁ সঁ। অ্যাবসিন্থের একটা গ্লাস থেকে সবুজ নিয়ে ছুঁয়ে দেন দিগাঙ্গনাকে। লজ্জায় মাথা নামায় সে। উঠে আসেন সত্যজিৎ। উঠে আসেন ঋত্বিক। ধকধক। কালীমূর্তির জিভের স্পন্দন লাগে আকাশ থেকে মাটিতে। আমি শেষ বারের মতো ওপার আঁকড়িয়ে দিতিকে প্রশ্ন করি—
“যাবে?”
“না।”
“যাবে?”
“না।”
“যাবে?”
“না।”
“যাবে?”
“না।”
“যাবে না?”
“না।”
ছেড়ে দিই ওপারের কাগজের নৌকো। বিবাহিতা। সময়। কোতওয়াল। অপ্সরা। ভাসতে ভাসতে চুপ। ডুব। খটাং খটাং করে নোঙর ওঠে। খেয়া দোলে। জলের ভ্রূকুটি অর্ধেক গেলে অন্ধকার। রোদের আঙুলটা পাশে। মাথার ওপরে উড়ছে ব্যঙ্গমী। দৈত্যপুরীর শ্মশান থেকে এক জীবনের যাত্রা। আমি, দিতি, ছড়া, ছবি। পাশাপাশি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। নজরুল হাল ধরেছেন। ছপ ছপ। জলের ওপর পা ফেলছে জোব্বা। দু মিনিট। তারপর। নেই। অস্তি নাস্তির হাতটা ধরে ফেললো ঝপ করে। বিদিশার কাছাকাছি। জন্ম এককে দূরত্ব মাপে ডানা। শালবন শালবন! শালের চুরুটের গন্ধে মেঘ করে আসে ছইয়ের ভেতরে। আমার বাঁদিকে হেমন্তের গুনগুন,”একটু হাওয়া নাই, জল যে আয়না…”! সামনে খানিকটা দূরে জোব্বার জলপদছাপের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন নজরুল। বেশ কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ গেয়ে ওঠেন, “হে গিরিজাপতি, কোথা গিরিধারী…অরুণকান্তি কে গো…”! কে? কে? কে? রবি ঢলে পড়ে। শতাব্দী ঢলে পড়ে। সহস্রাব্দ ঢলে পড়ে। জোব্বা এগিয়ে যায়। কেউ আসন পায়। কেউ পায় না। আখেরনের বুকের তিল শেষ খেয়ার মতো। শেষ সূর্যাস্তের রঙে। শেষ আমি আর দিতির ঠোঁটের আদরে। হয়তো, অন্যজন্মে ছুঁয়ে নেবে জাতিস্মর। তখনও আঙুলে যদি বয়স না ধরে। একটু একটু একটু করে পুড়তে থাকুক বিচ্ছেদ। সহজিয়ার আদরে। উড়তে থাকুক ছাই,
সমুদ্রে বহমান চিতার আকাশে
ছাই ভাসে।
ব্যঙ্গমার জনন-দৃঢ় পাখা
মেলে ধরে চঞ্চু নখ
চুমু থেকে খুনের সংলাপে।
গ্রীবা
তার থেকে থেকে ছড়িয়েছে
অনামিকা ডানার বিস্তার…
অন্ধকারে গর্ভবতী
জরতী সূর্যের
মৃতদেহ
শোনে শেষ শাক্ত উচ্চারণ
“এখানে
শোক
অথবা প্রেম
মেঘের মতো চরে……”
আনন্দ তার জাবর কাটে শুধু। রোজ। রোজ। আর রোজ।
সমাপ্ত।
আলোকলেখ্য—স্বয়ং
৪ নভেম্বর ২০১৮
সকাল ১১টা ৪০
কর্ণান্বিত কুন্তী (১)
দিন শেষে সূর্যের তেজ ফিরে যায় সূর্যে! গলাকাটা লাশটুকুই তবে কুন্তীর? যুগে যুগে ওটুকুই দিয়েছে রাষ্ট্র…
কর্ণাস্ত (২)
সমাপ্ত
____________________________
[১] রবীন্দ্রনাথ
[২] রবীন্দ্রনাথ
Posted in: November 2020 - Serial, PROSE