বিটকয়েন : সহস্রলোচন শর্মা

বিটকয়েন : পর্ব ৩

ব্যাঙ্কের উপর অগাধ ভরসা আম জনতার। অথচ সমপরিমাণ টাকা শেয়ার বাজারে খাটালে ব্যাঙ্কের থেকে বেশি রিটার্ন পাওয়া যেতে পারে। শেয়ার বাজারের থেকেও বেশি রিটার্ন পাওয়া যাবে বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগ করে। আর ক্রিপ্টোকারেন্সির সাধারণ গ্রাহকদের থেকে আবার মাইনারদের আয় আরও বেশি। আমরা আগেই জেনেছি, যে কোনও গ্রাহকই মাইনারের ভূমিকাও পালন করতে পারেন। ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের মতো মাইনারদের নিয়োগ করেন না কেউ। স্বেচ্ছায় মাইনিঙের কাজ যোগ দিতে পারেন যে কোনও গ্রাহকই। মাইনারদের তাই মাসান্তে কোনও মাইনে থাকে না। তবে মাসের শেষে মাইনাররা যা আয় করেন তার পরিমাণ শুনলে চমকে উঠবেন আপনি। মাইনারদের মূল কাজই হচ্ছে, সদ্য আপলোড হওয়া হ্যাশ বা সংকেতকে ডিকোড করে সে ট্রান্সাকশনকে বৈধ বা অবৈধ বলে ঘোষণা করা। এই ঘোষণার সাথে সাথে পুরানো ব্লকের উপর নতুন একটা ব্লকের সংযোজন ঘটান তাঁরা। ক্রিপ্টোকারেন্সির ব্লকচেইনে নতুন কোনও ব্লক সংযোজন করতে পারলেই আছে মোটা ইনাম। সবার আগে ‘প্রুফ অব ওয়ার্ক’ সহ যিনি নতুন ব্লক সংযোজন করতে পারবেন তিনিই পেয়ে যাবেন এই পুরস্কার।
কেন? নতুন ব্লক সংযোজনের জন্য পুরস্কার দেওয়া হয় কেন? বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক তাহলে। আমরা জানি, একটু বড় এমাউন্টের ক্রিপ্টোকারেন্সি ট্রান্সাকশন সঠিক ঘোষণা করতে অন্তত ৩ জন বা ৬ জন মাইনারের সম্মতির প্রয়োজন হয়। এখন যদি এমন হয়, আমার ট্রান্সাকশনের জবাবে মাত্র ১ জন বা ২ জন সম্মতি দিলেন। বাকিদের কেউ আর কিছু বলছেন না, চুপ করে আছেন বা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তাহলে? তাহলে তো আমার ট্রান্সাকশন মাঝপথে ঝুলে রইল! কি হবে আমার তখন? না, ক্রিপ্টোকারেন্সিতে এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এর কারণই হলো- পুরস্কার। কোনও ট্রান্সাকশনকে সবার আগে ‘প্রুফ অব ওয়ার্ক’ সহ যে মাইনার সঠিক বা বেঠিক ঘোষণা করবেন অর্থাৎ ব্লকচেইনে নতুন আরেকটা ব্লক সংযোজন করবেন, তাঁর জন্য রয়েছে পুরস্কারের ব্যবস্থা। পুরস্কার হিসেবে তাঁদের একাউন্টে জমা পড়ে যায় বিটকয়েন। কত বিটকয়েন জমা পড়ে তাঁদের একাউন্টে? বর্তমানে পুরস্কারের হার হলো ব্লক প্রতি ৬.২৫ বিটকয়েন। এই মুহূর্তে ১ বিটকয়েনের দাম প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা মতো। তাহলে ৬.২৫ বিটকয়েন মানে কত দাঁড়ালো? ৮,৫০,০০০×৬.২৫ টাকা = ৫৩,১২,৫০০ টাকা বা ৫০ লক্ষ টাকারও বেশি। অর্থাৎ যিনি সবার আগে নতুন ব্লক সংযোজন করতে পারবেন পুরস্কার হিসেবে তিনি পাবেন ৬.২৫ বিটকয়েন বা ৫৩ লক্ষ টাকা। বিটকয়েন জগতে দেখা যাচ্ছে প্রতি ১০ মিনিটে একটা করে নতুন ব্লক যুক্ত হয়ে চলেছে ব্লকচেইনে। সেই হিসেবে প্রতি ঘন্টায় সংযোজিত হয়ে চলেছে ৬টা নতুন ব্লক। অর্থাৎ প্রতি দিন ৬×২৪ = ১৪৪টা নতুন ব্লক সংযজিত হয়ে চলেছে। এই ১৪৪টা ব্লকের প্রতিটা ব্লকের জন্য রয়েছে ৫৩ লক্ষ টাকার পুরস্কার। এখন এই ১৪৪টা ব্লকের মধ্যে যদি দুটো ব্লকও যুক্ত করতে পারেন আপনি, তাহলে তো একদিনেই কোটিপতি হয়ে যাবেন মশাই!
পুরস্কারের রকম শুনে কি মনে হচ্ছে? অবিশ্বাস্য! সন্দেহ হচ্ছে যে, এমন ঘটনা সত্যি ঘটে কি না? হ্যাঁ, এমন ঘটনা ঘটে, ঘটে চলেছে। প্রতি নিয়তই এই খেলা চলছে বিটকয়েনের দুনিয়ায়। তবে ঘটনাটা সত্যি হলেও, পুরস্কার লাভের পথটা অত সহজ নয়। বিষয়টা কতটা কঠিন সেই ব্যাখ্যাই দেওয়া যাক এবার। আমি যখন কোনও ব্যক্তিকে বিটকয়েন পাঠালাম, সেই খবরটা একটা বিশেষ সংকেত বা হ্যাশে পরিণত হয়ে গেল। এই হ্যাশ ডিকোড করেই নতুন ব্লক তৈরি করেন মাইনাররা। একটা ট্রান্সাকশনের সংকেতকে ডিকোড করা কোনও সাধারণ কম্পিউটারের কম্ম নয়। CPU যুক্ত সাধারণ কম্পিউটারের কথা তো ছেড়েই দিলাম, পরবর্তী জেনারেশনের GPU (Graphics processing unit) বা FPGA (Field-programmable gate array) যুক্ত কম্পিউটারের পক্ষেও এই সংকেতের মর্ম উদ্ধার করা সম্ভবপর নয়। কেবলমাত্র ASIC (Application specific integrated circuit) যুক্ত কম্পিউটারই পারবে এই সংকেতের মর্ম উদ্ধার করতে। কোনও পেশাদার ব্যক্তি ছাড়া এই জাতীয় কম্পিউটার ব্যবহার করেন না কেউই। তারপরও রয়েছে আরও গল্প। শুধুমাত্র ASIC যুক্ত কম্পিউটার কিনলেই কাজ শেষ হবে না, সেই কম্পিউটারের হ্যাশ রেটও (Hash rate) বিবেচনা করতে হবে। প্রতি সেকেন্ডে সংকেত ডিকোড করার হারকে হ্যাশ রেট বলা হয়। কিলো হ্যাশ/সেকেন্ড, মেগা হ্যাশ/সেকেন্ড, গিগা হ্যাশ/সেকেন্ড, টেরা হ্যাশ/সেকেন্ড, পিটা হ্যাশ/সেকেন্ড, এক্সা হ্যাশ/সেকেন্ড, জেটা হ্যাশ/সেকেন্ড ইত্যাদি হলো হ্যাশ রেটের একক। এই একক গুলোর প্রত্যেকটা একক তার পূর্ববর্তী এককের ১০০০ গুণের তুল্য। অর্থাৎ, ১০০০ কিলো হ্যাশ = ১ মেগা হ্যাশ, ১০০০ মেগা হ্যাশ = ১ গিগা হ্যাশ ইত্যাদি ইত্যাদি। যে কম্পিউটারের হ্যাশ রেট যত বেশি হবে সেই কম্পিউটার তত দ্রুত সংকেত ডিকোড করতে পারবে। অর্থাৎ মেগা হ্যাশ/সেকেন্ড বা গিগা হ্যাশ/সেকেন্ড ক্ষমতা যুক্ত ASIC কম্পিউটারের সাহায্যে কোনও সংকেত ডিকোড করতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। ততক্ষণে পিটা হ্যাশ/সেকেন্ড বা এক্সা হ্যাশ/সেকেন্ড ক্ষমতা যুক্ত ASIC কম্পিউটার সেই সংকেত ডিকোড করে ফেলবে আর নতুন ব্লক তৈরি করে ফেলবে। অর্থাৎ, যাঁর কাছে যত আধুনিক কম্পিউটার আছে কেবলমাত্র তিনিই পারবেন পুরস্কারের বাজিটা মারতে। সেই আধুনিক কম্পিউটার রাখার জন্য বেশ বড় জায়গার প্রয়োজন। শুধু তাই নয়, অধিক হ্যাশ রেট যুক্ত কম্পিউটারের বিদ্যুৎ খরচাও আবার বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। অধিক হ্যাশ রেট যুক্ত ASIC কম্পিউটার দ্রুত গরম হয়ে উঠে বলে তাকে ঠান্ডা রাখতে সর্বক্ষণ একাধিক এসির প্রয়োজন হয়। মোটের উপর উচ্চ হ্যাশ রেট যুক্ত ASIC কম্পিউটার ব্যবহার করাটা খুবই খরচ সাপেক্ষ ব্যাপার যা আমার আপনার সাধ্যের বাইরে। তাই ইচ্ছা থাকলেও উপযুক্ত কম্পিউটারের অভাবে আমি বা আপনি মাইনার হয়ে উঠতে পারবো না। আচ্ছা, তর্কের খাতিরে না হয় ধরেই নিলাম, একেবারে সর্বাধুনিক ক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার রয়েছে আমার কাছে। তাহলেও, নতুন ব্লক সৃষ্টি করে আমার পুরস্কার জেতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ, একা একা এই সংকেত ডিকোড করা সম্ভব নয় দেখে বন্ধুবান্ধবরা মিলে একটা দল তৈরি করে ফেলেছেন অনেক দিন আগেই। ক্রিপ্টোকারেন্সি দুনিয়ায় এই সমস্ত দলকে ‘পুল’ নামে ডাকা হয়। পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের যে কোনও ব্যক্তি এই পুলের সদস্য হতে পারেন। পাবজি বা অন্য অনলইন গেমের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের যে কোনও বয়সের লোকই আপনার পার্টনার বা প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারেন। রাত দু’টো হোক বা দুপুর দু’টো গেম খেলার জন্য সব সময়ই অনলাইন পার্টনার পেয়ে যাবেন আপনি। অথচ, না আপনি আপনার অপর প্রান্তের সেই বন্ধুর সঠিক পরিচয় জানেন, না তিনি আপনার সঠিক পরিচয় জানেন। কিন্তু দু’জনে জুটি বেঁধে একটা গেম খেলে ফেললেন। অনলাইন গেমের মতোই সারা পৃথিবী জুড়ে এমন ভাবেই ছড়িয়ে আছেন মাইনাররা। দিনের যখনই কোনও ট্রান্সাকশনের খবর আপলোড হোক না কেন, পুলের সদস্যরা সেই সংকেত ডিকোড করতে সদা প্রস্তুত। ট্রান্সাকশন হওয়া মাত্রই সেই সংকেত ডিকোড করতে বসে যান তাঁরা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নতুন ব্লক যুক্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। নতুন ব্লক যুক্ত করার পর পুরস্কার বাবদ যা আয় হয়, ব্লক তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে সেই অর্থ বন্টন করা হয়। এই মুহূর্তে ৫-৬টা বড় বড় পুল চালু রয়েছে ক্রিপ্টো দুনিয়ায় যাদের প্রত্যেকের সক্রিয় সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ। উদাহরণ হিসেবে অ্যান্টপুল (Antpool) বা বিটিসি.কম (BTC.com) এর কথাই বলা যাক। বড় পুল ছাড়াও রয়েছে মাঝারি মাপের পুল, ছোটো ছোটো পুল, আছে ব্যক্তি উদ্যোগও। এক হিসাবে, এই মুহূর্তে সারা পৃথিবীতে প্রায় ১০ লক্ষ মাইনার আছেন। ফলে একটা ট্রান্সাকশন আপলোড হওয়া মাত্রই দুনিয়ার নানা প্রান্তের পেশাদার মাইনাররা নতুন ব্লক যোগ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সেখানে আমার আপনার মতো ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোসিটে আস্থা রাখা অপেশাদার শৌখিন লোকের পক্ষে নতুন ব্লক যোগ করে কোটিপতি হওয়ার বাসনাটা দিবা স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছুই নয়।
পুরস্কার ছাড়াও মাইনারদের আয়ের অন্তত আরও ৩টে উপায় আছে, যার প্রথমটা হলো- ট্রান্সাকশন ফি। ব্যাঙ্ক ড্রাফট বা অনলাইন পেমেন্টের ক্ষেত্রে প্রেরিত অর্থের উপর একটা ফি ধার্য করে থাকে ব্যাঙ্ক। ঠিক সেই রকম ভাবেই, বিটকয়েন বা অন্য যে কোনও ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে দ্বিতীয় কাউকে অর্থ প্রেরণ করলে, প্রেরিত অর্থের সাথে সামান্য পরিমাণে একটা ‘ট্রান্সাকশন ফি’ চার্জ করা হয়। মূলত ৩টে বিষয়ের উপর নির্ভর করে এই ট্রান্সাকশন ফি’র পরিমাণ। উদাহরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাক বিষয়টাকে। ১) ধরা যাক আপনি ‘কয়েনবেস’এর সাইট থেকে বিটকয়েন ওয়ালেট ওপেন করেছেন আর আমি ‘কয়েনমামা’ সাইট থেকে বিটকয়েন ওয়েলেট ওপেন করেছি। খেয়াল করে দেখবেন, দু’টো অনলাইন গ্রসারি শপে বা বাজারের দু’টো দোকানে একই কোম্পানির কোনও পণ্যর (ধরুন বিস্কুটের প্যাকেট) দামের সামান্য হেরফের হয়ে থাকে। ঠিক সেই ভাবেই আপনার ওয়ালেট থেকে ট্রান্সাকশন করলে যে ফি ধার্য হবে, আমার ওয়ালেট থেকে ট্রান্সাকশন করলে ভিন্ন কোনও ফি ধার্য হবে। অর্থাৎ, ক্রিপ্টোকারেন্সির বিক্রির সাইট বা প্ল্যাটফর্ম ভেদে ট্রান্সাকশন ফির সামান্য তারতম্য হয়ে থাকে। ২) এবার ধরা যাক, আপনি আর আমি একই সাইট থেকে ওয়ালেট ওপেন করেছি। কিন্তু আপনি বিটকয়েন ওয়ালেট ওপেন করেছেন আর আমি ইথিরিয়ম ওয়ালেট ওপেন করেছি। অর্থাৎ আপনার আর আমার ক্রিপ্টোকারেন্সি এক নয়। বিভিন্ন ক্রিপ্টোকারেন্সির ট্রান্সাকশন ফি বিভিন্ন। যে ক্রিপ্টোকারেন্সি অধিক ব্যবহৃত হয় তার ট্রান্সাকশন ফি বেশি পড়ে। সাধারণ ভাবে দেখা গেছে, অন্যান্য ক্রিপ্টোকারেন্সির তুলনায় বিটকয়েনের ট্রান্সাকশন ফি সামান্য হলেও বেশি পড়ে। এই মহূর্তে বিটকয়েনের ট্রান্সাকশন রেট হলো ১৩৮ সাতোশি/বাইট (পরিবর্তনশীল) ৩) এবার ধরা যাক, আপনি আর আমি একই সাইট থেকে একই ক্রিপ্টোকারেন্সির (ধরা যাক বিটকয়েনের) একাউন্ট খুলেছি। ধরা যাক, একই ব্যক্তিকে (পত্রিকার সম্পাদক মশাইকে) আপনি আর আমি কিছু বিটকয়েন পাঠালাম। তাতেও আপনার আর আমার ট্রান্সাকশন ফি এক হবে না। কারণ আপনি আর আমি তো সমপরিমাণ অর্থ পাঠাই নি। কি পরিমাণ অর্থ পাঠানো হলো তার উপর ট্রান্সাকশন ফি নির্ভর করে। তবে প্রেরিত অর্থের উপর ততটা গুরুত্ব দেয় না ক্রিপ্টো দুনিয়া। ক্রিপ্টো দুনিয়ায় ট্রান্সাকশন ফি নির্ভর করে সংকেত বা হ্যাশের ‘বাইট’এর উপর। সাধারণ ভাবে ট্রান্সাকশন ফি মাপা হয় সাতোশি/বাইট একক দিয়ে। ক্রিপ্টো দুনিয়া দেখে আপনার সংকেত ডিকোড করতে কত বাইট ব্যবহার করা হলো। সেই অনুযায়ী চার্জ করা হয় ট্রান্সাকশন ফি। এটা নিশ্চিত, বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতে গেলে বেশি বাইটের সংকেত লিখতে হয় আর কম অঙ্কের টাকা পাঠাতে গেলে কম বাইট খরচা হয়। সেই হিসেবে সহজ কথায় বলা যায়, টাকার পরিমাণের উপর ট্রান্সাকশন ফি ধার্য হয়ে থাকে।
মাইনিং ব্যতিরেকে মাইনারদের আয়ের দ্বিতীয় উপায় হলো বিটকয়েন ধার দেওয়া। শুধু মাইনাররা নয়, ক্রিপ্টোকারেন্সির যেকোনও গ্রাহকই এই পদ্ধতিতে আয় করতে পারেন। ধরা যাক, কোনও ব্যক্তির কাছে ২০টা বিটকয়েন আছে। এই ২০টা বিটকয়েনের মধ্যে, ১০টা বিটকয়েন তিনি জমা দিলেন ‘কয়েনবেস’ বা ‘কয়েনমামা’র সাইটে, ঠিক যেমন ভাবে আপনি ব্যাঙ্কে ‘ফিক্সড ডিপোসিটে’ টাকা জমা রাখেন। এই সমস্ত প্ল্যাটফর্মে ক্রিপ্টোকারেন্সি জমা রাখলে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে সুদ পাবেন আপনি। প্ল্যাটফর্ম ভেদে সুদের হার ভিন্ন হয়ে থাকে। কমবেশি ৫% সুদ দেয় প্রায় সব প্ল্যাটফর্মই। ব্যাঙ্কের মতোই এখানেও সুদ থেকে রোজগার করতে পারেন যে কোনও গ্রাহকই। আপনার জমা রাখা সেই বিটকয়েনগুলো নতুন কোনও গ্রাহকের কাছে বেচে দেবে কয়েনবেস বা ক্রিপ্টো প্ল্যাটফর্মগুলো, ঠিক যে ভাবে আপনার জমা রাখা ফিক্সড ডিপোসিটের টাকা দিয়েই ‘হোম লোন’, ‘কার লোন’, ‘এডুকেশন লোন’এর ব্যবস্থা করে থাকে ব্যাঙ্কগুলো।
‘ক্রিপ্টো কালেকটিবলস’ হলো মাইনার বা সাধারণ গ্রাহকের আয়ের তৃতীয় এক উপায়। কালেকটিবলস কথাটার মানে সংগ্রহে রাখার মতো বস্তু। আপনার বাড়ির শোকেসে যেমন বিভিন্ন গিফট আইটেম সাজানো থাকে কিম্বা দেয়ালে টাঙানো থাকে পেইন্টিং, ঠিক তেমনই আপনার ক্রিপ্টো ওয়ালেটে রাখতে পারেন ক্রিপ্টো জেম, ক্রিপ্টো পেইন্টিং প্রভৃতি। খেয়াল করেছেন নিশ্চয়, অনেকের বাড়ির দেয়ালে ‘মোনালিসা’র ছবি ঝোলানো রয়েছে। দর্শক মাত্রই জানেন যে ‘মোনালিসা’র সেই ছবিটা আসল নয়, নকল ছবি। বাস্তব দুনিয়ায় যে কোনও পেইন্টিঙের নকল প্রস্তুত করা যায়। কিন্তু ক্রিপ্টো পেইন্টিঙের নকল করা সম্ভবপর নয়। কম্পিউটারের সাহায্যে যেমন ভাবে ডিজিটাল আর্ট হয়, সেই ভাবেই ক্রিপ্টো দুনিয়াতেও আঁকা যায় ছবি। আর এই ছবি তৈরি করতে ব্লকচেইন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই ব্লকের সবকটা সংকেত বা হ্যাশ ডিকোড করলে তবেই সেই ছবির নকল প্রস্তুত করা সম্ভব। সেই হ্যাশ ডিকোড করা অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ ও খরচ সাপেক্ষ কাজ। ফলে শিল্পী ছাড়া অন্য কারও পক্ষেই সেই ছবির নকল করা সম্ভব নয়। ক্রিপ্টো পেইন্টিং বিক্রয় যোগ্য। বাস্তবে যে ভাবে টাকার বিনিময় কোনও পেইন্টিং কিনে থাকেন আপনি, সেই ভাবেই ক্রিপ্টো কারন্সি দিয়ে কিনতে পারেন কোনও ক্রিপ্টো পেইন্টিং। কি লাভ হবে সেই পেইন্টিং কিনে? ধরুন আজ যে পেইন্টিংটা ২ ইথিরিয়ম (এই সমস্ত ক্ষেত্রে বিটকয়েনের থেকে ইথিরিয়ম বেশি চলে) ব্যয় করে কিনলেন, অন্য কারও পছন্দ হলে কাল সেই ছবিটা ৪ ইথিরিয়ম দিয়ে বেচে দিন তাঁকে। যদি সঠিক বস্তু কিনে থাকেন (অনেকটা শেয়ারের মতো) তাহলে সে বস্তু বিক্রি করে লাভ পাবেন আপনি।
ক্রিপ্টো দুনিয়ায় এক সাড়া জাগানো ‘কালেকটিবলস’ হলো ‘ক্রিপ্টো কিটিজ’। কিটি মানে বেড়াল। ২৮শে নভেম্বর ২০১৭ সালে ভ্যাঙ্কুবর শহরের এক সফটওয়্যার কোম্পানি ক্রিপ্টো কিটি বাজারে আনেন। বেড়ালের কিছুদিন পরই বাজারে আসে ক্রিপ্টো ডগস। একে একে বাজারে আসতে শুরু করে ক্রিপ্টো পাপিজ, ক্রিপ্টো পান্ডাজ, ক্রিপ্টো বানিজ, ক্রিপ্টো পেটস এমনকি কাল্পনিক চরিত্রের মানুষ ক্রিপ্টো ফাইটার প্রভৃতি। এই সমস্ত প্রাণীদের কিনতে পারেন যে কোনও গ্রাহক। ক্রিপ্টো পেইন্টিঙের মতোই ব্লকচেইন পদ্ধতি দিয়ে তৈরি হয় ক্রিপ্টো পোষ্যগুলো। কোনও বিড়ালের নকল বেড়াল প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকের পোষ্যই হবে ইউনিক, একমেবাদ্বিতীয়ম। এই সমস্ত প্রাণী কিনে লাভ কি? এই সমস্ত প্রাণীদের নিয়ে হয় দৌড় প্রতিযোগিতা। বাস্তব দুনিয়ায় যে ভাবে ডগ রেস বা ঘোড় দৌড় হয়ে থাকে, কম্পিউটারে যে ভাবে গাড়ির রেস হয়ে থাকে, ঠিক সেই ভাবে ক্রিপ্টো দুনিয়ায়ও রেস হয়। সেই প্রতিযোগিতায় নাম দিন আপনি। প্রতিযোগিতায় জিতলেই পুরস্কার। এছাড়াও এই প্রাণীগুলো জননে তথা বংশবিস্তারে সক্ষম। তার সন্ততিরা আপনার সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে। পেইন্টিঙের মতোই ভালো দর পেলে, প্রাণীগুলো বিক্রি করে দিয়ে আয় করে থাকেন পোষ্যের মালিকরা। ঠিক এই ভাবেই আপনি কিনতে পারেন কোনও ক্রিপ্টো গ্রহ। সেই গ্রহ খুঁড়ে পেতে পারেন কোনও অমূল্য রত্ন। সি গ্রহে বসতি গড়ে তুলতে পারেন আপনি। পরে সময় হলে বেচে দিন সেই গ্রহটা, ঠিক যেমন শেয়ার কেনার পর সময় হলে আপনি বেচে দেন আপনার শেয়ার।
ভাবছেন এসব সত্যি কিনা? মনে হচ্ছে যেন ক্রিপ্টো রূপকথা! ক্রিপ্টো দুনিয়া সত্যই এক রূপকথার দুনিয়া। ক্রিপ্টো রূপকথার এমনি আরও চমকপ্রদ কাহিনী থাকছে আগামী পর্বেও।

(ক্রমশ)

Facebook Comments

Leave a Reply