সায়ন্তন চৌধুরী-র কবিতা
নয়টি কবিতা
১
বুলেভার্ডের ওপর ভাসমান ল্যাম্পগুলো জ্বলে উঠেছে,
আমি লক্ষ্য করলাম, শহরে ঢোকার সীমান্তবর্তী ব্রীজটা
পেরিয়ে এসেছি কিছুক্ষণ আগে;
এখন আর কোনো অজুহাত নেই ডাউনটাউনে না পৌঁছনোর।
এখন বিষণ্ণ সূর্যাস্ত আমার চারপাশে,
কংক্রিটের ছায়া আর আলোদের ল্যাটিসওয়ার্ক,
যা এক অতিকায় দাবার বোর্ডে স্কাইস্ক্র্যাপার সাজিয়ে রেখেছে
(অন্ততঃ সেরকমই মনে হয়েছিল এয়ারক্র্যাফটের জানলা থেকে);
যে শহরে কখনো আসিনি আমি, সেখানে জলের রঙ গাঢ় খয়েরি।
প্ল্যাটিনাম ডানা মেলে কয়েকটি মেশিনখোর টেরোড্যাকটিল
উড়ে গেল পাহাড়ের দিকে — সমুদ্রের দিকে;
দৃশ্যত এখন আমরা রাস্তার জ্যামে আটকে পড়েছি।
রেডিও ঘোষণা করছে গভীররাতে নিম্নচাপের পূর্বাভাস,
কুয়াশাময় আগামী সকাল আর কফির দম-আটকানো ঘ্রাণ —
কিছু কিছু ফটোগ্রাফ আমাকে বিব্রত করবে: স্মৃতি শুধু যেন
অর্থহীন শোকপ্রস্তাব, এবং একধরনের ব্রোকেন টেলিফোন খেলা।
(নৈঃশব্দের দিকে এক-পা)
(নৈঃশব্দের দিকে দু-পা)
২
এইসব আলমারি আর ওয়ার্ড্রোব, যেখানে তুমি
পোশাক খুলে রেখেছ, ইম্প্রেশানিষ্ট শিল্পীর মতো আয়নায়
পর্যবেক্ষণ করেছ নিজের নগ্ন শরীর: কানের তীর্যক দুল,
কন্ঠার উপকূলরেখা আর জ্যামিতিক স্তন,
এইসব দেখেছ তুমি, সিগারেট ধরানোর পরে দেয়ালে
কয়েকটি সমকামী পুরুষের ছায়া, দুঃস্বপ্নে কালো কাঁচঢাকা গাড়ী
ট্রাফিক সিগন্যালে থেমে; পাশে মোটরসাইকেল
আরোহীর হেলমেট-পরা একঝলক মুখ — রুক্ষ ও রূঢ়,
বাঁ গালে গভীর কাটা দাগ।
আমি শুধু এ শহরে তোমার জিনিসগুলো নিতে এসেছি।
৩
ঘুমের ভেতর যে দৃশ্যগুলো ফিরে ফিরে আসে: অনিয়ন্ত্রিত
এরোপ্লেন ভেঙে পড়ছে অজানা দ্রাঘিমায়, দুঃখিত মেশিন-দানব
ফ্ল্যাটবাড়ির জানলায় চোখ রেখে হার্ডকোর অ্যানাল সেক্স দেখছে,
কপ্টার থেকে প্রেমিক-প্রেমিকারা ঝাঁপ দিচ্ছে ক্যানিয়নের পাথুরে
ল্যান্ডস্কেপে এবং পতনশীল অবস্থায় তাদের প্যারাসুট খুলছে না।
জেগে উঠি — বেড়ালের আওয়াজ, সারা ঘরে, জ্বোরো গলায়
ডাকতে ডাকতে অজস্র বেড়াল আমাদের অতীতের ভেতর দিয়ে
হেঁটে যাচ্ছে, তাদের নরম নুলো, উলের বলের মতো শরীর
তেকোনা পার্কের কেন্দ্রে ও কোণে ঝরা পাতা নিয়ে খেলা করে;
বাথটবে খুঁজে পেলাম, ক্রিস্ট্যাল-চোখে সে তাকিয়ে রয়েছে
আমার দিকে, মাঝরাতে কোথা দিয়ে বেড়াল ঢুকল?
তুমি কি দেখেছ তাকে কোনোদিন, শহরের ফুটপাতে
হাতেপায়ে পলিথিন প্ল্যাস্টিক জড়িয়ে একমনে খেলতে?
ব্যালকনির ওদিকে সে লাফিয়ে মিলিয়ে যায় রাতের ভেতর,
ভেঙে-যাওয়া ঘুমটার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে
আমার মনে পড়ে কিছু কিছু সিনেমার ফ্রেম,
সস্তা থ্রিলার আর পাল্প ফিকশন, তৃতীয় শ্রেণীর এরোটিকা,
জাপানী কল্পবিজ্ঞান, পপকর্ন ও অস্বাচ্ছন্দ্যকর কাঠের সীট,
হাতলে ময়লার দাগ, অন্ধকার হলে ম্যারিজুয়ানার গন্ধ: চুমু খাই,
ঠোঁটের ভেতরে জিভ, স্পর্শ করে টের পাই তোমার বুকের বোঁটা
জেগে উঠেছে, আমার প্যান্টের ভেতর শক্ত লিঙ্গ —
সেদিন রাতে ৬৯ পজিশনে সেক্সের পর সিগারেট ধরিয়ে
তুমি বলেছিলে অর্গাজমের সময় একটা ভিনগ্রহী স্ট্রাকচারের
ছবি দেখতে পাও।
৪
টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে, এলিভেটরের ময়লা বোতাম ছুঁয়ে
আমি নীচে নেমে এলাম; ঠান্ডা, ডিস্টোপিয়ার শহর,
যেরকম তেজস্ক্রিয় শীতের ভেতর এই শতাব্দী নষ্ট হয়ে যাবে।
অ্যাভিনিউ ধরে কঙ্কালগুলো নীচুমুখে হেঁটে যাচ্ছে,
ফাঁকা কনস্ট্রাকশন এরিয়ায় মাটির স্তূপের মাঝখানে
একটি ক্রেন-ডাইনোসর ঝুঁকে মাপছে জলের তারল্য,
চুপচাপ বৃষ্টিতে কমলা-সাদা ট্রাফিক শঙ্কুগুলি এলোমেলো
আর সারি সারি ভেজা মেরুন মেলবক্স: মরা বাচ্চার লাশ।
মস্ত আকারের ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে জীবন পাল্টে দেওয়ার
প্রতিশ্রুতি, নির্মাণরত মেট্রোপলিসের শোরুমে
গাড়ীর মডেলগুলো স্থির, যেন কোনো সায়েন্স ফিকশন
উপন্যাসের মতো তারা এখন অনুভূতিপ্রবণ।
দূরে নিয়নের সংকেতগুলি ঝলমল করে, ভূতুড়ে
কর্পোরেট অফিসের রিভলভিং দরজা — ফিল্মের বিজ্ঞাপন;
কনভেনিয়েন্স স্টোরে ঢুকতেই সিসিটিভি ক্যামেরা চোখে পড়ল,
ফিলিপ কে ডিকের চরিত্রের মতো কর্মচারীটি
কাউন্টারের ওদিকে নিশ্চল।
খুনের ব্যাপারে আমি অনেককিছু জানি, বারকোড স্ক্যান
করতে করতে সে ফিসফিসিয়ে বলে,
কিন্তু আমি কিছুই বলব না কারণ আমার প্রাণের মায়া আছে।
৫
তোমার ল্যাম্পশেডে বিষাক্ত ফুলের কারুকার্য,
ড্রেসিং টেবিলে রাখা সাদা প্যাডে দু-একটা সমান্তরাল রেখা,
অসমাপ্ত ত্রিভুজ আর চতুর্ভুজগুলি,
বৃত্ত, বৃত্ত এবং শুধুই বৃত্ত — লক্ষ্য করি তুমি এঁকেছ অক্লান্তভাবে,
পাইয়ের মান এবং পাই সম্পর্কে কতকগুলো গাণিতিক উপপাদ্য।
অবাক হয়ে ভাবি এসব অমূলদ সংখ্যার কথা
তাহলে তুমিও চিন্তা করেছ, অথচ আমাকে জানাওনি।
৬
এসো, বেশ্যার মতো আদর করো —
আমার দিকে কিছু ডলার বিল ছুঁড়ে দিয়ে
সস্তা মোটেলের বিছানায় শুয়ে তুমি মিটিমিটি হাসছ,
জানলায় দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম দীর্ঘ উইকেন্ডের শেষে
আরভিগুলি পিছনে চাকালাগানো বোট টানতে টানতে
শহরে ফিরে যাচ্ছে। পামগাছের সারি, পরিত্যক্ত স্টিলপ্ল্যান্ট,
চিমনির ধোঁয়া, ফার্নেস: ডাইনো সূর্যাস্তের পরে
আকাশের রঙ ক্রমে খয়েরি, গোলাপি অথবা লাল, যেন
কল্পিত মরুভূমির এবড়োখেবড়ো রাস্তায় একজন
অফরোড বাইকার অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিয়ে গতি বাড়াচ্ছে।
৭
কারা এখানে বাস করে? অসংখ্য নেমপ্লেট, দেখি
কোনো লোক নেই — লালচে পাতায় ঢেকে গেছে
ছাইরঙা মসৃণ পিচ; বাড়ীগুলি পরপর —
সন্ধ্যেয় ক্রোমিয়াম আলো জ্বলে ওঠে, দু-একটা রেন্টাল কার
ফ্রন্টলাইট জ্বেলে গার্বেজ ক্যানগুলো খুঁজতে খুঁজতে
বড়ো রাস্তার ক্রসিংয়ের দিকে চলে যায়।
৮
আমি খেয়াল করলাম ব্যাকগ্রাউন্ডে কুকুরের ডাক থেমে গ্যাছে,
কোনো শব্দ নেই বিকেলের দৃশ্যমান মন্তাজের ভেতর, যেভাবে
একজন স্নাইপার তীক্ষ্ণ নজর রাখে তার লক্ষ্যবস্তুর ওপর —
শ্লথ হৃৎস্পন্দন, টান-টান স্নায়ু।
ধূসর সমুদ্র থেকে বেলাভূমি অভিমুখে ফিরে আসছে জেটস্কিগুলি;
বুনো ফুলের গন্ধ, সমুদ্রতীরে পড়ে থাকা ডেকচেয়ার,
যতদূর চোখ যায়, রেললাইন-ভর্তি গ্রানাইট;
ভেবে দ্যাখো, আমাদের কোথায় যাবার কথা ছিল
আর কোথায় এসেছি।
৯
ডিসেম্বর, আমাদের শরীরে এসে হাত রাখে, কোনো
দক্ষ সার্জেনের মতো লম্বা ও ছড়ানো আঙুলগুলি
ফরসেপ ধরার জন্যে প্রস্তুত —
চায়নাটাউনের অদ্ভুত আলোগুলো, লন্ঠনের অপর্যাপ্ত ছায়া,
হিমাঙ্কের কাছাকাছি উষ্ণতায় দুখানা মোটরসাইকেল
গাধার মতো অসাড়ে ঘুমোচ্ছে।
কাঁকড়া-সদৃশ চীনা অক্ষর, লাল পর্দা, শোকেসে
বুদ্ধের সোনালী মূর্তি, আমি হাঁটছিলাম রেস্তোরাঁগুলোর
পাশ দিয়ে, যেখানে উজ্জ্বল মানুষেরা চপস্টিকের সাহায্যে
প্লেট থেকে সুখাদ্য মুখে তুলছে।
একটা চকচকে এসইউভি
আমার কিছুটা আগে আড়াআড়ি ব্রেক কষে দাঁড়ালো
এবং তিনজন কালো মুখোশপরা লোক
একটি ছোটখাটো চেহারার মহিলাকে টেনেহিঁচড়ে
গাড়ীতে তুলল।
ডিসেম্বর, ড্রাগস্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা
এক ক্রাচ-সমেত বৃদ্ধ —
দেখি, সাইবারপাঙ্ক শহরে একজন দুঃখিত সুপারহিরো
মাথা ঝুঁকিয়ে একা একা বাড়ি ফিরছে।
Posted in: November 2020, POETRY