মহাকাশ, মহাবিশ্ব : শংকর লাহিড়ী
[বিস্ময় আর খোঁজ মানুষের এই দুটো গুণই ক্রমবিকাশ ঘটিয়েছে মানব সভ্যতার। নিজের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড ও তারই মাঝে নিজের আপাত অবস্থানকে চিনে নিতে চেয়েছে সে চিরকাল। ধীরে ধীরে আমরা জানতে পেরেছি আমাদের পৃথিবীকে, তারপর পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ, মহাবিশ্ব। কত অজানা খবর, কত আবিষ্কার ঘটে চলেছে দিনের পর দিন। সেই সমস্ত কথা নিয়েই এবার কলম ধরলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, চিত্র-পরিচালক ও প্রকৌশলী শংকর লাহিড়ী। কসমোলজি নিয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের কথা অনেকেই জানেন। যে দক্ষ শৈল্পিক ভঙ্গিতে তিনি এই সমস্ত জটিল তত্ত্ব ও আবিষ্কারের কথা লেখেন তার সাথে ইতিমধ্যেই অনেক পাঠক পরিচিত। শুরু হলো অপরজনের নতুন ধারাবাহিক বিভাগ – “মহাকাশ মহাবিশ্ব”।]
৬
কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্
মন্দিরে ঈশ্বরকে সামনে থেকে দেখেও ভক্তের সাধ মেটে না, তাঁকে কেন্দ্র করে সে একবার চারপাশটা ঘুরে আসে, প্রদক্ষিণ করে প্রতিমাকে। তিনি আছেন ভক্তের মনোমন্দিরেরও কেন্দ্রে, তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয় ভক্তের জীবন। তিনিই ইষ্ট। অথবা, যাকিছুকে ঘিরে আমরা আবর্তন করি, সকলই বুঝি ঈশ্বর। এই বিচারে পৃথিবী আবর্তন করছে সূর্যকে, তাই সূর্যই পৃথিবীর দেবতা। তবে এই ব্যাপারে পৃথিবীর দায় আরও বেশি। সে স্বেচ্ছায় আবর্তন করছে না। দেবতা সূর্যের এতই পরাক্রম, এতই তিনি বলশালী যে, পৃথিবীকে তিনি ঘুরতে বাধ্য করেছেন। এই বিচারেও তিনি মানবের আরাধ্য। পৃথিবীর সকল দেশে, প্রাচীন সভ্যতায়, পুরাণে, লোকগাথায় আছে এই দেবতার হরেক নাম, তাঁর স্তব, স্তুতি, আরাধনা। এই অত্যুজ্জ্বল আকাশদেবতা সাত ঘোড়ায় টানা সুবর্ণ রথে চড়ে সারাদিন আকাশ পারাপার করেন। তিনিই একমাত্র দেবতা, যাঁকে মানুষ প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করতে পারে। রোমানরা বলেন দেবতা অ্যাপোলো, গ্রীকরা বলেন হেলিওস, আর হিন্দুরা ডাকেন অনেক নামে : সূর্য, রবি, ভানু, ভাস্কর, অর্ক, দিবাকর, সবিতৃ, বিবস্বান, আদিত্য। পিতা কশ্যপ মুনি ও মাতা অদিতির পুত্র তিনি, নাম তাই আদিত্য। কবে, কেন, কিভাবে এমন এক মহাকাশ-দেবতা জন্ম নিলেন মুনিঋষির সংসারে, জানা যায় না। এইখানে হিন্দুশাস্ত্র আর জ্যোতির্বিজ্ঞান দুই ভিন্নপথ ধরলো। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, আনুমানিক সাড়ে চারশো কোটি বছর আগে, একটি ‘নাক্ষত্রিক মেঘমন্ডল’ (Stellar Nebula)-এর অভ্যন্তরে বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস এবং ধূলিকণার প্রচন্ড চাপে ও তাপে, সেই ঘূর্ণায়মান মেঘমন্ডল থেকে জন্ম হয়েছিল এই নক্ষত্রের। এই বিপুল নেবুলার অংশ থেকেই, প্রায় একই সময়ে, সৃষ্টি হয়েছিল সৌরমন্ডলের সকল গ্রহ, উপগ্রহ ও গ্রহাণু। সমগ্র সৌরমন্ডলের ভর যদি ধরা হয় ১০০ কেজি, তবে এর মধ্যে শুধু সূর্যের ভরই হবে ৯৯ কেজি ৮৫০ গ্রাম। আর বাকি ১৫০ গ্রামের মধ্যে আটটা গ্রহের মিলিত ওজন হবে ১৩৫ গ্রাম। এছাড়া আমাদের চাঁদ ও অন্যান্য দুইশতাধিক উপগ্রহ, এবং কয়েক কোটি গ্রহাণু ও ধুমকেতুর মিলিত ওজন হবে ১৫ গ্রাম।
ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির পরে প্রায় ১৩৮০ কোটি বছর কেটে গেলেও, মহাকাশে, মহাবিশ্বে এভাবেই কত নেবুলা থেকে আজও জন্ম হচ্ছে নতুন নতুন নক্ষত্রের, যাদের অনেকেই আমাদের সূর্যের চেয়ে আয়তনে ও ঔজ্জ্বল্যে অনেক বড়, এবং আরও বিশাল তাদের শক্তিপুঞ্জ। এইসব নক্ষত্রদের আয়ু হতে পারে কয়েক হাজার কোটি বছর, বা আরও বেশি। এটা নির্ভর করে তার নিজের ভর ও আয়তনের ওপরে। আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্ররা জীবৎকালে, তাদের জ্বালানি ক্রমে ফুরিয়ে গেলে, আয়তনে প্রায় ১০০-গুণ স্ফীতকায় ও লাল বর্ণের হয়ে ওঠে, যাকে ‘রেড জায়ান্ট’ বলা হয়। সেই অবস্থা থেকে আরও দীর্ঘকাল পরে, একটি বৃত্তাকার গ্রহের আকারের মেঘমন্ডল (প্ল্যানেটরি নেবুলা) হয়ে, ক্রমে একটা উজ্জ্বল সাদা বামন নক্ষত্র বা, হোয়াইট ডোয়ার্ফ-এ পরিণত হয় সে। আর যদি সূর্যের চেয়েও প্রায় আট-দশ গুণ বড় কোনও নক্ষত্র হয়, তবে সে মধ্যাবস্থায় ‘রেড সুপার জায়ান্ট’ হয়ে ওঠে। তারপর একদিন ‘সুপারনোভা’ হয়ে প্রচন্ড বিস্ফোরণে ফেটে প’ড়ে, লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরত্ব অব্দি বিপুল বিকিরণ শক্তি উগরে দিয়ে, সে একটা ‘নিউট্রন স্টার’ কিংবা একটা ‘ব্ল্যাক হোল’-এ পরিণত হয় (নীচে ছবি)।
এরকমই একটা অতিকায় নক্ষত্রের নাম বেটেলজিউস (Betelgeuse), যে আছে ওরিয়ন নক্ষত্রমন্ডলিতে, আমাদের থেকে প্রায় ৬৪৩ আলোকবর্ষ দূরে (তুলনায়, পৃথিবী থেকে সূর্য মাত্র ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড দূরে)। তার আয়তন ৭০০-টা সূর্যের সমান এবং উজ্জ্বলতা সূর্যের ১৪০০ গুণ। তার যৌবনকাল শেষ হয়ে গেছে প্রায় দশ লক্ষ বছর আগে, এবং বিগত চল্লিশ হাজার বছর ধরে সে এখন একটি ‘রেড সুপার জায়ান্ট’ হয়ে রয়েছে। কখনও তার দীপ্তি কিছুটা ম্লান হয়ে আসছে, কখনও আবার উজ্জ্বল, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অধীর আগ্রহে তাকে নজরে রাখছেন, কারণ অদূর ভবিষ্যতে সে একটা বিশাল সুপারনোভা হয়ে ফেটে পড়বে। তার পরিণতিতে সে কি একটা ব্ল্যাক হোলে পরিণত হবে, নাকি একটা নিউট্রন স্টার, জানা যায় না। অবশ্য যদি আজ আমার এই লেখাটির সময়েই সেই সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়, তবে সেটা আমরা জানতে পারবো আরও ৬৪৩ বছর পরে, যদি ততদিন পৃথিবীতে পরিবেশ ও প্রাণীজগত ধ্বংস হয়ে না যায় ; যদি ততদিন আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় পানীয় জল, খনিজ সম্পদ, বিদ্যুৎ শক্তি, বনাঞ্চল, কৃষিজমি, বাসস্থান ইত্যাদি অবশিষ্ট থাকে।
আমাদের কাছে সূর্যই বেশ বড় নক্ষত্র। তার ব্যাস ১৪ লক্ষ কিলোমিটার, পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ১০৯ গুণ। সূর্যের আয়তনের ভেতরে প্রায় দশ লক্ষ পৃথিবীর জায়গা হয়ে যাবে। তবু, এই সূর্য কখনো সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরণে ফেটে পড়ার মতো যথেষ্ট বড় নয়। তার ভেতরে যে শক্তির ভান্ডার আছে, তা জ্বলতে জ্বলতে ফুরিয়ে আসতে আরও অন্তত পাঁচ-ছশো কোটি বছর লেগে যাবে। কিন্তু তার এই বিপুল শক্তি সৃষ্টি হচ্ছে কীভাবে? পারমাণবিক বোমার ভেতরে যে ধরনের ফিউসান-বিক্রিয়া হয়, সূর্যের অভ্যন্তরে প্রচন্ড চাপে ও তীব্র উত্তাপে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম পরমাণুর সেই রকম বিক্রিয়ায় তৈরি হয়ে চলেছে প্রচন্ড তড়িৎচুম্বকীয় শক্তি, যা বিকিরণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বাইরে। সূর্যের ওপরের স্তরের দিকে এই তাপমাত্রা প্রায় ৫৫০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু তার কেন্দ্রে, বা অন্দরমহলে, যেখানে পারমাণবিক বিক্রিয়া চলছে, সেখানে তাপমাত্রা প্রায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ ডিগ্রি!
কীভাবে তৈরি হয় এই বিশাল তাপশক্তি, যা তার নিকটবর্তী বুধ ও শুক্র গ্রহকে পুড়িয়ে আংরা করে দেয়, অথচ ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরের পৃথিবীকে পরম যত্নে নাতিশীতোষ্ণ করে রাখে, যেখানে মলয় বাতাস বয়, পাখি গান গায়, ফুলে সুগন্ধ হয়, আর নরম রোদে জলে মাঠের ফসল পেকে ওঠে।
সহজ করে বললে, সুর্যের যে কেন্দ্রীয় অঞ্চল বা ‘কোর’, সেখানে বিপুল অভিকর্ষের চাপে ও তাপের ফলে হাইড্রোজেন অ্যাটম থেকে ইলেকট্রন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, তৈরি হয় আয়নিত প্রোটনের বিপুল ভান্ডার। এবারে (১) এইসব আয়নিত প্রোটনের মধ্যে পরস্পর সংঘর্ষে (ফিউশান) উৎপন্ন হয় ‘ডয়টেরিয়াম’ এবং তীব্র বিকিরণ শক্তির ‘গামা রশ্মি’। (২) ক্রমে ডয়টেরিয়ামের সংগে আরেকটি প্রোটনের সংঘর্ষে তৈরি হয় হিলিয়াম-৩ এবং আরও গামা রশ্মি। (৩) এবার দুটো হিলিয়াম-৩ পরমাণুর সংঘর্ষে তৈরি হয় হিলিয়াম-৪ পরমাণু এবং দুটো আয়নিত প্রোটন। এবার এই ১ থেকে ৩ চক্রটা, বা ‘চেইন রিঅ্যাকশান’ চলতে থাকে, যেভাবে শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ দুই প্রোটনের সম্ভাব্য সংঘর্ষে উৎপন্ন ডয়টেরিয়াম, পরে হিলিয়াম-৩ এবং হিলিয়াম-৪ এবং পুনরায় নতুন দুটো প্রোটন। আর প্রতিবারই তৈরি হচ্ছে বিপুল শক্তির গামারশ্মি (নীচের ছবিতে)। সমস্ত হাইড্রোজেন যখন জ্বলে শেষ হয়ে শুধু হিলিয়াম পড়ে থাকবে, তখন ছেদ পড়বে এই বিক্রিয়া-শৃংখলে। ততদিন সূর্য জ্যোতির্ময়।
সূর্যের কেন্দ্রে যেখানে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মধ্যে পারমাণবিক বিক্রিয়া চলছে, সেখানে প্রেসার বা, চাপের মান পৃথিবীর মাটিতে বায়ুমন্ডলের চাপের প্রায় ২৬,৫০০ কোটি গুণ। সেখানে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম কোনও কঠিন, তরল, বা গ্যাসীয় অবস্থায় নেই। আছে অতিতপ্ত ও আয়নিত অবস্থায়, যাকে প্লাজমা বলা হয়, যার তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের এই কেন্দ্রীয় চুল্লিতে ফিউশান বিক্রিয়ায় প্রতি সেকেন্ডে ৬০ কোটি টন হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হচ্ছে হিলিয়ামে। হ্যাঁ, শুরু থেকে আজ অব্দি ৪৫০ কোটি বছর ধরে এই বিক্রিয়া হয়ে চলেছে, প্রতি সেকেন্ডে ৬০ কোটি টন হাইড্রোজেন পরমাণুর হিলিয়াম ও শক্তিতে রূপান্তর। তার ফলে তৈরি হচ্ছে তীব্র শক্তির গামা রশ্মি। এই প্রচন্ড পারমাণবিক বিক্রিয়ায় লাগামহীন হয়ে, সূর্য কেন প্রচন্ড বিস্ফোরণে ফেটে পড়ছে না ? কে তাকে শাসন করে সংযত রেখেছে এমনভাবে, যাতে মাত্র সাড়ে আট মিনিট দূরের এই একমাত্র সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবীর সমস্ত প্রকৃতি, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে? এখানে যেমন গ্রীষ্ম আসে, শীত আসে, তেমনই আসে শ্যামল মেঘের বর্ষা, আসে মধুমাস বসন্ত। আর শরত ও হেমন্তের তো তুলনা নেই। অন্য আর কোন গ্রহে, কে কবে রাত-আকাশের দিকে তার গানের ভেলা ভাসিয়ে দেয় এমন করে—‘হিমের রাতের ওই গগনের দীপগুলিরে…’!
সূর্যের অভ্যন্তর বা, কোরের মধ্যে ভয়ংকর চাপে ও তাপে ফিউশান ক্রিয়া যখন বেড়ে যায়, তখন ফুলে ওঠে তার আয়তন। এর ফলে কেন্দ্রের তাপমাত্রা কিছুটা হ্রাস পায় এবং সামান্য ধীর হয় বিক্রিয়ার গতি। তাপমাত্রা হ্রাস পেলে ঈষৎ সংকুচিত হয় সেই কেন্দ্রীয় চুল্লি, যার ফলে পুনরায় বর্ধিত তাপে ও চাপে বেড়ে ওঠে ফিউশানের গতি। এইভাবে সূর্যের অভ্যন্তর যেন আমাদের হৃৎপিন্ডের মতোই ক্রমান্বয়ে স্ফীত ও সংকুচিত হয়ে, অবিরাম দপদপ করে চলেছে।
সূর্যের অভ্যন্তর থেকে প্রতিনিয়ত বেরিয়ে আসা এই তড়িৎচুম্বকীয় গামা রশ্মিই বিপুল তাপ ও আলোর ফোটন হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সৌরমন্ডলে। সূর্যের কেন্দ্রীয় অঞ্চল, যেখানে ফিউশান হয়ে চলেছে, আর তৈরি হচ্ছে হিলিয়াম, সেখান থেকে স্তরে স্তরে বাইরের দিকে ক্রমশঃ কমছে হিলিয়ামের পরিমাণ আর বাড়ছে হাইড্রোজেনের মাত্রা, যা ক্রমে ফিউশানে অংশ নিতে কেন্দ্রের দিকে নেমে যাবে।
সূর্যের কেন্দ্র থেকে সবচেয়ে ওপরের তলের দূরত্ব, যা আসলে সূর্যেরই ব্যাসার্ধ, প্রায় ৭০০,০০০ কিলোমিটার। কেন্দ্রের বিক্রিয়াশীল অঞ্চলের পরবর্তী স্তরগুলোর মধ্যে প্রথমেই আছে বিকিরণ বা রেডিয়েটিভ স্তর। তার বাইরে আছে তাপপ্রবাহী কনভেকশান জোন। আরও বাইরের দিকে আছে উজ্জ্বল হলুদ রঙের উত্তাল ফটোস্ফিয়ার। এর পুরুত্ব মাত্র ৩০০ কিলোমিটার, একেই আমরা সূর্যপৃষ্ঠ বলে চিনি। সূর্যের আলোর রঙ যদিও সাদা, পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের মধ্য দিয়ে এলে তাকে ঈষৎ হলুদ রঙের মনে হয়। এই ফটোস্ফিয়ারের বাইরে রয়েছে প্রায় ৫০০০-কিমি পুরু রিং-এর মতো গাঢ় গোলাপি আলোর ক্রোমোস্ফিয়ার, যাকে সাধারণ অবস্থায় দেখা যায় না, কেবল পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় চিনতে পারা যায়। সূর্যের কেন্দ্রে ফিউশান ক্রিয়ার ফলে যে প্রচন্ড শক্তির গামা রশ্মির ফোটনের জন্ম হয়, তাকে ঘন প্লাজমার ‘স্যুপ’-এর মধ্য থেকে নানাভাবে বিচ্ছুরিত হয়ে, বিচিত্র আঁকাবাঁকা পথে চালিত হয়ে উপরিভাগে এসে পৌঁছতে লেগে যায় প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার (১,৭০,০০০) বছর। অথচ, একবার ফটোস্ফিয়ারে এসে পৌঁছলে সেখান থেকে পৃথিবীর মাটিতে রৌদ্রালোক হয়ে ফোটন কণার পৌঁছতে সময় লাগে মাত্র ৮-মিনিট ২০-সেকেন্ড ! এই ফটোস্ফিয়ার অব্দিই সূর্যের আয়তনের সীমানা। এর পরে আছে একটা ট্রাঞ্জিশান জোন, এবং তার পরে মহাকাশে বহুদূর অব্দি ছড়িয়ে আছে যে তেজপূর্ণ প্লাজমার বিপুল ছটা, যাকে শুধু দেখা যায় পূর্ণগ্রাস গ্রহণের সময়, তাকে বলে ‘করোনা’। মহাকাশে এই সৌর ঝড়ের বিস্তার প্রায় ৮০ লক্ষ থেকে এক কোটি কিলোমিটার অব্দি। এছাড়াও আছে হঠাৎ করে কয়েক কোটি মাইলের একটা অতি দীর্ঘ শিখার মতো ছুটে আসা অতি তপ্ত তড়িৎচৌম্বকীয় প্লাজমা-ঝড়, যাকে বলা হয় ‘করোনাল মাস ইজেকশান’ (নীচে ছবি), যা ভীষণভাবে প্রভাবিত করতে পারে সৌরমন্ডলের এবং পৃথিবীর সামগ্রিক আবহাওয়াকে। নীচের ছবিতে তুলনামূলকভাবে পৃথিবীকেও দেখানে হয়েছে, যার থেকে বোঝা যাবে এই করোনাল ইজেকশানের আকার ও বিস্তার পৃথিবীর তুলনায় কত বিশাল হতে পারে।
প্রতি ১১-বছর অন্তর সূর্যের সক্রিয়তা খুবই বেড়ে ওঠে, পরবর্তী পর্বে ধীরে ধীরে আবার কিছুটা স্তিমিত হয়। ২০১২ সালে যখন সূর্য খুব সক্রিয় ছিলো (সোলার ম্যাক্সিমাম) তখন এমনই একটা করোনাল ইজেকশান প্রায় পৃথিবী অব্দি পৌঁছে গিয়ে তীব্র ভূচৌম্বকীয় ঝড় তুলেছিল। উত্তর মেরু ও আর্কটিক অঞ্চলে তার ফলে দেখা গিয়েছিল সবুজ আলোর প্রবল আন্দোলিত ঝালর, যাকে মেরুপ্রভা বা, অরোরা বোরিয়োলিস বলে (নীচে ছবি)।
নিজের কক্ষপথে থেকে পৃথিবী যেমন প্রদক্ষিণ করছে সূর্যকে, এবং সেই কক্ষতল বা এক্লিপ্টিক প্লেনের ওপর সে লম্বভাবে না থেকে বরং কিছুটা (২৩.৫ ডিগ্রি) হেলে আছে, সেরকম সূর্যও নিজের অক্ষের ওপরে প্রায় সাড়ে সাত (৭.২৫) ডিগ্রি হেলে, ঘুরে চলেছে। পৃথিবী যেমন প্রায় ২৪ ঘন্টায় নিজের অক্ষে একবার ঘুরে নেয়, যাকে আমরা এক দিন বলি, সূর্য সেখানে একবার ঘুরতে সময় নেয়, পৃথিবীর হিসেবে, প্রায় ২৭ দিন। তবে, পৃথিবীর মতো শক্ত মাটি-পাথরে গড়া নয় বলে, সূর্য যেমন একটা ঘূর্ণায়মান তপ্ত গ্যাসের গোলক, সূর্যের সেই গোলকের ঘূর্ণনবেগও সর্বত্র সমান নয়। তার বিষুবরেখা অঞ্চলটি যেমন ২৭-দিনে একপাক ঘুরে নেয়, তেমনই তার উত্তর মেরু অঞ্চল একবার ঘুরতে সময় নেয় প্রায় ৩৫-দিন।
সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রও বহুদূর বিস্তৃত। সমস্ত আয়নিত প্রোটন তো ফিউশান বিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারেনা, তাই তা বিপুল পরিমাণ তপ্ত আয়নিত স্রোত বা, ‘প্লাজমা’ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মহাবিশ্বেও। সূর্য থেকে উৎপন্ন এই স্রোত মহাকাশে যতদূর ধাবমান, ততদূর অব্দিই সূর্যের সংসারের সীমানা, যাকে হেলিওস্ফিয়ার বলা হয়।
আমাদের ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে, সূর্য তার সমগ্র সৌরমন্ডল নিয়ে ছুটে চলেছে ঘন্টায় প্রায় ৮,২৮,০০০ কিলোমিটার গতিতে। আশেপাশের প্রতিবেশী কোটি কোটি নক্ষত্রও তাদের গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে একইভাবে ছুটে চলেছে, নিজেদের পারমাণবিক জ্বালানি থেকে উৎপন্ন হওয়া প্লাজমার বিপুল স্রোত সঙ্গে নিয়ে। আন্তর্নাক্ষত্রিক জগতে প্রবাহিত হয়ে চলেছে এই প্লাজমা স্রোত বা, ইন্টারস্টেলার উইন্ড।
সূর্য যেদিকে ধাবমান, সেদিক থেকে সৌরমন্ডলের দিকে ধেয়ে আসতে চাইছে ওই মহাজাগতিক বিকিরণ স্রোত, আর তাকে আটকে দিচ্ছে সূর্যের নিজস্ব প্লাজমাপ্রবাহ, যা সূর্য থেকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে একটা গোলক রচনা করেছে, যাকে বলা হয় হেলিওস্ফিয়ার (Heliosphere)। দুইয়ে যেখানে মুখোমুখি, যার আগে সূর্যের প্লাজমা আর এগোতে পারছে না, সেই ধনুরাকৃতি অঞ্চলটিকে বলা হয় হেলিওপজ (Heliopause) ; সেটাই সৌরমন্ডলের শেষ সীমানা। এর পরে আরও বহুদূরে আছে ওর্ট ক্লাউড।
ভয়েজার-২ উপগ্রহটি এখন গভীর মহাকাশে। প্রায় সাত-আট মাস তার সাথে বার্তা বিনিময় করা সম্ভব হয়নি বিজ্ঞানীদের। কারণ, সে এখন এতটাই দক্ষিণ মহাকাশের পথে চলে গেছে যে, শুধুমাত্র আমাদের দক্ষিণ গোলার্ধে অস্ট্রেলিয়ার একটি বিশাল ২১০-ফুট (DSS43) ডিশ অ্যান্টেনার সাথে তার যোগাযোগ করা যায়, অথচ যেটিকে আগামী মঙ্গল অভিযানের জন্য জরুরি মেরামতির কাজে এতদিন বন্ধ রাখা হয়েছিল। সম্প্রতি ডিশ অ্যান্টেনাটি ফের চালু হওয়ার পরে ভয়েজারের সাড়া পেয়ে বিজ্ঞানীরা হাঁফ ছেড়েছেন। ১৯৭৭ সাল থেকে রওনা হয়ে, সম্প্রতি সে পেরিয়ে গিয়েছে সূর্য নামক নক্ষত্রটির সংসারসীমানা, বা সেই হেলিওপজ অঞ্চলটি। পৃথিবী থেকে এখন (এই লেখার সময় অব্দি) তার দূরত্ব প্রায় ২৩৭৬ কোটি কিলোমিটার। প্রতি সেকেন্ডে ১০ কিলোমিটার বেগে এবার সে ছুটে চলেছে মহাকাশের দূরতম গভীরে। উর্ট ক্লাউড পেরিয়ে, পরবর্তী কোনও নক্ষত্রলোকের সীমানায় পৌঁছতে তার লেগে যাবে আরও অন্ততঃ তিরিশ হাজার বছর।
অনুমান করা হয়, সূর্যের জন্মের পর থেকে বিগত ৪৫০ কোটি বছরে তার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩০%, এবং আগামী প্রতি ১০ কোটি বছরে ১% করে তা বাড়তে থাকবে। অর্থাৎ, ক্রমশঃ উজ্জ্বল হবে সূর্য এবং স্ফীতকায় হতে হতে একদিন সম্পূর্ণ পৃথিবীকেই গ্রাস করে নিয়ে একটা অতিকায় লাল দানবের চেহারা হবে তার।
তবে সূর্যের ক্রিয়াকর্মে প্রতি এগারো বছর অন্তর কিছুটা মন্দাভাব আসে, যাকে ‘সোলার লো’ বলা হয়। এখন আমরা সেই লো-পর্যায়ে রয়েছি। এই পর্ব শেষ হলেই সূর্যের তড়িৎচুম্বক বিকিরণ অনেকটা বেড়ে যাবে, শুরু হবে সৌর ঝড় (সোলার স্টর্ম), আর সূর্যের বুকে দেখা যাবে কয়েকটা কালো বিন্দু বা সোলার স্পট, যা সূচিত করবে তীব্রতা।
সূর্যের অভ্যন্তরে যেখানে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন রূপান্তরিত হচ্ছে হিলিয়ামে, যাকে বলা হয় প্রোটন-প্রোটন সাইকেল, তেমনই আরও বড় নক্ষত্রের কেন্দ্রের ফিউশানে আছে কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন, বা CNO cycle, যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় বিপুল শক্তি। সূর্যের ওই কেন্দ্রীয় অঞ্চলের তাপমাত্রা প্রায় দেড় কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সূর্যের ওপরপৃষ্ঠ, যাকে আমরা চোখে দেখতে পাই, তার তাপমান অনেকটা কম, মাত্র ৫৫০০ ডিগ্রি। কিন্তু যেটা বিস্ময়কর, সেটা হ’ল— সূর্যের বাইরের ছ্বটা বা করোনা, যাকে শুধু গ্রহণের সময় দেখা যায়, তার তাপমাত্রা দশ লক্ষ সেলসিয়াসেরও বেশি।
বড় রকমের কোনও করোনাল ইজেকশান অথবা, সোলার ফ্লেয়ার যদি ছুটে আসে পৃথিবীর দিকে, তবে শুধু মেরুপ্রদেশের মেরুপ্রভা বৃদ্ধি পাওয়াই নয়, সূর্য থেকে ধাবমান প্লাজমাবাহিত প্রবল চৌম্বক ঝড় নানা রকমের বিঘ্ন এবং ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতে পারে পৃথিবীর বুকে, এবং সৃষ্টি করতে পারে ভূচৌম্বক ঝড় (Geomagnetic storm)। বিপুল ক্ষতি হতে পারে উপগ্রহ-যোগাযোগ, ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ পরিবহণ, ইত্যাদি ব্যবস্থার। এই ঝড় কোনও প্রবল বেগে ধাবমান বিধ্বংসী বাতাস নয়, তার কোনও গর্জনও নেই। হঠাৎই মধ্যরাতে নিঃশব্দে তার তীব্র প্লাজমার আয়নিত ছোবল এসে ঝড় তুলতে পারে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের জ্যামিতিতে। থেমে যেতে পারে মাঝ সমুদ্রের জাহাজ, প্লেনের পাইলট যোগাযোগ হারাতে পারে এটিসি-র সাথে, নিমেষে ঘায়েল হতে পারে ইন্টারনেট চালিত কোনও ব্যবস্থাপনা। এছাড়াও দীর্ঘ দিন ধরে বদলে যেতে পারে পৃথিবীর আবহাওয়া।
এই সূত্রে মনে পড়ছে, আজ থেকে ২৫ বছর আগে ১৯৯৫ সালে কৌরবে প্রকাশিত আমার একটা কবিতার কিছু লাইন, যা পরে ‘উত্তরমালা’ বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল :
“একদিন মধ্যরাতে ডাক এসেছিলো,
যেন তীব্র এক জ্যামিতিক ঝড়—
আমরা কি বৃত্ত পরিধি, নাকি অসীমের দিকে ধাবমান
কোনও রেখা ;
সহসা একদিন রাতে এইসব প্রশ্ন উঠেছিল”।
সূর্যকে নিয়ে আরও কত কথা আছে, তা বলা যাবে আগামী কোনও পর্বে। সূর্যকে খুব কাছ থেকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার জন্য পাঠানো হয়েছে অনেক স্যাটেলাইট বা কৃত্রিম উপগ্রহ, যারা সংগ্রহ করছে নানা তথ্য, অনেক তরঙ্গদৈর্ঘের ছবি, অনেক বিশ্লেষণ। কারণ সূর্যই নিয়ন্ত্রণ করছে সমগ্র সৌরজগতের আবহাওয়াকে, তার মধ্যেই পাওয়া যাবে ব্রহ্মান্ডের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অনেক তথ্য ও সংকেত। অদিতির পুত্র তিনি। তিনি আদিত্য, তিনিই দিবাকর। আমরা তাঁকে প্রণাম করি।
[ক্রমশঃ…]
Posted in: November 2020 - Serial, PROSE