ব্যক্তিগত সিনেমাটিক : সেঁজুতি দত্ত
[ব্যক্তিগত সিনেমাটিক – সিনেমা সংক্রান্ত নিজের ভাবনাগুলি অথবা প্রতিনিয়ত যা কিছু নিজেকে ভাবাচ্ছে সেগুলিকে সিনেমার রেফারেন্সে ভাবার একটা প্রয়াসে এই কলাম। তাই এই কলামটি যেমন ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক আবার তেমনই ব্যক্তিগত এবং সিনেমাটিকও বটে। সিনেমায় পাওয়া বিশেষ কিছু মুখ নিয়ে লেখা এই কলাম এবং সেই প্রতিকৃতির বাছাই প্রক্রিয়া অবশ্যই ব্যক্তিগত। সেই মুখ সিনেমার, সেই মুখ ব্যক্তিগত এবং সেই মুখ রাজনৈতিক।]
পর্ব – ২
আজকের মুখ – চে
২০২০ সালে মৃত্যুর ঢল লেগে গেছে আর তার বেশিরভাগ খবর আমরা পাচ্ছি অনলাইন নিউজ পোর্টাল আর সোশাল মিডিয়ার দৌলতে। যে মৃত্যুতে শোক হবার কথা ছিল, যে মৃত্যুতে ভেঙ্গে পড়ার কথা ছিল, আবার যেসব মৃত্যুর খবর এড়িয়ে গিয়ে নিজের মতো বেঁচে থাকার কথা ছিল, এরকম সব খবর এখন একসাথে মিলেমিশে যাচ্ছে। সেইদিন হয়ত দূরে নয় যখন মানুষ দেখবে যে একই সঙ্গে প্রিয় কারো মুখ আর সেই মুখ থেকে প্রাণ কেড়ে নেওয়া তার হত্যাকারীর মুখ পরপর ভেসে উঠছে তাদের টাইমলাইনে আর দুটি ছবির নিচেই লেখা রয়েছে আর. আই. পি।
এ’কারণেই ভালোবাসার মুখকে ক্লেম করতে হয়, কিছুটা জোর করেই। বিজ্ঞাপনে মোড়া একটা শহর, সেই শহর জুড়ে মুখের ছবি যেখানে সারি সারি মুখই শহর হয়ে ওঠে, সেখানে ক’টা মুখ আমাদের চেনা? ক’টা মুখে আমরা নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই? এই প্রশ্ন যদিও নতুন নয়। ওদিকে এই প্রশ্নের উত্তরস্বরূপ সমকালের বিজ্ঞাপন চেষ্টা করে চেনা মুখ ব্যবহার করতে। সামাজিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কম্পিটিশন জিতে নেওয়া মুখ, শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর তকমা পাওয়া মুখ, যে ভালো রাঁধতে পারে তার মুখ ইত্যাদি জায়গা করে নিচ্ছে আজকের বিজ্ঞাপনে। এত চেনা মুখের ভিড়ে, দিনের বাকি যে সময়টা আমরা সোশাল মিডিয়ায় কাটাই সেখানে ভেসে বেড়ায় আরও অজস্র মুখ। করিতকর্মা আঙুলের প্রান্তে এখন গোটা পৃথিবী। তারা মুখ বিক্রয় করে, মুখের মিথ্যা গল্প নির্মাণ করে এবং সেই গল্প পৌঁছে দেয় ক্ষুধার্ত, পরিশ্রমী, অসমর্থ, কাহিল সব আঙুলের ডগায়। হাতের মুঠোয় এত মুখের গল্প নিয়েই ঘুমাতে যায় আজকের পৃথিবী। আমরা সেই পৃথিবীর নাগরিক। গত ৬ই নভেম্বর যখন খবর পেলাম যে ফার্নান্দো সোলানাস মারা গেছেন তখন চলচ্চিত্রের ছাত্রী হিসেবে আরেকটা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠল – তিন মিনিট ধরে চলা প্রাণহীন এর্নেস্তো চে গেভারার মুখ। তাই আজকের কলামের মুখ, চে।
১৯৬৮ সালে মুক্তি পায় ফার্নান্দো সোলানাস নির্মিত তিন খণ্ডের অ্যাজিটপ্রপ ডকুমেন্টারি “দ্য আওয়ার অফ দ্য ফার্নেসেস”। ১৯৬৭ সালের ১৬ই এপ্রিল হাভানা থেকে প্রকাশিত চে গেভারার অন্তিম পাবলিক স্টেটমেন্ট, “মেসেজ টু দ্য ট্রাইকন্টিনেন্টাল”-এর শুরুতে ব্যবহৃত হোসে মার্তির বিখ্যাত কোটেশন “It’s the hour of the furnaces and only the light shall be seen” থেকে এই ছবির নামকরণ। ল্যাটিন আমেরিকার দুই সংগ্রামী মুখ, চে গুয়েভারা এবং হোসে মার্তি, এই ছবির ছত্রে ছত্রে গাঁথা হয়ে থাকেন। কিন্তু আমরা আজকে এই ছবির আলোচনায় যাচ্ছি না, আজ আমরা শুধু কথা বলব চে’র মুখ নিয়ে। কথা বলব একটা তিন মিনিটের ক্লোজ-আপ শট নিয়ে যার পুরোটা জুড়ে আছে এমন একজনের মুখ যাকে আজ আমরা পোশাক থেকে শুরু করে সমস্তরকম পণ্যের পৃষ্ঠে মুদ্রিত হতে দেখতে পাই। টাকা দিয়ে সেই মুখ আমাদের কিনতে হয়। দেখা গেছে, লাল রঙের কাপড়ে কালো কালি দিয়ে আঁকা ওই মুখ একটু বেশিই বিক্রি হয়। সময় বিশেষে সেই মুখ আমাদের সোশালমিডিয়ার টাইমলাইন জুরেও ঘুরে বেড়ায়। ঠিক যেমন আজকে।
সোলানাসের মৃত্যুখবর পাওয়া মাত্রই ঠিক করেছিলাম চে’র মুখ নিয়ে লিখব। কিন্তু লিখবার সময় যে সেই মুখ আরেকবার, নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে সেটা ভাবিনি। আজ যখন লিখছি, খবর পেলাম দিয়েগো মারাদোনা মারা গেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আমার পালেও যে সর্বজনীন শোকযাপনের হাওয়া লাগল তা অস্বীকার করব না এবং এই দুঃসংবাদ প্রাপ্তির সাথে সাথেই টাইমলাইনে ফুটে উঠল সেই ছবি। চুরুট মুখে মারাদোনা ভেসে আছেন সমুদ্রের জলে, তার বাহুতে চে’র মুখ।
“দ্য আওয়ার অফ দ্য ফার্নেসেস” প্রথম খন্ড শেষ হয় চে’র মুখে এসে। শেষ শটের কিছুক্ষণ আগেই আমরা দেখতে পাই শোয়ানো আছে মৃত চে’র দেহ। সেই দেহ ঘিরে শোক করছেন সুদিনের স্বপ্নদেখা, ওঁর ওপর বিশ্বাস রাখা মানুষগুলো। ন্যারেশনে শুনতে পাই, “যে মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে মারা যান, তার কাছে মৃত্যু অন্তিম সময় নয়। মৃত্যু সেখানে বিজয়ের সামিল। মৃত্যুকে বেছে নেবার সঙ্গে সঙ্গে সে তার জীবনকেই বেছে নেয়”। এর পরেই আসে সেই তিন মিনিট। এই তিন মিনিটে ওলটপালট হয়ে যায় জীবনমৃত্যুর এপার ওপার। মৃতের মুখে ফুটে ওঠে ভাষা, বলে লড়াই জারি আছে।
আত্ম এবং অপরের বাইনারিতে এই মুখ অপরের। সে দূর থেকে হাতছানি দেয়, কাছে যেতে বলে কিন্তু আমরা বুঝতে পারি, যতই এগিয়ে যাই এই মুখ ততই দুর্বোধ্য হতে থাকে। ঔপনিবেশিকতাবিরোধী সংগ্রামের মুখ তার দেশ থেকে বেরিয়ে হয়ে ওঠে সারা বিশ্বের সংগ্রামী মুখের প্রতিনিধি। ওদিকে যে মুখে আমরা নিজেদের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হতে দেখি সেই মুখ যখন চেনা অভ্যাসের আওতায় চলে আসে তখন জটিলতাও বাড়ে। এই তথ্যের যুগে খবরের জোগাড় পাওয়া সহজ আর তাই কিছু খবরে মনখারাপ বাড়ে। আমাদের সহনাগরিকেরা আশাহত হন কারণ ওই মুখ উশকে দেয় আরো কিছু স্মৃতি, জানা যায় চে সমকামীদের অধিকারের ব্যাপারে সহমর্মী ছিলেন না।
বিভিন্ন মুখের ছবিতে গেঁথে থাকে আমাদের আগামীর স্বপ্ন। বাজার সেই মুখগুলিকে জীবন্ত করে বিক্রি করে আমাদের কাছে – আমাদেরই মুখ আমাদের কাছে। আমাদের স্বপ্নগুলিকে ছাড়িয়ে, মৃত্যুর নির্মমতাকে লুকিয়ে রেখে এই মুখকে করে তোলে আকর্ষণীয় এবং যারা এই আকর্ষণের দিকে পা বাড়াবে তাদের অনেকেই জানবে না যে সুকুমার ও দৃপ্ত চেহারার এই মুখ থেকে যদি প্রাণের শেষ স্পর্শটুকু কেড়ে নেওয়া হয় তখন কেমন দেখতে লাগে।
এক একটি মুখ এক একটি গল্প বলে। এই গোটা বছর যখন অজস্র মুখের ছবি দেখতে পাচ্ছি, যে মুখ থেকে প্রাণ বেরিয়ে গেছে অসময়ে, তখন চে’র ওই মুখ মনে পড়ে বৈকি! এর মধ্যে সব মুখ প্রিয়জনের নয়, কিছু মুখ দেখতে হয়ত ভালোও লাগে না, কিন্তু সোশালমিডিয়া নামক বাজারের নিয়মে এত মুখের ভিড়ে মৃত্যুও যখন আর আমাদের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে না এবং সারা পৃথিবী যখন মোবাইল স্ক্রিনে উদাসীন অঙ্গুলিহেলনে ব্যস্ত, এক একটি ইমেজের ডিউরেশন যেখানে কয়েক সেকেন্ডের, সেখানে ওই তিন মিনিট ধরে চে’র মুখ এক অবদমিত বাস্তবতা তুলে আনে। যে বাস্তবের মুখে স্বপ্ন আছে, মৃত্যুকে ছাপিয়ে যাবার ইঙ্গিত আছে আর তার সঙ্গে আছে জটিলতা। এই জটিলতা সমস্ত মৃত্যুকে এক করে দেখার সরলীকৃত অভ্যাসকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে শুধু, এইটুকুই।
[লেখক – সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।]
Posted in: ARTICLE, November 2020 - Serial