অস্তিত্ব এবং অন্যান্য খুঁটিনাটি অথবা নোটস যা জনরাবিহীন – তদোগেন গিরতে

নীল

ওডিসিতে হোমার লেখেন সমুদ্রের রঙ– সুরা-লাল। আজ এ মোটামুটি প্রমাণিত যে নীল রং-কে নীল বলে চিনতে পারার ক্ষমতা মানুষ খুব বেশিদিন আয়ত্ত করেনি। গ্রীক শব্দ কুয়ানোস (যা অধুনা সায়ান বা তুঁতে-কে বোঝায়) ক্বচিৎ ওডিসিতে দেখা যায় বটে, তবে হোমারের সময়ে তার অর্থ ছিল গাঢ়—যথা জিউসের ভ্রু-যুগল। আজও কিছু জনজাতি নীল বা নীলের সমার্থক কোনো শব্দের হদিশ রাখে না—তারা আকাশের আর গাছেদের রঙে ফারাক বোঝে না। নীল রঙ মিশরের আবিষ্কার, পিগমেন্ট আর নীলের ধারণা অন্তত—তা বলে নীলনদের সংগে গুলিয়ে ফেলবেন না প্লিজ। প্রাচীন মিশরে নীল শব্দটির অর্থ ছিল নদী, স্রেফ নদী। মিশরীয়রা লাপিস লাজুলি আমদানি করত, আফগানিস্তান থেকে—বহু প্রচেষ্টা চালায় এই পাথর থেকে রঞ্জক বানানোর, পারে না, তাদের রঞ্জক যা ইজিপশিয়ান ব্লু—তার মূল উপাদান ছিল তামা, চুনাপাথর, ও বালি। লাপিস লাজুলি থেকে যে নীল, আলট্রামেরিন, তা বর্তমান আফগানিস্তানের কোনো বৌদ্ধ মনাস্ট্রীতে প্রথম তৈরী হয় সম্ভবত ষষ্ট বা সপ্তম শতাব্দীতে। ইয়োরোপে তার আমদানি পঞ্চদশ বা ষোড়শ শতাব্দীতে। মিশরীয়রা প্রথম নীল রঞ্জক বানানোর পর, ধীরে ধীরে পৃথিবীতে নীলের ধারণা ছড়াতে শুরু করলে মানুষ নীল রঙকে আইডেন্টিফাই করতে শুরু করে। এ প্রসংগে বলে রাখা যায়, ফেরোসায়ানাইড-ভিত্তিক প্রুশিয়ান ব্লু-র একটি উপাদান ছিল রক্ত। বার্লিন শহরে ডিয়েসবাখ নামের এক পেশাদার কচিনীয়াল (Cochineal) বীটল থেকে লাল রঙ বানাতে গিয়ে রক্ত-কলুষিত পটাশ মিশিয়ে ফেলে—অ্যাকসিডেন্টাল।

রঙ থেকে মস্তিষ্কে আসা যাক, যা ধারণার সৃষ্টক ও ধারক। বহু পুরাকাহিনী, মিথ বলে—নাম এক শক্তি। নাম অস্তিত্বের বাহক। নাম ছাড়া কেইবা অস্তিত্বশীল? ধরে নেয়া যাক (ইমেজ ছাড়া কি মানুষ কল্পনায় সক্ষম?) আমাদের সর্বকর্মক্ষম মস্তিষ্কের কথা, তার ফ্রেইলটি—সে ততক্ষণ একটা প্রাথমিক রঙকে ধরতেই পারল না, অনুভব ও ব্যক্ত করতে পারল না, যতক্ষণ না তার একটা নাম দেয়া হল, তাকে কৃত্তিম ভাবে তৈরী করা হল, বস্তুর ওপর চাপিয়ে দেয়ার একটা ব্যবস্থা হল।
এবার অন্ধকারের কথা ভাব, সেই আদিঅন্তহীন প্রাইমর্ডিয়াল অস্তিত্ব যাকে আমরা স্রেফ আলোর অভাব বলে ধরে থাকি। স্বাধীনতার কথা ভাব, যাকে আমরা বন্ডেজের অভাব বলে ধরে থাকি। আমরা যা দেখতে পাই না, তাকে ইমাজিন করি কী-ভাবে? শূন্যতাকে ইমাজিন করতে আমরা পাত্রের কথা ভাবি, আধার, কোনো আকারের কথা, তাকে খালি করি, বা কুরে, গড়িয়ে তার ভেতরকে ফাঁপা করে তুলি—এ’কথা না জেনেই যে ওই শূন্যতাই আসলে সমস্ত, আর আমরা যারা অবসাদে নিজের ভেতর শূন্যতার কথা ভেবে ডুকরে উঠছি—সবাই আসলে এক আগাপাশতলা শূন্যতার ভেতর ভাসমান ধুলোকণা, ডাস্টডেভিল মাত্র।
যে জীবন ফড়িং-এর, দোয়েলের নয়, যে জীবন তোমাকে ছাড়া, তার কথা ভাবতে গিয়ে দেখি আমার প্রত্যেকটি চিপায় কোণায় ফাঁক ফোকরে তোমার হাতের ছাপ; অথচ একদম অন্তর থেকে বলতে বললে আমি জানি, তুমি এক ট্যাপেস্ট্রি যার ওপর আমি এক বুনে তোলা ছবি, আমি তদোগেন সেই শোকমুখো ক্লাউন, যার নাকের বলটির রঙ নীল।

ঘুমাও সুরঙ্গমা

ঘুমিয়ে পোড়ো না, অজানা নাম্বার থেকে ফোন আসবে– ভাইয়ের অ্যাক্সিডেন্ট, কাম সুন। এগনি কলামে মাসিমণি ডুকরে উঠবে–ফিরে আয় বাবা। অথচ আমার কোন ভাই নেই, মাসিমণি নেই, পালিয়ে যাইনি কোনোখানে।
সে রাত্রে দেখলাম ফ্লাডলাইট। বাস্কেট বল কোর্টে বাবা আর মা, কালো টি, হাফ প্যান্ট। মা শাড়ি ছাড়া কিছুই পরেনি, হাসপাতালেও, সুতি, নরম। মা’কে বলি, বাহ, দিব্যি লাগছে, ওয়ার্কিং আউট? সায়াটিকা? বাবা তো আমার যখন ১৪ বছর তখনই গিয়েছে, নিজহাতে মুখাগ্নি উদ্ধারণপুরে। বলি, ব্যাপার কি? এতদিন পরে? কোথায় গেছিলে? –ভালোবাসা, বুঝলি তো বাবু, প্রেমে পড়ে গেলাম আর রাঙা এক পথ, হাজারিবাগের শালবন চিরে কোথায় যে নিয়ে গেল!
ঘুমিয়ে পোড়ো না, কোথায় যে কে আত্মীয় হয়ে রক্তের ভেতরে বসে থাকে, পালাতে দেয় না।

ঘুমিয়ে পোড়ো না, তাহলেই তোমার ফিকে গোলাপি দেয়াল, গাঢ় তুঁতে নীল হয়ে যাবে। ল্যাম্পশেডে ঘিয়েরঙা চামড়া ঝুলিয়ে রাখবে কেউ। জানলা বন্ধ করে দেবে।
কতদিন মানুষ সার্শির কাচ হয়ে থাকে, একধারে ঘর, অন্যধারে আকাশ, আকাশ কি ততটাই, যা গাছেদের ফাঁকে, ঢ্যাঙা লম্বা বাড়িদের ফাঁকে–মানুষের, গাছেদের ক্ষয়-ক্ষতি হয়ে ঝুলে থাকে– সার্শি সেই ঘর যার নিজস্ব গভীরতা নেই– উইন্ড চাইম আছে, ঝড়ের রাত্রে, বেজে ওঠে, ফ্যানের বাতাসে…

ঘুমিয়ে পোড়ো না, তাহলেই ছাইগাছ আকাশে চারিয়ে দেবে মাথা, মাথার বিন্দি খুলে আকাশে পরিয়ে দেবে টিপ, আলো এসে অন্ধা করে দেবে, ফুলনে ফলন, বিহড়ে আগুন, ছাগল ঝলসে যাবে, সাধের তেঁতুল পাতা, তেঁতুল পাতার নয় ভাই, নব্বই বোন, ভরাট সংসার, বাথরুমে গুঁইসাপ, সম্বন্ধী কুমির।

সীমা কি বিশ্বাস? গোত্র কাশ্যপ? নিজেকে পেরিয়ে গেলে তবেই ফুলন—কাঁটাতার পেরিয়ে সে বসে থাকে, দেখে তেঁতুল পাতায় সম্পৃক্ত ছাগল। তেঁতুল পাতায় থাকে নয় ভাই, নব্বই বোন, ভরাট সংসার, বাথরুমে গুঁইসাপ—সম্বন্ধী চেঁচিয়ে ও্ঠে–কুমির কুমির! কুমির জলকে যায়, বেলা নামে পাটে—মাতাদেবি মুখটি খোলে না। পানপাতা মুখে বসে ফাজিল ভ্রমর, তারপর উড়ে যায়, সাইকেল-বালকের দেশে।
ঘুমিয়ে পোড়ো না, তাহলেই ছাইগাছ আকাশে চারিয়ে দেবে মাথা, মাথার বিন্দি খুলে আকাশে পরিয়ে দেবে টিপ, আলো এসে অন্ধা করে দেবে, ফুলনে ফলন, বিহড়ে আগুন, ছাগল ঝলসে যাবে, সাধের তেঁতুল পাতা, তেঁতুল পাতার নয় ভাই, নব্বই বোন, ভরাট সংসার, বাথরুমে গুঁইসাপ, সম্বন্ধী কুমির।

ভ্যানিলা প্লেইন

শূন্যতা তাই, যার মধ্যে ভাসমান দুটি বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে। আমি তোমার একাকীত্ব দেখি, আর একা হতে চাই। যখন হাতের কফিমগ আবছা হয়ে ওঠে, জানলায় স্ট্রীটল্যাম্প, মশালের আলো, প্রতিবেশী মহিলা (সদ্য ডিভোর্স), তার হাতে আইস্ক্রীমের বাটি, ভ্যানিলা প্লেন, দূরে কার দরজা বন্ধ হলো।
দরজা খুললে, তুমি ও মহিষ, কাদা জলে উবু হয়ে থাকো। আজকে তুমি কি আলাদা হয়ে যাবে? পৃথক–হেটেরোনর্মাটিভ, এই ন্যারেটিভ? তোমার জন্ম এক কেকের টুকরো থেকে–কেন ভোলো? লাইফ ইনশিওরেন্স পলিসি বলছে– শুভ জন্মদিন। এ’সমস্ত বারোটা বেজে এক সেকেন্ডে, হলো– তারপর অন্ধকার, সুচেতনা কার যেন দূরতর দ্বীপে শুয়ে থাকে ম্যাগটের সাথে। মাছির লাভার সুচেতনা।
ডিভোর্সি মেয়েটির আইসক্রীমের বাটি খসে পড়ে মেঝের উপরে– শূন্যতার শব্দ অমন তো নয়! শূন্যতা চ্যাট বক্সে মেসেজের পিং–লেখাটি পড়ুন।

পুতুল

লাউচারার মত নির্জনতা এসে বলে, চলো…চলে যাই গৃহস্থের কাছে। সে কথা বললে, চিড় খাওয়া কাচের বাটিতে জমে ওঠে দই, ফুল ফোটে টবের ক্যাকটাসে, বাথরুম, কিচেনে ট্যাপ থেকে খসে পড়ে ক্যালসিয়ামের স্তর, জল ফোটে অত্যল্প আঁচে।
বাঁচার জন্য এটকুই তো লাগে মানুষের। ভালোবাসা, পুতুলের জন্য থাক, জরিওয়ালা হলুদ পোষাক– তর্করত্ন ঘোর অদ্বৈতবাদী, উঠোনে নামলে, সে পুতুল পইপই হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসবে, উঁচিয়ে ধরবে তর্জনী, বাহাসে মাতবে, যেন নীলমণি লতা, সাপোর্ট ছাড়াই বাতাসে তুলেছে মাথা। ওইটুকু পুতুল, কি যে তার প্রকান্ড মত, হেসেই বাঁচি না!

Facebook Comments

Leave a Reply